প্রাচীন অস্ত্রাবলি । নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জুলাই ২০১৫, ৪:৩৪ অপরাহ্ণ, | ২৩০২ বার পঠিত
কর্পূরের ঘ্রাণ
যেইসব পদ্মপাতা, হাতির চোখ আর কর্পূরে ভরে গেলো তোমাদের আকাশ—তাদের মধ্যেও ছিলো উষ্ণতা, ছিলো আর্দ্রতা, ধূ ধূ লালসা। একচক্ষু আকাশ দেখে এইখানে পড়ে আছে শিয়ালের শব, ভিন্ন পাঁজর। পাঁজরের খাঁজে উদ্গত হচ্ছে হরিদাভ জামরুল, খণ্ডিত তৃষ্ণা। তৃষ্ণার পাশে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। মাটির ঢেলা ঘষে এঁকে ফেলি ছয়টি পাতাল; তৃতীয় পাতালের পাড়ে একলব্য গাছটিও আঁকি। মাটির ঢেলা সব ফুরিয়ে গেলে আকাশ হতে পতিত হয় হাতির একটি চোখ, একটি পদ্মপাতা কর্পূরের গন্ধে একাকার।
আকাকিভিচ
জুনিপোকারা
পথের নাম দিলো পাতাবনের জুনিপোকার দল। মধ্যরাত্রি গড়িয়ে পড়ছে ঘাসখণ্ডে, কম্পমান শিশিরের বোঁটায়। নক্ষত্রের ঘ্রাণ মেখে রাত্রি গড়িয়ে পড়ছে নিঃশ্বাসের বামপাশে। পাথরের পাশ থেকে ধনুকসমগ্র উড়ে গিয়ে সেঁটে যাচ্ছে ত্রিভঙ্গ গ্রহণে। শেষ হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সকল মটরশুটি ফল, বাসনার রক্তলগ্ন বীজ। শেষ হয়ে যাচ্ছে পথ। আর অন্তহীন থাকে সেইসব পতঙ্গদল, বুকে অনির্বাণ অনল।
তোমাদের ঘরে
এই যে ঝুলে আছে ছয়টি দেয়াল—আপাত মহাকর্ষ তারে দোলায়িত বাদামের দল—ওরা চুপিচাপ ডুবে যাচ্ছে। আকাশের ডোবায় ডুবে যাচ্ছে মহিষের ডানা, মায়ামায়া চোখ, গুটানো খুর, তার অর্ধেক হাসি। এই মন কেমন করা ঘ্রাণের পাহাড় ভেঙে তোমাদের বাচাল হাওয়ার বোতাম ঘুরে। বোতামে কেমন করে ঝুলে থাকে রুদ্ধশ্বাস বাসনার সুতো! দেখে দেখে এই চোখ পচে গেলে কোনোদিন—খুলে যায় অনিঃশেষ, খুলে যায় ছয় দেয়ালের যতি—আমি দেখি না। ভাবি, ডুবে আছি, ডুবে যাই চিরদিন তোমাদের ঘরে; তোমাদের ঘরে।
বসন্তের দুঃখ
আমাদের শাদাফুল পুড়ে যায়, পুড়ে যায়– ভস্ম হয় না কিছু, লাল অঙ্গার হয়ে থাকে। এইভাবে একটি দীর্ঘশ্বাস আর একটি শূন্যতার পাশে আমাদের শাদাফুল বসন্ত হয়ে যায়। বসন্ত, তোমার দুঃখের রং লাল।
তেরোটি দীর্ঘশ্বাস
একটি নামের ধারে উদ্গত হয় পুরুষপাখি। পৃথিবীর ময়ূরেরা ঘুঘু হয়ে যায় ধীরে। বাজারে শিকিপাখা অপ্রতুল রূপকথার ঝাঁপি হয়ে ফুরিয়ে যায়। টেরাকোটা কামনার ঝাড়ে ফুরিয়ে গেলে নৃত্য ও নাট্যম– নিভে যায় দৃশ্য, দৃশ্যের অপর পারে নিভে যায় চোখ। এই চোখ নক্ষত্রের ক্ষত অক্ষে ধরে দেখে ফেলে অন্ধকারের অজানিত ঘ্রাণ, ঘ্রাণের আড়ত। তেমাথা পথের ধারে চির দণ্ডক সেই ডাকবাকশের লেলিহান জিব জানে তৃষ্ণার প্রকার। ক্ষয় হয় ধ্যান, ক্ষয় হয় ত্রিবেণী মাকাল। নামের রূপ জানে না রক্তলগ্ন পাথর। পাথরের পাশে বিচূর্ণ পড়ে থাকে তেরোটি দীর্ঘশ্বাস।
জ্বরের ঘনক
দেয়ালে দুইটি টিকটিকি ছায়ার ট্রাপিজিয়াম আঁকে। ভাবি, শীতরাত ফুরিয়ে গেলে ছায়াছবিই হয়ে যাবো। একটা ক্ষতের পাশে খুলে রাখি উলের টুপি, দীর্ঘশ্বাস আর তৃষ্ণার দাগ। দুআঙুলে ঘষে ঘষে তুলে ফেলি কপালের দুইটি রেখা। একটা মিহিন রেখা বেরিয়ে যায় ধোঁয়া ধোঁয়া চোখের ডানা ছিঁড়ে। শীতরাত দীর্ঘ হতেই থাকে। আলোখেকো ছায়াদল হয়ে থাকে লেলিহান জ্বরের ঘনক।
লুপ্ত শৈশব
আমি তোমাদের লোক নই। লাইটপোস্টের নিচে যেইসব আলো ভান করে পড়ে থাকে– ওইখানে আমি নেই। দ্রিমিতিবনে লুপ্ত শৈশবের বিভা এখনো আছে; আছে কোনো হারানো বোতলে জমা। বোতল ভাসছে দূর সমুদ্রের ফেনায়। অথবা ডুবে আছে বয়েসী মাছের পেটের ভিতর ক্ষুধা-নিবারক। উঠানে ডুমুরের ছাইয়ের পাশে বেড়ে ওঠে অপস্রিয়মাণ অশ্রু। অশ্রুর ক্ষত নিয়ত হারায় ডানা। তোমাদের চোখে এইসব দৃশ্য ভ্রম হয়ে থাকে। আমি তোমাদের কেউ নই, আমার শিরার ভিতর শাদা উদ্ভিদের দেশ। এই দেশে তৃষ্ণা গাঢ় হয় নদীর সকাশে।
ক্ষত্রিয় যাপন
আর শুনতে ভালো লাগে না। রোদের দিনে ঘুমিয়ে পড়ি হাঁটতে হাঁটতে। আমি কার ক্লান্তির উত্তরাধিকার? একটি রেখাকে উলম্ব চিরে দিয়ে দাঁড়াই। চোখের পাশে ডানা ভেঙে পড়ে থাকে দৃশ্যের ভাগাড়। এই কথা বলছি যাকে সেও বধির চিরদিন। আমার শুনতে ভালো লাগে না; বলতেও ভালো লাগবে না আর। শাদাদিন শেষ হলে ফুরিয়ে যাবো সপ্ত আকাশ। রূপকথা ডুবে যায় এই আকাশের পাঁকে। রূপকথা অবিদ্যার চোখের তারা ক্ষয়ে পড়ে আছে। কবেকার বিছানার চাদরে লেখা অমর চিহ্নের রূপ ভিন্ন করে ফুরিয়ে যাই। এই দৃশ্যের পাশে ধৃতরাষ্ট্র হয়ে বাঁধি কবন্ধের গণিত। ধৃতরাষ্ট্র সে এক অন্ধ কল্পনা। সত্য এই ক্ষত্রিয় যাপন, জানে না বিছন। আর শুনতে ভালো লাগে না বনের রোদন।
প্রাচীন অস্ত্রাবলি
রাইক্ষেতে ফুরিয়ে যায় হলুদ। প্রখর, তোকে মনে পড়ে। বলেছিলি, এইখানে সমুদ্র নাই, এইখানে নুন নাই। সেইদিন আমরা নদীর ধারে রাত কাটিয়ে ভোরবেলা সূর্যকে এক লহমায় মুছে দিলাম। সেই থেকে কেউ কারো মুখ দেখি না। স্পর্শে টের পাই। আমরা পাহাড় আর ইমারতের ভিতর পাশাপাশি হেঁটে শিকার করি প্রাচীন অস্ত্রাবলি। কিংবা ধনেশের হাড়ের মাদুলি গলায় বেঁধে বসে থাকি দূরাগত জলার ধারে। আধো অন্ধকারে মহিষের স্নান দেখি। চোখের রেখায় সুর্মার জ্বালা। আহা, আমরা সুর্মাপাহাড় পুড়ে যেতে দেখেছিলাম কবে কার চোখের আগুনে! আমাদেরও চোখে আগুন আছে। সেই আগুন থেকে একদিন দিগন্তের কাঁখে আবার এঁকে নেবো প্রয়োজনীয় সূর্য ও সুধা। রাইক্ষেতে আবার জ্বলে উঠবে হলুদ, জ্বলে ওঠবে অন্তহীন দ্বিপ্রহর।
হংসধ্বনি
আমাদের গ্রামের সকল সেতার বাদকের বামহাতে ছয়টা করে আঙুল আছে। আর আমার বাম হাতে চারটা আঙুল। তাই আমি জলরঙে ছবি আঁকি। একটা ধনেশপাখি আমার কাছে এলে তার চঞ্চু শাদা থাকে। আমার লেমন ইয়েলোর পটে চঞ্চু ডুবিয়ে সে পান করে রাইক্ষেত। তারপর তার চঞ্চু হলুদ হয়। সে হলুদ চঞ্চু নিয়ে উড়ে যায় সেইসব সেতারবাদকের আঙ্গিনায়। সেতারের তারে তখন বাজে হংসধ্বনি। ধনেশ সেতারের তৃতীয় তারটি ছিঁড়ে ফেলে আমার নামে। আর আমি তার জন্য জলরঙে আঁকি একটি হংসধ্বনি।
ভুল জানলা
তুমিও সমকোণ থেকে বেঁকে হয়ে গেলে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি—সেতুগুলি গুটিয়ে নেয় ছায়া নদী থেকে; অথবা স্রোতই ভাসিয়ে নেয় সেইসব ছায়াসুধা তমসদুপুর। জীবন, ভুল জানলার শার্সিতে এঁকেছিলে দীর্ঘশ্বাস। ওপারে ফুরিয়ে যায় চন্দ্রমল্লিকার দিন।
রাতের করাত
আমার জানলার ওপারে একটা লালবাড়ি বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি। কোনো লাল ধুয়ে হয় না শাদা। একটি হাওয়া বারংবার নিয়ে আসছে আমার ঘরে বাড়িটার সিক্ত ঘ্রাণ। আমি শুনছি একটি গান। মাইলের পর মাইল উড়ে যাচ্ছে আকাশের মেঘ। আমার জানলার কাচে নাক ঘষছে টবে লাগানো গাছপালা। আমি তাকিয়ে আছি। গান ভেসে যাছে লালবাড়ি পেরিয়ে। গান ভেসে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও অজানিত একটি পাখির দীর্ঘশ্বাস হয়ে যাচ্ছে আমার আত্মজা। আমি তাকিয়ে আছি। আমার চোখে লেগে আছে মহাকাশ। তার কোনো আকার নেই। নিরাকার চোখে তাকিয়ে আছি একটি গানের দিকে।
পাঞ্চালির শৈশব
দেশলাই বাকশে ভরে দিলাম পাঞ্চালির অলিখিত শৈশব। অগ্নি ও নক্ষত্রের পুবে যে ভোর বিহঙ্গনাথ—সে কবে পুড়েছিলো উড়ুক্কু মাছের চোখে? সেই নির্ঘুম চোখই লক্ষ্য জেনে আমিই অন্তহীন শাড়ির কথক। পথিক বৃক্ষের কাছে হাত পেতে কে চায় পত্রালিকা? সেই পাতার শিরায় আঁকা আছে রক্তের সাঁতার। কোনোদিন আমার হাতের পাতা থেকে সব রেখা তুলে নিয়ে কারও মুঠোর মধ্যে গুঁজে দিয়েছিলাম। কোনোদিন প্রাচীনগ্রন্থের কালো কালো অক্ষর হয়ে কারও চোখের ভিতর তাকিয়ে ছিলাম। সেই দিনের সেই রক্তলগ্ন উষ্ণতার ভার নিয়ে কে তবে বয়ে বেড়ায় অলিখিত শৈশবের পাথর? একদিন তার শাড়িও আকাশের বিদ্যুতের মতো দীর্ঘ হয়ে ছুঁয়ে দেবে আমারই নিয়তি।
দৃশ্যাস্ত্র
রক্তজবার অভিশাপ বুকে নিয়ে পাথর হলাম। কেবল চোখ দুটি টলোটল, বুজে আছি—নিঃসীম অন্ধকারের প্রতিভাস। সূর্যের প্রতিপক্ষ দুইচোখও পাথরই হবে কোনোদিন। এইসব ভয় দূরে রেখে গুছিয়ে নিচ্ছি আপ্ত দৃশ্যাবলি। এই দৃশ্যাস্ত্রই থাকবে অভিশাপের পাশে।
এলিয়েন
এলিয়েন, তোমার দাঁত দেখাও, দেখাও বিবর। অনাহূত পথের দিশা ধসে পড়ে, ধসে পড়ে চালতার তলে। তোমারও কি পা আছে, আছে পায়ের আঙুল? ওই বৃক্ষের পাতার রেখাদল জানে ভুলেরও রং আছে। ভুলের রঙের ভিতর ডুবে ডুবে তোমার পথ জুড়ি। তোমার বিবর ভাবি অন্ধকারের সবচে’ উজ্জ্বল কানে বসে আছে দুঃখপুষ্প যামিনী। তোমারও দুঃখ আছে তবে! আমি ভাবলেই তোমার ললাট সংকুচিত হয়ে বয়ে যায় আষাঢ়ের দিকে। দাঁতে জামের অপরূপ দাগ নিয়ে তুমি দাঁড়ালে আমার বিপরীতে আমিও আশূন্য বিষাদ, আমাকে কুড়িয়ে নিয়ে যায় অজানিত দীর্ঘশ্বাস।
প্রিয় সংবাদপাঠিকা
আমার মা অনেক বছর আগে এক সংবাদপাঠিকার প্রেমে পড়েছিলেন। আমাদের চৌদ্দ ইঞ্চি শাদাকালো টেলিভিশনে রাত আটটার সংবাদ দেখতে দেখতে আমার মা স্বপ্ন দেখতেন, তার ছেলের বউ এমনই হবে। কিন্তু একে একে তার সব ছেলেই বড় হলো, সব ছেলেরই বিবাহ হলো। মায়ের স্বপ্ন পূরণ হলো না। একদিন আমিও বড় হতে হতে পড়ন্ত দুপুর শেষে এক বালিকার কাছ থেকে চেয়ে খেলাম একবাটি মুড়ি আর এক ঘটি জল। তারপর অনেকদিন ভুলে গেলাম, জনান্তিকে ঝরে গেলো হিজলের বন, জন্মান্ধ দিঘির পাড়ে। আমি জানতাম না, কোনোদিন সেই বালিকাও সংবাদপাঠিকাই হয়ে যাবে; আর তার রামধনু শাড়ির পাড়ে প্রতিদিন মাছের চোখ হয়ে আটকে যাবে আমার সকল বাসনা।
ইরাবান
গোপন বীণা
উড়ে যায় পাতা থেকে ঘাসের দাগ, উদ্গত হরিৎ। কেউ বাজালে দুপুরের পেটের ভিতর গোপন বীণা—বীণার অষ্টতারে তারে কেটে যায় আঙুল, ঋতাচারি নখ। আনখ আবেষ্টনে ঝরে যায় প্রেম, সবিনয় ছায়াছবি রাত। যাকিছু আঘাত—কিছুটা রোদের নামে আকাশের পায়ে লেগে যায়; কিছুটা ছায়ার নামে আলোর পাশে পুড়ে যায়। সেই যে কারো দরোজায় আঁকা করাতের ছবি, সেই যে কারো জানলায় ডোবা সূর্যের জ্বর—এইসব ফুলে ফুরিয়ে যায় পথেরও নিরাময়। পথের হাত খুলে দেখো, একটি আঙুল কম হয়ে আছে।
বিনীত দেয়াল
এলাচবনের ধার
সেইখানে জেগে আছো, এলাচবনের ধারে। কোথাও দীর্ঘ প্রাচীরদল পৃথিবীকে ঘিরে আছে। তোমার চশমার কাচে প্রাচীন মন্দিরের গায়ে জাগা টেরাকোটা, ছায়া হয়ে আছে। কোথাও লুপ্ত সমুদ্রের দিকে তুমি শাদা কুয়াশা হয়ে গেলে কেউ তোমাকে দেখে না। আমি কুয়াশার ওষ্ঠাধরে চুম্বন রেখে পাহাড়ের ছায়ায় আসি। ছায়া ছিন্ন হয়। যে পাহাড় পৃথিবীর স্তনরূপ মধ্যে নিয়ে আকাশকে দেখায়—আমি তার মধ্যে তোমার চিহ্ন রেখে আসি—একটি কম্পন। এই কম্পন আমি ওষ্ঠাধরে জমা রেখেছিলাম।
সবুজ স্নান
সবুজ চা দিয়ে স্নান করি, সবুজ স্নান। এই চা কাঁটাতার ভিন্ন করে আসে। স্নানের রেসিপি খুবই সহজ। স্নান শেষে সারা গায়ে যখন চা-গন্ধ বাষ্প নাচে তখন মনে হয় হিমালয়ের পাদদেশে সবুজ সূর্য হয়ে আছি। কখনো প্রিয় আঙুলেরা কান্নার ওপার থেকে এসে ছুঁয়ে দিলে অপরাজিতা হয়ে যাই, হয়ে যাই বাতাসের সহোদর ভাই।
# #