আশিঋদ্ধ সৈয়দ হক । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪, ৬:১৪ অপরাহ্ণ, | ২৪২৭ বার পঠিত
আশিঋদ্ধ সৈয়দ হক। ঊনআশি থেকে আশিচত্বরে অবতরণ উপলক্ষে বেশ লেখাপত্তর ছাপা হতেছে, কাগুজে ও বৈদ্যুতিন মুদ্রণমাধ্যমে, সমস্তই প্রশংসা ও অভিনন্দনমূলক অবশ্য, গত দশকাধিক কাল ধরেই তার ক্ষেত্রে হয়ে চলেছে এমনতর, পর্যালোচনাবাচক একটাও না। তা, আমাদের এই ভক্তিকীর্ণ দেশে একজন লেখকের জীবদ্দশায় তার কাজ নিয়ে দেড়-দুইখান পর্যালোচনাভিত্তিক লেখা ছাপা হইলেও তো ভাগ্য বলতেই হয় সেই লেখকের। সেদিক থেকে দেখলে অবশ্য সৈয়দের কাজ নিয়ে দেড়-দুইখান প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়েছে, কেউ কেউ অভিসন্দর্ভসদৃশ কাজও করেছেন হকের কাব্যনাট্য ও উপন্যাসকৌশল নিয়া, কাজেই বলা যাবে না যে একেবারে কিছুই হয়নি। কিন্তু খুব কাজের-কাজ কিছু হয়েছে এখন-পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না। তারে একটা তকমা দিয়া আটকাইয়া রাখা হয়েছে, রেখেছি আমরা হক্কলে মিলে, একটা সর্বরোগহর ঔষধি বিশেষণ, সেইটা হইল ‘সব্যসাচী’। ব্বাস, যাও, আর কী চাই! তিনি সব্যসাচী, সো, তারে নিয়া বলার কিচ্ছু নাই আর। এই আমাদের এক অস্ত্র, অভিপুরাতনী খাঁচা এক, বিশেষণ দিয়া শ্বাস রোধ করে মারো যত প্রতিভাবানেরে। যেন আর কোনো দায় নাই, কিছুই নেবার নাই যেন প্রতিভামাঠের সেই তুখোড়ের কাছ থেকে, হরেদরে নিচ্ছি যারা আঁজলা পাতিয়া তারা চুপিসারেই কম্ম সারছি, অ্যাক্নোলেজ করা আমাদের রক্তেই নাই নাকি! সিপিএম যেমন, কাট-পেইস্ট মাস্টার, রক্তেই নাই স্বীকার করার সবক। হয় তিনি জঘন্য, প্রতিভাসৃজনোদ্যমী তিনি লিখিয়ে-কবি-চিত্রী যা-ই হোন, নয় তিনি অবর্ণনীয় অসাধারণ। অন্যথা খুব অল্পই দৃশ্যমান। সমালোচনার লাইনে লাইনে জঘন্য, অথবা লাইনে লাইনে অসাধারণ, অঞ্জলি লহো মোর হে বঙ্গজন্মা সাহিত্যের পাঠকসমাজ! সৈয়দ হকের ঊনআশি-অতিক্রমী তথা আশিঋদ্ধিমুহূর্তে এই কথাগুলো মনে হইল, তো ভাবলাম মন থেকে বের করে দেখি কেমন দেখায়। কিন্তু অল্পকথায় গল্পটা বলে রাখা যাক এইখানে যে, সৈয়দ হক খুবই ইম্পোর্ট্যান্ট আমাদের সাহিত্যে, মানে-ও-পরিমাণে প্রবহমানভাবে, অনেক দিক থেকেই ইম্পোর্ট্যান্ট। সৈয়দ হকের ভার্স্যাটিলিটি ঈর্ষণীয় নয় কেবল, অনেকের কাছে আরাধ্যও।
ঊনআশি-পারানিয়া আশির ল্যান্ডিঙে দাঁড়িয়ে এখনও সচল তিনি সৃষ্টিতে, উদ্ভাবনায়, দেখার চোখ ও লেখার ঝোঁক তরুণ কোনো কবির প্রেমকামধ্যানমোহিত পরিস্থিতির সঙ্গেই তুলনীয় হইতে পারে কেবল। নতুন নাটক মঞ্চে নেমেছে গত বছরও, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, কবিতা আজও লিখে চলেছেন টানটান নিজের ধরনে ও ধ্বনিতে, উপন্যাস ওইভাবে ঠিক পুরনো সৈয়দ হকের কব্জিকে মনে পড়ায় না যদিও। প্রবন্ধের একটা বই বেরিয়েছে গেল বছর, ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ’, পড়ে বেজায় লেগেছে ভালো। অনুবাদ করে চলেছেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্দান্ত গতি ও কায়দায়, ইংরেজি থেকে তো বটেই, একটা একটা করে বেশ কয়েকটা বই বেরিয়ে গিয়েছে গেল দশক জুড়ে তাঁর হাত দিয়ে যেগুলো উর্দু কবিতার কুতুব কবিদের কবিতা থেকে চয়নপূর্বক তর্জমা করা। লাস্ট ইয়ার তাঁর হাত দিয়া আরেকটা ভালো কাজ পেয়েছি মিকেলেঞ্জেলোর কবিতার অনুবাদ। মির্জা গালিব ও মীর তকি তো করেছেন, সঙ্গে চেনা-আধাচেনা-আচেনা নানান উর্দু কবির শের সুখদ কবিতাভাষায় বাংলানুবাদ করেছেন তিনি এই বইগুলোতে। সব মিলিয়ে, বলা যায়, একটা দারুণ সৃজনগুঞ্জরিত শব্দমুখর সময় পার করছেন তিনি এই ঊনআশিতেও, সঙ্গে আমরাও উদযাপন করে নিতে পারছি নিজেদের বেঁচে-থাকাটাকে একটু আরও-অধিকতর ভালো করে। সেলিব্রেট করছি সৈয়দ হক, উইথ থ্রি-চিয়ার্স, ঊনআশিঋদ্ধ আশিপদার্পণে।
একসময়, এখন মনে পড়ছে, ‘দৈনিক সংবাদ’ নামের অধুনা-সার্কুলেশন-পড়ে-যাওয়া পত্রিকাটা খরিদ করতে প্রতিহপ্তায় বেস্পতিবার পায়ে হেঁটে যেতাম ও ফিরিয়া আসতাম কিনব্রিজের ওপার হইতে পত্রিকা বগলে চেপে। মাথার ওপর ঠাঠাভাঙা রোদ, বর্ষাদিনে বৃষ্টি ও বর্ষাতি নিয়া। পত্রিকাটার কাটতি তখনই ছিল নমিত, সব হকারের কাছে পাওয়া যাইত না, তখন ‘দৈনিক বাংলাবাজার’ ও ‘দৈনিক আজকের কাগজ’ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে মাঠ, ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’-ও এসে যাবে কয়দিন পরে। সেই সময়টায় সৈয়দ হক দৈনিক সংবাদের সাহিত্যসাময়িকীতে লিখে চলেছেন দ্য-ওয়ান-অ্যান্ড্-ওনলি ‘হৃৎকলমের টানে’। এরই পাশাপাশি লিখে চলেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ‘অলস দিনের হাওয়া’। মারকাটারি দিন ও দুপুর ছিল তখন, বলে শেষ করিবার নয়কো। ফুরাবার নয় সেই দিনগুলোর সুধা ও বিষবাষ্প মম অস্থিহৃদি-স্মৃতিপিঞ্জর হইতে। দীর্ঘকাল একটানা ধারাবাহিকভাবে ‘হৃৎকলমের টানে’ লিখে শেষ করে সৈয়দ হক শুরু করেন ‘জলেশ্বরীর দিনপত্রী’, বেশ-কিছুদিন সংবাদে ধারাবাহিক চলেছিল ওই লেখাটা, তারপর তো বই হয়েছে এই দুইটাই। বই হিশেবেই পড়েছি তাঁর ‘মার্জিনে মন্তব্য ও গল্পের কলকব্জা’, দুর্ধর্ষ, অনেক পরে তিনি সংবাদের সাহিত্যপাতাতেই ‘কবিতার কিমিয়া’ লিখে ওঠেন টানা কয়েক কিস্তিতে, এবং এইটি জুতে দিয়ে ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বইটা সাম্প্রতিক বাজারে বেরিয়েছে দেখতে পাই দ্বিগুণ কলেবরে। বেশিদিন আগের কথা নয়, এই তো বছর-সাতেক আগে সৈয়দ হক আরেকটা ধারাবাহিক বড় কাজ করে সেরেছেন সংবাদের সাহিত্যপৃষ্ঠেই, ‘কথা সামান্যই’, বাংলা শব্দ নিয়ে এমন অভিনব ভাবনার থিসোরাস সৈয়দ হক ফলিয়ে তুললেন। বহুদিন বাদে ‘কথা সামান্যই’ সুবাদে সেই সময়ের হপ্তাগুলো সত্যিকারের অন্তর্গত উত্তেজনায় কেটেছিল মনে আছে। একই পত্রিকার একই পাতায় একটা সাংঘাতিক ধরনধারনের অনুবাদ করেছিলেন সৈয়দ হক, ওই অনুবাদটা আমি খুঁজে চলেছি পুনর্পাঠের জন্য, যদিও বস্তাভর্তি ব্যক্তিগত সংগ্রহের সাময়িকপত্রিকাবাহক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তিন-চারটা ছুটির দিন লগ্নি করলেই পেয়ে যাব না তা নয়। কিন্তু জীবন তো এমন একটা জায়গায় এনেছে আমাদেরে, এমনকি ছুটির দিনটাও আস্ত আপনার করে পাবার জো নাই। এনিওয়ে, সেই দুর্ধর্ষ অনুবাদটা বিষয়ে যেটুকু মনে পড়ে সেটুকু বলে রাখি এখানে। এক ইংরেজ কবির, সৈয়দ হকের কবিবন্ধু সেই নারী খুব নামকরা কেউ নন যদিও বলে নিয়েছিলেন অনুবাদভূমিকাতেই, মায়ের জীবন ভিত্তি করে লেখা একটা আশ্চর্য বইয়ের অনুবাদ। ব্রিটিশ সেই স্বল্পপরিচিত কবিজননীর গার্হস্থ্যজীবনভিত্তিক স্মৃতিকথনমূলক রচনা, যার ভেতর দিয়া নারীর আবিশ্ববহমান বিপর্যস্ততার পাশাপাশি বিশ-শতকের শুরুর দিকের ইংলিশ সমাজের চেহারা দারুণভাবে উঠে এসেছিল। এবং যেহেতু সৈয়দ হকের অনুবাদ, ওইটা তো অনুবাদ থাকে নাই আর যেমন-তেমন, হয়ে উঠেছিল অনুসৃজন। ওই বছর পত্রিকাপাতায় অনুবাদটা ছাপা শেষ হবার পর থেকে তক্কে তক্কে আছি কবে এইটা বই হয়ে বেরোবে। কী দানবিক অনুবাদ হয়েছিল সেটি, কী বিভূতিবিম্বিত দুর্দান্ত অনুবাদ, বাপ রে বাপ! অনুবাদের কথা উঠবে, বিশেষত সৈয়দ হকের, আর তাঁর শেইক্সপিয়্যর তর্জমা বিষয়ে উল্লেখটি না-করে বিদায় নেবেন আপনে! এত সোজা! ‘ম্যাকবেথ’! বাপ রে বাপ! মূল টেক্সটের অ্যালিটারেশনগুলো দাঁতে ঝিলকিয়ে যায় পড়তে যেয়ে। কিংবা তাঁর করা ‘ত্রয়্লাস ও ক্রেসিদা’, কিংবা ‘টেম্পেস্ট’! সল্ বেলোর ‘হেন্ডারসন দ্য রেইন কিং’ উপন্যাসের তর্জমা ‘শ্রাবণ রাজা’ কার মন থেকে মুছিয়া গিয়াছে! এই জীবনে আহৃত মধু ও মনোহারী দ্রব্যের উল্লেখযোগ্য একাংশ তো সৈয়দ হকের কাছ থেকেই নিয়েছি আমি ও আমার সেই সময়ের বন্ধুরা, অস্বীকার যাই কেমন করে!
এমনিতে সৈয়দ হকের লেখাপত্র আমার বিশেষ পছন্দের। ছোটগল্পগুলো, গল্পপ্রবন্ধ বলেন তিনি যেগুলোর একটা বড় অংশকে, অধিকৃত করে রেখেছে আমায় সেই কবে থেকে এতাবধি। উপন্যাসে একটানা পড়ে গেছি তাঁকে ২০০৬ অব্দি। ম্যাড়ম্যাড়ে কান্নাকাটির বাংলা উপন্যাস লেখেন নাই তিনি। ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ বলুন, অথবা ‘মহাশূন্যে পরান মাস্টার’ বলুন, অথবা ‘ইহা মানুষ’, অথবা ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’, অথবা ‘গল্প কোলকাতার’ অথবা তাঁর অনেকানেক উপন্যাসের যে-কোনোটিই সশব্দ পড়েছি কবিতার মতো ঘোর শরীরে নিয়ে, এখনও যখন-তখন পারি পড়ে যেতে, পারি সৈয়দের উপন্যাস থেকে আবৃত্তি করে যেতে পাতার-পর-পাতা। কাব্যনাট্য তো তিনি লিখেছেন, লেখার চেয়েও বেশি কিছু ম্যাজিকই দেখিয়েছেন তিনি এই ফর্মে, এবং ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ গমগমিয়ে পড়ে সেরেই যাই ‘ঈর্ষা’র দিকে আজও, যাই তো, একই বৈঠকে। একটা আশ্চর্য সুন্দর বই আছে তাঁর ‘অন্তর্গত’। ফর্মের দিক বিচারে এইটি কবিতা, না উপন্যাস, আমি জানি না। ভারতবঙ্গের কবি জয় গোস্বামীর একটা বই আছে খুব জনপ্রিয়, ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’, এর বিজ্ঞাপনবাক্য প্রচারিতে দেখি এটি বাংলাভাষার প্রথম কাব্যোপন্যাস এবং যাহা জয় গোস্বামীর উদ্ভাবন ইত্যাদি। যা-হোক, বইটা ভালো। ‘অন্তর্গত’ পড়ে নেড়েচেড়ে দেখলে এই বিজ্ঞাপনী কর্তৃপক্ষের কাছে আপনারও আমার মতন ইচ্ছা জাগবে একটা চিঠি লিখি ব্যাটার চক্ষু হইতে গো-ঠুলিটা সরিয়ে একটু দৃষ্টি দূরে ছড়ায়ে দেখিবার অনুরোধ জানিয়ে। এনিওয়ে। এইটার অবশ্য, ‘অন্তর্গত’ বইটার, রচয়িতা নিজে একটা নাম দিয়েছিলেন। সম্ভবত কথানাট্য/কথাকাব্য ধরনের একটা নামের আন্ডারে এই তাঁর প্রবর্তিত ফর্মটারে ক্যাপ্চার করতে চেয়েছেন তিনি। আশির দশকের গোড়াতেই এই কাজটি করেছিলেন তিনি, এই ফর্মে এরপরে সেলিম আল দীন ‘চাকা’ রচনা করে উঠছেন দেখা যাবে; জয় গোস্বামীর বৃষ্টিতে ভেজার কাব্যোপন্যাস অনেক পরের, অনেক সাম্প্রতিক, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিককার ঘটনা। যা-হোক, কথাটা তো সক্কলেই জানেন যে বিজ্ঞাপনে লক্ষ্মী বসত করেন।
সৈয়দ হকের গল্পগুলোর মধ্যে এককালে আমার মুখস্থ ছিল ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’, ‘সাহেবচান্দের ঈদভোজন’, ‘আজাহারের মাতৃশোক’, ‘নেয়ামতকে নিয়ে গল্প নয়’, ‘গাধা জ্যোৎস্নার পূর্বাপর’ প্রভৃতি, এখন মুখস্থ ছুটে গেছে বলে বই হাতে নিয়া মাঝেমাঝে পায়চারিপূর্বক শূন্য মুহূর্তগুলো ভরায়ে তুলিতে আবৃত্তি করি নিজের জন্য নিজে। একটা কথা আমার মনে হয় যে, বাংলাদেশের সাহিত্যে তথা উপন্যাসে স্মার্ট কণ্ঠের যে-এক ন্যারেটরের আবির্ভাব ঘটেছিল বছর-পঞ্চাশ আগে, সেই ন্যারেটরের প্রভাব বাংলাদেশের বাংলা গল্পে ও উপন্যাসে একচ্ছত্রভাবে আজও দেখতে পাওয়া যায়। এখনও তরুণতর গল্পকারটিকেও যখন দেখি গল্পবয়নের কৌশল হিশেবে একজন কথক ক্যারেক্টারের শরণ লইতে, হামেশা ও হরদম এখনকার ছোটগল্পে এই ন্যারেটরের প্রবেশ লক্ষ করি, সেইখানে সৈয়দ হকের গলা ধার করতে দেখি, এ যেন অনিবার্য ও অবধারিত! রাম রাম! গল্পকারদের গল্লা এসে পিঠে পড়ল বলে! কিন্তু নব্বই দশকের কয়েক গল্পকারকে প্যানপ্যানে প্লটে সৈয়দ হকের কথক এস্তেমাল করে এন্তার গল্প লিখে ব্যাংক-বিমা প্রাইজ বাগাতে দেখে আমি অনেক আগেই বুঝে গেছি যে আমার গল্পপাঠদৃষ্টিশক্তি বিস্তর ত্রুটিপূর্ণ। তফাতে রহি, যা-হোক। গল্পকারেরা সৈয়দ হকের পাওনাগণ্ডা না-মেটায়ে, এক্নোলেজ না-করে, পিসফুলি গল্প লিখিয়া যাউন। আখেরে অবশ্য সৈয়দ হকেরই লাভ, প্রভাববলয় ও প্রভাবমেয়াদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হইতেই থাকবে। আমাদের শর্ট-স্টোরিটেলাররা আর কবে নিজেদের একটা জায়গাজমিজিরেত জুটাইবেন, মওলা মালুম। গড়ের হিসাব হাজির হইল অবশ্য, স্ক্রুটিনি ক্যালকুলেশনে বেশ কয়েকজন গল্পকার বেরিয়ে আসবেন এই বেদিশা-বেখবর-বেবোধ নকলনবিশির গহ্বর থেকেও।
তো, সেইটাই। তাঁর গদ্যঢঙ, বিশেষভাবেই, পছন্দ আমার। এবং তাঁর কবিতা আমি পছন্দ করি, বুঝবুদ্ধি হবার পর থেকেই করি, এখনও করি। তিনি সেই বিরল বাংলাদেশী বাংলা ভাষার কবি, যার কবিতা বুড়ো হয় নাই এমনকি ঊনআশিক্রসিং লেভেলেও! অথচ পঞ্চাশ পেরোনোর প্রাক্কালে আমাদের কবিরা যান বুড়িয়ে, এর প্রমাণ দিতে তারা ফাঁদেন প্রেমকাব্য একের পর এক, এবং বুড়িয়ে যে যান নাই সেই তথ্য প্রতিষ্ঠিতে তাদের লাইনে লাইনে একটা বালকের প্রেমে-পড়ার পাকামি দিন দিন অসহ্য হয়ে ওঠে, পাড়াপ্রতিবেশী পাঠকদেরে জ্বালিয়ে মারে, পঞ্চায়েত বসাইয়াও সেই বালকদল কবিদেরে প্রেম-করাকরি থেকে রোখা যায় না। বাংলাদেশের কবিতার পরিহাসপ্রতিম নিয়তিই যেন এইটা। সৈয়দ হক এ থেকে মুক্ত। তাঁর মতো শ্বাসরুদ্ধকর তেজ-টানটান কবিতা রচনা বাংলায় অদ্বিতীয় বললে বেশি বলা হবে না। কাজী নজরুল কবিতা লিখতেন যেমন, নজরুলের কবিতা সামনে এলেই যেমন মনে হয় এ রচিত হয়েছে উচ্চারিত হবার জন্যে, সৈয়দ হকের কবিতারও এই এক ব্যাপার যে দেখামাত্র সোচ্চার করে তোলে দর্শক-পাঠকেরে। একটা ফারাক এ-ই যে, নজরুলের উচ্চারণ যেন সমষ্টিকে দাঁড় করাবার তাগাদাবাহী, সৈয়দের কবিতা চায় ব্যক্তিকে দাঁড় করিবারে। একদম সটান, সতেজ, উন্নতশির, শতবর্ষের নির্জনতায় উচ্চারণোদ্যত। সংহত, শাণিত, সম্পন্ন, উদ্বোধিত।
সৈয়দ হকের লেখাপত্র, অগ্রগণ্যভাবে উল্লেখ্য তার গদ্যঢঙ, অনন্য অনেকানেক বিবেচনায়। যেমন তার সিন্ট্যাক্সিং প্যাটার্ন, শব্দচয়নগত সৌসাম্য, এমনকি বিরামচিহ্ন ব্যবহারের দিক থেকেও সৈয়দ হক অনন্য-অর্থেই গ্রাহ্য আগাগোড়া। বাংলা বর্ণমালার ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্যনিরিখে যে-দুই প্রধান প্রবণতা — অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ ধ্বনির ভিন্ন-তাৎপর্যের দ্যোতনা — সেইদিক থেকে বলা যায় যে সৈয়দ হকের গদ্য মহাপ্রাণজাত উচ্চারণের বৈভবে ভরপুর। হকের গদ্য — হোক সেই গদ্য উপন্যাসের বা কবিতার বা নাটকের বা গল্পের — উচ্চারিত হবার জন্যে এমনকি নির্জীব-নিঃসাড় পাঠকের জিহ্বাতেও সাড়া জাগায়। কেবল উচ্চারণেই ফুরায়ে যায় সেই গদ্য, এমন নয়; সৈয়দ হকের গদ্য পাঠকের সংবেদনেও সুস্থায়ী ছাপ রেখে যায়। এহেন উচ্চারণশৌর্যশীল গদ্যের নজির আমাদের ন্যায় সাধারণ পাঠকের অভিজ্ঞতায় এর আগেও এসেছে; যেমন, ঝটপট উদাহরণ, ইংরেজিতে হুইটম্যান এবং বাংলায় নজরুল এহেন মহাপ্রাণবন্ত গদ্যকর্ম করে গেছেন, অথবা মাইকেল মধুসূদন করেছেন মেঘনাদবধ মহাকাব্যে। এবং এহেন উচ্চারণপ্রাধান্য সৈয়দ হকের কবিতাকাজগুলোকেও দিয়েছে বিশেষ গতি ও ঋদ্ধ ভঙ্গি।
সৈয়দ হকের ন্যায় টানটান শ্বাসরুদ্ধকর ও তেজোদ্দীপ্ত উচ্চারণের গাম্ভীর্যসবল মন্দ্রসপ্তকের কবিতা রচনা সাম্প্রত বাংলায় অদ্বিতীয় বললেও অত্যুক্তি হবে না। তার কবিতায়, এমনকি উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-নাট্য সহ কলামে-কথনেও, একটা দুর্ধর্ষ এপিক টোন প্রথম কর্ণপাতেই পাঠকের মর্মগোচর হয়। এহেন মহাকাব্যিকতা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনসংলগ্ন হয়েছে সৈয়দ হকের উচ্চারণচৈতন্য ও গদ্যপ্রাখর্যের কারণেই। কিংবা তার লেখায়, বিষয়ানুবর্তনে এবং ভঙ্গি নির্বাচন ও পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে লেখার বিষয়বীক্ষণ-লিখনবিন্যাস-কৌণিকতা নির্ধারণ ও স্থাপনেও, এই মহাকাব্যিক কৌশলের প্রয়োগ অত্যন্ত সচেতন বলেই প্রতিভাত হয় সৈয়দ হকের রচনা পাঠোত্তর। উদাহরণ অল্পের উপর দিয়া সারা যাক। কবিতায়, কিংবা কাব্যনাটকে বিশেষভাবে, দেখা যাবে যেসব চরিত্র ও ঘটনা আবর্তিত সৈয়দ হকের কলমে, সে-সমস্তই বীররসপূর্ণ। নূরলদীন কিংবা আকবর হোসেন বা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান প্রমুখ ইতিহাসের অবন্দিত-বন্দিত বীরেরা সৈয়দ হকের কবিতায়-কথাসাহিত্যে যেভাবে এসে স্থাপিত হতে দেখা যায়, সেই স্থাপনাকৌশল অসাধারণভাবে এপিক। কবিতায়, এবং কথাসাহিত্যে, পাঠকের প্রতি যে-বন্দনাপর্ব রচিত হতে দেখি তার সাহিত্যে, সেসব অবধারিতভাবে মহাকাব্যের স্মৃতিই উসকিয়ে দ্যায় আমাদের পাঠচৈতন্যে। এক-ধরনের মহাকাব্যিক ধ্বনির বলয় ঘিরে রাখে তার সৃজিত রচনারাজ্য। সম্বোধনপদগুলো, কবিতায়, অপরিসীমভাবে নান্দনিক দ্যোতনা জাগায়ে তোলে পাঠকের মনে ও মননে। আশ্চর্যের ব্যাপার যে, এমন অসংখ্য শব্দচূর্ণ-সম্বোধন-কথোপকথনখণ্ড ব্যবহৃত হয় তার কবিতায়-নাট্যে যেগুলো পুরনো-স্মৃতিজাগানিয়া সত্ত্বেও ক্লিশে-আর্কেইক না-থেকে হয়ে ওঠে একদম সমকালীন। সংহিতার স্বর, উপনিষদের মন্দ্রগম্ভীরতা প্রভৃতি তিনি ব্যবহার করেন এবং সফল হন বারবার। নদীকে সম্বোধন করে, নদীকে সম্ভাষণ জানিয়ে, একের-পর-এক কবিতা রচনা করেন তিনি। এইটা আরেক এপিক টেক্নিক। তা-সত্ত্বেও চর্বিতচর্বণ মনে হয় না পুনঃপুনঃ পাঠে-পাঠান্তরেও।
শুধুই কি প্রশংসা প্রাপ্য সৈয়দ হকের? কোনোই কি সমস্যা নাই তার রচনাকৌশলে? তা তো নয়, সমস্যা আছে, এবং সৈয়দরচনারাজ্য পোলিটিক্যালি রিডিং দেয়ার সময় এই সমস্যা ভালোই ভজকট পাকাবে বলে মনে হয়। কিন্তু এই নিবন্ধ যেহেতু জন্মদিনের অভিবাদনপত্র, ভার্চুয়্যাল পুষ্পতোড়াসমেত বার্থডেউইশ, কাজেই এখানে সমস্যালোচনা আদৌ অভিপ্রেত নয়। এবং এ-ও উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হবে যে, অর্ধশতক ধরে যিনি লিখে চলেছেন বিরামহীন, একের-পর-এক ফর্ম ও পর্যায় যিনি প্রবর্তন করেছেন ও পারায়ে এসেছেন, তার লেখাপত্র তো অবশ্যই জ্যান্ত এবং জ্যান্তমাত্রেই সমস্যা-সঙ্কট প্রভৃতির বিহ্বলতাবহ। সৈয়দ হকের বড়সড় সমস্যা আছে একটা জায়গায়, যেইটা তার রচনার সমস্যা না যাপিত জীবনচর্যার, ঝটপট মালুম হয় না যদিও। আর রচয়িতা থেকে রচনা আলাদা-পৃথক করা যায় কি যায় না তা-ও তর্কসাপেক্ষ। ঘটনা হলো, সৈয়দ হকের যে-একটা ব্যাপার এখানে সমস্যা বলে কেউ কেউ চিহ্নিত করতে চাইবেন, সেইটা সমস্যা হিশেবে নির্ণীত হলে বলতে হবে যে এই সমস্যা সৈয়দের একলার নয়, তার সমবয়সী-সমকালীন বেশিরভাগ লেখক-বুদ্ধিজীবীরই সমস্যা এইটা। সমস্যাটা হলো, বিশেষ একটা রাজনৈতিক দলের ধ্বজা সৈয়দের রচনায় বড় বেশি প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়ে যেতে দেখি। কিংবা রাজনীতি বলতেই তার ও তাদের রচনায় দ্বিদলবিভাজিত একটা ব্যাপার। এহেন বাইনারি অপোজিশন্যাল পরিস্থিতি আখেরে সৈয়দের ও তার সমকালীন অন্যান্য আখ্যানভাগসমূহকে কালান্তরে অতিসরলীকরণের দোষে অভিযুক্ত করে ফেলে কি না, এইটেই আশঙ্কার ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধ সৈয়দরচনায় অসাধারণ শক্তিশৌর্য নিয়াই রিপ্রেজেন্টেড হয়েছে দেখব, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সিচ্যুয়েশন বিশ্লেষণে লেখকসুলভ প্রখর দ্রষ্টাদৃষ্টির স্থলে একটা পার্টিজ্যান প্রেক্ষণী ও বীক্ষণের শরণ লইতে দেখব তাকে, কেবল গতি ও ভঙ্গি দিয়া পার পাওয়া তো খুব বেশিদিন সম্ভব হবে না বলেই আমরা সন্দিগ্ধ, গদ্যেই যদি ভবী ভোলানো যেত তবে তো কথা ছিল না। আমরা দেখব যে, পঞ্চবার্ষিক ষড়যন্ত্রপরিকল্পনা নিয়া অসদুপায়ে/সদুপায়ে একেকটি নির্বাচনে একটা পাশমার্ক পেয়ে সরকারগুলো আসে আর যায় — যেমনটা থোড়-বড়ি-খাড়া রাজা আসে রাজা যায় — কিন্তু আমাদের লেখকেরা রাজনৈতিক তল্পিবাহকের ন্যায় নয়নে বাইফোকাল পরিধানপূর্বক অন্ধসদৃশ গোটা রাজনীতিটাকে না-দেখে একটা খণ্ডেরই অনুবর্তন করে চলেন এবং, বিস্ময়কর শোনালেও সত্য, আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের আনুগত্যপ্রদর্শনকারী জীবের তালিকায় সর্বাগ্রে লেখকের স্থান বরাদ্দ। ফলে দেখা যাবে যে ব্যতিক্রম অথবা আপদক্রম বাদ দিলে পাঁচবছর-অন্তরান্তর এদের লেখায় মসনদে-আসীন-মানুষ বুঝিয়া, স্বীয় অগ্রপশ্চাতের লাভালাভ হিসাবনিকাশিয়া, বিদ্রোহ অথবা পরাজয়ের সুর আসে, ফের জয় ও সুদিনের সুরটাও ওঠে আলবৎ। সৈয়দ হকের লেখায় এখন, এই ২০১৫-পূর্বাহ্নে, চলছে এক্ষণোক্ত দ্বিতীয় সুরের ঋতু। মসনদের মানুষ পাল্টানোর ওপর নির্ভর করে তার কণ্ঠে-ও-কবিতায়-ও-কথাসাহিত্যে ‘মানস মানচিত্র’ পাল্টানোর তাগিদজাগৃতি কিংবা নিভৃতি। ভোট দিয়ে এসে আমাদের লেখকেরা যতদিন ভুলতে না-পারছেন তারা কাকে ভোট দিয়ে এসেছেন, তদ্দিন আমাদের মুক্তি সুদূরপরাহত, মুক্তি মিলবে না আমাদের রাজনীতির, তথা আমাদের অর্থ-ও-সমাজনীতিনৈতিকতার। উল্টোটাই ঘটে এখানে, হায়, ভোটাধিকার প্রয়োগফেরত পরবর্তী ন্যূনতম পঞ্চবর্ষব্যাপী রচনায়-আচরণে-বিবৃতিতে-বক্তৃতায় মহতী উদ্যমে একচেটিয়া প্রকাশিয়া যান কারে ভোট দিয়া আসিয়াছেন আমাদিগের লেখকবর্গ। তবে যেহেতু জনগণ আমরাও আমাদের লেখকদিগেরই ন্যায় এক-ও-অভিন্ন রাজনীতিচৈতন্যের ক্রিটিক্যাল কনশ্যাসনেস্ ধারণ করি, বিশেষ বুঝতেও পারি না তাই ভানুমতির খেলাধুলোগুলো। রসুনের পশ্চাদ্ভাগ তথা ফার্মের সব-কয়টা ঝিমানো মুর্গির বিষ্ঠালাগানো নিতম্বই যে এক ও অভিন্ন, এই নির্ণয়টা অন্তত নব্বই-উত্তর সৈয়দ হকের সাহিত্যেও যদি নাহি মিলিল, তাইলে তো মুশকিল। পঞ্চবার্ষিক প্রোজেক্টে ‘দ্বিতীয় একাত্তর’-র নেসেসিটি দেখা দেবে, আর পাঁচবছর গ্যাপ দিয়া, বা দশবছর, সব সুরাহা হবে, নিভৃতি নামিবে জনমনে ও লেখকের অন্তরের অন্তস্থলে এবং কলমের নিবে ও কিবোর্ডে, শান্তিজল ঝরিবে আকাশ হইতে সরাসরি সাধারণ মনুষ্যেতরের বর্তনে, আহা! এমন যদি হতো!
সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫, কুড়িগ্রাম, বর্তমান রংপুর অঞ্চলে। পিতা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন, মা হালিমা খাতুন। ১৯৫২ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে স্নাতক উত্তীর্ণ হবার আগেই ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন। কর্মজীবন দেশে-বিদেশে সাংবাদিকতা ও লেখালেখি। প্রকাশিত প্রবন্ধবই : হৃৎকলমের টানে (১ম খণ্ড ১৯৯১, ২য় খণ্ড ১৯৯৫)। ছোটগল্প : তাস (১৯৫৪); শীতবিকেল (১৯৫৯); রক্তগোলাপ (১৯৬৪); আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭); প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২); সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প (১৯৯০); জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০); শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯০)। উপন্যাস : এক মহিলার ছবি (১৯৫৯); অনুপম দিন (১৯৬২); সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪); নীল দংশন (১৯৮১); স্মৃতিমেধ (১৯৮৬); মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬); স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭); এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭); স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯); বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১ম খণ্ড ১৯৮৯, ২য় খণ্ড ১৯৯০); বারো দিনের শিশু (১৯৮৯); বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯); ত্রাহি (১৯৮৯); তুমি সেই তরবারী (১৯৮৯); কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯); শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০); নির্বাসিতা (১৯৯০); নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০); খেলারাম খেলে যা (১৯৯১); মেঘ ও মেশিন (১৯৯১); ইহা মানুষ (১৯৯১); এছাড়াও অনেক আখ্যান-উপন্যাসকাজের ভেতর উল্লেখযোগ্য — মহাশূন্যে পরান মাষ্টার; দ্বিতীয় দিনের কাহিনী; বালিকার চন্দ্রযান; আয়না বিবির পালা; কালঘর্ম; দূরত্ব; না যেয়ো না; অন্য এক আলিঙ্গন; এক মুঠো জন্মভূমি; বুকঝিম ভালোবাসা; অচেনা; আলোর জন্য; বাজার সুন্দরী; বকুল রঙিন স্টুডিও; নারীগণ। কাব্যগ্রন্থ : একদা এক রাজ্যে (১৯৬১); বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯); বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা (১৯৭০); প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩); অপর পুরুষ (১৯৭৮); পরানের গহীন ভিতর (১৯৮০); নিজস্ব বিষয় (১৯৮২); রজ্জুপথে চলেছি (১৯৮৮); বেজান শহরের জন্য কোরাস (১৯৮৯); এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯); অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯); কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০); আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০); তোরাপের ভাই (১৯৯০); শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০); রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১); এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত হয়ে চলেছে একের-পর-এক কবিতাবই ফি-বছর, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য — নাভিমূলে ভস্মাধার; কবিতা সংগ্রহ-১, ২ ও ৩; বালক, তুমি একদিন; অমা-চন্দ্রিমার কাল; অধোগামী দিনের পঞ্জিকা; । কাব্যনাট্য : পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬); গণনায়ক (১৯৭৬); নূরুলদীনের সারাজীবন (১৯৮২); এখানে এখন (১৯৮৮); ঈর্ষা; এবং কাব্যনাট্য সমগ্র (১৯৯১)। কথাকাব্য : অন্তর্গত। অনুবাদগ্রন্থ : ম্যাকবেথ; টেম্পেস্ট; শ্রাবণ রাজা (১৯৬৯)। শিশুসাহিত্যগ্রন্থ : সীমান্তের সিংহাসন (১৯৮৮); আনু বড় হয়; হাডসনের বন্দুক। তিনি যেসব পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য — বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬); আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৯); অলক্ত স্বর্ণপদক (১৯৮২); আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩); কবিতালাপ পুরস্কার (১৯৮৩); লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক (১৯৮৩); একুশে পদক (১৯৮৪); জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৮৫); পদাবলি কবিতা পুরস্কার (১৯৮৭); নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০); টেনাশিনাস পদক (১৯৯০); জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার : চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গীতিকার।
একটা এমন বইয়ের পরিকল্পিত প্রবাহ খুব দরকার যেখানে এক-নজরে সৈয়দ হকের মতো যারা গদ্যে-পদ্যে ফিকশনে-ননফিকশনে হেঁটেছেন পথ, মোটামুটি ফলিয়েও তুলেছেন মিলিয়ে মন্দ-ভালো, তাদের সবধরনের লেখা থেকে একটা-দুইটা প্রতিনিধি নিয়া পাঠকাকর্ষী বহনবান্ধব সুদৃশ্য ও সুনির্বাচিত সংকলন প্রকাশ হবে সেই গ্রন্থপ্রবাহ প্রকল্পের লক্ষ্য। ধরা যাক, সৈয়দ হক চয়নিকা বা মান্নান সৈয়দ চয়নিকা ইত্যাকার। খুব বেশি তো এই বাংলায় নেই এমন, যারা একহাতে গেছেন লিখে বিচিত্র প্রকাশপ্রকরণে। কাজেই এইটা আলাদা আলাদা লেখকদের নামেই হতে পারে, যেমন খুব দরকার একটা সৈয়দ হক চয়নিকা, যেখানে তাঁর ২-৩টা গল্প, কয়েকগুচ্ছ কবিতা, নাটকের একটা বা ক্লাইমেক্স অংশগুলো কাব্যনাট্যের, জর্নালগুলোর একাংশ, প্রবন্ধের একটা নমুনা, আর সর্বোপরি উপন্যাসের থেকে নির্বাচিতাংশ অথবা আস্ত উপন্যাস, সুসম্পাদিত হয়ে ছেপে বেরোলে এই কাজ খুব উপকার করবে পাঠকের। এই চয়নিকায় চয়িত লেখায় স্পৃষ্ট পাঠক পরবর্তী ধাপে হয়তো ওই লেখকের অন্য রচনাদি কিংবা তার কেবল কবিতা বা কেবল গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি দিকে এগোলো অথবা ঝাড়া দিয়া ফালাইয়াই দিলো লেখকেরে আজাইরা মনে করে, বেঁচে গেল পাঠকের পকেট, অহেতু সব রচনাসমগ্র ক্রয়ের অর্থ ও গ্লানি। ইংরেজিতে এইটা কালচারের মতো রয়েছে দেখতে পাই, ভার্স্যাটাইল অথরদের ইন্ট্রোডাক্টোরি রিডার বের হয় এবং সুলভ মূল্যে বিক্রিত হয়, এদেশে তথা বাংলায় এইটা চালু হয়নি। এর ফলে সৈয়দ হকে পয়লাবার অভিষিক্ত হতে যাওয়া পাঠক যেমন উপকৃত হবেন, উপকৃত হবেন আপনার-আমার মতো সৈয়দের পূর্বপরিচিত পাঠকগোষ্ঠী যারা নানা কারণেই সৈয়দের লেখাপত্র থেকে দূরে অবস্থান করেন প্রবাসে বা নিজ বাসভূমে। এক-নজরে ফেব্রিট অথরের রচনারাজ্যে মধ্যেমধ্যে চোখ বোলানো সহজ হইত তখন। আমাদের দেশে অবশ্য সমগ্র — রচনা ও রচয়িতাকীর্তির — প্রকাশের একটা চল রয়েছে, যা কিনা আজকাল হিড়িকের মতন হু হু করে বাড়ছে। ৩৫ বচ্ছরের বয়স কুল্লে, এমন লেখক নিজের রচনাসমগ্র প্রকাশ করে কোলে লইয়া বারোয়ারি বইয়ের বাণিজ্যমেলায় কেলিয়ে বসে বিক্কিরি করেন, এই দৃশ্য কমন এখন, নিজের কর্মস্থল পত্রিকায় সেই সমগ্র নামধেয় সামগ্রীর বক্সট্রিটমেন্ট বিজ্ঞাপন ছাপেন দাঁতমাঞ্জনী পিকচার সমেত! সৈয়দ হকের মতো লেখকের সমগ্র অবশ্য অদরকারি নয়, কিন্তু সমগ্রসদৃশ উন্নতবপু গ্রন্থ সংগ্রহের জন্য উপযোগী যতটা, পাঠের জন্য ততটা নয়। এইটা শেষমেশ সংগ্রাহকের জন্যই। এই জিনিশ আমাদের বাজারে ছাপানোই হয়, আমার ধারণা, টাইকুন কুমিরদের ড্রয়িংরুম টার্গেট করে, এইধরনের দীর্ঘ কলেবর বইয়ের লক্ষ্য পাঠক অথবা পাঠ কোনোটাই নয় বলে মনে হয় আমার। চটজলদি উদাহরণ, শহীদুল জহির সমগ্র অথবা মামুন হুসাইন। কোনো মর্ত্য দুনিয়ার মানুষের পক্ষে ‘পাঠক সমাবেশ’ কর্তৃক ছাপানো বইয়ের হাতছানি এড়ানো কঠিন, তদ্রুপ কোনো মর্ত্য দুনিয়ার মনুষ্যশাবকের পক্ষে এই প্রকাশনীর বই হাতে ধৃত অবস্থায় পাঁচ মিনিটেই নিঃশ্বাসরুদ্ধ না-হওয়া অস্বাভাবিক। এত ঢাউস! এত দাম! ঢাউস আর দামের তো একটা মাই-বাপ থাকবে! এইটা আবার চয়নিকা প্রকাশের একটা যৌক্তিকতা যে, যেখানে-সেখানে বয়ে নিয়া যাওয়া যায় এবং যখন-তখন ওই লেখকের একটা রেপ্রিজেন্টেশন এভেইল ও এনশিওর করা যায়। এতাবধি আমি একজনও সংগ্রাহক পাই নাই, যে আদৌ পড়ার নিমিত্তে বই সংগ্রহ করে। একপ্রকার বড়াই করা, যে অমুকের সমগ্র আমার সংগ্রহে আছে বা তমুকের বইটা ফার্স্ট এডিশন আমার কালেকশনে আছে, তাদের কাছে একটা বইয়ের পয়লা বিচার্য বইটা শারীর-সৌষ্টবের দিক থেকে কালেক্টর্স আইটেম হয়েছে কি না। আমার আশেপাশে যেসব বইকারবারী কালেক্টর মশাইদিগেরে দেখি, তাদের সঙ্গে দেড়-দুইমিনিট কথা কয়েই বুঝে ফেলা যায় যে এরা বইয়ের ধুলোচাটা কীটমাত্র, বইয়ের পাতা ছিঁড়েখুঁড়ে বইতনুতন্ত্রীতে রক্তোচ্ছ্বাস-তোলা প্রেমিক পাঠক এরা নন। জনৈক বইয়ের দোকানদার-কাম-কালেক্টর মশাইকে আমি চিনি, যিনি নিজের দোকানে ব্যবসাটা করেন ঠিকই আমাদের পরিচিত কসাই বঙ্গাই মিয়ার ফর্ম্যুলায়, কিন্তু স্টক-সীমিত দুর্লভ কোনো বই তিনি নিজের বগলদাবা না-করে একজন পাঠকের হাতে বিক্রি করেন না, সেই পাঠক পায়ে ধরে ঝুলে থেকে দুগ্না দাম দিতে চাইলেও। অথচ ওই বই নিয়া তিনি দিনের পর দিন মলাট মোছা ছাড়া আর কোনো সহবাস-শরীরসংসর্গ করবেন না আমি নিশ্চিত, বইয়ের বডিতে উপগত হইবার ট্রেনিং তো তিনি অনভ্যাসে নাশ করিয়াই ফেলিয়াছেন, তবু অস্ত্র-গোলাবারুদ জমা করে ঘর ভরাইয়া ফেলতেছেন। এদের মৃত্যুর পর এত এত বই কোথায় যায়, এই কালেক্টরগোষ্ঠী তো নতুন নয় বরং যুগ যুগ জিয়ে রইয়াছে এরা, এদের নিয়া এই আমার এক কৌতূহল। বঙ্গাই মিয়া আমাদের প্রিয় কসাই, ফ্রেশ ও উমদা মাংশ পাওয়া যায় তার কাছে, শহরকুতুব রইস আদমিরা তার বিক্রিত কোয়ালিটি মাংশের ভক্ত-আশেকান বটে। এনিওয়ে। এইসব ভাবি। যে, একটা প্রোক্ত আদলের বইপ্রবাহ প্রকাশ করা দরকার, সুলভ মূল্যে যেসব ক্রেতাগোষ্ঠী বই খরিদিয়া তাকিয়ায় না-রেখে ছিঁড়েখুঁড়ে পড়ে ফেলে দিতে চান বই। কিন্তু শঙ্কিতও হই বৈকি, কেননা আমাদের এখানে তো বুক-এডিটিং হয়ে দাঁড়িয়েছে ছেলেখেলা। সেসব অন্য ভুবনের কারবার, ওই ঠাকুরঘর আর কলা খাওয়ার খবরে আমাদের কাজ নাই।
সৈয়দ হক নিয়া তো প্রশংসাপত্র রচনার দরকার নাই, এতক্ষণ এই নিদরকারি কাজটাই করে যাওয়া হলো। তবে ব্যাপারটা এ-ই যে, ঋণশোধ না-হোক, এ-জীবনে যাদের কাছেই বিস্রস্ত-বিপর্যস্ত মুহূর্তে ঠাঁই পেয়েছি নানান ছুঁতোনাতায়, তাদের ঋণ স্বীকার তো করে যাই আগে। দেখা-যায়েগা-বাদ-মে, কেউ কর্পোরেট কোনো অফার নিয়া আগাইয়া আইলে, সহজ সুদে ঋণ নিয়া খানিকটা ঋণ বেমালুম চাপিয়া গিয়া খেলাপি বদনাম ঘুচাবার কোশেশ করা যায় কি না। আপাতত ইরাদা প্রকাশিয়া রাখিনু। সৈয়দ হকের আশিঋদ্ধির দিনে তাঁরই একটা লাইন ছুঁড়ে বার্থডেউইশ জানানো যায়, এই লাইনটা সৈয়দ লিখেছিলেন শামসুর রাহমানের সম্ভবত পঞ্চাশতম জন্মদিনে একটা দীর্ঘকবিতায় ঈষৎ অগ্রজ কবিবন্ধুকে প্রেমোপহার দিতে যেয়ে, সম্পূর্ণ ব্ল্যাক-এন-হোয়াইট মেমোরি থেকে উঠাইয়া আনছি এই পঙক্তি, কিঞ্চিৎ বদল ঘটায়ে নিয়ে সৈয়দের জন্মদিনেই :
দীর্ঘ হোক সৈয়দের জীবন, ত্বরান্বিত হোক মানবের স্বপ্নসমূহের অনুবাদ।