বাইসাইকেলবেলা । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ নভেম্বর ২০১৪, ৫:৩০ অপরাহ্ণ, | ৪১৯৫ বার পঠিত
বাইসাইকেলের সেই দিনগুলো আমাদের! প্রত্যেকেরই ছিল একটা করে নিজের ইশকুল, আর দুইটা করে বাড়ি। দুইটা বাড়ির মধ্যে একটাতে নিজে ঘুমনিদ্রা যাইতাম, অন্য বাড়িটার সামনে দিয়া শীতগ্রীষ্ম বারোমাস বিকেলবেলা সাইকেলের প্যাডেল মেরে উদাস নয়নে চক্কর দিয়া বেড়াইতাম, কোনোদিন দেখা হইত পলকের তরে সেই বাড়িটার ভেতরের পরানভোমরার সনে, কোনোদিন কপাল থাকত খারাপ। সাইকেলের সেই দিনগুলিতে এ-ই ছিল প্রেম আমাদের। সেই কৈশোর, রাঙা রাজকন্যা আর বিকেলবাহিত সুর … ! সাইকেল রহুক চির অমর …
২
আমাদের সময়ে একচ্ছত্র কদর ছিল ফিনিক্স সাইকেলের। পুরাণের পাখির মতোই ছিল সেই সাইকেলের সুনাম। পরে একটা সাইকেল ধীরে ধীরে বাজার জুড়তে শুরু করে, সেইটা ছিল ইন্ডিয়ান হিরো জেট। নতুন জিনিশের জন্য পোলাপানদের নোলা ছুঁকছুঁক করে সেই আদিকাল থেকেই, আমাদেরও করত, হিরো জেটের মালিক হবার জন্য আমরা আম্মা আর চাচিমার কাছে ঘ্যানর-ঘ্যানর শুরু করি। কিন্তু কাজ হয় না। রাত্তিরে খেতে বসে বাবা-চাচা তিনজন মিলে আমাদের ভাইবোন-কাজিনদের সারাদিনের আমলনামা রিভিয়্যু করার সময় হিরো প্রসঙ্গ ওঠানো হয় এবং অবধারিতভাবে আদ্যিকালের ফিনিক্সের কাছে হিরোকে হারতে হয় রেফারিদের কারসাজিতে। ফিনিক্সের গতির তারিফ আর তার আগুনজন্মের পৌরাণিক কাহিনি ছোটচাচা তথা আমাদের কাকার মুখে শুনতে শুনতে একসময় নাভিশ্বাস উঠে যায় আমাদের। মুখের ওপর তো গুরুজনকে কঞ্জুস বলে মনের ঝাল ঝাড়া যায় না, তাই চুপ থাকি, কিন্তু মনে মনে ঠিকই আমরা কাকাকে কঞ্জুস বলে সাব্যস্ত করি।
৩
কিন্তু সত্যি ফিনিক্স খুব শক্তপোক্ত ছিল। ঘরের ভেতরে যতই বলি না কেন এইটা পচা, পুরনো জবরজং, বাইরে বন্ধুদের কাছে আমার সাইকেল সবারটার চেয়ে সেরা সাইকেল এই তথ্য প্রতিষ্ঠায় ফেনা তুলি মুখে। এমন কয়েকজন বন্ধু ও সহপাঠী ছিল আমার যারা বছর-বছর সাইকেল পাল্টাত। পয়সাওয়ালা বাপের পোলাপান সবাই, আমিই ছিলাম ফকিরমিসকিনগোত্রীয়। তবু মনে এইসব জায়গা দেই নাই কখনো, মনে মনে ঠিকই ছিলাম এবং রয়েছি ফিনিক্সপাখিটা আজও। ঘটনাটা দাঁড়ায় এমন যে, বাইরে ফিনিক্সের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারণামূলক প্রোমো এবং ঘরে ফিরে হিরো জেট খরিদের তদবির-তালাবি তথা অ্যাডভোক্যাসি চালানো হয়ে ওঠে আমাদের রুটিনওয়ার্ক। নতুন মডেলের সাইকেল কিনিয়া না-দিলে ইয়ার্লি পরীক্ষায় বসব না মর্মে কয়েকবার হুমকি দিয়েও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ানো যায় না। আর, কে না জানে, কর্তৃপক্ষ তো চিরকালই নিষ্ঠুর ও অতীব খতরনক।
৪
ওইটা ছিল, বলা যায়, আমাদের ফ্যামিলি-বাইসাইকেল তথা পারিবারিক দ্বিচক্রযান। কলেজে যাওয়া-আসার সুবিধে হবে ভেবে ছোটচাচাকে কিনে দেয়া হয়েছিল আইয়ুব খানের আমলে। এইসব ঘটে আমাদের জন্মের অনেক আগে, এমনকি আমাদের আম্মা-চাচিমাও তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। এরপর ছোটচাচা ব্যবসা শুরু করেন একসময়, কেনেন মোটরসাইকেল। ওই মোটরবাইকটা আমাদের ছেলেবেলার অনেক অনেক আনন্দের জননী এবং ওর পাখায় চেপে অনেক অনেক দেশবিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা ছোটচাচার স্পন্সর্শিপে। সেইটা ছিল ইয়ামাহা হান্ড্রেড। ছোটচাচা মোটর কেনার পর বাইসাইকেল খুব-একটা ব্যবহার হচ্ছিল না, কিন্তু বিক্রিও করা হচ্ছিল না, বাপচাচারা তখন গাছের কাঁঠালের আশায় গুঁফে তাও দিয়া যাচ্ছিলেন। এইসব আমার অনুমান। বাইসাইকেল বিক্রি করা হচ্ছিল না, যাতে তাদের বাচ্চাকাচ্চারা সাইকেল চালানো শিখতে পারে অল্প বয়সেই। সেই প্রত্যাশা জ্বালিয়ে রেখে ফিনিক্সকে বন্দী করে রাখা হয় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। আমাদের বাড়িতে একটা আলাদা ঘর ছিল পরিত্যক্ত-অথচ-কখনো-কাজে-লাগবে-এমন মালসামান স্টোর করে রাখবার জন্য, ঘরটাকে বলা হতো মালখানা। বাইসাইকেলটার জায়গা জুটে সেই মালখানায়। সেই বন্দীদশা থেকে মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত মেয়াদের মুক্তি মিলেছে তার, যেমন আমাদের ফুফুতো ভাইদের বা জ্ঞাতিদের মধ্যে কেউ যখন সাইকেল ক্রয়ের আগে শেখার জন্য যথাবিহীত শর্তপূরণপূর্বক ছোটচাচার কাছে পিটিশন করেছে। সেইসবই ছিল সাময়িক মুক্তি। ফিনিক্সের পূর্ণ শুভমুক্তি ঘটে, বলা যায়, আমাদের জন্মের পর। আমরা একগাদা ভাইবোন-কাজিন পালাক্রমে ফিনিক্সে সওয়ার হতে থাকি। প্রথমে কিছুদিন বিশেষ কায়দায় বগলি চালাই, অচিরে সাইকেলের সিটে বসে পুরোদমে সাইক্লিং শুরু করতে কামিয়াব হয়ে উঠি। মোটমাট ভাইদের মধ্যে সবাই এবং বোনদের মধ্যে দুইজন সফলতার সঙ্গে সাইকেল-সাক্ষর হতে পেরেছি। দিনগুলো, আহা, রবিবাবুর সোনার খাঁচায় নয়, সাইকেলের সিটে বসে হাওয়া সাঁতরে উড়ে বেড়িয়ে কাটায়ে দিতে পারা গেলে কতই-না ভালো হতো!
৫
সহপাঠীদের মধ্যে আমার চেয়েও হতভাগা দুইচাইরজন যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। ছিল না ব্যক্তিগত বাইসাইকেল এমন বন্ধুরাই আমার জীবনে পাওয়া ডাকসাইটে শ্রেষ্ঠ বন্ধু বলে আজ পেছনে চেয়ে দেখে উঠি। এখন যেমন রেন্ট-অ্যা-কার, তখন ছিল পাড়ায় পাড়ায় রেন্ট-অ্যা-বাইসাইকেল সুবন্দোবস্ত। ছিল সাইকেল সারাইয়ের ছাপড়া দোকান বটগাছের গোড়ায়, যেখানে সাইকেলের সার্ভিসিং ইত্যাদির পাশাপাশি চাকায় বাতাস ভরা বা ফুটবলে পাম্প করার জন্য আমরা লাইন দিয়া বসে থাকতাম। খুব পসার ছিল এই দোকানগুলোর তখন। এইসব দোকানেই ভাড়ায় মিলত সাইকেল, ঘণ্টাচুক্তিতে, দিনচুক্তিতেও কর্পোরেট কন্সেশন লাভ করা যাইত। দুইটাকায় ঘণ্টা, সাইকেল ফেরত দিতে দেরি হইলে বিলম্বজনিত একটা চার্জ ধার্য ছিল, কোনো ফল্ট ধরা পড়লে সেজন্য গুনতে হতো আলাদা ড্যামারেজ। বন্ধুদের মধ্যে যারা ভাড়ায় সাইকেল চালাত, তাদের কথাবার্তার মধ্যে সিংহাংশ ছিল সাইকেলকেন্দ্রিক, লক্ষ করতাম তারা সাইকেলের স্বপ্নে বিভোর দিন কাটাত আর পরীক্ষায় টেনেটুনে বেঞ্চ ডিঙাত। দুইটাকা ভাড়ার সাইকেলে যেসব অভিযানে বেরোত তারা, তখন তো ওদেরকে খারাপ ছেলে মনে করতাম, আজ বুঝতে পারি এরা প্রত্যেকেই আমার কাছ থেকে একটা করে স্যালুট সহ আজীবন সম্মাননা পাবার যোগ্য। ওদের মতো ডাকাবুকো হতে পারলে এ-জীবন এমন কুকুরের পায়ের কাছে কুকুরকুণ্ডলি বসে থেকে গুজরাতে হতো না। আজকের এই জিভ-বেরোনো-জেরবার জীবিকালাঞ্চিত কুত্তাজন্মে সেই সাইকেল-ভাড়ায়-চালানো অভিযাত্রী বন্ধুগুলোই আমার নিতিকার অনুপ্রেরণা, নিঃশ্বাসবান্ধব গ্যাসবার্নার, ফুয়েলস্টেশন আমার।
৬
বড় হতে থাকি এবং ক্রমশ সাইকেল থেকে দূরে যেতে শুরু করি। কিন্তু অনেক পরের গল্প এসব, অন্তত মহাবিদ্যালয়িক প্রবেশিকা পাশ দেবার আগ পর্যন্ত বাইসাইকেলসিট থেকে নামতে হচ্ছে না, জাম্পকাট দিয়া আগাইয়া আনছি এখানে। টেলিভিশন দেখতে শুরু করার আগে, ছেলেবেলায়, বই হাতড়াতে শুরু করি। টেলিভিশন ঘরে তুলতে বাপচাচারা ভয় পাচ্ছিলেন পাছে আমরা মানুষের মতো মানুষ হইতে কসুর করি। বিনোদনের কিছুই ছিল না হাতের কাছে, খানকতেক বই তো মুজতবা আলীর দেশে ঘরে ঘরেই থাকে। বইপড়া শুরু কোনো প্রেম ও পণ্ডিতি থেকে নয়, বইয়ের প্রতি উঁহু-হেহে প্রেম তখনও ছিল না আজও নেই, বইপড়া শুরু হয় আমার জীবনে টেলিভিশনের অনুপস্থিতি ও অভাব থেকে। সেইসব বইয়ের মধ্যে আমরা সাইকেলের সিকোয়েন্স খুঁজে বেড়াতাম। কাকাবাবু সিরিজের বইগুলোতে কখনো কখনো সাইকেল পাই, শাহরিয়ার কবির বা আলী ইমাম প্রমুখদের কোনো কোনো কাহিনিতে, একসময় সাইকেলের জ্যান্ত একটা বইয়ের সঙ্গে দেখা হয় যার নাম ‘মোটরসাইকেল ডায়ারিস’, এর্নেস্তো চে গেবারা সেই সাইকেলের ডানায় চেপে লাতিন দেশগুলো ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে লিখছিলেন পথে পথে হল্ট করে একটা-দুইটা করে ডায়রিভুক্তি আর ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন অনিবার্য ও অবিসংবাদিত। অনেক অনেকদিন বাদে যখন বড় হতে হতে বুড়ো হতে চলেছি, তখন আরেকবার সাইকেলপ্রেম রিভিজিট করে জয় গোস্বামীর কবিতা পড়তে যেয়ে। জয় গোস্বামী কবিতা লেখার আর্লি দিনগুলোতে থাকতেন সীমান্তবর্তী রানাঘাট মফস্বলে এবং এগারো ক্লাসের বিদ্যে পেটে নিয়ে বাংলা কবিতার প্যারাডাইম পাল্টাবার দুঃসাহসী দুঃসহ স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন নিস্তরঙ্গ। ছিল তাঁর ব্যক্তিগত বাইসাইকেল এক, যেইটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি আশেপাশের জঙ্গুলে এলাকায় একা একা একটা ঝোলায় লেখার খাতা-কলম আর পানিবোতল সঙ্গী করে। এইসব বিবরণ জয়ের নানান সময়ের অটোবায়োগ্রাফিক লেখাগুলোতে পেয়েছি অনবদ্য। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড জয়সমগ্র কবিতায় এই সাইকেল উঁকি দিয়েছে আমার চোখে মায়া ছড়িয়ে, এসেছে বিভিন্ন গদ্যলেখায়, এসেছে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ কাব্যোপন্যাসে। কবিতায় এত সুদৃশ্য সাইকেল বাংলায় এর আগে এসেছে বলে মনে পড়ে না।
৭.
সাইকেল এসেছে এর আগেও বাংলা কবিতায়, এসেছে পরেও, এসেছে যেমন সৈয়দ হকের কবিতায়। রাহমানের পাড়াতলী কিংবা আশেক জমাদার লেন অথবা পুরান ঢাকার পার্সপেক্টিভে কি বাইসাইকেল অনুপস্থিত একেবারেই? কিন্তু উপন্যাসে কি গল্পে একটা সাইকেল যতটা আটপৌরে অনুষঙ্গ হিশেবে এলেও চলে, যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ গল্পে এসেছে কিংবা আরও অনেকের গল্পে-উপন্যাসে, কবিতায় প্রেজেন্স হতে হয় একটুখানি ভিন্নভাবে। রেপ্রিজেন্টেশন্যাল হয়েও কোনোকিছুর নিছক প্রতিনিধিত্বের বাইরে যেয়ে একটা ব্যাপ্ত ভূমিতে দাঁড়াতে হয় কবিতাব্যবহৃত প্রতীক/প্রতীকোর্ধ্ব প্রসঙ্গের বাহন তথা বাইসাইকেলটিকে। সেই-অর্থে সৈয়দ হকের কবিতায় একাধিকবার সাইকেল আসতে দেখা গিয়েছে দুর্দান্তভাবে। যেমন সৈয়দ হকের একটা কবিতার নাম, একটু দীর্ঘ কবিতানাম যদিও, ‘প্রয়াত পিতার উদ্দেশে খেদ ও শোকসূচক একটি রচনা’, লক্ষ করা যাবে সেই কবিতায় কেমন দুর্ধর্ষ কায়দায় সাইকেল প্রযুক্ত, কবিতার তৃতীয় স্তবকে যেয়ে এমন পঙক্তিমালা পাবো : “দূরে যাবার সাইকেল তোমার, পিতা, / অপেক্ষায় পড়ে আছে তোমারই পুত্রের কাছারীঘরের কোণে, / সময় ক্রমশ খুলে নিচ্ছে তার নাট বল্টু চেন, / ক্রমে বসে যাচ্ছে চাকা; / এখন তোমার মতো আর কেউ বেরিয়ে পড়বার জন্যে / হাত রাখে না এর হাতলে।” … একই কবিতার কনক্লুডিং কাপ্লেটের আগে এই স্তবক : “পিতা, / তোমার পুত্ররা জানে না / তাদের পায়ের কাছে গর্ত করছে ইঁদুর / এবং নিঃশব্দে; / তারা জানে না তাদের হাতের লেখা এই লেখার কালেই / অচেনা ছাঁদের লেখা হয়ে যাচ্ছে / এবং / তাদের চারদিকে অনবরত খসে পড়ছে নাট বল্টু চেন।” ব্রত চক্রবর্তীর কবিতায় এসেছে আরেকটা সাইকেল, যেমন : “ভূতরূপ সিন্ধুজলে গড়ায়ে পড়িল নূতন / বৎসর — কে লিখেছিলেন? / যিনিই লিখুন, আমি এই নতুন বৎসরকে / বলি, দেখো লোকজন যেন / মাথা উঁচু করে হাঁটে নতুন বছরে। / মানুষের পাশে থেকে কোনো মানুষ / যেন পাগল না হয়ে যায়। / আর সাইকেলের প্যাডেলে পা পাবার দিনে / ছেলেদুটোর যেন হিল্লে হয়, / দেখো হে —” … এইরকম খুঁজলে আলবৎ কবিতায় দ্বিচক্রবিশিষ্ট চক্করযান পাওয়া আরও অনেকানেক যাবে সন্দেহ নেই। কিন্তু সাইকেলপ্যাডেল-নাগাল-প্রাক্কালে প্রেমে পড়ছে যারা, সাইকেলে ডানা মেলে উড়তে চাইছে যারা ভুবনবিন্ধ্যাচল, তাদের জন্য অন্তত দ্বিচক্রযানবান্ধব অভিভাবক হয়ে-ওঠা সক্কলের আগে জরুরি ও জনগুরুত্বসম্পন্ন বৈকি।
৮
সিনেমায় সাইকেল পেয়েছি অনেক। ঢাকাই সিনেমায় একসময় নায়ক সাইকেল চালাত, বাইসাইকেল, অনন্ত জলিলের যুগে এখন তো মনে হয় নায়কের রকেট চালানোও সারা হয়ে গেছে। এ-যুগের মানুষ না আমি, তাই ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। আমার নায়কযুগে ঢালিউডে সাইকেল চলত স্ক্রিনজুড়ে। একজন নায়ক ছিলেন সুব্রত, তার সিনেমায় সাইকেল থাকতই থাকত। শুধু তা-ই নয়, তখনকার সিনেমায় সাইকেল ঘিরে এন্তার হাস্যরস এমনকি প্যাথোসও প্রণয়ন করা হইত। ফিল্মি গানে সাইকেলকে উপজীব্য করে বেশকিছু ভালো ভালো গান রচনা হয়েছে যেগুলো আজও জনপ্রিয়। ‘নীল আকাশের নিচে’ সিনেমায় রাজ্জাকের সাইকেল চালিয়ে লিপ্সিং তো মশহুর। আরেকটা গান মনে পড়ে, ভুলে গেছি সিনেমানাম, ‘পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি / তার সাথে এই মনটারে বেঁধে নিয়েছি’ ইত্যাদি। কিংবা আরেকটা যেমন, ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া … ও-ও-ও পাব্লিক ভাই, সাইকেলের ব্রেক নাই’ … ইত্যাদি। বিটিভিযুগের টেলিফিকশন ড্রামাগুলোতে সাইকেল প্রচুর পেয়েছি। অনেক পরিবর্তিত-ও-পরবর্তীকালে চ্যানেলযুগে এসে একটা নাটক মনে ধরেছে খুবই, ‘সাইকেলের ডানা’ নামেই ছিল যদ্দুর ইয়াদ হয় নাটকটি। সিনেমা প্রসঙ্গে আর মাত্র দুটো উল্লেখ করি। প্রথমত সেই আর্নেস্তো চে গেবারার ডায়রিটা সিনেমা হয়েছে, বেশিদিন হয়নি সিনেমাটা বানানোর, ‘মোটরসাইকেল ডায়ারিস’ নাম দিয়েই। ভীষণ দুর্ধর্ষ লাগে দেখতে। যে-একটা সাইকেল চিরদিনের অশ্রুবিন্দু হয়ে লটকে লেগে রহিয়াছে নয়নে মম, কোনোদিন ঝরিবে না আর, কোনোদিন ঝরিবে না যেন, কোনোদিন ঝরিবেনাকো, মহান সেই ডিরেক্টর ডি সিকা, ‘বাইসাইকেল থিফ’ সেই সিনেমার নাম, যেসব সিনেমা দেখে সিনেমা ব্যাপারটাকে বইয়ের ইক্যুয়াল মর্যাদা দিতে ও ভালোবাসতে শিখেছি, ‘বাইসাইকেলচোরা’ তার মধ্যে একদম শুরুর দিককার একটা। বাপ আর পুতের সেই নিয়তিনিগ্রহের শিকার মুখাভিব্যক্তিগুলো কোনোদিন ভুলিতে কি পারি!
৯.
পুরনো দিনের হিন্দি ফিল্মে সাইকেল, মোটর নয় বাইসাইকেল, অনেক ভিভিডলি ডেপিক্টেড হয়েছে দেখা যাবে। বিশেষত গানের চিত্রায়ণ/কোরিয়োগ্রাফির সময় বাইসাইকেল বাহনানুষঙ্গ হিশেবে গ্রেইট রোল প্লে করেছে। সর্বপ্রাচীন ম্যুভিগুলোর মধ্যে একটা ‘খাজাঞ্চি’, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় এই ফিল্ম রিলিজ হয়েছিল নাইন্টিন-ফোর্টিওয়ানে, যেখানে একটা গানে দেখা যায় একগুচ্ছ কুশীলব পুরো পর্দা জুড়ে একঝাঁক বাইসাইকেলে বেল বাজায়ে বাজায়ে শহরসরণী ধরে চলিয়াছে দূরে। এরই মধ্যে ম্যুভির নায়িকা ও নায়ক ক্যামেরাফোকাস হচ্ছেন ঘুরেফিরে। শামশাদ বেগাম গানটা গেয়েছেন শ্রুতিসুমধুরভাবে যেমনটা তিনি গেয়ে থাকেন বরাবর। ‘সাওয়ান-কে নাজারে হ্যায়’ শীর্ষক গানটা আজকাল ইউটিউবে অ্যাক্সেস করা যায়। এই গানটাই কি সিনেমায়, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টাল সিনেমায়, মেয়েদের প্রথম বাইসাইকেল রাইডিং? আমাদের হাতে তথ্য আছে, কেবল রাজতনয়ের হাতেই তথ্য আছে এমন নয়, কেবল খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করছেনাকো। তবে এইটা আপাতত বলা যায়ই তো যে এই সিনেমায় সাইকেলদৃশ্যগুলো শৈশবে ফুর্তি এনেছিল অনেক কচিকাঁচার মনে। এছাড়া আমরা তখন অলম্পিক্স চলাকালে সাইক্লিং দেখতাম বিটিভি কর্তৃক রিলেকৃত ও রিপ্লেকৃত অনুষ্ঠানে, দেখতাম বছরজুড়ে হপ্তাহিক ‘জিলেট ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস স্পেশ্যাল’ প্রোগ্রামে সাইকেলদৌড়, এবং ঘুমের ভেতর টিলা-পাহাড় বাইতাম সাধের রেইসিং সাইকেল দিয়া।
১০.
সেই আশি-মধ্যপাদে এবং নব্বইগোড়ায় বাংলাদেশের দৈনিক খবরের কাগজগুলোতে একটা নিয়মিত সংবাদভিত্তিক ফিচার হপ্তায় হপ্তায় দেখা যাইত, সচিত্র ফিচার, অভিন্ন কাহিনি, কিন্তু পাত্র-চরিত্রাদি বিভিন্ন। সেইসব ফিলার টাইপের নিউজফিচারগুলো খুব মনোনিবেশে দেখতাম ও পড়িতাম ও মনশ্ছবি দেখিতাম ওই নিউজফিচারে উপস্থাপিত-উপজীব্য নায়কের জায়গায় নিজেরে বসায়ে। সেসব খবরের শিরোনাম হতো সচরাচর এমন : সাইকেলে বিশ্বভ্রমণ। এক-কলাম কয়েক ইঞ্চি চিত্রসমেত খবর। কদাচ দুই-কলাম। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণে দেখা যাইত যে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ ঘুরে এসে পত্রিকার মফস্বল সংবাদদাতার নিকট নায়ক সাইকেলারোহী তথা সাইকেলে-ভূপর্যটক আপন স্বপন ওপেন করছেন এই মর্মে যে তিনি নিকট-ভবিষ্যতে দুনিয়া দাবড়াইতে চান দুই-চাক্কার উড়োরথে চেপে। একই স্টোরি, ট্রিটমেন্ট একই ফিরে ফিরে, কিন্তু পরে এদের ফলোআপ রাখত না কাগজঅলারা বা রাখতাম না আমরাও ফলোআপ তাদিগের। তবে সেইসব সচিত্র ফিচার পড়তে পড়তে নেশার লাটিমে ঝিম ধরত আমাদের, নয়নে হেরিত ঘোর, মনে মনে আমরাও একদিন বিলক্ষণ সাইকেলযোগে বেরিয়ে পড়ব বিশ্ববিহারে বোঁচকাগাট্টি গোল করে, ব্যাকপ্যাক-হোভারস্যাক গোছাবার প্ল্যানপ্রোগ্রাম ছকা হয়ে গেছিল কতবার মনে মনে! নেহায়েত ইয়ার্লি এক্সাম সামনে রেখে একটু ওয়েইট করতে যেয়েই দিরং হয়ে গেছে এতটা। তা, পারায়ে গেছে বয়স এমন তো নয়, সাইকেলখোকাদের বয়স পনেরোতে এসে আটকে থাকে, এমনটাই দস্তুর দুনিয়াজোড়া। ওই-যে, অঞ্জন দত্ত গাইছে, “বাড়ছে না বয়েস পনেরোতে এসে গেছে আটকে” — হ্যাঁ, সেইটাই।
১১.
এরশাদকে টেনেহিঁচড়ে নামানোর বছরে, সেই গত সহস্রাব্দের নয়ের দশকে একদম গোড়ায়, সাইকেল চালানো শিখি আমি। সে-বছর হরতাল লেগেই ছিল বছরভর, সেই হরতালে আমাদের শ্রেণির পরিবারগুলোর মানুষের সমর্থন আমি নিজের চোখে দেখেছি, এখন ওই দিন বা ওই বাস্তবতা নাই আর। তো, রাস্তা থাকত ফাঁকা, আর তখন অত গাড়িঘোড়াও ছিল না আজকের মতো। সদর সড়ক দিয়া গাড়ি যাইত ঘণ্টায় একুনে তেরো-চোদ্দ বড়জোর। তখন তো গুনতাম সড়কের কিনারায় দাঁড়িয়ে গাড়ি এবং বরফকলের বরফবহনকারী ভ্যান, তাই মনে আছে অ্যাক্যুরেইট কয়টা গাড়ি যাইত সড়ক দিয়া। হাইস্কুলদিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি সাইকেল চালিয়েছি রূপককে পেছনে বসিয়ে। পছন্দের দুইটা স্পট ছিল আমার ও রূপকের, সাইকেল এক্সপেরিমেন্টের জন্য নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ, এক হলো সুরমাপাড় আর দুই বিসিক ইন্ডাস্ট্রি এরিয়ার বিশাল বিশাল ধানকলগুলোর সিমেন্টপাকা প্রাঙ্গন ও সেই এরিয়ার ব্যাপক ভূখণ্ড জুড়ে নিরিবিলি আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো। প্রবেশিকা ক্লাসে পড়ার দিনগুলো প্রচুর প্যাডেল মেরে কেটেছে। এরপর সাইকেল চালানো হয়ে পড়ে অক্যাশন্যাল, কাজের তাগিদে, শুধু রূপকের বাড়িতে যেতাম প্রায় বিকেলে তাদের বাড়িসংলগ্ন পেছনদিকের সুবিশাল সব্জিক্ষেতে সূর্যাস্ত দেখতে। রূপক মরেছে ২০০৬ সালে, সে-বছর সেপ্টেম্বর মাসে সর্বশেষ সাইকেলে পা রেখেছি এইটা আমৃত্যু মনে থেকে যাবে বলে আমার ধারণা। আজ্ঞে, সিনেমায় মৃত্যুদৃশ্য দেখানো খুব রিস্কি, মায়েস্ত্রো মেইকার না-হলে কেঁচে যাবার আশঙ্কা হান্ড্রেড পার্সেন্ট, ঠিকঠাক ডিল করতে না-পারলে মেলোড্রামা হয়ে যায় আস্ত জিনিশটাই, গোটা ব্যাপারটা হয়ে পড়ে রিডিক্যুলাস। ওইদিকে না-যাই তাই।১২
“সাইকেলটা আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি / পারব না ছাড়তে এ-ঠ্যাং” — কোত্থেকে আসে ভেসে এই দ্বিপদ অন্ত্যমিলবিহীন পদ্য? ওই-যে, অঞ্জনগান, অঞ্জন দত্তের পপ্যুলার গানটার লাইন, ‘রঞ্জনা’ সেই গানের শীর্ষনাম। রঞ্জনা আমি আর আসব না — পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবে / বলেছে পাড়ার দাদারা / অন্য পাড়া দিয়ে যাচ্ছি তাই / রঞ্জনা আমি আর আসব না। বাংলা গানে এই একটা সাইকেল তো খুবই কিউট, খুবই জীবনঘনিষ্ঠ, রঞ্জনার বাড়ির সামনে দিয়ে এই ন্যালাক্ষ্যাপা চশমাপরা গুডবয় ইমেজের প্রেমমোহিত মুখচোরা প্রায়-কিশোর ছেলেটাকে প্রেমটানে হররোজ চক্কর দিতে যেয়ে প্রেমিকাপ্রতীম সেই ইশকুলসহপাঠিনীর নিজের ও অন্যান্য নানান কিসিমের পাড়াতো বড়ভাইদিগের হাতে হেনস্থা হতে হয়েছে এসবের লেখাজোখা ইতিহাসে নেই, থাকা উচিত ছিল যদিও, অঞ্জনের গানে এইটা আছে। “চশমাটা খসে গেলে মুশকিলে পড়ি / দাদা আমি এখনো-যে ইশকুলে পড়ি / কব্জির জোরে আমি পারব না / পারব না হতে আমি রোমিও / তাই দুপুরবেলাতে ঘুমিও / আসতে হবে না আর বারান্দায়” — এহেন কৈশোর ছিল নব্বইয়ের বাংলাদেশে টাউন-ভিলেজ নির্বিশেষে অলমোস্ট সর্বত্র। অভিমান আর অসহায়তার এমন বয়ঃসন্ধিবিদীর্ণ কৈশোর। কম্পেয়ারে গেলে এখনকার কৈশোর বরঞ্চ অনেক সমর্থ ও সঙ্গতিসম্পন্ন, অনেক ডাকাবুকো-ডেস্পারেইট, অনেক কনফিডেন্ট, অনেক সেল্ফ-রিলায়েন্ট। সময়, বলা বাহুল্য, চেইঞ্জ হয়েছে অনেক। অনেক অধোগতি সত্ত্বেও হয়েছে ঢের অগ্রগতি। সার্টেইনলি।
১২.
কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা কৈশোর ধরে রাখার রহস্যময়ী বিদ্যা হাতে নিয়া দুনিয়া বিহার করে বেড়ান। কিশোর কুমার বা এন্ড্রু কিশোর বা কিশোরী আমানকরের কথা বলছি না আমি, বলছি আমার এক সহকর্মীর কথা। আহমেদ হোসাইন চৌধুরী নাম তার, ট্রেনলম্বা পোশাকী নাম হলেও ডাকনাম মিষ্টি খুব, তারেক। বিবাহিত, তবু মরিয়া যান নাই তারেক এখনো, স্পোর্টসম্যানশিপ তবুও অটুট তার মধ্যে, দেখতে পাই। ঠিক এই কারণে স্ত্রী কর্তৃক অহেতু সন্দেহের শিকার হইতে হয় কি না বেচারাকে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট কিছুই জানার উপায় নাই। আমাদের স্ত্রীরা দারুণ সন্দেহসঙ্কুল কল্পনাশীলা, তাদের সন্দেহ স্বামীদের হাড়হাড্ডি গ্রীষ্মকালেও হিম করে রাখে, তাদের কল্পনায় তারা স্বামীকে জেমস বন্ডের চেয়েও অত্যাকর্ষক রমণীমোহন বলে দেখে ওঠেন হামেশা। তারা চান না তাদের সোয়ামি চিরতরুণ থাকুন চেহারাসুরতে, সেক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টর বেশি বলে মনে করেন তারা। তারেক তদুপরি চিরকৈশোর বরপ্রাপ্ত। স্যুইট ডিস্পোজিশনের অধিকারী। এভারগ্রিন সাইকেলারোহী। নিজের কী-এক শুভদিনে একটা ফোটোগ্রাফ উত্তোলন করেন তারেক, তার ফেবুপত্রিকায়, সাইকেলে আরোহনপূর্বক কিউট ও কৈশোরোজ্জীবক ছবি একটা। তাই-না দেখে এই স্মৃতিরোমন্থনরাক্ষসের স্মৃতির ভোঁদড় উঠল নাচি। দিলাম বিসমিল্লা বলে সাইকেলে প্যাডেল।
১৪.
বাইসাইকেল রিভিজিট করেছে আমার জীবনে, এইটে লেটেস্ট নিউজ। আমার ছেলেমেয়েদের মধ্যে এখন সাইকেলক্রেজ তুঙ্গস্পর্শী বলে লক্ষ করছি। কিন্তু তাদের একজনও সাইকেলপ্যাডেল নাগাল পাবার জোখা হয়ে ওঠে নাই এখনও। কাজেই তারা কল্পনায় সাইকেলচারণ করে বেড়াচ্ছে চান্স পাইলেই। শিশুদের কল্পনার সঙ্গে পেরে-ওঠা আইনস্টাইনের পক্ষেও অসম্ভব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা কল্পনা চালু রাখতে পারে। একসময় আমরা বড়রা তাদের কাছে হার মানতে বাধ্য হই, এবং পরাজয় লুকাতে যেয়ে বাচ্চাদেরে ধমকিয়ে বিশুষ্ক বই পড়তে বসাই। গোমড়া মুখে বেচারাদেরে পড়তে দেখে মায়া জাগে হুহু হাওয়ার বেগে, কিন্তু উপায় তো নাই, জগৎ সাইকেলচারীদের জন্য জায়গা রাখে নাই কোথাও। উচিত ছিল যদিও, কল্পনার জন্য সর্বোচ্চসাধ্য স্পেসটুকু রাখা, সাইকেলে ভ্রমণলিপ্সুদের জন্য দুনিয়ার পথঘাটপ্রান্তরগুলো সুগম রাখা আবশ্যক ছিল। ঊর্মি, কাবুলিওয়ালা গল্পের মিনির ন্যায় মিষ্টি ছোট্ট মেয়েটা, সাইকেলের গল্পে একঘণ্টা পার করে দেয় আমার সঙ্গে। রোহান, আর্লি চাইল্ডহুড বয়সগ্রুপের বেবিবয়, বাইসাইকেলের পেপারক্লিপিংস পেলে বেহুঁশ বকবক করতেই থাকে। সায়ান, দুইবচ্ছর হয়েছে টেনেটুনে, এরই মধ্যে একটা নিজস্ব ভোক্যাব্যুলারি আর ডিকশন গড়ে নিতে পেরেছে সে, কিন্তু তার সিন্ট্যাক্সপ্যাটার্ন এমনধারা যে নোম চমস্কি থেকে শুরু করে আগুপিছু ভাষাবিজ্ঞানীদের কপাল জুড়ে বলিরেখা স্থায়ীরূপ পরিগ্রহ করে অর্থোদ্ধারকল্পে, সেই ছেলেটা বাইসাইকেলদৃশ্য সামনে নিয়ে মশগুল থাকে নিজে, আধা-উন্মাদ বানিয়ে ছাড়ে তার খেদমতগারদের। এদেরকে বাইসাইকেলের স্টিল ফোটোগ্রাফ দেখাতে লেগে গুগলের পাতার পর পাতা পার হই, এদের একেকটা পছন্দের সাইকেলের পাশে হেলান দিয়া আমিও বসি, এদের বকবক শুনি সাইকেলকল্পনায় বিভোর। এদের প্রত্যেকেই জিন বহন করছে আমার বংশের, সেই পৌরাণিক পাখির বংশসুতো, অসহায় কিন্তু আগুনস্বপ্নে টগবগে সেই ফিনিক্স পাখিটির। এ নিয়ে একটা আলাদা প্রোজেক্ট প্ল্যান করতে বসব অচিরেই, সিনেমা দ্য বাইসিকল, যেখানে নিজেরও টুটাফাটা জীবনের ম্যানিফেস্টেশন চোলাই করে ঢোকানোর মওকা পাবো হোপফুলি। টিল দ্যান, বাইসাইকেলে বিশ্বভ্রমণের আরও একটা ব্যর্থ স্বপ্ন রাফখাতায় ছক কেটে রাখুক নতুন দিনের নওল কিশোর, আমার ঘুমুঢুলুঢুলু মেয়ের বয়সী মিষ্টি কিশোরীরা, আমারই জেরক্সকপি ইকড়িমিকড়ি কিশোরেরা। বাইসাইকেল রিলোডিং, অ্যাগেইন! বাইসাইকেল রিলোডস অ্যাগেইন-অ্যান্-অ্যাগেইন ইন লাইফ …
পোস্টস্ক্রিপ্টাম : জীবনের যত মধুর ভুলগুলি, খুব সম্ভবত, ছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজৈবনিক একটা রচনার নাম। শ্যামল যে-বছর মারা যান, সেই বছরেই ধারাবাহিক কিস্তিতে আমাদের দেশের একটা সাময়িকীতে সেই রচনা ছাপা হচ্ছিল, প্রতি হপ্তায় শুক্কুরবারে লেখাটা বাদ-জুম্মা জাম্বুরাভর্তার সঙ্গে রসসিক্ত গিলতাম মনে পড়ে। সেইখানে শ্যামলের হাতের অনন্য তাস তথা তাঁর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ একবাক্যে একাকার করে দেয়ার ম্যাজিক তো ছিলই, ছিল অনেক কিছুই আরও যা যা শ্যামলরচনায় পেয়ে এসেছি চিরকাল। প্রসঙ্গের অবতারণ এইখানে যে-কারণে, সেইটা বলি শুধু। শৈশব সম্পর্কে একটা, বা এইরকম মুক্তো ও মার্বেলতুল্য অনেক, উক্তি পেয়েছিলাম শ্যামলের উপলব্ধিরূপে, যা আমার একেবারে হাড্ডিতে কাঁপ ধরিয়ে দিয়েছিল। শ্যামল বলেছিলেন, হুবহু মনে নেই বলে কোটেশনমার্ক দিচ্ছি না, পকেটে যার শৈশব নেই তার উচিত নয় প্রতিভার নদীতে সাঁতার দিতে যাওয়া। আমার মনে হয়েছিল, হায়, আমার তো শৈশব এক্কেরে ভাতের মাড়, আমার কী উপায় হবে তবে! এর মানে এও নয় যে, প্রতিভাপাত্র হইবারে খুব লালায়িত ছিলাম। কিন্তু তখন তো অরুণ-বরুণ তরুণ কিরণের দিন আমার, যার ফলে দুনিয়া আমার হাতেই নতুন করে তৈয়ার হবে এমন একটা ফল্স প্রাইড মনের কোণে নিয়া জিন্দাবাজারের রাস্তা দিয়া মনমরা হেঁটে বেড়াতাম। যা-হোক, আজ্ঞে, বাচ্চামানুষ ছিলাম নেহায়েত। কিন্তু সত্যি আমার শৈশব অত বর্ণিল নয়, যেমন ও যতটা আমার বন্ধুদের বর্ণাঢ্য সেই-অর্থে তো নয়ই, সাধারণ অর্থেও নয়। আজ ভাবি, নয় নয় করেও অনেক কিছুই তো রয়েছে আমারও শৈশবের, রয়েছে অন্তত অবর্ণনীয়তার বর্ণ, নৈরঙের রঙ। সেই রঙ তো দুই-তিন ছোপ চড়ানো যাইতেই পারে কাঁচা টেক্সচারের ক্যানভাসে। এবং আমার শৈশবে ঘুড়ি নেই তো কি হয়েছে, সত্যি আমার শৈশব ঘুড়িরিক্ত, রয়েছে সাইকেলগল্প আমার। আমাদের প্রত্যেকেরই একটা করে সাইকেলগল্প রয়েছে, এবং অবহেলা না-করে সেই গল্পগুলো লিখে ফেলা উচিত। শৈশবের একইঞ্চি জমিও যেন অব্যক্ত না-থাকে, এককণা মাধুরীও যেন অপচয়িত না-হয়, এইটুকু নিশ্চিত করা জরুর। অনেক তো দেখা হলো দুনিয়ার তেলেসমাতি, অনেক দর্শন-বিজ্ঞান-ডিস্কোর্স, অবশেষে জানলাম প্রতিটি মানুষ তার শৈশব থেকেই পেতে পারে প্রয়োজনীয় ফুয়েল ও ইঞ্জিনস্ট্রেন্থ। তাই না? কিন্তু মানুষ তার শৈশব ভুলে থাকে বলেই দানবিক দিগগজ হয়ে জীবনাতিপাত করে। একটার পর একটা আননেসেসারি ফ্যাসাদ-ঝগড়া বাঁধায়ে চলে জীবনভর। যে মানুষ রোজ একবার তার শৈশব স্মরণ করে, তার দিন কাটে শিউলিকোমল শিশিরের ন্যায় ট্র্যান্সপ্যারেন্ট। মনে হয় আমার। এনিওয়ে। ঊর্মি আমার কাজিনের মেয়ে, ঊর্মি আমাদের অনেকেরই আত্মজার নাম। দুনিয়ার সকল ঊর্মির জন্য উৎসর্গ করি শৈশব আমাদের। শিশুদের কাছে তাদের বাপচাচাদের শৈশবই হতে পারে সবচেয়ে বড় পৈতৃক উপহার। তবে, এই পৃথিবীগ্রহের সকল অয়ন-সায়ান-আইমান-শ্রেয়াস-রোহান-ইথিকা ও ঊর্মিদিগেরে একটা করে লাল সাইকেল কিনে দেয়া দরকার মনে করছি। আমার নিকট শৈশব আর লালরঙা সাইকেল সমার্থক। ফিনিক্স ছিল দুনিয়ার কালো, বাটার জুতার ন্যায় বেঢপ, বড় ব্যাটামানুষদের চালাবার জন্য বানানো। ওই কাল্লু মামাই যা-হোক সান্ত্বনা যুগিয়ে থেকেছে সঙ্গে আমার আকৈশোর। সমস্ত অপূর্ণ আব্দার ভুলে যেতে পেরেছি শৈশবের, শুধু লাল একটা ছোটসাইকেলের অচরিতার্থতা আজও ভুলতে পারি নাই। ফি-বছর বলা হতো, এইবার বছরি-পরীক্ষায় একনম্বর হলেই কিনে দেয়া হবে ড্রিমসাইকেলটা। তা, একনম্বর হলেন তো ছোটচাচা খুঁত বের করলেন অঙ্কে কি ইংরেজিতে, একশতে একশ না-পাওয়ায় একবছর পেছানো হলো স্বপ্ন বাস্তবায়ন, এই করে করে একসময় প্রকল্পমেয়াদই গেল ফুরিয়ে। এক বা দুই মার্কের কারণে হাতছাড়া হওয়া শৈশব হাতে নিয়ে বড় হয়েছি আমরা অনেকেই। এবং বড় হয়ে পেয়েছি সুমনকে, পেয়েছি কবীর সুমনের গান, সেই গানওলা বলছে : “একটুর জন্য কতকিছু হয়নি / ক্ষয়ে-যাওয়া আশা তবু / পুরোটা ফুরোয়নি … একটুর জন্য প্রেম দিলো চম্পট / তবুও হৃদয় করে / আশা নিয়ে ছটফট” — সহস্র দুরাশার ভেতরেও আশাতেই থাকতে শিখে ফেলছি তদ্দিনে, একটু একটু করে এর গানে ওর গানে নাড়া বেঁধে শ্রবণদীক্ষা নিয়ে, একটু একটু করে শিখে ফেলছি ইস্রাফিলের প্রলয়শিঙার মুখেও ধরে রাখতে হয় কেমন করে দেবদূতের স্বর্গীয় হাসিটা। আজ বুঝতে পারি, ওইসবই ছিল স্ট্র্যাটেজি — দিচ্ছি-দিচ্ছি করে সাইকেলটোপ ফেলে আমাদিগেরে বৈতরণী অতিক্রম করানো আমাদের বাবাকাকার — ছোটদেরকে ঠকানোর, অথবা বড়দের টিকে থাকার। ডারউইনের জৈববিবর্তন তত্ত্ব ভুলে যেয়ে বা অস্বীকার করে জীবনধারণ তো সম্ভবও নয়, এইসব বুঝতে পেরে একসময় ছোটচাচার ওপর থেকে রাগ পড়ে এসেছে বড় হতে হতে। ঊর্মির জন্য, জগতের সকল ঊর্মির জন্য, আমার শৈশবের না-পাওয়া সেই লালবর্ণা বাইসাইকেলের সমান আবেগের ভালোবাসা। বাইসাইকেলবেলা আবহমান, অনবদ্য, উড্ডয়নশীল।