যাত্রাবিন্দু অথবা রাস্তাবাদ্য । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৬:৩৫ অপরাহ্ণ, | ২৫৫২ বার পঠিত
নিম্নপত্রস্থ রচনাটা ছাপা হয়েছিল উতঙ্ক পত্রিকায়, ‘প্রিয় কবি’ থিম নিয়ে বেরোনো পত্রিকাটার সেই বিশেষ সংখ্যাটা বেরিয়েছে বছর-খানেক হতে চলল, ২০১২-ফেব্রুয়ারিতে-সহসাপ্রয়াত পশ্চিমবঙ্গজ কবি জয়দেব বসু নিয়ে রচনাটা লিখেছেন জাহেদ আহমদ। এমনিতে উতঙ্ক পত্রিকাটা টাঙ্গাইল থেকে সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়ে চলেছে দশকাধিক কাল ধরে। যেখান থেকে এই পুনঃপত্রস্থ রচনাটা আহৃত, সেইটে উতঙ্ক দশম খণ্ড, কবিতাপাঠকের পছন্দতালিকার কবি নিয়ে সেখানে লিখেছেন অনেকেই এবং সব-মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত কৌতূহলোজ্জীবক রচনা সেখানে সংকলিত হয়েছে লক্ষ করা গেল। পত্রিকাটা এই এত লম্বা সময় ধরে চালিয়ে আসছেন যৌথভাবে কথাসাহিত্যিক রাশেদ রহমান ও কবি স্বপন সৌমিত্র। যথাক্রমে লেখক ও প্রথম-প্রকাশকালীন সম্পাদকদ্বয়ের একজনের মৌখিক সম্মতি নিয়ে এই রচনাটা রাশপ্রিন্ট পুনঃপ্রকাশ করছে। পরিবর্তিত মাধ্যমে পুনঃপ্রকাশকালে এই লেখাটা যারা আগে দেখেছেন/পড়েছেন এবং যারা এখন এতদ্বারা এইটে দেখতে/পড়তে চলেছেন তাদের সবার জ্ঞাতার্থে এর প্রথমপ্রকাশকালীন তথ্য উল্লেখ করা হলো।
সম্ভব কি এমন যে একজন কবি চিরদিন অপরিবর্তনীয়রূপে শ্রেয় ও প্রিয় গণ্য রইবেন একজন পাঠকের কাছে? একজন কবি চিরজনপ্রিয় রইতেই পারেন গোষ্ঠীর কাছে, দেশ-জাতি ও দুনিয়ার কাছে, যেমন রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-বোদলেয়র-পাউন্ড-এলিয়ট প্রমুখ ভুবনজনপ্রিয়। কিংবা গ্রাহ্য তারা যার-যার নিজেদের জাতি-গোষ্ঠীবাসীর কাছে। এখন অষ্টপ্রহর কেউ কি কীর্তন শুনতে চাইবে? একইভাবে কেউ চাইবে কি দিবানিশি খেউড় অথবা মার্গউঁচু ধ্রুপদ খেয়াল শুনিয়া যাইতে? একটানা সারাক্ষণ বৈষ্ণব পদাবলি কি সুফি কালাম অথবা ঔপনিষদিক শান্তিবৃষ্টি কিছু পাঠকের পোষাইতে পারে, সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। কিন্তু বেশিরভাগ পাঠকের, অন্তত মনোলীন উচ্চারণে একা একা পাঠ ও পায়চারি করেন যে-সমস্ত পাঠক, চাই নিত্যপ্রবাহিত কবিতার যোগান। এক ও অভিন্ন নদীতে দ্বিতীয়বার স্নান করা যায় না যেমন, তেমনি একজন কবিতে লাইফ কাটিয়ে দিতে পারেন মহামানবের মতো মহাপাঠকবৃন্দ। তেমন একনিষ্ঠ, মনোগ্যামাস, লা-শরিক কবিতে আস্থাশীল তথা ঈমানদার পাঠকের সংশ্রব এড়িয়ে চলাটাই নিরাপদ। কাজেই প্রিয় কবি সবসময় নেসেসারিলিই একাধিক, কবিতাপাঠক কখনো তৌহিদি জনতার ন্যায় এক-নর্তক হতে পারেন না, উৎকৃষ্ট কবিতাপাঠের সিলসিলা একজন পাঠককে সর্বদা বৈচিত্র্য আবাহনের দিকে ধাবিত করে।
একজন কবি, বেশ কয়েকজনের মধ্যে, কম্প্যানি দিয়ে চলেছেন গত এক-দশক ধরে জনৈক নামধামখ্যাতিযশহীন কবিতাপাঠককে। সেই কবিটির নাম জয়দেব বসু। নদীর নাম সই অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা, আর আমাদের সেই পাঠকের নাম তো জানে নগরের নয়জনা। আলাপ-পরিচয় হলো, এইবার খোঁজ করা যাক কবির শক্তিমত্তার। মুশকিল হলো, কবির শক্তিমত্তা আলোচনামাধ্যমে দেখানো অসম্ভব না-হলেও অসম্ভবের খুব কাছাকাছি। কিংবা যারা পারেন দুইপাতার বকবকানি দিয়া কবিতা সনাক্ত করতে, কবিকে চেনায়ে দিতে, তেমন তালেবর তো সবাই না। যারা পারেন, যেমন জিম-ইন্সট্রাক্টর অথবা সার্কাসের রিং-মাস্টার বা ডাব্লিউডাব্লিউএফ চ্যাম্পিয়ন রেস্লার অথবা পাড়ার মোড়ের কলেজ-প্রভাষক, তাদের দ্বারস্থ হইলে পরে একটা মাপ পাওয়া যাইতে পারত। তবে কবিতা ও কবি ডিটেক্টিং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় সেই কবির কবিতা পড়া, আলোচনাফালোচনা বা কবি ও কবিতার উপর দুরুদ-শরিফ পড়ার মাইফেল আদৌ কাজের কিছু না।গাঁওয়ার রাধিকার কাছে লেখার হাত ফিরে চেয়েছিলেন জয়দেব বসু। সুন্দর একটা কবিতা আছে এই গাঁওয়ার রাধিকাটিকে নিয়ে, জয়দেবের, যে-রাধিকা কিশোরী ও কটুগন্ধ শরীরের এক গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দা। আমার এক বন্ধুকে আমি জানি যে কিনা সারাজীবন তার লেখার হাত ফিরে পেতে চেয়েছে দুনিয়াবি সমস্ত সুখ-সুবিধা-মানসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে। কেবলি দিনরাত সে তার লেখার হাত ফিরিয়ে দেয়ার অ্যাপিল করে গেছে পাখির কাছে, ফুলের কাছে, পতঙ্গেরও কাছে। একটা অক্ষরও সে লিখে উঠতে পারে নাই জিন্দেগিতে, কেবল একপৃথিবী লেখার খোয়াব দেখে গিয়েছে জীবনভর আর তালেবর তর্জনগর্জনবীরপুঙ্গবদের তাঁবেদারি করে মরেছে। এখনও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বাকি তার। দুনিয়ার যত জন্মগর্বী অ্যাপার্টমেন্টডগ মিলিয়নিয়্যরদের ডোরে ডোরে যেয়ে ডেকে ডেকে ফরিয়াদ করে ফিরেছে : একটাবার আমি আমার লেখার হাত ফিরে পেতে চাই, প্রিয়! প্রভু আমার, পরম সখা, আমারে আমার লেখার হাত ফিরিয়ে দাও হে! এই মিনতি করি তোমায়, ফিরায়ে দাও লেখার হাত, শালিক আমার, কাচারিমালিক, ছালবাকলা-উঠে-যাওয়া লোলচর্ম লোলুপ-লুম্পেন জমিদার, হে মিছামণ্ডল, বাঘ ও মোষ সম্প্রীতিশীলনের হে ঘাটের জল, হে দেড়-টাকার ছাগল, হে আমার হাজারটাকার বাগানমালিনী, ফিরে পেতে দাও মোরে লেখার হাতখানা আমার! পারো যদি তো দোসর হও, মকদুর থাকে তো জোগাও মোরে লেখার প্রাণনা, না-পারো তো তফাৎ যাও। অবিলম্বে দূর হঠো, মহাজ্ঞানী নাদান কমিনে কাঁহিকা, আভি নিকলা হারামজাদে!
সেই নির্বোধ উন্মাদ বন্ধুটিকে আমি তোতাপাখির মতো থোতামুখ ধরে বুঝাতে যেয়ে ব্যর্থ হয়েছি কিচ্ছুটি বুঝাইতে। সে কিছুতেই না-বুঝিল যে, এই পথ একলার। এই পথে ফরিয়াদ বৃথা। এই পথে নেই থাকতে কোনো কৈফিয়তের দায়। এ একার যুদ্ধ, লড়াই একলার। এই পথে সঙ্গী নেই, কমরেডশিপ-কমিসারিয়েট-কমান্দান্তে নেই, লিখনকৌশল শেখাবার কোনো কমান্দান্তে থাকে না কারোরই। সংঘ ও সৌহার্দ্য সমস্ত গড়পরতাদের জন্য। গড় প্রণত হয়ে সাষ্টাঙ্গে পেন্নাম ঠুকে জাঁহাবাজ দিনগুজরানের জন্যই জন্ম গড়পরতাদের। যারা দূরে যেতে চায়, তা তারা পারুক বা না-পারুক, ভ্রমণসময়ে তাদের কোনো সঙ্গী নিতে নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কম্প্যানিয়নশিপ সতত ষড়যন্ত্রশীল, শেষমেশ ব্যক্তিকেই সমাধা করতে হয় কাজ, সংঘ অকাজের সর্বদাই। কিন্তু পুচ্ছ নাচানোর জন্য সংঘ খুব দুর্দান্ত বাহন। তোমরা কী দেখো নাই, হে সৃজনশিখরস্পর্শেচ্ছু মানবজাতি, কত কত পুচ্ছনর্তকের দিগ্বিদিক দাদাগিরি! দেখো নাই কি, নাঙ্গা তলোয়ার হাতে লয়ে তারা কেমন তুলকালাম করিয়া গিয়াছে এই সেদিনও! দুয়ারে দুয়ারে, দ্যাখো আজি খেলা ঘুরিয়াছে, সেই পুচ্ছসর্বস্ব পুংটারা কেমন করুণা মাগিয়া বেড়াতেছে! এমনই তো হবার কথা, কালে কালে এইই তো হয়ে এসেছে, সংঘষণ্ডাদের ক্ষেত্রে অন্যথা কিছু তো হবার নেই। কাজেই তুমি সংঘে সদা সন্দিহান থেকো, যেমনটি ছিলে চিরকাল, শুধু নিজের হিম্মতে একিন রাখিও। পথ যত বন্ধুর, মনে রেখো, গন্তব্য ততই বিন্দাস সুমধুর। এবং, পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন, এই পথ একলার। কিশোরী কিংবা ভরযুবতী কেউই পারে না এই অগস্ত্যযাত্রায় শরিক হতে।
এখন জয়দেবের কবিতাটা আওড়াই। কবির প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘ভ্রমণকাহিনি’, প্রকাশকাল ১৯৯০, সেখানেই সুলভ কবিতাটি। কবিতার শিরোনাম ‘যাত্রাবিন্দু’, কবি জয়দেব বসু।
আলপথে গোলাপি কুর্তা পরা কিশোরীর স্ন্যাপশট, আমাকে লেখার জোর ফিরে দাও। যায় সূর্য, অস্ত যায় পশ্চিম গগনে। বরফশূন্যতা ভেঙে কোথায় ছুটছে ট্রেন, দু-পাশে সবুজ দড়ি, পাতাবেড়া। এতক্ষণ রাগে মাথা ঝনঝন করছিল, দেখো, এখন মেঝেতে কারা শুকোচ্ছে সেদ্ধ-করা ধান। নিমেষে মিলিয়ে গেল ল্যাম্পপোস্টে ভর-দেওয়া মেঝেনশঙ্খিনী, সন্ধ্যার নিসর্গে তার বাহুমূল থেকে উঠে এল তীব্র, কটু ঝাঁঝ। হে গন্ধ, প্রসন্ন হও, আমার অক্ষরজ্ঞান এখনো হয়নি। রাত্রিদিন এককথা ভ্যানর-ভ্যানর আমি শুনতে পারি না। কে না জানে, মেয়েটি আমাকে দেখে প্রতিদিন নাক কোঁচকায়! কী আর করার আছে, সব ছেলে প্রণয়ের উপযুক্ত নয়। তা বলে কি বিষ খাব, ত্রিভঙ্গ মেঝেন, বলো এতদূর নাটক কি ছাব্বিশে সাজে? তারচেয়ে দেখো ওই অপার আকাশ থেকে ঝুলে পড়ছে একগুচ্ছ মেঘ। কুটিল, বিষণ্ন গ্রাম ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে, আমাকে গল্প বলো তার। ভুবনের পাঠ বলো, কীভাবে মাসীর কান কেটে নিয়েছিল? বলো, কবে গেছিলেন উন্মাদ কবির কাছে মার্ক্স ? এবং মিনতি করি, বন্ধ করো একঘেয়ে পরাজয়গাথা। তেষট্টি পয়জার মারি পিরীতব্যর্থতাকে। আমাকে লেখার হাত ফিরে দাও, বেমানান কুর্তা-পরা গাঁওয়ার রাধিকা।
জয়দেব বসু-র কবিতাসংগ্রহ, প্রথম খণ্ড, প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। দেখামাত্র খরিদ করেছিলাম তৎকালীন ৩৫০ বাংলা টাকায়। এরপর, ২০১২ ফেব্রুয়ারিতে, জয়দেব বৈকুণ্ঠে চলে গেলেন। অতি আচমকা, মাত্র ৫০ ছুঁতে-না-ছুঁতেই, দারপরিগ্রহহীন রহস্যসম্রাট যেন। কবির উপযুক্ত প্রস্থানবয়স কত, এ এক তর্কযোগ্য প্রশ্ন, যা-হোক। জয়দেব আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে একদম অন্য মর্তবার একজন। কোন কারণে, কেন ও কতখানি প্রিয়, এইসব নহি অবহিত। প্রেম নিয়া গান যতটা ভালো, পর্যালোচনা ঠিক ততটাই বিকট। মনে হয় আমার যে, প্রেমাস্পদ নিয়া মিটারস্কেলে মেজারমেন্ট করা কৃত্রিম প্রেমের প্রমাণ। পুরা আর্টিফিশিয়াল। বুক ও কোমরের ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স অথবা ছাতি-সিনার মাপজোখপূর্বক তো প্রেম হয় না। ভালোবাসাটাসা কেন হয়, কেমনে হয়, সেসবও তো বিলকুল বলতে পারি না। যাউক, তবু দুইয়েকটা কথা আজ বলে রাখি এখানে। এভাবেও কবিতা যায় লেখা, তা জয়দেব না-পড়লে জানা হতো না। আমরা এখানে বৈষ্ণব ভাবদর্শনের কবি, মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ তিনি বটে এবং সংস্কৃত ভাষায় ‘গীতগোবিন্দ’ মহাকাব্যকার, জয়দেবকে নিয়ে কথা বলছি না জানবেন। বলছি গত শতকে আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গজ কবি জয়দেব বসু সম্পর্কে, যিনি বাংলায় কবিতা লিখতেন, ঠাকুরহস্তে স্থাপিত পাঠভবনে যিনি বাংলা পড়েছেন এবং সম্ভবত পড়িয়েছেনও অনেকবছর এখানে-ওখানে।
রাখুন তো, যত্তসব অগুরুত্ববহ কথাবার্তা, খায়াদায়া কাম নাই খালি বকরবকর। বরং বলা জরুরি যে, এভাবেও-যে বাইরেকে ভেতরে ধরা যায়, এইভাবে বাইরের বিষয়াশয় কবিতায় আনা যায়, জয়দেব দেখালেন। অবশ্য এই কাজ আগেও হয়েছে বাংলায়, একঘেয়ে অন্তর আর হৃদিভাসানো অলকানন্দা খোঁড়াখুঁড়ি না-করে একটু চোখের আলোয় দেখা চোখের বাহিরের ভুবনটাকে কবিতায় গেঁথে তোলার কাজ, কিন্তু মোস্ট-অফ-দি-টাইম সেসব অ্যাফোর্ট স্লোগ্যানধর্মী মেলোড্রামা হয়ে থেকে গিয়েছে। এই কাজে কেউ নজরুল পর্যন্তও যেতে পারলেন না, নেরুদা তো না-ই, উত্তরণ দূর অস্ত। নাজিম হিকমতের কপি করে গেলেন কাতারে-কাতার, বেশুমার বাংলার কাব্যকুরুক্ষেত্রের তা-বড় তা-বড় পাণ্ডবগণ, শুমার করিয়া দেখো উহারা কয়েক হাজার। যাউক, স্লোগ্যান বা মেলোড্রামাও খুব খারাপ কিছু না; মানে, চলে আর-কি। কিন্তু জয়দেবে এসে এ-বাবতে বেশ সুখানুভূতি লাভ হইল। মনে হলো, বাহ্, বেশ তো! মুরদ আছে দেখি এই বেগহীন আবেগভাণ্ড বঙ্গভূমির কবির! না, এ কেবল সমাজবাস্তবের কাব্যিক বিবৃতি কিংবা রাজনীতি বিধৃত করা নয়; তীব্র ঘৃণা আর প্রতিবাদটাকে, অনাস্থা আর প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধটাকে, প্রেমে ও প্রজ্ঞায় মেপে-ছেনে-ছেঁকে আমাদের সামনে রেখে যাওয়া। আমাদের পায়ের তলার মাটিস্তরে ঝাঁকুনি দেয়ার প্রয়াস করেছেন জয়দেব। মতান্তরে জগতের বহির্দেশটাকে জগতের অন্তর্দেশে ট্র্যান্সফার বা ট্র্যান্সমিট করা। সামহাও, জয়দেব এইটা ভালোই ডিল করতে পেরেছেন তাঁর সমকালে। এবং মোস্ট সাক্সেসফুলি, মনে হয় আমার। জয়দেব বসু, অনেক দিক থেকেই, অন্য কবিদের চেয়ে ভিন্ন। তাঁর সমকালে তিনি-হো-ভিন্না আলবৎ। মনে হয় যেন জয়দেব ঠিক আমারই রাগটাকে ধরতে চেয়েছেন, পেরেছেনও, অনেকটাই। কিন্তু জয়দেবকেন্দ্রী কথকতা আজ আর নয়। এঁর কবিতাকলাকৌশল নিয়ে একটা লেখা বানাবার সামর্থ্য অর্জন করতে পারব নিশ্চয়, একদিন, আশা করি। তদ্দিন তাঁর কবিতাসংগ্রহ প্রথম খণ্ডের প্রচ্ছদ ফিরে ফিরে দেখি, শাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে রেড-অ্যান্ড-ব্ল্যাক হরফ ইতস্তত ছড়ানো, ফ্রন্টকাভারের বিলো-অ্যালাইনমেন্টে একটা দুর্দান্ত সরল ইমেজ পুট করা। সেখানে একটা মানুষের মুণ্ডুহীন আবক্ষা আদল, টিশার্ট-পরিহিত কোনো যুবার আবছা ছবি, মুণ্ডুহৃত মুখস্থলে একটা ক্যামেরা বা বন্দুকের ভিউপয়েন্ট কিংবা চাঁদমারিচিহ্ন, গোল সেই ফোকাসমার্কের দুইপাশে একটা আধছিলা হলুদ কলা আর একটা চড়ুইপাখি। ব্যাককাভারে ফের ছোট্ট দুইটা মোটিফ, একটা আধখাওয়া আপেল সজীব ও সবুজ, ফের সেই ভিউপয়েন্ট বা টার্গেটমার্কের সিল্যুয়েট। বইটির প্রকাশক সপ্তর্ষি। প্রচ্ছদচিত্রক রাজীব চক্রবর্তী। ছাপা হয়েছে, ইন্ট্যারেস্টিং যে সেইটা সাহিত্যের মমতারাজ্য কলকাতা থেকে নয়, শ্রীরামপুর হুগলি থেকে। সে-যা-হোক, এইবার ডেরায় ফিরিয়া যাই। যাবার আগে বোনাস ট্র্যাক, একটা না, পরপর তিনটা। আদৌ পরিকল্পিত নয়, নিতান্ত ঝটিতি এই নিবন্ধ, বোনাস ট্র্যাকগুলো দৈবচয়িত। চোখ-কান বন্ধ করে, ইয়াআলি বলে, ডানেবাঁয়ে না-তাকায়ে কথাগুলো বলে ফেলা সম্ভব হলো। নচেৎ ফেঁসে যেতাম হাইড্র্যান্ট যথা।
আমি কি তরুণ কবি? রোহিতাশ্ব, মতামত দাও। উদাসীন হাসো কেন? এ-কথা শুনেছি বটে, তুমি কোনো কবিফবি পাত্তা দাও না। শিল্পে তোমার, হায়, দিলচসপি নেই। কী আর করার আছে, সকলে পাঠক নয়, কেউ কেউ আরো বেশি — কবিতাবিরোধী। তবু এই অভিধার মীমাংসা আশু প্রয়োজন। তরুণ কবিরা শুনি অনেকেই অতিবিপ্লবী। কেউ কেউ দাড়ি রাখে, কেউ যায় খালাসিটোলায়। বাকি সব করে রব এখানে সেখানে। তবু তারা নিয়মিত জ্যান্ত কবিতা লিখে থাকে। রোহিতাশ্ব, লাল ঘোড়া, আমাদের অতিবামে অ্যালার্জি রয়েছে। অন্যসব রোগভোগও সম্প্রতি কাটিয়ে উঠেছি। এবং কবিতা, দেখো, লিখতে পারি না। আমার ব্যাপার তবে বাদ দাও। এসো, ওই কবিদের ছুঁয়ে দেখি অনুভূতিদেশ। এখানেও সমস্যা ঘনাল। কে কবি কবে কে মোরে? যে-জন ডিভোর্স দেয় শবদে শবদে সেও কেন কবি নয়? যদি সেই দম্পতি হয়ে থাকে পুরাতন — সরস্বতীহীন? (দুশ্চিন্তা; ভ্রমণকাহিনি, ১৯৯০)
তোমাদের হাত থেকে টাকা নিই, বোধ নিই, বিবেকখচিত এক পিকদানি নিই। গলা শিরদাঁড়া তাতে ধরে রাখি। আর শোনো, বিষণ্ণতা ছুঁয়ে থাকি রোজ। শুধু যে-ক’দিন জ্বর হয়, মাধুকরী অসমাপ্ত থাকে, পেটের ভিতরে কেউ কথা বলে। প্রাথমিক কষ্টটুকু সহ্য হয়ে গেলে ভেদবুদ্ধি মাথা চাড়া দেয়। বোঝা যায়, আরো বহুদিন তোমাদের উপদংশে চুমু খেতে হবে। (বুদ্ধিজীবী; ভবিষ্যৎ, ১৯৯২)
আজকাল আমি তার মুখটিও মনে করতে ভয় পাই, মাধবী গাছ, যদি আকাশ আবার ছিঁড়ে পড়ে, যদি আবার শ্বাস আটকে যায়, যদি গ্রাস মুখে তুলতে গিয়ে দেখি ভাত নয় — রক্ত জমে আছে ড্যালাড্যালা … ভাবতে ভাবতে ওয়াক উঠে আসে মাধবী গাছ, চারপাশে কেবলই মৃত্যুসংবাদ শুনি, আমার খুব ভয় করে, আমি রোগা হয়ে যাচ্ছি দিন-দিন, নির্জন হয়ে যাচ্ছি, কোথাও যাই না আর, বন্ধুদের বাড়ি না, মা-বাবার কাছে না, রাস্তা পার হতে গিয়ে আচমকা ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি আর শিরদাঁড়া হিম করে ছুটে যায় ট্রাক … মাধবী গাছ, সে তো খুব ভালো আছে, স্বপ্নমগ্ন রেস্তোরাঁর কোণের টেবিলে বসে আছে চায়ের পেয়ালা আর ছেলেটিকে নিয়ে, যেতে-আসতে প্রত্যেকেই তাদের কুশল দিয়ে যায় … মাধবী গাছ, রাত দুটো বেজে যায়, আমার ঘুম আসে না, ভয়ে বুক শিরশির করে ওঠে, আমি তোমাকে এসব কথা বলব বলে রাস্তায় ছুটে যাই, তীক্ষ্ণ হর্ন বেজে ওঠে, চোখের মধ্যে ঢুকে যায় হেডলাইটের আলো … মাধবী গাছ, আমার কী হবে? (ভয়; ভবিষ্যৎ, ১৯৯২)
জয়দেব বসুর নিজস্ব কাব্যভাষা আছে, তার কবিতারাজ্য স্বতন্ত্র, আলাদা তার বাকবিভূতি, এইগুলো তো কথা ঠিকই, কিন্তু কবি-পরিচিতি হিশেবে এগুলো খুবই ছেঁদো ও মামুলি কথা গুটিকয়। লিখনশৈলীর বিচারে তিনি ঝকমকা আধুনিক, অথবা জবরজং খটোমটো উত্তরাধুনিক, অন্তত জয়দেব বসুকে এই লাইনের কথাবার্তায় কুলিয়ে ওঠা যাবে না। তার বিষয়বিস্তার, তার দার্শনিক প্রত্যয় ও অনুজ্ঞা, ইত্যাদি সম্পর্কে বোলচাল জয়দেবের সামনে ফলানো বেফায়দা। তার কাব্যভাষা ও কলম যুগপৎ সময়োপযোগী ও সময়োত্তীর্ণ প্রভৃতি বলেও জয়দেবকে সম্যক বোঝানো যাবে না। জয়দেবকে চেনা যায় তার শিরশীর্ষ ও শিরদাঁড়ায়, চেনা যায় তার শিরার ভেতর বয়ে-যাওয়া রক্তস্রোতে, চেনা যায় তাকে তার রাগে, অ্যাঙ্গার দেখে; এই রাগ, এই অ্যাঙ্গার, তুলনারহিত। এবং, বলা বাহুল্য, চণ্ডাল কাপালিকের রক্তবর্ণ চোখের ভেতর তবুও অস্পষ্ট নয় সেই বিস্ময়কর নরম প্রেম। এমন প্রেম বাংলা কবিতায় ঠিক এইভাবে ছিল না আগে। যারা ঝাঁকের-কৈ জীবনে-যাপনে খাপ খাওয়াতে পারেন না নিজেদেরে, যারা নিজেদের অনুরাগের সমান মর্যাদায় নিজেদের রাগটাও উদযাপন করতে চান, তাদের জন্যই চিরদিন জয়দেব বিরাজিবেন।
এইবার তো একটা আপাত কনক্লুশন টানা লাগে। সেইটা কিভাবে, কেমন করে, নিজেও কি ছাই জানি আমি! দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী সঙ্গ দিয়া চলিছেন যিনি, তিনপ্যারা লিখতে-না-লিখতেই তারে উপজীব্য করে লেখা আর্টিক্যল খতম দেয়া সম্ভব রঙ্গভরপুর শত-সহস্র শ্লোকসমালোচকের দেশ এই বঙ্গভূমিতেই। কিন্তু উপসংহার না-টানতে পারি, একটা কবিতা তো টাঙাতে পারি এর্নেস্তো চে-র স্মরণে লেখা ও টানাগদ্য ফর্ম্যাটে তুখোড় ছন্দস্পন্দিত, জয়দেবেরই কবিতা, শামিয়ানা হিশেবে এর্নেস্তো চে স্মরণসভায় এইটা টাঙানো যায়। বেঁচে থাকলে বছর-চুরাশি বয়স হতো অরণ্যতরুণ কবি, বিপ্লবী, চিকিৎসক ও রাষ্ট্রমুক্তিচিন্তক চে গেবারার। মরে গেলেন বলেই তিনি পৃথিবীর সমান বয়সী আয়ুস্মান হয়ে বেঁচে উঠলেন। ‘অ্যান্টি ইউএস সিন্ড্রোম’ শিরোনামের সেই কবিতাটির পুরো শরীর ছেড়ে শেষাংশটুকু উচ্চারণ করছি শুধু, জয়দেব বসু অদ্ভুত অসহায় আবেগে এটি লিখে রেখে গেছেন তার ‘জনগণতান্ত্রিক কবিতার ইশতেহার ও অন্যান্য’ কবিতাগ্রন্থে। দেখা যায়, কবিতাটিতে, একজন স্নায়ুরোগগ্রস্ত তরুণ তথা কবি নিজে একের-পর-এক প্রলাপের মতো সত্যমর্মান্তিক বকে চলেছেন ডাক্তারের সঙ্গে এবং সবশেষে এইভাবে ক্যাথার্সিস খুঁজে নিচ্ছেন স্বয়ং কবি কিংবা নিচ্ছি বিমোক্ষণ খুঁজে আমরা তার কবিতার পাঠকেরা :
… হ্যাঁ, জানি আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি ডাক্তার, কিন্তু আপনি ফিরে যান, আমাকে একা থাকতে দিন, আমার ভালো লাগছে ফাঁকা হয়ে যেতে, তর্কবিতর্কহীন বিবেকদংশনহীন একদম শূন্য হয়ে যেতে … এই পবিত্র এপিডেমিক — এরই চুমুতে-লালায়-কামড়ে আমি হয়ে উঠছি উন্মাদ, আপনি যান ডাক্তার, আর আপনার কোনো দরকার নেই, ক’টা দিন পরেই আমি পুরোপুরি ভারসাম্য হারাবো, কিন্তু তার আগেই জোগাড় করে নিতে পারব একটা অন্তত ছুরি … হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি একজন প্রায়োন্মাদ পাসপোর্ট বানাতে পারে না, তাছাড়া ইসলামেও আমার বিশ্বাস নেই, তাই বাগদাদ পৌঁছবার সৌভাগ্য হয়তো হয়ে উঠবে না, তবু এই শহরে আমারই মতো অসংখ্য প্রায়োন্মাদের ভিড়ে মুখ লুকিয়ে আমি পৌঁছে যেতে পারব মার্কিন দূতাবাসের সামনে, নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে পারব একটি নিষ্পাপ শ্বেতাঙ্গ দম্পতির জন্য, তারপর … তরুণ মার্কিনটির কণ্ঠায় ঠেকানো ছুরিটা সরিয়ে আনার আগেই, তার ফ্যাকাশে-মেরে-যাওয়া স্ত্রীর নীল চোখের দিকে চেয়ে বলব : ‘‘এর্নেস্তো চে … আমাদের এর্নেস্তোরও এমনই একটা বউ ছিল মাদাম … ভয় পাবেন না, তার মতো অবস্থা কখনোই আপনার হবে না, কেননা শেষ পর্যন্ত আমরা মানুষ … অসহায়ভাবে মানুষ … যা আপনার প্রেসিডেন্ট নন … লিঙ্কনের পর থেকে যা আপনাদের প্রেসিডেন্টরা কখনো ছিলেন না … থুঃ … !’’
জয়দেব তো দুনিয়ার সার্কাসট্যান্টের বাইরে এখন, বছর-দুই হতে চলল, তবে এই তাঁবুর বাইরে বেরোনোর আগে তো বেঁচে ওঠা যায় না প্রায়। একজন অন্তর্লীন দগ্ধ ক্রোধ ও বেদনার কবিকে তাই বেঁচে ওঠার জন্য মরতে হয়। এইটাই নিয়ম এই মিকিমাউস ক্যারিক্যাচার কবিনিসর্গজগতে। এই মৃত, অথবা অতিজীবিত, জয়দেবের কবিমুখ মনে রেখে এই নিবন্ধহ্রস্ব রচনাটা আদৌ জয়দেবাবয়বের ছিঁটেফোঁটাও প্রকাশ করে নাই কিংবা করতে পারে নাই। কিছু তথ্য সংযুক্তি হিশেবে রাখা যাক। ঊনিশশো বাষট্টিতে জন্ম, তথা ভ্রমণ শুরু, ঊনিশশো বারোতে শেষ। পশ্চিমবঙ্গে, আজীবন, আমৃত্যু সেখানেই। ঊনিশশো নব্বই ঈসায়ীতে ডেব্যু কবিতাবই ‘ভ্রমণকাহিনি’। বিশ্বভারতীর পাঠভবন ও উত্তরশিক্ষাসদনে শুরুর দিককার বিদ্যায়তনিক পড়াশোনা। দার্জিলিঙে কেটেছে ছেলেবেলা। শান্তিনিকেতনে কেটেছে ছোট ও বড়বেলার অনেকটা। স্নাতক ও তদুর্ধ্ব পড়াশোনা প্রেসিডেন্সি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ডিসিপ্লিন নিয়ে। ছিলেন রাজনীতি বিষয়ে সক্রিয়ভাবে সোচ্চার, ওতপ্রোত জড়িয়ে থেকেছেন জনমুক্তিকামী রাজনৈতিক প্রত্যয়ের প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে ছাত্রাবস্থা থেকে শেষ-নিঃশ্বাস নেয়া অব্দি। যুক্ত ছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট) — সংক্ষেপে সিপিআইএম — দলের সঙ্গে। এইসব রাজনৈতিক সম্পৃক্তি নিয়া তার কোনো দ্বৈধ-দোলাচল ছিল না, নিজের কবিতায় এসব অভিজ্ঞতা এসেছে অনেক জীবন্ত অবয়ব ধরে, ক্রিটিক ও কমিটমেন্ট দুইয়ের মিলমিশ নিয়ে সেই জগতে জয়দেব স্বতশ্চল। অধ্যাপনা ছিল তার পেশা। কবিতাবইগুলোর মধ্যে কয়েকটা যথাক্রমে : ‘মেঘদূত’, ‘ভবিষ্যৎ’, ‘জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়’, ‘জনগণতান্ত্রিক কবিতার ইশতেহার ও অন্যান্য’, ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’ উল্লেখযোগ্য। দে’জ পাব্লিশিং হাউজ থেকে বেরোনো ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বাজারে সুলভ, সপ্তর্ষি থেকে বেরোনো ‘কবিতাসংগ্রহ’ প্রথম খণ্ড যেমন।