আমার সঙ্গোপন রবীন্দ্রনাথ / পাপড়ি রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ মে ২০১৪, ৪:০৫ পূর্বাহ্ণ, | ২২৩০ বার পঠিত
রবীন্দ্রনাথ মানে রবীন্দ্রনাথ। এর বাইরে কোনোভাবেই তাঁকে দেখবার উপায় নেই। এমনকি ভাববারও উপায় নেই। যে কেউ একবার রবীন্দ্রনাথ পড়লেন তো মনে হবে-আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে/বসন্তেরই বাতাস টুকুর মতো…
তা আপনি রবীন্দ্রনাথের যাই পড়ুন না কেন! আর পড়বার মতো বিস্তর লেখাপত্র তো তাঁর রয়েছেই। কবিতা, গান, গল্প, চিঠি, উপন্যাস, ডায়রী, নাটক, ভ্রমনকাহিনী এমনই নানান কিছু। ধরুণ পরতে শুরু করলেন ‘বিদায় অভিশাপ’—
. হায় সখা এতো স্বর্গপুরী নয়
. পুস্পে কীটসম তৃষ্ণা জেগে রয়
. মর্মমাঝে বাঞ্ছা ঘুরে বাঞ্ছিতেরে ঘিরে
. লাঞ্ছিত ভ্রমর যথা বারংবার ফিরে
. মুদ্রিত পদ্মের কাছে।
এই যে অরুপ প্রেমের এমন রুপময় প্রকাশ, অথচ আমি কিন্তু হতাশ! জানি, এক্ষুণি ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। রবীন্দ্র অন্ধভক্তরা শিং উঁচিয়ে তেড়েফুঁড়ে আসতে পারেন। কেউবা রাগের চোটে আমায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতেও পারেন! কিন্তু আমিই বা কি করতে পারি? আমার মনের লাগাম কষার তরিকা আমার জানা নাই।
মানসী, বলাকা, চিত্রা, পূরবী, পুনশ্চ, শেষলেখা, পলাতকা, জন্মদিনে, পরিশেষে, পত্রপুট, ক্ষনিকা বা শ্যামলী ভ্রমন করে এসেও তাঁর কাব্যে আমার যেমন জাগার কথা, তেমন অসীম তৃষ্ণা জাগেনি। হয়তো কড়া রোদ্দুরে পুড়ে এসে খুলে বসেছি
. তখন বর্ষনহীন অপরাহ্ন মেঘে
. শংকা ছিল জেগে
. ক্ষণে ক্ষনে তীক্ষ্ণ ভৎসনায়
. বায়ূ হেকে যায়
. শূন্যে যেন মেঘছিন্ন রৌদ্ররাগে পিঙ্গল জটরা
. দুর্বাসা হানিছে ক্রোধ রক্তচক্ষু কটাক্ষ ছায়া (পরিচয়ঃমহুয়া)
পড়েছি ঠিকই কিন্তু আমার চোখের সন্মুখে ভেসে উঠেছে—
‘একদিন বর্ষাকালে মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ইষৎ তপ্ত সুকোমল বাতাস দিতেছিল,রৌদ্রে ভিজা ঘাস এবং গাছপালা হইতে একপ্রকার গন্ধ উথথিত হইতেছিল,মনে হইতেছিল যেন ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিঃশ্বাস গায়ের উপরে আসিয়া লাগিতেছে।‘ (পোস্টমাস্টার,গল্পগুচ্ছ)
কিংবা মন মোর মেঘের সংগী শুনছি-এই মেঘের সংগীতের মাঝেই আমার কানে বেজেছে ঝপ্ করে জলে বুঝি কিছু পড়েছে!
‘একবার ঝপ করিয়া একটা শব্দ হইল কিন্তু বর্ষার পদ্মাতীরে এমন শব্দ কত শোনা যায়। রাইচরণ আঁচল ভরিয়া কদম্বডাল তুলিল। গাছ হইতে নামিয়া সহাস্য মুখে গাড়ির কাছে আসিয়া দেখিল কেহ নাই, চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, কোথায় কাহারও কোনো চিন্হ নাই।’ (খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, গল্পগুচ্ছ)
আর কি সব অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড ‘ঝরঝর মুখর বাদল দিনের’ মাঝেও আমার কানে ওই ঝপ্ শব্দই বেজে ওঠে। কারো কিছুই নয় এতে আমারই বিপদ। রবীন্দ্রনাথের বর্ষা মানেই আমার কাছে ঝপ। এক্ষনে নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট, নদী জলে পড়া আলোর মতো সুস্পষ্ট তাঁর কবিতা বা গানের চাইতে আমি ভেসেছি অন্য ভেলায়। তাঁর একেবারেই অন্য ধাতের,অন্য ছাঁচের গুচ্ছ গুচ্ছ গল্পের গভীরে।
অর্থাৎ তাঁর কবিতা বা গান আমায় সেভাবে নাড়া দিচ্ছে না, বা তাদের প্রতি আমি দুর্মর টান কিছু অনুভব করছি না। আমি শুধু ভেসে যাচ্ছি তাঁর গল্পের ভেলায়। তাঁর গল্প নিয়ে কিছু বলতে গেলেও মুশকিল আমার ষোলআনাই। আমি কাকে রেখে কার কথা বলবো? ‘অতিথি’ তো ‘আপদ’। ‘আপদ’ বলি তো ‘ইচ্ছাপূরণ’। তারপর ‘একরাত্রি’, ’কংকাল’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ’দালিয়া’, ‘ল্যাবরেটরি’, ‘নষ্টনীড়’, ‘বলাই’, ‘শাস্তি’ বা ‘সমাপ্তি’।
কাবুলিওয়ালার রহমত যেন সমগ্র পৃথিবীর বাবাদের মমতা বুকে নিয়ে ভাস্বর হয়ে আছে। রহমতের পিতৃহৃদয়ের হাহাকার আমাকে একেবারে দলিত মথিত করে দেয়।
‘অবশেষে দরজার কাছে গিয়া একটু ইতস্তত করিয়া কহিল, ‘খোকীকে একবার দেখিতে পাইব না?’(কাবুলীওয়ালা,গল্পগুচ্ছ)
এই খুকী মিনি। মিনির কথা ভাবলেই ফটিক এসে দাঁড়ায়। নয়তো রতন। কাবুলীওয়ালার বেদনার চাইতে পোস্টমাস্টারের মনোবেদনা কি সামান্যতম পেছনে ঠেলে দেয়া যায়?
‘একটি সামান্যতম গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচছা হইল, ফিরিয়া যাই, এ জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি—কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকুলের শশ্মান দেখা দিয়েছে-এমন নদী প্রবাহের ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল,জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।
(পোস্টমাস্টার,গল্পগুচ্ছ)
পোস্টমাস্টারের মতো রহমত এই রূঢ় সত্য জেনেছিল কিনা বলা মুশকিল। কিন্তু তার বুভুক্ষু পিতৃহৃদয় শুধু মাত্র নিজের ছোট মেয়েটির ছায়াকে বাস্তবের সংগে একাত্ম করতে এসেছিল!
ফলে রবীন্দ্রনাথের এই ভিন্ন মাত্রার, ভিন্ন স্বাদের গল্পরাজ্যে আমি আর কাউকেই স্থান দিতে পারিনা। গল্পরাজ্যে সবাই রাজাও নন, হতেও পারেন না, রবীন্দ্রনাথ আমার একমাত্র রাজাধিরাজ!
তাঁর গল্পঝুলিটি খুলে বসলেও কি আমার নিস্তার মেলে? তাঁর উপন্যাসের গোটা কয় চরিত্র তখন যে আমায় জ্বালিয়ে মারে! মৃণাল এসে দাঁড়ালো তো কুমুদিনীর শাপলার ডাঁটার মতো হাত দুইখানা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো। মা গো! কী যে তুখোড় ব্যক্তিত্ব কুমুর! বাংলা সাহিত্যে এমন অভিজাত নারী চরিত্র খুব কমই পেয়েছি আমি! যদিও মৃণাল ও কুমুর সামঞ্জস্য প্রায় নেই বললেই চলে। একজন যদি হয় গনগনে কয়লা, অপরজন তুষের আগুন। জ্বালা অবশ্য তাদের দুইজনারই আছে।
এদিকে কোনো রাতে ’কংকাল’ এসে দীর্ঘশ্বাস ফেললে আমি দামিনীকেও সরিয়ে দিতে পারিনা।
‘সাধ মিটিল না জন্মান্তরে যেন তোমাকে পাই’ ( চতুরঙ্গ)
‘কংকালে’ও তো ভালোবেসে সাধ মেটে নাই! সেও কি জন্মান্তরের লোভে বিষ ঢেলেছে ডাক্তারের মদের পাত্রে? আর নিজের ঠোঁটে?
. যেমন পাখীর গান-যেমন জলের তান
. যেমনি এ প্রভাতের আলো
. যেমনি এ কোমলতা-অরণ্যের শ্যামলতা
. তেমনি তাহারে বাসি ভালো
(পল্লীগ্রামঃচৈতালী)
আমি এই পংক্তির সঙ্গে মৃণ্ময়ীকে দাঁড় করিয়ে দেই।
ওই যে চপলা,অধরা এক বালিকা। বেগবতী জলের মতোই স্বচ্ছ যার অন্তর। একেবারেই আনাড়ি অথচ সরল, কোমল, অবুঝ!
‘সমাপ্তির’ মৃন্ময়ী এক আশ্চর্য মধুর নারী আমার কাছে।
তেমনি আরেক জন ‘হৈমন্তী’!
. পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ
. তরুশ্রেণী চাহে পাখা মেলি
. মাটির বন্ধন ফেলি
. ওই শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশেহারা
. খুঁজিতে আকাশের কিনারা..। (বলাকা)
আমার হৈমন্তীর পাখা মেলা কি আর বলাকা দিয়ে সামাল দিতে পারি? ফের বলছি রবীন্দ্র অন্ধভক্তরা আবারো শিং বাগিয়ে, চক্ষু লাল করে আমার দিকে তেড়ে এলেন বলে!
অথবা হে পাতকী, সাহস তো তোর কম নয় রে!
কি করতে পারি আমি? যদি আমার তেমন করে মন সায় না দেয় তাঁর গান বা কবিতাতে?
‘ভালো যদি বাসো সখী কি দেবো গো আর?…
যতই ভালোবাসার গান আমি শুনিনা কেন অপুর ভালোবাসার তুলনা এ জগতে কোথায় পাবো?
‘যদি লোকধর্মের কাছে সত্য ধর্মকে না ঠেলিব যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহুযুগের যে শিক্ষা তা কী করিতে আছে। জান তোমরা? যেদিন অযোধ্যার লোকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার দাবি করিয়াছিল তার মধ্যে আমিও যে ছিলাম। আর সেই বিসর্জনের গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের মধ্যে একজন! (হৈমন্তী, গল্পগুচ্ছ)
হৈমন্তীর সেই শেষবারের মতো নিভে যাওয়া হাসিটির সংগে আমি কোন গান বা কবিতাকে মিলাতে পারবো?
হৈমন্তীর সংগে ভাবতে বসি মৃণালিনীকে। তারপর বিমলা। কুমু। সন্দীপ। নিখিলেশ। অমল। এবং চারুলতা!
চারুর রক্তহীন ফ্যাকাশে মুখ দেখিয়া আমিও যে জগত সংসার ভুলিতে বসি!
‘পাশের বারান্দা হইতে চাপা কান্নার শব্দ শুনিতে পাইয়া ত্রস্তপদে গিয়া দেখিল,চারু মাটিতে পড়িয়া উপুড় হইয়া কান্না রোধ করিবার চেষ্টা করিতেছে। এরুপ দুরন্ত শোকোচ্ছাস দেখিয়া ভূপতি আশ্চর্য হইয়া গেল।’ (নষ্টনীড়,গল্পগুচ্ছ)
চারুলতার এই শোকমগ্নতা ভুলতে পারা কি অত সহজ?
. ভ্রমর যেমন থাকে কমল শয়নে
. সৌরভ সঘনে, কারো পথ নাহি চায়
. পদশব্দ নাহি গনে, কথা নাহি শোনে
. তেমনি হইব মগ্ন পবিত্র মায়ায় (নিভৃত অপ্রেম,মানসী)
যত যাই বলি না কেন রবীন্দ্রনাথের অজস্র অমর সংগীত বা কবিতায় আমার চক্ষু, কর্ণ শান্ত হয়, কিন্তু অন্তরতম অন্তর শান্ত হয়না। অন্তরকে বশ মানাতে পারিনা। আমার অশান্ত মন ঘুরে ফিরেই যায় সুভার কাছে। চন্দরার কাছে। চারুলতার কাছে। যায় ফটিকের কাছে। রতন, কুমু, কুসুম, বিজয়া, রাইচরণ, তারাপদ আমাকে ক্রমাগত ঘোরগ্রস্ত করে রাখে। কবিতা, ছন্দ, বানী, সুর সব ছাপিয়ে তখন যিনি আমার সঙ্গোপন হয়ে ওঠেন তিনি ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ। গল্পগুচ্ছের রবীন্দ্রনাথ। আমার গল্পরাজ্যের রাজাধিরাজ!