সুপুরিখোলের গাড়ি । পাপড়ি রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুলাই ২০১৫, ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ, | ৩০৭০ বার পঠিত
বেড়ানোর জন্য শীতকে প্রায় সবাই উত্তম সময় বলে মনে করে। কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশের প্রায় সব ঋতুতেই ঘরের বাহির হওয়া যায়। আমি নিজে বর্ষাকালে বেড়াতে পছন্দ করি। ঠিক ঘোর বর্ষাও নয়, বাদলার প্রথম ফোঁটা পড়ল কি পড়ল না, ঘর ছেড়ে বেরোবার জন্য মন আমার মেঘের সঙ্গী হয়ে ওঠে! কারণ বছরের প্রথম জলস্পর্শে গাছ-লতাদের যে হাসিখুশি দন্তবিকশিত চেহারা, এটা যে অনুভব না-করবে সে কিছুতেই দেখতে পাবে না।
বেড়ানো মানে বেড়ানো — ঘরের বাইর, প্রতিদিনের বিশ্রী রুটিন থেকে নিষ্কৃতি! চেনামুখদের সরিয়ে অচেনামুখদের সাথে একাকার হয়ে যাওয়া। আমার কেন জানি মনে হয় মানুষেরা আদতে জন্মসূত্রেই পথিক — কিন্তু সংসার, প্রাত্যাহিকতা, রুটিরুজি, সভ্যতা এসবের নাগপাশে তাদের পথিক-স্বভাব চাপা পড়ে যায়। কী আর করা! কোনোরকম ম্যানেজ-ট্যানেজ করে, সবকিছু রি-শাফল করে ঘরের বাইরে যদি দুই পা ফেলা যায়, মন্দ কিছু নয়। তবে ‘ঘুরন্তিস গ্রুপের’ সদস্য হওয়ার পূর্বে একবার শুধু ঝালাই করে নিতে হবে — সকলেই মনের কাছাকাছি কি না, মানে সমমনা কি না; নইলে আনন্দের সবুজ পাহাড় অচিরেই বরফের তলায় কবর হয়ে যাবে। তবে ১০০ ভাগ তো কিছুতেই মেলে না, ৫৫/৪৫ হলেও আনন্দযজ্ঞ ঘটানো যেতে পারে।
.
তা আমাদের ‘ঘুরন্তিস গ্রুপ’ কয়দিন আগে মুন্সীগঞ্জ সফর দিয়ে এল। মুন্সীগঞ্জ হলো প্রাচীন বিক্রমপুর জেলা। আর বিক্রমপুর ছিল বঙ্গ ও সমতটের রাজধানী। এমনই শান-শওকত তার! ঢাকারই সন্নিকট আর দুর্দান্ত গোছানো ও প্রাচীন ঐতিহ্যময় এক শহরে এতদিনেও কেন যাইনি, সেই দুঃখে মাথা ঠুকে দেবার যোগাড় হলো!
.
ভোর-ভোর রওয়ানা হলে আস্ত একটা দিন বাইরে কাটানো যায়, কিন্তু ভোরের প্রস্তুতি সত্ত্বেও ঠিক নয়টায় স্টার্ট নিলো আমাদের পঙ্খীরাজ। আদতে আমাদের মাইক্রোবাসের চালক এতটাই দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ঘোরান যে, আমরা ভুলে যাই ওটা গ্যাস বা তেল-চালিত যান। মনে হয়, আমাদের তেজি ঘোড়াটার বুঝি দুইটা ডানা গজিয়েছে, আর সে পঙ্খীরাজ হয়ে উড়ে চলেছে! এই উড়ে চলা মেঘের দেশে না হোক, মেঘশামিয়ানা মাথায় করে তো বটেই। ফলে মন মোর মেঘের সঙ্গী … !
.
ঢাকাশহর দৃষ্টির আড়াল হলেই দেখবেন, শরীর-মন কেমন ফুরফুরে তুলোট হয়ে ওঠে! মফস্বলের গাছ-লতাদের মাঝ থেকে যে হাওয়া উঠে আসে, তাতে অক্সিজেন ঠাসা থাকে বলে মন আর শরীর বেলেহাঁস হয়ে যায়। না-যেয়ে উপায়ও নাই যে!
.
এক থেকে দেড় ঘণ্টার ভেতর আমরা মুন্সীগঞ্জের বাঁকে! এর মাঝে পেরিয়েছি নদী বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যা। আর ঘন সবুজের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে আমাদের চোখের জ্যোতি গিয়েছে বেড়ে। ফলে আমাদের কাছে সবকিছুই স্বচ্ছ ও নন্দিত হয়ে উঠছে! পথঘাট-বাড়িঘর-দালানকোঠা-গাছলতা-জংলা সবই দেখছি আলো-ঠিকরানো! যেন স্বর্গ থেকে সদ্য তারা ধরায় সমাসীন হয়েছে! এমন বেহেশতি পরিবেশে খিদা জাগারই কথা! ফলে ভ্রমণসঙ্গীরা বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলে, তারা খাবে এবং খাবেই। মুন্সীগঞ্জ শহরের এক রেস্টুরেন্টে তখন গরম নান-সব্জী-ডাল-গোমাংস-তেহারির খুশবু থইথই করছে। ফলে এক কেবিনে আমরা গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে বসে গরম নানের জন্য হাঁকডাক শুরু করি। তবে ব্যস্ততার কারণে বেয়ারারা আমাদের খুব বেশি পাত্তা দিতে চায় না। আমরা ডেকে গলা ব্যথা করে ফেলার পরে খাদ্য সম্মুখে আসে। বলাই বাহুল্য তা গরমাগরমই ছিল। খানাখাদ্য শেষ করে আমরা চায়ের তেষ্টায় ব্যাকুল হই, কিন্তু মন্দ কপাল চা নাই! চা পাওয়া যাবে সেই বিকেলে। চা-বিকেলের আশায় তাকিয়ে থেকে আমরা ইদ্রাকপুর দুর্গের (১৬৬০ খ্রি.) প্রবেশদ্বারে পৌঁছে যাই।
.
৩৫০ বছরে পুরানা এই দুর্গ। সুবেদার দ্বিতীয় মীর জুমলার টাইমে এইখানে অথই জল ছিল। ছিল চার নদীর মোহনা — মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি আর শীতলক্ষ্যা। আর সেই জলমগ্ন জায়গার নাম ছিল কালিদাস সাগর। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ ঠেকাতে এই দুর্গ নির্মা করা হয়। কোনো-একসময় ইদ্রাকপুর দুর্গ থেকে নাকি সুড়ঙ্গপথে লালবাগ কেল্লায় পৌঁছে যাওয়া যেত। সেই সুড়ঙ্গপথ এখনো রয়ে গেছে। তবে সেই সুড়ঙ্গের মুখটা সিল করে দেয়া হয়েছে। কারণ ওই সুড়ঙ্গে যারাই নেমেছে, তারা কেউই আর ফিরে আসেনি! ধারণা করি কার্বন-মনোঅক্সাইডের আধিক্যের কারণে সকলের মৃত্যু ঘটেছে। এ-রকম দুর্গ বাংলাদেশে আরো দুটো রয়েছে বলে জানা গেল। একটা হাজিগঞ্জে, অন্যটি সোনাকান্দায়। গোলাবারুদ নিয়ে সৈন্যসামন্তরা যে ভালোভাবেই শত্রুকে বাধা দিতে পারত, তা দুর্গ ঘুরেই টের পাওয়া গেল। বেশ বুদ্ধি খর্চা করে এই দুর্গের নির্মাণ! যে কালিদাসসাগরে একদা দুর্গ নির্মাণ হয়েছিল, সেই সাগরের লেশমাত্র হয়ে বেঁচে আছে এক ছোট্ট পুকুর। তাতে ভেসে আছে কিছু টোপাপানা, দাম আর শুকনো পাতার রাশি। আর ওই স্বল্প জলের তলায় বেঁচে আছে কিছু মীনরাজি। দুর্গের সামনের সিঁড়ি সটান উঠে গেছে, আর বেরোবার সিঁড়ি বা পেছনের সিঁড়ি সামান্য আড়াল-আবডাল রেখে নেমে গেছে। চারপাশের পুরোটাই সৈন্যদের জন্য সুরক্ষিত বলে মনে হয়। আর কেমন যেন প্রাচীন প্রাচীন ঘ্রাণ পাওয়া যায় এলাকাটা জুড়ে। দিব্য চোখে যেন দেখা যায় ম্যালা লোকের হট্টগোল, সদ্যই তারা যেন লুকিয়ে পড়েছে যে যার মতো করে। মনে আশা জাগে, তাদের দেখা সহসা মিললেও মিলতে পারে।
এরপর আমাদের গন্তব্য হয়ে ওঠে বজ্রযোগিনী গ্রাম, অতীশ দীপঙ্করের (৯৮০-১০৫৪ খ্রি.) জন্মভিটায়; যেখানে গড়ে উঠেছে বৌদ্ধবিহার। এক ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটায়’ জন্ম নিয়েছিল ‘এশিয়ার নয়ন’ অতীশ দীপঙ্কর। ভারি অবাক লাগে এই ভেবে যে, অমন এক অজপাড়াগাঁ থেকে তিনি আলো বিলিয়েছিলেন এবং নিজে হয়েছিলেন ‘এশিয়ার নয়ন’! এই শ্রীজ্ঞান বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয় রোধে রাজা চঙছপের বিশেষ আমন্ত্রণে তিব্বত গমন করেন। সেখানে তিনি ১৭৫টি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিব্বতীরা তাঁকে সম্মানসূচক হো-জো-বো অর্থাৎ দ্বিতীয় বুদ্ধ উপাধিতে ভূষিত করে।
.
তাঁর জন্মভিটায় পুনঃসংস্কারের কাজ চলছে দেখতে পেলাম। তখন রোদ্দুর বেশ ফুঁসে উঠেছে আর মিষ্টি কুমড়োর মাচানের উপর রোষ ঢালছে, ফলে উত্তাপে আমরাও বেশ অস্থির ও পিপাসার্ত! কিন্তু নতুনকে জানা ও ভ্রমণের নেশা আমাদের কোনোকিছুতেই ক্লান্ত করে না। ফলে আমাদের পঙ্খীরাজ উড়ে চলে নাটেশ্বরের উদ্দেশে। যেখানে সদ্য আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো পুরাকীর্তি।
তাঁর জন্মভিটায় পুনঃসংস্কারের কাজ চলছে দেখতে পেলাম। তখন রোদ্দুর বেশ ফুঁসে উঠেছে আর মিষ্টি কুমড়োর মাচানের উপর রোষ ঢালছে, ফলে উত্তাপে আমরাও বেশ অস্থির ও পিপাসার্ত! কিন্তু নতুনকে জানা ও ভ্রমণের নেশা আমাদের কোনোকিছুতেই ক্লান্ত করে না। ফলে আমাদের পঙ্খীরাজ উড়ে চলে নাটেশ্বরের উদ্দেশে। যেখানে সদ্য আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো পুরাকীর্তি।
.
সপ্তম শতকের চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ সমতটে ৩০টি বৌদ্ধবিহারের কথা উল্লেখ করেছেন। ২০১০ সাল থেকে ৯টি বিহারে উৎখননের কাজ পরিচালিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, নাটেশ্বরের আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহারের সাথে অতীশ দীপঙ্করের গভীর সম্পর্ক ছিল। বৌদ্ধবিহারটি ৯৮০-১০৫০ খ্রিস্টাব্দের। এটি ছয় একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। তবে স্থানটি খুঁজে পেতে আমাদের বেশ সমস্যা হয়, কারণ চোখে পড়ার মতো কোনো সাইনবোর্ড এখনো সেখানে লাগেনি। একে-তাকে জিজ্ঞেস করে করে আমরা ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে যাই। আসলে কাটামাটির ঢিবি দেখেই আমরা নোঙর করি। চড়াই-উৎরাই বেয়ে দেখতে থাকি হাজার বছর পূর্বের জীবনের চিহ্ন। দরদালানের ইট, চাতাল, সিঁড়ি। কোনো-একদিন এইখানেই কি-না গাওয়া হতো সহজিয়া সংগীত। কিন্তু আজ সব মাটির নিচে তলিয়ে গেছে। প্রশ্ন জাগে, মাটির নিচে সমাধিস্থ হওয়ার পূর্বে কি কেউ তথায় জীবিত ছিল? এক বা একাধিক জীবন্ত প্রাণ কি ঢুকে পড়েছিল বুভুক্ষু মাটির গ্রাসে? ভেবে মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে!
.
.
ওই সমাধিস্থ জনপদে এক নিঃসঙ্গ কোকিল কেঁদে যাচ্ছে অনবরত। কোকিল ক্লান্ত হয়ে সামান্য বিরতি দিলেই বউ-কথা-কও পাখি ডেকে মরছে। কী যে অদ্ভুত দৃশ্য! আর আমাদের পাশে এক বিরহী শালিক খুঁটে খাচ্ছে ঘাসের শরীর। এক শালিক দেখে আমাদের মন খাঁ খাঁ করে ওঠে — ওয়ান ফর সরো … ! খনন-চলা প্রাচীন বিহার দেখে ফিরে এসে শুনি আমাদের গাড়ি বিকল! মরেছি! তাহলে ক্যামনে কী! যে-বাড়ির পাশে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে, সেখানেই আমরা জল চাই, আশ্রয় চাই। ওটা মালিহা আর ময়নাদের বাড়ি। ওরা আমাদের দুপুরের অন্ন-জল জোগায়। বাংলাদেশ মায়ার দেশ, মমতার দেশ, সহমর্মিতার দেশ — এসবই ফের নতুন করে চোখে পড়ে। খর-দুপুরে আমরা মালিহাদের পুকুরে হাঁস হয়ে সাঁতার কাটি। সবুজের মাঝে নয়ন মেলে অনুভব করি — এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি … আহা!
.
নয়নাভিরাম প্রকৃতি আমাদের মূক করে রাখে। হিজল আর নাটাগাছের ছায়া, কিছু ঘাস আর জংলা। নাম-না-জানা বৃক্ষদের মাঝে নারিকেল আর সুপুরি গাছেদের উঁকিঝুঁকি। ফলন্ত আম আর লিচুর হাতছানি। আমাদের পঙ্খীরাজ ফের সচল হয়ে ওঠে। আর আমাদের বাড়িফেরার ডাক আসে। ঘরে ফিরতে হবে। আমরা তো চিরপথিক নই — পথ আমাদের কিভাবে আগলে রাখবে?
.
পদ্মহেমধামে লালনের আখড়া না-দেখে ফিরে আসতে হচ্ছে বলে মনের ভেতরের খচখচানি থামে না। কিন্তু ধলেশ্বরীর তীরে এসে ব্যাকুল বাতাসে আমরা সব বেদনা বিস্মৃত হই। স্রোতস্বিনী নদী আমাদের সাথে হেসে ওঠে। নদীর ধারেই মুক্তারপুরের দধি আর মিষ্টির দোকানের সারি, না কিনে ফিরলে ঘরের লোকদের মুখ ম্লান হয়ে উঠবে।
.
জলজ হাওয়ায় আমাদের ফের ক্ষিধেতেষ্টা জাগে। আর সেই বিকেল-চা পান করি ধলেশ্বরীর তীরে বসে। ফের আমাদের হাওয়াইগাড়ি চলতে শুরু করে ঢাকার উদ্দেশে। মুক্তারপুর ব্রিজে তখন সূর্য বিদায় নিচ্ছে। আর মানুষেরা ভিড় করে দেখছে বিদায়ী সূর্যের মোহনীয় দৃশ্য। আমরা কি সামান্য বিষাদাক্রান্ত? সূর্যের বিদায় দেখতে দেখতে ধলেশ্বরীর দিকে হাত নেড়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে উঠি — আবার আসিব ফিরে, ধলেশ্বরীর তীরে …
# #