ডিলান মারলেইস থমাস : ওয়েলশের মাতাল । হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ অক্টোবর ২০১৫, ৭:০৮ অপরাহ্ণ, | ২৯০৪ বার পঠিত
‘আমি কী দেখতেছি তা যদি তোমারে বলতে পারতাম… অনেক দূরে আকাশের কিনারে তিনটা মেয়ে আর একটা ছেলে মিইলা ছোট ছোট মাছ কুড়াইতেছে আর তাদের বাধা দিতেছে শত শত ঝিনুককুড়ানির দল। আমি বুঝতে পারি না মাইলের পর মাইল, মাইলের পর মাইল ছড়াইয়া থাকা কাদা আর ধূসর বালি; মাছধরা মেয়েদের নীরবতা, তাদের বড় বড় স্তনগুলা ঝইরা পড়তেছে জামার শক্ত গিঁট খুইলা; পিপার মতন; বালির ‘পরে তারা কেমন বাঁইকা যাইতেছে; আমি বুঝতে পারি না বক আর গাংচিলের অস্তমিত কান্না, উত্তর সাগরের দিকে চাইয়া যেই গরুগুলা শুইয়া আছে মাঠে আর সূর্যের আলোয় যখন আলোকিত হইয়া যায় জেলেদের উল্লাসিত পাল। কাগজে এইগুলা এত সাধারণ দেখায়! তোমার কাছে মনে হইতে পারে এইগুলা যেন কোন পাগলের অযথা চিত্কার যারে সে বলতেছে সাহিত্য! অথচ সমুদ্রটা আমার কাছে শব্দের সমুদ্র হইয়া আসে। তাইলে কেমন কইরা ছোট নৌকাটা ভাসাই চোখ না লাগা এই ক্যানভাসটায়? আসলে — এইগুলারে কোন বাস্তবিকতা দিতে পারি না আমি অথচ এইগুলা আমার মতই বাস্তব; আমার মতই জীবন্ত’! — ডিলান মারলেইস থমাস।
লাফার্নির ভাড়া করা কটেজে বইসা যখন এই কথাগুলা এক সাবেক প্রেমিকারে লিখতেছিলেন কবি ডিলান মারলেইস থমাস, ঘরে তখন তাঁর নতুন বৌ। কেইটলিন ম্যাকনামারা। কয়টা দিন পরে তাঁদের ঘরে একটা পুত্র সন্তান আসবে। যার নাম রাখা হবে ল’লিন এডোয়ার্ড। ১৯৩৯ সাল। ওয়েলশের জনপ্রিয় কবি এই ডিলান। শখের সাংবাদিক। ততদিনে প্রকাশিত হইছে প্রথম কবিতা সংকলন ‘এইটিন পোয়েমস’। লেইখা ফেলছেন ‘কাগজে সই করা হাত’। তার এক বছর পরে প্রকাশিত হইল নতুন সংকলন ‘টুয়েন্টি ফাইভ পোয়েমস’। লোকাল জনপ্রিয়তা ছাড়াইয়া তিনি তখন ইংরেজ সমালোচকদের মধ্যেও আলোচিত। নন্দিত। তারচেয়ে বেশি নিন্দিতও! অথচ তারপরও কেইটলিনের মনে আতংক। সংসার কীভাবে চলবে? আগামীকাল চুলায় আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করতে পারবে ত এই অপরিনামদর্শী মদখোর? ওয়েলশের বিখ্যাত মাতাল?
ওহ্ লাফার্নি! জন্মস্থান সোয়ান্সী নয়। তার অদূরে ফার্ণহিল নয়; যা কবিরে গাঢ় এক মোহের মধ্যে নিয়া যাইত। পনের বছর; হয়ত পনেরশত বছর ধইরা এই সময়জ্ঞানহীন শহরের মধ্যে, এই সুন্দর মাথা-গরম শহরের মধ্যে ঘুইরা বেড়াইছেন ডিলান। তারপরও এক অপরিচিত; তারপরও এক দূর অতিথি পাখি তিনি। কোন প্রেমিকা না; কোন বন্ধুও না; এই লাফার্নি-ই তার মোহাজির। দরকার হইলে যেইখানে ডিলান বড়জোর অল্প কয়জনরে ফোন দিয়া ডাইকা আনতে পারেন অথবা কয়টা বক পাখিরে তাদের ক্রিশ্চিয়ান নামে ডাকতে পারেন। লাফার্নির দূর্গ আর মিঠা পানি তারে কাতর কইরা রাখে।
ত, এইসব কথা বলতেছি। এইসব- আরো কিছু… ডিলানের কবিতায় যাবার আগে। তারপর ডিলান ইংল্যান্ড যাবেন। কাজ করবেন রেডিও বিবিসি-তে। রেডিওতে একজন ভাল আরজে হিসাবে, পাঠক হিসাবে, বক্তা হিসাবে — এইখানেও পাবেন তুমুল জনপ্রিয়তা। কবিতার পাশাপাশি আরো অনেক কাজ করবেন; উল্লেখযোগ্য হইল — নাটকের স্ক্রিপ্ট। তারপরও তার বেতন নিয়মিত হয় না। কাজের বিনিময়ে খাদ্যের মধ্যেই ডিলানরে কাটাইত হয় এক দীর্ঘ সময়। যুদ্ধ শুরু হইলে তার অভাব আরো বাইড়া যায়। তার বৌ নীল চোখের পরী কেইটলিন ম্যাকনামারারে নিয়া তারে থাকতে হইছে লন্ডনে এক কামড়ার একটা রুমে। সাথে ল’লিনের নতুন জন্ম নেয়া বোনটা। যেইখানে একটা পর্দা দিয়া রান্নাঘর আলাদা করতে হইত।
কেইটলিনের কাছে কোনদিন বিশ্বস্ত ছিলেন না ডিলান। ২২ বছর বয়সে লন্ডনের যেই বারে তাদের দেখা হয়; প্রথমবার — মদে চুর ডিলানে মত্ত হইয়া পড়েন কেইটলিন। একধরনের অস্থিরতা, ফিউডাল বিশ্বাসের মত অবধারিত এক টানে আটকা পইড়া যান কেইটলিন। নীল চোখের পরী। নিজের প্রেমিকরে ছাইড়া ডিলানের লগে শুইতে আপত্তি হয় নাই তার। ঘর বাঁধতেও দেরি করে নাই তারা। পরিণতি — একজন মাতালরে বিশ্বাস করার মূল্য দিতে হইছে তারে। আজীবন। এইভাবে — আমৃত্যু ডিলানরে চোখে চোখে রাখতে হইছে তারে। ডিলানের একের পর এক পরকীয়া, ব্যভিচার, মাতলামি, সংসারে অভাব, উদাসীনতা — সবকিছু নিয়া।
কবিতা থেইকা ডিলান বেশি পরিচিত একজন মাতাল হিসাবে। এই ডিলান মঞ্চে উঠলেন; সবাই একধরণের আতংক নিয়া তাকাইয়া আছে তারপরে কী হয় দেখতে। পিনপতন নীরবতা। হয়ত তিনি মঞ্চের মাঝখানেই চিৎ হইয়া পইড়া যাইতে পারেন। অথবা এমন কিছু আপনারে শুনাইয়া ফেলতে পারেন যেইটা আজকে সন্ধ্যায় আপনারে কেউ শুনাইবো; ভাবতেই পারেন নাই। তারে কোন উৎসাহ দেয়া লাগত না কোনদিন; তিনি নিজেই নিজেরে উৎসাহিত করতেন; বরাবর। মদ খাওয়া ছাড়া— কেইটলিন আর ডিলানের জীবনে ভিন্ন কোন গল্প ছিল না। মদ-ই ছিল তাদের ভালবাসা। পানশালা ছিল তাদের প্রার্থনা-ঘর।
সাহিত্যের ট্রাজেডি কী? এই জায়গায় আপনে এমন কোন জীবন দেখবেন না যার আগে অন্য জীবন নাই! অভিজ্ঞতা আর অভিজ্ঞান — এই দুইয়ে সাহিত্য হয়। কেন এইটা ট্রাজেডি? আপনারে এইখানেও একটা বাস্তবতারে স্বীকার করতে হইতেছে! একটা শৃংখলরে স্বীকার করতে হইতেছে। ‘হোল্ড ইওর টাং’ ‘বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে’ ‘হৃদয় আমার খেয়ার যাত্রী বৈতরণীর পার’ ‘আমি যত দূরেই যাই’ আকুতি, আক্ষেপ, অতএব, আগ্রহ — এইসব জীবনের ভিতরের ব্যপার। তোমরা বাইচা আছো; অতএব — এর বাইরে তোমাদের আর কোথাও যাবার নাই; এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর কী হইতে পারে!
৩০ এর দিকে ‘নিউ এপোক্যালিপটিক্স’ নামে ইংরেজ তরুণ কবিদের একটা সংঘে মিলতে অস্বীকার যান ডিলান। বলেন যে, এরা হইল বুদ্ধিবৃত্তিক গোবরের পাত্র যারা থিওরি ধইরা ঠাইসা থাকে। সাহিত্য করতে গিয়া কোন গ্রুপের লগে অথবা কোন থিওরাইজড আন্দোলনের লগে ডিলান কোনদিন হাত মিলান নাই। তিনি একটা বিশেষ চিন্তায় ক্যাটাগোরাইজড হইতে চাইতেন না মূলত। যদিও মনে করা হয়, আধুনিক সিম্বলিজম এবং সুররিয়ালিজমের এক ধরণের প্রভাব তার কবিতার মধ্যে ছিল কিন্তু ডিলান এইসব আলাপ উড়াইয়া দেন। ডিলানের স্বর ইংরেজি কবিতার সনাতন আয়াম্বিক ফর্মের না হইলেও মনে হইতে পারে যে এইটা আয়াম্বিক। তথাপি ডিলানের ফর্ম তার নিজের; আয়াম্বিকের কাছাকাছি। এমনকি মর্ডানিজম এবং রোমান্টিসিজমের মত ব্যপারগুলা দিয়াও ডিলানরে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। পোস্ট মর্ডানিজম যেইখানে সামাজিক অনুষঙ্গগুলা থাকে; কিন্তু ডিলানের কবিতায় আপনে এই জিনিসটারেও ক্যাটাগোরাইজড করতে পারবেন না বরং ফলে সমালোচকেরা তারে নির্মমভাবে নিপীড়ন করলেও তার কবিতায় অস্পষ্টতা অন্ধকারচ্ছন্নতার কোন জুতসই ব্যাখ্যা হাজির করতে পারেন নাই।
শব্দে, শব্দের শব্দে, লয়ে, তাদের বহুমাত্রিক অর্থে, তাদের গভীরতায়, তাদের অযৌক্তিক উল্টে ফেলা বিন্যাসে ডিলান ছিলেন পীড়িত। ইমেজের মহাজাগতিকতায়, ইমেজে লেপটানো নারী পুরুষের যৌনতায়; এর ইউনিফিকেশনে ডিলানের প্রথম জীবনের কবিতা ছিল মৌলিক কিন্তু কঠিন। ডিলান নিজে মনে করতেন — তার কবিতায় আছে অপরিণত হিংস্রতা, একগুয়ে লয়, অনর্গল দ্বিধা, অতিরিক্ত ভারি চিত্রের সমাহার যেইটা কবিতারে প্রায়-ই একটা অসংলগ্নতার মধ্যে নিয়া যায়। পরবর্তী কবিতা এবং সনেটগুলাতে ডিলান বেশ বিস্তৃত হইয়া ফিরা আসেন। এইবার আর তার কবিতায় অস্পষ্টতা তেমন নাই বরং প্রকৃতি আর মানব সমাজের সাথে একধরনের ঐক্য পাওয়া যায়। সময়ের অপ্রতিরোধ্য বিবর্বতনের ভিতর। ধীরে ধীরে তিনি কবিতার গঠন আর আঙ্গিকরে আরো বেশি শাণিত, আত্ননির্ভরশীল কইরা তোলেন যেইটা সময়হীন মহাজগতরে ছেদ করে তার দ্বান্দিক দৃষ্টি দিয়া।
ডিলান মনে করতেন মানুষের শরীরের রক্ত মাংস হাড় অস্থিমজ্জা শিরা গ্রন্থির মত কবিতাতেও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা, স্বতঃলব্ধ চিন্তা চিত্রায়িত করা যায়। আর এর জন্য তিনি শব্দের ব্যবহারের উপর ব্যপক জোর দিতেন। এমনভাবে যে মনে হইত, কবিতাটা একটা অনুষ্ঠান বা একটা ঘটমান ঘটনা। ডিলান চাইতেন, একটা কবিতা কী অর্থ বুঝায় তার থেইকা জরুরী এইটা কিভাবে তার অর্থটারে বুঝাইতেছে। একটা কবিতা কিভাবে অসম্পূর্ণ থাইকা অথবা তাৎক্ষণিক একটা বুঝাপড়া বাদ দিয়া একজন পাঠকরে তার লয় দিয়া আঘাত করে; অথবা কবিতার খুবই ক্ষুদ্র একটা বিমূর্ত ইমেজ তারে নাড়াইয়া দেয়। ফলে কবিতার শেষে তাদের ভিতরকার পরিবেশ উল্টাইয়া যায়; যদিও কবিতার বিষয়টা এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট-ই রইয়া গেছে! ফলে ডিলানরে দেখা গেল তিনি ছুটতেছেন গতানুগতিকতা আর ব্যথিত জীবন ধারণ করা এই বাস্তবতার মাঝখান দিয়া যেইখানে শব্দের ভূমিকাই মূল; বিষয় থেইকা।
আগেই বলা হইছে, ডিলানের পদানুপদিক স্টাইল ইংরেজি ভাষার গতানুগতিক ছন্দ থেইকা ভিন্ন। তার কবিতা নিজস্ব নিরিখে সারিবদ্ধ; ধারাবাহিক; মূল বক্তব্যের দিকে গেলে দেখা যায় সমস্ত জীবনের লাইগা তিনি একধরনের ইউনিফিকেশনের কথা বলতেছেন; বলতেছেন ধারাবাহিক জীবন এবং মৃত্যুর কথা; নতুন জীবনের কথা যেইটা সামগ্রিকভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মরে একটা সুতা দিয়া বাধতেছে। ডিলান এমন এক জৈবিকতাকে দেখেন যেইটা জাদুর মত সমস্ত বৈচিত্রতাকে এক কইরা নিতেছে আর তিনি কবিতার ভিতর দিয়া এই ইউনিফিকেশনরে উদযাপন করতেছেন। তিনি দেখেন নারী আর পুরুষ একসাথে বৃদ্ধিতে, ভালবাসায়, যৌনতায়, জন্মের উৎসবে, মৃত্যুতে এক বৃত্তে বাঁধা; ফলে তার সবকয়টা ইমেজ মূলত এঁদের বৈপরিত্যেরই কারণ থেইকা উদ্ভূত। বাইবেল বর্ণিত ঘটনা ডিলানরে চমকাইয়া দেয়। ডিলান স্ববিরোধী ইমেজ নির্মাণের ভিতর দিয়া পুরাণ সময়টারে ভ্রমণ কইরা আসেন।
ডিলান মহাবিশ্বের গঠনের সাথে মানুষের এনাটমির সাদৃশ্য দেখেন; দেখেন মানুষের ক্ষুদ্রতা আদতে মহাবিশ্বের সমগ্রতারই একটা ইমেজ। তার খোদা প্রকৃতির সাথে, যৌনতায়, ভালবাসায়, প্রক্রিয়ায়, জীবনীশক্তিতে এবং ডিলানে মিইশা থাকেন। কিন্তু মৃত্যু? মানুষের মৃত্যু ত হয়। এইটাই কী আদতে মানুষের সবচেয়ে বড় মানবিক পরাজয়? সিঁম দ্য ব্যুভোয়াঁ এইটারে দেখছেন কড়া এক বিদ্রোহীর মত। বলছেন মানুষের মৃত্যু হইল একটা আনজাস্টিফায়েবল ভায়োলেশন। ব্যুভোয়াঁর পক্ষে এইটা বলা কঠিন ছিল না। চিন্তা করাও কঠিন ছিল না। এই উপলব্ধি বাস্তবিক অর্থে তাঁরেই বেশি মানায়। তাঁর চিন্তা ছিল তাঁর সময় থেইকা অনেক বেশি অগ্রসর। আপনি তাঁরে বরং সাহিত্যের ভ্যানগগ বলেন? না; এইটাও তাঁরে ভালো মত মাপার জন্য কিছু না। আর এই জায়গায় ডিলানেরও একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। একটা দর্শন ছিল। ডিলানের কবিতায় মৃত্য আসে উপাসনার মত কিন্তু এইটা মৃত্যুরে দেবত্বের জায়গায় নিয়া গিয়া উপাসনা না; যেইটা আদতে একটা মানবিক পরাজয় বরং এইটা আসে এমন ভক্তি থেইকা যা মূলত সব কিছুর মধ্যে বিরাজে এবং সবকিছুরে নিয়ন্ত্রণ করে অবচেতনে।
ডিলান ওয়েলশ-জাতীয়তাবাদি ছিলেন না। এমনকি কবিতাও তিনি ওয়েলশের ভাষায় লিখেন নাই। কবিতা লিখছেন ইংরেজি ভাষায়। বরং তার জীবনী লেখক কন্সটেন্টাইন ফিৎসগিবন মনে করেন, এই ওয়েলশ জাতীয়তাবাদের প্রতি ডিলানের একরকম অনীহা-ই ছিল। আর এইটা তিনি পান তার স্কুল শিক্ষক পিতা ডেভিড জন থমাসের চিন্তা থেইকা। যদিও ডিলান নিজেরে আগে একজন মাতাল এবং পরে একজন ওয়েলশম্যান হিসাবেই পরিচয় করাইয়া দিতেন। আর তিনি ভালবাসতেন মনুষ্য-প্রজন্ম; বিশেষ কইরা মহিলাদের!
ওয়েলশ কবিতা মূলত কিছুটা অস্পষ্ট, কুয়াশাচ্ছন্ন, ভাবোচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত; চারণিক। জড়সড়, তীক্ষ্ণ। ডিলান কখনোই কবিতার এই পথে পা বাড়ান নাই। বরং তার কবিতা অনেক বেশি সঙ্গীতময়। এবং এইটাই মুলত তাঁর কবিতার সিগ্নেচার। আদতে ওয়েলশ গ্রেইট ব্রিটেনের একটা উপনিবেশই। এবং আধুনিক সময়ে এইটারে এইভাবে না দেইখা বলা যায়, ওয়েলশ গ্রেইট ব্রিটেনের একটা অঙ্গরাজ্য যেইটা স্বায়ত্বশাসিত। ওয়েলশের সাহিত্য ফলে একটা বিশাল ট্রাডিশনের মুখোমুখি হইয়া পড়ে। আবার বাজারের দিকে চিন্তা করলেও এইখানকার ছোট ছোট লেখকদের লন্ডনের দিকে চাইয়া থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। ফলে গত শতকের ৭০’র দশকে পাইপলাইন নির্মাণের রাজনৈতিক ঘটনা যতটা জাতীয়তাবাদি চিন্তা ওয়েলশের মনে তৈরি করতে সক্ষম হইছিল, সেইটা মোটেও যথেষ্ট ছিল না ওয়েলশ জাতীয়তাবাদরে আরো বেশি শাণিত কইরা সবক্ষেত্রেই ইংরেজদের একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফালাইয়া দিতে।
কিন্তু তারপরও এই জাতীয়তাবাদের শিকার হইছিলেন ডিলান। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের। ফলে তিনি থাকছেন দীর্ঘদিন ধইরা ব্রাত্য। শুধু এইটাই না। ডিলান ইংরেজ সাহিত্য সমালোচকদের দ্বারাও থাইকা যান উপেক্ষিত। এর ঐতিহাসিক কারণ নিয়া কথা বলছেন ডিলান এবং ডিলানের সাহিত্য নিয়া এক দশকের বেশি সময় ধইরা গবেষণা করা অধ্যাপক জন গুডবাই। ডিলানের উপর লেখা তাঁর নতুন বই “The Poetry of Dylan Thomas : Under The Spelling Wall” প্রকাশিত হইলে সোয়ানসি ইউনিভার্সিটির এই অধ্যাপকের সাথে কথা বলেন আরেক ক্রিটিক এন্ড্রু ডালি। সেইখানে জন গুডবাই বলেন- ‘প্রথমমত ডিলান তার মইরা যাওয়ার ২০ বছর বাদে সাংঘাতিকভাবে আলোচনায় আসেন। যারা তাঁর সাথে পরিচিত ছিল এবং তারে নিয়া কাজ করছে, তারা বুড়া হইয়া গেছে এবং রিটায়ার্ড করছে। এবং তার বেশিরভাগ কাজই খুব কঠিন এবং ৫০ মিনিটের সেমিনার খুবই কম একটা সময় আলোচনার যেমন ডাফির কবিতা বা সেক্সপিইয়রের সনেটের মত। এই কারণেই বেশির ভাগ মানুষ তার কম সংখ্যক কাজের কথাই জানে। আবার মূল ব্যপারটা হইলো- ব্রিটিশ কবিতার আধিপত্যবাদি ন্যারেটিভে তিনি মানানসই ছিলেন না’।
তিনি আরো বলেন — ‘৭০দশকের মাঝামাঝি সময়ে, তোমার মনে থাকতে পারে, ব্রিটিশ রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে ডানদের একটা প্রকট প্রভাব পড়তে থাকে। এইটা কবিতার জগতেও মারাত্নক প্রভাব ফেলে। ইংরেজ সমালোচকেরা চাইতেছিল আমেরিকা প্রভাবিত বিশ শতকের মর্ডানিজম এবং ব্রিটিশ সামন্তীয় প্রভাবকে প্রত্যাখ্যান করতে। ফলে ওডেনকে এলিওট, পাউন্ড, স্টিভেন্স এবং উইলিয়ামের সাথে প্রধান কবি হিসাবে হাইলাইট করাটা তাঁদের একটা দায় হইয়া পড়ে। ১৯৩৭ সালে ওডেন মারাও যান। ফলে এইটা তাদের জন্য সহজ ছিল। ওডেনের ভয়েস ছিল ইংরেজ; এবং ভদ্র। সে কবিতারে রাইখা যায় ৩০ থেইকা ৪০ এর দশকে। ফলে তুমি দেখবা, অডেনরে নিয়া তারা বিস্তর সংকলন কইরা রাখছে ‘দ্য ইংলিশ অডেন’ নামে এবং তারে প্রতিষ্ঠিত করা হইছে ৩০এর দশকের সবচেয়ে প্রভাবশালি কবি হিসাবে’।
আরেকটা জাতীয়তাবাদি কারণ ছিল যে আমরা একজন মহান কবিরে জন্ম দিছি। অথচ অডেন তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলা ১৯৩৪ এর পর ডিলানের সেরা সময়েই করতেছিলেন। ফলে ডিলান সহজেই ইতিহাস থেইকা উইড়া যায়। তারে ৪০এর কবি হিসাবে ডাকা হয় অথচ তার মূল কাজের তিন ভাগের ২ভাগ ১৯৩৯এর আগে করা। ওয়েলশে আবার ভিন্ন কিছু হইল। এংলো-ওয়েলশ লিটারেচার তৈরি হইলো। একটা আলাদা সাবজেক্ট হিসাবে ৬০-৭০এর দশকে। যার কেন্দ্রে অবশ্যই ডিলান থাকবে। কিন্তু ওয়েলশের ক্রিটিকরা ইংরেজ ক্রিটিকদের মতই মর্ডানিজমরে এবং ডিলানের ১ম কাজগুলারে ঠিকভাবে নিতে পারলো না এবং আরেকটা মূল কারণ হইলো ওয়েলশের বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালারা চিন্তার দিক থেইকা সোশালিজম থেইকা ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদি হইয়া উঠতে লাগলো। যেইটার সবচেয়ে গুরুতর ঝোঁক ছিল ওয়েলশ ভাষায় লেখা ঐসব সাহিত্যই তারা নিবে যেইটা জাতীয় — আত্নোপলব্ধির দিকে মানুষরে নিয়া যায়। ফলে ডিলান এমন এক বিধি বহির্ভুত কেউ হইয়া গেলেন যে তারে তারা নৌকা থেইকা ধাক্কাইয়া ফেলাইয়া দিলো না কিন্তু তারে পাশ কাইটা গেল। তোমার চাইরদিকে চাইয়া দেখ। ওয়েলশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে কয়টা একাডেমিকরে দেখ যারা ডিলান নিয়া কাজ করছে? উত্তর- শূন্যটা।
‘১৯৭০ হইল সমালোচনার যুগ। এইটা ভাল। এইটাতে ডিলানরে জানা যাইত আরো ভাল কইরা। তার ভাষা আর রেটরিকের কৌশল, স্বত্তা, লিঙ্গর উপর তার দেখা ইত্যাদি নিয়া। কিন্তু সমালোচকেরা এইখানে ব্যর্থ। যারা তারে নিয়া লেখছেন তারা আসলে জন একারম্যান, ওয়ালফোর্ড ডেভিস, রালফ মড, বারবারা হার্ডিদের মত পুরান সমালোচকদের জাবর কাটছেন। ফলে নতুনরা ডিলানরে নিতে পারে নাই’।
‘৭০এ যে ক্ষতি করা হইছে তা এখনো ঠিক হয় নাই। ২টা কারণ। আমরা তারে পছন্দ করি কিন্তু আমরা জানি না তারে মধ্য শতকের কোন জায়গায় ঠাই দিবো। আবার আমরা তার প্রশংসা করি। ২য় কারণ, আমরা তারে পছন্দ করি না। সে মদখোর ছিল। তার হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। শৃংখলাজ্ঞানহীন সেল্টিক; ইংরেজি সমালোচকেরা এইগুলা ব্যবহার কইরা তার কবিতার উপর আগে থেইকাই একটা ধোঁয়া তৈরি কইরা দিছেন। তারা বরাবর যেইটা করছে তা হইল তারে কাছ থেইকা না পড়তে চাওয়া; জানতে না চাওয়া। আর তুমি যদি ডিলানরে কাছে থেইকা না পড়, তাইলে তুমি দেখবা না তার কবিতার ভিতরকার গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক বাহাস, রস, কাঠামোর মাস্তানি আর আত্মোপলব্ধিতে ঠাসা একটা মৌলিক গড়ন! তারে নিয়া আসলে আর কোন কথা বলার নাই। সে কাউরে প্রভাবিত করে নাই। কাজেই সে বাদ। সে বড়জোর কিছু জিনিসে ভাল ছিল’।
যেই বয়সে কবিরা খুবই সম্মানিত হইয়া থাকেন বা ভাব ধরেন; হয়ত কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান অথবা সৃজনশীল শিক্ষক হইয়া দিন গুজরান করেন সেইখানে ডীলান একজন শেষ যাযাবর; জীবনের সবকিছুরে বাজি ধইরা লেখালেখি করতেছেন ভাল কিছুর; নিজের প্রতিভা নিয়া জুয়া খেলতেছেন; মৃত্যুর লগে গুটি খেলায় মত্ত থাকতেছেন এবং মরার আগে অবশ্যই শেষ বোতলটা গিইলা ফেলতে ভুলেন নাই!
এবং এইটা বলার জন্য আপনার বাড়তি কোন সাহসের দরকার হইবো না যে, ডিলান আসলে প্রাসঙ্গিক আজকের একুশ শতকেও। যখন সাহিত্যের ভিতর আর কোন ক্যাটাগরি বিশেষ নাই অথচ সবাই দাবি করতেছে — বিভিন্ন রকমের ফর্মের ভাঙ্গাভাঙ্গিতে নিমগ্ন তারা। ডিলান ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখলেও কোন না কোনভাবে; অবশ্যই নিজের ওয়েলশ জাতীয়তাবাদরে উপেক্ষা কইরা; একরকম — ওয়েলশরেই রিপ্রেজেন্ট করছে; ওয়েলশের আন্তঃআবহাওয়া নিজের কবিতায় সঙ্গীতের মত বর্ণনা কইরা; এর হাস্যকর ইতিহাসের ভিতর দিয়া। এবং বলা যাক, এইটাই ওয়েলশ জাতীয়তাবাদিদের কাছে ডিলানরে ব্রাত্য কইরা রাখছিল এতকাল! ডিলান পশ্চিমের একজন বন্য মানুষ, একজন সেল্টিক কবি যার দখলে মন্ত্রমুগ্ধ বাকসর্বস্বতা। একজন লোক-চরিত্র যে অবচেতনে ধারণ করে তার শেকড় যেইটা ইংরেজদের মধ্যে আপনে পাইবেন না তেমন একটা।
এইটা বলা আমার কাজ না, ডিলান থাকবেন কি থাকবেন না আরো কিছু দিন; কিন্তু তারে একুশ শতকেও একজন প্রধান কবি হিসাবে আপনে নির্দ্বিধায় মাইনা লইতে পারেন। বস্তুজগত এবং ভাবজগতের এক অসামান্য সামগ্রিক সচেতনতা তার কবিতার মধ্যে পাওয়া যায়। এবং একটা আকুতি আপনে টের পাইবেন টোটাল ইউনিফিকেশনের; সিঙ্গুলারিটির। ডিলানই আমাদের মনে করাইয়া দেন, ভাষা আসলে কিছু বলার জন্য না আদতে; বরং এইসবের ভিতর দিয়া ভাষা নিজেই নিজেরে প্রতিনিয়ত বলতেছে আমাদের! ইন দ্য এন্ড, ডিলান এক বন্য মাতাল কবি; এই আধুনিক বিশ্বের সাথে বেমানান এক রোমান্টিক!
[লেখকের বক্তব্যঃ এই লেখাটারে লেখকের মৌলিক লেখা হিসাবে না দেখার অনুরোধ থাকতেছে। ডিলান নিয়া যারা পড়ছেন অথবা তার কবিতার লগে যাদের পরিচয় আছে, তারা নিশ্চয়ই এই ধরণের কিছু ব্যপার সেইখানে পাইয়া থাকবেন। ডিলানের কয়টা কবিতা অনুবাদ করার পরে, তারে এবং তার কবিতারে আরো ভালভাবে জানার লাইগা আমারে একটু খোঁজ খবর নিতে হইছে। এই জায়গায় আমি উপকৃত হইছি বিশেষ কইরা ডিলান নিয়া আলোচনা করছেন বিভিন্ন সময়ে এইরকম কয়জন বিজ্ঞ আলোচকের কাছ থেইকা। এই লেখাটারে তাদের আলোচনার একটা অনুলিখন হিসাবেই ধরা যাইতে পারে। অবশ্য আমি ওই আলোচনাটাই নিছি, যেইটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হইছে। ডিলান পাঠে আমি এইরকমই কিছু ব্যপার ফিল করতে পারছি। কাজেই এই আলোচকদের ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা। এনারা হইলেন জোনাথন দ্য বারকা বাটলার, মাইকেল শাপিরো, কেভিন পাওয়েল, জেইন ক্লিনটন, কন্সটান্টাইন ফিৎসগিবন, হান্নাহ এলিস, ওয়েন শিয়ার্স, অনডাইন কোহানেমার্চ, এলান মেসি, ডোমিনিক আটন, জন গুডবাই এবং অবশ্যই নীল চোখের পরী কেইটলিন ম্যাকনামারা।]
চাঁদের বুকে ভাঁড়
গোলাপের ছল ছিঁড়ে পাপড়ি ঝরছে
যেন নৈশব্দের স্রোত যেন আমার অশ্রু
আমার সকল ব্যথা ভেসে আসছে
বিস্মৃত আকাশ আর তুষার — ফাটল থেকে
মনে হয়, কোনদিন পৃথিবীটা ছুঁয়ে দেখি
সে তখন ভেঙ্গে খন্ডখন্ড হয়ে যায়
কারো ধাক্কায় বিগড়ে যাওয়া স্বপ্ন যেন
বড় বিষণ্ণ, অ-ধরা সুন্দর।
কাগজে সই করা হাত
কাগজে সই করা হাত একটা শহর ধসিয়ে দিলো
পাঁচটা অসীম আঙ্গুল মিলে নিঃশ্বাসেও কর বসালো
দ্বীগুণ হ’লো লাশের সারি; দু’ভাগ হ’লো দেশ
পাঁচ রাজায় আনলো ডেকে এক জাহানের শেষ।
ঢালু স্কন্দ ধরে ঝুলতেছে অপার হাত
খড়িলাঠি নিয়া ঠাসা আঙ্গুলের ফাঁক
রাজহংসীর পালক দিয়া খুনের ইশতেহার লিখে
কিচ্ছু বলতে দিবে না মোদের; না আছে তার দিশে।
চুক্তিতে সই করা হাত — প্রসব করলো জ্বর
দুর্ভিক্ষ আনলো ডেকে; আনলো পঙ্গপাল
মহান সেই হাত মহান মাস্তানি যার
কেমন হিজিবিজ-হিজিবিজি ডাকনামটি তার।
আমাদের রাজা গুনতেছে মরা পাঁচ আঙ্গুলের কড়ে
পাথরের মত তোমার ও — ললাট জমাট ক্ষতের ভারে
বেহেস্তের মত করুণা — কৃপায় একটা হাতের শাসন —
বীভৎস হাতটির কোন অশ্রু নাই কাঁদতে তাহার বারণ।
মূল কবিতাঃ The hand that signed the paper
বইঃ Twenty five poems (1936)
আকুলতা থেকে
কিছুটা আসে আকুলতা থেকে
দুঃখ নয়; অনুতাপে বিদ্ধ হয়ে
ভীতির বিস্ময়ে ভাঙ্গতে গেলে তারে
বিস্মৃতি ক্রন্দন নিয়ে আমার আত্মা জেগে ওঠে।
কিছুটা আসে বিশ্বস্ত মুসাফির হয়ে
তারে শোনো — সবকিছু নিরাশার নয়; কোথাও তবে-
নিশ্চয়তা আছে; আছে বিরাম; বিস্ময় চিহ্ন
না হয় ভাল না বেসে দূরেই রেখে
শেষ পরাজয়ে তারে সত্য মনে হলে।
অবলায় হত এইসব যুদ্ধের পরে
আর কী থাকে মৃত্যুর চেয়ে মুমূর্ষু কিছু
জমায়ে ক্ষত ফালিফালি বিষাদ কেটে
তার শুধু যন্ত্রণা বওয়া
অদূরে — দাঁড়ায়ে থাকে প্রেমিকা — বোবা
নির্বেদশূন্য বিমূঢ় প্রত্যাখ্যানে; তার ছলকে ওঠা শব্দে
রঞ্জিত সৈনিক যেন ছলকে উঠছে তিক্ত লহু।
তবে ঠিক আছে এই ব্যথার উপশম?
ক্রমশ বিধ্বস্ত দেহে বাজতেছে অনুশোচনা?
তবে ঠিক আছে এহেন মিথ্যার তাঁবু; তার অস্পষ্টতা?
ফাঁপা শব্দের পিঠে উধাও হয়ে যায় যন্ত্রণা?
অবিরাম নিগ্রহের এই গল্প তোমার
তপ্ত চুল্লীর কাছে নৃত্য করাতো আমায়!
ঠিক আছে তবে — এই হাড়, রক্ত, মাংসের ছিলকা?
মোচড়ানো মগজ, এই মচকানো কোমর?
কুকুরের থালার নিচে খুঁজেছিলে শস্যের মাঠ!
দেখ — রুটি শস্যভাণ্ডার আর ফাঁসির রজ্জু নিয়ে
আমার উত্তোলিত বাহু ডাকতেছে তোমায়
ছোঁয়াচে পীড়া ছেড়ে তুমি শুধু এইদিকে আসো।
মূল কবিতাঃ Out of the sighs
বইঃ Twenty five poems
আগুন-হামলার পরের উৎসব
(১ম উৎসব )
আমরা
শোকার্ত যারা
শোক করতেছি
শ্রান্তিহীন মৃত্যুর আঁচে পোড়া সড়কের মাঝে;
একটা শিশু জন্ম নিলো
তার মালিশ —মাখা মুখ
পোড়ায়ে দিতেছে কবরের কালো-স্তন
তার মা খুড়তেছে মাটি; হাতগুলো তার আগুনের ফুলকি।
শুরু হোক
গান গেয়ে
গানের ভিতর থাকো
শুরু থেকে আবার জ্বলতেছে অন্ধকার;
শিশুটার জন্মশতকের মাঝে
তারারা ভেঙ্গে যায়
বিকানো স্বর যখন অন্ধ ঝিমায়;
আমরা — প্রায়শ্চিত্যহীন অলৌকিকের সাথে শোক করে যাই।
ক্ষ’মো
আমি ক্ষমা করি
আমি — ই তোমার মৃত্যু যেমন আমরাই অনুসারী;
এরে রেখো ভাসায়ে তুমুল প্লাবনে;
যদি ঝরে ফিনকি দিয়ে লহু
যদি ধুলার মিছিল বাজে পাখির মতন
আমার ভিতর বাড়বে শস্যদানা যেমন আমার ভিতর বাড়ে মৃত্যু তোমার।
কাঁদতেছে
তোমার মরণ
কাঁদে
ঘন আগুনের সড়ক হ’য়ে নামতেছে ভোরের শিশু
আমরা মত্ত গিলে উড়ন্ত সাগরের পুঁথি
আহ! ভালোবাসা — শেষ প্রজ্জ্বলিত ভাষা;
কালো তুষের কোমর ধরে ঝুলতেছে আগামীর ভ্রূণ।
(২য় উৎসব )
আমার পরিচিত তারা
আদম অথবা হাওয়া; সুশোভিত ধর্মের ষাঁড়
শাদা ভেড়া শাদা — মেষশাবক
অথবা মনোনীত কুমারী
লন্ডনের উঁচা মন্দিরে
শুইয়া আছে তুষারস্তুপে নিজেরে ঢেকে
মরে যেয়ে সবার আগে
টুকরা খুলির অঙ্গারে? ওগো বৌ; বৌয়ের নাগর
ওগো আদম — হাওয়া; তোমরা একত্রে
ঘুমাইতেছ
কবর — ফলকের বিষণ্ণ স্তনে
এডেনের বাগানে
ধবল কঙ্কাল যেন।
আদম — হাওয়ার কিংবদন্তি
আমার মর্মমূলে
নিমগ্ন আশেকি আমার
মাড়িয়ে শব দুগ্ধ — শিশুর
মাড়িয়ে তার মূর্তি
শব্দ-গানে-স্বরে সম্মোহিত
যে শিশু পুরোহিত; ফের যে শিশু ভৃত্য;
কে তবে জেহেলের নিশিপতন
অথবা সূর্যের মতন ফল
টুকরা খুলিটির অঙ্গারে?
পুরুষ — ব্যর্থ তুমি; নারী — ব্যর্থ তুমি
হোঁচট খেতে খেতে ডুব দিতেছ অন্ধকারে
উগ্রতার বাগিচায়
উলঙ্গ ইতরের মত
(৩য় উৎসব)
জ্বলন্ত গির্জার
শিরা আর শৃঙ্গের ভিতর
বার দিক ধাওয়া তারানের
গলিত মুখের ভিতর
সময় পোড়ানো ঘড়ির শবের ভিতর
স্যাভাথের ভস্মাধারের প’রে
অবসরে — পাক খাওয়া ডোবার প’রে
সূর্য-ঘর আগুন — বস্তির প’রে
সোনালী ফুটপাত শুয়ে থাকে মৃতের গুঞ্জনে;
ঠিক যেন অগ্নিশিখা রুটির ভিতর
জ্বলজ্বলে মদের ভিতর
সমুদ্রের ভারে
গহীন সমুদ্রের ভারে
ইতরে কাতর ব্যর্থ সমুদ্রের ভারে
বিস্ফোরিত হয়; ঝরে; চিৎকার করে
জিন্দাবাদ জিন-জিন্দাবাদ
আদিম ওঙ্কারের বিকট বিচ্ছিন্ন রাজত্বের।
মূল কবিতাঃ Ceremony after a fire raid
বইঃ Deaths and Entrances (1946)
ফার্নহিল
যখন কিশোর ছিলাম আপেল গাছের তলে বসতাম আমি
গানের মত দুলত আমার ঘর; আমি তার দুয়ারের সবুজ ঘাস
রাত ভরে জ্বলত নক্ষত্র যেন জঙ্গলের সারি সারি গাছ
সময়ের ভিতর জ্বলজ্বলে আমার সুদিন
আপেলের রাজ্যে রাজপুত্রের মতন
বৃক্ষ আর পত্রশোভিত
ছুটতাম দিনমান তারাফুল বার্লির পিছে
ধুলার মতন বাতাসের ঝড়ে নদীর কিনারে।
ছিলাম সবুজ, বেপরোয়া; শস্যাগারের নায়ক
মাঠ জুড়ে ফিরতে ফিরতে গাইতাম সুখের গীত
প্রখর রোদে যুবক সূর্যের সাথে
সময় জুড়ে আমি; সময় জুড়ে আমার খেলা
আমি সবুজ শিকারি, সোনালী রাখাল; যার শিঙ্গায়
গান গাইত বাছুরের দল
আর দূর পাহাড়ে — ধ্বনিত হত শিয়ালের ডাক; স্পষ্ট; শীতল
ধীরে ধীরে বেজে উঠত স্যাবাথের লহরি
পবিত্র স্রোতের নুড়িপাথর ধরে।
সমস্ত দিন, প্রখর রৌদ্রদীপ্ত দিন, ছিল রঙ্গিন রঙ্গিন; খড়ের মাঠ
যা ছিল আমার ঘর; তার চুল্লি থেকে বেজে উঠত সুর; বাতাসে বাতাসে
পানির মত টলটলে চোখ
ঘাসের মত সবুজ আগুন
পিচ্চি তারাদের নিচে অন্ধকার
দূরে — পেঁচাদের ডাক শুনে শুনে ঘুমিয়ে যেতাম আমি
যখন সমস্ত চাঁদ আমার কানের কাছে নিদ্রারত; আস্তাবলে ওম খুঁজে খুঁজে
নিশাচর পাখি
খড়ের গাদা মুখে কোথাও যাইত উড়ে; আর ঘোড়াদের দল
জ্বলে উঠত অন্ধকারে; অকস্মাৎ।
তারপর জেগে ওঠা; শ্বেত আগুন্তুকের মত শস্যের মাঠ
ফিরে আসে; শিশির নিয়ে; তার কাঁধে মোরগের ডাক; উচ্ছ্বসিত সে
যেমন আদম আর হাওয়া।
ফের জমে জমে উঠত আকাশ
ঘুরতে ঘুরতে বেড়ে উঠত সূর্য
যেন ফের জন্ম নিতো আরেকটা শাদামাটা দিন
ঘূর্ণনরত; যেন মন্ত্রমুগ্ধ হেঁটে যাচ্ছে উষ্ণ ঘোড়া
সবুজ আস্তাবল ছেড়ে
প্রার্থনায় নিমগ্ন অনড় শস্যক্ষেত্র ধরে।
ছিলাম ধূসর- ঘরের পাশে; খেঁকশিয়াল আর অতিথি পাখির মাঝে
নতুন মেঘেদের নিচে; কার লাগি অপেক্ষারত এক বিরান হৃদয় নিয়ে।
সূর্য কেবল উঠতেই থাকত
আমি ছুটতাম বোধশূন্য পথে
যেমন ঘর হয়ে — উঁচু খড় হয়ে — ছুটত আমার ইচ্ছাগুলো;
নীল আকাশের সওদায় কে দিতো বাধা!
সকালবেলায় — কী সুরে গান গাইত কেউ
বন্ধ করে চোখ পিছু নিতাম তার
শিশুদের আগে; সোনা দিনের ভিতর।
ছিলাম বেপরোয়া; ভেড়ার মত শাদা দিনগুলো সেই —
আমার হাতের ছায়ায় নাই হয়ে যেত চিলেকোঠার ভিড়।
চাঁদ কেবল উঠতই
ঘুম মেরে
আমি তারে শুনতাম উঁচু ক্ষেতের পাড়ে উড়তে
শস্যালয়ে — জাগিয়ে কারে পালিয়ে যেত সে।
সেইসব নাজুক ইতরতা আমার —
সময়ের সবুজ আত্মা আমি — কেমন মরে যাইতেছি আজ
কোন নিঃসঙ্গ সমুদ্রের মত — কোনদিন-আমার ভিতর গান ছিল বেঁচে।
মূল কবিতাঃ Fern Hill
বইঃ Deaths and Entrances