কবির মৃত্যু, কবির জন্ম, কবিতার অমরতা । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুন ২০১৪, ১:৪৭ অপরাহ্ণ, | ৩৪৮৪ বার পঠিত
সবুজ অথচ করুণ কূটকচালিলিপ্ত এই ডাঙার ভুবন ছেড়ে চলে গেছেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন, সন ২০১৩ জুন মাসের ১৬ তারিখে, জৈষ্ঠ্যের কাঁঠালগন্ধী বৃষ্টির ঝুমঝুমি দিনে। দেখতে দেখতে বছরচক্র পুরো হয়ে এল। অকালে, এত অকস্মাৎ, এই চলে-যাওয়া। আবার অকালেও বলা যাবে না পুরোপুরি, ষাটোর্ধ্ব বয়সে একজন কবির প্রস্থান অন্তত মনুষ্যজন্মের গড়-আয়ুর নিরিখে দেখলে নেহায়েত হ্রস্বও বলা যাবে না, মানুষের জীবনদৈর্ঘ্য তার কাজের বহর বিবেচনায় রেখে পরিমাপিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেই সূত্রে, খোন্দকারের বিচিত্রমাত্রিক কর্মগ্রাফ নজর ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলে, কেউ বলতে পারবেন না যে একটি জীবন কিচ্ছুটি না-করে, কোনো কন্ট্রিবিউশন না-রেখে দুনিয়ায় দিন-গুজরিয়া গিয়াছেন তিনি; না, তা আদৌ নয়, কিন্তু আমরা তো বেশিরভাগই তা-ই, নিছক ফেসবুকনায়ক হয়ে, কিচ্ছুটি না-করে কেবল কূট-কদাচারে নিজেরা লিপ্ত থেকে, দুনিয়াটা আবিল করে রেখে, কোনো ইম্প্যাক্ট না-রেখে নিজের যাপিত সময়ের গায়ে, এতটুকু খড়কুটোও না-রেখে আপন সন্ততির ভবিষ্যনিশ্চিতির তরে, বেশ তোপধ্বনি বগলদাবা করিয়াই বিদায় নিতেছি হরহামেশা। তাঁর প্রস্থানদৃশ্য কোনোপ্রকার নাটকীয়তাহীন, অতি নিভৃতে, সম্ভবত খুব-কেউ জানতেনও না টানা-দুইদিন হাসপাতালায়িত ছিলেন খোন্দকার। সম্ভবত, কেননা আজকাল তো তরুণতর কবিকেও — যিনি কিনা কাব্য-লিখিবেন-বলিয়া-ঠিক-করিয়াছেন-কিন্তু-লিখিয়া-উঠিতে-পারেন-নাই-এখনও-সময়াভাবে এমনদেরকেও যখন দেখি খুকখুকে কাশি হলেও খবর হয়ে বিরাজেন মিডিয়ায় — ফেসবুকে হোক বা বান্ধবদোস্তের ব্লগস্পটে — সেখানে খোন্দকারের রোগসংবাদ বা তাঁর তবিয়তের ফিলহাল স্ট্যাটাস জানতে পেলে কেউ কেউ, অন্তত যারা কবিসাহিত্যিক না, যারা আমার-আপনার মতো কবিতার ভোলাভালা পাঠক কেবল, তারা আরোগ্যাশীর্বাদ করতেন মনে মনে এবং প্রকাশ্যেও কেউ কেউ কমেন্ট পোস্ট করে। অথবা আর-কিছু পারি না-পারি, ‘রোগশয্যায় একজন কবি অমুক’ — এহেন সংবাদে একটা লাইক তো দিবার পারতাম!!! হায়! লাইকসিকার, লাইকফ্রিক, লাইকফ্যানাটিক, লাইকক্রেইজি হে স্যেল্যুকাস্ নব্য বঙ্গীয় সুসাহিত্যসমাজ!
পার্থ, তোমার তীব্র তির — খোন্দকার আশরাফ হোসেনের একটা কাব্যবইয়ের নাম — একবিংশ বছরের-পর-বছর সংখ্যাগুলোর সম্পাদকীয়তে আপনার মৃদুস্বর মার্জিত কিন্তু তীক্ষ্ম রসবোধ খুব উপভোগ করতাম, খোন্দকার! সম্পাদকীয়তে, এবং সমগ্র পরিকল্পনায়, এত সচেতন পত্রিকাবিন্যাস আমার মতো শিল্পবোধশক্তিবিরহিত অপগণ্ডকেও আকৃষ্ট করেছিল একসময়। এরপর থেকে আপনার একবিংশ, আমি ও আমার বন্ধুরা পাশাপাশি ছিলাম পরষ্পরমুগ্ধ বহুদিন। অনেক দিয়েছে, আমাকে অন্তত, এই পত্রিকাটি। তখন কোনো সার্চইঞ্জিন ছিল না তো — ছিল কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক ছোটকাগজ টুটাফাটা — হুটহাট কবিতা ও কাব্যতত্ত্ব প্রভৃতি নিয়া সার্চ দিলা আর হুড়মুড়ায়া পাঁচসহস্র স্কলার্লি আর্টিকল বারায়া আইলো — কল্পনাতেও অমনটি ছিলনাকো। কয়েকটি ছোটকাগজ ছিল, পশ্চিমবঙ্গেরই বেশি, অপ্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার উনোনে একটু শুকনো খড় ও লাকড়ি যোগাত আমাদেরে। দেশে ছিল গুটিকয় তখন, আমাদের বেড়ে-ওঠার সময়ে, একবিংশ একটি তাদেরই।
কত কী পড়েছি আমরা আপনার অনুবাদে! সেলানের কবিতা পড়েছি — পাউল সেলান — ইগল্টন পড়েছি দীর্ঘদিন-ধরে-প্রকাশিত ধারাবাহিকে — টেরি ইগল্টন পড়তে পড়তেই তো লিট্যারারি থিয়োরি নিয়া আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে বলতে গেলে, একটা দুর্দান্ত প্রবন্ধ পড়েছি ওলে সোয়েঙ্কার, লিভারপুল পোয়েটদের নিয়ে সেই মিষ্টি বিস্তারিত প্রবন্ধটি, কিংবা মায়া অ্যাঞ্জেলা, আর সেই হাইকু কবিদের নিয়ে এবং তাদের উল্লেখযোগ্য অনেক হাইকুর সৃজনশীল তর্জমা আলোচনা সহ, কোরিয়ার বিশেষ এক কাব্যধরনসিজো সম্পর্কে প্রথম জেনেছি আপনারই দৌত্যে, টেড হিউয়েজের কাক সম্পূর্ণ ও অন্যান্য অনেক, অথবা আমাদের শ্রেণিকামরাপাঠ্য পড়াশোনায়-পরীক্ষাপাশে প্রভূত সহায়তা করেছেন আপনি আপনার সফোক্লিস্ এবং ইউরিপিডিস্ অনুবাদগুলো দিয়ে। এইসব ঋণ — আপনার নিকট — একে কী যেন বলে উপমহাদেশীয় দর্শনে? একলব্য নই আমি। কিন্তু কর্জ শোধ করা না-করা পরের আলাপ, কর্জস্বীকার তো কর্তব্য।
এবং আপনার পত্রিকার বিশেষ কয়েকটি সংখ্যার কথা মনে রাখব না! যারপরনাই যত্নের কাজ সেসব। অসম্ভব সুচয়িত ও মেধাবী সমস্ত কাজ। একটু বিদ্যায়তনঘেঁষা, এ নিয়ে একটু খেদ অবশ্য ছিল আমাদের। রসবোধ ফুটে উঠত সমস্তকিছুতেই, কিন্তু রম্য নয়, রগড় কদাপি নয়। ঋজু, স্পষ্টরেখ সব। চোখধাঁধানো নয়, মনোরম, মনমাখানো। দুই যুগন্ধর কবিকে একসঙ্গে পেশ করেছেন বড় সসম্ভ্রম শ্রদ্ধায়, নজরুল-জীবনানন্দ সংখ্যায়। এছাড়া আপনার বিশেষ ফ্যাসিনেশন ছিল অবিভক্তকালীন বাংলার তিরিশি কবিকুল নিয়ে। সেহেতু সসম্ভ্রম শ্রদ্ধা আপনি তর্পণ করেছেন বিশেষত আধুনিক বাংলা কবিতার সেই উন্মেষকালপর্বের প্রতি, তিরিশি পাঁচ স্টলোয়ার্দি কবির প্রতি, তারিফি আলোচনা করেছেন আপনার সাহিত্যিক জীবনপ্রবাহের বিভিন্ন বাঁকে, লেখায়জোখায় নিজের এবং নিজের পত্রিকায়, এইসব না-থাকলে কেমন হতো আমাদের বেড়ে-উঠবার দিনগুলো, কতদুর ও কেমনতর হতো বিকাশ আমার বন্ধুদের, আজ আর কল্পনাও করতে পারি না। বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা করেছেন, লিখেছেন আধুনিকবাদ নিয়ে মনোজ্ঞ প্রবন্ধ, দুনিয়ার সর্বত্র কোথায় কেমন আধুনিকতা খাড়া হয়েছিল সেসব নিয়ে বিপুল পরিসরে সুবিস্তৃত লিখেছেন, পড়ে আলো পেয়েছি। কিংবা আবুল হাসান নিয়ে একটা ভালোবাসাদীপ্ত সংখ্যা করেছিলেন, অমিয় চক্রবর্তী নিয়ে যেমন, কত কাজ একজীবনে! শেষের দিকের একবিংশগুলো খুব পড়েছি বলব না, তবে দেখেছি উল্টেপাল্টে এবং খোঁজ রেখেছি একবিংশ বেরোলো কি না, আমার জীবন ও জীবিকায় এখন পড়াশোনার কোনো বালাই নাই।
খোন্দকার নিজে ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক, পড়াতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কাজেই তিরিশি কবিতাকলা ও সাহিত্যাদর্শের প্রতি তাঁর ফ্যাসিনেশন থাকাটা আদৌ অপ্রত্যাশিত ছিল না। ফ্যাসিনেইটেড ছিলেন তিনি, তিরিশি কবি ও কবিতায়, যেমনটি ছিলেন তাঁর সময়ের সাহিত্যবন্ধু ও সতীর্থ অলমোস্ট সকলেই, কিন্তু অবসেসড মোটেও ছিলেন না তিনি তাঁর অপরাপর অনেক সংলগ্নজনের ন্যায়। এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে তাঁর প্রবন্ধগুলোতে, যেখানে বাংলার আধুনিক কবিতারাজ্য নিয়া তাঁর মূল্যাঙ্কন ও বিবেচনা ভারসাম্যবহ, কেবল তোষণ ও কদরদান কিংবা অচেতন উপভোগবিবরণী তিনি ফাঁদেননি তাঁর গদ্যে। এবং গদ্যও ছিল সর্বদা স্বাদু, বুদ্ধদেবঘরানার মার্জিত ও পরিমিতি বৈভবসম্পন্ন, প্রবন্ধগদ্য পড়েও পাওয়া যেত সৃজনোদ্যম। বুদ্ধদেবকে তিনি, তাঁর সময়ের ট্রেন্ডই ছিল যেমন, দ্রোণাচার্য জ্ঞান করতেন। তবু কইতে যেয়ে কথার ভেতর রাখঢাক বা ছলচাতুরি চোলাই করতে দেখা যায় নাই তাঁকে। এমনকি বুদ্ধদেব সম্পর্কে প্রেম সত্ত্বেও অতিভাবাচ্ছন্ন ছিলেন না তিনি, এর পক্ষে একটা নজির হাজির করা যেতে পারে এখানে, এই লেখা অবশ্য নজির-পেশকারক কোনো লেখা না, তারপরও বক্ষ্যমাণ নিবন্ধকার বিশেষ-এই অংশটি থেকে এ-ইতিহাস সর্বপ্রথম জ্ঞাত হওয়ায় এইটা উল্লেখ করা যাচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অংশটুকু খোন্দকার সম্পাদিত ও স্বোপার্জনে-প্রকাশিত পত্রিকা একবিংশ (সংখ্যা ২৪, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, ঢাকা) ‘আধুনিকবাদ ও বুদ্ধদেব বসু’ প্রতিপাদিত খণ্ড হইতে চয়িত, সম্পাদকীয় ভাষ্যের এক-জায়গায় খোন্দকার বলছেন : “যদিও ভদ্রলোক সাম্প্রদায়িকতার মতো কঠিন শব্দবন্ধ বুদ্ধদেব বসু-র প্রতি প্রয়োগ করা খুবই অনুচিত, তবু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর শীতলতা, অনীহা ও অবিশ্বাস পশ্চিমবঙ্গের উচ্চকোটির বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মনোভাবের প্রতিনিধিত্বশীল ছিল বলেই মনে হয়। তাঁরই মতো, এমনকি তাঁরও চেয়ে উচ্চকিতভাবে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়বিরোধী ছিলেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী। তিনি একাত্তরের অনেক পরে বোধহয় নব্বইয়ের দশকে স্বাধীন বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ নামে অভিহিত করে আলোড়ন তুলেছিলেন, এবং কিয়ৎকালের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের সু-সম্পর্ক মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলাফল, বাংলাদেশে দেশ সাপ্তাহিকীর আগমন নিষিদ্ধ হয়, এবং এর অভিঘাতে রাতারাতি ওই পত্রিকাটি পাক্ষিকে রুপান্তরিত হয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় শিবনারায়ণ রায়কেও অনুরূপ মনোভাব পোষণ করতে দেখেছি। বুদ্ধদেব বসু মুক্তিযুদ্ধকালীন কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গীয় সরকার ও সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও উচ্ছ্বাসকে ‘ন্যাকামি’ বলেছেন, এতে তাঁর সুদূরগামী ভবিষ্যজ্ঞান (বাংলাদেশ আখেরে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে — এ-রকম পয়্গম্বরি পূর্বানুমানহেতু) হয়তো প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আগুন ও গন্ধকের নদী সাঁতরে পাড়ে-ওঠা বাঙালি জাতি (অন্তত পূর্ববঙ্গীয় ভাগে) তাঁকে সেজন্য উষ্ণ ধন্যবাদ না-ও দিতে পারে।” চেতন-নচেতন দুইভাগে তাবৎকিছু যুধা করে ফেলার এই সাহিত্যরাজনীতিপাড়ায় কেবল এই কারণেই বুদ্ধদেবের পিণ্ডি চটকাতে পারতেন যে-কোনো লেখক, কুশপুত্তলিকা দাহপূর্বক রচনা জ্বালাময়ী করে তুলতে পারতেন, অথবা দেবদ্বিজে ভক্তিমার্গ মস্তকে রেখে মেন্টরের ভ্রান্তিবিলাস বেমালুম চেপে যেতে পারতেন। খোন্দকার যথাসাধ্য মুক্তমনন ও সহৃদয়হৃদয়সম্বাদী ছিলেন অন্তত রচনায়। এবং রচকজীবনের বাইরে তিনি দৈনন্দিন যাপনে কেমনতর ছিলেন, এ-সম্পর্কে এই নিবন্ধকার বিলকুল অন্ধকারে; এইটা জানা বা জানানো অত দরকারিও নয় মনে হয়, এই নিবন্ধ অন্তত তেমনধারা অ্যানেকডোটাল হইতেও চাইছে না। আরেকটা কথা, খানিক অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করে রাখা যাক, বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে এই ইতিহাসাংশ অবগত হবার অব্যবহিত কিয়ৎকালের মধ্যে এই নিবন্ধকারের আপিশের আবশ্যক বইসূত্র খুঁজতে যেয়ে একটা আর্কাইভে বেশকিছু পুরনো সাময়িকপত্র উল্টেপুল্টে দেখার সময় শিল্পতরু (সম্পাদক : আব্দুল মান্নান সৈয়দ) পত্রিকার পুরনো একটা খণ্ডে এ-সংক্রান্ত গোটা একটা রচনা নজরে আসে, যেখানে জনৈক লেখক স্বয়ং বুদ্ধসাক্ষাতের বরাত দিয়ে এহেন অভিযোগ খণ্ডাতে চেয়েছেন এবং পুরো ওই রচনার পজিটিভ পরিমার্গ তথা তার আউটল্যুক অ্যামেচারিশ হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট মননগ্রাহ্য মনে হয়েছিল। তবে এখানে এইটুকু উল্লেখই আপাতত করা হলো, পরে কখনো হয়তো-বা আলাপ জোড়া যাইতে পারে এ-তাবতীয় কয়েক কৌণিক উতর-চাপান একত্র করে।
একাধারে সম্পাদনা করে গেছেন, একাগ্র অভিনিবেশে, একবিংশ সংখ্যার-পর-সংখ্যা। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মননবিশ্ব পরিব্রাজনের নিমিত্তে যে-কেউ তাঁর সম্পাদিত প্রায় তিরিশটি খণ্ডের একবিংশসড়কে একচক্কর ঘুরে আসতে পারেন। যদিও খোন্দকারের স্বপ্রণীত গ্রন্থজগৎ সমৃদ্ধ অনেক, মূলত অনুবাদ ও বাকবিভূতিবিদগ্ধ মৌলিক প্রবন্ধচয়নিকার সমাহারে সেই পৃথিবী সৃজিত, রয়েছে তাঁর কবিতার কোমল বইগুলো। ফোকাস করি আপাতত খোন্দকারকৃত সম্পাদনাকাজগুলোতে, কেননা বাংলাদেশের সাহিত্যাঞ্চলে পত্রিকা-সম্পাদনার ভেতর দিয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব চারিয়ে দেয়ার উদাহরণ অতীব অল্প, খোন্দকার সেই কড়ে-গণনীয়দের মধ্যে একজন। পত্রিকার নিয়মিত আয়োজনে সাহিত্যতত্ত্ব নজরকাড়া জায়গা জুড়ে তো থাকতই, কিন্তু এর বাইরেও ঝোঁক প্রকাশ পেত কয়েকটা এলাকায়, যেমন টেরি ইগল্টনের সাহিত্যতত্ত্ব : পরিচয় স্বীয় হস্তে ট্র্যান্সলেইট ও ধারাবাহিক প্রকাশের কথা প্রাগুক্ত ইতোমধ্যে, এছাড়া নানাভাবেই নানান প্রাবন্ধিককে দিয়ে লেখায়ে নিয়েছেন লিট্যারারি থিয়োরি বিষয়ে, তর্জমা করিয়ে ছেপেছেন, পড়েছি আমরা, প্রারম্ভিকা পাঠবস্তু হিশেবে সেইসব রচনাপত্তর প্রভূত উপকারে এসেছে পরবর্তীজীবনে আমাদের যাবতীয় পড়াপড়িকাজে, যেমন এডোয়ার্ড সাইদ ও অরিয়েন্টালিজম, মিশেল ফ্যুকো ও ফ্যুকোদর্শনে প্রতিবিম্বিত মানব, অবিনির্মাণবাদ ও জ্যাক দেরিদা, ফ্রেড্রিক জেইমসন, আধুনিকবাদ, উত্তরোপনিবেশবাদী পাঠ ও পঠনতত্ত্ব ইত্যাদি। বিশাল কলেবরে ক্রোড়পত্র করেছেন, পঞ্চপাণ্ডব হিশেবে মশহুর তিরিশি পাঁচজনাকে নিয়ে তো অবশ্যই, এর বাইরে নজরুল উপজীবক স্রোতবিরুদ্ধ পুনর্বিবেচন ও নবমুল্যাঙ্কন, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক নতুন পাঠচেষ্টা ও ভিন্নতাবাহী বীক্ষণ-পুনরীক্ষণের উদযোগ, এবং উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিশেবে একটা আয়োজন করেছেন অকালপ্রয়াত অবাক আবেগানুভবাতুর কবি আবুল হাসান বিষয়ে ক্রোড়পত্র সবিশেষ।
খোন্দকারের একবিংশ গৌরচন্দ্রিকাগুলো থেকে কয়েকটা ভাষ্যাংশ চোখ বুলায়ে দেখা যাক, সহজে এবং অনায়াসে একটা আন্দাজ করা যাবে তাঁর বীক্ষণ-বিবেচন তথা তাঁর গদ্যসংঘট্ট ও গদ্যচাল সম্পর্কে, অল্পায়াসে স্মরণ করা যাবে খোন্দকারের নিচুলয়-মিতবাক তথাচ শ্রবণাকর্ষী স্বর। অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রয়াণের অব্যবহিত পর খোন্দকারের সম্পাদকীয় ভাষ্য : “অ্যালেন গিন্সবার্গ ষাটের দশকের তুমুল কবি, বীট-পুরোধা, আমেরিকার মতো পুঁজিবাদী দেশে বিলাস-বৈভবের যে বিকার তারই পঙ্কে ফোটা পঙ্কজ,প্রতিবাদী কবি। … গিন্সবার্গ মহৎ কবি নন হয়তো, (মহৎ কবির সংজ্ঞাও সুস্থির নয়) তবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কবি আমেরিকার প্রেক্ষিতে। ওয়াল্ট হুইটম্যানের পরে গিন্সবার্গের মতো অকপট উৎসারণে স্বভূমিকে নিয়ে আর কেউ কবিতা লিখেননি। গিন্সবার্গের আমেরিকা-ফিক্সেশন তাঁর মাদার-ফিক্সেশনের মতোই প্রবল … বস্তুত গিন্সবার্গ এজন্যেই তাঁর সমকালীন কনফেশন্যাল কবিদের মধ্যে থেকেও কনফেশন্যাল কবি নন। তিনি প্রবলভাবে বহির্মুখী; উইলিয়াম ব্লেকের মতো নগরনরক পরিব্রাজক … বিশশতকের অহংকারী শক্তিমদমত্ত আমেরিকাকে ভেতর থেকে বিদ্রুপ করার প্রেষণা ছিল এই সমকামী ইহুদী কবির; যদিও আমেরিকা সানন্দেই এরকম দশ-বিশটা গিন্সবার্গকে পুষতে পারে, পিঠচাপড়ানি দিয়ে, পুরস্কৃত করে সভ্য-ভব্য অ্যাকাডেমিতে স্থানও দিতে পারে অক্লেশে। গিন্সবার্গের বিদ্রোহও, হায়, নিজেকেই লুপ্ত করেছে সচ্ছ্বল জীবন ও হাততালির কলরোলের মধ্যে। তবু তিনি ভবিষ্যতে স্মৃত হবেন, হয়তো উল্লেখযোগ্য মার্কিনী কবি ও আরেকজন ব্যর্থ কারেজ-টিচার হিশেবে।” — (একবিংশ ১৭, জুলাই ১৯৯৭)। অরুণ বয়সে অকাল প্রস্থানের পুরো দুই যুগ পর রোম্যান্তিক অবক্ষয়চেতনার কোমলার্দ্র সুস্মিতকণ্ঠ কবি আবুল হাসান খোন্দকারভাষ্যে স্মৃত হচ্ছেন এইভাবে : “বাংলা কবিতায় তাঁর স্থানটি ইতোমধ্যে সুচিহ্নিত হয়ে গেছে। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির অনেক অচিকিৎস্য আবেগ তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়েছিল। আজকের মুখস্ত মানুষের ভিড়ে সেই স্বপ্নাতুর, বেদনা-বিষণ্ন তরুণের মুখটি আর দেখি না, বাংলা কবিতার চৌমহলা ঘরে যিনি যুক্ত করেছিলেন একটি ব্যক্তিগত ঝুলবারান্দা, যেখানে দাঁড়িয়ে মৃত্যুসাগরের ঢেউ দেখা যায়। অসুখ আর আসন্ন মৃত্যুর বোধ আর কোনো বাঙালি কবির চেতনায় এত হৃদয়দ্রাবী রূপে দেখা দেয়নি, না, রবীন্দ্রনাথেও নয়, জীবনানন্দেও না।” — (একবিংশ ১৮, মার্চ ১৯৯৯)। বাংলা কবিতার দুই যুগন্ধর নজরুল-জীবনানন্দ যুগ্মায়নপূর্বক খোন্দকারের স্মরণ-মূল্যাঙ্কনায়োজনের কিঞ্চিতাংশ : “তিরিশি বাংলা কবিতা পশ্চিমে জাত আধুনিকবাদকে নমস্য ভেবেছিল। জীবনানন্দ দাশ আধুনিকবাদী কবিতা-ঘরানার মধ্যে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর অবস্থানটি চিরকালই রয়ে গিয়েছে কিছুটা কৌণিক; আধুনিকবাদী চিন্তাপ্রপঞ্চকে গ্রাস করেও তার সাথে কিঞ্চিৎ অসঙ্গত ও অনিরাকৃত। ঊনিশশতকীয় যে-রোম্যান্টিসিজমের রূপান্তরমূলক সঞ্জনন ঘটেছে মডার্নিজমের মধ্যে তারই কৌণ-পাথরকে চেতনায় সযত্নে লালন করেছেন জীবনানন্দ। কলকাতার ট্রামলাইনের আদিম সর্পিনী সহোদরার চিত্রকল্পের পাশাপাশি রূপসী বাংলার কলমিদাম ও আকন্দধুন্ধুলের ঘ্রাণে মজ্জমান হওয়া শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। # এই তিরিশি মডার্নিজমের মেঘই ছায়াচ্ছন্ন করেছে নজরুল ইসলামকে। বিশের দশকে বাংলা কবিতায় তাঁর তুমুল উত্থান রোম্যান্টিক চেতনার সহর্ষ সহস্র নির্ঘোষে, পশ্চিমে সে-চেতনার ততদিনে বারোটা বেজেছে। অনতিকালের মধ্যে নজরুল হয়ে পড়েন অ্যানাক্রোনিজম, যে-কারণে জীবনানন্দ (যে-জীবনানন্দ ঝরাপালকে নজরুলীয় রোম্যান্টিকতার পরহেজগার ছিলেন) বলেছেন, ‘নজরুল ঊনবিংশ শতকের ইতিহাসপ্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি’। আজ এই একুশ শতকের প্রথম প্রহরে যখন মডার্নিজমের আক্ষেপ শমিত ও দমিত, উত্তরাধুনিকবাদ যখন মেঘকুয়াশা সরিয়ে অপসৃত-অস্মৃতদের মুখের রেখা দেখতে চাইছে — আধুনিকবাদ যা-যা এড়িয়ে-মাড়িয়ে গেছে, ধুলো ঝেড়ে তুলে নিতে চাইছে পুনর্বার — নজরুলে ফেরার সময় ঘনিয়ে এসেছে মনে হয়। একসময় জীবনের প্রতি বিশ্বস্ততা, রাজনীতি-সমাজচিন্তার প্রতিফলন কবিতায় ব্রাত্য ভাবতেন আধুনিকবাদীরা। কে জানে কালচঙ্ক্রমণ সেই ইতিবাচকতা, সেই শিরা-শোণিতের সংক্ষোভ তথা নজরুলীয় চিৎপ্রবণতাকে কবিতায় পুনর্যোজিত করে কী না।” — (একবিংশ ১৯, অগাস্ট ২০০০)। খোন্দকারের অবলোকনে অমিয় চক্রবর্তী কীভাবে ধরা পড়ছেন, দেখা যাক : “বাংলা আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রধান পুরুষ অমিয় চক্রবর্তী; তাঁকে তিরিশি পঞ্চপাণ্ডবের একজনও বলা হয় ঈষৎ লীলাচ্ছলে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তিনি নিজের গুণে, তাঁর পাণ্ডব-ভ্রাতাগণের প্রতিফলিত গৌরবরশ্মির কারণে নয়। অমিয় চক্রবর্তী দর্শনীয়ভাবে আলাদা; তাঁর ভাষা ও আঙ্গিক, আস্তিক্য, বাউলিয়ানা ও নিরাসক্ত ঔৎসুক্য নিয়ে তাঁর সমগ্র জীবনবেদ, তাঁকে আলাদা করেছে আর সবার থেকে। … রবীন্দ্রস্নেহধন্য এই কবিকে অনেকে রবীন্দ্রানুসারী বলে চিহ্নিত করে ঠেলে দিতে চান ঊনিশশতকীয় বর্জ্যবাক্সে; প্রবাসী ছিলেন বলে মিডিয়ায়-রাজত্বকারী সমকালীনরা তাঁর চিরনির্বাসন নিশ্চিত করতেও নিশ্চেষ্ট থাকেনি। তাঁর কবিতায় রবীন্দ্রানুগত্য নেই, রবীন্দ্রদ্রোহও নেই উচ্চকিত বুদ্ধদেবীয় ঢঙে — আছে নিষ্কম্প বিশ্বাসে জীবনের অস্তিবোধ, মঙ্গলময়তা ও শুভত্বকে লালন করবার অভিকাঙ্ক্ষা, যা তাঁকে রবীন্দ্রচেতনার সমীপবর্তী করেছে। কিন্তু ব্যাপারটি শুধুই দার্শনিক জীবনবীক্ষার ঐক্য; কবিতার করণকৌশলে, তাকিয়ে দেখার সকৌতুক ভঙ্গিতে, তিনি আলাদা। সহজ নিরাভরণ গদ্যের মধ্যে কাব্যের ঝঙ্কার মিশিয়ে এমন একটি কাব্যকলা নির্মাণ করেছেন তিনি, যাকে মনে হবে আর্টলেস্ আর্ট । বিশ্বভ্রামণিকতায় অমিয় চক্রবর্তী প্রথম নন; কিন্তু তিনিই প্রথম বিশ্ব থেকে গৃহাভিমুখযাত্রার পথ দেখিয়েছেন।” — (একবিংশ ২০, মার্চ ২০০১)। খোন্দকারের সুধীন্দ্রনাথ-মূল্যাঙ্কন এমন : “আধুনিকবাদী বাংলা কবিতার অন্যতম স্থপতি সুধীন্দ্রনাথ তাঁর কালেও ছিলেন দুষ্পাঠ্য, সাধারণের জন্য অপ্রবেশ্য; কুখ্যাতভাবে এলিটিস্ট ও উচ্চম্মন্য; নিজের ধী সম্পর্কে অতিপ্রত্যয়ী; আড্ডায় একক বক্তা, আশ্চর্য বাকবিভূতিসম্পন্ন মানুষ; কবিতায় ক্লাসিক শৈলীর অনুসারী, শব্দব্যবহারে অভিনূতন, শব্দসৃজনে কলম্বাস। তাঁর কবিতা বহুমাত্রিক নয়; তা শব্দস্তনিত, গম্ভীর, উদাত্ত ও ঝঙ্কৃত। প্রেমকেই করেছেন অন্বিষ্ট; ব্যক্তিগত প্রেমের রোম্যান্টিক বিক্ষেপই ক্লাসিকতার দৃঢ় বন্ধনকেও ফাটিয়ে দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে নানা স্বরে; আবার নানা স্বর মিলে গড়ে তুলেছে ঐকতানের অর্কেস্ট্রা।” — (একবিংশ ২১, মে ২০০২)। এবং বুদ্ধদেব (নিজেই তিনি, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু বিষয়ে একবাক্যে তাঁর নির্দ্বৈধ অবস্থানের কথাটা প্রারম্ভেই ) : “বিশেষত কবিতায় আধুনিকবাদের আবাহনকারী ভগীরথের বুদ্ধদেব বসু। (আধুনিকতার নয় অবশ্য, আধুনিকতা অনেক বিশদ এক আলখেল্লা যা জীবনের সবকিছুকে ধারণ করে, এবং বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার আবাহনকারীর গৌরব প্রাপ্য রবীন্দ্রনাথের, কিংবা তারও আগে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের।) … তিনি রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান দিকপাল। সাহিত্যসম্রাট অভিধাটি আদিখ্যেতার মতো না-শোনালে বুদ্ধদেবের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেত নিঃসন্দেহে, কেননা কে আর এত বিচিত্রমুখী ও বিচিত্রবর্ণিল রচনাসম্ভারে বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে রবীন্দ্রনাথের পর? তাঁর সীমাবদ্ধতাও ছিল কিছু, থাকাটা স্বাভাবিক, ভক্তির আতিশয্যহেতু সে-বিষয়ে নীরব থাকাটাও কাজের কথা নয় … ।” — (একবিংশ ২৪, ফেব্রুয়ারি ২০০৯)। এক-নজরে এ-ই হলো সম্পাদক খোন্দকারের মাননিক বিবেচনাবোধ ও পূর্বজ কবিদের স্বীকৃতিদান তথা আত্তীকরণপরিচয়। এখানে বিষ্ণু দে কিংবা সমর সেন সম্পর্কে তাঁর মূল্যাঙ্কন হাজির করা যায় নাই, নিবন্ধকারের নাগালে একবিংশ কুল্লে এই-কয়টি সংখ্যাই বর্তমান বিধায়।
খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতা নিয়ে এখানে কথা চালানো অনিবার্য কারণে সম্ভব হচ্ছে না, কারণ সময়াভাব নয় যতটা সংগতিরিক্ততা বা সাধ্যশূন্যতা। কবিতালাপ করার জন্য কম্পিটেন্ট অপর কোনো কবিই কেবল, এই নিবন্ধকারের ন্যায় স্রেফ কবিতাপাঠক তো অবশ্যই ডিসকোয়ালেফায়েড এক্ষেত্রে, এমনকি যিনি লাইসেন্সড কবি নন, রেগ্যুলার কবিতানুশীলক নন যিনি, তেমনতর কবিতাক্রিটিকও যোগ্যতা রাখেন না কবিতালোচনার। কাজেই এ-বাবতে অলমিতি বিস্তরেণ বাঞ্ছনীয় ও শ্রেয় মনে হয়। কেবল খুচরো দুইয়েক কথা আপাতত বলা যেতে পারে, একদম উম্মি কবিতাপাঠক হিশেবে, খোন্দকারের কবিতা আমাদের সময়ের বন্ধুদের কারো কাছেই তেমন হৃদয়গ্রাহ্য মনে হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতে হবে, কে জানে। কেউ যদি সতর্ক ও সর্বভূক কবিতাপাঠক হন, তখন তার পক্ষে এইটা কবুল করা সহজ হবে যে খোন্দকার কবিতা লিখেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং সযত্ন প্রশিক্ষায় সেই কবিতারাজ্য গড়ে উঠেছে তিল তিল করে। সেখানে কবিতার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ও মণিমুক্তো ছড়ানো অজস্র, নিশ্চয়ই, কিন্তু তবুও কোথাও অভাব তো রয়েই যায় যে-কারণে কবিতা অমীমাংসিতা রাহসিক অধরা নামেই মশহুর ভুবনময়। এইটা ঠিক যে, স্ট্যান্ডার্ড কবিতাই লিখেছেন খোন্দকার, অ্যাভারেজের চেয়ে যে-কোনো তুল্যদণ্ডে সেইসব কবিতা উঁচুতে রাখার মতন, এলিয়ট কথিত ট্র্যাডিশন এন্ড্ ইন্ডিভিজ্যুয়্যাল ট্যালেন্ট দুর্নিরীক্ষ্য নয় সেখানে, শেইমাস্ হিনির কবিতায় যেমন সুস্মিত নিসর্গ — খোন্দকারের কবিতাতেও অনুরূপ প্রকৃতিনিসর্গ সুলভ, নিখুঁত উপমাচিত্রকল্প বুননের ব্যাপারটা তাঁর মধ্যে আগাগোড়া লক্ষণীয়, রয়েছে দেখার তীর্যকতা, নান্দনিক বয়ানকৌশল ইত্যাদি কিছুরই কমতি নেই সেখানে। এতকিছুর পরও তাঁর আঙ্গিক, তাঁর প্রকরণ, তাঁর কয়েনেইজ, তাঁর ডিকশন, তাঁর কবিতাগাঁথুনি এবং সর্বোপরি তাঁর কবিতায় একটা বর্ণনাত্মক শৈলী ইত্যাকার সমস্তকিছুই কেমন-যেন অনেকটা রাহমানীয়। মনে পড়বে আমাদের যে, খোন্দকার তাঁর কবিতাযাত্রা শুরু করেছিলেন রাহমান-অধ্যুষিত কবিতাচাতালের ভরা-ও-জমজমাট মজমা থেকেই। বিভিন্ন পর্বান্তরে তাঁর কবিতা নানা মাত্রা, নানাবর্ণা পালক ও রঙ যুক্ত করে নিয়েছে বটে, কিন্তু ঘুরেফিরে সেই শুরুকালীন ইম্প্রেশন থেকে বের হতে পারেনি সেভাবে। যে-কারণে ‘পার্থ তোমার তীব্র তির’, ‘সুন্দরী ও ঘৃণার ঘুঙুর’, ‘তিন রমণীর ক্বাসিদা’, ‘তোমার নামে বৃষ্টি নামে’, ‘আয়(না) দেখে অন্ধ মানুষ’, ‘যৌবনবাউল’, ‘যমুনাপর্ব’, ‘কুয়াশায় মুশায়েরা’ প্রভৃতি একের-পর-এক কবিতাগ্রন্থে অনেকানেক নিটোল ও নন্দনোত্তীর্ণ কবিতা উপহার দিয়েও খোন্দকারের কবিতা তাঁর সময়ের তরুণতর কবিদের হৃদয়গ্রাহ্য হয়নি। যেইটা মনে হয় যে, একজন কবি তার উত্তরসূরী কবিসমাজে আলাদাভাবে অবলোকন-ও-অবধারণযোগ্য হয়ে ওঠেন, প্রভাব-অভিঘাতবিস্তারী হয়ে ওঠেন তখনই, যখন তিনি তার সময়ের ভঙ্গিটাকে, সময়ের ভঙ্গিগুলোকে, সময়বিভঙ্গিসমূহ আত্মসাৎ করে নিয়ে ফের সময়কে একটা অভিনব ভঙ্গি ফিরিয়ে দেন। খোন্দকার এই ব্যাপারটা দাগ-রাখার মতো করে সেভাবে পারেননি করতে। এতদসঙ্গে এও অনস্বীকার্য যে, তিনি তাঁর উন্মেষপর্বে আবির্ভূত অপরাপর সহপথিক কবিদের তুলনায় এগোনো, অগ্রসর কবিপ্রতিভা, রাহমানস্বরচ্ছাপ সত্ত্বেও ওই সময়ের অন্য যে-কোনো কবির চেয়ে বেশি শিল্পসুষম ও সহনীয়, কবি হিশেবে তাঁর অরিজিন্যালিটি প্রায় প্রশ্নাতীত। কবিতাপাঠের ক্ষেত্রে যদি স্বতঃস্ফূর্ত স্বরপ্রবাহ ও পঠনস্বাদুতা ধর্তব্য হয়, তো খোন্দকারের কবিতাবিভূতি নিঃসঙ্কোচ প্রশংসাযোগ্যা। আর-যা-ই-হোক, সমসাময়িক কবিদের মতো খোন্দকার অন্ধ-ও-অবিবেচনাবাহিত রাহমানানুকার নন। ওই সময়টায়, বাংলাদেশের কবিতায় রাহমান পত্তনি ও প্রতিষ্ঠার পর, তিন-দশকেরও অধিক কাল চলেছে বেদম রাহমানানুসৃতি। ঠিক এই পটভূমিতে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের উন্মেষ ও যাবতীয় বিকাশ। অর্জন কম নয়, কাজেই, সে-অর্থে। একটা আক্ষেপ, অন্তিম একটা খেদ, রয়েই গেল পাঠক হিশেবে আমাদের, সেইটা এ-ই যে, শেষ-বছরে এসে খোন্দকার আশ্চর্য অন্যরকম একজোড়া ইংরেজি বহুলাবৃত্ত কবিতার অনুবাদ — অনুসৃজনই আসলে — করে উঠেছেন, একটা রবার্ট ফ্রস্টের এবং অন্যটা টিএস্ এলিয়টের। খোন্দকার কবিতানুবাদে বরাবরই সিদ্ধহস্ত ও সফল, টেড হিউয়েজ বা সেলান ও শেইমাস্ হিনি ছাড়াও অজস্র অন্যান্য কবিতানুবাদনে সেই দৃষ্টান্ত মজুদ রয়েছে। যেমন আধুনিকবাদ বিষয়ক সুদীর্ঘ রচনাটা প্রণয়নকালীন তিনি দুইহাতে তর্জমা করে নিয়েছেন ইংরেজি ও ফরাসী সমস্ত ইনফ্লুয়েনশিয়্যাল মডার্নিস্টদের কবিতাকাজ, উদাহরণ দর্শানোর প্রয়োজনে। সেগুলো সবই তাকিয়ে দেখার মতো, তারিয়ে তারিয়ে চাখার মতো। তবু প্রোক্ত দুই বিশেষ অনুবাদনকর্ম খোন্দকারকে ফের অবলোকনকেন্দ্রে নিয়ে আসার মতো গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যবহ পুরানা ঢাকার ডায়ালেক্ট কবিতায় ব্যবহারের এমন নজির এর আগে একটিই সাকুল্যে, সম্ভবত, সেইটা শামসুর রাহমানের এই মাতোয়ালা রাইত । আক্ষেপ এ-ই যে, বেঁচে থাকলে এইধারা কাজ খোন্দকারের ঝুলি থেকে বেরোত আরও।
তিনি ছিলেন, বিশ্বকবিতার সোনালি শস্য তুলে দিয়েছিলেন আমাদের হাতে, এখন নেই আর। তিনি ছিলেন, অন্তরঙ্গ অবলোকন করিয়েছিলেন আমার মতো অনেককেই বাংলা কবিতার দিকে, এখন নেই আর। তিনি হৃদিবিভ্রাটে পড়ে নিজের ছায়াটা গুটিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছেন কীর্তিনাশার দিকে। বেহুলার ফেলে-যাওয়া ভেলায় চেপে বেহুলারই কাছে? একটা কাব্যসঙ্কলন করেছিলেন নিজের, অ্যান্থোলোজি নিজের কবিতার ইংরেজি ভাষান্তরের, নাম রেখেছিলেন অন বেহুলা’স র্র্যাফ্ট । অ্যাকাডেমিতে খুব যশস্বী ছিলেন, ইংরেজি পড়িয়েছেন জীবনভর বিশ্ববিদ্যালয়ে, অ্যাকাডেমিয়ার রামরেখা-লক্ষণরেখা মান্যিগণ্যি করে গেলে আরও যশ হতো ওই লাইনে। কিন্তু তরুণ কবিদের যত্নআত্তি করে বিস্তর অপমান সয়েছেন, অনুমান করি সংগত কারণে, তবু অবসর নেননি পত্রিকা প্রকাশের স্বেচ্ছাবৃত্তি থেকে শেষবছর পর্যন্তও। বর্তমানকালের কবি হলে তো ‘ফিল্ডওয়ার্ক’ করে সেরে কবেই স্টেজে উঠে উদাসনয়ন মুস্কুরাইতেন। তা তিনি করেননি, কেন যে! সে-যা-হোক, বড় উদাত্ত ছিলেন তরুণদের লেখা ছাপাতে, মুক্তহস্তে লেখা চাইতেন শর্তারোপনবিহীন, শুনেছি আমি, আমার বন্ধুদের অনেকেই খুব ভালো কবি এবং তাদের কবিতা খোন্দকার সযত্ন প্রকাশ করেছেন তাঁর পত্রিকায়, লেখক হলে আমিও লিখতে পারতাম সেখানটায়, — এতটাই উদার ও লিখনমগ্ন ছিলেন তিনি, বিভিন্ন সময়ে বন্ধুদের মুখে শুনেছি তাঁর পত্রিকান্তপ্রাণ উদ্যম ও সৃজনাবেগের গল্প।
অপ্রিয় ও অস্বস্তিকর একটা প্রসঙ্গ নিবন্ধ শেষ করার আগে, সেইভাবে উল্লেখযোগ্যতা নাই যদিও এইসব কীটাণুকীট অপপ্রসঙ্গের, শেয়ার দেয়া যাক। খোন্দকারপ্রস্থানের অব্যবহিত পরে ফেসবুক প্রভৃতি মাধ্যমবাহিত হয়ে এই হা-হতোস্মি কীর্তিটা আপনারও নজরে ঠেকতে পারে। একটা বিতর্ক উঠেছিল প্রয়াত কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, কিংবা তাঁর অন্ত্যেষ্টি-উত্তর শোকায়োজন ও শ্রদ্ধাতর্পণানুষ্ঠানে, চিরদিন-কবিতা-লিখে-দুনিয়ান্তরিত কবির অনুজপ্রতীম কবিবন্ধুরা শামিল হবেন কি না এই মর্মে। বেশ থিয়োরাইজ করে কেউ কেউ, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অনেকেই, মুর্দা লাশের প্রতি ঘৃণা ও জীবিতকালীন বিদ্বেষ জিইয়ে রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। ঘটনার বিস্তারিত কোনো ক্ল্যু বোঝা না-গেলেও সম্যক এইটা আঁচ করা যায় যে, খোন্দকারের সঙ্গে তাঁর হাঁটুবয়সী কবিদের চেতনাবাহাস অথবা হয়তো অন্য কোনো অমার্জনীয় গুরুতর অপরাধজনিত কারণ জড়িত, হয়তো-বা আওয়ামী-অনাওয়ামীপ্রীতিভক্তি প্রদর্শনে খোদ প্রয়াত কবিই ঊনিশ-বিশ ঘটিয়েছেন কোনো, হয়তো অন্য অমোচনীয় গুস্তাকি কোনো, খণ্ডানোর কোনো উপায়ও তো খোন্দকারের নাই, তিনি তো ততক্ষণে পগারের পার তথা কীর্তিনাশা, কাজেই বিরোধ-গোস্বা-ঘেন্না থাকুক অটুট, অন্ত্যেষ্টিকীর্তি হোক বয়কট — হইল সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সম্প্রচার। এতদিনে বোঝা গেল সত্যি সত্যি বাংলা সাহিত্য বাঁক পরিবর্তন করেছে এবং উহা ব্র্যাভো বলবার মতো বটে। এনিওয়ে। আপত্তির কিছু তো নাই এতে, কেননা প্রাচ্যীয় আদব খেলাপ না-করে বাংলা কবিতা জাতে উঠবে না, অান্তর্জাতীয় ও বৈশ্বিক হবেনাকো যথেষ্ট পরিমাণে — এ-ই হয়তো প্রতীতি আমাদিগের সম্বচ্ছর-বই-বিয়োনো চন্দ্রসূর্য কবিদের। আমরাও নিশ্চয় চাই হিংসা চিরজীবী হউক, কাকমাংশ কাউয়ায় খাউক, কবিতা জাতে উঠুক! কবিতার জাত-বেজাত পরে নির্ধারণ করবেন, জনাব, আগে নিজের গোরের জন্য মাটিটুকু পরখিয়া নিন ভালোমতো, ওইখানে তো রিডিক্যুলাস্ অহিংসা ছাড়া নাহিকো কুচ্ ঔর! তো, কেমনে কী! ওরে, তোরা যা প্রচারিয়া যার-যা ইচ্ছা বাঙ্গালা কবিতায়, কেবল করিনু মুই এই-না প্রার্থনা : আমার সন্ততি যেন রহে অহিংসা আর মরমিয়া ভালোবাসায়।
শেষপ্যারার আগের প্যারা, সম্ভবত, এইটা। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ প্রয়াণোত্তর খোন্দকার শোকানুচ্ছেদ রচেছিলেন একবিংশ সম্পাদকীয়-পরিসরে, সেখান থেকে শেষবারের মতো উদ্ধৃতি টুকছি : “তিনি ছিলেন আমাদের অগ্রজ কবিদের একজন। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে তাঁর কবিতা বিখ্যাত হয়ে আছে। ছাত্রজীবনে ছিলেন তুখোড়, সরকারি আমলা হিশেবে সফল, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক দায়িত্ব পালন করেছেন সাফল্যের সাথে। কবিতা ও ছড়ায় তাঁর উপস্থিতি ছিল, কিন্তু উপেক্ষিতই ছিলেন বরাবর। আশির দশকের মাঝামাঝি হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো বেরোয় তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ : ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি ‘ ও ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’, পাল্টে যায় বাংলাদেশের কবিতার মানচিত্রটি অনেকটাই। দর্পিত এই প্রত্যাবর্তন তাঁর, কিয়ৎকালের জন্য। তারপর আবার দীর্ঘ নীরবতা। ততদিনে তাঁর ঠাঁই অনেকটাই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। মৃত্যুর অব্যবহিত আগে কিছু তরুণ কবিতাকর্মীর নিহৃদয় আচরণ তাঁকে মর্মাহত করেছিল শোনা যায়। অনতিকাল পরেই স্ট্রোকে অজ্ঞান হয়ে যান। আর জ্ঞান ফিরে আসেনি বৎসরাধিককাল। অতঃপর তাঁর দেহাবসান। আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানাই। সংকীর্ণ রাজনীতি ও কালের কলহের পরপারে তাঁর নাম অবিনশ্বর থাকবে — যতটা অনশ্বরতা সম্ভব, আপেক্ষিকতার পরিধিতে এই কালসন্ধ্যায়।” — এই কথাগুলো খোন্দকার নিজে লিখে না-গেলে এখন আমরা তাঁর টোম্বস্টোনে রাখার জন্য তাঁকে অ্যাড্রেস্ করে একই-ও-অভিন্ন কথাগুলোই লিখতাম। এই নিবন্ধের শেষ পারানির কড়িটাও খোদ খোন্দকারই যোগাইলেন।
কবির মৃত্যু তিনভাবে হতে পারে শ্রেয় ও কবির কাঙ্ক্ষিত : এক, ফুলের আঘাতে; দুই, হৃদজটিলতায়; এবং তিন, বুলেটবিদীর্ণ বক্ষে। প্রথমোক্তভাবে মৃত্যু পেয়েছিলেন রাইনার মারিয়া রিল্কে, আমরা জানি। তৃতীয় ধরনে একটা কাল পর্যন্ত আততায়িত হয়েছেন অসংখ্য কবি। জীবনের সমান তীব্র চুমুক নিয়ে আমাদের কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন দ্বিতীয়োক্তভাবে আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। কিন্তু তাঁর আত্মা আমরা পাচ্ছি চিরকাল তাঁর কবিতায়, আত্মার শাঁস ও সুবাসিত নির্যাস তো কবিতাই, তাই না? এখন তাঁকে অ্যাওয়ার্ড গছিয়ে মরণোত্তর ক্ষেপিয়ে না-তুললেই হলো। ঘুমোতে দেই আমরা তাঁকে, জেগে উঠবেন তিনি তখনই যখন আমরা কবিতা পড়তে শুরু করব তাঁর। কবিতার প্রকৃত উদয় হয় দৃশ্যপট হইতে কবির অন্তর্ধানের পর, কবিতা পড়ার প্রহরেই কবির জন্ম ও মৌহূর্তিক অমরত্ব, কবির পুনরুত্থান বস্তুত তার প্রস্থানোত্তর।