জেরোম কে জেরোম’র গদ্য : ঘড়ি / অনুবাদ : এমদাদ রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ আগস্ট ২০১৪, ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ, | ৩৬০৩ বার পঠিত
জেরোম কে জেরোম, পুরো নাম জেরোম ক্লাপকা জেরোম, জন্ম ১৮৫৯ সালে; ইংল্যান্ডে। ছেলেবেলা কেটেছে প্রচণ্ড কষ্টে। পার্লামেন্টের সদস্য হবার ইচ্ছা ছিল তার, কিন্তু চরম দারিদ্র্য আর মায়ের মৃত্যু তাকে ভীষণ একা করে ফেলে। কাজ করতে শুরু করেন লন্ডন এবং নর্থওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে। একসময় বেছে নেন বিচিত্র পেশা। কখনও সাংবাদিকতা, কখনও শিক্ষকতা… আর সবসময়ই প্রচণ্ড হতাশা। তাঁর গল্প আর বিদ্রূপাত্মক রচনাগুলির রয়েছে বিতর্কিত আর বিখ্যাত হবার খ্যাতি। মার্ক টোয়ান, কিপলিং এবং আরথার কোনান ডোয়েলের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধকে নিয়ে লেখা আর কার্টুনের মাধ্যমে বিদ্রুপ আর আঘাত করাই ছিল তার লেখার মূল লক্ষ্য। হাস্যরস সৃষ্টির মাধ্যমে জেরোম কে জেরোম আসলে মানুষের বিষণ্ণতাকেই তুলে ধরেছেন। লিখেছেন বিদ্রূপাত্মক নাটক, উপন্যাস, গল্প আর বিচিত্র বিষয়ে গদ্য। ১৯২৭ সালে এই লেখকের মৃত্যু হয়। Tea-Table Talk, Three Man in a Boat, Dairies of A Pilgrim ইত্যাদি তাঁর আলোচিত বই।
দুই জাতের ঘড়ি আছে। তাদের মধ্যে এক জাত, সব সময়ই ভুল সময় নির্দেশ করে, এবং এই ভুল সম্পর্কে তাদের থাকে নির্ভুল ধারণা। সময়কে ভুল করে দেখাবার মধ্যেই যেন তাদের সমস্ত মহিমা। অন্য জাতের ঘড়িগুলো, যখনই তাদের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়, তখনই তারা ভুল করতে থাকে। ঘড়িগুলি আরও বেশি ভুল করবে যখন কেউ এই কথা ভাববে—সভ্য দেশগুলির ঘড়ি সব সময়ই নির্ভুল।
ঠিক এরকমই একটা ঘড়ির কথা আমি মনে করতে পারি। যখন আমি নিতান্তই এক বালক। এক প্রচণ্ড শীতের রাতে ভোর তিনটের দিকে ঘড়িটা চিৎকার করে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল। আমরা সকালের জলখাবার শেষ করেছিলাম দশ মিনিটের জায়গায় মাত্র চার মিনিটে, পাঁচ মিনিটের একটু পর পৌঁছে গিয়েছিলাম আমার ইশকুলে, বসে পড়েছিলাম সিঁড়ির ধাপে আর ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করছিলাম। মনে হয়েছিল পৃথিবী তার অন্তিমে পৌঁছে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে; চারপাশের সবকিছু ছিল মৃতদেহের মতো নিশ্চুপ, দণ্ডায়মান।
আমাদের পরিচিত একজনের ঠিক এরকম একটি ঘড়ি ছিল। স্বর্গ-বিষয়ে তার মারাত্মক ধরনের বিপন্নতা ছিল, যে-বিপন্নতা তাকে মাসের পর মাস আচ্ছন্ন করে রাখত। যখন সে তার স্বপ্নগুলোর বর্ণনা দিত, শুনে মনে হত বাস্তব পৃথিবীটা তার কাছে এক ঘোরলাগা আচ্ছন্নতা ছাড়া আর কিছু নয়। তার কাছে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার অর্থ ছিল— শুধুমাত্র একটা ঘড়ির কারণে— চলন্ত রেলগাড়িকে ধরার জন্য বিধ্বস্ত হতে হতেও ধরবার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে লোকটির স্বপ্ন দেখার নির্দিষ্ট সময় বজায় থাকল। সূর্য যেভাবে সকাল-সন্ধ্যা-বিকেল-রাত্রি নির্দেশ করে, ঠিক সেভাবে তার অদ্ভুত ঘড়িটি তার স্বপ্ন দেখবার সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল।
বিষয়টি শিশুদের পবিত্র হাসির কথা মনে করিয়ে দিত, যার মাঝে আত্মার শুদ্ধতা আছে। যেমন, কোন একদিন সকালে, বাড়ির প্যাসেজে তোমার চারপাশে পরিবারের সবাইকে জড়ো করলে, চুম্বন করলে তোমার সন্তানদের কপালে, হাতের আঙুল ছোঁয়ালে তাদের চোখে, তারপর প্রতিজ্ঞা করলে যে আর কোনদিনই রান্না করবার কয়লা আনতে ভুলে যাবে না। অবশেষে হাত নেড়ে, মমতাময় দৃষ্টিতে তাদের বিদায় জানালে আর ছাতামাথায় স্টেশনের উদ্দ্যেশে চলে গেলে।
অথচ আমি কখনই এই বিষয়টা ভাবতে পারি না,– আমার পক্ষে এই গোঁ ধরা, যা অস্বস্তিকর— তোমার গতির চেয়ে দুই মাইলের বেশি এগিয়ে গিয়ে এটা আবিষ্কার করাঃ এক ঘণ্টার চারভাগের তিনভাগ সময়ের আগেই তুমি স্টেশনে পৌঁছে গেছ (প্রত্যাশার চেয়ে কতই-না দ্রুত!), অথবা ধীরে সুস্থ্যে ব্যস্ততাহীন পদচারণা করেছ পুরটা পথ, এবং স্টেশনের বুকিং অফিসের বাইরে ইতস্তত কালক্ষেপন করছ, নয়তো আশেপাশে ঘুরতে-থাকা স্থানীয় কিছু নির্বোধ লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলছ, অসতর্ক হামবড়া ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ প্ল্যাটফরমে আর কেবল তখনই তুমি দেখতে পেলে— ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে! অন্য জাতের ঘড়িগুলি— খুবই সাধারণ কিংবা সব সময়েই ভুল করে যারা— যথেষ্টই শান্তশিষ্ট। তারা তোমার ক্ষতি করবে না। তুমি তাদের দম দিয়ে, —যখন ঘড়িগুলি যাপন করছে জীবনের প্রকৃত অবসর— সপ্তায় এক বা দুইবার ঠিকঠাক করে চলতে পারার মত ‘জীবন্ত’ করে রাখো (এবং তুমি যেভাবে লন্ডন টম-ক্যাটটাকেও ‘নিয়মিত’ চলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাও।) কিন্তু তুমি যে এসব করছ, তা কোনও আত্মপরায়ণ অভিপ্রায় থেকে জেগে উঠে না, এটা তৈরি হয় ঘড়িগুলির নিজস্ব দায়িত্ববোধ থেকে, তুমি এটা শুধু অনুভবই করতে পার, যে-কোনকিছুই ঘটতে পারে, তুমি এর দ্বারা যথোপযুক্ত কাজটিই করেছ, তাতে তোমার ভিতর কোনও অপরাধবোধ জেগে উঠবে না বা অপরাধী হিসাবে শাস্তিও ভোগ করতে হবে না।
যতদূর বোঝা যায়, কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য— যা তুমি কখনই কল্পনা কর না এবং তাতে তুমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত বা হতাশও নও— তুমি মেয়েটির কাছে জানতে চাইলেঃ এখন কয়টা বাজে?
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে জানাল— হ্যা, খাবারঘরের ঘড়িতে দেখতে পাচ্ছি দুটো বেজে পনের মিনিট।
এরকম উত্তরে তুমি কিন্তু কোনভাবেই বিভ্রান্ত হবে না। খুবই মামুলি একটা বিষয় হিসাবে এটাকে বিবেচনা করবে। হয়তো কোন এক জায়গায় তখন সবেমাত্র বিকাল হয়েছে। শুধু এটা মনে করবে যে তুমি কৌতূহলোদ্দীপক পারিপার্শ্বিক অবস্থার সবকিছু সম্পর্কেই যথেষ্ট সতর্ক আছ আর ঘড়িটি চারটা থেকে মাত্র চল্লিশ মিনিট এগিয়েছে। তুমি খুব শান্তভাবে তার শক্তি ও ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা জানাবে এবং অবাক হবে এই সবকিছু কীভাবে সম্পন্ন হচ্ছে সেই কথা ভেবে।
স্বয়ং আমি এমন একটি ঘড়ির অধিকারী হয়েছিলাম, যা ছিল জতিলতায় পূর্ণ, দুর্বোধ্য, গতানুগতিকতা মুক্ত এবং আনন্দচ্ছ্বল। আমি ভেবেছিলাম ঘড়িটা দ্রাঘিমারেখার যেকোনো অবস্থানকেই নির্দেশ করতে পারে। উপকূল থেকে জলপথে যাত্রার উপযুক্ত মুহূর্ত-নির্ণায়ক ঘড়ি হিসাবে তার কাছে আমার যতটুকু প্রত্যাশা, তা না মিটিয়ে সে কাজে বিরত থাকত, তবে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, সে তার কাজকে কেবল এক স্বয়ংক্রিয় ধাঁধা হিসাবেই বিবেচনা করত। ধাঁধাগুলি বিচিত্র কৌতূহল ও আকর্ষণে ভরপুর।
একবার আমি এক লোকের কাছে শুনেছিলাম যে তার এমন একটি ঘড়ি ছিল, শুধু সে ছাড়া আর কারো জন্যই সেটা উপকারী যন্ত্র ছিল না। সে-ই ছিল সবচে ব্যতিক্রমী মানুষ, যে ঘড়িটার মতিগতি সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছিল। লোকটা আমায় বলেছিল— এটা এমন এক চমৎকার যন্ত্র, যার ওপর তুমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নির্ভর করতে পারবে, তবে তোমাকে এর চারিত্রিক কায়দা সম্পর্কে অর্জন করতে হবে পর্যাপ্ত জ্ঞান। কোনও আগন্তুক ঘড়িটির দ্বারা খুব সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারে, যেমন ধরেন, সে বলে চলল, ঘড়িটা যখন পনের বার অ্যালার্ম দেয় কিন্তু তার কাঁটাগুলি নির্দেশ করে এগারটা বেজে বিশ, আমি বুঝতে পারি, সে আসলে নির্দেশ করছে আটটা বাজতে আর মিনিট পনের বাকি। ঘড়ি সম্পর্কিত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দায়সারা গোছের যেকোনো পর্যবেক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা দিতে পেরেছিল লোকটিকে।
কিন্তু আমার ঘড়িটি নিয়ে সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর বিষয় হল এর বিশ্বাসযোগ্য অনিশ্চয়তা। সুশৃঙ্খল কোন নিয়মেই সে কাজ চালাতে পারত না, তাতে এই জগৎসংসারে যত উলটপালটই ঘটুক না কেন। তাকে মনে হত বিশুদ্ধ আবেগে আক্রান্ত একটা ঘড়ি! একদিন আমার অদ্ভুত ঘড়িটা লীলাচঞ্চল হয়ে পড়েছিল। পৃথিবীতে স্বাভাবিক নিয়মে ভোর হবার তিনঘণ্টা আগেই রাতটাকে সে ভোর করে দিয়েছিল!
সে ছিল ভোর থেকে তিন ঘণ্টা এগিয়ে আর এটা নিয়ে তার মনে কোনও বিকার ছিল না। পরের দিন সে ইচ্ছা করল নিজেকে আর বাঁচতে দিবে না। পরিকল্পনামত কাজও শুরু করে দিল সে। প্রতি চার ঘণ্টার ভিতর থেকে দুই ঘণ্টা সময় সে হারিয়ে ফেলল, যা ছিল অপ্রত্যাশিতরকম শোচনীয় একটা ব্যাপার। বিকালের দিকে তার যাবতীয় কাজকর্ম বন্ধ হল। তারপর, সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে আসছিল, ঘড়িটি হঠাৎ আনন্দে অস্থির—স্বতঃপ্রণোদিত যন্ত্রটি পুনরায় কালের চক্রে আবর্তিত হতে শুরু করল।
ঘড়ি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে আমি কোনোকিছুকেই গ্রাহ্য করব না, কারণ যখনই এই ব্যাপারে আমি আমার সাদামাটা উপলব্ধি প্রকাশ করতে যাব, আমি নিশ্চিত যে লোকে বলবে আমি অতিরঞ্জন করছি।
কোনোকিছুকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করার পক্ষে এটা খুবই হতাশাজনক, কারণ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য তোমার স্নায়ুগুলি এমনভাবে উন্মুখ হয়ে থাকে যে লোকে তোমাকে বিশ্বাসই করবে না। তোমার শুধু মনে হবে অতিরঞ্জন করছ।
এটা আমি প্রায় সময়ই অনুভব করি— ভিতরে প্রলোভন জাগছে। স্বয়ং নিজের জন্যই এই জেগে-ওঠা। এ হল নিজেকে বাঁচাবার একটা কৌশল, যা জন্মের পরেই মানুষ আত্মস্থ করে নেয় আর সারাজীবন বয়ে বেড়ায়।
আমরা সব সময় অত্যন্ত সতর্ক থাকি যেন কোনভাবেই অতিকথন বা অতরঞ্জনের পথ উন্মুক্ত না হয়। এটা এমন এক আচরণ, যা যেকোনো মুহূর্তে নিজেদের ভিতর থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেগে উঠতে পারে। এটা অবশ্যই কুরুচিপূর্ণ আচরণগুলিরও একটি। পুরনো দিনগুলোয় কবি আর ব্যবসায়ীরা অতিকথন করত। তাতে লুকানো থাকত কিছুটা চাতুরী এবং অতিকথনের শিল্পটাকে প্রকাশ করবার খ্যাতি। আরও যথাযথভাবে বলতে গেলে, স্রেফ বাস্তবতার নগ্নতাকে অগ্রাহ্য করা। আজ কিন্তু সকলেই অতিকথনে ব্যস্ত।
অতিকথনের সৌন্দর্য প্রকাশের বিষয়টি শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচিতে দীর্ঘদিন টিকে থাকার মত কোনও বিষয় নয়, বরং জীবনের পক্ষে জরুরি একটা উপাদান, যা কি-না জীবনে টিকে থাকার যুদ্ধে আবশ্যকীয় বিষয় হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
পুরা দুনিয়াটাই অতিরঞ্জত। সব কিছুকেই অতিরঞ্জিত করা হয়েছে— সাইকেল বিক্রির পরিমাণ থেকে বাৎসরিক ধর্মান্তরিতকরণ— সবকিছুকেই, এমনকি পাপের অনিবার্য পরিণাম থেকে উদ্ধার পাওয়া এবং হুইস্কির মত কড়া মদকেও।
অতিকথনই আমাদের যাবতীয় ব্যবসায়-বাণিজ্যের বুনিয়াদ। আমাদের শিল্পসাহিত্যের পতিতজমি। সামাজিক জীবন-সূচনার মূল অংশ। আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের ভিত্তি। বিদ্যালয়পড়ুয়া বালক হিসাবে আমরা অতিরঞ্জিত করি আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে, আমাদের ফলাফলকে, আমাদের ঋণ-জর্জরিত পিতাদের। মানুষ হয়ে জন্মানোর পরও আমরা অতিরঞ্জিত করি আমাদের উৎপাদিত পণ্যগুলিকে। অতিরঞ্জিত করি আমাদের অনুভবগুলিকে, এমনকি অর্থের উৎসকেও। শুধু কর আদায়কারীর বিষয়টা ব্যতিক্রম। তার কাছে অতিরঞ্জিত করি আমাদের যাবতীয় ব্যয়কে। আমরা অতিরঞ্জিত করি আমাদের গুণগুলিকে, এমনকি আমাদের যাবতীয় ব্যভিচারকেও।
অতিকথনের অভিনয় করতে করতে আমরা পঙ্খিলতার অতলে তলিয়ে গেছি, জীবন ভরে ফেলেছি ঝুরি ঝুরি মিথ্যা দিয়ে, পরম আনন্দের সঙ্গে। আমরা এর নাম দিয়েছি ‘যা ইচ্ছা করো এবং তা বজায় রাখো’।
যদি আমরা বছরে একশো পাউন্ডের মালিক বনে যাই, তাহলে কি দুইশ পাউন্ড বলব? ধরা যাক, আমাদের ভাঁড়ারঘর খালি হয়ে গেছে আর উনুনও জ্বলছে না, তবু আমরা সুখি হব ‘পৃথিবী’ (মানুষের অভিজ্ঞতা এবং অন্যের প্রতি প্রচণ্ড কৌতূহলী এক প্রতিবেশী) আমাদের দেড়শ পাউন্ড ধার দেবে। যেদিন এর পরিমাণ হবে পাঁচশো, আমরা লোকের কাছে গল্প করব এক হাজারের, আর অতিগুরুত্বপূর্ণ ও ভালোবাসার ‘পৃথিবী’ (ছয় বন্ধু, যাদের দুজন এখন রয়েছে ঘোড়ায়টানা গাড়িতে) সম্মত হল যে আমরা এখনি সাতশো পাউন্ড খরচ করে ফেলব, তাতে বিশ্বসংসারে যে-ঘটনাই ঘটুক না কেন, এটা বিবেচিত হবে চলতি ঋণ হিসাবে। পরিচিত কসাই আর রুটির কারিগররা খবরটি জানতে পারবে আমাদের গৃহপরিচারিকার মাধ্যমে।
কিছুক্ষণ পর, — যখন আমরা চাতুরী সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী —আমরা উচ্চাভিলাষী কাজটা করতে শুরু করলাম। আমরা ভারতীয় রাজকুমারদের মত খরচ করতে লাগলাম, অথবা, আরও যথার্থভাবে বলতে গেলে —কীভাবে টাকাকড়ি খরচ করতে হয় তার ধারণা লাভ করলাম। কারণ আমরা জানতাম সময়ের ভিতর দৃশ্যের বিদ্যমানতা —কীভাবে নিজেদের বিত্তশালী হিসাবে প্রদর্শন করা যায় আর দেখানো যায় কাড়ি কাড়ি মুদ্রা ঝকমক করছে। হে সুপ্রিয় প্রাচীন পৃথিবী, বালজিবাব তোমাকে আশীর্বাদ করুন। এই আশীর্বাদ দরকার তার পুত্রকন্যাদের জন্য।
এ হল গতি লাভ করার রঙ্গচিত্রের নমুনা। অভিনন্দন জানানো এবং হাসিমুখে তাকিয়ে থাকা মিথ্যের দিকে, লোকের সঙ্গে আলাপ করা যা প্রতারণায় পূর্ণ, বেদমভাবে মার খাওয়ার চিন্তার দিকে সংকীর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকা, যা এটাই জানায় যে দেরিতে ঘটুক বা দ্রুতই ঘটুক না কেন, আমাদেরকে আঘাত করা হবে প্রচণ্ড হাতুড়ি দিয়ে, এবং এটা শীঘ্রই রূপান্তরিত হবে কুহকবিদ্যার এক প্রাণবন্ত খেলায়, যতক্ষণ না ধূসর ঊষালোকের আলো ফুটে উঠেছে।
‘সত্য’ ও ‘প্রকৃত’ হচ্ছে পুরনোদিনের কেতা। অসৎ উপায়ে কড়ি কামানোর জন্য ‘সত্য’ ও ‘প্রকৃত’ এখন স্থূল ও কুরুচিপূর্ণ পদ্ধতির সঙ্গে মানানসই। আসলে প্রথম দেখায় কোনোকিছুকে যা মনে হয়, আসলে তা ‘প্রকৃত’ নয়, তা হচ্ছে চতুর কুকুরটি সেইসব চতুর দিনগুলিতে যা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিল। আমরা নীরস পিচ্ছিল কঠিন মাটি থেকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, আমরা ঘরবাড়ি গড়েছি রামধনুশোভিত মাটিতে এবং অলীক কল্পনায়। আমরা ঘুমিয়েছি এবং হেঁটে বেড়িয়েছি রামধনুর নিচে। আমাদের ঘরগুলির ভিতর সৌন্দর্য ছিল না, কেননা, তারা ছিল কনকনে ঠাণ্ডা আর কুয়াশায় স্যাঁতস্যাঁতে। যখন সোনালি মেঘদল গলে একাকার হয়, রুক্ষ পৃথিবীর অধোদেশে নামতে থাকে প্রবল বৃষ্টিধারা, তখন ঘুরে ফিরে আমাদের মনে জেগে উঠত কেবল ভয়।
কিন্তু সেখানে আমাদের এত দুর্ভোগ আর আতঙ্কের কারণ কী ছিল? যেকোনো আগন্তুকের কাছে আমাদের ঘরবাড়িগুলিকে মনে হত মনোরম আর উজ্জ্বল। যেসব চাষি নিচের মাঠে কাজ করছে, তারা চোখ তুলে দেখছে এবং ঈর্ষা করছে আমাদের —এই ঈর্ষা আমাদের জাঁকজমকপূর্ণ বসতভিটা আর গৌরবের প্রতি। যদি তারা ভাবে যে সত্যিই এগুলি মনোমুগ্ধকর, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা পরিতৃপ্ত হব।
বেঁচেবর্তে থাকবার জন্য আমরা অন্য কাউকেই কিছু শিখাইনি, এমনকি নিজেদের জন্যও কোন দৃষ্টান্তের জন্ম দিইনি। বিজয়ীর শক্তিমত্তা নিয়ে দুর্বিষহ আচরণ দ্বারা শিক্ষকের মত আমরা কি বলেছি —এটাই হল বেঁচে থাকবার সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক পদ্ধতি? আমরা যথেষ্ট পরিমাণে আত্মবিসর্জনকারী!
আহা! অবশ্যই আমরা ঈশ্বরের প্রতি যথেষ্ট পরিমাণ বিশ্বস্ত, আর আমরা আনুগত্য প্রকাশ করছি আমাদের নতুন অভিষিক্ত রাজার নিকট। আনুগত্য প্রকাশ করছি ছদ্মবেশী রাজপুত্রের কাছে, চতুর রাজকুমারীর কাছে।
মানুষকে —যদি সে টিকে থাকতে চায় —তাকে অবশ্যই স্তুতি করতে হবে। চারপাশের জীবনকে দেখতে দেখতে অবশেষে জীবনের অন্তর্দৃষ্টির মধ্যে কী আছে মানুষ তা উপলব্ধি করে। সে খুঁজে পায় শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তমকে। তবু মানুষ পতিত হয়, বিস্ময় ও ভয়ের যুগপৎ অনুভব দ্বারা তাড়িত হয় তার প্রতি, যার চোখ উনিশ শতকের ওপর খোলা রয়েছে।
কোনও মহান প্রতিমার জন্ম কি এই ব্রহ্মাণ্ড দিতে পেরেছিল, যা চুরিকরা পদমর্যাদার মত মিথ্যের খোদাইকৃত মূর্তি নয়?
এইসব হল কর্কশ, নির্লজ্জ, উদ্ধত আর কপট, অন্তঃসারশূন্য হৃদয়ের উপলব্ধি। মানুষ এটা উপলব্ধি করতে পারে যে তার আত্মা আর পবিত্র নয় আর সঙ্গে সঙ্গেই সে পতিত হয় আর পদচুম্বন করে; এবং শক্ত হয়ে এঁটে থাকে —চিরকালের জন্য নিজের কাছে নিজেই প্রভুর পদ-লেহনের শপথ করে।
প্রভু, হায়! সে এক পরাক্রমশালী অধিরাজ, সম্রাট। রাবারের তৈরি কিং হামবুর্গ। চলো, আমরা গড়তে বসি হিউনের মন্দির, যে-মন্দিরের ছায়ায় রাজাকে আমরা পূজা করতে পারব, তাকে বাঁচাতে পারব আলোর আক্রমণ থেকে। চলো, রাজাকে আমরা রক্ষাকবজের আড়ালে ঢেকে ফেলি। দীর্ঘজীবী হোক আমাদের কূপমণ্ডূক মেকি শাসক।
আমাদের মত সোলজারদের জন্য উপযুক্ত নেতা ঠিক করতে হবে। অভিষেক-গ্রহণকারী মহামান্য মিথ্যা-রাজাদের জয় হোক! বেচারা রাজা অ্যাপারেন্স দীর্ঘজীবী হোক। তার জন্য আমাদের নতমস্তক বশ্যতা। আমরা কিন্তু রাজাকে উপরে তুলে শক্ত করে ধরে রাখব।
রাষ্ট্রের সৈনিকেরা শুনুন, রাজার বেঁচে থাকবার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হল তাকে যথেষ্ট উঁচুতে তুলে রাখা। নিজের কাজ নিজে করার পক্ষে প্রয়োজনীয় হাড় ও পেশি তার নেই, সে এমনই এক বেচারা সম্রাট!
তার পদতল থেকে আমরা যদি হাত সরিয়ে নিই, তাহলে এক গাঁদা জীর্ণ ন্যাকড়ার ওপর তার পতন হবে আর ক্রোধান্ধ বাতাস টেনে হিঁচড়ে ঘুরপাক খাওয়াতে খাওয়াতে তাকে বহুদূর উড়িয়ে নিয়ে যাবে। রাজা পরিত্যক্ত হবে। হায়! তার চিরস্থায়ী আসনটির জন্য চলো জীবন উৎসর্গ করি। তার খাবার পরিবেশনে হাত লাগাই। চিরকালীন অস্তিত্বহীনতার বাতাস, মুখ থেকে ছেড়ে দেবার মত চলো তাকে মস্ত আকৃতিতে গড়ে তুলি। বলতে থাকি, বিস্ফোরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা তার সঙ্গেই আছি!
একদিন না একদিন সে সশব্দ ফেটে যাবেই। যেমন যেকোনো বিস্ফোরণের আগেই আমরা বুদ্বুদ দেখতে পাই, তেমনি তাকেও একদিন দেখা যাবে পরিণত হয়েছে এক বিশালাকৃতি দানবে।
ইতোমধ্যেই সে আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে, এখন পর্যন্ত সেই প্রভাব আমরা কাটাতে পারিনি। পৃথিবীর বয়স বাড়ছে অধিক থেকে আরও অধিক কপট ও ছলনাময় পৃথিবী হিসাবে, অতিকথন এবং মিথ্যাচার হিসাবে; এবং সে, যে-ছদ্মবেশ ধারণ করছে, অতিরঞ্জন করছে, মিথ্যা বলছে অবিরাম, সে-ই আমাদের সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম!
পৃথিবী হল আদা দিয়ে তৈরি রুটি কেনাবেচার এক প্রচণ্ড কোলাহল। আমরা প্রতিটি বুথ আর পয়েন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছি জমকালোরঙে-আঁকা চিত্রগুলি। বাজাচ্ছি বিশাল বিশাল ড্রাম আর মেতে উঠছি দম্ভের খেলায়।
কিনুন আমাদের তৈরি সাবান। শুনুন হে জনগণ, আপনাদেরকে কখনোই বুড়ো হাবড়াদের মত দেখাবে না। আপনাদের টেকো মাথা পুনরায় ঢেকে যাবে নতুন গজানো চুলে।
আপনারা আর কোনোদিনও গরিব হবেন না, আগের মত অসুখিও হবেন না আর। আমরাই আপনাদের একমাত্র সত্যিকার সাবান। উফ! মিথ্যা ইমিটেশন থেকে সতর্ক থাকবেন। কিনুন আমাদের তৈরি লোশন। আপনাদের মধ্যে যারা প্রায়ই প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ভোগেন, যাদের পাকস্থলী নষ্ট হয়ে গেছে, পা টনটন করে, কিংবা যাদের দুটো হাতই ভেঙে গেছে, অথবা যাদের কোমল হৃদয় ভেঙে গেছে মুহূর্তের এক ঝড়ে আর সেইসব দজ্জাল শাশুড়িরা, আপনাদের কাছে বিনীত প্রার্থনা এই যে, পান করুন আমাদের সালসা। দেখবেন, এই সালসা জীবনের সমস্ত ঝঞ্ঝাট ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে।
যারা যেতে চান স্বর্গে, তারা আসুন আমাদের গির্জায়। কিনে নিন পয়সা বানানোর গাইড বই। মিটিয়ে দিন গির্জার বেঞ্চের ভাড়া আর শুধু প্রার্থনাই করুন। আপনাদের সেই বিভ্রান্ত ভাইদের কথা স্মরণ করুন, যারা ভুল পথে চলে গেছে। এখন তাদের জন্য আপনাদের আর করবার কিছুই নেই —এ-কথা মগজে নিয়েই চলুন প্রার্থনায় রত হই। এটাই একমাত্র নিরাপদ উপায়।
বুদ্ধিমান নির্বাচকগণ —ভোট দিন আমাদের মার্কায়, যাতে আমাদের দল ক্ষমতায় যেতে পারে। দেখুন, আমরা ক্ষমতায় গেলে পৃথিবী সম্পূর্ণ নতুন হয়ে জন্ম নেবে, যার কোথাও আগের তিল পরিমাণ পাপ কিংবা দুঃখ থাকবে না। প্রত্যেক স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত ভোটারের জন্য থাকবে আনকোরা ইউটোপিয়া, যা তৈরি হবে প্রত্যেকের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং প্রত্যেকের নিজস্ব আইডিয়া অনুসারে। এটা সকলের হাতেই থাকবে, বিশুদ্ধ আকার এবং আত্মার প্রায়শ্চিত্ত বিষয়টি যার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আহা! সুবর্ণ সুযোগটি হেলায় হারাবেন না।
আহা! আমার ফিলোসফিটা লক্ষ্য করুন, কেননা এটাই শ্রেষ্ঠ এবং গভীরতর। আহা! আমার সঙ্গীত শ্রবণ করুন, কেননা এই সঙ্গীতই সবচেয়ে শ্রুতিমধুর। আহা! আমার আঁকা ছবিগুলোই শুধু কিনুন, কেননা শুধু এগুলোই সত্যিকারের শিল্প হতে পেরেছে। আহা! কেবল আমার লেখা বইগুলোই পড়ুন, কেননা শুধু এই বইগুলোতেই মানুষের সূক্ষ্মতম অনুভূতিগুলোকে ধরা হয়েছে।
আমিই একমাত্র শ্রেষ্ঠ পনির ব্যবসায়ী। আমিই সবচেয়ে চৌকশ আর্মি। আমিই শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়ক। আমিই শ্রেষ্ঠতম কবি। আমিই শ্রেষ্ঠতম সার্কাসের সঙ। চটকদার কথা-বলা শ্রেষ্ঠ ধাপ্পাবাজ। আমিই শ্রেষ্ঠতম সম্পাদক। শ্রেষ্ঠতম দেশপ্রেমিক আমিই।
আমরাই শ্রেষ্ঠতম জাতি। একমাত্র আমরাই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম মানুষের দঙ্গল। আমাদের ধর্মই চিরকালীন ধর্ম।
বাহ! আমরা সকলে কী নারকীয় চিৎকারটাই না করছি!
ঠিক কীরকমভাবে আমরা প্রত্যেকে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করছি, প্রচণ্ড শব্দে ড্রাম পেটাচ্ছি, উচ্চস্বরে চেঁচাচ্ছি —আমরা তার একটি বর্ণও অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বিশ্বাস করছি না!
লোকে নিজেদের মধ্যে বিনিময় করছে তাদের ভাবনা। তারা বলছেঃ এটা আমরা কীভাবে তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে আবিষ্কার করতে পারি যে কে এই চিৎকার-করতে-থাকা লোকদের ভিতর শ্রেষ্ঠতম? কোন জন সেই দক্ষতম ব্যক্তি?
উত্তরে তারাই বলছেঃ এখানে কেউই শ্রেষ্ঠতম নয়। কেউই দক্ষতম নয়। সর্বোত্তম দক্ষ লোকটি এখানে নেই। এইসব হৈ চৈ কোলাহল ও বিশৃঙ্খলা যারা তৈরি করেছে, তারা সবাই জ্ঞান-দক্ষতা আর সক্ষমতার ভানকারী হাতুড়ে লোক মাত্র। আমাদের মধ্যে তার কোন আসন নেই। স্থান নেই। যেখানে মোরগ ডেকে ওঠে তাকে সেখানে দেখতে পাবে। আমরা বুঝতে পেরেছি শ্রেষ্ঠতম ও সর্বোত্তম হল তারা, যারা উচ্চস্বরে এবং দীর্ঘসময় ধরে ডাকতে পারে। এটাই আমাদের কাছে উৎকর্ষ নির্ণয়ের শ্রেষ্ঠতম পরীক্ষা। সুতরাং, মোরগের ডাক দেয়া ছাড়া আমাদের করার আর কী বাকি রইল? আমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট তারাই যারা মোরগের উল্লাসময় স্বরে চিৎকার করছে আর দীর্ঘকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এক গোবরের ঢিবিতে, আমরা যার নাম দিয়েছি পৃথিবী!
আমি এখন আমাদের ঘড়ি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে যাচ্ছি।
আইডিয়াটা ছিল আমার স্ত্রীর। ঘড়িটাকে আপন করে পাওয়ার জন্য, হ্যাঁ, প্রথম দর্শনেই তাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার জন্য সে পাগল হয়ে গিয়েছিল।
আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের বন্ধু বোগেলের বাড়িতে দুপুরের খাবারে যোগ দিয়েছিলাম। বোগেল এইমাত্র একটা ঘড়ি কিনেছে। একটা পড়ে-পাওয়া পুরাতন ঘড়ি, এসেছে এসেক্স থেকে। এইসব পড়ে-পাওয়া জিনিস কেনায় সে পাকা লোক। সে বসেছিল বিচিত্র নকশা-খোদাই বিশাল পালঙ্কের মত দেখতে একটা ঘড়ির ওপর, যার ওজন প্রায় তিন টন। সে বলল, খুব সুন্দর ছিমছাম এই জিনিশটা সংগ্রহ করা হয়েছে হল্যান্ড থেকে। কথাটা সে এমনভাবে বলল যে মনে হল এটা তার মালিকের ছাতার ভিতর থেকে খসে পড়েছে আর বেচারা বোগেল লোকের নজর এড়িয়ে সেটাকে খুঁজে পেয়েছে রাস্তার পাশে। ব্যাপারটা আর কেউ বুঝতেই পারেনি!
সদ্য-কেনা ঘড়ি নিয়ে সে দারুণ উত্তেজিত ছিল। ঘড়িটা ছিল আগের আমলের পুরনো উঁচু কাঠের বাক্সে রক্ষিত ওজনচালিত ঘড়ির একটি মডেল। খোদাই-করা ওক কাঠের বাক্সের ভিতর তার উচ্চতা ছিল আট ফুট। তার ছিল ধ্বনিময়, গভীর ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির মত ছন্দময় টিকটিক শব্দ, যেন রাতের খাবারের পর সঠিক তাল-লয়-ছন্দে পরিবেশিত হচ্ছে সঙ্গীত আর ঘরময় তৈরি হয়েছে অনাড়ম্বর সহজতা।
ঘড়িটাকে কেন্দ্র করেই আমাদের আলাপ জমে উঠল। কীভাবে ঘড়িটার প্রলম্বিত ও গুরুগম্ভীর টিকটিক শব্দকে সে ভালবাসতে পেরেছে বোগেল আমাদের তা বলল। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে কাদা, তখন সে আর তার ঘড়িটা যমজ বন্ধুর মত সময় কাটায়। মনে হয় পুরনো বন্ধুরা তার সঙ্গে কথা বলছে। বলছে পুরনো দিনগুলি কেমন ছিল। কেমন ছিল পুরনো দিনের চিন্তাধারা, কেমন ছিল মানুষের বেঁচে থাকবার পদ্ধতি, এবং কেমন ছিল সেইসব পুরনো আমলের মানুষ, যারা এই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছে!
ঘড়িটা আমার স্ত্রীরত্নের মনে গভীর প্রভাব ফেলল। ঘরে-ফেরার পুরটা সময় সে ছিল গভীর ভাব নায় মগ্ন। যখন আমরা বরাবরের মত সিঁড়ি ভেঙে ঢুকে পড়েছি আমাদের ঘুমাবার গুহায়, সে বলল, আমরা কেন ঠিক এরকমই একটি ঘড়ি কিনছি না? তার বিশ্বাস ঘড়িটা হবে ঠিক একজন মানুষের মত যে আমাদের দেখেশুনে রাখবে। সে এটাও কল্পনা করে নিল যে ঘড়িটা আমাদের অনাগত সন্তানদেরও বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবে।
নর্থহ্যাম্পশায়ারের সেই লোকটিকে —যার কাছ থেকে আমরা মাঝেমধ্যে আসবাবপত্র কিনে থাকি— ব্যাপারটা বললাম। সে জানালো আমি ঠিক যেমনটা চাইছি সে ঠিক তেমন একটা জিনিশ আমার জন্য জোগাড় করবে। সুনিশ্চিতভাবে ভাগ্যবান ছিলাম বলেই নর্থহ্যাম্পশায়ারের আসবাবপত্রবিক্রেতা বেশ সময় নিয়ে খুঁজে পেতে অদ্ভুত কিন্তু আকর্ষণীয় এবং বেশ পুরনো কেতার একটা ঘড়ি জোগাড় করল। ঘড়িটার একটা ছবি এবং খুঁটিনাটি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে জানতে চাইল আমাদের ফ্ল্যাটে এটাকে পাঠিয়ে দেবে কিনা। ছবি দেখে, আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে জেনে নিয়ে বললাম, হ্যাঁ, দেরি না করে পারলে আজই পাঠিয়ে দাও।
দিন তিনেক পর কারা যেন দরজার কড়া নাড়ল। নিশ্চয় এর আগেও কয়েকবার নাড়া হয়েছিল কিন্তু আমি ঘড়িটির ইতিহাস নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকায় শুনতে পাই নি। মেয়েটি জানাল বাইরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই পিকফোর্ডের মালামালবহনকারী লোকগুলিকে দেখলাম। তাদের হাতে ঠিকানা-নির্দেশসহ মালপত্রের তালিকা। বুঝতে পারলাম তারা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ঘড়িটি নিয়ে এসেছে। বায়বীয় কণ্ঠে তাদের বললাম— হ্যাঁ, ঠিক আছে। এটাকে ওপরে তুলে আনো।
তারা অপারগতা প্রকাশ করল। নিচ থেকে একটা ঘড়িকে ওপরে তোলা নাকি তাদের পক্ষে সম্ভব নয়!
নিচে নেমে দেখি সিঁড়ির ধাপে কিলক দিয়ে আটকানো একটা বাক্স, ঠিক যেন লন্ডনের ক্লিয়পেত্রা ওবেলিস্ক, যা ওপরের দিকে ক্রমশ সরু, চতুষ্কোণ দীর্ঘ শিলানির্মিত স্তম্ভ বিশেষ; যার শীর্ষদেশে রয়েছে ছোট্ট একটা পিরামিড।
তারা বলল, এটাই আপনার ঘড়ি।
আমি কাটারি আর লোহার দণ্ড জোগাড় করে, রাফিয়ান মার্কা দুজন লোক ডেকে প্রায় আধঘণ্টা ধাক্কাধাক্কি করার পর ঘড়িটাকে ওপরে উঠাতে পারলাম। এতক্ষণ সিঁড়ি দিয়ে লোকচলাচল বন্ধ ছিল, ওপরে তুলে নেয়ায় ভাড়াটেদের মনে আগের স্বস্তি ফিরে এল। ঘড়িটা রাখলাম দোতলার খাবার ঘরের কোণায়। গোরায় সে এমন ভাব করল যেন সে খুব নড়বড়ে, যেকোনো মুহূর্তে লোকের মাথায় ভেঙে পড়বে। এ অবস্থা ঠেকালাম প্রচুর পেরেক, স্ক্রু আর জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করে। ঘড়িটার জীবনের সব ঝুঁকি হ্রাস করে অবসাদ আর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
মধ্যরাতে, হঠাৎ ভীতিকর আওয়াজে স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেল। সে বলল —ঘড়িটা এইমাত্র তেরোবার অ্যালার্ম দিয়েছে! আমি কি এটা ভাবতে পারছি যে কেউ একজন মারা যাচ্ছে? তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম —এসবের কিছুই আমি জানি না। বললাম, হতে পারে পাশের বাড়ির কুকুরটা মরতে বসেছে। আমার স্ত্রী বলল, কিছু একটা ঘটার ইঙ্গিত পাচ্ছে সে। সম্ভবত আমাদের সন্তানটি জন্ম নিতে শুরু করেছে। তার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। প্রাণ আকুল করা কান্নায় ভেঙে যেতে যেতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল।
অবশ্যই কোথাও তোমার ভুল হচ্ছে —কথাগুলি বলে সকালে তাকে প্রবোধ দিলাম। তাতে সে স্বাভাবিক মানুষের মত খানিকটা হাসতে পারল। বিকালে ঘড়িতে আবার তেরোবার অ্যালার্ম বাজল। তাতে আতঙ্ক আরও তীব্র আকার ধারণ করল। সে আমাকে বিশ্বস্তভাবে বোঝাতে চাইল, আমাদের অনাগত সন্তান এবং আমি উভয়েই মারা যাচ্ছি আর সে স্বামীসন্তানহীন বিধবায় পরিণত হতে যাচ্ছে। বিষয়টিকে আমি স্রেফ একটা কৌতুক হিসাবে বিবেচনা করলাম। এটা তাকে আতঙ্কিত করে তুলল। বলল, সে বিষয়টাকে ঠিক যেরকম অনুভব করছে দয়া করে আমিও যেন সেরকম অনুভব করি। তার ধারণা হল আমি তাকে সান্ত্বনা দেবার খাতিরে নিরুদ্বেগ থাকবার ভান করছি। সে বলল, এখন যা কিছু ঘটবে সবকিছুকেই সে সত্যিকার সাহসের সঙ্গেই মোকাবেলা করবে। আমার স্ত্রী যে-লোকটিকে এই দুরবস্থার জন্য দায়ী করল, সে হচ্ছে বেচারা বোগেল।
রাতে ঘড়িটি আবারো অ্যালার্ম বাজিয়ে আমাদের সতর্ক করে দিল। আমার স্ত্রী ধরেই নিল যে এই সংকেত তার অ্যান্ট মারিয়ার মৃত্যু-সম্পর্কিত। এই সংকেতকে সে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিল।
পরদিন ঘড়িটা চারবার তেরোটি করে অ্যালার্ম বাজাল। হঠাৎ আমার স্ত্রীকে খুব উৎফুল্ল মনে হল। সে বলল- মনে হয় আমরা সবাই মারা যাচ্ছি! সম্ভবত কালাজ্বর বা প্লেগ এগিয়ে আসছে। আমাদের কারোরই আর নিস্তার নেই। আমরা সবাই প্লেগে আক্রান্ত হব।
‘সবাই একসঙ্গে মারা যাচ্ছি’ এটা ভেবে আমার স্ত্রী-রত্ন প্রফুল্ল হয়ে উঠল আর ঘড়িটাও তার দায়িত্ব এমনভাবে পালন করতে লাগল যে তার অ্যালার্মের কারণে আমাদের যত বন্ধু আর আত্মীয়স্বজন ছিল তাদেরকে —স্ত্রীর বর্ণনা অনুযায়ী— হত্যা করতে লাগল। বন্ধুবান্ধবের মৃত্যুর পর ঘনিয়ে এল প্রতিবেশীদের জন্য মৃত্যুসংকেত।
ঘড়িটা মাসের তিরিশ দিনই একসঙ্গে তেরোবার অ্যালার্ম বাজাল, যতক্ষণ না ব্যাপক গণহত্যায় আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ি। মাইলের পর মাইল জীবিত মানুষের কোনও অস্তিত্বই ছিল না!
তারপর ঘড়িটা চরম যুক্তিবোধের পরিচয় দিল। বন্ধ হল অবিরাম হত্যাযজ্ঞ। ক্ষতিকর চরিত্র পাল্টে স্রেফ ঊনচল্লিশ আর একচল্লিশের ঘরেই বারবার বাজতে থাকল। ঘড়িটার প্রিয় নির্দেশকবিন্দু ছিল বত্রিশ, কিন্তু হঠাৎ একদিন সে ঊনপঞ্চাশের কাছে এসে বাজতে লাগল। ঊনপঞ্চাশের ঘর সে কিছুতেই পেরুতে পারল না। কোনভাবেই বুঝতে পারলাম না সে এমন আচরণ কেন করছে! ঊনপঞ্চাশের ঘর কিছুতেই পেরুল না ঘড়িটা। তার বেজে-উঠার মধ্যে বিরতি খুব কমই ছিল। প্রতি ঘণ্টায় সে তিন থেকে চারবার পর্যন্ত অ্যালার্ম দিত। আবার কখনও দিনের অর্ধেকটাই কাটিয়ে দিত শব্দ না করে।
প্রকৃত অর্থেই ঘড়িটা ছিল এক আশ্চর্য বস্তু!
মাঝে মধ্যে ভাবতাম তার প্রতি সমস্ত ‘মনোযোগ নিবিষ্ট করব’, যাতে প্রতিটি ঘণ্টাকেই সে নিয়মিত আবর্তন করতে পারে। তাকে নিয়ে আমার এই ধারণার জন্ম হল যে, সময়কে উপহাসের ব্যাপারে সে যথেষ্ট সাহসী। সুতরাং, তার প্রতি আমার বিশেষ অনুরাগ জন্ম নিল।
ঘড়িটা সময়ের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয়। সে যখন তার কালচক্রপথ আবর্তন করে, তখন সময়কে প্রায় খোলাখুলিই অবমাননা করতে পারে। এই প্রবণতা তার ভিতর প্রবল। সে জানান দেয় দুটো বেজে আটত্রিশ মিনিট, এবং তার ঠিক বিশ মিনিটের মধ্যেই বলে বসে —এখন বাজে মাত্র একটা!
বিষয়টা কি এমন, ঘড়িটা তার মালিকের প্রতি অনুভব করছে সত্যিকার ঘৃণা আর মনে করছে এই ঘৃণাকেই সে সবার সামনে প্রকাশ করবে? তার ঘৃণার অনুভব এটাই বোঝাচ্ছে যে, মালিকের পোশাক-পরিচ্ছদের যত্ন নেবার কাজে নিয়োজিত ভৃত্যের কাছে কোনও মানুষই প্রকৃত নায়ক হতে পারে না। এটা এজন্যই হতে পারে —সময় যেন এক পাথরের মূর্তি, কিন্তু তার স্থায়িত্ব ক্ষণকালের। মুহূর্তেই মরে যায় অন্য মরণশীলদের মত। হয়তো এটাই ‘সময়’-এর সবকিছু, হয়তো পুরাতন ভৃত্যের ছানিপড়া ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকার মত কোনও ব্যাপার। তার শুধু একটাই কাজ —টিকটিক, টিকটিক শব্দে বেজে চলা সারাটা জীবন ধরে। সবশেষে সময়ের সামান্যতা আবির্ভূত হয় আবছাভাবে, ছাপ ফেলে যায় মানুষের আতঙ্কিত চোখে।
ঘড়িটা যেমনভাবে ভয়ানক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আর বারবার আঘাত করে পঁয়ত্রিশ এবং চল্লিশের ওপর, তাহলে কি সে প্রবাদকথার মতই বলে —বাহ, সময়! তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি, তুমি ঈশ্বরতুল্য আর কী ভয়ঙ্করই না তোমাকে দেখায়! একটা কিমাকার ভূত ছাড়া আর কী তুমি? একটা স্বপ্ন —এখনও আমরা যারা বেঁচে আছি, ঠিক তাদের মতই বেঁচে থাকবার একটা স্বপ্ন। এছাড়া তুমি আর কী? হ্যাঁ, তুমি ধীরে ধীরে বয়ে যাও। ফেরা আর হয় না তোমার। শাশ্বত মানুষ, সময়কে ভয় নেই।
সময় হল চিরন্তনতার পটভূমির ওপর পতিত পৃথিবীর এক ছায়া।