আমার বিশেষ বাবা ও ঈদের বিশেষ নাটক । হুমায়ূন সাধু
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ আগস্ট ২০১৪, ৭:৫০ অপরাহ্ণ, | ২৬৫০ বার পঠিত
![](https://raashprint.net/files/uploads/2014/08/হুমায়ুন-সাধু-.jpg)
ছোটবেলায় আমরা বিশাল পরিবার একসাথে বসে টিভি দেখতাম।
যদিও আব্বা টিভি দেখাটা পড়াশুনার ক্ষতি, পোলাপান নষ্ট হবার প্রধানতমঃ উপকরণ মনে করত। দুলাভাই বাসায় প্রথম টিভি আনার পর আব্বা বহুদিন কারো সাথে কথা বলে নাই। সেই আব্বাই সবচেয়ে বেশি টিভি এবং টিভি নাটকের ভক্ত হয়ে গেল। আব্বা নাটক এবং গান খুব পছন্দ করতেন। টিভি ছিল তার দখলে তার বেডরুমে। কখন দেখা যাবে কি অনুষ্টান কে কে দেখবে এগুলা আব্বার নিয়মে চলত। কিন্তু যেহেতু নাটকের বেলায় তার আলাদা দূর্বলতা নাটক থাকলে আমরা সব ভাই-বোন এলাউ। আমার বেলায় বেশি। আমি একটু টেকনা ছিলাম, টিভি ঝিরঝির করলে এন্টেনা ঠিক কয়া, টিভি খুলে ভিতরে কলকব্জা দেখা, এসবের কারণে বাবার কাছে আলাদা একটা সমীহ পেতাম। ‘আর কিছু না হইলেও মেকানিকগিরি করে চলতে পারব’ এমন কিছু ভাবত কিনা জানিনা।) পুরা রুমে বসারও একটা সিস্টেম ছিল। বাবা-মা খাটে আধশোয়া, ছোট কেউ থাকলে খাটে জায়গা পেত, মুরুব্বি বা মেহমানের জন্য চেয়ার আর আমরা গণ, মাটিতে ফ্লোরিং করে বসতাম। আমার এক ভাই তার স্ট্যাটাস একটু বাড়ানোর জন্য মোড়া বা পিড়ি নিয়ে বসত।
নাটক শুরু হবার ঘোষণা হলেই হুড়াহুড়ি শুরু হয়ে যেত তারপর টাইটেল। লম্বা টাইটেল দেখে আব্বা বিরক্ত হত,
—এত লেখা দেয়া লাগে নাকি
নাটকের ফাঁকে ফাঁকে আব্বার কমেন্ট থাকত আমরা উত্তর দিতাম মনে মনে। যেমন ক্যারেক্টার হয়তো ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফার্স্ট খেতে বসছে
আব্বাঃ দেখছ কান্ডটা, হাত-মুখ না ধুয়ে খেতে বইসে গেছে
আমরা মনে মনেঃ ওরা যে পেস্ট আর ব্রাশ দিয়া দাঁত মাজে ঐটা কে দিবে (সেরকমই ধারণা ছিল)।
ক্যারেক্টার হয়তো টয়লেটে গেছে, বের হয়ে আসছে
আব্বাঃ এত তাড়াতাড়ি! মনে হয় কলে পানি নাই
মনে মনেঃ ওরা টয়লেট করেনা (সেরকমই ধারণা ছিল)
রোমান্টিক সিনগুলাতে আমার বড় ভাই-বোনেরা সবচেয়ে বিপদে পড়ত। মাথা নিচু করে থাকত আর ট্যারা চোখে আব্বার দিকে তাকাতো।
নায়ক-নায়িকা ভার্সিটিতে প্রেম করতেছে
আব্বাঃ দেখছনি ইয়ং পোলাপানের কারবার, এই করতে গেছে আর কি, পড়ালেখার নাম দিয়ে পেরেম। রেজাল্ট কোত্তেকে ভাল হবে! ওদের বা-মাকে বলে দেয়া উচিত।
আব্বার প্রিয় ছিল হুমায়ূন ফরিদী, আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের, রাইসুল ইসলাম আসাদ, জাহিদ হাসান, আর সূবর্ণা মুস্তাফা, বিপাসা, শমী। এদের কেউ অন্য বেশ ধরে অন্যকোন রোল করলে আব্বা আর চিনতনা। নাটক শেষে বলত
—ও এটা অমুক ছিল!!
আব্বা কারো নাম মনে রাখতো না, যে নাটক ভালো হয়, হিট হয় ঐ নাটকের চরিত্রের নামেই তাকে আজীবন চিনত। যেমন কোথাও আলী যাকেরকে দেখলে বলত
—এটা মামা না?
আমি বলতাম,
—না আব্বা, এটা আলী যাকের
আব্বা বলত,
—ঐ আর কি, মামা ক্যারেক্টার করছিল না।
হুমায়ূন ফরিদী, আসাদ এরা গরীব, পাগলের ক্যারেক্টার করলে বলত,
—দেখছ কত বড়লোক কিন্তু কোন গরীমা নাই। কি সুন্দর ক্যারেক্টার ফুটাই তুলছে দেখছ।
মনে মনেঃ জ্বি, আমরা দেখতেছি, আমাদের চোখ আছে।
নাটকের এন্ডিং নিয়ে আব্বা বেশিরভাগ সময় অস্নতুষ্ট থাকত। হয়তো নায়ক-নায়িকার মিল হইসে, হ্যাপি এন্ডিং।
আব্বা বলত,
—না হয় নাই
আম্মাঃ কেন?
আব্বাঃ বিয়ে দিলনা, বিয়ে দেখাবেনা!?
আম্মাঃ হ, বিয়া দেখাবে তোমারে দাওয়াত করবে। আজকে আপাতত ঘরেরটা খেয়ে ঘুমাও।
এই ব্যাক্তিগত প্যাচালে আমরা থাকতাম না। শো শেষ হলে আমরা ভাই-বোনেরা আব্বার রুম থেকে বের হয়ে যেতাম। সেখানে আরেকটা আলোচনা বসত। নাটক কেমন হল, এটা আমাদের কি শিক্ষা দিল, কার অভিনয় ভাল হল!
(যদিও হুমায়ূন আহমেদের বেলায় আমরা শিক্ষা টিক্ষার ধার ধারতাম না। সে অবিংসবাদিত, অপ্রতিদ্বন্দি। সে একাই একশো।)
আব্বা নাই আমাদের ভাই-বোনেরা এখনো ঢাকা, নিউইয়র্ক, নরওয়ে থেকে একসাথে হলে একসাথেই ঈদের নাটকগুলা অন্তত দেখি। অনেক কষ্টে আম্মাকে টিভির রিমোটের নাম্বার চিনিয়ে, কোন নাম্বারে কোন চ্যানেল চিনাইসি। আমি এই সেক্টরে কাজ করি, আমার মা, পরিবার দেখবে এটাই আশা। তারা অতকিছু বুঝে চিন্তা করে বিচার করেনা, নিউট্রাল থেকে করে। হয়তো কোন বাজে নাটক দেখল, আমাকেই ধমকাল, এগুলা কি বানাস। দেখা গেসে ঐ নাটকের সাথে আমি কোনভাবেই যুক্ত না, চৌদ্ধগুষ্টিরও চিনিনা। আমার কাজের অনুপ্রেরণা আমার মা, আমার পরিবার। আমার কাজের প্রথম ভাইবটা আমি পাই আমার পরিবার থেকে। আমি, আমরা কত কষ্ট করে কাজ করি। কয়েকবছর ধরে চ্যানেলও বেশি, নাটকও বেশি, আম্মারে শিখাইয়া দিসি জাম্প দিয়া দিয়া কিভাবে দেখতে হয়। আম্মারে আম্মার পিএ খুঁজে খুঁজে কলকাতার বাংলা চ্যনেলের সিরিয়াল চিনাইয়া দিসে, আর কিছু মনে রাখতে পারেনা কিন্তু ঐ নাম্বারটা ঐ চ্যানেলটা আম্মার মনে গেঁথে গেসে। আর চ্যনেল আর এডের যে হাল আমিও কিছু বলতাম না।
আসল ঘটনায় আসি। এবারের ঈদের নাটকের কথা। আমি বেকুব না হয়ে পারিনি। এবার ঈদে যথারীতি আমরা টিভি নিয়া বসছি। আমাদের অনুষ্টান থাকে, আমার নিজেরও থাকে। এতদিন দেখে আসছি একই আর্টিস্টের একাধিক নাটক। এবার যে উপলব্ধি হলো, একই আর্টিস্টের সারাদিন ব্যাপি নাটক, কোন কোন সময় ২দিন ধরে। দেখে মনে হইসে ঐ আর্টিস্টের রেট্রোস্পেক্টিভ চলতেসে। শুধু তাইই না, একই সময়ে একাধিক চ্যানেলে একই
আর্টিস্টের নাটক একই সাথে চলতেসে মহাসমারোহে, এমনও গেছে একসাথে চারটা চ্যানেলে চারটা। পুরা ঘোল খাইয়া গেসি। নাটক দেখতে দেখতে ভাইয়া বলতেসিল,
—দেখছ, মেয়েটা কত সহজ সরল ছিলনা, এখন কি ডেঞ্জারাস।
আমি বললাম,
—না ভাইয়া, ভুল হচ্ছে। ঐটা আরেকটা, এটা আরেকটা।
ভাইয়া বলল,
—হুম, তুমি বেশি বুঝ!
আমি আসলেই বুঝতেসিনা, ভাইয়ার চেয়ে বেশি বোঝার অবস্থাও আমার না।
আম্মা বলল,
—এটা দেখতেস কেন? তিশার একটা দেখতেসিলা না ঐটা দেখ।
কয়েকবছর আগে যেটা হইছে খুঁজে পেতাম না, এখন খুঁজে পাচ্ছি কিন্তু কোনটা দেখতেসিলাম বুঝে পাইনা। ১৫ মিনিট দেখার পর হয়তো বুঝতেসি “ও এইটা না”। ততক্ষনে হয়ে গেসে। আম্মাও দেখতেসে। বললাম,
—কি দেখলা কি বুঝলা।
আম্মা বলল,
—বোঝার কি আছে সব একই।
আমি কিছুটা পড়াশুনা জানি, রিমোট বুঝি, নিয়া আমারই প্যাচ খাইয়া গেসে, আম্মাদের কি হবে?! আমিতো টিভি দেখিনা, নেটে, ইউটিউবে দেখে নিব, আম্মাদের কি হবে!!??
বিচিত্র অভিজ্ঞতা, পুরা বেয়াক্কেল হয়ে গেলাম!!
আমারে খ্যামা দে মা।
আমার বাবা থাকলে হয়তো ‘এই করস তোরা, এই করতাসস’ কইয়া রিমোট দিয়া বাইরাইয়া মাইরা ফেলত মনে হয়!
. ____________ # #