কাইয়ুমরেখা, কাইয়ুমরঙ, কাইয়ুমক্যানভাস । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ নভেম্বর ২০১৫, ৬:৫১ অপরাহ্ণ, | ৩৬৫৮ বার পঠিত
এখনো আঙুল থেকে অবিরাম রূপ ক্ষরে এই বাংলার,
রূপনারানের কূলে একটি মানবী
এখনো তো জল সয়,
ছলাৎ সজল হয়ে আজো এক নৌকোর গলুই
কাইয়ুমকে টেনে আনে কুয়াশায় নীলাভায় সাড়ে-তিন-বাই-সাত
শাদা ক্যানভাসে
শেখ সাহেব বাজারে।
[সৈয়দ শামসুল হক। আমার শহর। তৃতীয় বসতি, অংশ। কবিতাসংগ্রহ, বিদ্যা প্রকাশ, প্রথম মুদ্রণ। ঢাকা, ১৯৯৭]
গত শতকের এইটিজের দিকে আমরা যারা প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যায়তনের বইপত্রাদি পড়ে এই বিতিকিচ্ছিরি বয়সে এসে ঠেকেছি, স্বীকার কর্তব্য যে আমাদের চিত্রকলায় চোখে-খড়ি হয়েছে মুখ্যত হাশেম খান আর সরদার জয়েনউদ্দীনের ছবি দেখে দেখে। শ্রেণিপাঠ্যভুক্ত ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর-ফাইভের বইগুলোতে এই দুইজনের আঁকাআঁকি আমরা বাস্তবের বাপঠাকুর্দার চেয়েও অধিক সমীহ করতাম। অলঙ্করণ ছিল সবটাই, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট, পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদ পূর্ণ। ছবি দেখেই আমরা চ্যাপ্টারে লেখা কাহিনি কল্পনা করে নিতে পারতাম। কাইয়ুম চৌধুরী চিত্রাবলি দেখেছি কিঞ্চিৎ বিলম্বে, যখন পাঠশাল শেষে খবরের কাগজ আর সাময়িকপত্রাদি টুকটুকিয়ে দেখতে শিখছি। একটা সময় পর্যন্ত যেসব বই পড়তাম — আউটবই বলে নিগৃহীত ছিল যেসব বই আমাদের গার্জিয়ানদিগের কাছে — যেমন রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজ বা সেবা ও প্রজাপতি প্রকাশনীর ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ এবং ‘ওয়েস্টার্ন’ কাহিনিমালা ছাড়াও অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখ্য সচিত্র আরব্য রজনীর ঢাউস বই বা ‘কিরিটি সিরিজ’ বা আকবর হোসেন প্রমুখের উপন্যাস ইত্যাদি, সেসব জায়গায় ঠিক কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা থাকত না। কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা পেয়েছি যখন শওকত ওসমান বা সেইসময়ের আরও সকল লেখকের লেখাপত্রাদি স্বাভাবিকভাবে পেতে শুরু করেছি এবং উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করেছি। সৈয়দ হকের বেশকিছু বইপত্রে, হুমায়ূন আহমেদের শুরুর দিককার অনেক বইয়ের মলাটে, কাইয়ুম চৌধুরী দেখি। কিন্তু মূলত কাইয়ুম চৌধুরীকে পাই সাময়িকপত্রের প্রচ্ছদে, খবরকাগজের সাপ্লিমেন্ট পাতাগুলোতে, এবং বাংলাদেশে একুশে বইমেলা চলাকালীন ফি-বছর বেশুমার বইয়ের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত প্রচ্ছদসমূহে। একসময় দেখি যে কাইয়ুম চৌধুরীর স্বাক্ষরবিহীন খামখেয়ালে-দেয়া ব্রাশের টান বা কলমপেন্সিলের লাইনটাও সনাক্ত করতে পারি ঠিকঠাক।
সৈয়দ হকের কবিতাপাঠের সুবাদে এক অন্তরঙ্গ কাইয়ুম চৌধুরীকে দেখে উঠি অল্পবয়স থেকেই। হকের কবিতার একটা ব্যাপক অংশ জুড়ে রয়েছে চিত্রকলার রেফ্রেন্স। বাংলার, বাংলাদেশের উন্মেষকালীন বিশেষত, শিল্পকলার নানাবিধ মোটিফ হকের কবিতায় পেয়েছে চমৎকার জায়গা। এই কবির কবিতায় এপিক ঢঙে একটা টোন সবসময় দেখা যায়, এপিকের প্রধান অবলম্বন বীররসের ব্যবহার, এপিকের প্রলম্বিত কণ্ঠস্বর সৈয়দ হকের কবিতার বড়সড় বৈশিষ্ট্যই বলা যায়। এইটা আজ আর কারো অজানা নয় যে গত সেঞ্চুরির পঞ্চাশের দশকে এ-দেশের লেখকদের মধ্যে যে-একটা ভূখণ্ডচৈতন্য জন্ম নিয়েছিল, যার সুফল অচিরে পেয়েছি আমরা, সেই পঞ্চাশের প্রধান লেখক কয়েকজনের মধ্যে একজন সৈয়দ হক। সমান শক্তিমত্তায় এখনও সচল তিনি সেই তরুণদিনের ন্যায়। সৈয়দের কবিতায় বিচিত্র বিষয়বিভূতির মধ্যে স্রোতস্বিনী নদী, বিশেষত ব্রহ্মপুত্র-বুড়িগঙ্গা আর পুণ্ড্র অঞ্চল বলে খ্যাত বগুড়ার/রংপুরের কুড়িগ্রামপার্শ্ববর্তী তরঙ্গিনীদিগেরে, পেয়েছি ফিরে ফিরে। এর মধ্যে জল, জলযান, নৌপথ, নদীবাঁক, নৌকার গলুই, গলুইয়ের চোখ, নদীতীরবর্তী পাটল রঙের মাটি, নিসর্গশোভা, নান্দনিক নিত্যপুরাণের নানাবিধ চিহ্নাদি ইত্যাদি অনুষঙ্গে বেশুমার কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকলার উপস্থিতি উঁকি দিতে দেখেছি। ঠিক একইভাবে দেখেছি আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, কিবরিয়া প্রমুখ স্টলোয়ার্ট বাংলাদেশী পেইন্টারদের কাজের ব্যবহার সৈয়দ হকের কবিতাপটে হাজির। বলা বাহুল্য, ওই সময়কার সকল প্রধান পেইন্টাররা সৈয়দ হকের আযৌবনের বন্ধুবৃত্ত। হকের কবিতায় প্রেজেন্টেড কাইয়ুমের চিত্রপটচিহ্ন বহু জায়গা থেকে তুলে এনে দেখানো সম্ভব। এইখানে সেই সুযোগ অনুপস্থিত আপাতত। সৈয়দ হকের সাহিত্যে রাজনৈতিক নাঈভিটি আগাগোড়াই বিদ্যমান, বলা বাহুল্য, অথবা উচ্চাসীন ক্ষমতাকাঠামোর বলয়ে লেজুড়বৃত্তিজীবন যাপনের লালসা তার অক্ষরকীর্তিতেও দুর্লক্ষ নয়। এই কারণেই তিনি ইন্-ফিউচার পাঠকপাতে অবাঞ্চিত গণ্য হবেন কি না ভাবতে হয় বৈকি। কিন্তু বর্তমান নিবন্ধে সেই নিরীক্ষণ অপ্রসঙ্গ বলিয়াই বিবেচ্য এবং ফলে পরিত্যাজ্য। বলতে হবে এখানে কেবল এটুকুই যে, সৈয়দ হকের টেক্নিক্ এবং স্বরশৈলী থেকে আমরা বিস্তর শিখেছি এককালে; টেক্নিক্ দিয়াই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জয় করা যাইলে তো দুনিয়া পানির চেয়েও সহজ হয়ে যেত। অগত্যা। কাইয়ুম চৌধুরী জীবনভর মধ্যবিত্ত ন্যুব্জ জনসাধারণের দৃশ্যবস্তু ও নন্দনমর্ম নিয়া কাজ করেছেন, অন্তিম দিন পর্যন্ত এঁকে গেছেন রোজগারগত এবং ব্যক্তিক ও শৈল্পিক সততা সাধ্যমতো স্বচ্ছ রেখে। সৈয়দ হকের ন্যায় রাজার নীতির অন্ধ অনুসৃতি করে যাওয়া কাইয়ুম চৌধুরীর স্বভাবে একেবারেই ছিল না; আমরা কাইয়ুমকে একবারের জন্যও ব্রতচ্যুত হইতে দেখি নাই। কিন্তু হেথা নয়, ফের কখনো অন্য কোনোখানে, অন্য কোথাও হবে এই আলোচনা।
কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকলা স্বাধীনতা-পরবর্তী বিগত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের সর্বত্রপরিচিত ও সর্বজনগ্রাহ্য সাংস্কৃতিক একটি চিহ্ন হয়েই উঠেছিল বস্তুত। ফলে পেইন্টিঙের প্রকৃতিগতিক-ভাবসাব-বিষয়াশয় সম্পর্কে একদম উম্মি-আনপড় আমার মতন বৈষয়িক বুদ্ধিহীন বোকা পাঠকের পক্ষেও সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে কাইয়ুমের কাজের কিছু প্রবেশপথঘাট। বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত শৈল্পিক উদ্যোগ-আয়োজনগুলোতে কাইয়ুম নিজের অবদান রেখেছেন অনিবার্য ও অবধারিতভাবে তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম ছিলেন বলেই। কামরুল হাসানের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে নেতৃত্বই দিয়েছেন তিনি নিভৃতে বস্তুত প্রায় সমস্ত বড় আয়োজন-প্রয়োজনকালে। এমন কোনো দৈনিক পত্রিকা বের করা মুশকিল হবে যেখানকার মাস্টহেড-লোগো ইত্যাদি ডিজাইনের প্রাক্কালে কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পজ্ঞান কাজে লাগানো হয় নাই। কিংবা কামরুলের হাসানেরই পথে, জয়নুল আবেদিনের পথে, পরিক্রম করে যেতে দেখি আমরা কাইয়ুমকে ক্যানভাসে এবং অন্যান্য সর্বত্র।
কাইয়ুম চৌধুরীর ক্যানভাস দেখে একটা ব্যাপারই মনে হতো প্রথম প্রতিক্রিয়ায়, সেইটে এ-ই যে, ‘বেশ মিষ্টি তো ছবিটা! বাহ্! সুন্দর তো!’ এবং এইখানেই কাইয়ুমক্যানভাসের বল বলি কিংবা বিনাশ সবকিছুই। মিষ্টি বেশি হলে যা হয়, কেউ খুবই ভালোবাসেন শুদ্ধ সৌন্দর্য ও ভেজালহীন সুমিষ্ট দ্রব্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিষ্টি ও সৌন্দর্য পরিমাণে একটু কমিয়ে এস্তেমাল করলেই স্বাস্থ্যসুরক্ষা হয় বলে চিকিৎসাবেত্তারা মনে করেন। মুক্তিযুদ্ধ অনুষঙ্গ হিশেবে এসেছে প্রধানত কাইয়ুমক্যানভাসে, সেইখানেও সুন্দর আর স্বচ্ছ শারদীয় ঢং উপস্থিত, বীর বা বীভৎস রসের নেসেসারি ব্যবহারটুকুও গরহাজির। মুক্তিযুদ্ধ উপজীব্য করে এই শিল্পীর অসংখ্য কাজ রয়েছে দেখতে পাবো। ‘অগ্নিদগ্ধ গ্রাম’ শীর্ষক একটি চিত্রপ্রবাহ কাইয়ুমের এই বিষয়ক সবচেয়ে সফল কাজের নমুনা। গ্রামের নারীমুখ এসেছে কাইয়ুমের কাজে, বারেবারে এবং বিচিত্র বিভঙ্গে, সেখানেও সৌন্দর্য। সর্বত্র পরিশীলনের ছাপ এবং অত্যন্ত গোছালো ও মার্জিত রুচির শাসনে সেইসব কাজ যেন প্রশাসিত। অতিশয় রুচিবোধশাসিত হলে যা হয়, কাইয়ুমের কাজে সেই বিপদটা অনিবার্য ঘটেছে দেখব। জনরুচি উদ্বোধিত হয়েছে অবশ্য, বহুল ও ব্যাপকভাবে হয়েছে জনরুচি উদযাপিতও। প্রশংসা করাই যায় যে তিনি শুধু শিব গড়েছেন, বাঁদর গড়েন নাই। কিন্তু কলাকারিতে, কলাকারের কাছে, শিব আর বাঁদর একই বিভাগের একই ডিপার্টমেন্টের একই ফ্যাকাল্টির ইক্যুয়্যালি ইম্পোর্ট্যান্ট দুই জিনিশ বলিয়াই তো গণ্য হবার কথা। কাইয়ুমের ক্যানভাসে বেদনা নাই, নির্ঝরের স্বচ্ছতা আছে, আনন্দ আছে। প্রেম আছে, বেশুমার শান্তিকল্যাণ এবং উচ্ছল রৌদ্রের উৎসার আছে, প্যাথোস্ নাই। কিন্তু দুনিয়ায় বেদ অসম্পূর্ণ যদি-না তাতে বেদনা থাকে — এই কথাটাও তো উড়িয়ে দেবার ন্যায় ফেলনা না।
কামরুল হাসানের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরীর ড্রয়িঙের সাদৃশ্য সবসময় খুবই চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছে আমার কাছে। সাদৃশ্য তখনই চিত্তাকর্ষক যখন তাতে একটা আলাদাত্ব যুক্ত থাকে। এইটা কাইয়ুমের ছিল। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই মিল-বেমিল তার অঙ্কনে আগাগোড়াই ছিল। যেমন জীবনানন্দের সঙ্গে শক্তির বা বিনয়ের। সাদৃশ্য বরং বৈশিষ্ট্য করে তুলতে পেরেছেন তারা — কামরুলের সঙ্গে কাইয়ুম, জীবনানন্দের সঙ্গে শক্তি-বিনয়। কামরুলের ত্রিকোণা মুখাবয়ব, সুচালো ওষ্ঠ, কাইয়ুমের চৌকোণা। কামরুলের সঙ্গে আঁকাআঁকির সাদৃশ্য দিয়া কাইয়ুম চৌধুরীকে বিচার করা হচ্ছে না এখানে, সেইটা যাবেও না করা, কিন্তু প্রস্থানাঙ্কে এসে তথা মৃত্যুদৃশ্যে কামরুলের সঙ্গে কাইয়ুমের এমন সাদৃশ্য আমরা দেখব বলে প্রস্তুত ছিলাম না। কামরুল আটাশি সালে, কাইয়ুম দুইহাজারচোদ্দ সালে, মঞ্চে মানুষের সামনে কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। শিল্পীর মৃত্যু, শিল্পীর প্রস্থান, মঞ্চের ওপর মানুষমাঝারে হলে তো খুবই কুর্নিশযোগ্য। জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের মাঝেই তো থাকবার কথা শিল্পীর কবির লেখকের কর্মীর। সৈয়দ হকের মতো ক্ষমতাপ্রভুর হয়েই শিঙা বাজাবার ন্যাক্কারজনক নুন-তেল-ননি-মাখনের নতজানুতার ধিক্কৃত জীবন যেন কোনো কবি-শিল্পী-লেখককে যাপিতে না হয়।
আপেক্ষিক তো বটেই, এইভাবে বিচার করা। কিন্তু আপেক্ষিকতা ব্যাপারটা যেহেতু দুনিয়ার প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিদ্যমান, আপেক্ষিকতা ব্যাপারটাকে/ধারণাটাকে তাই লসাগু ধরিয়া নিয়া আলাপের বাইরে রাখলেই ভালো। সম্ভব হলে পদার্থবিদ্যা ছাড়া বাকি সর্বত্র কথাবার্তায় রিলেটিভিটির উল্লেখ সর্বদা বাহুল্য দোষে দুষ্ট গণ্য হোক। প্রয়াণের অব্যবহিত পরে একজন শিল্পীকে নিয়া চুলচেরা সালিশ-বিচার করা তত জরুরি নয় যতটা জরুরি এবং স্বাভাবিক সেই শিল্পীর সঙ্গে কেমন করে আমরা সংযোগ গড়েছি, বিষয়টা সাধ্যানুযায়ী স্বীকার করে রাখা; কীভাবে হেঁটেছি তার সঙ্গে আমরাও পথ, বুঝতে চেয়েছি শিল্পের পথে তার মোক্ষটুকু, এইসব কবুলতি শিল্পীকে প্রস্থানোত্তর শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পথ হতে পারে একটা। যার যার মুহূর্তের ভাবনা, আবেগানুভূতি, বলে ফেলাই উত্তম অবিলম্বে। একজন শিল্পী ও কবি ও সিনেমাকার বারেবারে নতুন করে বিবেচিত-পুনর্বিবেচিত হবেন, এইটা তো প্রত্যাশিত।
ঐতিহ্যের নবায়ন ও নিত্য উপস্থাপন কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রভাষাশৈলীর একটা তাৎপর্যপূর্ণ দিক। যদিও বিচিত্র দিগন্তে শিল্পী ছুটিয়েছেন তার তুলি, ফিরে দেখতে পাই তিনি নিঃশঙ্ক থেকেছেন যা-কিছু আবহমান তা-কিছু তুলে নিতে ক্যানভাসে; একটা এক্সিবিশনের টাইট্যল্ ছিল ‘আবহমান’, কাইয়ুমকে বুঝতে এমনকি তার প্রদর্শনীশীর্ষনামগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ। জীবদ্দশায় শেষ প্রদর্শনীর নাম ‘নকশি কাঁথার মধ্যে ভ্রমণ’, এইখানেই শিল্পীর একাধিক আত্মপ্রতিকৃতিবিচ্ছুরিত অটোবায়োগ্র্যাফি ধাঁচের ক্যানভাস চিত্রভোক্তাদের নজরে এসেছে। কাইয়ুমের ঐতিহ্যানুগত্য কলানুশীলক ও সমুজদার সকলের কাছেই শিক্ষণীয়।
চলে গেলেন কাইয়ুম চৌধুরী। কীভাবে কেমন করে কী অবস্থায় থাকবেন তিনি মহাকালে, কালোত্তীর্ণ হবেন কি না, আর্টক্রিটিক তা জানিবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু আমরা তো আছি এখনো, যতদিন আমরা বাঁচি ততদিন কাইয়ুম চৌধুরীর রঙস্মৃতি রোমন্থন করে যাব। আমাদের সন্ততিরা হয়তো কোনো অন্য রঙমিস্ত্রীর মেমোরিচিপ্স খরিদ করবে বাজার থেকে, অথবা তারা হয়তো রঙের নেসেসিটিই যাবে ভুলে, কিন্তু আমরা আমাদের গাট্টিবোঁচকা গোছায়ে পরলোকভ্রমণে বেরোবার আগেও মুখ ঝুঁকিয়ে পুরনো খবরকাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে শেষবারের মতো আফসোস করব : আহা! কাইয়ুমের অলঙ্করণগুলো বৈকুণ্ঠলোকে যেয়ে পাবো তো! কী ইলাস্ট্রেশন! কী সাবলীল রেখা আর ব্রাশের স্ট্রোক! কী স্রোতস্বিনী ইলাস্ট্রেশন! অজস্র … অজস্র …; অজস্রতার দিক থেকে কাইয়ুম সম্ভবত পূর্বজ সকলেরেই ছাড়িয়ে গেছেন। অন্তত ইলাস্ট্রেশনে, অন্তত প্রচ্ছদচিত্রণে। ক্যানভাসে কাইয়ুমের ভাবগতিক নিয়া আমরা চিরকাল তাচ্ছিল্য-তামাশা-হাসাহাসি করলেও অনস্বীকার্য যে প্রাইমারি রঙগুলো নিয়া কাইয়ুম খুব সুন্দর ডিল্ করতে পেরেছেন আগাগোড়া, আমার কাছে এইটা বরাবর খুবই শিক্ষণীয় মনে হয়েছে। সবুজ আর লালগুলো, প্রভূত সফেদ শাদাও, উনি কী দৃষ্টিনন্দন কোমল ও নরম করে তুলতে পারতেন! তবে যেহেতু ক্যানভাসে তিনি বিষয়নির্ভর থাকতেন, ক্যানভাসগুলো পুনরাবৃত্তিপৃথুল হতো সবসময়, খুব কমন্ কিছু মোটিফ ঘুরেফিরে এসেছে। এইগুলোই সিগ্নেচার তার, অবশ্য, অঙ্কনশৈল্পিক শক্তিমত্তার দিক থেকে একটু দুর্বল অথবা সবল সেইটা আলাদা সালিশ। অ্যানিওয়ে। আমাদের জীবনস্মৃতির অ্যালব্যাট্রোসগুলোর সঙ্গে এই আরেকটা ঝুলে গেল গলায় সেদিন ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর কাইয়ুম তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে। এই অ্যালব্যাট্রোস নিয়া আমরা বারেবারে কথা বলে যাব তো নিশ্চয়।
শিল্পী পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে। আয়ুর অঙ্কে মোটামুটি দীর্ঘ জীবনই পেয়েছেন বলা যায়। এবং একটি দিনও অলস বিলাসী হাওয়ায় ভেসে কাটান নাই, এই কথাটা আমরা মাথা নুইয়ে কবুল করব কাইয়ুমের কাজের বহরের দিকে একবার চকিতে তাকিয়ে। এত প্রচুর আর প্রাচুর্যঋদ্ধ ও প্রাণমর্মবন্ত কাজের বহর কম শিল্পীর ক্যারিয়ারেই দেখা যাবে। এঁকেছেন অলমোস্ট সব মাধ্যমেই। তেল-জল তো বটেই, অ্যাক্রিলিকে, গোয়াশে, এমনকি ছাপচিত্রেও। সবখানেই ছিলেন নিজের একটা ফোক্যাল্ সার্চ নিয়া হাজির। সর্বত্রই সিগ্নেচার চিনিয়েছেন কয়েক আঁচড়েই।
এত সুর আর এত রঙ, কোনোদিন ফুরাবার তো নয়। কাইয়ুম কম্যার্শিয়্যাল্ আর্টের জায়গায় এই বাংলায় যা করেছেন, তা নিয়া আমরা ভাবতে বাধ্য, ফিরে ফিরে দেখতে বাধ্য। হি ওয়াজ্ দি লাস্ট এম্পিরর অফ বাংলা লেটারিং। বাপ রে বাপ! এমন সুরেলা লাইনে বাংলা হস্তাক্ষর, দুঃখিনী বর্ণমালার এমন নকশা আর শানদার প্রেজেন্টেশন, এমনই পিক্টোরিয়্যাল্ প্রেজেন্টেশন অফ বেঙ্গলি ক্যালিগ্র্যাফি, এই জিনিশ আর ফিরবে না এইটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই পরিচয়টা কাইয়ুম এত প্রভূতভাবে রেখেছেন যে একবাক্যেই তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে একটাবারও দ্বৈধ হয় না। আর ক্যানভাসের বাইরেকার কাজে কাইয়ুম ক্যানভাসেরই সমান মমতায় নিষ্ঠ হয়েছেন বহুবিচিত্র পোস্টারে-প্রচারপত্রচিত্রে-অক্ষরচিত্রণে, এর তুলনা আর কোথাও নাই, এই ডিজাইন্ ও গ্র্যাফিক্ কাজে কাইয়ুমের পূর্বজদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় এবং কামরুল হাসান ছাড়া তৃতীয় তুলনা কাইয়ুম নিজে। এত প্রচুরতা আগের দুইজনের কাজে দেখা যাবে না তা-ও প্রসঙ্গত বলিয়া যাওয়া যাইতে পারে। অ্যানিওয়ে। বেরোলেন কাইয়ুম মহাকালবিহারে, তাঁর বিহার সুখের হোক। অ্যাডিয়্যু নয়, লেট্’স্ স্যে ওয়েলকাম্ টু কাইয়ুম চৌধুরী!
* * *