ইছামতি ও শবের ট্রাক । হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০১৫, ৩:২৩ পূর্বাহ্ণ, | ২২১৮ বার পঠিত
যখন নগরের ঘুম ভাঙ্গবে
যখন নগরের ঘুম ভাঙ্গবে তখন একটা
পাখি থাকবে ভাঙ্গা রাস্তাতে; মৃতপ্রায়—
মরতে মরতে মরে যেতে যেতে—সে তার
ডাক খুঁজবে সকালবেলার; ভোরেরবেলাতে
একটা বটেরপাতায় কালো পিঁপড়া দেখে
একটা জানালায় কারো বিরান মুখ দেখে
কী শূন্যতায় ঝুলে ঝুলে নেমে গেছে রোদ
অপরাহ্নে—কোন এক প্রেমিকের পিঠে; কোন
কৃষকের পা’য় থাকা শুকনা কাদায়; কী শূন্যতায়।
মরতে মরতে মরে যেতে যেতে সে তার ডানা
খুঁজবে—যখন উড়তেছিল; যখন সে উড়ত
তার বউটারে নিয়া বাতাস ভেঙ্গে আকাশ কেটে
অসংখ্য বিকালে কোন কোন বৃষ্টির দিনে
বৃষ্টির পরে বৃষ্টির ঈর্ষায়—
যখন নগরের ঘুম ভাঙ্গবে
পাখিটা মরে যাবে ডানা খুঁজে না পেয়ে
পাখিটা মরে যাবে তার ডাক খুঁজে না পেয়ে।
ইছামতি
ঘাসেরা মরে গেলে
আকাশের নীলটাও মরে
রোদের পেট ভরে
উড়ন্ত চিলের ভিজা চোখে
সাঁকো ধরে অস্ত দুপুরবেলায়
তুমি ভাসো—
মরে যাওয়া ঘাসের ‘পরে
মরে যাওয়া নীলের শূন্যস্থানে।
আমি ধানের উদ্যানে
ছায়াছায়া আবছায়া অপছায়া
তোমার দিকে এতোটা আসি
মাঝখানে নদী
বয় ইছামতি নদী
শরশর শরশর শরশর
টানে আমার সঙ্গীত
টানে তোমার কানে
তুমি নদীর পাড়ে থাকো
তুমি নদীর পাড়ে রাঁধো।
তখন চিলের শহরে
যেখানে ইছামতি নাই
চিলের ভিজা চোখে ডুবে
রোদেরা বেঁচে বেঁচে যায়।
তুমি এদিকেও ভাসো
সাঁকোর দৈর্ঘ্য ধরে
তোমার ইছামতি আনো।
আমি ধানের উদ্যানে
শীষে শীষে স্রোত হয়ে
স্রোতে স্রোতে ভেঙ্গে যেয়ে
আচমকা তোমার দিকে
বিহারে বিরাম টানি।
তুমি নদীর পাড়ে থাকো
তুমি নদীর পাড়ে রাঁধো।
অস্তসায়াহ্নেঃ
এটা আসে দিনের হালচাষ শেষে
অস্তসায়াহ্নে ক্লান্তশ্রান্ত হলে
কারো কারো ঘরে একলা মাঠে
ঘাসহীন গরুশূন্য কোন মাঠে
কোন রাখাল নাই নাই কাছে তার
কোন ভাঙ্গাচোরা বাড়ি—না হয়
মফস্বলে এক সরকারি ঘরে
শুধু সাইনবোর্ড ঝুলে—তার আশপাশে
চুপে হাঁটে কোন লোকাল বেকার
ব্যস্ত নিরালে সে দেনদরবারে—
এটা আসে তখন মনে আসে এটা
কতগুলা না—বুঝা স্বর-বর্ণ ধরে
শব্দ না থাকা বিকট কতক শব্দে
ইচ্ছে করে না—বুঝা ভাষায়
মন চায়, এরে ধরে যদি রাখা যাইত
কোন কারো হাতে; ধরো, তোমার হাতে
তাদের নাড়তা, নেড়ে দেখতা তুমি
রাখালের নিখোঁজ বাড়িটা হয়ে
তাদের নিতা তুমি ঘাসহীন গরুশূন্য
মাঠে অথবা সরকারি ঘরে লোকাল
বেকারের কানের কাছে—
ইগু আয়—যায় খালি মন’র মাঝে
ইতর বাচ্চাটার দাঁত ওঠার মত
এসে থেকে এইভাবে বড় হয়ে যায়।
এটা আসে ক্লান্তশ্রান্ত স্ব-নিঃসঙ্গ
রক্তস্রাবে—শুধু বলে ফেলা দরকার
একটা জায়গা দরকার শুধু—
সাঁজের পাখি ফিরে আসার আগে
না হয় যদি ফিরে আসে
আরেকটা ভোরে তার বাইরে যাবার আগে।
বড় নীল আকাশ প্রেমিকা
সংবিধান এখন আধুনিক গণকবর।
মনে হয়, প্রতিদিন হয়ে উঠছে মানুষের রক্ত মাংস হাড়
আর বিমূঢ় বর্ণস্তুপ শব্দস্তুপের পতিত ভাগাড়।
সড়কের ম্রিয়মাণ প্রান্ত; আমি তার
একাকী আরোহী।
টেলিস্কোপে ভাসছে যে লুব্ধক— সে আমার মিতা।
দেখছি, বর্ষার প্রণয়ীদের মত থেকে থেকে হেঁকে উঠছে
সারি সারি ভাঙ্গারির দোকান। জলহীন বৃষ্টিপাতে—
তাদের ভাঙ্গা চোয়াল হয়ে ওঠে রহস্যময়।
রহস্যে আমার মন লাগে না। তবু আজ আরক্তিম খেয়ালে
ডুবে যেতে চাই এই মৌয়াল রাত্রির বুকে।
শুধু দেখতে দেখতে—
নগরের রেস্তোরাঁয় দুলে উঠছে আলো। চিরহরিৎ এই প্রান্তর
ভরে যাচ্ছে, টেক্সাসের বিলুপ্ত কবর থেকে উঠে আসা
সফেদ হাড়ের ছায়াদের ভিড়ে।
এইসব হাড়ে কালো চামড়ার আর কোন চিহ্ন নাই।
তাই আমারও কোন প্রশ্ন নাই। এই রাত্রিতে—
ডুবে যেতে যেতে দেখি মিলিয়ে যাচ্ছে তাদের নৃত্য;
লীন হয়ে যাচ্ছে তাদের সঙ্গীত—
‘বড় নীল আকাশ প্রেমিকা; তাহার নিচে আমার
কেন ঠাই নাই’?
শবের ট্রাক
আজিকে দিনে দিনে আমি শৈশবে যাবো
খেলিতে— তাবাস্সুমের সাথে মাছ ধরতে
তাবাস্সুমের পা কেটে গেছে। আজকে—
দূর্বা ঘাস ডলে তার পা’য় ফুঁ দিবো আমি।
এইসব ভাবনা আসে। ঘুমের পরে; সকালে সকাল।
অগোচরে দিন যত বাড়ে শুধু বুড়া হইতে থাকি—
বকুল ফুলের পাশে; তার রঙ মুছে যায়।
সমস্ত শহর জুড়ে সারি সারি খালি খালি ট্রাক
চলে পাথর কাটা মাঠে—
কারো মনের পাশে সাঁকো তুলবে তারা
কোন গুম হওয়া দ্বীপে সড়ক টানবে তারা
তাবাস্সুমের পা কেটে গেছে
কোন নিস্বন নাই—আর্তনাদের
শুধু একটা ছবি—অশ্রুর
যাইতেছে বিঁধে— কোথায় যে!
ফের ট্রাকের ভিতর খণ্ডখণ্ড শবের মত ফিরছে পাথর
তোমাদের পাশ কেটে সড়ক থেকে উঠানে
তোমরা ঘুম দিতেছ একটা একটা লাশের সাথে
কেউ বলবে না আর তোমাদের বন্ধ জান্লায়
ঘাস জমতেছে; মৃতের গন্ধ নিয়া ঘরের ছাদে গাছ উঠতেছে।