অপর ও সন্ধ্যানাদ । নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ অক্টোবর ২০১৫, ৫:০৪ অপরাহ্ণ, | ২৫২৪ বার পঠিত
শব্দের বানে এইখানে ডুবে যায় সন্ধ্যা। এই সন্ধ্যানাদে কোনো অজানিত টানে হাওয়াটিও কাঁপে। প্রচণ্ড শৈশবে ঘাস চুরি করে পালিয়েছিলো কেউ। সেই ঘাসের গন্ধ আমার শরীরে। সন্ধ্যার রং পাল্টে দিই ক্রমশ। পকেট থেকে বের করে জ্বালাই লোবান। ধূপগন্ধ সত্যের বিষে অমর হবো ভেবে অর্ধেক মরে যাই, অর্ধেক মরে যাই। কোথাও ছড়িয়ে থাকে কাঁটাময়। ঝিঁঝি আর প্রজাপতির সুখ আছে। সবুজ আর হরিতের ঘর খালি পড়ে আছে। ছায়াময় পাতাদের ফনা ফেনানীল। অপর, তোমার রূপ আমাকে গোপনে দেখাও। ক্ষেতের আল সব চিরে চিরে দাও। জলে জলে জলীয় হোক ভরাগ্রীষ্ম। গ্রীষ্মের শহরে আসো রজঃবতী। ছড়িয়ে থাকো রাত্রির উত্তরে। বিনম্র সন্ধ্যায় নদীপথ কেমন শূন্য হয়ে যায়! অস্থিরমতি সরল উড়ে হাওয়ার কোরাসে। তুমি এদিকে আসোনি আর একদিনও। এই সরলতা অবিনাশী কোমলের ঘর—প্রতিদিন সলাজ বসনপ্রান্তে গান বুনে চলে। ওইসব গান তোমার প্রতিবেশ হতেও পারে। কোনো সকাতর শব্দমূল যদি থাকে—ওই প্রাচীন ওঙ্কারে তোমার নাম ছিলো। চিত্রলিপি পাওয়া গেছে যে পাথরে—সে পাথর আজ আমার টলোমলো চোখ।
যে পাপ গীত এই নখপত্রালিকায়, যে ভাদর ভস্ম হয় আমার হাতে—আমি খুব ধীরে তাদেরই সঙ্গে বাড়ন্ত দুপুরের জিভে অস্থির, অনতিদূর পথের কার্নিশে চকচকে বালি হয়ে থাকি। ওরা বিড়ম্বিত পদচ্ছাপ খুঁজে ফেরে। আর আমার নখপত্রে ছায়াছবি হয়। আকাশ ধসে পড়ে হাতের আঙুলে। আঙুল শালবন অন্ধকার ছুঁয়ে অস্ফুট সুখ। কেউ দুর্বিণীত আঁখিঠার নেয় চোখে। কামনার একফোঁটা চুলে লাবণ্য ঝরে। লাবণ্যের ধামে ঝিমঝিম সন্ধ্যা। সন্ধ্যা যে নৈঃশব্দ্যকে প্রশান্ত করে—ধোঁয়া ধোঁয়া ভাঁটফুলের গন্ধে উন্মাতাল। খসে পড়া উত্তরীয় আঙুলে জড়িয়ে মিহিন সুতার কারুকাজ বুঝি। মসলিন বিলাবলে সারেঙ্গী বাজে। তার স্বরলিপি লেখা থাকে চোখের কাগজে। জানলার বাহিরে মৃত্যু ও মৃত্তিকার দাগ। কারো পদচিহ্নের আশে এই মাটি নীল, মোহ ও মোহনার ডাকে সাড়া দেয়। নদীকেশ ধীর ভাসমান পদ্মকুঁড়ি লীন। যাকিছু দীনতা নিভে যায় অচেনা গন্ধে। গন্ধের উৎস বাস্তব আছে খড়ের গাদায়। কী রঙে যে ডাকি? গীত সব পাখি। পাখিরা গীত হলে জানলার বাহিরে নৃত্য। পদ্ম কুসুমিত ভুলের আড়ত। ভাগাড়ের শব কঠিন ছাই হয়ে যায় বমন আর ভূমিকার প্রক্ষালনে। পদচিহ্ন পড়ে আছে অন্য পথে কারো গ্রহণে।
.
কখনো জোনাকিরা মাঠের দখল নিলে আমরা এইঘরে আলো জ্বালি। প্রত্যুত্তরে পুড়ে যায় ছায়াসুর। আলো আর অ›ধকারের মাঝখানে ধূসর। তাকে আমরা ছায়া নামে ডাকি। সে-ই বুঝি তুমি, অপর। জোনাকিরা কখনও ছায়ার চরে। তারা রাতভর জ্বলে। মাঠে আমাদের ছায়া ঘূর্ণিমান। মাঝখানে পথ পাড়ি দিয়ে শরীর ছেড়ে যাই। যা কিছু আলো স্থির—অস্বীকার করি তাকে। জোনাকিরা তবু অধীর প্রদীপ জ্বালে। ঘুমের একটি বিন্দু বহুদূর আলোকবর্ষের পথ পাড়ি দিয়ে আসে। আমি তাকে চোখে ধরে শুয়ে থাকি। চোখ বুজে ক্লান্তি সাজাই চোখের গাঁয়ে। গাঁয়ের নাম নদীপার। নদীপারে পৃথিবী নিঝুম। নিঝুমের চোখে শুয়ে থাকে আমার চোখের ঘুম।
একটি রেখার ভিতর দিয়ে হেঁটে গেলে ভেঙে পড়ে রেখা। নিঃশ্বাস ভেঙে পড়ে। বিস্তীর্ণ রাত রাত ঝুলে থাকে চোখের নিচে। অদূরে ঘুলঘুলিপথে আলো আসে এইসবের উত্তর। শেষগ্রাম শেষরাত্রি ধীর। কাকের পালকে সুপ্ত, যা কিছু উপাখ্যান—ধান আর গান। যখন তাদের ঈর্ষা করি—শুয়ে থাকি ঘরে। যখন খালি হয় চোখের বিবর—রেখার শরীরীবদল বৃত্ত তৈরি করে। অথবা আছে জলের নদীতে স্নান। অথবা আছে দারুণ নৌকোযান। অথবা ভুলে পৌঁছে গেলাম তটে। অথবা ভুলে রঙ ছড়ালাম পটে। বর্ষা ঘুরছে উড্ডীন ঘূর্ণিপাকে। বহুতল মেঘ তাকিয়ে থাকে। গলিপথ হারিয়ে যায়। গলিমুখে হলুদ মাধবীলতার ঝাড়। দীর্ঘ মৃত্যুচুলে তাকে খুঁজে আবার। বিড়ালচোখের রাত ডুবে আছে নাগরিক নর্দমায়। নর্দমার জল ক্রমে কালশীতে জমে আনত পাথর। খুব রাতে পুড়ে একপ্রস্থ চাঁদ আর একা বিলবোর্ড। বিলবোর্ডের দৃশ্যে ছিলো দেখা যায় শাদা, শূন্য জানলা ঘর।
ভেসে যাই রাতে পৃথিবীর সাবলিল পাপ। একটি তারার তিল খুঁড়ে আর ফিরতে পারি না ঘরে। ঘরের বনে হরিণের সবুজ অভিমান জমে দিঘি। আমি অভিমান না বুঝে গোধূলির সবিনয় হনন। এখনো বিকেলের সুতোয় আটকে থাকি। কতোদূর গতকাল ডাকে! ফিরতে পারি না। ঘুরে ঘুরে ধোঁয়া মেখে আমি বিভিন্ন নিদ। কারো চোখে ঠাঁই নেই। ধানগাছ ক্রমে পাতামন্ত্র ভুলে যায়। উত্তাল শূন্যে তাকিয়ে ভাবে মরালের কথা। মরাল কোথাও উড়ছে, উড়ছে পলাতক। ধানবন মাটিছিন্ন রোদ হয়ে যায়। হাওয়ার ভিতর তাকিয়ে দেখি বাতাসেরও মৃত্যু আছে; জোছনার ভিতর যেমন চাঁদের। এই সত্য, এই নিষ্ঠুর সুন্দর আমাকে বলেছে এইসব। অনতিদূরে কালো জলের বুকে এই সন্ধ্যা জমে পাথর হয়ে যায়। এই সন্ধ্যানাদে আমি অপরকে ডাকি আয়। শ্রবণছিন্ন অপর, সে কেবল হাসে অপস্রিয়মাণ।