শিল্পসফলতা, কারুবাসনা ও শিল্পীর প্রস্থান । জাহেদ আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ মে ২০১৪, ৪:২৮ অপরাহ্ণ, | ৬৬৬৭ বার পঠিত
কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে …
জোর বৃষ্টি ঝরছিল সেদিন সাতসকালের শহরে। তুমুল কালোমেঘে-ছেয়ে-থাকা আকাশের তলে মেঘচুম্বী বহুতলগুলো ভিজছিল বেশুমার বাকহীন বেদনাবিলীন। উপচানো সুরমাশরীরে মুখ নুয়ে রয়েছিল তীরবর্তী বিরিখের গাল-গ্রীবা-চুল। এই বিষণ্ন মধুবন্ত বৃষ্টির শহর, এই কড়া-লিকার চা আর ছায়াগাছ ও রৌদ্রপরিবাহী টিলার শহর প্রিয়বেসে তুলি-কালি-ক্যানভাসে তুলতেন তেল-জল রঙের দ্যোতনা যিনি, সেদিন এমন ছোপছোপ মেঘমন্দ্র শহরের পিচপথে বৃষ্টির-ভাপ-ওঠা সোঁদাগন্ধ দিনে — দিবারম্ভের আগে-আগে — নিয়েছেন তিনি তার শেষের নিঃশ্বাস। ঊনতিরিশ মে দু-হাজার-ছয় যিশুবর্ষে শাহ্ আলম মারা যাবার পর প্রকৃতিনিয়মে একে একে এতগুলি দীর্ঘ বছর গেছে পেরিয়ে। এ-শহরের রঙ-রেখাপ্রিয় প্রতিটি মানুষের মনে ভেসে ওঠে থেকে-থেকে এখনও, মনে বেজে ওঠে এখনও, সন্তস্বভাব চুপচাপ-হাসিমাখা আলমের শান্তসৌম্য মায়ার মুরতি — ‘বড় বেদনার মতো’ বেজে-ওঠা আলমের অনুপস্থিতি।
এমন নয় যে চিত্রবোদ্ধাদের চটজলদি চমৎকৃতকরণের অনেক-অঢেল রসদ রেখে গিয়েছেন আলম, এমন নয় যে রেখায়-রঙে-রূপে-রঞ্জনে নিজের একটাকিছু স্বতন্ত্র স্বাক্ষর রেখে যেতে পেরেছেন তিনি, এমনও নয় যে মৃত্যুপরবর্তী আলমের আঁক-অভিনবতা আবিষ্কারে আগডুমবাগডুম আদিখ্যেতা দেখালে আলম আচমকাই বড় ও বরণীয় হয়ে উঠবেন। না, এমন নয়। বস্তুত এমনটা বললেই বরং অধিকতর সত্য শোনায় যে, অঙ্কুরোদ্গমের পর গাছের কাণ্ড পুষ্ট হলো, দেখতে দেখতে ছেয়ে গেল পরিপ্লুত পাতাপত্রালিতে এবং কাছ-দিয়ে-হেঁটে-যাওয়া কতিপয়েরে দিলো গ্রীষ্মগুমটে ছায়া ও বাতাস, কেবল পেল না সে তার আপনকার ফলটুকু ফলাবার সন্তুষ্টি ও সুযোগ। হায়! মানুষেরা যাকে বলে অমোঘ বিধান, বলে অন্তিম শয়ান, সেই মৃত্যু এসে নিয়ে গেছে তারে অন্যদেশে অন্য পারাবারে — উপাড়ি নিয়াছে আহা গৌতমবুদ্ধের ন্যায় ধ্যানমৌন ফুল-ফুটি-ফুটি গাছটিরে!
অল্পদিনেই আলম অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছিলেন ছোট্ট এ-শহরের শিল্পিত সকল কর্মকাণ্ডে। আলমকে আমরা পেয়েছি আমাদের সারস্বত সমস্ত আয়োজনের নেপথ্যে — নিভৃত নায়ক ও নিষ্ঠ কর্মীর বিনীত ভূমিকায় — পুস্তকপত্রিকার প্রচ্ছদে-পৃষ্ঠালঙ্করণে, কীর্তিমানের নিখুঁত-নিপুণ প্রতিকৃতি অঙ্কনে, উৎসবপোস্টার প্রণয়নে, অনুষ্ঠানমঞ্চের শোভা রচনায়, ঋতু-আবাহনে, পালাপার্বণের বিচিত্রিত আল্পনায়। আলমকে পেয়েছি আমরা আমাদের প্রেমে, দ্রোহে, বিষাদেও। চারুকলি ও চারুনিকেতন — দু-দুটো চিত্রকলাচর্চাগৃহের সঙ্গে আলমের ছিল ওতপ্রোত যুক্ততা, চারুশিক্ষালয়দ্বয়ের প্রতিষ্ঠাসময় থেকেই। সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমি-র চারুকলা বিভাগে আলমের কাছে আঁক-শিখতে-আসা শিল্পশিক্ষার্থীরা তার বিশেষ-মনোগ্রাহী আঁকদানকৌশল ও আঁকানুশীলনপ্রক্রিয়ার স্মৃতি চারণ করেন সসম্ভ্রম শ্রদ্ধায়। আলমের অভাব আরও বহুদিন বোধ করবে তার শিল্পসতীর্থ-সারথীরা, তার কাছে এসে হাতে-তুলি-ধরা আঁকিয়ে অনুজ, আলমের অভিভাবকতুল্য শ্রদ্ধাভাজন অগ্রজ, তার পরিবার ও সর্বোপরি তার বন্ধুবান্ধবেরা।
ফ্ল্যাশব্যাকে একটাবার আলমের সেই শ্মশ্রুকোমল মুখ, স্বচ্ছনেত্র ঘোরপ্যাঁচহীন সেই চাহনি, কবুতরের মতন মৃদু ও মায়াকাড়া আভা-বিচ্ছুরক সেই তার কথা বলার ধরন ও কণ্ঠস্বর স্মরণ করবার জন্য তার বন্ধু ও স্বপ্নসহোদর-সুখদুঃখপরিজনেরা প্রায় নির্ব্যাতিক্রম প্রতিবছর উদ্যোগ নিয়ে আসছেন নিয়মিত। আলমের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই স্মৃতিনিংড়ানো ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে এই বিভাগীয় জেলাশহরের লোক্যাল সবগুলো দৈনিক, স্মরণসভা আয়োজন করা হয় একাধিক মহলের তরফ থেকে দফায় দফায়, একাধিক ছোটকাগজ সশ্রদ্ধ প্রেমে পাতা বরাদ্দ করে আলমস্মারক লেখা ও আঁকা ছাপতে — এর মধ্যে উল্লেখ্য ‘সূনৃত’ ষষ্ঠ খণ্ড (প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০০৭, সম্পাদনা : আহমদ সায়েম) — একটা স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেন আলমের বন্ধুরা, যেখানে আলমরচিত ড্রয়িং-পেইন্টিং-ক্যারিকেচার মিলিয়ে মোটমাট ৭৬টি চিত্রকর্মের রেপ্লিকা ছাপানো হয় (প্রকাশকাল : মে ২০০৭, সম্পাদনা : আহমাদ সেলিম) এবং ছবিগুলো নিয়ে তারিফি আলোচনা করেন সিলেটে-বসবাসরত বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পী, শাহ্ আলমের ‘শিক্ষাগুরু’ ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিক্ষক, অরবিন্দ দাসগুপ্ত। উল্লেখ্য, ‘মোর লাগি করিয়ো না শোক’ শিরোনামক ওই স্মারকগ্রন্থে প্রায় ৩৫জন সংস্কৃতিকর্মক আলম-শুভানুধ্যায়ীর স্মৃতিলেখা ছাপানোর শেষে অকালপ্রয়াত শিল্পী শাহ্ আলমের নিজের জবানিতে একটি ছোট্ট লেখা স্থান পেয়েছে, যেটা ‘চারুকলি’ চিত্রালয়ের ২০০৫ বার্ষিক চিত্রপ্রদর্শনী-ম্যাগাজিনে সভাপতিবক্তব্য হিশেবে প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া আলমের মৃত্যুর পরপর তার বন্ধু-গুণগ্রাহী শিল্পার্থী অনুজ-অগ্রজদের উদযোগে আয়োজিত হয় বেশকিছু ছোটবড় ছবিকর্মের সমাহারে একটি চিত্রপ্রদর্শনী, যেটি ছিল শাহ্ আলমের আজীবন-লালিত সাধ, শিল্পীর ইচ্ছে এইভাবে একটু হলেও চরিতার্থতা পায় কি না, তা জানতে পারার মতন আধ্যাত্মিক লাইনঘাট সকলের নেই নিশ্চয়। হায় জীয়ন্তে-মরা তারুণ্যের হাহাকার, হায় ইমার্জিং ইয়াং পেইন্টারের রোজকার গ্রাসাচ্ছাদনের নিমিত্তে এত-এত সমঝদারের দোরকড়া নাড়ার গনগনে গ্রীষ্ম ও কনকনে শীত, হায় জীবিতকালীন চিত্রকরকে ঠকানো উচ্চাঙ্গ-সাংগীতিক মহানির্বাহী নিয়োগকর্তা, হায় লিখিত শোকবার্তা, হায় নির্মম-নির্নীতি অপমান, হায় সর্বসাকুল্যে সাড়ে-চারহাজার বাংলাদেশী মুদ্রার মাসোহারা, হায় পৃষ্ঠদেশে শিরদাঁড়া থাকার অপরাধে এম্প্লোয়ারের বিরাগভাজন ও কর্মস্থল হইতে নিষ্ক্রমণ, হায় মিচকি ইবলিসের হাতে-পড়া বাংলার মানবোন্নয়ন, হায় জীবনের সফেন সমুদ্র ও শহর-জনপদে হাঙরের সনে হুটোপুটি শিল্পীর সহিষ্ণুমহান জীবন ও শিল্পনৈতিক বাস্তবতা, হায় হাসি, হায় কান্না, হায় দেবদারু, হায় প্রস্থানোত্তর মুহূর্মুহূ প্রশংসা, হায় মরণোত্তর পুরস্কার, হায় চিতা নিভিয়া যাইবার পরে এমন অপরূপ শোকোৎসব ও চিত্রপ্রদর্শনী … হায়! এমনধারা হায়-হায় ধ্বনি চিরদিনই ধিক্কারের ন্যায় বেজে যায়, বেজে চলে জনান্তিকে, এহেন অবিচারমুখর মনুষ্যখোঁয়াড়ে।
এই সমস্তকিছুই প্রমাণ করে যে, শাহ্ আলম যেমনভাবেই হোক জয় করে নিয়েছিলেন তার সময়ের ছোট্ট গণ্ডীর পারিপার্শ্বিক পরিসর, জয় করে নিয়েছিলেন হৃদয় তার সময়ে বিচরণশীল মানুষগুলোর, স্বল্পকালীন হলেও শিল্পবর্তিকা হাতে তিনি স্নিগ্ধ আভা ছড়ায়েছিলেন তার আপন প্রতিবেশে। কেবল শিল্পসাফল্য অন্তিম ও একমাত্র বিচারসূচক হতে পারে না মানুষের ক্ষেত্রে, অথবা তা যদি হয়ও তবু বুঝতে হবে শিল্পের সংজ্ঞা আদৌ একবগ্গা কিছু হতে পারে না — যেমনটা একবগ্গা আর একপেশে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে অভ্যস্ত আমরা আর্ট ও কাল্চার ইত্যাদি — তা তো খণ্ডিত বটেই, ঠিক অত জড় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংসিদ্ধিবদ্ধ জিনিশ নয় এইসব আঁকাআঁকি-লেখালেখি-দেখাদেখির দুনিয়া। মানুষের আনন্দ কিসে হয়, কিসে কার কখন-যে মন মজে যায়, প্রেমবৈরী পৃথ্বীবক্ষে কে-যে কোন ফোকরে করে নেবে মানুষের মন জয়, এইসবের তল মেলা ভার, আল্টিমেইটলি এই ব্যাপারগুলো অমীমাংসিত রয়ে যায়। ঢের কাঠ-খড়-ইশকুরুপ-বল্টু জুড়ে দিয়ে শিল্প বানিয়ে শেষরক্ষা হবে এমন কোনো নিশ্চয়জ্ঞান নাই দুনিয়ায়। বিকট ভয়ঙ্কর নলেজের জাহাজ হয়েও ভরাডুবি ঠেকাতে কে পেরেছে কবে, এই ভবে, কেবলই স্কিলের সর্দার হয়ে কে পেরেছে ”ভেনি, ভিডি, ভিসি” বিবৃতি ছুঁড়ে দিতে আখেরি বিচারে! বেশি কিছুই রিক্যোয়ার্ড নয় এক্ষেত্রে, কেবল চাই সহজিয়ানা, সারল্য ও স্বচ্ছ ঝর্ণাজলের ন্যায় নিরন্তর নিম্নে-উতলা ধরণীতলের দিকে নেমে আসার সহজাত নৃত্যমুদ্রা। শাহ্ আলমের এই সম্পদগুলো ছিল, সহজাতভাবেই ছিল, অল্পকালের মধ্যেই তাই শাহ্ আলম হতে পেরেছিলেন তার নিজের বিচরণক্ষেত্রের জুলিয়াস সিজার। হাতে পুঁজিপাট্টা যা-ই থাক, মানুষের মন জয় করে নেবার জাদু দেখিয়ে গেছেন এই শিল্পী, দি ইল্যুশনিস্ট অফ আনরিয়াল কালার অফ হিজ টাইম চিত্রী শাহ্ আলম। শিল্পসাফল্য দিয়ে একজন তরুণ শিল্পী — যিনি কি-না প্রয়াত অতি অকালে — বিচার্য হবেন না নিশ্চয়; তিনি বিচার্য হবেন তার কারুবাসনা দিয়ে। এইটুকু হদিস, আলমের কারুবাসনার দাগ ও দর্দ, খুঁজে পেতে চাইলে তার টুটাফাটা কাজগুলো খুঁটিয়ে দেখা আবশ্যক। ওখানেই ঠিকঠাক দেখা যায় চেহারাখানা আলমের। আলবৎ। কারুবাসনাই শিল্পী শাহ্ আলমকে শেষ করে দিয়েছে, ফের ভরিয়েছে নব নব জীবনে অপার অশেষ, একবার-দুইবার-তিনবার স্মরণের জানালায় এনে দাঁড় করাইছে তাকে তার মৃত্যুর দশকাতিক্রমকালেও পরিচিত লোকালয়ে। এ-ই তো, জীবনে, আর কী চাই! শিল্পী — বিশেষতই জীবনপ্রত্যুষে-প্রয়াত কোনো তরুণ শিল্পী — কারুসফলতায় নয়, কারুবাসনা দিয়েই বিচার্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। জীবনানন্দ দাশের সেই উপন্যাসের চরিত্রটি ঝিলিক দেয় স্মৃতিতে আমাদের, যেমন ঝিলিক দেন শাহ্ আলম, ”কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সবসময়ই শিল্প সৃষ্টি করবার আগ্রহ, তৃষ্ণা … কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দিয়েছে।” এই সেই কারুবাসনা, যা জীবনানন্দকে টেনে নেয় ট্রামচাকায় পেরোতে-না-পেরোতেই পঞ্চাশ, এই সেই কারুবাসনা, যা আলমকে গ্রেইভিয়ার্ডে ডেকে নেয় তিরিশ-প্রাক্কালে। কাজেই, সঙ্গত কারণেই, শিল্পীর কারুসফলতার চেয়ে কারুবাসনা নানাভাবেই বিবেচনার দাবি রাখে বেশি, শিল্পীর নিয়তি নির্দিষ্ট রয় তার কারুবাসনাবীজের ভেতরে। একজন রক্তমাংশের মানুষ ভয়াবহভাবেই রক্তপায়ী-মাংশাসী এই চিৎকারোন্মত্ত ভবসংসারে কেন ও কোন জাদুবলে পেইন্টিং-পোয়েট্রি-সিনেমা ইত্যাদি সৃজনের জন্য প্রণিপাত করে নিজেরে, এ এক রহস্য বটে, এ এক বিপন্ন-ও-বিমূঢ়-বসে-থেকে নির্জনা ভাববার মতোই বিস্ময়। একজন মানুষ ওয়ালস্ট্রিট ফেলে কেন গোচারণভূমিকায় নেমে পড়ে খেয়ে-না-খেয়ে, কেন বক্ষফুটোগুলো ওষ্ঠে চেপে একমনে ভেঁজে যায় গীতিমাল্য, কেন তার স্ট্রংলিকার চায়ের পেয়ালা জুড়িয়ে যায় জঠরচিন্তা-নস্যাৎ-করা চারুবৃত্তিচর্যায়! যে-জীবন মানুষের, অসহায়ভাবে হ্যান্ডস-আপ মানুষের, কেন ও কোন কুক্ষণে-যে তার সনে দেখা হয় কারুফড়িং ও শিল্পদোয়েলের! কথাটা কাজেই স্মর্তব্য যে, একজন অকালপ্রয়াত তরুণ সৃজনকর্মীকে বেঁচে-থাকাকালীন তার পারিপার্শ্বিক প্রেরণা ও পরিপ্রেক্ষিতের প্রেক্ষণী দিয়ে দেখতে হবে, কেবল শিল্পসফলতা নয়, শিল্পের পথে হেঁটে বেড়াবার ঐকান্তিক পা ও হৃদয়চিহ্নও ধর্তব্য ও গুরুত্বপূর্ণ। করতে পেরেছি কি না, বা যা-কিছু করেছি তা-সব অতুলনীয়-অনন্য হয়েছে কি হয়নি, ইত্যাকার বিচারাচারের বাইরেও রয়েছে দেখবার ও দেখাবার মতো অনেক তরিকা দুনিয়ায়। একজন শাহ্ আলমের শিল্পীজীবন, প্রোফাইল অফ আ সাডেনলি-ডিস্যাপিয়ার্ড ইয়াং এন্ড্ ইমার্জিং পেইন্টার, ক্যালাইডোস্কোপে দেখতে ও দেখাইতে যেয়ে এই কথাগুলো জরুর মনে রাখতে হবে।
এক্ষণে একটু ল্যুক-ব্যাক করে দেখে নেব অকালপ্রয়াত শিল্পী শাহ্ আলমের আর্লি দিনগুলো, জন্ম ও বেড়ে-ওঠা বৃত্তান্ত তার, শিল্পসড়কে পরিব্রাজনের প্রস্তুতি ও তার বিকাশের মুহূর্তগুলো। শুনব খোদ শিল্পীরই নিজের জবানিতে। একটু পরের প্যারাগ্রাফে উপস্থাপিতব্য অটোবায়োগ্রাফিক স্কেচটুকু সংগ্রহ করা হয়েছে একটা মাসিক পত্রিকার পুরনো সংখ্যা থেকে। এথা পুনঃপত্রস্থ বক্তব্যটুকু বস্তুত বাপ্পা ঘোষ চৌধুরী কর্তৃক পরিগৃহীত শিল্পী শাহ্ আলমের একটি ইন্টার্ভিউয়ের স্মৃতিকথাপ্রাসঙ্গিক অংশ। সম্ভাবনাশীল এক তরুণ শিল্পীর শৈশব, বেড়ে-ওঠা, তার আঁকাআঁকি-সূচনাকাল ও রেওয়াজেতিহাসের আখর ধরে রাখা ‘আলাল ও দুলাল : শাহ্ আলম ও শাহীন’ শীর্ষক আলাপচারিতাটি ছাপা হয়েছিল অধুনা-প্রকাশ-স্থগিত ‘মাসিক দর্পণ’ পত্রিকার জুলাই ২০০৪ সংখ্যায়। বিভাগীয় এ-শহরচৌহদ্দির সংস্কৃতিশিল্পাঙ্গনে সেই-সময়টায় শাহ্ আলম ও শাহীন সহোদরদ্বয় স্বনামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, পার্ফর্ম করতেন একজন নেপথ্যে এবং অন্যজন মঞ্চপুরোভাগে দর্শকসম্মুখে, শেষোক্তজন স্থানীয় অনুষ্ঠানাদিতে গাইতেন উত্তাল ও বলিষ্ঠ গলায় ব্যান্ডগান। আড্ডাচ্ছলে নেয়া হরিহরাত্মা দুই-ভাইয়ের বাতচিত অত্র অঞ্চলে ওয়েল-সার্ক্যুলেইটেড একটি সিনেম্যাগাজিনে প্রকাশের ঘটনা সাক্ষ্য দেয় সেই-সময়টায় শাহ্ আলম কতটা গ্রাহ্য ছিলেন সর্বত্র ও সকলের কাছে। টের পায়নি কেউ ঘুণাক্ষরেও যে, এর মাত্র বছর-তিনেকের মাথায় আয়ুসিংহাসন থেকে অকালে চ্যুত হবেন দুইয়ের এক, ভারী হৃদয়ে পাড়ি জমাবেন অফেরা বন্দরের পানে একজন শাহ্ আলম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অত্র উপস্থাপিত কথাচারিতাটিতে একেবারেই নিবিড়ভাবে মেলে আলমের গলার স্বর, এটিই একমাত্র সাক্ষাৎকার তার, কিন্তু প্রোক্ত স্মারকগ্রন্থ অথবা আর-কোথাও সাক্ষাৎকারটি পুনঃসংরক্ষণ করা হয়নি, এমনকি কোথাও উল্লেখও পাওয়া যায় না সাক্ষাৎকারটি বিষয়ে। এই রচনার প্রয়োজনে সেখান থেকে কেবল আলমের মুখনিঃসৃত কথাগুলো দলিলায়িত রইল, প্রশ্ন ও অন্যান্য ফোড়ন ইত্যাদি মুছে নিয়ে, অপরাপর কথাবার্তা লাফিয়ে পেরোনোর সময় ত্রিবিন্দুসূচক যতিচিহ্ন বসানো হয়েছে। এখানে আরও উল্লেখ করা মার্জিত হবে যে, এই রচনার ধাঁচ বজায় রেখে এথা সাক্ষাৎকারটি অবিকৃতভাবে পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপন করা আদৌ সম্ভব ছিল না, কাজেই কেটেছেঁটে একপ্যারা-পরিমাণ জায়গায় ব্যাপারটা আঁটাতে যেয়ে এর মূল টেক্সটপ্রদত্ত অভিপ্রায়ের রসভঙ্গও ঘটে গেছে এমন আশঙ্কা থাকা বাঞ্ছনীয়, এবং ইত্যাকার ব্যবহার অথবা আবশ্যক সম্পাদনাকাণ্ডে সাক্ষাৎকারগ্রাহকের সম্মতি আদায় করা উচিত ছিল, সম্ভব হয়নি বিধায় এখানে এই ঋণস্বীকার নথিবদ্ধ রইছে নিম্নলিখিত একটি প্যারাগ্রাফের মূল ব্যক্তি তথা বাপ্পা ঘোষ চৌধুরী সমীপেষু। শুনি শিল্পী শাহ্ আলমের জীবন ও স্বপ্নবাস্তবতা তারই নিজের আওয়াজে :
”জন্ম ১৯৭৫-এ। ইমিডিয়েট ছোটভাই শাহীন ১ বছর ১০ মাসের ছোট। আমাদের দু-জনেরই জন্ম ঢাকা ক্যান্টোনমেন্টে। আব্বা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। শাহীনের জন্মের পর আমার খুব কঠিন নিউমোনিয়া হয়েছিল অনেকটাই অযত্নের কারণে। বাঁচার কথা ছিল না। এইগুলো পরে আব্বা-আম্মার কাছ থেকে শোনা। … ঢাকায় জন্ম হলেও আমাদের ভিটাবাড়ি হবিগঞ্জ জেলার সুলতানশি গ্রামে। আব্বার অবসর গ্রহণের পর আমরা যখন গ্রামে চলে আসি, তখন খুব ছোট ছিলাম। গ্রামীণ পরিবেশে খুব ছোটাছুটি করতাম। মাঠে দৌড়ঝাঁপ, নদীতে সাঁতার, রাখালদের সাথে গরু রাখতাম। সারাদিন মাছ-ধরায় ব্যস্ত থাকতাম। এসব দেখেটেখে আব্বা ভাবলেন, এগুলো বুঝি আর মানুষ হলো না। তাই মানুষ করতেই সিলেটে নিয়ে এলেন। … আব্বা সিলেট টেক্সটাইল কারখানায় চাকরি নিলেন, আর আমাদের দু-ভাইকেই ভর্তি করে দিলেন দেবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। … স্পষ্ট মনে আছে, ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়েই প্রথম আঁকাআঁকির ফিল জেগেছে। জাতীয় পতাকা দিয়েই আমার শুরু।এ-সময়ে বইয়ের পাতায় খাতার পাতায়, টেবিল বা বেঞ্চ যেখানটাই খালি পেতাম সেখানেই টুকটুক ছবি আঁকা শুরু করে দিতাম। তখন তো আঁকার ব্যাকরণ জানা ছিল না। তারপর ওই স্কুলের পরীক্ষায় হাতের কাজ নিজে তৈরি করে দিতাম। এভাবেই শুরু। … খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ৯৪-র দিকে সম্ভবত, বাসায় কার্টুনটার্টুন আঁকতাম। পড়ার টেবিলে বসে হোমওয়ার্কের খাতায়-পাতায় ছবি আঁকতাম, টেবিলের কাছে আব্বা এলেই টুপ করে লুকিয়ে ফেলতাম। আঁকাআঁকির একাডেমিক জ্ঞান নেই। যতক্ষণ বাসায় থাকতাম, সারাক্ষণ একা একা এইসব করতাম আর ভাবতাম অনেক এঁকে ফেলেছি। আনন্দ পেতাম। এগুলো টুকরো করে কেটে বাসার দেয়ালে লাগাতাম। … বইয়ের পাতায় ক্লাসের খাতায় আঁকিবুকি করতে দেখলে সব বাবাই তো বকাবাদ্যি করেন। বাবা অবশ্য আমার ছবি-আঁকা ব্যাপারটা বেশ পছন্দই করতেন। তবে শুধু বলতেন যে এসব এখন নয়, পরে। একদিন সেলিম ভাই নামের একজন বললেন, তোমার আঁকার হাত তো খুব ভালো! আমি তার চিঠি নিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে গেলাম। ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষায় আমি খালি-হাতে গিয়েছিলাম, অন্যরা দেখি বোর্ডটোর্ড নিয়ে পরীক্ষা দিতে গেছে। দেখে তো ভাবলাম যে আমার এসব হবে না। কলস, গ্লাস ইত্যাদি আঁকতে দিলেন, আঁকলাম। শাহীনও একই সময়ে পরীক্ষা দিয়েছিল, গানের বিভাগে। ওকে বললাম রেজাল্ট দেখে আসতে। সে এসে বলল আমি পাশ করেছি। শুনে খুব ভালো লাগল। সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার আজাদের ভাই ওইসময় আমাকে শিল্পকলায় ভর্তির টাকা দিয়েছিলেন। ভর্তি হলাম। আব্বা বললেন, পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ছবি-আঁকাআঁকি করলে তার আপত্তি নেই। তো ভর্তি হয়ে গেলাম। একটা বিষয়ে বোধহয় আমি অন্যরকম ছিলাম, ক্লাসে একদম গল্প করতাম না। ননস্টপ কাজ করতাম। অনেকেই ক্লাস শেষ হওয়ার আগে-আগে চলে যেত, আমি শেষপর্যন্ত থাকতাম। পরিতোষদা প্রথম ক্লাসেই প্রশংসা করলেন আমার, ভালো লাগল। … আউটডোরে গেলে আমি নিজস্বতা খুঁজতাম, এক-পর্যায়ে শিল্পকলা একাডেমির এনুয়্যাল এক্সিবিশনে শ্রেষ্ঠ হই। পরীক্ষা দিয়ে আমি মধ্যম মান নিয়ে পাশ করি। শিল্পকলায় কেউ প্রথম বিভাগ পায় না। স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর হাত থেকে পুরস্কার নিই ৯৬ সালে, প্রান্তিক চত্বরের অনুষ্ঠানে। বিশাল অনুষ্ঠানে ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ বিষয়ে আঁকায় অংশ নিয়ে প্রথম হই। বিচারক অরবিন্দ স্যার, আর হীরা ভাই। হীরা ভাই বলেছিলেন আমি নাকি ভালো ছবি আঁকি। পরপর দু-বার শ্রেষ্ঠ হই, যার ফলেই হয়তো শিল্পকলা থেকে বেরিয়ে চাকরি খুঁজতে হয়নি। শিল্পকলা থেকে পরিতোষদা চলে গেলে সেখানে আমি জয়েন করলাম। পরে ধীরে ধীরে পোস্টার, বই, পত্রিকার প্রচ্ছদ আঁকতে শুরু করি। নজরুল জন্মশতবার্ষিকীতে ৪-৫টি বড় বড় পোর্ট্রেট করি আমি। এ-সময়েই আমার পরিচিতি বাড়তে থাকে। এবং এই সময়টাতেই সুফিয়া কামালের পোর্ট্রেট, মুহম্মদ জাফর ইকবাল সহ অনেকের পোর্ট্রেট করি। আর এখন ইদানীং বইয়ের প্রচ্ছদ ও পত্রিকায় ইলাস্ট্রেশন করি। স্টুডেন্টদের সময় দেই। নতুন কুঁড়ির জাতীয় পর্যায়িক শিশুকিশোর প্রতিযোগিতায় গত ২ বছর বিচারক হয়ে গিয়েছিলাম। … অনেকেরই ধারণা, চারুকলা ইন্সটিট্যুট থেকে না-শিখলে আর্টিস্ট হওয়া যায় না। আমি চারুকলা থেকে ডিগ্রি নিইনি। এটা তো সত্যি যে, ক্রিয়েটিভ জিনিশগুলো একদম যার যার নিজের। প্রতিষ্ঠান থেকে শিখতে হয় শুধু গ্রামার। মূল ব্যাপারটা, অর্থাৎ ছবি-আঁকাটা একেবারেই নিজের। … বইপুস্তক, বিশেষ করে বাইরের বই সাহায্য করেছে। পিকাসো … ও অনেকেরই নানা বইপত্র কালেকশনে রয়েছে। … শিল্প এবং ছবি-আঁকার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। ছবি আঁকলেই শিল্পী হয় না। পরিপূর্ণ শিল্পী অন্য জিনিশ। … শিল্পীরা সমাজের খারাপ দিকটা সবার আগে বুঝতে পারে, যেমন পারে সবার-অগোচরে-থাকা সুন্দর দেখতে ও দেখাতে। শিল্পীর এক-ধরনের দায়বদ্ধতা থাকেই, সমাজের প্রতি। ছবি-আঁকার মাধ্যমে ভালো-মন্দের মেসেজ একজন শিল্পী তার সমাজকে জানান। … প্রিয় ও পছন্দের শিল্পী অনেকেই। শাহাবুদ্দিন, মোস্তফা মনোয়ার, জয়নুল আবেদীন, ফিদা হুসেন, পিকাসো … স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যম ওয়াটার কালার, অয়েল পেইন্টিং।”
শাহ্ আলম স্মারক এথাকার এই শব্দগাথা ছুঁয়ে যাবে তাদেরকেই যারা আলমকে বন্ধু জ্ঞান করতেন। ছুরি-কাঁচি চোখে নিয়ে যারা আলমের এঁকে-রেখে-যাওয়া ছবির রেখাদৌর্বল্য ধরার মধ্য দিয়ে বেয়াকুফ নিজের পণ্ডিতি জাহির করতে উদগ্রীব, আলমকৃত চিত্ররচনায় রঙপ্রয়োগ, স্পেসব্যবহার, শিল্পদৃষ্টি, টোন-টেকনিক-স্ট্রোক-টেক্সচার ইত্যাদি কড়া নিক্তিতে তুলে ব্যক্তি শাহ্ আলমকে বিচার করবেন যারা, তাদের কাছে আলমকে-ঘিরে-গ্রথিত এ-স্মৃতিগাথা নেহাত বাহুল্য ও বাগাড়ম্বর বলে মনে হতে পারে। এখানে অন্তত কোনো স্তবস্তুতি কীর্তনের প্রয়াস করা হয়নি বলে দাবি রাখি। আলম কি করেছেন, কোথায় গেছেন, কতদূর যেতে পেরেছেন, কতদূর যেতে পারতেন, কোথায় তার কি কি অর্জন কি বর্জন-বিসর্জন ইত্যাদি ভাবনা আর-যারা করে করুক, আলমের বন্ধুরা নয়। মহাকালের মুকুট অধরা থেকে গেল বলে হায়-হায় যারা করবার তারা করবে, আলমের বন্ধুরা তাতে নির্বিকার। বিকার তাদের তখনই আসে, যখন বন্ধুরা ভাবে : ফেরানো যাবে না তারে আর, হায়, এই রঙের-আগুন-ভরা শিল্পের সংসারে! আলমের জন্য তাদের চোখ ভিজে ওঠে, ভিজে যায়, ভিজে যাবে মর্মতল বহুদিন আরো — যারা কিনা ছিল তার শিল্পসহচর। না, কোনো শিল্পসংরক্ষণঘরে নয়, আলম হৃদয়ে রইবেন তাদের, যারা তার বন্ধু ও সংলগ্নজন। আলমকে যারা চিনতেন, আলমকে যারা জানতেন, মর্মদ্রাবী খ্রিস্টীয় এ মে মাস এলেই আনমনা হবেন তারা আরও বহুদিন; — মে মাস, আলমের মৃত্যুমাস। আহ্! বন্ধুরা কী করে ভুলবে যে, মে মাস যুগপৎ আলমের জন্ম ও বিবাহমাসও বটে! অতএব, হেন ঝরোঝরো-বর্ষণমুখর মে মাসে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে স্মরণ করবে — এই স্বাভাবিকতা অব্যাহত থাকবে আরও বছর-কিছুকাল। অতঃপর জীবনের যথাবিধি মোতাবেক যা হবার তা হবে। অতএব, অতএব, বন্ধুরা ছাড়া আর-কেউ যেন এ-গান না-শোনে …
রেকগ্নিশন ও মূল্যায়ন : শিল্পী শাহ্ আলম সিলেটের শাহপরান উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে চিত্রকলা বিষয় নিয়ে একটি ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন পত্রিকা ও একটি অসরকারি উন্নয়নসংস্থায় ইলাস্ট্রেটর হিশেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ২০০০ সাল থেকে শেষদিন পর্যন্ত অনবচ্ছিন্নভাবে সিলেটের জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে চিত্রকলাশিক্ষক হিশেবে দায়িত্বরত ছিলেন। বলা বাহুল্য যে অল্পকালের মধ্যেই চিত্রকলাশিক্ষার্থীদের কাছে শাহ্ আলম অত্যন্ত প্রিয়মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। অসরকারি সংস্থায় ইলাস্ট্রেটর হিশেবে কর্মকালে তিনি শিশুমনোপযোগী বিস্তর বই ও পঠনসামগ্রী উন্নয়নে অবদান রাখেন। লোক্যাল পত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনায় ছিটিয়ে-ছড়িয়ে রয়েছে তার অলঙ্করণদক্ষতার প্রচুর নিদর্শন। নাট্যমঞ্চসজ্জা ও বাড়ি-ইমারতের কামরাভ্যন্তরীণ পরিসরপরিকল্পনা ও শিল্পশোভা রচনায় রেখেছেন তিনি তার মেধার স্বাক্ষর। শিল্পনির্দেশকের কাজ করেছেন তিনি একাধিক স্থাপনা নির্মাণ ও দৈনিক পত্রিকা পত্তনিকালে।
এটা পরিতাপের হলেও সত্যি যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও শিল্পী তার জীবদ্দশায় নিজের নির্বাচিতা কাজ নিয়ে একটি চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজনের ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। মৃত্যুর পর তার আমৃত্যু-লালিত স্বপ্নের এক্সিবিশনের জন্য স্বনির্বাচিত কতিপয় কাজের সঙ্গে বন্ধুবান্ধবদের সংগ্রহে-রাখা কাজগুলোর অল্পকয়েকটি নিয়ে একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে আয়োজিত প্রদর্শনীপ্রাক্কালে প্রকাশিত মোমেন্টোপুস্তিকার মুখবন্ধে এই অকালপ্রয়াত শিল্পী সম্পর্কে একটি ক্ষীণতনু মূল্যায়ন করেছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও আর্টক্রিটিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ইংরেজিতে-লেখা সেই মূল্যায়নমূলক অনুচ্ছেদটি বাংলায় এনে এখানে রেখে দেয়া যাচ্ছে :
“নন্দনভুবনে শাহ্ আলম খুব নামজাদা কেউ নন। মনে করতে পারছি না আমি তার কোনো কাজ রাজধানীর কোনো গ্যালারিতে দেখেছি বলে, বা ঢাকার কোনো শিল্পজর্নালে তাকে বা তার কাজ উপজীব্য করে লেখাপত্র নজরে এসেছে বলে মনে পড়ে না। তারপরও মনে হচ্ছে এখন দেরিতে হলেও যে রেখে-যাওয়া তার কাজগুলো সন্দেহাতীতভাবেই শিল্পমেধার দিক থেকে ঋদ্ধ। … নিঃসন্দেহে শাহ্ আলম প্রকৃতিদত্ত দক্ষতার অধিকারী এক প্রতিকৃতিচিত্রী, কিংবদন্তি বাউল শাহ আব্দুল করিমের একজোড়া প্রতিকৃতিচিত্র আলমের এই দক্ষতা সত্যায়িত করার পক্ষে যথেষ্ট। আলমের আঁকার হাত অত্যন্ত সুষম বহুমাত্রিক, কলম-কাগজি অথবা কাঠকয়লা যা-ই হোক স্বনিয়ন্ত্রণে রেখে এবং সহুজে নৈপুণ্যে এঁকে যেতে পারেন। তার রেখাঙ্কনগুলো স্পন্দমান ও অত্যন্ত সুনিশ্চয়, এবং রয়েছে তার অনুপুঙ্খকরণের সহজাত নজর। তার জলরঙগুলোও যথেষ্ট অনুনাদক তথা অনুরণনগুণসম্পন্ন ও আলোকভেদ্য, আঁকার মাধ্যমগত সুবিধাদি তিনি চিনে নিতে পেরেছেন যথানিষ্ঠ। চিত্রকৃতির এই অনুনাদগুণ তথা অনুরণনবৈশিষ্ট্যটিই শিল্পীর কাজগুলোর পাঠোন্মোচন তথা রসাস্বাদনে কখনো-কখনো অন্তরায় হয়ে উঠেছে বটে, এটি ঘটেছে বিশেষভাবেই যখন তিনি দৃষ্টি-আকর্ষণাভিপ্রায়ে জোরালো ও কড়াপাকের রঙ ব্যবহার করতে গিয়েছেন তখন। … এমনিতে তার কাজ রচনাপ্রাখর্য ও রূপবিচারে পরিচ্ছন্ন প্রকাশবিভূতিসম্পন্ন। …”
শাহ্ আলম প্রয়াণের পরবর্তীকালে শিল্পী অরবিন্দ দাসগুপ্ত বড় কলেবরে মূল্যায়ন করেন তার এই প্রিয় শিষ্যের রচনাকীর্তি, শিল্পমোক্ষ ও প্রবণতা প্রভৃতি নিয়ে। বৃহৎ কলেবর রচনাটি স্মৃতিগ্রন্থে সঙ্কলিত রয়েছে। এখানে ব্যবহৃত কথাগুলো অবশ্য নেয়া হয়েছে একই মূল্যায়নকারীর একটি নিবন্ধাকৃতি রচনা থেকে, যেটি ছাপা হয়েছিল আলমের মৃত্যুর অব্যবহিত পরের সপ্তাহে একটা স্থানীয় দৈনিকের স্মরণায়োজনে, সেখান থেকে একাংশ চয়ন করা যাক :
“…তার ছবিতে রঙপার্সপেক্টিভ ও ড্রয়িংপার্সপেক্টিভের সমন্বয় সবসময়ই প্রাধান্য পেয়ে থাকে, তেমনি থাকে কম্পোজিশনের চমক এবং এক ছন্দময় বলিষ্ঠতা। শাহ্ আলমের ছবির মূল সুর গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও মাধুর্য, যেমনটি আমরা শিল্পী এসএম সুলতানের মধ্যে পাই। তবে মাঝেমধ্যে তার কিছুটা ব্যতিক্রমও আমাদের নজরে আসে, বিশেষ করে তেলরঙে আঁকা ছবিগুলোতে। সেখানে গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ থেকে বিশ্ববৈচিত্র্যই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তেলরঙে ফর্মভাঙা পদ্ধতিটি পুরোপুরি দ্বিমাত্রিক না-হলেও দ্বিমাত্রিকতার অবয়বে মোড়ানো। … আসলে শাহ্ আলম ফর্ম নিয়ে খুব বেশি নাড়াচাড়ার সুযোগ পায়নি, তাই নিজস্ব একক কোনো স্টাইল গড়ে নিতে পারেনি। … শাহ্ আলমের প্যাস্টেল রঙের ছবিগুলো সাবলীলতা, ছন্দময় গতিশীলতা এবং পরিশীলতার আমেজে ভরপুর। রঙের টেক্সচার ও টোন মাঝেমধ্যে আমাকে অবাক করে দেয়। বিষয়বস্তুর ভাবগাম্ভীর্য, রঙের উজ্জ্বলতা এবং কমনীয়তা লক্ষ করার মতো। পেন্সিলস্কেচে টোনের পরিমিতিবোধ, তীক্ষ্ণতা, ওজন ও সর্বোপরি পার্সপেক্টিভের যথাযথ ব্যবহার মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। পেন্সিলস্কেচে পরিবেশের ভাবগাম্ভীর্য কিংবা ফিগারের প্রাধান্য দিতে গিয়ে ছবিতে আলোছায়ার ব্যবহার সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি হতে গৌণভাবে উপস্থাপন করত। এতে ছবির গুণগত মান যাতে অক্ষুণ্ন থাকে সে-ব্যাপারেও ছিল সে পূর্ণ সচেতন। …”
এরচেয়ে বড় স্বীকৃতি কিছু তো দরকার নেই একজন প্রয়াত পটুয়ার। আদৌ কোনো স্বীকৃতিরই দরকার থাকে না আপনি যখন দৃশ্যপট থেকে অন্তর্হিত। রেকগ্নিশন ও মূল্যায়ন প্রভৃতি জীবিতদের জাগতিক জলপানির কারবার। কাজেই মৃত্যুর দশকপ্রাক্কালে শাহ্ আলমকে স্মরণ করা হচ্ছে — এ-ই তো মস্ত স্বীকৃতি, বিশেষত এই তিনসেকেন্ডের তরে সেলেব্রিটি হইবার কালের খপ্পরে। শাহ্ আলম তার আপন সময়ের পান্থজনের সখা হতে পেরেছিলেন — মনুষ্যজন্মে এরচেয়ে দামি কিছু হইবার নাই বোধহয়।
পোস্টস্ক্রিপ্ট : শাহ্ আলম। অকালপ্রয়াত প্রতিভাবান এই চিত্রশিল্পীর শেকড় সিলেট বিভাগাধীন হবিগঞ্জ জেলার সুলতানশি গ্রামে প্রোথিত। জন্ম ৫ মে ১৯৭৩ এবং মৃত্যু ২৯ মে ২০০৬। সিলেটেই বেড়ে-ওঠা ও আঁকাআঁকিবিকাশ, কর্মসূত্রে এখানেই ছিলেন তিনি আমৃত্যু। গোর হয়েছে নিজের পৈতৃক বাড়ির সংলগ্ন ছায়াচ্ছাদিত গ্রেইভিয়ার্ডে, হবিগঞ্জেই, নিভৃত পল্লি সুলতানশিতে। প্রয়াণের পর প্রায় একদশক হতে চলেছে, এখনও প্রতিবছর এই শিল্পীকে স্মরণ করেন স্থানীয় সংস্কৃতিক্রিয়ায় লিপ্ত ও তৎপর সকলে, এখনও শাহ্ আলম বৈশাখভোরে এ-শহরের মানুষের চোখে রঙের হাহাকার জাগায়ে যান। সিলেটে যে-কয়টা আঁকার ইশকুল রয়েছে শিশুকিশোরদের, সেসবের প্রায় সব-কয়টাতেই শাহ্ আলম সাদর শ্রদ্ধায় স্মরণীয় হয়ে আসছেন ফি-বছর। তাকে সম্মান জানিয়ে এ-শহরে একটি চিত্রপ্রদর্শনপরিসর প্রবর্তন করা হয়েছে, যে-গ্যালারিটি এখানকার প্রথম বেসরকারি ও বাণিজ্যিক উদ্যোগ, দেখতে দেখতে সেই ‘সিলেট স্কুল অফ আর্ট’ অভ্যন্তরস্থ ‘শাহ্ আলম গ্যালারি’ পত্তনির পর বছর-পাঁচ পেরিয়েছে এরই মধ্যে। একাধিক আঁকশিখন স্কুলে এস্টাব্লিশ করা হয়েছে শাহ্ আলম মেমোরিয়াল কর্নার, একাধিক পেইন্টিং এক্সিবিশন অর্গ্যানাইজ করা হয়েছে তাকে ডেডিকেইট করে।
[ক্রেডিটলাইন : এপিগ্রাফ-পঙক্তিটি অমিয় চক্রবর্তীর একটি কবিতা থেকে নেয়া। আর এই নিবন্ধের সঙ্গে ব্যবহারের নিমিত্তে শিল্পী শাহ্ আলমের একটি পোর্ট্রেইট ঝটিতি-আঙুলে এঁকে দিয়ে বাধিত করে রেখেছেন চিত্রকর শিল্পী সত্যজিৎ রাজন। সবিনয় ঋণ স্বীকার করি ঠিকই, কিন্তু ওইভাবে ঋণ প্রকাশেরও জরুরৎ খুব-একটা নাই, কেননা পোর্ট্রেইটটি আদতে শিল্পী শাহ্ আলমের প্রতি তার অনুজপ্রতীম শিল্পতীর্থসহযাত্রীর একটি ট্রিবিউটও বটে। প্যাস্টেলে আঁকা দ্রুতাঙ্কিত পোর্ট্রেইটটি দৃষ্টিপ্রীতিকর হয়েছে, যেখানে যন্ত্রণাজারিত ও যিশুসমাহিত শাহ্ আলম মুরতিখানা তার আন্তর্চারিত্র্য সহ যথেষ্ট যথাকাঙ্ক্ষিত ফুটে উঠেছে। একটি পোর্ট্রেইট খোদ প্রয়াত শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি; এবং রচনার-সঙ্গে-সেঁটে-দেয়া আরেকটি ট্রিবিউট-পোর্ট্রেইট ২০০৬ সালে আলমের মৃত্যুপরবর্তী কোনো-একদিনে এঁকে উঠেছিলেন এম্যেচার-পেইন্টার শওকত ইমাম, যিনি ছিলেন আলমের পূর্বতন কর্মস্থলের ভূতপূর্ব চাকুরে, ডিজিটাল মিডিয়ায় আঁকা আর্টওয়ার্কটি আলমের একদা-প্রায়-বিতাড়িত কর্মস্থলের আর্কাইভ থেকে কালেক্ট করা হয়েছে। এছাড়া শাহ্ আলমের অটোবায়োগ্রাফিক প্যারাগ্রাফটি গৃহীত হয়েছে অধুনা-প্রকাশলুপ্ত ‘মাসিক দর্পণ’ পত্রিকার জুলাই ২০০৪ সংখ্যা থেকে, এই পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলো দেখতে দেয়ার জন্য শিল্পসজ্জন চিত্রী ইসমাইল গনি হিমন বিশেষভাবেই কৃতজ্ঞতার্হ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের প্রাথমিক রূপটি ড্রাফ্ট করা হয়েছিল ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে আলমপ্রয়াণের অব্যবহিত পরেই ‘বৈঠা’ নামের একটা ভাঁজপত্র তথা পোয়েট্রিফোল্ডারে ছাপানোর প্রয়োজনে, যে-পাতাটি সিলেট থেকে বেরোত অনিয়মিতভাবে এবং সাতটি ইস্যু বেরোনোর পর এটি বন্ধ হয়ে যায়, অনিবার্য কারণে আলমস্মারক ‘বৈঠা’ বার হয় নাই আর, এবং বলা বাহুল্য বৈঠাও অকালপ্রয়াত পত্রিকা এক। বৈঠার পরিত্যক্ত ডামি-ফাইলটি থেকে এ-নিবন্ধের প্রাথমিকাংশটুকু উদ্ধার ও উন্নয়নে সহায়তা করেছেন বৈঠাকাণ্ডারি অশোক দত্ত ও উজ্জ্বল দাশ। সবশেষে এনায়েত ইউএস ইসলাম একটি বিশেষ ধন্যবাদ পাবেন তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের শাহ্ আলম স্মারকগ্রন্থটি নেড়েচেড়ে দেখতে দেয়ার জন্য।]