অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী । জাকির জাফরান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ১:৩৮ পূর্বাহ্ণ, | ২২৯৯ বার পঠিত
তৃতীয় কবিতাবইয়ের ভেতর দিয়ে জাকির জাফরান সফর করে এসেছেন স্বসৃজিত কবিতাভুবন আরেকবার এবং উপহার দিয়েছেন পাঠকেরে সেই নির্জন অনাবিল সফরবিবরণী। এর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠা আর নদী এক জন্মান্ধ আয়না, জাফরানের দুই জীবনাখ্যান, এই দুই কবিতাবই বাংলা সাহিত্যের সমকালিক স্বর সমাবেশন ও সনাক্তকরণে একটি সিগ্নিফিক্যান্ট ভূমিকা পালন করেছে মর্মে কবিতাপাঠক মনে করে উঠতে পারবেন নিশ্চয়ই। তৃতীয়ায় এসে সেই ভুবনধ্বনিদৃশ্যগন্ধ অধিকতর অন্বিত হতে পেরেছে কবিতার নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে, এইটা পাঠক টের পাবেন গ্রন্থে প্রবেশ করে কিয়দ্দুর যেতে-না-যেতেই এবং গ্রন্থপত্রবিহার উপভোগ করবেন সন্দেহাতীতভাবে। এইখানে কবির তৃতীয় তর্পণ অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী থেকে একগোছা কবিতা আমরা পাঠ করার সুযোগ নিতে পারি, বইয়ের ভেতর গেলে এই নিরালা আচ্ছন্নকর চরাচরের পূর্ণদৈর্ঘ্য রঙিন চলচ্চিত্র গোচরীভূত হতে দেখব মন্তাজগুলো সমেত। কবিতায় একটা আসক্তিগুণ সহজেই চারিয়ে দেন কবি যা পাঠকের প্রবেশদুয়ার হিশেবে ক্রিয়া করে। এছাড়া জাকির জাফরানের কবিতা পাঠকাদৃত হবার শক্তি ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে বলা বাহুল্য। কবিতায় শিশিরস্বচ্ছ দ্যূতি, শীতভোরের ন্যায় নিশ্চুপ কুয়াশামায়া আর নরম বাঙ্ময় আলোস্ফূর্ততা জাকির জাফরানের কবিতার বিশেষ দ্রষ্টব্য। চৈতন্য প্রকাশন থেকে প্রকাশপরিকল্পিত বইটি ফেব্রুয়ারি ২০১৫ থেকে পাঠকের দোরগোড়ায়। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। — সঞ্চালক, রাশপ্রিন্ট।
শীত
হেমন্তের বাদামী ওষুধ আর চকোলেট ভর্তি লরি আসে, শীত এলে।
শীত মানে অমাবশ্যায় চড়ে পরিযায়ী মেয়ে-পাখিদের ফিরে আসা। বাঁকা বাঁকা তরঙ্গের দেশ পাড়ি দিয়ে, আমাদের যৌথ অবচেতনের জল ঠোঁটে নিয়ে। দলে দলে। এবং উপদলে। শীত এলে স্পর্শের চাদর দিয়ে দেহ ঢেকে রাখা।
আর শীতার্তের ছেঁড়া অন্তর্বাসে জমা হয় বসন্তের গান — রজনী কামার্ত হলে — এক চন্দ্রহাঁস দেখা দেয় বিছানার বিজন প্রান্তরে।
জল
রতিক্লান্ত ঘুমের মেশিন, জলে গেলে
আমাকেও নিও। অন্তর্দেশে যদি আলো জ্বলে,
বলিও সকল প্রেম স্বপ্নের সমাধি খুঁড়ে,
যেখানে ঘৃণার জন্ম সেই সবুজ নিসর্গে
সূর্যের ক্লান্তির অবসরে…
বলিও গভীর আলিঙ্গনও দূরত্ব বাড়ায় —
এই ভেবে সহস্র বৃক্ষের দিন যায়… মনোবেদনায়,
কাহারও ছুটির দিনগুলি আজ ভাগ হয় পাতায় পাতায়।
জলে গেলে আমাকেও নিও, অন্তর্দেশে যদি আলো জ্বলে,
বলিও গভীর প্রেমে, অমাবশ্যায়,
সকল অন্তর্বাসই সেই-মতো দেখা হয়ে যায়।
সান্নিধ্য
তোমাহার সান্নিধ্যের তীরে যাবো, তমঃরজনীতে।
তুমি ঘুমিয়ে পড়লে
নৌপথে শৃঙ্খলা আসে ফিরে, আর,
জলে স্থলে অন্তঃরীক্ষে যে-দিকে তাকাই
জন-অসন্তোষ নিয়েও ফুটে থাকে ফুল
তোমাহার সান্নিধ্যের তীরে, এই অমারজনীতে।
আমি
আমার এ জীবন-নকশা
বৃথা যায় প্রভু,
শুকনো পাতার নিচে আজ
চাপা পড়ে গেছি
আমি আগুন আগুন।
আগন্তুক
কত শত বেদনার উদ্ভাবক তুমি
হে আগন্তুক,
তোমাকে আসতে দেখে নিত্যদিন
মনে মনে কতবার হয়েছি শামুক।
আর ভেতরের অগ্নিকাণ্ডের দিকে চোখ,
দেখে যাও, বেঁচে আছি গালগল্পহীন।
আফিম
আফিম-মেশানো চোখ —
তোমার দৃষ্টির পথ মাস্তুলে ভরা।
এসো বসি, গান করি, শুই,
শুঁকে দেখি, কে আগে?
তুমি নাকি আমি আজ ডাকহরকরা?
ফুল
জেনেছি বিস্ময়ে —
মিথ্যেরা ফুলের রঙে বেঁচে থাকে
হাজার বছর।
ফুলে ফুলে, পিঁপড়ের পায়ে নুপূর দেখেছি কাল
অপার বিস্ময়ে।
তুলতুলে হয় ইফতার —
দিগন্তঢালুতে নুয়ে পড়ে
সূর্য; আমরা খেজুর খেয়ে,
নীলিমা ও অস্তরাগ খেয়ে
ভাঙি উপবাস। স্বর্ণোজ্জ্বল
সন্ধ্যা নামে, মসজিদের শীতল
হাওয়া বয়
দিকে দিকে আর
একটু একটু করে ঝুঁকে
পড়ি, সর্বশেষ নক্ষত্রের দিকে।
মূর্ছা যায়
ভোরের শিশির।কৃষক ঘুমায়
কিষানীও ঘুমায়
মাঝখানে ধানের প্রাচীর।
শান্তস্নিগ্ধ আফিমের ঘরে।
তাকে পেলে জানা যেত আরও কিছু স্মৃতি,
কখন কোথায় কোন শীতার্তের চোখে
পুড়েছে শিশির,
জানা যেত কোন রাতে ফুটে থাকে অনিদ্রার ফুল,
আর জনসেবকের পায়ে কেন বাসা বাঁধে
বিষণ্ন প্রবাল।শান্তস্নিগ্ধ আফিমের ঘরে শুয়ে আছে কেউ —
এখন সে দূরবর্তী কোনও বিষাদ-স্টেশন
জীবনের সফল ব্যাথারা জেগে ওঠে এইবিষাদ-স্টেশনে।স্মৃতিকাঠের বাক্সের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি
বাসর রাতের হাওয়া।
মাঝে মাঝে ঘ্রাণ নিই,
মাঝে মাঝে মাতালের মতো বেরিয়ে আসে সেই হাওয়া
টলতে টলতে বলে, মামা, ভালোবাসা কোন দিকে?
অদৃষ্ট
আজ অদৃষ্টকে নিয়ে লোফালুফি খেলা যাক।
নিয়তির কলহাস্যে ঘুম ভেঙে যায়। ওলটপালটের গুঞ্জনে মাতোয়ারা চারিদিক। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে বাস করে যে-অন্ধ দেবদূত, তার সঙ্গে ভালোবাসা নিয়ে দু-একটি কথা বলা যাক। ভালোবাসা শব্দটির ঘ্রাণ কি পায়রা ওড়ানোর ঘ্রাণের মতো? দেখতে কি চলচ্চিত্রের মতো? জীবন কি কারো আনমনে কাটাকুটি খেলা? অদৃষ্টের বিষ ও বিষাদে কুচকুচে নীল হয়ে আছে হৃদযন্ত্র, তারপরও রক্তজবা ফুটেই চলেছে। নিয়তির মুখোমুখি ফুটে থাক কৃষ্ণচূড়া ফুল।
আজ অদৃষ্টকে নিয়ে লোফালুফি খেলা যাক, চলো।