“কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন, আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন।” [কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত ও রাজশেখর বসু সারানুবাদিত মহাভারত থেকে উৎকলিত]
.সারাদিন কেটে গেল কলমীর গন্ধভরা জলে … যদি বলতে পারতাম! আহ্! বলতে পারতাম যদি যে, সারাদিন কেটে গেল কলমীর গন্ধভরা জলে … তাহলে? জনম সার্থক হতো তবে? বেঁচে-থাকা আরো খানিক অর্থময় হতো নাকি? আরো কিছু যুৎসইভাবে জীবন কাটিয়া যাইত বুঝি? যদি বলা যেত ওভাবে : সারাদিন কেটে গেল কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে! হতো সব, সকলি সমস্ত হতো; হায়! জীবন যে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার হয়া যায়! যে-জীবন মানুষের, দোয়েলের/ফড়িঙের দেখা সে কী পায়? বরঞ্চ মানুষ নিকটে গেলে তারা উড়ে যায় … উড়ে যায় পুড়ে যায় প্রকৃত সারস … পুড়ছে দেশ ও মানুষ, চলছে বাণিজ্য ও বইয়ের মেলা বার্বিকিউভূখণ্ডের হিংসুটে নেত্রীবিকলাঙ্গ অপরূপায়িত অঙ্গনে, পুড়ছে জনতা।
.
২.
সারাদিন কেটে গেল গাড়লের সনে হেসে হেসে … সারাদিন কেটে গেল কচ্ছপের সনে কেশে কেশে … সারাদিন কেটে গেল মাকালের সনে মেশে মেশে … সারাদিন কেটে গেল খেলেধুলে গাধাদের সমাবেশে … সারাদিন কেটে গেল ফালতু ও ফড়িয়ার ফাঁদে ফেঁসে … সারাদিন কেটে গেল বহুবর্ণ বাঁদরের অবিকল বেশে … সারাদিন কেটে গেল গর্দভের গলা ঘেঁষে ঘেঁষে … সারাদিন কেটে গেল পাখাহীন পাখিদেশে এসে … সারাদিন কেটে গেল সাজানো বানোয়াট আগুনের আঁচে নিভন্ত চুল্লির প্রতি বিদ্বেষে … সারাদিন কেটে গেল যামিনীসন্ন্যাসে … সারাদিন কেটে গেল কুচক্রান্ত পর্ষদের সঙ্গধন্য শীতঋতু অপলক একটি নিমেষে … এই পাখি এই ফুল এই অগ্নি এই জল খেলাখেলি শেষে, সারাদিন কেটে গেল কলমীর গন্ধভরা গানাবাজানা ভালোবেসে …
৩.
মিথ্যে বলতে বলতে, মিথ্যে চলতে চলতে, মিথ্যে করতে করতে, মিথ্যে শুনতে শুনতে, মিথ্যে দেখতে দেখতে, মিথ্যে ভাবতে ভাবতে, মিথ্যে মানতে মানতে, মিথ্যে ঢাকতে ঢাকতে অবিকল হয়ে গেছি মিথ্যের রাক্ষস। হয়ে গেছি যেন এক মিথ্যেমহারাজ। আর কেমন যেন নিজেকে আজকাল শূকর শূকর লাগে। কুকুর কুকুর মনে হয় নিজেরে আজকাল। জগজ্জোড়া মিথ্যের মাতোয়ালা মজমা বসিয়াছে, আমি কোন তালেবর যে অন্য পণ্যে বাণিজ্যসফল হতে চাইছি বড়! বরং ভালো গেয়ে ফিরি মিথ্যের জয়গান। হই খ্যাতকীর্ত মিথ্যেক্যানভ্যাসার। … এই যে এত মিথ্যে-মিথ্যে বলে মাতামাতি করছ, বত্স্য, জগৎ মিথ্যে আর তুমি বুঝি সত্যযুধিষ্ঠির! আসলে, কে না-জানে যে, যার কোনো ক্ষ্যামতা নাই সে-ই খালি তার চারপাশ নিয়া চিল্লাপাল্লা করে ফেরে। করে ফেরে স্রেফ অপারগের আস্ফালন। যার আছে ক্ষ্যামতা, সে তার কাজেকর্মে দেখিয়ে দ্যায় কোথায় কী আছে কতটুকু আছে, দেখায় কোথায় কী নাই কতটুকু নাই। যার ক্ষ্যামতা বর্তমান সে তো ভাই মুখ বুঁজে মুক্তা ফলায়! হাহ্! সে তো ঝিনুক, নীরবে সহে যায়! আহা রে! আমার বালের তলের শামুক-ঝিনুক হীরা-মানিক-রতন! হা রে আমার নীরবে-নিভৃতে সহন! যাও! সহে যাও!
৪.
আজ দিন কেমন কেটেছে? কেমন কাটতি হলো আজিকে দিনের? ওহে, কেমন কেটেছে তব আজিকার দিন? হেন কোনো ঘটনা কি ঘটে নাই ঘটা করে লেখা যায় যাহা? ঘটেছে? … কোথাও রোমাঞ্চ নাই? খাঁটি করুণ বাস্তবতা? এবং এই বাংলাদেশেরই কথা? যে-দেশ মরে-পচে-হেজে গেছে? ফেইল্ড স্টেইট থিয়োরি তুমিও কপ্চাইছ ওই নিউজপেপারবণিক ভোল-বদলানো সম্পাদকটার মতো? খতিবের পায়ে পড়ে ব্যবসা বাঁচাও, অবিলম্বে, বিটিভিস্ক্রিনে আমরা তোমার উর্ধ্বমুখো নিতম্ব হেরিব। সত্যি কি সে, এই দুঃখিনী বর্ণমালার দেশ, মরা-পচা-হাজা? নাকি তুমি? সবকিছু তো চমৎকার চলে ঠিকঠাক। তোমার কেবল সকল গানেই তাল কেটে যায়, শাল-তমালের ছায়াও তোমার ভাল্লাগে না, হায়! তার মানে তুমিই সেই জন, যাকে নরকের দ্বাররক্ষী হিশেবে খোঁজা হচ্ছে! যাও, নরকে তোমার শান্তি সংরক্ষিত। আঁস্তাকুড়ের আপনজন তুমি, যাও! হেথায় তোমায় মানাইছে না গো … লালপাহাড়ের দেশে যাবা? রাঙামাটির দেশে? যাবি? তু লালপাহাড়ের দেসে যা, রাঙামাটির দেসে যা … সেথায় গেলে মাদল পাবি, মেয়ে-মরদের আদর পাবি … সত্যি সেথায় পাওয়া যাবে মেয়ে-মরদের আদর! যখন খুশি মাতাল-মনে বাজাবার এক পাগলপারা মাদল! যাবে পাওয়া? সেথায় গেলে! … হেথায় তোরে মানাইছে না গো, ইকেবারে মানাইছে না গো … এই চামার এই ডোম এই ধ্বজভঙ্গ এই কথা-বলতে-কোঁকায়-কুঁথায় কিন্তু-কুচক্রান্তে-ক্লান্তিহীন শূকরশাবকদের পাশাপাশি বেঁচে-থাকা, শ্বাস-নেয়া … থুঃ! …
৫.
বহু বহু কাল আগে, কবেকার ধূসর ধূসরতর দশকে, এই দেশে একপ্রকার তরুণাস্থিস্পন্দন ছিল বিশেষ ধাঁচের ক্ষুদ্রবপু মুদ্রিত পত্রিকাকেন্দ্রিক। গুটিকয় লোকে এই জিনিশ করত ও দেখত, ততোধিক গুটিকয় এতে লিখত ও গুটিকয়ের পেটের ভেতর ততোধিক গুটিকয় যারাই লিখত এতে তারাই পড়ত এবং কোনোদিন দু-নয়নে দেখেও নাই হেন স্পন্দিত তারুণ্যের কর্মযজ্ঞ বর্ণিত গুটিকয়ের বাইরের কেউ, খুব গুটিকয় লোকের মধ্যেই সীমায়িত ছিল এর পরিচিতি। লিটলম্যাগ ম্যুভমেন্ট নামে স্বর্ণপ্রস্তরঘটি যে-জিনিশটা একেবারেই কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে এতদঞ্চলের সাহিত্যে, তারই এক অন্য ধরন দেখা যাচ্ছে এখনকার তরুণ গাইয়েদের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক’ ব্যাপারটাতে, দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে লেখালেখিলিপ্ত অজস্র তরুণের কমেন্টে-নোটে, দেখা যাচ্ছে ব্লগে বিচিত্র পোস্টে, দেখা যাচ্ছে ওয়েবম্যাগে, লিট্যার্যারি পোর্ট্যালে। এইখানেই, ডিয়ার দুঃখিনী বাংলা অ্যালফ্যাবেট, গোঁ-ধরে-বসে-থাকা বাংলা গান প্রিয়তমা, আজন্ম বুনো শূয়োরের ক্রোধ নিয়া যারা অন্তে-গরম-শিক জেনেও উত্তুঙ্গ ধূলিঝড়ে অস্ট্রিচের ন্যায় মাথা বালিতে গুঁজে রেখে ছ্যাবলামো করতে চায় না, হাল-জমানার প্রযুক্তিস্ফীতি তাদেরে একটু হলেও সসম্মান বিকাশের স্পেস করে দিয়েছে। এছাড়া উপায় কই? কোথাও নেই মর্যাদার একটুখানি জায়গা অবশিষ্ট। যার হাতে কড়ি, সে-ই ধরে ফেলছে শিল্পের লেজ। ধরে রাখছে শিল্পের লাগাম দুই হাতে কষে। আর, কিছু লোক সেই টাকাওয়ালা ফালতুদের পিছু মুচকিমিচকি হাসিখুশি-উদ্বেল! সে-তুমি যেখানেই যাও, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে বাউলা গানের আসর, পাঁচহাজার বিডিটি টিকেটে প্রবেশযোগ্য সুফি ফেস্টে কিংবা একহাজার রুপাইয়া হাদিয়ার কিমৎ চুকায়ে ইন্ডিয়ান আইডল ইনভাইটেড কবিদেবদিগের পার্ফোর্ম্যান্সে সুপারহিট পোয়েট্রি-রিসাইট্যল প্রোগ্র্যামে, চিত্র কিন্তু একই এবং চিত্র চমৎকার …
৬.
তুমি একটাও ফুলের কথা লেখোনি, একটাও লেখোনি তুমি পাখপাখালির গান, পাখির ক্বচিৎ উড়ে-যাওয়া; কিংবা যেমন আজ দুপুরে আপিশ-অরণ্যে — তোমার কাজের জায়গাটি তো বেশ অরণ্য-অন্বিত, সবুজে শোভিত, পাখপাখালিতে প্লুত, ফড়িঙে আর ফলপাকুড়ে ভরভরন্ত বেশক; — আজ দুপুরে আপিশ-অরণ্যে সহসা একটি পাখি তোমার চোখের ওপর ছিটিয়ে গেল তার শরীরবল্লরী, কই, তুমি তো দেখি তার কথা লিখলে না! এই দ্যাখো, উড়ে-যে গেল তোমার চোখ-মুখে ছিত্রি দিয়া তার সুতন্তু শরীর-সুষমা, সে কি আলবৎ পাখি ছিল, নাকি ছিল পাখিনী কোনো-এক? তুমি তার কথা লিখবে না? তার গান? তার ডানাকিনারের ডোরা? তার মাথায় খানিক কেশর কিংবা মোরগফুলের ঝুঁটি? অথবা, এই যেমন আজ রোদ দিলো কী ভীষণ, তারপর রোদ-ফোকরে হেথা-হোথা ছায়া দিলো কী গহন-মগন, তার বিবরণ কে লিখবে শুনি? কে বলো লিখবে তবে এদের কথা — এই ফুলের ফিরিস্তি, চাঁদের চামর-দোলানো রূপকাহিনি কিংবা পাখির প্রতিবেদন? এত পাতা পেরিয়ে এলে, তবু তুমি একটাও কোনো ফুল কিংবা পাখি কিংবা ছায়া কিংবা রোদ কিংবা গান কিংবা দুইপাশে-দেখা ধানক্ষেত লিখলে না! কী হে, কী হচ্ছে এইসব? যত্তসব যন্তর-মন্তর, যুক্তি-তক্কো-গপ্প আর গোব্রেপোকার সারগাম সাধিতেছ দিবারাত! আর অবিরাম অবিরাম আত্মকুণ্ডয়ন! বাংলায় বিগত বছর-বিশেকের লেখালেখিচর্চায় যা-কিছু হয়েছে, তার মধ্যে একটা কমন ব্যাপার দেখতে পাবে তুমি; সাধারণ এবং প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে বহমান ওই ধারা ও ধরন, যার ফলে ব্যাপার বেশ অস্বাভাবিক ঠেকে। ব্যাপারটা হলো, সমস্ত লেখালেখিই প্রায় ব্যতিক্রমবিহীন ভেতরের-দিকে-গুটোনো; বিশেষ করে কবিতা। বাইরে এতকিছু ঘটে চলেছে ঘটনা-অঘটনা, সেসবের কোনো প্রভাবই পড়ছে না লিখিয়েদের মধ্যে! চারিপাশের এত বিকার এত বিবমিষার বিস্তার কবি-সাহিত্যিকদের ভেতরে কোনো রেখাপাত ঘটাচ্ছে না! একটা পুরো সময় ও সংঘ-অসংঘবদ্ধ সাহিত্যসমাজ এতটাই অন্তর্মুখী, মেনে নেয়া যায়! হ্যাঁ, স্বভাব-অন্তর্মুখীনতা হলে সেটা স্বাভাবিক বটে; কিন্তু সকলেই যখন সমান ও অভিন্ন অন্তর্মুখী, তখনই বুঝতে হবে ব্যাপারটা স্বভাবজ নয়। যেমন স্বাভাবিক নয় সবাই যদি সমানতালে চিৎকারিয়া ওঠে, কিংবা কলমীলতার ঝাড়ে যদি রডোডেনড্রন ফোটে! এইদিকে দেখো কেমন আরামসে নোকরিবাকরি-ব্যবসাপাতি চালাইতেছ তুমি, আর বাগদত্তা বাংলা-কবিতার সনে বিবাহ তোমার ভেঙে যায়, ভেঙে যায়! আর কবিতা তো অধিকন্তু তেমনধারা মর্তবার কিছু না, দেখিয়া-শুনিয়া মনে হয়, কবিতা ম্যাক্সিমাম থার্টিফাইভ-এমএম পার্ফোর্ম্যান্সের পরাকাষ্ঠা আজকাল। হায়! আমি-তুমি আমসত্ত্বের তুমতুমিতে আবিল হয়ে আছে অধুনা বর্ষাবিরল বাংলার ঘনঘটাময় কবিতার আকাশ; এর বাইরে কিছু নেই? আছে; — মুমূর্ষু মরমিপনা, রাংকাগজের রহস্য-স্যস্যার, ভাবান্দোলনের বুজরুকি, ঐতিহ্যের ঐরাবত, বানানো বেদনা ও বুদবুদ, ব্যক্তিক প্রতিভার বাঁদরামি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পৌরোহিত্যপ্রকল্প, ফাজলামি-ফিচলেমি-ফস্টিনষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বোপরি, দূর নয়, দিল্লি যাওয়ার আগের স্টেশনে অবস্থিত দাদাদেশ থেকে আমদানিকৃত রেডিমেড অ্যালিগোরি-এপিথেট আর অনচ্ছ ঘষাকাচে সয়লাব হয়া আছে তোমার দেশের জশ্নে-জলসাগুলো। পথ খুঁজে চলেছ তুমি, বেরোবার। চেষ্টা করছ তুমি। চেষ্টা করছ ওই গা-জ্বালা-ধরা আত্মকুণ্ডয়ন থেকে নিজেরে উদ্ধরণের। এইসব ওইসব সেইসব থেকে খুঁজিয়া চলেছ তুমি পরিত্রাণপথ, ক্ষ্যাপা যেমন ঢুণ্ডিয়া চলে পরশপাথর। বেলাশেষে ব্যর্থ হবে হয়তো, কিন্তু ওই আত্ম-আচ্ছন্নতা আপাতত তোমাকে দিয়ে সম্ভব হচ্ছে না আর। তারচে বরং বহুদিন-না-লেখার বিবিক্ত বিচ্ছিন্নতা ঢের ভালো। ভালো বরং আধশুয়ে স্রেফ দিনলিপি লিখে চলা। কিংবা কিচ্ছুটি-না-লিখে কেবল চুপচাপ থাকা, চেপেচুপে থাকা, আর খুঁজে চলা শীতপাখির ডিমের খোসায় অপার্থিব আভা। এ-ই তো, এইটুকুই, এই খুঁজে চলাই সমস্ত, সব। পাও বা না-পাও পথ, পারো বা না-পারো তুমি, এই চরৈবেতিক্রিয়া, এই খুঁজে চলা নয় জেনো মোটে হেলাফেলার। যেমনটা এখানে, এই নিবন্ধখানা ফাঁদতে লেগে অনিচ্ছুক অদৃশ্য পাঠকেরে সজোরে শুনায়ে গেলে সাড়ম্বর আত্মজীবনাংশ, কবিতায় যেন এমনধারা না হয় কখনো। অক্ষরে যদি অঙ্কন করো আত্মপ্রতিকৃতি, অন্যে যেন আপনার করে ভেবে নিতে পারে তারে। কিংবা যদি অঙ্কন করো অন্যের আননখানি, যেন তা আবার নিজের বলেই চিনে উঠতে পারো। এ-ই হলো শিল্প, তোমার কাছে, এ-ই হলো কবিতার কথা। আর কবিতা নিয়ে ওইরকম আলাদা কোনো ভাবনা আছে তোমার? আলাদাভাবে ভেবেছ কখনো, কোনোদিন, কবিতা নিয়ে? আলাদাভাবে ভাবা মানে জীবন থেকে জিনিশটাকে বিযুক্ত করে ভাবা, বিচ্ছিন্ন করে ভাবা। তার কী কোনো দরকার আছে? কবিতা ও জীবন একই জিনিশেরই দুইরকম উৎসারণ, বহু আগে বলে গিয়েছেন জীবনানন্দ নামের একজন। আর জীবন জিনিশটাই-বা কি আসলে? পদ্ধতিগত কোনো বিজ্ঞান বা দর্শনপ্রসূত মহাকায় বস্তুবিশেষ? প্রাত্যহ পল-অনুপল, দণ্ড-মুহূর্ত, দৈনন্দিনের জটিলতা ও জঙ্গমতা, দেখা-অদেখা মুখ-মুখোশাবলি, জল-মাটি-পাখি-গাছ বাতাস ও বালিহাঁস, প্রেম-অপ্রেম-আলো-অন্ধকার, ঘৃণা-বিবমিষা-বিষাদ-বাৎসল্য-বিদ্রোহ-বিরহ-মিলন, মৃত্যু ও মাদলের সুর … এই-ই তো, এইসব নিয়েই তো, জীবন। অতএব আলাহিদাভাবে কবিতার কায়-কসরত নয়, সম্পাদকরঞ্জন খুবসুরত সো-কল্ড্ সাহিত্যচর্চাও নয়, ‘একই জিনিশেরই দুইরকম উৎসারণ’-বাক্যাংশে বিবৃত অনির্দেশ্য-অপরিসীম যে-উৎসের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে আবছা-আবছা, সেই উৎসটিরে যদি ট্রেস করতে পারো, যদি তারে বসাতে পারো বর্ণের আসনে একবার, তবেই তোমার সূর্য ওঠা সফল হবে সকালবেলার সুরম্য টেবিলে।
.
৭.
বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ-থমথমা রাত, ধরা যাক, অথবা একঘেয়ে মেহগনিবৃক্ষের মর্মান্তিক নগুরে-নৈসর্গিক বাকরুদ্ধ বিভাবরী; এবং আপনি জাগরণে, নিঁদ নাহি আসে তব আঁখিপাতে। ধরা যাক, ঠিক এমন মুহূর্তে, বসিয়া দাওয়ায় অথবা ক্যাক্টাস-টবে-ঘেরা ছাদে, আপনি করছেন বাংলা কবিতার ময়নাতদন্ত এবং সেইসঙ্গে মুসাবিদা করে চলেছেন এর সুরতহাল বিষয়ক সন্দর্ভ। ভেবে গলদঘর্ম আপনি, ধরা যাক, বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়া। বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কী, যদি জিগ্যেশ করেন, উত্তরে অঙ্গুলিনির্দেশ আপনারই দিকে। বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ, নিঃসন্দেহে, নির্ভর করছে আপনার ওপর। তরুণ কবি, দূরপ্রান্তে ধ্যানরত ধীমান কবিতাভাবুক, আপনার ওপর, তোমার ওপর, নির্ভর করছে, এখন, এ-মুহূর্তে, এই অসহনীয় সুবাতাসময় সুশীল সুখী-সুখী সাহিত্যসময়ে, বাংলা কবিতা। তরুণ কবি, জানি, এই গর্দভ-গণ্ডার-গবয়-গোমূর্খের সঙ্গে এককাতারে একাসনে একপাতে বসে-পড়া প্রকাশপ্রসেসের ধার ধারেন না আপনি। তবু, এবং ওই-কারণেই, গাধা-গণ্ডার-গবেট-গবয়-গোমূর্খের গায়ের বোঁটকা গন্ধে বিপর্যস্ত ভারী বাংলা কবিতা, অপেক্ষা করছে আপনার। নির্ভর করছে, আপনার ওপর, তরুণ কবি, তোমার ওপর। স্পর্ধা-গরজানো, ভেতরে ভেতরে গতি-পুষে-রাখা আপাতদৃষ্টে দুর্গত কবি, বাংলা কবিতার সনে আপনার বিবাহমুহূর্তের বেলা যে বয়ে যায়! কখনো কখনো এমন সময় আসে, আপনি জানেন, তরুণ কবি, যখন মেধার চেয়ে বরং স্পর্ধার দরকার হয় বেশি। মিনমিনে মেধা, নাকি স্পন্দিত স্পর্ধা — তরুণ কবি, সিদ্ধান্ত আপনার। লোকমুখে-প্রতিষ্ঠিত আদতে অপ্রামাণ্য কিংবদন্তির পুতুপুতু প্রতিভা, নাকি কথিত প্রতিভার পশ্চাদ্দেশে-ঘা-দেয়া আবাল্যলালিত বঙ্গনৈতিকতার পতন — তরুণ কবি, সিদ্ধান্ত আপনার। তরুণ কবি, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সঙ্গে বহু বছরের সাধনায় গড়ে-তোলা মজবুত ও টেকসই ব্রিজ ভেঙে যাবার ভয়ে ভ্যাবদা-ভোদাই হয়ে বসে-থাকা, আশা করি, আপনার পোষাবে না। বাইফোকাল-ফোকর দিয়ে দিনমান ভরা-কলসির ভান বুনে-যাওয়া, আশা করি, আপনার পোষাবে না। মিউমিউ মুদ্রিত মূষিক হবার খোয়ায়েশ, আস্থা রাখি, আপনার নেই। মিট্টি-মিট্টি বাত, আর মিস্টিক-মিস্টিক ভার্স — হেনতর ফার্স কাঁহাতক আর, তরুণ কবি, বলুন? তরুণ কবি, ভাবুন, সিদ্ধান্ত নিন। কি ভাবছেন, তরুণ কবি, বাংলা কবিতার কেষ্টঠাকুরটি হয়ে কদম্বতলায় বসে থাকবেন, রাধাভুলানিয়া মোহন-মধুর মুরলী বাজাবেন আর মুচকি-মুচকি মুস্কুরাইবেন, লাইক ইয়োর অ্যান্সেস্টর্স? শেইম! মুখে বেশ ছোটকাগজের প্রতি প্রেমপ্রীতিভালোবাসা-হৃদয়ের-যত-আশা, মাগার মাকাল ‘সম্পাদক’ বেচারীর চুরিচামারি-করে-ছাপানো অতীব দুঃখের ধন কাগজটির তিরিশ শতাংশ গাপ্ করে গিলে-ফেলা! ওহো হো ম্যারে ইয়ার, ‘ছোটকাগজ করে এত কমার্শিয়াল হলে কী চলে’! হাহ্ ! প্রশ্নগুলো সহজ, তরুণ কবি, আর উত্তরও তো জানা। আপনার অজানা কিছুই তো নেই এই ধেড়ে-ইঁদুরে-কেটে-ফেলা ধূসর ধরাধামে। তবে আর দেরি কেন, তরুণ তুর্কি, কষান আপনার উত্তর-থাপ্পড়! আমাদের সম্মানচামড়া ছিঁলে যাক, ছিঁড়েখুঁড়ে যাক, আপনার আতপ্ত আঘাতে। আপনি কি লক্ষ করছেন, তরুণ কবি, কিভাবে ‘করছে’ তারা বাংলা কবিতাকে? ‘করছে’ সামনে থেকে, ‘করছে’ পেছন থেকে, ডান থেকে বাম থেকে ডান-বাম থেকে; ভূতলে শুইয়ে ‘করছে’, চত্বরে বসিয়ে ‘করছে’, ‘করছে’ থরে-থরে বেড়ে-ওঠা পত্রিকাপ্রাসাদে; কাঁচা পুঁজি হাতে-থাকা হঠাৎ-গজা পেটমোটা লিটম্যাগলাল্টু হাবা কবির হাতে লাঞ্চিত-শ্লীলতাহৃত আজ বাংলা কবিতা। লক্ষ করুন, তরুণ কবি, ‘কবিদের নিজস্ব বনানরীতিতে মুদ্রিত’-ফুটনোটে শোভা পাচ্ছে আজিব-আদল আক্ষরিকার্থে আকাট মূর্খের আদিভৌতিক আখর! কবিমুখনিঃসৃত মধুবিবৃতিগুলি সচরাচর এমন : কবিতা বোঝবার বস্তু নয়, কবিতা উপলব্ধির, স্রেফ অনুভবের! তা, তরুণ কবি, তুমিই বলো, বুঝতে গেলে মাথা লাগে, করোটিকোটরে একটা-কিছু অন্যবস্তু-উপস্থিতি লাগে, কিঞ্চিদধিক হৃদয়ও; কিন্তু উপলব্ধি-অনুভবের বেলায়? মস্তক? — নৈব চ নৈব চ। তবে? কী থাকে আর — উপলব্ধি-অনুভববোধক অঙ্গ — শিশ্ন? গুরু, হেগোর অনুভব-উপলব্ধিমারানো মালগুলান পইড়া বাঁড়াও তো খাড়ায় না দেহি! তরুণ কবি, ক্ষমা করবেন। — ক্ষমা! কিসের তরে! খিস্তির চেয়ে কোনো অংশেই পৃথকতর শোভন-সুশ্রাব্য-শ্লীল নয় আপনার প্রতিবেশ। খিস্তিই হোক, অতএব, আপনার প্রাথমিক ও পরিস্রুত প্রকাশমাধ্যম। তরুণ কবি, তাল-তমালের ঝুঁটি-ঝাঁকানো তাম্রবর্ণ ত্রাতা, খিস্তি চাই … খিস্তি! যাজক-যজমান-পুরোহিতদের পিলে-চমকে-দেয়া পবিত্র খিস্তি, এখন, এ-মুহূর্তে, এইখানে, একমাত্র ও নির্বিকল্প আপাত নিস্তার। না, ভয় নেই, তরুণ কবি, খিস্তি-খেউড়ের খেলো খতিয়ান হবে না আপনার কবিতাকাজগুলো; কেননা আপনার ঝুলিতে আছে ‘ট্র্যাডিশন’, আছে অনির্বচনীয় ‘ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্যালেন্ট’। তরুণ কবি, ভয় কী আপনার! খিস্তি দিন, খায়েশ মিটিয়ে খিস্তি দিয়ে নিন শুরুতেই, হে বেয়াড়া বেয়াদব! এই তো মাত্র ক-টা দিন আর, এরপর তো কুলকুচি করে শ্রীরামকৃষ্ণ সকলসহিষ্ণু স্বামীজী হয়ে যাবেন — সংসার আপনায় সাতপাকে বেঁধে ভেড়া-মেষ বানাবেই! তার আগে যে-কয়টা দিন …; তরুণ কবি, যাবিই যখন, দাগ রেখে যা! তরুণ কবি, মফস্বলের ম্যান্দামারা মিনমিনানো ট্রেডমার্কখানি … না, আপনাকে মানায় না। তরুণ কবি, তাকিয়ে দেখুন, প্রতিভাহীনতার প্রকৃষ্ট প্রকাশ আজকের বাংলা কবিতা। বুড়ো বয়সেও বলদ বিষয়ে বাক্যরচনায় নিরুপায় না-পারগ, বাংলায় রচিত যে-কোনো পুস্তিকার প্রথম অনুচ্ছেদ দ্রুতপঠনে ধ্বজভঙ্গ — এরাই আজি বাংলা কবিতার রঙচঙে রাখোয়াল! হ্রস্বৈকারে নির্বিকার ‘রবীন্দ্রনাথ’-লিখে-আসা আঠাশবর্ষীয় আকাট আদুভাই, ছড়া-পদ্য দূর-অস্ত একটিও ঘুমপাড়ানি গান বুকে না-থাকা ব্যক্তিবিশেষ — ইহারাই আজ বাংলা কবিতার বিশেষিত বিচারক! না হে না, অদ্ভুত আঁধার এ নয়! এই তো, তরুণ কবি, এটাই আপনার কাজের সময়। টেনে তুলুন আস্তিন আর গুটায়ে ফেলুন পাৎলুনপ্রান্তিকা! তরুণ কবি, ভাবী বাংলার কবিতানির্বাহী, এটা কাজের সময়, কেবলই আদিকালিক অদ্ভুত আঁধার এ নয়। এ হচ্ছে আপনার, তরুণ কবি, কাজের সময়। অনেক তো যোগালি দিলেন জীবনে, কামলা খাটলেন আমড়াবাগানে অনেক, তরুণ কবি, আর কত? এইখানে রাখুন আপনার আইডেন্টিটি, এই নিরালোক নভোমণ্ডলে ভাসন্ত ভূর্জপত্রে, আবহমান এই বাংলা-কবিতার ছেঁড়া তালপাতায় রাখুন আপনার সিগ্নেচার। টিউশানি থেকে ফেরা-পথে ক্লান্ত কবি, চাঁদের দিকে চোখ রেখে ছাত্রীর একফোঁটা মুখ মনে-পড়া বিধুর কবি, অথৈ অভিমানে আঁকুপাকু অমল-ধবল বিষাদমুরতি কবি, শ্বাসরুদ্ধ শহরে সহসা-বহা বিরল বাতাসে ভেসে-আসা দূরবাসী বন্ধুর অনাদি অছোঁয়া শরীর-শিহরা আননস্পর্শে বিদীর্ণ বসন্তযুবা, ঘাড়-গুঁজে-লেখা আর ঘাপটি-মেরে-থাকা — কত আর! অদ্য ফুল খেলবার দিন নয়, প্রিয়, নহে অদ্য ওপেন-টু-বাইস্কোপ-দিন। দিন তবে দিন-বদলের? না, তরুণ কবি, বদলে দেবার বাজনাবাদ্যি হয়েছে অনেক … অনেক বছর ধরে পথ হাঁটিয়াছ তুমি প্লাতেরোর পাশে … দেখেছ বেশুমার বদলের বাঁদরামি, দেখিয়া চলেছ বহু বুড়াধুড়া বলদের বলদামো, বাঁক-ফেরাবার বাকবাকুম যত বৃহন্নলাদের … কত আর! এইবার, তরুণ কবি, এইবার এইবার তোমারও সময় হলো শকুন-শকুনীসনে পাশা খেলিবার। সময় হলো পচনকে পচন আর প্লাতেরোকে প্লাতেরো বলবার। প্লাতেরো কি জানে তার মর্মপরিচয়? তুমি জানো, হিমেনেথ, শুধু তুমি জানো। আর জানে বাতাসে-ব্যালেন্স-রেখে বগল-বাজিয়ে-বাঁচা ব্যালে-নর্তকেরা। কিন্তু তারা তা বলে না। তারা তা বলে না ভয়ে মঞ্চ-হারানোর। যেহেতু তাদের পেশা ব্যালে ও ব্যবসায়! উপরন্তু সার্কাস-সার্কিটে গাধার ভূমিকা কভু অস্বীকার্য নয়। তরুণ কবি, গাধানুকূল্যে তুমি একপা-ও এগোতে রাজি নও, জানি। রাজি নও যোগ দিতে গাধা-গরু-গুম্ফহুলোর সম্প্রীতিসঙ্ঘে — যারা কায়মনে প্রচারিয়া চলে কেবল কদলীবৃক্ষের কুশল, খড়খৈলভূষির কালোয়াতি খেয়ালগীতিকা আর এঁটোকাঁটার জাতীয় অ্যান্থেম। তুমি তো তাদের মতো নও, যারা বাস্কেটে ছুঁড়ে না-ফেলে প্যাট্রোনাইজ করে যায় যত্ত বাজে-কাগজের! বোধবুদ্ধিহীন বাচ্চাতোষ বন্ধুর ব্যথিত করুণ মুখ দেখতে হবে — কেবল এই মানবিক মমতায় দ্রবীভূত হয়ে তার কচিকাঁচা কুচ্ছিৎ ‘কবিতা’ আর-কত সাত-এগারো-সাতাত্তর বছর প্রশ্রয় দেবে তুমি! তোমার আজকে-দেখানো করুণা, তুমুল তরুণ কবি, আগামীকাল অপরাধ গণ্য হবে। আর-যা-ই-হোক, কবিতার প্রতি অপরাধ, ওহো কবি-তরুণ, অনুমোদন করবে তুমি! তৃণসম দহিবে না তব ঘৃণা তাদেরে — যারা কবিতা-কবিতা খেলে চলে ফ্রম ক্রেডল টু দ্য গ্রেইভ্? কবিতা ক্রীড়াসামগ্রী নয়, যেমন কবিতা নয় সেক্রেড স্ক্রিপ্চার; রাইট? নতজানু হয়েই ছিলে তুমি, এখনো যেমন আছো, কবিতা-সঙ্কাশে; ফের বুক-টানটান দাঁড়াবে যদি, সে-তো কবিতারই কাছে! কবিতা হাতিয়ার নয়, তরুণ কবি, কবিতা যেমন নয় হাত — হনন কিংবা লালনের; হাত ও হাতিয়ারের উর্ধ্ব অথবা অতীত — কবিতা; কবিতা সোপান নয়, সরোবরও নয় — সোপানে বা সরোবরে মেলে না কবিতা; তর্কে মিলায় না কবিতা, বিশ্বাসের সনেও তার আজন্ম বিচ্ছেদ; কবিতা রয়েছে, সম্ভবত, কেবল কবিতাতেই। অরুণ-বরুণ-কিরণ ওগো তরুণ কবিবর, নও তুমি নও শুধু স্বপননির্ভর; তুমি পর ও অপর সকলগণের শব্দ-অধীশ্বর; কিছুটা-বা তুমি রূপনারাণের কূলে বসে-থাকা অপরূপের ধীবর। পরা-অপরাজাগতিক তুমি যুগপৎ অনিত্য ও অজর। এত শাস্ত্র এত শস্ত্র এত বুশ এত মায়েস্ত্রো হ্যুগোশ্যাভেজ-ফিদেলক্যাস্ত্রো কিছুই তোমার আদৌ কোনো ব্যাপারেই লাগবে না, যখন তুমি আসবে। ডিয়ার বাফালো সোলজার, এই ব্যারেন বাংলা-কবিতা আর এই জরুরিঅবস্থার আজ তোমাকেই দরকার! বিষণ্ন বুনো মোষ, আরণ্যক এই নৈস্তব্দ্যে তুমিই উঠিবে ফুঁৎকারি ফের আদিম ওঙ্কার! ওহে যাজক ওহে যোজক ওহে তস্কর গোলাম-নফর দিনানুদৈনিকের নোকর জংলী হে জানোয়ার, এই বাংলাখোরদের খোঁয়ারি কাটাতে আজ তোমাকেই দরকার! আপনি পারবেন, তরুণ তুখোড়, তুমিই পারবে ভাই! হবুচন্দ্র মহারাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রীগুলোর গদালস্করী বোলচালবাজি ভেস্তে দেয়া চাই। ওরা যা পারেনি, আমরা পারিনি, তোমার যেন সাধ্যে থাকে তা-ই। ঢুকবে তুমি ঠাকুরঘরে, আলবৎ, কলা খেতে নয়, কেলেঙ্কারী ঘটাতে। অতি আঁতেল আলু-পটলের অনন্ত বিরানব্বইপৃষ্ঠা বিষ্ঠা ভূঁইচাপা দিয়ে তুমি তাতে পুঁতে দেবে স্রেফ একশব্দ কি অশব্দ একটি কবিতা … স্বাগত তরুণ কবি, এই বিরানায়! স্বাগত তোমায় বাংলা-কবিতার আবহমান ঠিকানায়। গঠিত হও, শূন্যে মিলাও, শূন্য থেকে তুলে আনো ফের পূর্ণ-অন্তঃসার। এসো, ঝরাও এসে জেঁকে-বসা এই শীতে বিগত বর্ষার ঝমঝম। স্বাগত হে সশব্দ সন্ত! সর্বনাশের আকুল আশায় তোমাকে স্বাগতম! শুভ গ্রীষ্ম শুভ বর্ষা শুভ শীত শুভ বসন্ত শুভ অঙ্কুরোদ্গম! এবং শুভ অন্ধকার…
৮.
কোনো অর্জন কি নেই তবে, এই সময়ের? এই সময় মানে তোমার সময়, তোমার দশক। ওদিকে শোনো সিরাজুদ্দৌলারা যাত্রাচিৎকারি চলিয়াছে তারস্বরে : বাংলা কবিতার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, কে আসি ভরসা দেবে, শোনাবে আশার গান, দেবে বলারিষ্ট বটিকা এনে ওষ্ঠে … ইত্যাদি নরুন-ভাসানো নাসিকাক্রন্দন। ভুলে যাচ্ছ কেন, তরুণ কবি, দশকে দশকে কবি-লিখিয়েরা সযত্ন দশকসংকলন বানায় আর দশক পেরোবার পরপরই তারা ‘দশকের গণ্ডি পেরোনো’ অনাদি-সময়ে-আবির্ভূত বোধিসত্ত্ব ও অমর বলিয়া নিজেদেরে জাহির করিতে উঠিয়া-পড়িয়া লাগে! তুমি তো তাদের মতো ভণ্ডবাবা নও। বাটপারের ভয়ে ন্যাংটো হতেও তোমার ঘোরতর আপত্তি রয়েছে, জানি। তাই বলে একে-তাকে ডেকে ডেকে দেখাতে হবে পরিধেয় পোশাক-পরিচ্ছদ! না, তা নয়, নিজেই নিজেকে দেখা; চৌকাঠের বাইরে বেরোবার আগে আয়নায় একবারটি নিজেকে দেখে নেয়া, দর্পণে দেখে নেয়া ব্রণভরা আপন বদনখানি, যাতে যুৎসই ভেষজের খোঁজ নিয়ে ফেরা যায় বনস্পতি থেকে। সেই জন্যেই তো অমন সওয়াল : কোনো অর্জনই কি নেই, বিশেষত কবিতায়, তোমার সময়ের? ঝুলিতে কিছুই সঞ্চয় নেই, তোমার দশকের! একেবারেই কাব্যকপর্দকহীন বুঝি শূন্যদশক! এতক্ষণে, অরিন্দম, কহিতে পারো সহর্ষে দুর্বিনয় দম্ভে : যত অপ্রতুল আর অকিঞ্চিৎ হোক, অর্জন যেটুকু তাতে ভান নেই ভনিতা নেই খাদ নেই কোনো। যেটুকু সঞ্চয় তাতে সাকিন-সরহদ্দি ভালোই ঠাহর করা যায়। আর-যা-ই থাকুক না-থাকুক, রহস্য সৃজনের নামে রগড়ারগড়ি নেই তোমার দশকের কবিতায়, নেই ইঙ্গিতময়তার নাম ভাঙিয়ে ইতলামি-বিতলামি; — যা কি-না, যেসব কি-না ছিল তোমার পূর্ববর্তীদের অতিশয় প্রিয় প্রবণতা। নিজের নিঃশ্বাস নিজের চারপাশ না-চিনে ছিল নির্বিকার উৎপল-রণজিৎ-জয় আর মৃদুল-বিনয় থেকে কেটে নিয়ে কেবল ধোঁয়াশা তৈয়ারিকরণ; ছিল না দশাসই প্রতিষ্ঠান একটাও এতদঞ্চলে, কিন্তু ছিল পশ্চিমবঙ্গীয় প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অবুঝ ও অন্ধ অনুসৃতি … ছিল আরো অযুত-নিযুত আশি-নব্বই ন্যাকামো-নখরামো … তারা আজ কই সব? পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বোল-পাল্টে-ফেলা পুশিক্যাট! অঙ্গুলিমেয় দুই-তিরিজন বাদে বাকি সকলেই নিয়মিত-নাম-প্রকাশেচ্ছু উদাস-আকুল কবুতরমার্কা কবি। ভেবে দেখো, তরুণ কবি, তোমার দশক শুরু থেকেই ছিল ওইসব আরো নানান কিসিম ঢপ-ছিনালি থেকে মুক্ত। যেটুকু দেখেছে তারা, তোমার দশকের তরুণেরা, সেটুকুই সাজায়েছে সাধ্যমতো সালঙ্কারা অথবা নিরলঙ্কার ভূষায়। নবিশ ছিল তারা একসময় স্বাভাবিকভাবেই, বহুলাংশে এখনও, কিন্তু নকলনবিশ ছিল শতকরা দশমিক শূন্যশূন্য সামান্য অঙ্কই। যা-কিছু লিখেছে তারা, লিখেছে আন্তর তাগিদ থেকেই। পূর্ববর্তীদের মতো তারা পয়গম্বর হতে চায় নাই। লেখার ভেতর লালনফকিরগিরি তারা কদাপি করে নাই, কিংবা করেনি লেখা উঁচিয়ে স্লোগ্যানপঙ্কিল লেনিনলিডারি। তাদের লেখায় পাবে তুমি পরানবৈচিত্র্য আর নানা-বরন বিভা, সতর্কতায় পরিত্যাজ্য হয়েছে সেথা বমনোর্দ্রেকী ভড়ংসর্বস্ব বিদ্যার বৈভব। গুরুবাক্য ধার্য মানো যদি, বিদ্যার সঙ্গে যথেষ্ট অবিদ্যা না-মেশালে তাহা সাহিত্য হয় না; — ঠাকুর রবিনাথের ভক্তবন্ধু বা পাঁড় খিস্তিখোর লোকদেখানো পুরস্কারপুটু শত্তুর না-হয়েও তারা তা মিশায়েছে বটে সুষম সততায়, যে-অবিদ্যার আরেক নাম রস। সেসব বিচারের ভার বিকট কোনো বিদ্যায়তনিক বাম্বুসাইজ বিশারদের হাতে নয়, তরুণ কবি, তোমার কাঁধেই ন্যস্ত সেই ভার। অহেতু-অকথ্য অতীতমুগ্ধ কিংবা মাদারগাছের মতো ফাঁপামাথা মহাকালমুখো না-হলে সেই ভার তুমি স্বাচ্ছন্দ্যেই বহিবারে সক্ষম। ভুল-শুদ্ধ পরের কথা, তোমার জানা থাকা দরকার তরুণ ঘূর্ণিনৃত্যকর, লিখেছে তারা রক্তে লিপ্ত থেকে, লিখনকালে থেকেছে কেবল নিজেতে নতজানু।
৯.
নতুন বছর ঢুকে দেখতে দেখতে একজোড়া মাস অতিক্রান্ত হয়ে যায় ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গটগট পায়ে এগিয়ে আসে ভৈরব হরষে দ্যাখো মহাকাল। নতুন একটা দশক। নতুন মাত্রেরই নিয়তি পুরনো হবার ভবিতব্য। নতুন দশকের প্রায় মধ্যবয়স। মধ্যগগনে দ্যাখো নতুন দশক। নতুন দশকের সম্পূর্ণ নতুন কবিরাও, অরুণ-বরুণ শক্তি ও বাকবিভূতির কবিদল, অব্যবহিত দশকসূচনাতেই দৃশ্যপটে হাজির। সক্কলেরই রিস্ট ও চিকবোন্ সমান শক্তপোক্ত নয় এখনো, কথাও নয় থাকবার, এখনও তো অনেকেই ব্যাকড্রপের অন্তরালে লাস্ট মোমেন্টের প্রাণায়াম সেরে নিচ্ছেন, অচিরে এসে ঢুকবেন তরুণ ম্যাজিশিয়ান, দ্য আলকেমিস্ট অফ বেঙ্গলি পোয়েট্রি, ইল্যুশনিস্ট অফ বাংলা কবিতাকাণ্ড, মঞ্চ-দুমড়ানো সময়নির্দেশক নির্মাতা স্তানিস্লাভস্কি; — এরপর একটানা বিরামহীন সৃজন, স্তরান্তর, স্বরান্তর, সময়ান্তর, ভুবনান্তর। কারোরই এখনো ঘরঘাট হয় নাই, কিন্তু কনফিডেন্স চোখে পড়ার মতো প্রত্যেকেরই প্রায়, লিখছেন প্রত্যেকেই লেজুড়বৃত্তির বাইরে রেখে নিজেদেরে — এইটা তাৎপর্যপূর্ণ খুবই। কিন্তু লেজুড়বৃত্তি ব্যাপারটা খানিক বিস্তার করা লাগে এইখানে। কেননা কবিতা লিখতে যেয়ে আবার লেজুড়বৃত্তি কথাটা আসে ক্যামনে! এসেছে তো, যুগে-যুগে এসেছে, দেখেছি আমরা। প্রভাব আর লেজুড়বৃত্তি দুইটা দুই আলাদা কথা। প্রভাবিত না-হয়ে, প্রভাবচিহ্ন না-রেখে, পথচলা প্রায় ইম্পোসিবল। প্রভাবিত হওয়াটা, বা ঠিকমতো প্রভাবিত হওয়া এবং প্রভাব আত্তীকরণ, বরং প্রতিভাবানের পরিচয়। এক্কেবারে অপ্রভাবিত কবি হয় ভূঁইফোঁড়, অথবা ভূপৃষ্ঠের ধারণ-ক্ষমতাওতার বাইরে। লেজুড়বৃত্তিচারীরা আঁটঘাট বেঁধে সংঘবদ্ধভাবে একজন-কোনো কবিকে কপি করে চলে, এরা ডামাডোল করে চলে কেবল, এবং মোস্টলি সেই কেন্দ্রকবিটি সচরাচর হয়ে থাকেন লেজুড়ধরা কপিকারদের ইমিডিয়েট পূর্ববর্তী ডিকেডের কোনো কম্যুনিকেশনচৌকস কমান্ডার। প্রভাবগ্রস্তরা টের পায় নিজেদের খামতি, ফলত শুধরে নেবার চান্স ও স্কোপ পায়, কিন্তু লেজুড়ধরা তা পায় না ভাগ্যবিভ্রাটে। প্রভাব খুব মনোলীন অনুশীলনকালে ঘটে থাকে, লেজুড়কৃত্য ঘটে একপ্রকার কাল্চারাল মোবিলাইজেশনের তরিকায়। লেজুড় একটা ট্র্যাডিশন হয়ে দাঁড়ায়, ছেড়ে-দে-মা ধাঁচের একটা কনভেনশন, প্রভাব সাধারণত ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্যালেন্ট বলিয়াই হিসাবগ্রাহ্য। প্রথম দশক পর্যন্ত কবিতাসার্কিটে লেজুড়বৃত্তিচারণ দুর্নিরীক্ষ্য না-হলেও এই সময়ে, এই দ্বিতীয় দশকে, লেজুড়াচার আশাকরোজ্জ্বলভাবে এখন-পর্যন্ত কম দেখা যাচ্ছে; বা দেখা গেলেও অল্প গুটিকয়ের মধ্যে, এতে হতাশ হবারও কিছু নাই, খুবই রিডিউসিং সেইটা। যাদের দম অল্পদৌড়ের, তারা লেজুড়বৃত্তি দিয়া সাততাড়াতাড়ি কিছুটা আদায়-উশুল তুলিয়া পাততাড়ি গুটাইয়া নিক, দুরপাল্লার যাত্রীদিগের জন্য রইলই তো গোটা আসমুদ্রহিমাচল। ও আচ্ছা, ভালো কথা, ফিজিক্যালি লেজুড়বৃত্তির কথা এইখানে ক্যাল্কুলেশনের বাইরেই রাখা যাইল বলা বাহুল্য। বলা হচ্ছে লেখার ভঙ্গি-ডিকশন-ডৌল-গড়ন-ঢপ-প্রকরণ প্রভৃতি দিয়া লেজুড়বৃত্তি কিংবা ফলোয়ারগিরির রিডিকিউলিং ট্রেন্ডটার কথা। এই দশকে সেইটা, মাশাল্লা, আদৌ অত অ্যালার্মিং হয়ে এখনও ওঠে নাই। ফিজিক্যালি ঠিক ইমিডিয়েট আগের দশকের কবির সনে টেবিলগোল ঘিরিয়া বসে দুইপাত্তর মধু অথবা পাইঁট-দুই পিওর দর্শনাবাঙালি কি তিনকাৎরা কারণবারি পেটে ফেলাটা আদৌ দোষের কিছু না হয়তো, তবে লেখায় সেই সিনিয়র-দোহানো তরল ক্রিয়া করলে সেইটা আলবৎ দুষ্ট ও দুষ্কৃতি রীতিমতো। নতুন সময়ের, দ্বিতীয় দশকের, কয়েকজনের দেখা আমরা পেয়েছিলাম প্রথম মনে পড়ে ‘মেটাফিজিক্স’ নামের একটা খুদে পত্রিকায়। তেজ ও ঝাঁঝ সমেত। ২০১০ যিশুবর্ষের শেষদিকে এসে ‘লোক’ পত্রিকায় বেশ কয়েকজনের দেখা পাওয়া যায় একসঙ্গে। এছাড়া আরও অন্যান্য সর্বত্র দ্রুতই দ্বিতীয় দশকখণ্ড সরব ও সৃজনমুখর হতে শুরু করে; এবং অনলাইন-প্রোভাইডেড ওয়েবজিনগুলো তো এই সময়ের সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্র। ততোধিক বড় ও নির্ভরযোগ্য-নির্ঝঞ্ঝাট জায়গা কবিদের যার-যার ফেসবুকপাতা আর ফেসবুকেরই বিভিন্ন ফোরাম। তবে এইটা একটা ফাইন্ডিং হইতে পারে যে, প্রকাশক্ষেত্র হিশেবে ওয়েবপত্রিকা এখনো কবিতার রিলায়েবল সোর্স হয়ে উঠতে পারে নাই। গদ্যের ক্ষেত্রে এইটা হয়েছে যদিও, দুইয়েকটা খুবই গোছানো ওয়েবপোর্টাল হয়েছে এরই মধ্যে যেখানে যুগপৎ আনন্দপ্রদায়ী ও চিন্তাচাগানো গদ্যের মোলাকাত মেলে। কিন্তু কবিতা ব্যাপারটা ওয়েবে এখনো অগোছালো। সো, কবিদের ফেসবুক-নোটস্টোরেজগুলো ভরসা। পাঠক হিশেবে এই দ্বিতীয় দশকের কবিতা পড়ে আপনি আশ্বস্ত হইতেই পারেন এই মর্মে যে এরা পারবে। এরা তাদের সময়টাকে এতাবধি-আচরিত কবিতাবানানো প্রবণতা থেকে বের করে আনতে পারবে। এরা পারবে তাদের সময়টাকে টেনেহিঁচড়ে দাঁড় করাইতে মানুষ তথা মানবীয় মেধা ও ঔৎকর্ষের পক্ষে। কেবল ধোঁয়াশা আর আলুথালু রহস্য তৈরি করে যাওয়াই যেখানে দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল গত কয়েক দশক ধরে, সেখানে এই দ্বিতীয় দশকের কবিরা মনোনিবিষ্ট ধোঁয়াশানিরসনে — এইটা সাউন্ডস্ গুড বলেই তো মনে হবে আপনার কাছে। এইটা বাংলা কবিতার জন্য অনেক বড় ঘটনা, আশাব্যঞ্জনা, আলোকরশ্মি অফ হোপ। উইন্টার ডিস্যাপিয়ারিং, স্প্রিংটাইম অ্যাপ্রোচিং, নতুন কবির অভিষেক শুভ হোক। উদ্বোধন ঘটুক নতুন দিনের নতুনধারা বাংলা কবিতার। সঞ্জীবের সেই গানটা গাওয়া যাইতেই পারে এইবার, অথবা গাইতে না-পারলে নেপথ্যে এফেক্ট হিশেবে এই মিউজিক জুড়ে দেয়া যাইতেই পারে অত্যাবশ্য, ওই-যে সেই গানটা, মৃত্যুর অব্যবহিত আগের মাসে বেরোনো সংকলনে গেয়েছিলেন সঞ্জীব যে-গানগুলো, তাদের একটিতে এই লাইন : প্রভু, আখের রসে আরেকটুকু মিষ্টি দিও! … ওইটাই তো। টক হোক, তেতো হোক, মিষ্টি অথবা ঝাল, হে নতুন দিনগুলো, অয়ি নতুন দিনের কবি, ওহো নতুন দিনের বাংলা কবিতা ও গান, আরেকটুকু, খুব বেশি না-পারলেও কুল্লে একরত্তি, কেবল আরেকটুকু, যতটা সাধ্যে কুলোয় তারও উর্ধ্বে যেয়ে একটু যোগ কোরো, সাধ্যাতীত যুক্ত কোরো, হে!
১০.
রোক্কে রোক্কে, তরুণ কবি, ছিপনৌকোর মতো টানটান-উত্তেজক হে তাতার-দস্যু কবিতাকান্তিমান, এখনি অন্ধ বন্ধ করিছ পাখা! নয়তো এত হিসাবনিকাশ কেন! দ্য শো মাস্ট গো অন, এক্ষুণি কেন দশকতামামি হেন! নয় নয়, এ নহে তেন শেষের সংহিতা। হয় হয় বাহে হয়, এ তো মাত্র শুরুর বাদ্য হয়! করো অবধান, তরুণ তুলসী দাশ, ইহজগতের অধিরাজ তুমি ওহে ইমরুল কায়েস, তোমার কিসের ভয়! চরৈবেতিমন্ত্রে তুমি রহিয়াছ দীক্ষিত, পথপার্শ্বের পানশালায় খানিক জিরিয়ে নিয়ে পাখা, শুরু করো পদব্রজে ফের নরকহণ্টন। লেখা বেচিয়া হাভেলি বাগাতে উদগ্রীব তুমি নও, হতোদ্যম হবে কেন! লক্ষ্য তোমার মোক্ষধাম বাংলার ত্রস্ত ওই নীলিমার তলে সারি-সারি গুমটিঘরে একের-পর-এক খিড়কি খুলে দেয়া, আজেবাজে আলোচনাবাজদের এই দেশে তুমি আনন্দগ্রন্থিক। জরাগ্রস্ত যদুবংশ ধ্বংস করে সেথায় তোমারই হাতে অপরূপায়িত হবে এক অন্য অমৃতসমান মহাবাংলাগাথা, তুমিই সে-যুযুধান। রোহিতাশ্ব, তরুণ কবি, কোনঠে গেলে তুমি ওগো ভগ্নি ওহে ভ্রাতঃ! আমি কান পেতে রই … ওই তো নিক্ষেপের-ঠিক-আগে কবিতার শর হাতে ধনুকছিলার-চেয়েও-তীক্ষ্ণ বারুদ-অগ্রাহ্য-করা বনপ্রতিবেশী সিধু-কানু, ওই তো খনা, সন্ত-নয়-তবু-সন্তেরও-অধিক ওই তো চন্দ্রাবতী! দি ল্যান্ড অফ শকিং জয়, দি সিটি অফ বার্ন্ট ফ্লেশ, দি কান্ট্রি অফ ক্যানিব্যাল, তরুণ কবি, এই দেশেতেই জন্ম তোমার, কুণ্ঠিত হয়ো না যেন কথাটি স্বীকারিতে, এই দেশটিই তোমার যেখানে ফ্যাল্কন ক্যান’ট হিয়্যার দ্য ফ্যাল্কনার, বেঙ্গমা পায় না শুনিবারে তার বেঙ্গমিটিরে, যেখানে থিংস ফল অ্যাপার্ট, যেখানে দ্য সেন্টার ক্যান’ট হোল্ড, কেবলই সিন্ডিক্যাটের অ্যানার্কি যেইখানে, পঞ্চমীর চাঁদ ডুবিয়া যাইবার আগে যেইখানে ডুবিয়া গিয়াছে বেপাত্তা হয়ে স্যেরেম্যনি অফ ইনোসেন্স, বদমায়েশেরাই যেইখানে ফ্যুল অফ প্যাশনেইট ইন্টেন্সিটি, সার্থক জন্ম তোমার এবং যা-কিছু ধম্মকম্ম সেরে মরতেও হবে তোমারে সেই দেশেতেই। দিস্ ইজ দি গিভেন কন্টেক্সট, তরুণ কবি, বাকিটা তুমি বানায়ে নাও অযোধ্যা আপন ছেনি-বাটালি দিয়া। তারপরেও তো বলবার থাকে বহুকিছু, ভবিষ্যদ্বাণী ও অশ্রুতপূর্ব রিভিলেশন থাকে হাতে কিছু, সবসময়েই শিওর্লি দি সেকন্ড কামিং ইজ অ্যাট হ্যান্ড, যদিও প্রস্তরনিদ্রায় কেটে যায় যেন যুগযুগান্ত, টোয়েন্টি সেঞ্চুরিস্ অফ স্টৌনি স্লিপ, তরুণ কবি, কিচ্ছুটি নিরাশার নয়, কেননা ওই তো তোমার আগমনদামামা ও দাপুটে হ্রেষাসুর শোনা যায়! এবং এই হলো ইতিহাস, অতি সংক্ষেপে। এপিটাফ ও অবেলিস্কের এই অন্ধপ্রদেশে তোমার হাতেই রচিত হবার অপেক্ষায় তাবৎ এপিস্টেমোলোজি। এই হলো ইতিহাস, অতি সংক্ষেপে, তোমার স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ এবং ভবিতব্য এ-ই।
লেখক পরিচিতি
অনিয়মিতভাবে লেখালেখিলিপ্ত, মূলত নোটক, মুখ্যত প্রকাশবাহন ফেসবুক