ওয়াল্ট হুইটম্যানের দু’টি গদ্য / অনুবাদ এমদাদ রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০১৪, ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ, | ৩৯৫৪ বার পঠিত
[গদ্য দু’টি অনুবাদের পর হুইটম্যানের জন্ম আর মৃত্যু ছাড়া আরও বেশি কিছু জানার ইচ্ছা হল। খুঁজতে খুঁজতে দূরে আর কিছু গভীরে গিয়ে পেয়ে গেলাম হেনরি মিলার! আলম খোরশেদের ভাষান্তরে হেনরি মিলারের ভাবনাগুচ্ছ। মিলার বলছেনঃ ‘আমার বন্ধু অ্যাবে রাটনার আর আমি যখন আমাদের আমেরিকাব্যাপী এয়ারকন্ডিশন্ড নাইটমেয়ার যাত্রা শুরু করি তখন আমরা ছিলাম লং আইল্যান্ড-এ, ওয়াল্ট হুইটম্যান যে খামারে জন্মেছিলেন সেটা থেকে খুব একটা দূরে নয়। আমরা ঠিক করি যাত্রা শুরু করার আগে তাঁর জন্মস্থানের পাশ দিয়ে গিয়ে আমাদের শ্রদ্ধা জানাবো। কথামত তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা গাড়ির গতি কমিয়ে মাথার টুপি খুলে নিই, তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে, মৃদু হেসে আমাদের অভিযান শুরু করি।’মিলারকে তখন মুগ্ধ হয়ে পড়ছি, ‘আমি হুইটম্যানকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম লেখক বলে মনে করি, এমনকি ইউরোপের যে-কোন শ্রেষ্ঠতমর চেয়েও শ্রেষ্ঠ । লীভ্স্ অভ গ্রাস একটি সত্যিকারের মাস্টারপীস, আত্মার সংগীতবিশেষ। তাঁর কবিতা সং অভ মাইসেল্ফ-এ স্বাধীনতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।’ এখন এই শেষরাতে, নিজের সংগ্রহের পেপারব্যাক লীভ্স্ অভ গ্রাস বের করে পড়তে পড়তে অন্ধকার-ফিকে-হয়ে-আসা হ্যাম্পশায়ারের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়!
হুইটম্যানের জন্ম হয় ১৮১৯ সালের ৩১ মে, আমেরিকায়; জীবন শেষ হয় ২৬ মার্চ ১৮৯২। তাঁর ‘সেইসব দিন’ বইটি প্রকাশ পায় ১৮৮২ সালে। বিচিত্র-বিষয়ে-ঠাসা এই বইটিকে হুইটম্যানের ডাইরিও বলা যায়। অনূদিত গদ্য দু’টি এই বই থেকেই নেয়া।]
একটু পর—ঝলমলে আলোয়—এক অদ্ভুত সঙ্গীত, এই সব দিনরাত্রি মুখর করে দেয় (এপ্রিলের শেষে, মে’র প্রথমে) কালোপাখির গান; অবশ্য সবজাতের পাখিই, অকস্মাৎ ছুটে চলে, শিস-ধ্বনি দেয়, লাফায়, স্থির হয়ে বসে, গাছেদের ডালেপাতায়। আমি আগে আর কখনোই এমনটা দেখি নাই, শুনি নাই, কিংবা বলা যায় এই দেখা আর শোনার মাঝামাঝিও কিছু ঘটে নাই, পাখিদের অবিরাম ছুটে চলা, বসা, গান গাইতে থাকা জনিত এই যে ব্যস্ততা; এই যে গানপ্লাবন এই যে একাকার উন্মাদনা; আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বছরের ঠিক এই সময়টায় আর কখনোই এমন হয় নাই। মহাসমুদ্রের মতো, পাখিদের এই পরম্পরা।এইখানে আমি আজ যে পাখিদের গান শুনলাম, তাদের নামের একটা তালিকা দিচ্ছি—
কালোপাখি (অগুন্তি),
চড়ুই (অগুন্তি),
চিত্রা ঘুঘু,
ক্যাটবার্ড,
পেঁচা,
কোকিল,
কাঠঠোকরা,
পানকৌড়ি,
রাজপাখি,
কথক,
কাক (অগুন্তি),
কোয়াক,
রেন,
মাটিখোর,
মাছরাঙ্গা,
দাঁড়কাক,
কোয়েল,
ধূসরমুখা,
টার্কিশ-বাজ,
ঈগল,
মোরগ-বাজ,
নাছোড়বান্দা,
হলুদিয়া,
সারস,
শরালি,
চুচুক,
কীচকী,
বন পায়রা।
পরে আরও যারা আসে, তাদের নামের তালিকা—
ব্লু বার্ড,
টুনটুনি,
কিলডার,
শাদাপেট-সোয়ালো,
টিট্টিভ,
গাঙশালিক,
রবিন পাখি,
উইলসন থ্রাস,
বনমোরগ,
ফ্লিকার।
কতখানি সঙ্গীত (বুনো, সরল, আদিম, নিশ্চিত কিন্তু এত মিষ্টি আর এত টক) যে এখানে বাঁশির মত বাজছে! তার পাঁচ ভাগের চার ভাগই পাখিদের গলার। দুনিয়ার সমস্ত পাখি আর তাদের গলার ভঙ্গি! গত আধঘণ্টা থেকে, এখনও, আমি যখন থেকে এখানে বসে থেকেছি, দেখতে পেয়েছি, কয়েকগোছা ঝরাপালক একসঙ্গে এসে পড়ছিল ঝোপঝাড়ের ওপর, পড়তেছিল তারা উড়ে উড়ে, অবিরাম, আমার ইচ্ছা হল ব্যাপারটাকে বলি স্পন্দময় শিস-ধ্বনি। আর এখন, ঠিক যেন একটি খুব ছোট্ট একটা পাখি চকিতে দেখা গেল, পুরোটাই মালবেরিরাঙা, ঝোপের চারপাশে- মাথা, ডানাগুলি, শরীর গাঢ় লাল, খুব উজ্জ্বলও নয়- গানও গাইছে না, যা এতক্ষণ আমি শুনছিলাম। ৪টার সময়ঃ সত্যিকারের এক জমকালো কনসার্ট আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। এক ডজন নানাপ্রকারের পাখি যেন এক ইচ্ছাশক্তির বলে একসঙ্গে জড়ো হয়ে গেছে! হঠাৎ, বৃষ্টি এসে তাদের কোরাস বন্ধ করে দেয় তবু পাখিদের উদ্দাম গান আর থামে না, তারা যেন যূথবদ্ধ এই জীবনে, কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যেতে চায় না। এই দৃশ্যদেখা শেষ করে আমি ডোবার কাছের গাছের গুড়িতে বসে পড়ি। বহুলস্বরের কিচিরমিচির আর তার পূর্ণান্তর হতে থাকে আমার থেকে একটু দূরত্বে আর তখন আমি দেখতে থাকি একটি পালক, সমস্ত সঙ্গীত থেকে বিছিন্ন, নিঃসঙ্গ, জঙ্গলের ভিতর কোথায় জানি উড়ে যাচ্ছে- যেন গান গাইছে একাকীত্বের, যেন তার উড়ে যাওয়ার সঙ্গে মিশে গেছে মানুষের জন্য পৃথিবীতে নিয়ে আসা ভালবাসার গান- যে-গান অনন্তজীবনকালের, যে-সময় চিরপ্রণম্য, শুধুই তার।