নবারুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ আগস্ট ২০১৪, ৯:৫০ পূর্বাহ্ণ, | ৬৭৪০ বার পঠিত
আদিয়্যু, নবারুণ!
চিরস্বাগত নবারুণ ভট্টাচার্য!
না, ‘হারবার্ট’ বা ‘কাঙাল মালসাট’ নয়, কিংবা ‘খেলনানগর’ বা ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ কি ‘মসোলিয়াম’ও নয়, এগুলো তো অবশ্যই নবারুণের মহাকালযাত্রার শক্তপোক্ত নৌকা একেকটা, নবারুণ’স্ আর্ক, কিন্তু আমি ভাবছিলাম নবারুণের কবিতাগুলো নিয়ে। ‘এই মৃত্যুউপত্যকা আমার দেশ না’ তার ডেব্যু কবিতাবই। এই উচ্চারণটা আমরা তার কবিতাবাহিত হয়ে পেয়েছিলাম হাতে — এই মৃত্যুউপত্যকা আমার দেশ না — এখন এইটা আমরা আমাদের যে-কোনো বড় সঙ্কটে জাতীয় সংবাদপত্রে পুনঃপুনঃ প্রচারিত হতে দেখি, বড় মোক্ষম উয়েপন এ-উচ্চারণ একবাক্যে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের, শাসকের দিকে অনাস্থার আঙুল উঁচানোর, রক্তচক্ষুকে তুড়ির শব্দে চ্যালেঞ্জ জানানোর, স্পর্ধাতর্জনী বাঁচিয়ে রাখার বিরল এবং অধুনাপ্রায়লুপ্ত এক বাংলা হাতিয়ার নবারুণের কবিতা।
আমি যদি লিখতে পারতাম, ওই অর্থে, তাহলে নবারুণের কবিতা নিয়েই লিখতাম।
আরও দুইটা কবিতার বই তার, নবারুণ ভট্টাচার্যের, প্রকাশকাল অনুসারে যথাক্রমে এরা ‘পুলিশ করে মানুষ শিকার’ ও ‘মুখে মেঘের রুমাল বাঁধা’। ‘রাতের সার্কাস’ সম্ভবত তার সর্বশেষ কবিতার বই। বেরিয়েছিল ভাষাবন্ধন প্রকাশনী থেকে। প্রকাশসাল দেখতে পাচ্ছি ২০০৯, প্রকাশমাস জানুয়ারি। ভাষাবন্ধন কি তার নিজের প্রকাশনা ব্যবসায়? সেইরকমই শুনেছি। এবং পরে খেয়াল করে দেখেছি যে এই প্রকাশনাগার থেকে বেরোনো বইপুস্তিকাগুলো বাজারে বেশিরভাগ সময় বেমানান, এরা মানানসই বিশেষ-যাপনস্বপ্ন-নিয়া-যাবজ্জীবন-দণ্ডভুক্তভোগা মানুষের বুকে, এদের যোগ্য বাসস্থান মাকড়শাজালঘেরা আপনার অনাড়ম্বর বুকশেল্ফ। নিজের বইগুলো পুঁজি-ঝিলমিলে ফেরিওলা পাব্লিশারের হাতে দেন নাই তুলে, ছেপেছে ভাষাবন্ধন প্রকাশনী, কিংবা কোনো সতীর্থ সহযাত্রীর কাছে করেছেন সোপর্দ। অন্যান্য অনেক ও অনেকের বই বেরিয়েছে, যেমন নিজেরও বেশকিছু, এই পাব্লিশিং ডেরা থেকে। দেখা মাত্র খরিদ করি কিংবা না-করি, আমরা নিশ্চয় করে ভেবেছি যে এই বিশেষ বইটা ভালো হবে, কেননা এইটা ভাষাবন্ধন থেকে বেরিয়েছে, কেননা এইটা আঁতুড়ঘরে নবারুণের নজর ছুঁয়ে এসেছে। এইভাবেই, ধীরে ধীরে, নবারুণ আমাদের নিকট তার বইয়ের অক্ষর-বর্ণভরা পাতাপত্রালির বাইরে এক সমীহ-জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। সমুদ্রসুদূর বাতিঘরের ন্যায় বিরাজিতে শুরু করেন তিনি আমাদিগের এই পড়তে-ভুলে-যাওয়া কেরানিজীবনে। এখন তো অবস্থা এমন যে, আপনি নিজে লেখক এবং আপনার সারিন্দা আপনার চেয়েও অনেক বেড়ে লেখক। ফলে লেখা বাইরাচ্ছে ঠিকই, বিস্তর সাহিত্যসংঘাতসৌহার্দ্য জন্মাতেছে মুহূর্মুহূ, কিন্তু গানটা আর হচ্ছে না, মানে যেন জলসাটা ঠিক জমছে না, সুর লাগছে না জায়গামতো যেন, অর্কেস্ট্রা ব্যাহত হচ্ছে। ফেসবুকে-চোখেমুখে ঝাটিঙ্গাপাখির ন্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে আত্মাহুতি দিতেছে নিতিমুহূর্তে। একের-পর-এক লেখকের-কবির মিনি-ইন্টার্ভিউ, মিডি-ইন্টার্ভিউ, বিগি-বিগি ইন্টার্ভিউ। গণতন্ত্রের এ এক অপরূপ দিক, গণতন্ত্রের এইটাই আবার গাড্ডারও দিক বটে। লেখা খেয়ে বেঁচে থাকছি তিনবেলা আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি।
কিন্তু নবারুণ ছিলেন আমাদের সঙ্গে, বেঁচেই ছিলেন, বেহাত-হয়ে-যাওয়া আমাদের স্বপ্নের কোনো ভূখণ্ডের শেষ প্রতিভূ হয়ে। যে-স্বপ্নভূখণ্ডটা আমাদের সৃজনে ও যাপনে ছিল ভিত্তি হবার কথা, আলু-ছোলা-বাখরখানি বেচতে বেচতে বেহাত হয়ে গেছে সেইটা, আমরা এখন হরষে গাই হাওয়াগানা, নাচি হাওয়ার নাচ, হাওয়ায় বাঁচি হাওয়ায় হাঁচি, হাওয়াবাদ্য বাজায়ে হই হাওয়ায় পুরস্কৃত। অথচ নবারুণ তো কখনো চ্যূত হন নাই। নবারুণের আগুন তো কখনো নেভে নাই। আমরা যারা ঝাঁকে গেছি মিশে, হ্যান্ডশেইক করেছি আপোসের, তারা দূর থেকে নবারুণকে দেখেছি, এবং বিনতমস্তকে গেয়েছি গোপনে-গরজি সুমনের গান : “পুড়ুক আগুনে আমার কান্না-হাসি / তোমাকেই আমি তোমাকেই ভালোবাসি।”
কৃশকায় রুগ্ণ-ভগ্নস্বাস্থ্যের মানুষটা, বা দৈত্যটা, ক্যান্সারে ভুগছিলেন। মরে গেলেন। সহসাই। সিক্সটিসিক্স। কিন্তু মরে যাবার আগে একবারও মরেন নাই তিনি আমাদের ন্যায়। একের-পর-এক লেখায়, একের-পর-এক ফ্যাতাড়ুর গল্পে, বেঁচে গেছেন নবারুণ। মরতে মরতে আমরাও বেঁচে উঠেছি তৎসঙ্গে। কেরানিজীবনের দিনগোনা বছরের এ-মাথা ও-মাথা আমরা বইদোকানে যেয়ে খোঁজ নিতাম নতুন নবারুণ এসেছেন কি না, তারপর পেয়ে এবং না-পেয়ে দ্রুত সন্ত্রস্ত বেরিয়ে আসতাম বইদোকান থেকে। কেননা আমাদের বইদোকানগুলো সমস্তই ইয়াঙ্গার-ওল্ডার কবিদিগের পরনিন্দাশাস্ত্র অনুশীলনের আখড়া একেকটা। ভালো হয়েছে এক হিসাবে যে এখন থেকে নবারুণের নতুন বই খুঁজতে যাওয়া লাগবে না বইদোকানে।
এইটা একটা তাজ্জুব-কা-বাত ভাইয়া, আপনে চেশোয়াভ মিউশ পছন্দ করেন, মিরোস্লাভ হোলুব লাইক করেন, নিকানার পাররা ভালোবাসেন, বিটনিক ও লিভারপুল কবিদিগের মধ্যে কেউ কেউ এবং হার্লেম পোয়েটেরা আপনার জান, কিংবা ডেরেক ওয়ালকট পড়ে আপনি শিহরিত, সবই পড়েছেন মানবেন্দ্রানুবাদে, কিংবা শিশিরকুমার দাশের তর্জমায় জর্জ সেফেরিস পড়ে আপনি গদগদ; অথচ এই আপনিই কিনা নাকমুখ কুঁচকে কহেন : না, ইয়ে, মানে যেইটা বলতে চাইতেছি যে, বাংলায় এইসব ঠিক হয় না, বাংলা কবিতার সঙ্গে এইসব ঠিক যায় না আর-কি, এন্টিপোয়েট্রির বাস্তবতা আমাদের নাই, বুঝলেন না? না, ভাইয়া, বুঝলাম না। তা, থাউক, বোঝার বয়সও তো পার হইয়া গিয়াছে, এখন তো সময় ঠিক বোঝাবুঝির অনুকূলও নয়। কিন্তু কোথাও কৌতূহল রহিয়া গেল … উহাদেরে লাগে ভালো যদি, ইহাদেরে কেন নয়, এ-ই মম কোয়েশ্চন হয়। সেক্ষেত্রে আপনার উত্তর : আরে মিয়া, বুঝলা না, মানে আমারে ঠিক টানে না, মানে আমি ঠিক নিতে পারি না। উত্তর শুনিয়া খামোশ না-হয়ে উপায় আছে? এইধারা টানাটানি, নেওয়া-দেওয়া, নেনাদেনা নিয়া বাংলা কবিতা হাঁটিতেছে রাজপথে। দেখেশুনে মনে হয়, আমরা বোধহয় ড্যাম শিওর বাংলা কবিতার অভিমুখ বিষয়ে। সেইটা বৈষ্ণব প্রকৃতিলীনতা আর প্রেমসুধারসধারা, হালের ক্রেইজ যুক্ত হয়েছে ফাইজলামিকীর্ণ গোমূর্খগিরি লুকাইবার স্মার্টনেস। তা ভাইয়া, আপনার প্রেমপারিজাত ও পয়্মালি চলুক না, আমার তো আপনারে শ্রদ্ধা-শ্রদ্ধা লাগে। আর ভাইয়া, আপনারও চলুক না স্লাভো জিজেকগিরি, আমার তো আপনারেও বিদ্যা-বিদ্যা লাগে। লেকিন, কথা হলো, শ্রদ্ধা কাপুর আর বিদ্যা বালানের বাইরেও তো ইন্ডাস্ট্রি বিরাজে ব্যাপক মাত্রা ও মজমায়। সেইসবও চাখতে চাই আমি। কাজেই আমার যেমন আপনাদিগের ফুরফুরে ফড়িঙের হাওয়াবাতাস বা ফ্লাইং স্যসার চাই, তেমনি চাই জয়দেব-নবারুণ-শৈলেশ্বর।
নিজেকেই ক্রমাগত উপর্যুপরি হ্যামারিং করে যেতে দেখা যায়, নবারুণকে, তার কবিতায়। যেমন ধরুন, খেয়াল করবেন, নবারুণের কবিতায় এক কবির উপস্থিতি পৌনপুনিক। এই কবি, কখনো একা কখনো দঙ্গলে-সিন্ডিকেটে, সিঁদেল চোরের ন্যায় বিদঘুটে কীর্তিকলাপের হোতা। নষ্ট-কীটদষ্ট সময়ের প্রেজেন্টেশন হিশেবে এই বিতিকিচ্ছিরি-কুচ্ছিৎ অমাবস্যাবর্ণ কবিদের আনাগোনা মানুষের লোকালয়ে। এবং অবশ্যম্ভাবী অতএব নবারুণের কবিচিহ্ন পরিত্যাগ। গদ্যকার হিশেবে এক গনগনে নবারুণের আবির্ভাব অতএব অবধারিত। হয়েছেও তাই। কিন্তু পুঁচকে পণ্ডিতদের এই লিলুয়া বাতাসে, এই জিজেক-পাণ্ডিত্যের দেশে, নবারুণকে সেজন্যে লেজছাঁটা বান্দরের লাফঝাঁপ দিতে হয় নাই। তিন-চারটা লাইন আওড়ানো যাক নবারুণখণ্ড হইতে : ”উড়িতেছে ডাঁস, উড়িতেছে বোলতা, উড়িতেছে ভীমরুল / নিতম্বদেশ আঢাকা দেখিলে ফুটাইবে তারা হুল। / মহাকাশ হতে গু-খেকো শকুন হাগিতেছে তব গায়, / বাঙালি শুধুই খচ্চর নয়, তদুপরি অসহায়।” এই জিনিশ তো গায়ে এসে লাগে, ফের দুম করে কিছু বলাও তো যায় না এই কথকঠাকুরটিরে। মুশকিল।
নবারুণ পুতুপুতু লাইফ চান নাই। প্রথম লেখা থেকে শেষ লেখা অবধি সম্ভবত সেই প্রমাণ হাজির। আগাগোড়া আগুন। একবারও নেভে নাই। চিতায় গেছে একদম সটান। নবারুণের পূর্বসুরিদের মুখ তো প্রসঙ্গত মনে পড়বেই। ঋত্বিক, মণীশ, মহাশ্বেতা, বিজন। এবং নবারুণ। দ্য নবারুণ। “পৃথিবীতে টাকা থাকবে না দুগ্গা, তুমি দেখে নিও, কাজগুনো থেকে যাবে” — কার গলা শোনা যায়? শোনেন মশাই, সিনেমার জন্যে প্রেমট্রেম থেকে আমি সিনেমা বানাইতে নামি নাই, কালকে যদি এরচেয়ে ভালো কোনো প্রকাশমাধ্যম পাই তো সিনেমার পোঁদে লাত্থি মেরে সেইখানে চলে যাব। কার গলা রে? কে কথা কয়? সে যে নড়েচড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনমভরই মিলবে অবশ্য, কেননা তার ‘কাজগুনো’ তো থেকে গেছে। সেই পাগলার। লেলিহান লকলকে সেই উন্মাদের। সত্যজিতের ১৮০ ডিগ্রি উল্টা সেই মায়েস্ত্রোর। মাঝে মাঝে মনে হয়, নবারুণ কি তবে কবিতার চেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া ঠাওরে গদ্যের দিকে ধাবিলেন? না-হলে ডেব্যু হারবার্ট থেকেই কেন হবে একের পর এক বাজিমাত? যদিও কে না জানে যে, বেশিরভাগ গাদাগুচ্ছের কবিই তো ছন্দে-নিশ্ছন্দে লেখে স্রেফ শখের বশে, স্রেফ নাম ফাটানোর জন্যে। লেখার ভেতরচাপে, লেখার মহাজাগতিক ঠাপের ঠ্যালায় লেখে কয়জন আর বলেন? গুটিকয়, সর্বকালে, নবারুণ সেই বংশের।
“ভাবতে অবাক লাগে, এমন এক ধারা তৈরি করে গেলেন এই লেখক, যার না-আছে কোনো প্রাক, না-রইল কোনো ভবিষ্যৎ। যেন বিপুল ব্যতিক্রমী কোনো ধারা নবারুণের সঙ্গে জন্মাল, রইল তাঁর সঙ্গে আর ওঁর সঙ্গেই মারা গেল! প্রতিটি লেখার ভাষা-ব্যবহার নতুন নতুন দিগদর্শন। প্রতিটি চরিত্র সমাজের এমন সব কোণ থেকে তুলে আনা, যা অভাবনীয়! আগে কেউ কখনো ভেবেছেন, সমাজের তথাকথিত অতি-অদরকারি বিষয়ও সাহিত্যের উপাদান হয়ে উঠতে পারে? নর্দমার পোড়াকাঠি তুলে এনেও সাহিত্য রচনা করতে পারতেন নবারুণ। বৃদ্ধ আগুন চাইছে, কেউ দিচ্ছে না। নবারুণের কলম চঞ্চল হয়ে উঠত অজানা খনির নতুন মণির খোঁজে! যে-কোনো ছোটখাটো ঘটনা ওঁকে নাড়া দিত। কুকুর, বেড়ালকে দেখেও ওঁর সাহিত্যমন জাগ্রত হতো। ‘লুব্ধক’ বা ‘অন্ধ বেড়াল’ই প্রমাণ, কতটা ব্যতিক্রমী তাঁর লেখনী। মানুষ ছাড়া এ-বিশ্বে আর কিছু নেই, এই একদেশদর্শী ভাবনার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে নবারুণের সাহিত্যে সমাজ পেতেছে কীটানুকীট, পোকামাকড়। এই দর্শন, এই দেখার চোখটাই নবারুণ ভট্টাচার্য। একেবারে স্বতন্ত্র!” — সুমন মুখোপাধ্যায় লিখেছেন কথাগুলো সদ্য নবারুণ বিষয়ক ছোট্ট অথচ অন্তর্স্পর্শী ট্রিবিউট-অবিচ্যুয়ারিতে। এক নয়, দুই নয়, তিন-তিনটি নবারুণ-আখ্যান ইনি সিনেমায় তুলেছেন, এর মধ্যে রয়েছে ‘হারবার্ট’ ও ‘কাঙাল মালসাট’, ভাবা যায়! একবার-আধবার হইলে বলা যাইত অবশ্য যে এক্সপেরিমেন্টের বায়ুচরা ব্যামো বৈ কিছু নয়কো। তথাচ তিন-তিনবার! কানের লতি চিমটি কাটি, বুকে ক্রস, দুগ্গা দুগ্গা! সাহস! টলিউডের ঘোলা জলে এর ডুবে মরা অনিবার্য জেনেও নবারুণের নেশায় এরে ছাড়ে নাই বাপু! উল্লেখ করা যাক একটা ঘটনা, নবারুণ যে-ঘটনার নায়ক, গদ্যে এইটা এনেছেন সুমন : “যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানে ঠাণ্ডা পানীয় দেওয়া হচ্ছে। নবারুণদা আচমকা বলে বসলেন, ‘আমি মানুষের রক্ত খাই না।’ ব্যস! বাকিরা সবাই চরম অস্বস্তিতে। হেলদোল নেই নবারুণদার।” বলা বাহুল্য, বোঝাই যায়, এই ঘটনা সাম্প্রতিকের নয়। ইজরায়েল যে-হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে আমেরিকাচ্ছায়ায়, সেই নিধনকাণ্ডের বিরুদ্ধে সবসময়ই ছিলেন তিনি আমৃত্যু, নরেন্দ্র মোদী যখন ২০০২ সালে আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির টেলিভিশনপর্দায় সদম্ভে ধর্মীয় জজবা গলায় নিয়ে শত শত সন্ত্রাসী-নয়-স্রেফ-মুসলমান প্রাণ বধ করল গুজরাটে, সেই ঘটনার পর এ-নিয়ে কবিতা লিখেছেন নবারুণ, নানাভাবেই এইটি ফিরে এসেছে তার পরের নানান লেখাপত্রে, যেমন এসেছে প্যালেস্টাইন-পক্ষপাত বারবার লেখায় তার। আজকালকার ফেসবুকিশ কাণ্ডকারখানায় যেমন প্রতিবাদ ব্যাপারটা কেমন খেলো ও লোকমনোরঞ্জনী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, নবারুণসাহিত্য ওই পদের পুংটামি ভাবলে আপনার জিন্দেগির সতেরোআনাই বোগাস, অন্যদিকে এসব ব্যাপারকে ফের যেন বামপক্ষী বিখাউজ-খোঁসপাচড়ার মুষ্টিবদ্ধ-শক্তচোয়াল টুয়েন্টিফোরআওয়ার্সডটকম মনে করে কেউ ভুয়া পাতকী হইবেন না। “তাঁকে এক-আঁচড়ে মার্ক্সিস্ট বলে দেওয়া যায় না। আবার অ-মার্ক্সিস্টও বলা অসম্ভব। বিশ্ব জুড়ে ঘটে-চলা পটপরিবর্তন অনায়াস জায়গা করে নিয়েছে তাঁর লেখায়। বলতেন, তিনি এই পটপরিবর্তনের একইসঙ্গে অংশীদার এবং ভিক্টিম। মার্ক্সীয় মতবাদের সঙ্গে বৌদ্ধদর্শনের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন নবারুণ। আবার অশরীরী ব্যাপার নিয়ে এমন কাণ্ড বাঁধিয়েছেন যে, রিয়েলিটি আর ননরিয়েলিটির নিপাট বুননে জন্ম নিয়েছে অদ্ভুত অ্যাবস্ট্র্যাকশন। আর এইসব পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যেই রয়েছে নবধারার এই লেখকের নিজস্ব রাজনৈতিক কণ্ঠ, স্বকীয় শৈলী। ‘হারবার্ট’ তার প্রমাণ। ‘কাঙাল মালসাট’ তার অভিজ্ঞান। ‘মহাযানের আয়না’ তার নিদর্শন।”
গদ্যেই লিখেছেন তিনি তার আখ্যানভাগগুলো, তবে সেগুলো কবিতা নামে কেউ যদি ডেকে শান্তি পেতে চান তো পাইতেও তো পারেন। গনগনে গান, লকলকে লেলিহান কবিতা সেসব। কোনো কাজ পার্ফেকশনের দিকে নিয়ে যাওয়ার নাম তো কবিতাই, নাকি? জীবনযাপনও তো, নবারুণের, অনাপোস কবিতা একটাই। এলেবেলে এটা-ওটা হবার চেয়ে বরং শূকরজীবন প্রেফার করেছেন নিজের জন্য নবারুণ। শূকরজন্ম তো সম্মানেরই বরং, অন্তত নবারুণ এই জীবনটাই ঈপ্সিত মনে করেছেন, ‘রাতের সার্কাস’ বইয়ের একটা কবিতার ভেতর অনেককিছুতে অনাস্থা জানায়ে শেষে লাস্ট স্ট্যাঞ্জায় যেয়ে এইভাবে মহিমান্বিত করছেন শূকরজন্ম : “এসব তুচ্ছ বেশ্যাপনায় যে সায় দেবে দিক / শূকর হবার অনেক মজা, অন্তে গরম শিক।”
যারা রাগটাকে উদযাপন করতে চান জীবনে ও কবিতায়, অ্যাঙ্গার সেলেব্রেইট করতে চান নিজের যাপনলগ্ন, তাদের নিকট কবি নবারুণ অভ্যর্থনা পাবেন। যেমন পাবেন ২০১২ ফেব্রুয়ারিতে প্রয়াত জয়দেব বসু। প্রকৃতির ও প্রেমের পুতুপুতুবর্ণনায় বিকলাঙ্গ বাংলা কবিতায় এদের একটা জায়গা থাকবে নিশ্চয়। এনিওয়ে। যেই গনগনে রাগটার দেখা পাওয়া যায় এই দুইজনের কবিতায়, সেইটা আমাদের ট্রেন্ডি ঈর্ষা-অসূয়াজাত ফাইজলামি-ফিচলেমিভরা রাগানুরাগ নয় কিন্তু! এইটা,কি বলব, আন্তরিক জ্বলন-প্রদাহজাত, অনেক বেশি কমিটেড এই অ্যাঙ্গার, যুগপৎ ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক এর প্রকাশ।
কত কত প্রণাম সারা হয়নি এখনো! ওদিকে পোর্চের নিচে উঠিয়ে-নিয়ে-যাবার পাল্কি এসে দাঁড়াবার বেলা তো আমারও সন্নিকট। কত-কী করার আছে বাকি … !
‘রাতের সার্কাস’ থেকে একটি ট্রিবিউট-রিসাইট্যল :
ইতরের দেশ
আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
এখানে বণিকেরা লেখকদের উদ্ভাবন করে
এবং লেখকেরা উদ্ভাবিত হয়
আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
যে-দেশের বুদ্ধিজীবী-অধ্যুষিত সরকার
শীতের ইথারের মধ্যে গরিব মানুষের ঘর ভেঙে দেয়
আমি একটি ইতরের দেশে থাকি
যেখানে অবশ অক্ষরমালা চিবোতে চিবোতে
কবিরা গরু হয়ে যায়
উল্টোটাও যে হয় না এমনও বলা যায় না
আমার ভাগ্য আমি নিজেই ভেঙেছি
তাই বাতিল স্টিমরোলারদের
কাছে বসে থাকি
বসে থাকি আর
রাস্তা বানাবার গল্প শুনি
(দেশটি ক্রমেই ইতরের দেশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে — লিখেছিলেন ঋত্বিক ঘটক)
অন্ত্যেষ্টি অনুচ্ছেদ। ১৯৪৮ সালে এসেছিলেন, মহাজাগতিক বিমানে চেপে, ২০১৪ সালে শেষ হলো মিশন। সিক্সটিসিক্স। নবারুণের প্রতি এই শ্রদ্ধাগদ্য অত্যন্ত অপ্রস্তুতভাবে লেখা, তাৎক্ষণিকতার দাগ এর শরীরে সর্বত্র, কাজেই এইটে কেবল নবারুণপাঠকদের নজরে ঠেকলে বেঁচে যাব এ-যাত্রা প্রাণে, পুঁচকে প্যাঁচানো ক্রিটিকদিগের গোচরে গেলে আর নিস্তার নাই। শেষোক্তরা খানিকক্ষণ চোখ ঘুরিয়ে একটু অন্যদিকে তাকিয়ে থাকুন, অথবা তাকানো অফ রেখে চোখেরে আরাম দিন, এই ফাঁকে শেষ কুচকাওয়াজে শামিল হই আমরা নবারুণের সৎকারানুষ্ঠানে। গুডবাই অ্যান্ড গেট ব্যাক স্যুন, নবারুণ!