এ লেখা কবির সাথে কবিতার— কবিতার সাথে পাঠকের যে সম্পর্ক ও সংশ্লেষণ তৈরি করেছে তার অতরঙ্গ অনুভবের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। আমাদের অভ্যস্ত কবি ও কবিতার আলোচনার ছুরি কাঁচি তত্ত্ব তালাশের কাছ থেকে সচেতনভাবেই এই লেখাকে দূরে রাখা হয়েছে।
এ লেখা কবির সাথে কবিতার— কবিতার সাথে পাঠকের যে সম্পর্ক ও সংশ্লেষণ তৈরি করেছে তার অতরঙ্গ অনুভবের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। আমাদের অভ্যস্ত কবি ও কবিতার আলোচনার ছুরি কাঁচি তত্ত্ব তালাশের কাছ থেকে সচেতনভাবেই এই লেখাকে দূরে রাখা হয়েছে।
খুব সুন্দর একটি অন্ধকার রাত বিষন্নতার উদাসীনতায় স্বপ্নের গর্ভপাতের যন্ত্রণায় ভোর থেকে ভোর পর্যন্ত একটি অলৌকিক অপেক্ষা, একটি রক্তাক্ত নীরব বিছানার কণ্ঠস্বর ‘নদীর তল থেকে/ আর্তি আসে ডুবন্ত শিশুর’ সূর্যের চেয়েও প্রভাবশালী এই ডানা ঝাঁপটা দিয়ে উড়িয়ে দেয় হাতের উপর প্রত্যাহারের স্পর্শ ঘুমের নির্লিপ্ত গন্ধ ‘সন্ন্যাস ভেঙ্গে’ অর্ধেক ছায়ার ভাষায় বহমান লিখে চলে করতলের কুয়াশা বৃত্তান্ত। স্বাধীনতার জন্য যে আর্তি গোপন করে রাখি আজ এই শিউরে ওঠা সময়ের ঘুমন্ত মর্মের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘দেহতরঙ্গ… মানুষ…’,‘ঝরাচ্ছি বীজ ঝরিয়ে চলেছি।’ একদিন ঠিক পৌঁছে যাবো ডানা।
.
‘ …শেষ রাতে গোপন হোমের/ যজ্ঞ কেউ শুরু করে দেবে।.
.
রাতের কঙ্কাল ভাসে ‘দেয়ালঘেরা’পুকুরের জোনাকি আলোয়। অনন্ত রহস্য ঋতুর হয় না শেষ। শীতের কুয়াশা কঠিন শরীরে ঝুলে থাকে বসন্তের ছবি। বৃষ্টি বলে যাকে পৃথিবীতে ঝরে যেতে দেখেছে সকলেই তার স্মৃতির ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছে মৃত্যু; আর জাগে না! মোমের জন্মকথা নিয়ে পুরাণ, শ্লোক আর স্তব গান গাওয়া শেষ হয়ে গেলে মুক্তিদাতার ভয়ে কেঁপে উঠি; বলে উঠি ‘কী করব আমি ? কী করতে পারি ? আমি যে এখনো ক্ষুদ্র !’ ‘মোমসমুদ্রের’ গোপন সব নথি গলে চাঁদের পেট থেকে বেরিয়ে আসে ধূলিঝড়, মানসিংহের ঘোড়ায় চড়ে সময় ছুটে চলে যায় বহু সময়ের অস্ফুট সর্বনাশের কাঁটাতার পেরিয়ে ‘মোহতন্দ্রা ভেঙ্গে ধ্যানগরিমার জাল ছিঁড়ে।’এখান থেকেই যেনো কবি যজ্ঞের শুরু— জীবন ডানা মেলে গিরিচূড়ার গুহাপথ পেরিয়ে পূর্বতন আতঙ্কের রক্তমাখা হাড়ের শিকড় অভিমুখী প্রশ্নস্রোতধারায় নিজস্ব ভাষা ও বর্ণনা বরাবর সাজ্জাদ শরিফের কবিতা অভিযানের।
.
মধ্য আশিতে বাংলাদেশের কবিতার ধমনীতে বইতে শুরু করল নতুন ডানা ঝাপটানো ঝড়ো বাতাস। কবিতার দেহ মনে লাগলো নতুন পুলক। যে কয়েকজন এই দৃশ্যকল্পে এসে পূর্ববর্তী সকল পঙ্ক স্রোতকে অতিক্রম করে নতুন যাত্রার ঘোষণা করলেন, সাজ্জাদ শরিফ সেই তিন দ্রোণচার্যের একজন। ভাষার ব্যবহার এবং বিষয়ের বিচিত্রতার বিশিষ্টতায় মধ্য আশির কবিতায় যে অনিবার্য রূপ বদল ঘটল সে রূপ বদলের ক্ষেত্র তৈরি ও তার স্বতঃস্ফূর্ত শব্দশ্রমিক কবি সাজ্জাদ শরিফ তাঁর কবিতার একটা নিজস্ব জগৎ নির্মাণের জন্য ভাষাকে নিজের মতন করে গড়েপিঠে নিলেন অন্তত ব্যক্তিক অনুভূতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসা তাঁর সুলুক সন্ধানী কৌতূহলের সিঁড়িগুলোতে অন্তরঙ্গ নির্জনতায় পা ফেলে ঢুকে পড়লেন জাদুসুরাসার স্নায়ুকোষের গুমঘরে। যেখানে ‘ডান পায়ে ছুঁয়ে আসে জল:’ আর জ্বলে উঠে ‘গোপন হোমের.’ এক পুরাণ যজ্ঞ।
.
কবি প্রকৃত কী আকাঙ্ক্ষা করে? স্বাধীনতা। কী এই স্বাধীনতা? যাকে আলিঙ্গন করে নিতে পারলেই বোধের ধারালো তন্তুগুলো আরো মর্মস্পর্শী ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। কেনই বা কবির জন্য এই স্বাধীনতা যাপন অনিবার্য? সত্য ও রহস্যের ওপারে পৌঁছাতে হলে নিজেকে ঝরঝরে ডানার মতন হালকা ও অবমুক্ত করে নিতে হয় সকল কাঠামো ও শৃঙ্খলের মায়াময় সংস্পর্শ থেকে। তবেই মুক্তির প্রকৃত স্বাদ জাগে। সত্যের নিষ্ঠুর উপলব্ধির উন্মাদনার জন্ম হয়। সমাজ ও ব্যবস্থাপনা খনোই নিজের উপর হামলাকে বরদাস্ত করে না। আর কবিতার শুরু হয় এই সত্য বক্তব্যের সংবেদনশীল দ্বান্দ্বিকতায়। কবি তা অন্তরঙ্গ অনুভবের নির্যাস দিয়েই তাঁর বাক্যকে নির্মাণ করেন। আত্ম সত্যের উদ্বোধনের শৈলী দিয়েই কবিতার শরীরকে রূপময় আলোর গাণ্ডীব হিসেবে মানবিক তীর ছুঁড়েন। যাপন ও অভিজ্ঞতার প্রতি মুহূর্তের সংঘাত ও সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যে জীবন এগিয়ে যায় তার নির্মোহ পর্যবেক্ষণই তো কবি তাঁর প্রকাশ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে আন্তঃসম্পর্কের পারস্পারিক চিত্রকল্পের অভিজ্ঞানে সামনে হাজির করেন— নিজস্ব উপলব্দিজাত স্বতন্ত্র শব্দ বাক্যের নিখুঁত গাঁথুনিতে। এই নিজস্ব সুর ও স্বর এক আকাক্সিক্ষত মুহূর্ত কবির কাছে। সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিবেশ পরিবেশের সাথে কবির যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তার ক্রমাগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এসে কবি পৌঁছান অভীষ্ট লক্ষ্যের সেই স্বতন্ত্রতায়। কবি যদিও ব্যক্তিক অনুভূতির বর্ণনাই করে চলেন কিন্তু এই ব্যক্তি অনুভূতি কোনো একক ব্যক্তিক অনুভূতি আর থাকেন না সম্পূর্ণভাবে সামষ্টিক হয়ে উঠেন আর এখানেই কবির নিজস্ব স্বরের উদ্বোধন। এখান থেকে পূর্ববর্তী সকল অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার নতুন রূপান্তরের শুরু। এই রূপবদল মানসিক আর্তির গহ্বরে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুর সত্যের সংবেদন। সাজ্জাদ শরিফ তাঁর কবিতা যাপনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে নির্মম রুষ্ট সমাজ ও ব্যক্তিচেতনার সামনে এনে দাঁড় করান আমাদের যার গহীন অন্তরালেই কবিতার জন্ম। যেখানে অতীন্দ্রিয় যুক্তি কাঠামোর পুরাণের সাথে বাস্তবতার ছায়া ঘুরে ফিরে সত্যমত এক আলোর তীব্র ক্ষার সৃষ্টি করে অথচ অভিজ্ঞতার জগৎ যার স্পষ্ট স্বরূপ উপস্থিত দেখতে পায় না যেনো কোনো ইশারা যেনো কোনো রহস্যের ঠিক সমাধান মুহূর্তে উৎকণ্ঠায় নিবিষ্ট পায়চারি। এভাবেই সাজ্জাদ শরিফের ‘ডানা’এগিয়ে যায় শব্দের নতুন গড়ন বাক্যের নতুন সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত এক উপস্থাপনের অভিজ্ঞতায়। এই নব রূপ‘শিরায় শিরায় গাড় ছায়া এঁকে যায়’। দিশার রহস্য ভেদ করে আরো অনন্ত রহস্যের সত্য বরাবর।
.
কবির তৃষ্ণা কখনোই সম্পূর্ণ হয় না। অসম্পূর্ণতার দিঘল তৃষ্ণায় সম্প্রসারিত হয় কবির চেতনা। ক্রমশ পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিকেই তার প্রবল উৎসাহ। সকল ‘করাতদাঁত’ ভেঙ্গে ‘বালিস্রোতের ঝড়’উপেক্ষা করে ‘জলদানোর ভয়’কে মাড়িয়েই দুরন্ত ছুটে চলেন ‘নিজেই নিজের লাশ নিয়ে’। আত্মতুষ্টির গিরিখাদে পড়ে গেলে যে কবিতার অনিবার্য মৃত্যু ঘটে তা থেকে কবি মাত্রই সচেতন। তাই কবিই পারেন তৃপ্ততাকে তুচ্ছ করে হেঁটে যেতে অন্তহীন অতৃপ্তির রহস্য উন্মোচনের দিকে। সে জলপথে ‘হাঙরদল’, ‘ঘূর্ণিঢল’, লেলিহান লালার ক্ষার কবির পথকে রুদ্ধ করে অনুভূতির ডানা কেটে নিতে উদ্ধত হয় ‘রাতকুকুর’কিন্তু ‘স্বপড়বদেহ’যার‘দীর্ঘ দেবদারু’যে কেবল অসীমের দিকেই যাবে বলে জন্ম নিয়েছে পুনরাগমনে পুনরাগমনে শেকড়ের দৃঢ় উপগমনের কাছে ‘জন্ম নিতে চাই’ বলে ঘোষণা করেছে তার কাছে সকল দিগন্ত পার হয়ে যাওয়ার যে জ্যান্ত অভিজ্ঞানের সূর্যালোককে রুখে দাঁড়ায় এমন ‘ধর্মবনানী’ কোথায় পৃথিবীতে? কোথা নেই। ভাষা তরঙ্গের নিজস্ব ঢেউ ভেঙ্গে যার গতি এগিয়ে যায় সে মাঝি মহাবিশ্বের আয়নাকে ভেঙ্গে ভেসে যেতে পারে সমাপ্তিহীন মোমসমুদ্র অভিযানে নির্ভয়। কবি সাজ্জাদ শরিফ তাঁর ভাষা ও চেতনার গঠন করে নিয়েছেন সেই মতন যে ‘শিকারি নিজেই তুমি হয়েছ নিরুপায় শিকার’ তখন অনুভূতির অধিবিদ্যাজাত জগতের মধ্যে কবি অনর্গল কথা বলে চলেন আয়না পিপাসার। বাক্যের গঠন ও ভাষার ব্যবহারের দিক থেকে সাজ্জাদ শরিফ বাংলা ভাষায় একটি নতুন অভিজ্ঞতা। যেখানে চেতনা অঞ্চলের প্রতি মুহূর্তের যে বুদবুদ তার নির্যাস কবিতায় সংক্রমিত হয় উপলব্ধির কৌণিক ইশারায় আর দৃশ্যের সবল উপস্থিতির অনুপুঙ্খ বর্ণনাসহ ঝরঝরে স্নিগ্ধ মুগ্ধ প্রজ্ঞায়। কেঁপে কেঁপে জাগে উপবন/ তার প্রতি রোমকূপে, স্তনতলে নতুন শহর’।
.
‘কোথায় যাবি রে শেষে? কী জলধারায়?’
.
শেষ কোথায় ? শেষের শেষে যে শুরু তার শেষে কিংবা আলোর গতি বরাবর আলোহীন কোনো অবস্থান কী শেষ? মূলত শেষ এক প্রকার শুরুর জিজ্ঞাসা। ভাবনার বহুস্বর ও বৈচিত্র্যময় উপস্থিতির বাস্তবতায় ক্রমাগত সংশ্লেষণী একটি প্রক্রিয়া। শুরু বলে যাকে আমরা চিহিৃত করছি সেও এক আপাত মীমাংসিত অবস্থান পরবর্তী প্রশেড়বর সূচনা মাত্র।পূর্ববর্তী কবিতা স্রোতের বাইরে এসে শুধু ব্যক্তি বা সামষ্টিক অনুভবের বা উদ্দেশ্যের পরিকল্পিত স্বরে মধ্য আশির কবিতা শুধুমাত্র এগিয়ে যায়নি। রূপান্তরের অনিবার্য সন্ধিক্ষণে এসে তখনকার কবিতা বিষয়ের বৈচিত্রতার সাথে অনুভবের নানামাত্রিক পরাগায়ন ও সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ভাবনা কাঠামোকে বা নানা রকম ডিসকোর্সের মধ্য দিয়ে তারা নির্মাণ করেন এক নতুন অভিজ্ঞতার যার সাথে প্রকৃতই বাংলা কবিতার পূর্ব পরিচয় ছিল না। কবিতার মননের ‘মাস্তুলে আঘাত লেগে সূর্য ঝরে গিয়েছে পশ্চিমে’ সেই সূর্যকে নব প্রভাতের আলোর সাথে সম্পর্কিত করার যে শব্দযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো সে যুদ্ধের একজন সফল যোদ্ধা হিসেবে কবি সাজ্জাদ শরিফের নাম কবিতার ইতিহাসে তাঁর ভাষা ও বিষয় বৈচিত্রতার বহুমাত্রিক সুচিন্তিত পদচিহৃ সুনিশ্চিত ভাবেই থেকে যাবে তা অনায়াসেই বলে রাখা যায়।
.
এখানে এই পৃথিবীতে জীবনের করোটিতে অভিজ্ঞতার গহীন রাত এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে ওঠার অলিঙ্গন খেয়ে ফেলেছে ভোগের নিষ্ঠুর তোষণ। নদী আর অরণ্যের দিকে যে পথগুলো খোলা ছিল নক্ষত্র আর সূর্যনীল স্বপেড়বর কুয়াশায় ভেজা টলমল সে রোদের অস্তিত্বে ঢুকে পড়েছে সর্বগ্রাসী অন্ধকারের ‘কালিমা’। তনারাজ্যের যন্ত্রণাপথে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে বিপদজ্জনক সেই সব ভীতির উপাখ্যান যা শিখে নিয়ে হাজার বছর ধরে যে প্রাণ যে প্রেম যে সরলতার জীবনস্রোত বহমান ছিল সাবলীল তার গতি পথের ঈর্ষাযোগ্য উর্বর ভূমির জল হাওয়া মাটিকে রক্তাক্ত করা হয়েছে বৃত্তির উচ্চকিত পরিবেশনা ও বিপণনের স্বাভাবিক প্রাবল্যে। প্রসারিত দুই হাত ভরে যে পারস্পারিক আক্রমণের জীবন বেছে নিলাম আমরা কোনো ঘোষণা ছাড়াই গভীরতম অসুখের ‘অতিকায় দানো’ এসে সব পথ সব জ্ঞান সব প্রজ্ঞার গায়ে চুনকালি মাখিয়ে ফেলে রেখে গেল অগিড়বপরিখার পেটে’এখন কোন বীজ থেকে উদগত হবে সেই ‘দ্বীপাবালিকার’উচ্ছল দিন আর অন্ধকার খুঁড়ে বের করে আনা আলো রূপকথার। জানা নেই; তবুও কিছু আশার আকাক্সক্ষা বাঁচিয়ে রাখে সচল বীজ ভাসিয়ে দেয়‘তরঙ্গশীর্ষের জলে’ কোথাও যদি শুধু প্রাণের প্রাচুর্য জেগে উঠে, রুদ্ধ বোধের রোধন কেটে যায় আর শুরু হয়ে যায় এক আলো মর্মর মানুষ জীবন। শুধু ঠিক তখনই মনুষের ইতিহাস আবারো মানুষের নিঃকন্টক মানবিক বোধের দখলে চলে আসবে। যদিও আমরা ‘যে দ্বীপে বসত করি তার নাম ক্ষণপরিত্রাণ’। যেন আটকে গেছি কোনো এক পেন্ডুলামের অতল ‘শ্বাসরুদ্ধ মাতাল সাগরে’, চারদিকে শুধু অথৈ ঢেউয়ের আগ্রাসন। পরিত্রাণ কোথায়? কোন সে মন্ত্র? কোথায় সে কণ্ঠ ? স্বরে ও উচ্চারণে যে জাগিয়ে তুলবে ‘ গোধূলিসাঁতার’। তার কোন সন্ধানই আমাদের অন্তর্গত এখনো — যে টিমটিমে আলো বেঁচে আছে দিতে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার বিপুল সম্ভাবনায় ছেয়ে গেছে ‘মোমসমুদ্রের’ জল। আজ আর শুধু সংঘর্ষেই ‘রক্তপাত ঠেকাতে পারবে না’ কেউ।
তাহলে পরিত্রাণের যে আকাঙ্ক্ষা তার নাম কী মৃত্যু? নাকি মৃত্যুই সেই দেবদূত যার অপেক্ষায় ‘সহস্র ডানার’আদর নিয়ে বসে আছি। যেনো মৃত্যু পরবর্তী কোনো অনন্য অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য বহুকাল থেকে কী অস্থির অপেক্ষায় বসে আছে আর শুভাগমনের ফটকের দেয়ালে একপাশে লেখা আছে-‘আমাকে কী বেছে নিতে বল/ ও ডানা, ও পুনরাগমন?’ অন্যপাশে ‘অরণ্য শহর ঢেকে দিলে/ ওই কোলে ঘাড় নুইয়ে দেব’। যখন ‘জলদানবের পায়ে পায়ে/ গোপন চিতাপাহাড়’ তখন কোথায় কোনো নদী বা অরণ্যের কাছে আমাদের ফিরে আসা। কোথায় কে রয়েছে চূড়ান্ত উপসংহারের আয়োজনে? মৃত্যু আর মৃত্যুর অভারণ্যের পরিহাসে যখন মানুষের অন্তর্জগৎ ছাই তখন কোন সে বর্ম যা বাঁচিয়ে তুলবে সৃষ্টির এষ্ণা। এই ক্ষরণ ও ক্ষারের বিষাক্ত অন্ধকার থেকেই যেনো এক বিকশিত বোঝাপড়ার শুরু। দৃশ্য থেকে দৃশ্য অভিমুখী বিস্তীর্ণ কল্পনার অনুপুঙ্খ যাত্রা। কিন্তু কোন আগুনের প্রাচুর্যে জ্বলবে আলো সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রহস্য আর সজ্ঞানের ভেতর অবমুক্ত হবে ‘তপ্ত নদী উথলে ওঠে শীতল দেহ তার’। অনুভূতির সংশয়, আড়ষ্টতা অন্ধত্ব কাটিয়ে জেগে উঠবে আর্তির সৃষ্টি উন্মুখ আর্তনাদ। স্থির দৃষ্টি রেখে নিজেই নিজের অন্ধকারে ‘কাকে যে ডাকে, ডেকেই চলে’ এই অস্থিরতা এই হৃদয়ের উচাটন এই একাকীত্ব তবু ভাগ হয়ে যায় না কোথাও। অথবা প্রেম ভাগ করে নেয়নি কেউ কখনো কোনো ‘ব্যথার ভঙ্গিতে’ও। আয়নার কোলাহল আর চিরুনির গন্ধ পথে নির্বিকার কেন যে এই আত্মছল— কেউ জানে না আর জানে না বলেই ‘তরল বুকে আকাশ ঝরে পড়ে’। জলশব্দ পতনের ভঙ্গির ব্যথাতুর ধার নিয়ে নিজস্বমগড়ব রাত কেটে যায়, দিনের শুরু থেকে শেষঅব্দি ‘চুমুর গোলাপ ভেসে যায় বেদনার মৃদু স্রোতে’। রাতের দিঘল মজ্জায় বাস্তবের কাঁটাগুলি হিংস্রতায় দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। হৃৎপিণ্ডের ত্রিশূল অন্ধকারের বীভৎস মিথ্যা মোহের জগতকে বাস্তবতার স্বরূপ হিসেবে উপস্থাপন করে সত্যের ভ্রূণগুলোকে ফালি ফালি করে কেটে অজ্ঞাত ছুরির নদীর টকটকে লালে ভাসিয়ে অতল করে ফেলে ‘প্রবালের ফাঁকে নিমেষঘর’—এ। এই দমবদ্ধ অভিজ্ঞতায় জড়োসড়ো নিঃসঙ্গ কবি শব্দ দিয়ে তৈরি বাক্যের দীর্ঘ সাঁকো পেরিয়ে এগিয়ে যান অজ্ঞাত রহস্যের সেই ঈঙ্গিতের কাছে যেখানের ‘কোলাহলভরা শীতে’র গন্ধ গায়ে মেখে ‘রহস্যটিলা’র পাশে বনপরিদের দল ‘পারদমাখানো নারীদেহ’ রূপে দাঁড়িয়ে থাকে। অধিবিদ্যাজাত অনুভবের সচল বয়ানে শব্দের সংবেদের ভেতর থেকে তীব্র পিপাসার আর্তি ফেলে তুলে নিতে মর্মার্থের নিগুঢ় উপলব্ধির গুপ্ত হীরক শ্লোক। কেননা সেই সব পদাবলীর প্রতিটি অক্ষরের গুপ্ত কোঠরে লুকানো আছে পুনরাগমনের সব নকশা। অচেনা অরণ্যের অন্ধকার খুলে জীবনের সেই জলাভূমিতে পৌঁছে যাওয়ার পথনির্দেশিকা যেখানে আশ্রয় নিয়ে নিলে বোধের মুকুরে আলোফুলের পরাগায়ন হয়। সমস্ত ‘মর্মব্যথা’, ‘ক্রন্দন-আকুল দিন’,‘বেদনামর্মের’‘অবিমৃশ্যকারিতার দিন শুরু’ হয়।
এইটুকু পথ অব্দি চলতেই ‘গনগনে তীব্র ক্ষার/ দিয়েছে শরীর দগ্ধ করে’ তবু পায়ের উৎসাহ প্রসারিত হয় শুধু ঠোঁটে নিয়ে ‘এই দগ্ধদেহ কুষ্ঠদেহ নিয়ে জনে জনে/ করেছি তোমারই খোঁজ।’ কবিতার প্রতি কবির এই প্রেম এই একাকী উদগম মানুষের শাশ্বত সৃষ্টিশীলতারই সংকেত। পরিত্রাণের দিকে হেঁটে যাওয়ার বলিষ্ঠ এ পদচিহৃ কেবল কবির পক্ষে এঁকে যাওয়া সম্ভব। কোথায় কোনো বাঁশি বেজে উঠলো বা উঠলো না তা নিয়ে কবির কোনো অনুশোচনা নেই কেননা কবি তাঁর অন্তরঙ্গ বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই তাঁর চলার পথনির্দেশিকা ঘোষণা করে ফেলেছেন—
.
. ‘যদি না জবাব পাই যদি বা জবাব পাই তবে
বুক পেতে নেব সে তির, রুদ্ধ করে দেব স্রোতধারা’