ঈদসংখ্যা আত্মজৈবনিক । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ জুলাই ২০১৫, ৯:২০ পূর্বাহ্ণ, | ৩২৭৬ বার পঠিত
.
পৃথিবীব্যাপী সাহিত্যে আধুনিকতার মৃত্যুতারিখ নিয়া ডিবেইট থাকতে পারে, ডেথ অফ অথার নিয়া নানা মৌলানার নানা মত থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে ঈদসংখ্যার ডেথ-ডেইট নিয়া কারো কোনো মতদ্বৈধ নাই। প্রিয় দর্শক, যদি ইজাজত দেন, আপনাদিগের জন্য এইবার একটা ক্যুইজ। বলুন দেখি, বাংলাদেশে ঈদসংখ্যার মৃত্যুদিন কোনটি? উত্তর : বাংলাদেশে ঈদসংখ্যার মৃত্যু হয়েছে ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে। আচ্ছা, ঠিক আছে, এবার বলুন দেখি, বাংলাদেশে ঈদসংখ্যার জন্ম হয়েছিল কবে? ১৬ কোটি একসঙ্গে হাত তুলেছেন দেখতে পাচ্ছি। জ্বী, সর্বকনিষ্ঠদের মধ্য থেকে একজন আপনি বলুন। বাংলাদেশে ঈদসংখ্যার জন্মদিন ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ। উত্তর সঠিক হয়েছে। সঠিক উত্তরদাতার জন্য জোরালো করতালি ও টয়লেট্রিজ সামগ্রী। … কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত এত ঈদসংখ্যা বাজারে এবং সেগুলোতে এত গুচ্ছগাদার লেখক, অন্তত এম্বোল্ডেন হরফে লেখকনাম ছাপা হইতে দেখা যায়, এরা তাইলে কি? উত্তর : এরা কৃষ্ণের জীব, এরা কাঙাল, ঈদসংখ্যামিস্কিন। ফের প্রশ্ন : দুই-চাইরজন হইলেও তো লোকে কেনে, এদের পরিচয়? এরা বাংলাসাহিত্যদরদী। কিনছে এই আশায়, এই করে করে একদিন ক্যারিকেচার-উপন্যাসকার ভাঁড়-নিবন্ধকার কুচুটে-কবিতাকার কৃষ্ণজীবগণে ফিন্যানশিয়েলি একটু সলভ্যান্ট হয়ে উঠবে, একটু মরার আগে বেঁচে উঠতে পারবে নিজে, একটু অক্ষরের মুখপানে তাকাবার ফুরসতটুক পাবে। কিন্তু হায়! আশায় আশায় দিন যায়, গুড়ে পড়ে খাবলা-খাবলা বালি, ফের কবে একটি ঈদসংখ্যা জন্মাবে বাংলায়, আমার মেয়েটা আয়েশ করে পড়বে বিছানায় উপুত শুয়ে দুই-পা বেণীর মতন আড়াআড়ি আকাশপানে দুলিয়ে দুলিয়ে।
.
ঈদসংখ্যার সকল শুভানুধ্যায়ী পৃষ্ঠপোষকদেরে পবিত্র ঈদুল-ফিতরের শুভেচ্ছা। আর গাজায় মানুষ মরছে না মুসলমান — ২০০২ সালে গুজরাটে প্রকাশ্য দিবালোকে এক-সহস্র মুসলমান মারার স্বঘোষিত ও প্রমাণিত হোতা বজরঙ্গী ভাইজান নরেন্দ্র মোদী ইন্ডিয়ার পিএম হিশেবে সুমহান না স্বল্পমহান — ওইদিকে আইএস মানুষ মারছে না আর-কিছু মারছে, ঘোষিত আস্তিক আর ঘোষিত নাস্তিকের নৃত্যকেত্তনে কে উন্নত কার চেয়ে — এই-সমস্ত তর্কের তাপে শান দিয়া যান আপনার যাবতীয় বুদ্ধি। কিন্তু এরই ফাঁকে একটু সময় করে এই ঈদসংখ্যাটি পড়ে ফেলুন। মরুক মানুষ, অথবা মুসলমান, অথবা জৈন, অথবা রামগরুড়ের ছানা — ব্যাহত না-হয় যেন তর্ক আপনার। আপনি মরবেন না। জানবেন, আলবৎ, আপনি অমরা। আপনে এই ঈদসংখ্যা পড়তেই থাকবেন। ঈদের শেমাই খাবেন। সকলকে শুভেচ্ছা। ঈদমোবারক!
ঈদ ও ঈদসংখ্যা
ঈদসংখ্যায় ঈদের আনন্দ উদযাপন শুরু হতে হতে অবশ্য আমার জীবন শৈশব-মখমল ছেড়ে বেশ দূরে চলে এসেছে। কিন্তু তবু ঈদের সিজনে এক-রকম ব্যাপার ছিল যে, ব্রডশিট পত্রিকাগুলো সম্পূরক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করত। গুচ্ছগণ্ডায় একপাতা কবিতা আর দুইখান গল্প ও অন্যান্য ঈদকেন্দ্রিক নিবন্ধ ইত্যাদি ছাপা হতো। ওইগুলোকে সেকালে আমরা ঈদসংখ্যা বলিয়া জানিতাম। গোগ্রাসে গিলিতামও। শুধু তো পত্রিকাছাপা সাময়িকভাবে বন্ধের আগের দিনের স্পেশ্যাল সাপ্লিমেন্ট নয়, এরও আগে সপ্তাহ জুড়ে খেলার পাতা থেকে শুরু করে মহিলাঙ্গন পাতা, বিনোদনপাতা থেকে শুরু করে কচিকাঁচার আসর ইত্যাদি বিভাগীয় রুটিনপাতায় বিশেষ যেসব লেখাপত্র প্রকাশিত হতো, সব কালেক্ট করা ছিল আমাদের কালের ঈদের অঙ্গ। অবশ্য এখনকার মতো ম্যাগাজিনমত্ততা তখন ছিল না, ভাঁড়ামি নিয়া আস্ত পত্রিকা প্রকাশের নির্লজ্জ দুঃসাহস তখনও কল্পনাতীত। এখন তো প্রতিদিন ম্যাগাজিন, প্রতিদিন ভাঁড়ামো অবধিবিহীন। ঈদ এলে সেই বেগুনে বেশুমার তেল ঢালা হয় কেবল। জানি না এখনকার পাঠক সত্যিই এতটা বেগুনবিলাসী কি না। তা, হতেও পারে যে তারা বাধ্য হচ্ছে বেগুনবণিকদের কারসাজি মেনে নিতে মুখ বুঁজে। এছাড়া উপায় কী! কিন্তু সব্জি হিশেবে বেগুন খুব মুখরোচক আইটেম, আমাদের বেশিরভাগেরই ফেব্রিট। তবে লেখকেরা লেখায় সুন্দর, বেগুনক্ষেতে বেগুন। কথাটা বেগুনকিষান, বেগুনবণিক ও গুণাকর লেখকদের মনে করিয়ে দেবার কেউ অবশিষ্ট নাই আর এই দেশে। আফসোস! তবে এইসব তো বড়বেলার হাহুতাশ। ছোটবেলায় ঈদসংখ্যা নিয়া আহামরি অভাব বোধ করেছি বলে মনে পড়ে না। শারদীয় সংখ্যাগুলোই ছিল অনাভাব বিকল্প। দু-তিনটে শারদীয় সংখ্যা, ভারতীয়, বছরভর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে দিব্যি ঈদ পর্যন্ত কাটিয়ে দেয়া যাইত। সচিত্র সন্ধানী একটু কলেবর বাড়ানো সংখ্যা বার করত মনে পড়ে যদ্দুর, অথবা বিচিত্রা যেমন। অন্যদিন দিয়া সাড়ম্বরে ঈদসংখ্যা বার করার চল এই সেদিনের কাণ্ড, তদ্দিনে আমরা ডাঙ্গর হয়ে মাধ্যমিকের গণ্ডি ডিঙিয়েছি। চিত্রালীও বর্ধিত কলেবরে সেমি-ট্যাবলয়েড টাইপের পাতা বার করত, যদি স্মৃতিবিভ্রান্ত না-হই আমি। কিন্তু দৈনিকের ম্যাগাজিন সাইজের ঢাউস মাল আউট খুব সম্প্রতির ঘটনা আদতে। দেখতে দেখতে এই নিত্যবস্তু ফুলেফেঁপে একদম দৈত্যরূপ ধরিয়াছে। এইটা আজকের পাঠক সত্যি এঞ্জয় করে কি না, আমার কোনো স্টাডি নাই। কিনাকাটি দেখে তো খদ্দেরের মন নিয়া কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ করা ঝুঁকিপূর্ণ ও অবিশ্বস্ত। হোকগে যাচ্ছেতাই। ইদানীং ঈদসংখ্যায় একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। একেবারে এই বছর-দুই কি তিন থেকে সেই মাত্রা আইসাইটে এল। অনলাইন ব্লগ ও পূর্ণাঙ্গ পোর্টালগুলোর ঈদসংখ্যা আয়োজন। সত্যি বলছি, মন্দ হচ্ছে না আদৌ পয়লা-পরথমবার। মহাসমারোহে এইসব জায়গা ফালতু সমস্ত কথাসাহিত্যিক তকমাধারীদের কুরুচিকিশোরতোষ উপন্যাসবস্তুতে ছেয়ে যাবে নেক্সট ইয়ার থেকে, এইটাই আশঙ্কার। এইবার আরেকটা ত্রাসের খবর দিয়া কাহিনি খতম দেই। ঈদসংখ্যাজাগতিক ঝনঝনানিতে একদম অন্তিম সংযোজন হচ্ছে, সেল্যুকাস, ফেসবুকে ঈদসংখ্যা ছাপানো! জনৈক বকাবাজ টকেটিভ ফেবুনোটক ধুমিয়ে প্রকাশ করে চলেছেন ঈদসংখ্যা, সাবস্ক্রিপশনের তোয়াক্কা না-করে, বাজারে এই নিয়া আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে ব্রেকিংন্যুজ। নোটকের ঘনিষ্ঠ মহলে এই নিয়া ত্রাহি ত্রাহি রব, কোনো কোনো বন্ধুবান্ধব হিক্কা তুলে অক্কা পাবার সন্নিকট, তবু নোটকের তাতে ভ্রুক্ষেপ নাই। অগত্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘনিষ্ঠজনেরা তাকে, সেই বেশরম নোটকার মশাইকে, সতর্ক বয়কট করে চলেছেন লাগাতার লাইক না-মেরে। এইসব গুচ্ছগাদার ঈদসংখ্যা অবিলম্বে প্রকাশ বন্ধ অথবা সাময়িকভাবে স্থগিত হওয়া দরকার বলে মনে করছেন সারস্বত সমাজের বিদগ্ধ-বিদূষী-বিজ্ঞজন। অন্যথায় নিরপরাধ নিরীহ পাঠকবর্গের নাভিশ্বাস খুঁজে আনতে মহাশূন্যে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এমনকি আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার দ্বারস্থ হওয়া লাগতে পারে বলে তথ্যাভিজ্ঞ সূত্র থেকে জানা গিয়াছে। নাম-প্রকাশে-অনিচ্ছুক এক ঈদসংখ্যাবিশ্লেষক বলেন, প্রকৃত বেগুনচাষী কৃষির তথা সামগ্রিক সমাজের বন্ধু, কিন্তু মুৎসুদ্দীশ্রেণির ফড়িয়া বেগুনবণিক তথা ঈদসংখ্যাদালালেরা সাংস্কৃতিক সুবাতাসের জন্য ভয়ঙ্কর। পূর্বোক্ত নোটক সর্বত্র দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়াছেন। এই বিষয়ে আশু পদক্ষেপ কে নেবেন, প্রশ্নের জবাবে আমতা আমতা করা ছাড়া কারো কাছ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সমস্ত ফেবুসোসাইটি ও সমগ্র জাতি আজ গভীর সঙ্কটে নিপতিত। উদ্ধারের আশা প্রায় নাই। কিন্তু এইভাবে নিজেই নিজের ঈদসংখ্যা ছাপাছাপির ঘটনা ভবিষ্যতের আনন্দযজ্ঞে এক অশনী সংকেত, বলাবলি হচ্ছে সর্বলোকে।
.
ঈদচন্দ্র সন্দর্শন ও অন্যান্য
হপ্তা-খানেকের জন্য নির্ভার হওয়া গিয়েছে বেশ তো! ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে ঈদের, বড়-ঈদের ছুটি, ইতোমধ্যে একজোড়া বা তারও বেশি দিন খরচও হয়ে গেছে। রইল বাকি কয়, এক্ষুণি সে-ক্যাল্কুলেশন নয়। এখন এই বারোটা-উত্তীর্ণ রাত্তিরে বেহতর শান্তি লাগছে, স্বস্তি লাগছে, ফুরফুরে লাগছে। সাধারণত চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী দিনটি ঈদের দিন নাকি ঈদের পূর্বদিন। এইবার সেই হ্যাপা নাই। কারণ সৌদিয়ারবে ঈদ হয়ে গিয়েছে, অতএব পরদিন আমাদের ঈদ, এই হিসাব পুরনো। সম্প্রতি সৌদিয়ারবও ঈদগণিতের একচ্ছত্র প্রায়োর কন্ডিশন নয় আর, এখন যুক্তরাজ্য প্রভৃতি যে-কোনো ফরেন কান্ট্রিও লোকে ঈদ-ইকোয়েশন মেলানোর ক্ষেত্রে বেশ গণ্যি-গ্রাহ্যি করে দেখতে পাই। কিন্তু তবু স্বচক্ষে চাঁদ দেখার পাট উঠে গিয়েছে আমাদের জীবন থেকে। চাঁদ-দেখা কমিটি নামে ধর্ম-মন্ত্রণালয়ের যে-একটা সাম্বচ্ছরিক প্রকল্প রয়েছে, সেইটাও লোকে এখন বিশেষ আমলে নেয় বলে মনে হয় না। আমাদের ছেলেবেলায় ঈদের চাঁদ বারান্দায় এসে জানিয়ে যেত ঈদবার্তা, আমরা একটু কোণাকুনি দাঁড়িয়ে অঙ্গুলিনির্দেশে দেখাতাম একে-অন্যকে, আম্মা ঈদের চাঁদ দেখে একটা কী-যেন শ্লোক/সুরাপঙক্তি বিড়বিড়িয়ে আমাদের গালে-মুখে হাত বুলিয়ে দিতেন। একই কাজ আমার চাচিমা করতেন কাজিনদেরকে, দাদি করতেন তার আধাবুড়া ছেলেদের ক্ষেত্রে। এইসব ছিল তখন। অবাক লাগে ভাবতে যে, আমাদের মা-চাচিমা তখন তুমুল তরুণী একেকজন! মনে আছে, বেশ ক-বার আমরা ঘটা করে ছোটচাচার সঙ্গে মোটরবাইকের পাছায় চেপে কিনব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে গিয়েছিলাম। ম্যুন ওয়াচিং, ঈদম্যুন, লাইভ। তখন প্রচুর লোক চাঁদ দেখার জন্য কিনব্রিজে ভিড় জমাতো। স্বনয়নে শাওয়ালের চন্দ্র না-দেখে ঈদ হতো না তখন। তারপর যুগ পাল্টে গেল। এল টেলিভিশনের চাঁদঘোষণার দিন। ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ — শোনার সঙ্গে সঙ্গে কী-যে-এক হিপ-হিপ-হুররে হতো গভীর ভেতরে, প্রকাশ করতাম অল্পই। কিন্তু ততক্ষণে কাছের-দূরের মসজিদগুলো থেকে একযোগে-প্রায় আওয়াজ শুরু হবে : “মোবারক হো ঈদুল ফিতর! শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেছে! ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেছে! কাল ঈদ!” সেইসঙ্গে প্রচার করা হবে স্থানীয় মসজিদে ও ঈদগাহে ঈদের জামাতের সময়সূচি। কিন্তু জমানা বদলিয়া গিয়াছে হে! এখন হুজুরেরাও টেলিভিশনপন্থী! মিছিল করে টেলিভিশনের পক্ষে জনমত আদায় করেন, টেলিভিশন জিন্দাবাদ বলে প্রকম্পিত করে তোলেন তামাম সিটি কর্পোরেশন, ভোটতরণী পারাইতে হেন কিছু নাই যা হুজুরেরা করেন না। ব্র্যাকেটে বলে রাখি যে, এই টেলিভিশন মার্কা নিয়া হুজুরদের ঐতিহাসিক ডেমোন্সট্রেশন দেখতে/বুঝতে চাইলে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়োর্যাল ইলেকশনের রেফ্রেন্স মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। তো, কথা হলো, হুজুরদের এথিক্স ও মোর্যাল ভ্যাল্যুজ বড় সহি, বড় মারাত্মক! ব্যাপারটা আমাদের চাইল্ড-ডেমোক্রাসির লাগি ভীষণ খুশখব্রি নিঃসন্দেহে। কিন্তু মওকা পেলে টেলিভিশনের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করতে হুজুরদের আটকানো যায় না কোনো কথার কোনো যুক্তির বিনিময়েও। ব্যাপারটা আমাদের অ্যাডাল্ট-রিলিজিয়নের লাগি কিমুনতর নিউজ তা অবশ্য আমি বলিতে নাপারগ। তবে আমাদের তরুণদিনের ইমাম-মুয়াজ্জিন হুজুরেরা তাদের করণীয়-কর্তব্য সম্পর্কে বেশ সিন্সিয়ার ছিলেন মনে পড়ে। এইবার আমাদের পাড়ার ডজন-খানেক মসজিদের একটা থেকেও চন্দ্রদর্শন অথবা ঈদজামাতের সময়সূচি সম্প্রচারমূলক কোনো নিউজ-আইটেম ধরনের কিছু ব্রডকাস্ট করা হয়েছে বলে শ্রবণে আসে নাই। কান পেতেই ছিলাম। হুজুরেরা উত্তরোত্তরাধুনিক হয়ে উঠুন, পোলিটিক্যাল এন্টিটি হিশেবে ফ্রেইরিয়্যান কনশিয়েন্টাইজেশন খুব জোশ হউক তাহাদের, আমাদের ঈদের পূর্বরাত্রিতে ছেলেবেলা-জাগানিয়া গান ও স্মৃতিচিত্রচূর্ণের বারোটা বাজলে হুজুরদের কী আসে যায় তাতে! ঈদের চাঁদ দেখার স্থানীয় ঘোষণা আর ঈদনামাজের সময়সূচি ডিক্লেয়ার করার কাজে — মায় নামাজ পরিচালনায় — চিরকাল হুজুরদের মতি থাকতেই হবে এমন কোনো কথা তো নাই। হুজুরদের কাজকর্মের যুগোপযোগী প্যারাডাইম-শিফ্টিং তো হতেই পারে। তা-ই হোক। আমরা দেখোয়াড়, দেখে যাই নির্বিকার। দেখি যার-যা-কাজ সে-তা-না-করুক, দিকে দিকে প্যারাডাইম শিফ্টিং হোক! খোল্লামখুল্লা গায়ে-গতরে পোলিটিক্যালাইজেশন হোক সমস্ত লোকের, সবকিছুর। খোশখবর, খোশামদেদ!
.
এবারে জানিয়ে দিচ্ছি ঈদ উপলক্ষ্যে তিনদিনব্যাপী আমাদের অনুষ্ঠানমালা
ঈদ তো সাতদিন, কিন্তু তখন আমাদের দেশ উন্নয়নশীল ছিল বলে ব্যবসাবাণিজ্য কম হইত নিশ্চয় এবং পয়সায় কুলায়ে উঠতে পারত না বলে আমাদের সবেধন নীলমণি বিটিভি ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচারিত কুল্লে তিনদিন! হতাশ মুখে মেনে নিতাম ঘোষণা, আর আমরা ভাইবোনে বলাবলি করতাম যে এরপরেরবার একদিন বাড়াবেই বাড়াবে এবং সর্বসাকুল্যে ঈদের অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে দীর্ঘ চারদিনব্যাপী! কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের জল্পনাকল্পনা আর আব্দার কখনো বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তবু ওই তিনদিন, প্লাস কুরবানি-ঈদের তিন, আমাদের জন্য ছিল বছর-জুড়ানো মহার্ঘ্য অমলিন! গোগ্রাসে গিলিতাম বিটিভিবিতরিত বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
তা, আজকের মতো অত সময়সীমাবাঁধনহারা ছিল না আমাদের কালের বিনোদনব্যবসা। আমাদের সবকিছুই ছিল অল্প অল্প। অল্পের অবতার ছিলাম আমরা, ছোট ছোট খুশির ঈশ্বর, তাই বলে আমাদের উদযাপিত আনন্দোল্লাসের মাত্রা অল্পপ্রাণ ছিল না মোটেও। দুপুর বারোটায় শুরু-হওয়া বিশেষ অধিবেশন সমাপ্ত ঘোষিত হতো রাত বারো বাজতেই, এর মধ্যেই আমাদের ছেলেবেলা চেটেপুটে নিত তার প্রয়োজনীয় রস, জোগাড় করে নিত তার জ্বালানি ও পথ-রসদ। বছরভর ওই তিন-দু-গুণন ছয় ছিল আমাদের অনন্ত ফুর্তির সঞ্চয়, আমাদের গল্পসঞ্চয়িতা, আমাদের বিস্ময়নৃত্য! আজকের শিশুদের বিনোদন তো টুয়েন্টি-ফোর-আওয়ার্স, উঠতে বসতে, খেতে ও খেলতে সর্বত্র। অত নসিব নিয়া আমরা আসি নাই বটে, আবার জগতের অভাগা লাঞ্ছিতও মনে করি না নিজের ছেলেবেলাটাকে, যেটুকু জুটেছে তাতেই তো চলছে আজও, অফুরান যেন!
কী বাদ দিতাম ওই তিনদিন থেকে! একবর্ণও নয়। যেটুকু ছুটে যেত কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ফেরে, কাউকে-না-কাউকে জিগায়ে সেটুকু মেকাপ করে নিতাম, ইশকুল খোলার পর ক্লাসমেটদের পুঁছতাছ করে পেয়ে যেতাম ছুটে-যাওয়া অংশ, পুষিয়ে নিতাম। সকালবেলার অধিবেশনে পিচ্চি শিশুদের মুখে অকাব্যিক-অলিরিক্যাল ঈদগান থেকে শুরু করে সন্ধ্যার স্লটে প্রবীণদের ঈদরোমন্থন, ব্যান্ডগানের অনুষ্ঠান, ছায়াছন্দ, সিনেমানাটকের কুশীলবদের লিপ্সে গানাভিনয়, বিচিত্রানুষ্ঠান, নাচানুষ্ঠান, ঈদের বিশেষ নাটক, সার্কাস — বিদেশী ও দেশী, জাদু প্রদর্শনী — বিদেশী ও দেশী, ঈদের বিশেষ বাংলা ছায়াছবি, ইংলিশ ফিচার ফিল্ম, মিস্টার বিন ও থ্রি স্টুজেস, আদিকালিক রিয়েলিটি শো … কত্ত কী আরও! সমস্তই বিস্তারে বলার মতো যোগ্যতা আমার কাছে অন্তত রাখে, জগতের কাছে তা যতই গুরুত্বহীন মনে হোক-না কেন। সময় শেষ, অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণার পালা সন্নিকট, জানিয়ে দিচ্ছি ঈদ উপলক্ষ্যে আগামীকাল আমাদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। আমাদের অধিবেশন শুরু হবে …
ঈদ ও অন্যান্য প্রেম
ছেলেবেলায় মাটির ব্যাংকে টাকা জমাতাম, বছরভর, তবে ঈদের জন্য নয়। সেই ব্যাংকে-সঞ্চিত অর্থ মূলত খরচ হতো পৌষমাসে রেঙ্গামাদ্রাসার ওয়াজে যেয়ে স্যাকারিন-দিয়া-বানানো রসগোল্লা আর মশলামুড়ি খেয়ে, বেহালা ও বাঁশি কিনে, এবং দুর্ধর্ষ অভিযান পরিচালনাকল্পে ক্রীত প্লাস্টিকের পেট্রোলগাড়ির পেছনে। এছাড়াও অনেক খাইখর্চা তো ছিলই, বিশেষত জলসা তথা ওয়াজের মেলায়, বিস্তর মনোহারী জিনিশপত্তর উঠত ওয়াজ-ময়দানের পাশের মাঠে ম্যারাপ-বাঁধা দোকানীদের রাতভর ওই মেলায়। যেমন, ধরা যাক, ইশটিমার। মানে, জাহাজ, জলযান। খেলনা জাহাজ, টিনের বানানো, ছোট্ট হাতের তালুতে হয়ে যেত তার স্থান-সংকুলান ও অল্প-কেরোসিনে সেই জাহাজ রীতিমতো সশব্দ চলে বেড়াইত পুকুরের পানিতে! একটা হ্যারিকেন-সলতের মতো সুতলিতে ম্যাচকাঠি দিয়া আগুন ধরালেই ভটভট শব্দ তুলে এবং ধোঁয়া বার করে ছুটত আমাদের অর্ণবতরী! কিন্তু অমন বিস্ময়বোধক যতিচিহ্নিত বাক্য রচনা বাহুল্য। আমাদের ছেলেবেলার খেলনাগুলো ওইরকমই ছিল। বাঁশি তো বাজতই, দিনভর, বেহালাও ছড়াইত অচিন শত রাগরাগিনী আমাদের শিশুস্কন্ধে সওয়ার হয়ে। একনম্বরী ছিল সবই, আমাদের ছেলেবেলায়, জালঝোপরার কোনো কারবার ছিল না। তা, আবহমান সত্য বলতে এই একটাই তো যে, ছেলেবেলায় ভেজাল নাই কোনো। বড় হতে হতে আমরা ভেজাইল্যা হয়া পড়ি, কিংবা উল্টো করে বললে, ভেজাইল্যা না হয়া বড় হওয়া যায় না। কথা মিছা না, হাছা, শৈশবের মতো অবিতর্কিত ও স্বচ্ছ।
ওয়াজ ছাড়াও বছরের আরও দুটো বড় মাইলস্টোন ছিল অঙ্গুলিগণনযোগ্য। দুইটা আলাদা টাইম ও ইভেন্ট, আমরা কাউন্ট-ডাউন করে যেতাম প্রতিদিন ইশকুল থেকে ফিরে, এদের একটা হলো শিববাড়ির মেলা ও অন্যটা ঢাকাদক্ষিণের বারুনির মেলা। আমাদের বাড়ির পাশেই শিবমেলা, মাতুলালয়ের দেশে চৈতন্যদেবের আখড়ায় বিশাল বারুনি চৈত্রমাসের সবকয়টি রবিবার জুড়ে। বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই এসে যেত মেলা একটার-পর-একটা, যার ফলে একব্যাংকনির্ভর হলে তো চলে না, তাই ব্যাংক ছিল একাধিক। কোনো কোনো বিশ্বস্ত ক্লায়েন্টের কাছে সুদে টাকা খাটাতাম, যেমন আম্মা ও ছোটচাচির কাছে, ওই বয়সের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ব্যবসা থেকে প্রোফিট-মার্জিন খারাপ ছিল না একেবারে, বেশকিছু মাইক্রোসদৃশ দেখা-যায়-না কিন্তু-দেখতে-গেলে বিকট ম্যাক্রো জোচ্চুরিও করতাম বটে ওই-বয়সে আমাদের মাইক্রোক্রেডিট গ্রুপের মেম্বার-বেনিফিশিয়ারি আম্মা-চাচিমার সঙ্গে। যা-ই হোক, বড় হয়ে সেসব ভাওতাকাণ্ড তওবা-কসমকিরা কেটে ছেড়ে দিয়েছি, লিখায়েছি নাম ডাকাতের দলে। সেসব ডিফ্রেন্ট স্টোরি।
আরেকটা ছিল আমাদের গ্রামের উরুস, দরিয়াশার মোকামে মেলা বসত তিনদিন-দুইরাত, হযরত দরিয়া শাহ বাবা শাহজালালের সহচর, তিনশ ষাট আউলিয়ার মধ্যে একজন। দরগা-র উরুসে গিয়া বিশেষ জুৎ করতে পারতেন না আমাদের বাপচাচারা, আন্দাজ করি, যেজন্য অন্য সময়সুযোগে দরগাশরিফে গেলেও উরুসভিড় এড়িয়ে চলতেন, কিন্তু নিজগ্রামের উরুস তো নিজেদেরই উরুস, সেখানে নিয়ে যেতেন, প্লাস্টিকের ঘড়ি-গাড়ি কিনতাম দেদার, টিনের চাক্কালাগানো ঈগলপাখি ইত্যাদি। আরেকটা জায়গায় একবার যাওয়া হতো নিত্যিবছর — বাউল আরকুম শা-র বার্ষিক উরুস মোবারকে। এই উরুসে যাওয়াটা, আরকুম শা-র উরুসে, পারিবারিক কারণেই ছিল প্রতিবছরের স্মরণীয় কাজগুলোর একটি। কিন্তু এই গল্প, আল্লা হায়াতে রাখলে, অন্যদিন। মোদ্দা কথাটা হলো গিয়ে, সবখানেই নিজস্ব ফান্ডের একটা ইনিশিয়েটিভ লাগত, রিভলভিং কিছু আয়-ইনকাম তো ছিলই, কিন্তু অনুদান তথা ওয়ান-অফ গ্রান্ট ছিল মূল সোর্স অফ অপারেটিং দিজ ইন্টার্ভেনশনস্। এখন তো আমাকে এইসব প্রোজেক্টে কেউ ফিন্যান্স করতে ইন্ট্রেস্ট শো করে না, খালি নিজের জেনারেটেড ইনকামে প্রকল্প পরিচালনার ইতিহাস তো আমল করি নাই কোনোদিন, সেইটা আদৌ নোবল জব হবেও না জানি, সিচ্যুয়েশন মেনে নিয়ে একসময় নিজেই হয়া যাই ফিন্যান্সার, যাকে ভদ্দরজবানে বলে ডেভেলপমেন্ট পার্টনার। এখন এইসব প্রোগ্রামের জন্য অ্যামাউন্ট অফ তহবিল রিজার্ভ রাখতে হয়, বাচ্চাকাচ্চারা আছে না! এরা বিগড়ালে তো মুঘল বাদশাহির সালতানাত ধরে টান পড়ে যাবে। তারচেয়ে বরং দুইপয়সা যাক নিজের পেটের বাইরে, প্রকৃত নিজেরই তো পেটে, ব্যাপারটা ক্যুল না? আলবৎ, আপেলকুল, সংস্কৃতির স্বার্থে।
এখন, যে-কথা বলছিলাম, ঈদের সালামি বাবতে রেইজ-করা ফান্ড ওইসব ব্যাংকে ও অন্যান্য শুভঙ্করী উন্নয়নমূলক সেবা-ব্যবসায় বিনিয়োগ করে রাখতাম। প্রয়োজনের সময় টালবাহানা টের পেলে ঢেউটিন তো খুলতে পারতাম না ওই-সময়কার ছোট্ট হাতের প্রশাসন দিয়া, তাই বিকল্প পথ ধরতাম, অর্থাৎ আম্মা-চাচিমার মাথার চুল ছিঁড়ে ফিল্ডের সব পয়সা কানাপাই-কড়ায়গণ্ডায় আদায় ও উসুলের হুমকি দিতাম, কাজ হতো, কাজ না-হলে একনাগাড়ে কয়েকদিন বাড়ির প্রত্যেকটা কামরার শক্তপোক্ত কব্জার দরোজাসমূহ দড়ামদিড়িম আওয়াজে মেঝেতে-চিড়-ধরানো বলপ্রয়োগ করলেই, বিলম্ব-প্রদানজনিত জরিমানা সমেত ফিল্ডে-ছড়ানো সব বকেয়া বাপ-বাপ ডেকে উঠে আসত। তবে ছেলেবেলায় এছাড়াও খরচের খাত ছিল প্রচুর, শুধু ঈদ বা দুর্গাপুজার মণ্ডপের সামনে হাওয়াইমিঠাই খাওয়া ও সহপাঠী প্রতিমাদের দেখা ছাড়াও, একটা এমন খাত ছিল শীতকালে পাড়ার ও প্রতিবেশী পাড়ার ও শত্রুপাড়ার নানান কিসিমের ক্লাবের উদ্যোগে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পীরা আসছেন বলে ঘোষণা চলত হপ্তাজুড়ে রিকশায় মাইক লাগায়ে বড়দের কানমগজ ফাটিয়ে এলাকার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম রাউন্ড দিয়ে, এবং সুদূর ঢাকা থেকে আগত তালিকার দশজন থেকে এক-দেড়জন পোকায়-খাওয়া গাইয়ের নজর দেখা যেত আর বাকিটা চ্যাংড়া মিঠুনকাট চুলের পাড়াতো বড়ভাইয়ের মাইকের মুখ চেপে ইনিয়েবিনিয়ে সিলেটি-কমলালেবুসুঘ্রাণছড়ানো ঘোষণা বারবার। এই নিয়া আমাদের দফায় দফায় হুজ্জুতি-কোন্দলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা আছে বটে, সেসব পরজন্মে কেউ নিশ্চয় ইতিহাসে এন্ট্রি দিয়া রাখবে।
ঈদছুটি : বালকবেলায় এবং বড়বেলায়
ছেলেবেলার ঈদের ছুটি আর বড়বেলার ঈদের ছুটির একটা প্রভেদ লক্ষ করা যাক। তখন ঈদ ছিল উত্তেজনার, আততির, রুদ্ধশ্বাস চাপের। নতুন জুতা-জামা-গ্লাস-ঘড়ি ফিটফাট হবে কি হবে না সেই টেনশনের, ঈদের দিন কোনদিক থুয়ে কোনদিকে বেড়াতে বেরোব, কয়টাকা সালামি পাবো আর তাতে কতদূর পোষাতে পারব, কোন টেলিভিশনপ্রোগ্রাম না-দেখলেই নয় আর কোনটা বাদ দিলেও চলে — এইসব অপরূপ অশান্তি নিয়া আসত ও টুপ করে ফুরিয়েও যেত ঈদছুটি। প্ল্যানপ্রোগ্রামের পর প্ল্যানপ্রোগ্রাম, ইমপ্লিমেন্টেশন অল্প, ফান্ড স্কার্সিটি ছাড়াও টাইম একটা মেজর কন্সট্রেইন্ট ছিল সেই ব্যস্তসমস্ত বালকবেলায়। এখনও ফুরায় অবশ্য ঈদছুটি, নীলিমা হইতে ঝুপ করে নেমে ঈদ টুপ করে যায় ডুবে আমাদের বাড়ির পেছনপুকুরে, তবে সেই বালকবেলার মতো অত অশান্তি-উদ্বেগের মধ্য দিয়া নয়। ঈদের ছুটি, এখন ইদানীং, ফুরায়ে আসে ঘুমায়ে ঘুমায়ে। কোথাও বেরোনো হয় না, যাওয়া হয় না শালিধানের চিড়া বা বিন্নিধানের খৈ খাইতে মাতুলালয়ে কিংবা পাড়ার মোড়ে নয়াপত্তনি আইসক্রিমপার্লারে, বেরোতে ইচ্ছে করে না বলেই হয় না কোথাও যাওয়া। বাইরেই তো থাকি বছরভর, নানান ধান্দায়, বিবিধ ফন্দিফিকিরে। এর-ওর মন যুগিয়ে, এর নামে ওর কানে কুৎসা ফাটিয়ে, মিথ্যে কথা বলে আর মিথ্যে চলেফেরে এবং মেকি কম্মেকারবারে নিজেরে জড়ায়ে রেখে কেটে যায় আমাদের আস্ত বছর। বড়সড় এই ছুটির সময়টাই কেবল সুস্থিরে মুখোমুখি হতে পারি নিজের, আপন দর্পণ হাতে লয়ে দেখি মুখব্রণ ও অপসৃয়মাণ শৈশবমাধুর্য, অথবা হই মুখোমুখি অমোঘ অন্ধকারের। এ অন্ধকার বিষণ্ন মৃত্যুর নয়, এ আনন্দময় জীবনের, এ অন্ধকার ঘনঘোর বৃষ্টির অথবা পাৎলা কুয়াশার। পেলব, মসৃণ, সুকোমল অন্ধকার।
ঈদের শৈশব, শৈশবের ঈদ
সবই তো শৈশবের, যত সুখ যত শৌর্য যত বিত্ত যত বৈভব সমস্তই শৈশবের। বাকি জিন্দেগি তো শুধু শৈশব ভেঙে ভেঙে খাওয়া, শৈশবের হীরেতে শৈশবের জহরতে শৈশবের আলোয় হেঁটে হেঁটে যাওয়া। শৈশবের লাইটহাউস পথনির্ণায়ক জীবনের। আযৌবন আপ্রৌঢ়কাল মানুষ শৈশবমুখাপেক্ষী, কেউ টের পায় কেউ পায় না। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের অটোবায়োগ্রাফি পড়েছিলাম, সম্ভবত জীবনের যত মধুর ভুলগুলি শিরোনাম ছিল সেই দুর্দান্ত গদ্যরচনার, সেখানে একটা মারাত্মক কথা পাই যা আজও ভুলি নাই, ছিল কথাটা এমন : যার পকেটে শৈশব নাই, প্রতিভার নদীতে তার সাঁতার কাটতে যাওয়া বৃথা। আমার শৈশব খুব-যে বর্ণিল, খুব-যে রঙিল, খুব-যে ঘটনাঝিলমিল ও তরঙ্গবহুল, না, তা নয়। এই নিরঙ নির্ঘটনা নির্বর্ণ শৈশবেরও বটে একটা আলাদা রঙ রয়েছে, নির্বর্ণের নিরক্ষরতার বর্ণ ও অক্ষর, সেই পরিস্থিতির বিবরণ তো বর্ণন করাই যায়। আমি যদি লিখিয়ে হতাম, লিখতাম সেই নির্গল্পের গল্পগুচ্ছ, হতাম যদি আঁকিয়ে আমি, দেখাতাম এঁকে সেই অপরূপ রঙহীন অবর্ণনীয়তা ক্যানভাসে, যদি হতাম গাইয়ে, তুলে নিতাম গলায় আমার একলার মুখর ও মৌনী নির্জন শৈশব। অসংখ্য জনসাধারণের মতো আমিও অথর্ব এইখানে, এই সৃজনজগতে, ঠাকুরকথিত অপরূপ আনন্দ গ্রন্থনার বিধাতাদানকৃত কোনোপ্রকার অলৌকিক মকদুর আমার নাই, থাকলে ভালো হইত না মন্দ হইত তা-ও তো বলতে পারছি না। কান্না করছি? কি জানি, ক্রন্দনই হয়তো, কান্নাই হবে হয়তো-বা। কান্না না-লিখতে পারা বা না-আঁকতে না-গাইতে পারার অক্ষমতাজাত নয়, কান্না যদি থাকে তো সেটা সশরীর-সরেজমিন শৈশবে ফিরতে না-পারার প্র্যাক্টিক্যাল ও টেক্নিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল কিছু পরিস্থিতির অসহায় শিকার হবার কারণ থেকে উৎপন্ন। শৈশবের ঈদ কেমন ছিল, তা আমার এখনকার ঈদ উদযাপনের ধরন দেখলেই বুঝতে পারবে যে-কেউ। শৈশবই একজন মানুষকে আজীবন আমৃত্যু পরিচালিত করে বলে আমার বিশ্বাস, শৈশব শুধু পরিচালিতই করে না, দস্তুরমতো প্রভাব বিস্তার করে একজন মানুষের জীবনে তার আপনকার শৈশব। এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে মনোসমীক্ষক ফ্রয়েড হওয়া লাগে না, সাইকোঅ্যানালিসিসের থিয়োরি রপ্ত করা লাগে না, বা জানার দরকার পড়ে না কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং। বোঝা যায়, এমনিতেই বোঝা যায়। যে-কোনো মানুষের স্বাভাবিক-অবস্থায়-আচরিত দশ থেকে তিরিশ মিনিটের ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করে গেলে সেই মানুষটির কতিপয় বেইসিক প্রবণতা আঁচ করা যায়, সে-থেকে সেই মানুষটির শৈশবছবির একটা গ্রাফ এঁকে তোলা যায়, ক্যারিকেচার, নট ইন ডিটেইল্স। অফকোর্স।
ঈদের শীতগ্রীষ্ম
মেমোরি এখনো স্বচ্ছ, টলটলে, শৈশবের। ছেলেবেলায়-শেখা নামতা আর গানের ন্যায় এখনো কটকটিয়ে যেতে পারি বলে সে-দিনগুলো। মনে পড়ে, যদ্দুর মনে পড়ে, ছেলেবেলার রোজামাসগুলো খুব ঝড় ও বৃষ্টিসৃজিত ছিল। বড় হতে হতে ক্রমে সেই কালবোশেখী আর জষ্ঠিমাসা তালপাকা দাহ রূপান্তরিত হতে থাকে লেপমুড়ি হি হি শীতে। এদানীং আবার গরমকালে রোজা ও ঈদ অনুষ্ঠিত হতেছে, ব্যাপারটা ভারি ইন্ট্রেস্টিং। অবশ্য বড় হতে হতে কিছু অত্যাবশ্যক জ্ঞানবুদ্ধিও ঘটপূর্ণ না-হলেও অল্পস্বল্প জুটে গিয়েছে। সেই-সুবাদে খানিকটা আহ্নিকগতি ও বার্ষিকগতির ব্যাপারস্যাপার জানা হয়েছে। এবং ছেলেবেলায় যেমন রোজা ছিল বৃষ্টিবিপুল ও রৌদ্রপরাক্রমী, দীর্ঘকাল মধ্যিখানে শীতকালীন রোজা পাবার পর, ইদানীং রোজা আবারও পুরনো রূপে শৈশবের আমকাঁঠালের সিজনে ফিরছে দেখতে পাচ্ছি। শীতকালীন রোজা আর দাহকালীন রোজার মধ্যে একটা পার্থক্য যেমন টের পাওয়া যায় কালবোশেখাচ্ছন্ন অন্ধকার আর কুয়াশাঝাপসা সান্ধ্য প্রকৃতি দেখে, তেমনি শীতের সব্জি ও গ্রীষ্মের ফলপাকুড়ের উপস্থিতি থেকেও ভোজনটেবিলে এইটা আরও স্পষ্ট বোধগম্য। স্পষ্ট ফারাক রয়েছে তেমনি শীতের ঈদ ও গ্রীষ্মের ঈদের মধ্যে। একটা তো হলো যে, শীতকালে জামাজুতো পরে তদুপরে একটা ভারী জোব্বাজাব্বা চাপাতে হয়। এই কারণে শীতঋতুতে ঈদাগম আমাদের মতো পুচ্চিকাচ্চিদের কাছে আকর্ষণীয় হয়নি ন্যাচারালি। ঈদের জামাটাই যদি না-দেখে কেউ জবুথবু শীত ঠেকাবার ঠেলায়, সেই ঈদের আগমন/প্রস্থানসংবাদ কী-এমন ভ্যালু অ্যাড করবে আমাদের কাছে! এদিকে গ্রীষ্মকালে কেবল জুতো-পরিচ্ছদ প্রদর্শনই নয়, নানাবাহারী কেতাদুরস্ত ভঙ্গিও গ্রহণ করা যায়, যেমন কলার উঁচিয়ে বোতাম খুলে বেড়ানো যায়। এইটা অন্য সময় করা যেত না, কড়া মুরুব্বিদের অসহযোগ ছিল নেপথ্যে প্রধান হেতু, কিন্তু ঈদের সময় ছেলেছোঁকরাদের এমন অনেককিছুই লঘু চোখে দেখা হতো। বেড়াতে বেরোবার মুখে বৃষ্টি এসে যাওয়া আবার হ্যাপা আরেকটা, যে-কারণে গ্রীষ্মঈদ পুরোপুরি সাপোর্ট করবারও নয়। এদিক থেকে শীতের ঈদ সেইফ। ফলে আমরা শিশুরা আদৌ মীমাংসায় আসতে পারিনি কোনোদিন এই ইশ্যুতে; — কোন ঋতুতে ঈদ প্রেফারেবলি বেটার, বলা ডিফিকাল্ট। দুইটার দুই চার্ম, দুইটার দুই বিপত্তি।
ঈদের পরের দিন রোজার স্মৃতিচারণ
কথাটা আম্মা প্রতিবারই বলেন, কোনোবার ভুল হয় না বলতে, শেষ-সেহরি খাওয়ার রাতে; প্রতিবারই বলেন যথাপূর্বরীতিতে। বেঁচে থাকলে আরও-একটি বছর বাদে আসবে আবার রোজার মাস, রমজানের দিন, সবাই মিলে একসঙ্গে সেহরি খাওয়ার গভীর ভোররাত; — বক্তব্য বলি বা প্রার্থনা এট্টুকু, স্বচ্ছ, নির্দোষ, সোজা। আমরা সবাই নীরবে এন্ডোর্স করি আম্মার স্বগতোক্তিসুলভ কথাটা। আর চুপচাপ খেতে থাকি বছরের অন্তিম সেহরি। কিছু শোক, ফুরিয়ে-যাওয়াজনিত আফসোস, কিছু আসন্ন ঈদের জন্য চোরাফুর্তি নিয়া আচ্ছন্ন একটা অবস্থায় শেষ করি বর্তনের দানা খোঁটা। ভালোয় ভালোয় শেষ হয় রোজা।
যা-ই বলো, ধর্মপ্রাণ-অধর্মপ্রাণ নির্বিশেষে মুসলমান-অমুসলমান সকলের জন্য এ এক উৎসবের মাস বটে। এটা অন্তত অন্যান্য দশ-এগারো মাসের তুলনায় ভিন্ন যেহেতু, উৎসববাতাস অতএব এমনিতেই এর গায়ে লেগে রয়। এছাড়াও এই মাসে বেশিরভাগ আপিশের-দোকানপাটের এবং গুটিকয় মানুষের আচারাচরণেও লক্ষণীয় কতিপয় চেঞ্জ আসে, সে-অর্থেও উৎসব ভাবার যথেষ্ট গ্রাউন্ড রয়েছে। যদিও জানি যে এর ভেতরনিহিত নির্দেশটা ভিন্ন, নিঃসন্দেহে মহৎ নির্দেশ, অনুসরণ ও অনুশীলনসম্ভব : সর্বত্র জীবনাচরণে সংযম প্রদর্শন ও লালনের নির্দেশ। কিন্তু সেই শিক্ষা, সেই শীলন-চর্চা, করে কয়জন? বলতে পারি, আইজকালকার বাংলাদেশে একজনও নয় অন্তত। উপরন্তু এক বল্গাহীন ভোগের মাসে রুপান্তরিত হয়েছে এটি। ধুমধামের মাস, লুটতরাজের মাস। লুট যে কেবল বণিকদের একচেটিয়া, তা নয়। যে যেভাবে পারছে, লুটক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছে। আর অন্য নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অসংযমের কথা তো কহতব্য নহে। যেসব নষ্টিফস্টি-ভ্রষ্টামি-ব্যামোবালাই জাতীয়জীবনে বছরভর চলমান এই বড় বিবেকহীনতার দেশে, সেসব রোজার মাসে এসে বেড়ে যায় দ্বিগুণ যেন। উদাহরণ চাইলে দেয়া যায়, কিন্তু তার বোধহয় দরকার হবে না। রাস্তায়-ঘাটে, সদরে-অন্দরে, সাক্ষাতে-পরোক্ষে সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান এক বর্জ্য ও অতি-অবনতিশীল অসংযমের চিত্র চারপাশে। এই চিত্রছবি, এই পরিস্থিতি, এই পরিণামচিন্তাহারা রাজনীতি ও সমাজ-প্রতিবেশ থেকে বেরোনোর ও পরিত্রাণের ন্যূনতম প্রক্রিয়াভাবনা যদি শুরু হতো রমজান মাসে, এই দেশ অত অসহনীয় হতো না তাহলে। কে শোনে কাকে! এইসব না-ভেবে বরং ভালোয় ভালোয় বছরের একটা মাস সপরিজন শেষ করতে পেরেছ, সো, শোকর গোজার করো। করো প্রার্থনা যেন আসছে বছরের রোজামাসটাও একইরকমে, এরচেয়ে ভালো না-হোক দুধেভাতে না-হোক, এমনই মন্দে এমনই ভালোয় এমনই মৃদুভালোয়-বেশখারাপে সবাইকে সঙ্গে নিয়া কাটাতে পারো। পরিস্থিতির যা ভাবগতিক, মনে হচ্ছে, এইটুকু প্রত্যাশা হাই-অ্যাম্বিশন রীতিমতো।
ঈদের দিবাগত রজনী ও রূপকের প্রস্থান
রূপক চলে যায় যিশুবর্ষ ২০০৬ অক্টোবরের ২৮, কোনো-এক রোজাঈদের দিন-ফুরনো রাতে, অতি আকস্মিকভাবে। এই কথাটা, ‘অতি-আকস্মিক’ অভিব্যক্তিটা, আমার বন্ধু রূপক রঞ্জন দেব আমাদের সবাইকে প্র্যাক্টিক্যালি শিখিয়ে দিয়ে যায় চিরতরে। এরপর থেকে প্রতিবছর ঈদ এলে, ঈদের দিন-পারানো রাতে, রূপকের স্মৃতিচারণ করে চলেছি। ইন-ফ্যাক্ট, বছরে দুইবার রূপকস্মৃতি ডায়রিতে লিখে রেখে চলেছি বিগত বছর-বারো ধরে। এক হলো, অক্টোবরের ২৮ তারিখ, আর হলো রোজাঈদের দিনাবসানে। এর ব্যত্যয় এখনও হয়নি। মনে হয়, বাকি জিন্দেগি এই স্মৃতিচারণ ও স্মরণিকা রাইটিং ব্যাহত হবে না। তার মানে এ-ও নয় যে, এই দুইদিনই রূপকের কথা মনে পড়ে সারাবছরে। না, তা না। রূপকের মুখ অলমোস্ট এভ্রিডে মনে পড়ে। কেন, সেই গল্প নয় এখন।
মনে পড়ে তো কতকিছুই! খালি মনে-পড়াপড়ির গান — ভালো লাগে কারো? উপায় নাই, প্রিয়, মনে-পড়াপড়ি ছাড়া গান হয় না কোনো। দুনিয়ায় সমস্ত সুর, শিল্প ও গল্প একচেটিয়াভাবে মনে-পড়াপড়ির কারবার। নাথিং এল্স। বোবার মনে-পড়াপড়ি চটজলদি বুঝতে পারি না হয়তো, বোবার ইশারাভাষা সবাই সমানভাবে পাঠোদ্ধার না-ও করতে পারেন। কিন্তু আমরা যারা বোবা না বলে বড়াই করি, আমরা যারা কথা-বলা গালগপ্পের জাহাজ একেকখানা, তাদের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই কিন্তু স্মরণিকা একেকটা। উচ্চারিত ধ্বনি মাত্রেই স্মারকস্তম্ভ, আমরা চাই বা না-চাই। জীবিত মানুষের নিয়তিই হলো মেমোয়্যার রচনা করে চলা কাজেকর্মে-ভঙ্গিতেভাবে-ইঙ্গিতেআকারে-সংগীতেনৃত্যে-কথায়নীরবতায়, স্মৃতিকথা ছাড়া জগতে কোনোকিছুরই অস্তিত্ব নাই।
ভাবছিলাম, কত-কত দূর চলে এসেছি আমি ও আমার পৃথিবী! আমার প্রিয়তমা, আমার প্রাচীনা, আমার জননী-ও-প্রণয়িনী পৃথিবী! আর তো ফেরা হবে না হায় সেই দিনরজনীগুলোতে! ফেলে-আসা আগুনহল্কা আর কুয়াশাপালকের সেই বিকেল ও দুপুরগুলো আমার! সেই গ্রীষ্মবর্ষাশারদীয় সংখ্যাগুলো! রোজ অপরাহ্নে হাইওয়ে ধরে হেঁটে হেঁটে বা বাইসিকেল হাঁকিয়ে রূপকের বাড়ি যাওয়া … রূপকদের বাড়ির লাগোয়া সব্জিক্ষেতে যেয়ে বসে-থাকা মাগরেব-মুহূর্ত পর্যন্ত … ফেরার সময় বেগুন-মুলো-টোম্যাটো অথবা শাকপাতা কিছু-না-কিছু-একটা হাতে বা সাইকেলহাতলে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরা … রূপকের বিছানাপার্শ্বের ছোট্ট খিড়কিতে চোখ রেখে রূপকদের বাড়িসীমান্তজোড়া বাঁশঝাড়ের ঘন ও নিঝুম বাতাস অবলোকন … কত পরিকল্পনার বুনন … কত গানের গল্প, গল্পের গান … সুমন-অঞ্জন-নচিকেতা-মাকসুদ-বাচ্চু-জেমস প্রমুখের নতুন অ্যালবামের খবরাখবর … আর ফিরবে না, হায়, ফিরে আসবে না আর সেই দিন ও ধরণী!
ঈদের আয়ু মাত্র সাতদিন!
ঈদের দিনটি ফুরিয়ে গেল ফুস করে! ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল জানালাডালে-বসা বসন্তবাউরি পাখিটি! শিশুদের কিচিরমিচির শান্ত হয়ে এল। জগতে আনন্দের ক্ষণ অতি অল্পস্থায়ী। কিন্তু তার রেশ — আনন্দের রেশ ও খুশির শিস — ক্ষেত্রবিশেষে বিরাজ করে জীবনভর, বারবার ফিরে আসে, রহিয়া রহিয়া হৃদি ভাসায়ে নিয়া যায়, পরান আকুল করে।
ছেলেবেলায় এই দিনটি ফুরিয়ে যাওয়ার সময় কী-যে হাহাকার লাগত! মনে হলে এখনও হু হু হাওয়া ওঠে বেদনা-ও-বিষাদ মথিত-মিশ্রিত। সন্ধ্যার দিকে যেয়ে মনে হতো — হায় হায়, কিছুই তো হলো না, না-হলো স্বস্তিমতো ঈদের ঘোরাঘুরিটাও, তবু কোন ফাঁকে ফুরায়ে এল মধুপ্রহরগুলি! ঈদের দিনটা আরেকটু কেন লম্বা হলো না! আর কী-যেন অচেনা আকুলতায় আশঙ্কায় আকুলিয়া আশঙ্কিয়া উঠিত অন্তর।
উপর্যুপরি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আম্মা তখন কাউন্সেলিং করতেন নানাবিধ সান্ত্বনাযুক্তি সাজিয়ে। বলতেন, ঈদ তো একদিনের নয়, ঈদ সারাবছরের। আমরা আম্মাকে বুঝদারি-মাস্টারি বন্ধ করতে বলতাম ধমক দিয়া, আমাদের একপাল ভাইবোনের মিলিত ধমকের প্রভাবে আম্মা নানান যুক্তি উপস্থাপন করেই যেতেন ঈদ ফুরায় নাই প্রমাণ করতে।
একটা যুক্তি, ঈদ ফুরায় নাই মর্মে, বেশ মনে ধরত আমাদের। যে, সাতদিন পর্যন্ত ঈদ। কেন, কেন? সাতদিন কেন? বুঝদারি-মাস্টার্নিগিরি শুরু হলো আবার! না, আম্মা এবার খুব দুঁদে উকিলের ভূমিকায়, এইটা সত্যি, ঈদের আয়ু সাতদিন। কারণ, সাতদিন পর্যন্ত ইশকুল বন্ধ। দুনিয়া জুড়েই এইটা অতএব সবাই জানে। দুনিয়ার সবকিছু ছুটি কাটায় ঈদদিনগুলিতে।
তা, আম্মার কথায় যুক্তি আছে বিবেচনা করে আমরা ঈদের প্রথমদিন-ফুরানো রাত্তিরে খাটে যেতাম অবশেষে ঘুমাতে। পরদিন আর আম্মাকে বিশেষ বেগ পেতে হতো না আমাদেরে সামলাতে। কারণ টারজান, থান্ডার ক্যাটস, টম অ্যান্ড জেরি, বগুড়ার কোন-একটা সার্কাসদল — বগুড়া ইয়ুথ কয়্যার সেই দলের নাম সম্ভবত, জুয়েল আইচ ও ডেভিড কপারফিল্ড আসতেন আমাদের বাড়ি টিভিতে চড়ে।
কিন্তু মনে আছে, ঈদের দিনের প্রতিটি প্রহরের রোদ নজর করতাম, প্রতিটি গাছের পাতা ঠাহর করতাম গাঢ় নজরে, প্রতিটি পথকুকুর খেয়াল করতাম খুব ভালো করে। কারণ, আম্মা বলেছেন, এই দিনে সবাই নাকি আনন্দখুশি করে! এবং এই অভ্যাস এখনও, সারাজীবন ধরে, সঙ্গে রয়ে গিয়েছে। এমনকি ঈদের রোদ্দুরের মধ্যে সাধারণ দিনের চেয়ে ভিন্ন গন্ধও খুঁজে বার করি!
সারাদিন বসে থাকলাম, পায়চারি করলাম, শিশুদের সঙ্গে খুনসুটি করে গেলাম দিনভর। দিনের আলোর প্রতিটি বাড়-কম, প্রতিটি ছায়াপাত, প্রতিটি গাছের পাতার নড়াচড়া জরিপ করে গেলাম সারাদিন। তারপর সন্ধ্যা নামল। আমি আমার অভিভাবকত্বাধীন শিশুদেরে নিয়া আমার আম্মার মতো ফাঁপড়ে পড়লাম। অংশ নিলাম ঈদ ফুরিয়ে গেছে নাকি সাতদিন আছে এই বিতর্কে। একসময় তাদের ঘুমন্ত মুখ দেখে ঈদ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে টের পেলাম। নিজের পার্ফোর্ম্যান্স সেলিব্রেট করলাম গুনগুনিয়ে।
আর্ফারাত্রি, ঈদশপিং, জটাধারী ভীষণ শহর
পরীক্ষার যেমন পূর্বরাত্রি, ঈদেরও তেমনি, রাত পোয়ালেই কি-হয় না-হয় নিয়া জল্পনাকল্পনা আর অজানার রোমাঞ্চ। বয়স এখন যেখানে এনেছে আমাকে, সেই রোমাঞ্চ ফোঁটা মাত্রও নাই, এই রোমাঞ্চানুভূতি বিবৃত করে চলেছি তবু কবেকার সেই প্রিহিস্ট্রি থেকে। এখন তো শতভাগ লিখিত/বিবৃত অনুভূতিই পুরনো অনুভূতির জাবর-কাটা ব্যতিক্রমহীনভাবে। এখন নতুন অনুভূতি ধারণের গ্রাহকযন্ত্র কমজোরি, বিকল হইয়া গিয়াছে বলাই উত্তম। তবু অনুভূতিলিস্টি — পূর্বজন্মের — এত লম্বাচওড়া যে, একজীবন কেটে যাবে হেসে-গেয়ে সেইসব অনুভূতির অঘ্রানঋতু উদযাপন করে করে। যে-কথাটা চাইছিলাম বলতে, সেইটা হলো, ঈদের দিবাপূর্ব রাত্রিকে কেউ ডাকে চাঁদরাত, কেউ চানরাইত, আমরা ডাকি আর্ফারাইত। শব্দটা, আর্ফারাত্রি, কোথাকার বা কি তার ব্যুৎপত্তিবৃত্তান্ত বলতে পারব না কিচ্ছুটি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমরা চাঁদরাত মানে আর্ফারাইত জেনে এসেছি। বিস্তর বড় ও মস্ত পণ্ডিত হয়ে জেনেছি যে আর্ফারাইত মানে চাঁদরাত, খুশিদিনপূর্ব রজনী। কিন্তু শব্দার্থবোধিনী রচিতে তো বসি নাই, ঈদসংখ্যায় সেই কাজ করা মানে মাইর খেয়ে কইলজা ঝেরঝেরা বানাবার ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত, বসেছি কিছু মনোবেদনা জাহিরিতে ইনিয়েবিনিয়ে। এই ইনানোবুনানো উগড়ে দেওয়াতেই তো দুনিয়া কামিয়াব দেখিতে পাই আজিকালি। ইতুপুতু মনোবেদনাবাজারের খুব রমরমা দেখিতে পাই তো! অবশ্য আমার ইন্টার্প্রিটেশন ভুল হইতেও পারে।
এখন বলি, আর্ফার রাইতে কী করতাম আমরা আমাদের জীবনকালে। কেনাকাটায় এত মত্ত হয়ে ওঠে নাই পৃথিবী তখনও। বড়জোর ঘরের মেয়ে-মহিলাদের, আমার বোন-কাজিন আর আমাদের মা-চাচিমাদের, কসমেটিক্স ও মনোহারী পুঁতিমালা-কাচচুড়ি-ফিতা-সায়া-ব্লাউজ-পেটিকোট প্রভৃতি কিনতে যেতে হতো শহরের বণিকদ্বারে, শেষ ইফতার সেরে চাঁদ দেখা সাঙ্গ ও সফল হলে পরে। আমরা ছেলেরা বাপ-চাচাদের আঙুল ধরতাম শহরের রঙিন বিজলিসজ্জিত বস্ত্রবিপণীগুলো পুনর্বার দেখিবার আশে। কেনা হতো আমাদেরও ঈদনামাজের নতুন নকশাকারুকৃত টুপিটা, আতর ও সুর্মা, বা প্লাস্টিকবেল্টের ভালো-টাইম-দেয় এমন শস্তা বাচ্চাতোষ হাতঘড়ি কিংবা প্লাস্টিকরিমের চশমা লালবর্ণিল। কোরবানি-ঈদে কেনা হতো ছুরিচাকু ও বটি-দা — আর্ফারাতে — বায়না ধরতাম জায়নামাজ কেনার, আমার-সঙ্গে-পড়ে পয়সাওলা বাপের পুত্র অনেকদিন হলো জুম্মাদিনে জায়নামাজ কান্ধে নিয়া যাতায়াত করে মসজিদে সুতরাং ওইটা একটা ছোটচাচাকে বলে-কয়ে বাগাতে পারলে প্রেস্টিজ অনেক হাই করে তোলা যাবে, কিন্তু ওই নিগোসিয়েশন করতে করতে একসময় কোন ফাঁক দিয়া বড় হইয়া যাই উদিশ পাই না। জায়নামাজ বাগানো হলো না আর।
আজকাল তো হরিলুট অবস্থা আর্ফারাইতের বাজারে। কেনাকাটিবিলাসী মানুষ শেষ-মুহূর্তে কেনাকাটি করে চুটিয়ে ধুমিয়ে। রাজ্যির দোকান, রাজ্যির ক্রেতা, রাজ্যির ভান ও ভণিতা। কী পাগলের মতো কিনতে পারে মানুষ, বাপ রে বাপ, না-দেখলে বিশ্বাস হবার নহে। দেদারসে কেবল কিনিছে মানুষেরা, ডানে-বাঁয়ে ভুরুটি না-কাঁপিয়ে। দরদামের দস্তুর যেন উঠিয়াই গিয়াছে। ক্রেতারা বাজিকরের ন্যায় কিনছে তো কিনছেই। কোনোপ্রকারের কোনো বার্গেইন না-করে কিনছে আর ব্যাগে ভরছে। দাম হাঁকাচ্ছে দোকানী সাতশ, তো খরিদ্দার লুফে নিচ্ছে যেন ছয়শ টাকায়। এর একটা মানে হলো, লোকজনের জেবে মালকড়ি দেদার। না-হলে আগে যেখানে দর-দস্তুর করা নিয়া কতরকম কত কাণ্ড হইত, এখন সেসবের কোনো বালাই নাই। অন্যদিকে একদর তথা ফিক্সড-প্রাইসের দোকানঘর বেড়েছে দিন-দিন, ব্রহ্মাণ্ড সয়লাব হয়ে গিয়েছে যেন ভদ্রলোকী শাইলকের বাণিজ্যগদিতে। একদিক থেকে দেখতে গেলে এর একটা সুফল অবশ্য রয়েছে। যেইটা হলো, খরিদ্দারের ভোগান্তি কিছুটা কমেছে। এখন, তুমি চ্যাঁচাবা গলাকাটা নিয়া। তা, গলা মিয়া তোমার যেমন কাটা যাচ্ছে, আশরাফ-আতরাফ অন্য সকলের বেলাতেও তা-ই। ওম্নিতেও তোমার গলা আস্ত ছিল না, আবার এম্নিতেও গলাটা কাটা যাচ্ছে। এতদক্ষেত্রে আমাদের দেশে সাম্যবাদ কায়েম হয়েছে বলতে পারো। গলাকাটা সাম্য। মারহাবা! আর দেখো, আমার মতো স্বল্প-ও-সীমিত আয়রোজগারের মানুষ উৎসবে শরিক ও শামিল হতে যেয়ে কেমন সপরিবার নাকানি-চুবানি খাচ্ছে! যেন বস্ত্র খরিদ আর শেমাই খাওয়াতেই উৎসবের সমস্ত আনন্দ-খুশিয়া! মুসলমান, সম্ভবত, বাংলাদেশে জন্মে-যাওয়া দারিদ্র্যরেখার-খানিক-উপরে-থাকা আবার ক্রয়সামর্থ্যসীমার-অনেক-নিচে যেসব লোক ভিড়ের চাপে চ্যাপ্টা যাত্রী জীবনের — আমার মতো — এরা যা-সম্ভব খুশিফুর্তি-আনন্দোল্লাস করতেই জানে না সেইভাবে। কে জানে, এই কথাটা লাখ-ডলার খর্চানো ওয়ার্ল্ডব্যাংক-ফিন্যান্সড্ গবেষণায় মেজর ফাইন্ডিং হিশেবে এলেও উঠে আসতে পারে।
ঈদভোর, ঈদগোসল, ঈদজামাত
নয়ন মেলিয়া দেখি ঈদের সূর্য উঠি উঠি করছে! ঈদভোরে গোসল করা ঈদেরই একটা অংশ। গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গত বছর, আনফর্চুনেইটলি, ঈদগোসলের মতো গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ছেড়ে দিয়েই শুরু করতে হয়েছিল আমার ঈদদিন। বাদ পড়ে গিয়েছিল, দুর্ভাগ্যবশত, অত্যাবশ্যক আরেকটি অংশ — ঈদজামাত। অথচ ঈদের দিনের পৃথকত্ব/বিশেষত্ব, মোটা দাগে, ওই দুটো দিয়েই। ঈদস্নান আর ঈদজামাত। সবকিছু মিলিয়েই ঈদজমায়েত। আমার শৈশব আমার কৈশোর আমার তরুণ দিনগুলো আলো করে রেখেছে যে-সমস্ত অভিজ্ঞতা, যে-সমস্ত তাৎপর্যগুরুত্ববহ ঘটনা, তার মধ্যে এইমাত্র-কথিত দুই অংশের পুনঃপুনঃ ভূমিকা আমি স্বীকার করি। কী-যে সেই দিনগুলো! ঘোড়ার মতন টগবগে আর পাখির মতন উড়ুউড়ু। সোনার খাঁচায় নয়, তিলাঘুঘু-দুর্গাটুনটুনির বাসায় এবং খরগোশের ভক্ষ্য নরম ঘাসের গালিচায় রেখে এসেছি সেই দিনগুলো আমাদের। আহা রে! শীতসকালের হাড্ডি-হিহি আর দাঁত-কিরিকিরি হিমের মধ্যে পুকুরে যেয়ে কাকডুব — ঝুমুর ঝুমুর পুকুরজলে কাঁপতে কাঁপতে ঈদগোসল বছরে দুইবার — কুয়াশাকামড়ানো জগতের কোনো-এক সুপুরি-শিম-কলা-নারকেল-কদম গাছেপাতায়লতায়-ঘেরা বাড়িতে! গোসল সেরে একদৌড়ে ঘরে ঢুকেই ঠাসঠুস শব্দে দ্রুতহাতে তেল বুকেপিঠে সপাটে ডলে মেখে নতুন-বানানো/খরিদ-করা জামা গায়ে গলিয়ে একহাতে পাজামার ফিতা টানাটানি করে দাঁতের ফাঁকে নতুন-পাওয়া টুপি গিঁথে একটা-কিছু মিষ্টিপিঠেপুলি জিভে দিয়ে দে-দৌড় মসজিদ/ঈদগা ময়দানে, গিয়ে আরম্ভ-হচ্ছে-হচ্ছে নামাজের কাতার ঠেলেঠুলে চেপেচুপে দাঁড়িয়ে-পড়া, তারপর নামাজ শেষে কুইক ঈদকোলাকুলি করে বাড়ি ফিরে মুরুব্বিজন সবাইকে কদমবুসি ঠুকে দুই-চাইর টাকা ঈদসালামি ইনকাম করতে এঘর-ওঘর যাওয়া — এ-ই হলো আমার স্মৃতিতে ঈদের স্পেশ্যাল ফিচার, স্মরণীয় সুন্দর আমার, ঈদসংস্কৃতি অফ মাই টাইম। এরও আগের একটা ফেজ গিয়েছে অবশ্য, মনে আছে অবিকল স্পষ্ট সব, যখন আম্মা নাইয়ে চুল-আঁচড়িয়ে সুর্মাচক্ষু-আতরকর্ণ পাঠাতেন আব্বা-কাকার সঙ্গে ঈদজামাতে। দিনকে-দিন দুনিয়া পাল্টাচ্ছে, ফাস্ট থেকে ফাস্টার হচ্ছে তাবৎকিছু, শর্ট থেকে শর্টার, তবু আমি চাইব ঈদের দিনটি যেন ওই-রকমটাই থাকে। সেই আমার ছেলেবেলার মতো। অমনই পুরনো ধাঁচের, ওল্ডি গোল্ডি, আমার শৈশব-কৈশোরক সংস্কৃতির। বারেবারে ফিরে আসুক ওই সেই ঈদস্নান, ওই দৌড়ে দৌড়ে ঈদগা যাত্রা, বাড়ি ফিরে সেই একই-রকম কদমবুসি ও তিনআনা-আটআনা আয়রোজগার। কিং অফ স্মল থিংস, ছোট ছোট খুশিফুর্তির রাজা। চাইব যেন আমার পরের কেতাদুরস্ত প্রজন্ম এসে তাদের জীবনধারা সকলই পাল্টে ফেলুক, শুধু ঈদের দিনটি যেন পুরনো পিতার আমলের কেতায় পালন করে। এইটুকুই।
ঈদভ্যাকেশন ও একটি প্রস্তাব
ফুরায়ে আসিল ক্রমে মধুপ্রহরগুলি, প্রিয়, নগরে ও ঘরে কেরানি ও কাকেদের মনখারাপ খুব। এমনই একজন ছুটিদিনগুলো স্বর্গের খুব কাছের স্টেশন নিজের জন্মজগতে কাটিয়ে কাজের শহরে ফেরার অব্যবহিত পরপর বড় হৃদয়বিদীর্ণ ও মর্মান্তিক ফেবুস্ট্যাট শেয়ার করেছেন একখানা : আবার সে-শহরে … যে-শহর আমার না! বাপ রে বাপ! হোয়াট অ্যা স্ট্রোক! চৈনিক একটা চালু প্রবাদ হলো এই-রকম যে, যা কিনা তুমি তিনলাইনে বলতে পারবা না, তা তোমারে বলতে বলেছে কেঠায় বাপধন! চৈনী-জাপানীরা তো হাইকুভক্ত খুব, তথ্যটা নিশ্চয় এইখানে মনে পড়বে আমাদের। শুধুমুদু নোটের পর নোট উড়াইতেছ, অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ নিবন্ধমস্তানী, মিঞা, কামের নামে ভেরেণ্ডি! কিৎনা জঞ্জাল পয়দা করে চলিয়াছ, পগারপারের যাত্রী হে, সে-খেয়াল আছে? এই-রকম কথাবার্তা গায়েবি এল ভেসে মোর কানে। এবং সলজ্জ বসলাম, অগত্যা, আরেকখানা টাইটানিক মুসাবিদায়! সেই ১৯১২ সালের ভরাডুবির পরও তো দেখি তাসির হইল না আমার! আবারও ভাসাইলাম ডিঙা গাজী গাজী … বদর বদর বলে! এই নোট, এই নিবন্ধ, অতএব, দুনিয়ার তামাম মাতৃগৃহকাতর মানুষের সম্মানে ভেজিলাম ফের ফেবুদরিয়ায়। একটু আগে যে-লাইন উৎকলিত হয়েছে, কে সেই লাইনের জননী কি মিডোয়াইফ, কে হেন অ্যালিয়েনেশনাক্রান্ত নরাধম ধুন্ধুমার এ-ফেবুজমানায় এই মিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ফ্রেন্ডস-ফলোয়ার্স পরিবেষ্টিত সদাখোশ মহাবিশ্বে — সেই নাম প্রকাশিয়া যাইব ততঃপর পরের অনুচ্ছেদে। ব্যক্তির নাম তানভীরুল ইসলাম দীপু, নোয়াখালি এক্সপ্রেস, কবি কিংবা কেরানি কিংবা কাক কোনোটাই নন বরং মস্ত অফিসার এবং সেই সুবাদে সস্ত্রীক বসবাস সেই নিঠুরা সার্সি-নগরে, মুঘলামলে যার নাম ছিল জাহাঙ্গীরনগর। এই পর্যন্ত পরিচয় ক্লিয়ার। কিন্তু, খটকা আছে একটা, শাহেনশা ঢাকায় নিবাসী এবং মস্ত অফিসার — রাইট — কিন্তু কবিও কি নন? ওই-রকম এক্সপ্লোসিভ একখানা আয়াত রচনার পরও কবি বলা হবে না তাকে! তা, তিনি যদি নিছক শাহবাগশা হয়াই তৃপ্ততুষ্ট রহিতে চাহেন তো কথা আলাদা। যার হৃদয় ত্রিভুবনজাহান জানাশোনার পরেও খড়গাদার সেই টিমটিমে বেথেলহেমের জন্য আকুলিবিকুলি করে, তিনিই তো শাহেনশা! না?
আপিশ যেতে হচ্ছে না টানা প্রায় একহপ্তা — লাফাচ্ছিলাম কত্ত প্ল্যানপ্রোগ্রাম ছকাইতে ছকাইতে আর ইরেজার দিয়া মুছতে মুছতে, এরই মধ্যে ভোর হয়ে গেল, ফুরায়ে আসিল মধুনিশি! বিরাট ছুটির জাহাজ, প্রমোদতরণী, মনে মনে ভাবছিলাম আর লাফাচ্ছিলাম। কত্তকিছু করা যাবে, কিচ্ছুটি-না-করে কত্ত কত্ত বসে থাকা যাবে, চেয়ে চেয়ে দেখা যাবে কত্ত কত্ত অচাওয়া-অদেখা, ভাবছিলাম এইসব। ভাবছিলাম, স্বস্তি! ভাবছিলাম, শান্তি! ভাবছিলাম, ওঁম্! ব্যোম ভোলানাথ হয়ে বসে থাকো অথবা গড়াগড়ি যাও, দৌড়াও অথবা হাঁটো ছন্দে-ছন্দে-দুলি-আনন্দে-বনফুল-যথা ইচ্ছেমাফিক যেদিক তব খুশি, ঈদছুটি ইহা যেহেতু! যদি খুব খারাপও কাটে নেহাৎ আসন্ন হপ্তাখানা, ভাবছিলাম ছুটিনোটিশ দরশনকালে, তা-ও আফসোস করব না। ভ্যাকেশন যেভাবেই কাটাই, ভাবছিলাম, ওইটাই জীবন তো প্রকৃত প্রস্তাবে। এবং ওইটুকুতেই জীবন্ত ও চাঙ্গা হয়ে উঠি আমরা। চাকরিজীবন যাপন করতে করতে বছরভর মরে পড়ে থাকি, বেঘোরে ও বেধড়ক মরে পড়ে থাকি, এই একটামাত্র হপ্তা মানবজীবন যাপনের মওকা পাওয়া যাচ্ছে! একে হেলা করা পসিবল নয়কো। প্রতিবার এহেনই ভাবি, প্রতিবার হই হত-আশা। ভাবি, ফি-বছর যেমন ট্র্যাফিক সপ্তাহ পালন করা হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে, তেমনি একটা আলাদা সপ্তাহ পালন করা যায় না — যাকে এনজিওবকাবিদগণ ভুলবাংলা আর ততোধিক জগাখিচুড়ি ইংরাজি মিশায়েমুশায়ে কেশর নকলভঙ্গিতে ফুলায়ে বলতে পারবে, ইয়েস, ইয়েস, ইনোভেটিভ আইডিয়া! মারহাব্বা শোভানাল্লা! তা, আমাদের কথাখান হলো, প্রস্তাবিত সেই সপ্তাহটির নাম হবে ‘মানবজীবন যাপন সপ্তাহ’। প্রোজেক্টের কাম কী — ভাই, নামেই পরিচয়। হেন হপ্তা পালনের প্রথা চালু করা যায় না? ভাইবা দেখুন সুশীল ঠাকুরগণ! মনে হয় মন্দ হবে না। ফান্ডফ্লো তো মোরা জানিই কী-পরিমাণে এবং কোনদিকে হইতে যাইতেছে প্রবাহিত, অতএব, সোজা হয়া কাতার বানলেই কিস্তি ছিপছিপায়া যাইব ভাইসা হাওড়ে ও পাহাড়ে এবং শ্মশানে-শূন্যোদ্যানে … চ্যালচ্যালায়া চলিব নাও … উস্তাদ, আওয়াজ দেউক্কা! মানুষের মতো জীবন যাপনের সংজ্ঞা ও অন্যান্য নানান মশলাপাতি-ডিস্কোর্স প্রভৃতি নিয়া আলাপালোচনাই হবে সেই দিবসের মেজর প্রতিপাদ্য, কর্নেল-জেনারেল প্রতিপাদ্য হিডেন রহিব। পুরস্কারমত্ত সুস্বচ্ছ সুশীল সমাজ তথা প্রাচীনকালিক জনৈক ফর্মা হাসান কর্তৃক উত্থাপিত বপুমস্ত তর্কবিতর্কের শেষে কনক্লুশনকৃত সেই সিভিল সমাজ-এর প্লেয়ার-অ্যাক্টর-গ্যাম্বলাররা আমাদের এই প্রস্তাবটি নিয়ে ভেবে দেখলে পারেন। পস্তাবেন না, ড্যাম শিওর!
এবং এই সেই অপরূপ পৃথিবী, দিজ ইজ দ্য ওয়ান্ডার অ্যামাং অল হ্যাভেনলি অ্যান্ড আর্থলি ওয়ান্ডার্স, এরই নাম দধির ভেতরের দধি তথা মানবজনম, যেখানে একলক্ষ দুইলক্ষ তিনলক্ষ মেরিলিন মনরো পরিবেষ্টিত থেকেও কেউ কেউ অহর্নিশি মায়ের লাগি কাঁদে! একের পর এক অর্থকরী দিনের সাঁকো পেরোতে পেরোতে কেবল তারা মায়ের অনর্থ কুঁড়েতে ফেরার দিন ও অবকাশ গোনে! এইসব অবলা মায়ের পুত্তুলি … এইসব মাতৃমুগ্ধ মায়াবী মিষ্টি জীব … ! এরাই তো — ধুর, ভুলে গেলাম, কী-যেন বলে — অমৃতকন্যেপুত্র? অপরূপ অত্যাশ্চর্য বোকা মানুষগুলো! — স্বর্গের ইমিডিয়েট আগের স্টেশন বলে মনে করে যারা তাদের শীর্ণাস্বাস্থ্য মাতৃহস্তে-রোপিত-ও-লালিতবর্ধিত ফলঝোরা জামগাছতলা!
# #