হ্যাম্পশায়ার জার্নাল । এমদাদ রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জানুয়ারি ২০১৫, ২:৫১ পূর্বাহ্ণ, | ২৮৮৩ বার পঠিত
আমি ও হ্যাম্পশায়ার
…তার পাশে কিছু শামুক, তার পাশে কিছু পাতা, গন্ধ আর ঘ্রাণ, স্মৃতি আর জীবন; বৃদ্ধা ইভলিন আর তার কুকুর,—হ্যাম্পশায়ার—গন্ধ আর ঘ্রাণ, স্মৃতি আর জীবনের। শমসের নগরের সঙ্গে হ্যাম্পশায়ার আজ একাকার। এই ছিল দশ ঘণ্টা আগের খুব স্বাভাবিক এক জীবন, ঠিক যেন স্টিল লাইফ। এর মাঝে রয়েল মেইল পৌঁছে দিয়েছে বেকেটের জার্মান ডাইরি’জ ১৯৩৬-১৯৩৭। ধূসর মলাটের ওপর সবুজরঙে লেখা স্যামুয়েল বেকেট!
জীবনের তখন কী হয়? দেখো জীবন, কতকিছু শিখিয়েছ তুমি… বেকেটের ডাইরি! আশ্চর্য অনুভূতি হয়। মনে হয় কী যেন… কোথায়, কোন দেশে এই এখন, হত্যাকাণ্ড ঘটছে! তারপর, মনে হয়, পিটসবুরগের কনসার্টে গান গাইছে ‘পোয়েটিক জাস্টিস’, আর কবি জয় হার্জো স্যাক্সোফোন বাজাতে বাজাতে গাইতে শুরু করেছেন দ্য বার্ডস… এখনই জেগে উঠবে উইনচেষ্টার স্ট্রিট। একটা বই হাতে নিলে কতকিছু হয়। কত ভাঙচুর। এই যে একটি ভয়ানক অভিনয় দৃশ্যঃ
শুয়োরের বাচ্চারা, সাবধান হবি, সা আ আ আ আ ব ধা আ আ আ আ আ ন…
ধুপধাপ আওয়াজ হয়। বাতাসে গোঙানি। চাপা। গন্ধ আসে। গন্ধ যায়। ভেঙে যাওয়া থেঁতলে যাওয়া এক কণ্ঠস্বরঃ হরিদাস, হরিদাস… সাবধান হবি…
রাজা সাবধান করে দিয়েছেন। কেউ কারো মুখের দিকে তাকাবি না।
কেউ কারো মুখের ভাষা পড়বি না।
ঘেউ ঘেউ। দূরে। থেমে থেমে। ঘেউ ঘেউ।
বাতিগুলো নিভে যায়। আসলে, নিভে যেতে চায়।
এখন, উইনচেষ্টার স্ট্রিট জেগে উঠবে।
পাশের জানালা দিয়ে হ্যাম্পশায়ারের রাতের আকাশ দেখি। মেঘ করেছে। রাস্তায় যুবক-যুবতীরা, চুম্বনরত। আগস্টের শেষ দিকে হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা নেমেছে। হাসান আজিজুল হককে মনে পড়ে, মানে তাঁর গল্পকে। এখন নির্দয় শীতকাল। ঠাণ্ডা নামছে হিম… এইসব। খোলা জানালার কারণে ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ ব্যাপারটা ভয়ানকরকম টের পাওয়া গেল। বাইরের যুবকরা হাততালি দিচ্ছে, মেয়েরা চিৎকার করে গাইছে- ওলমৌস্ট হ্যাভেন… লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার… কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ… ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া…
বুকটা হু হু করে উঠে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া! ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ আর ‘ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া’ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়? ছোট বোন’টির কাছে? মায়ের কাছে? শমসের নগরে? জানালা খোলাই থাকে। কোরাস ঢুকে পড়ে ১০ নম্বর উইনচেষ্টার স্ট্রিটের চূড়ায়। এক কুঠুরিতে।
আত্মজা ও একটি করবী গাছের ‘ঠাণ্ডা নামছে হিম’ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে আর খোলা জানালায় হ্যাম্পশায়ারের আকাশ! বাইরের রাস্তায় যুবক-যুবতীদের কোরাস- কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ… ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া; আমি যেন শমসের নগর থেকে আমাদের গ্রামের পথে হাঁটছি! সারারাত তারা এই গানটি গাইবে। তাদের কোরাসে উইনচেষ্টার স্ট্রিট আজ ঘুমাবে না!
ছাদের ওপর বসে থাকবে একজন। ফিডলার। হ্যাম্পশায়ারে রাতের শেষ হওয়া দেখে দেখে ভায়োলিন বাজাবে সে। ছাদের ওপর ফিডলার। নিঃসঙ্গতা! আহা, নিঃসঙ্গতা! গন্ধ ও ঘ্রাণ; স্মৃতি ও জীবন! বাবার খুব প্রিয় ছিল সূর্যমুখী ফুল। তার মৃত্যুর পর, ফুলগুলি কোথায় ফুটে? ভোরে, মা যখন বাবার কবরের দিকে তাকান, আমার স্থির বিশ্বাস সূর্যমুখী ফুলগুলি তখন তার বুকের ভিতর ফুটে।
ওলমৌস্ট হ্যাভেন… লাইফ ইজ ওল্ড দেয়ার… কান্ট্রি রোড টেইক মি হোম টু দ্য প্লেইস আই বিলঙ… ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া…
তাপস গায়েনের অনুবাদে, জয় হার্জো’র একটি দীর্ঘ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি পড়ে ফেলা যাক—
‘এইসব হলুদ পাখি, যারা ধূমায়িত আগ্নেয়গিরির ওপর
চক্রাকারে ঘুরে, তাদের সংলাপে জেগে ওঠে গান
এই পাথরের।’
শুয়োরের বাচ্চারা, সাবধান হবি, সা আ আ আ আ ব ধা আ আ আ আ আ ন… নতুন দিনের খবরের কাগজের শিরোনাম—স্টপ দিজ ম্যাডনেস! … আর, শিশুদের লাশ। বাবার সূর্যমুখী ফুল মায়ের বুকে ফুটছে! ভোর হচ্ছে হ্যাম্পশায়ারে, শমসের নগরে। ছাদের ওপর ফিডলার। ভায়োলিন বাজাচ্ছে। তখন, আলবেয়ার কামু তাঁর ডাইরিতে লিখছেনঃ আমি অস্তিত্বের অভিঘাতের দিকে অগ্রসর হতে অস্বীকার করি না, কিন্তু আমি এমন কোনও যাত্রাপথও আকাঙ্ক্ষা করি না, যা মানুষ থেকে দূরে সরে গেছে। আমরা কি আমাদের তীব্রতম অনুভূতিগুলোর শেষে ঈশ্বরকে খুঁজে পাব?
২০১৪; (০১-১০০) চলবে