বার্টল্ট ব্রেশ্টঃ নাটক গল্প কবিতায় বোধের জাগরণ । হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ মার্চ ২০১৪, ৩:৩৬ পূর্বাহ্ণ, | ৩৯১৪ বার পঠিত
একঃ ‘ধ্বনি, স্বর আর দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুনত্ব সংযোজনের মধ্যদিয়ে রাতারাতি মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে জার্মান সাহিত্যের অবয়ব বদলে দিয়েছে সে’। কথাটা জার্মানির মহান কবি, গল্পকার এবং নাট্যনির্মাতা বার্টল্ট ব্রেশ্টের ‘ড্রামস ইন দ্যা নাইট’ নাটকের সমালোচনায় বার্লিনের বিখ্যাত ক্রিটিক harbert ihering এর। তিনি বলেন- ‘এ এমন এক ভাষা যা স্বর, মাড়ি, কান, মেরুরজ্জু আলোড়িত করে!’ তৎকালীন বার্লিনে তরুণ কিন্তু অপার সম্ভাবনাময় সৃজনশীলদের ‘kleist prize’ নামে মর্যাদাপূর্ণ একটা পুরস্কার দেয়া হত; যেটা ১৯৩২সালে অর্থাৎ হত্যাকারী ফ্যাসিস্ট হিটলারের দল ক্ষমতায় আসার বছরখানেক আগে বন্ধ করে দেয়া হয়; ১৯২২ সালে ব্রেশ্টকে এ পুরস্কার দেয়ার সময় বলা হয়-‘ স্বপ্রনোদিত কাব্যকলা প্রয়োগ না করেও তার ভাষা যেমন সুতীব্র, প্রাণবন্ত; তেমনি অতিরঞ্জিত কথন না থেকেও সিম্বলিকাল। ব্রেশ্ট এমন একজন নাট্যকার যার ভাষা ভীষণ শরীরবৃত্তীয় এবং সরাসরি বোধে আঘাত করে’।
মূলত ‘ড্রামস ইন দ্যা নাইট’ নাটকের জন্যই তার এ পুরস্কার পাওয়া যদিও ততদিনে তিনি আরো কিছু নাটক (যেমন baal, in the jungle) রচনা করেন এবং মঞ্চস্থও। তরুণ এ কবির প্রথম জীবনের উপলব্ধি ছিল শেষতক শূন্যতাই আমাদের শেষ সাথী। সে সময় তার সৃষ্টিগুলোতে সুললিত ভাষা এবং চিত্রসৃষ্টির ভেতর ফুটে উঠত রাজনীতিবিমুখতা, শুধুই সামগ্রিক সৌহার্দ বা প্রীতিবাদের তাফসীর। ‘ড্রামস ইন দ্যা নাইট’ নাটকটি চলাকালীন সময়ে তার রচিত একটা কবিতা ‘born later’. সেখানে কবি বলেন- i admit it: i/ have no hope/ the blind talk of a way out. i/ see.// when the errors have been used up/ as our last companion, facing us/ sits nothingness.
একজন ধর্মপ্রাণ প্রোটেস্ট্যান্ট মা এবং ক্যাথলিক বাবার ঔরসে ১৮৯৮ সালে আউসবার্গে জন্ম নেয়া বার্টল্ট ব্রেশ্ট খুব ছোট বয়স থেকেই বেড়ে ওঠেন ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্টদের লড়াইয়ের কথা শুনতে শুনতে। তার বয়স যখন ষোল, রসায়নশাস্ত্র প্রয়োগ করে ক্রমে শিল্পবিকাশে সাফল্যশিখায় চড়ে বসা জার্মান শাসকদের দেখেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যেতে। যুদ্ধের নৃশংসতা, লক্ষ মৃত্যু, ক্ষুধা, অন্যায় আর মানবতার বিভীষিকাময় পরিণতি দেখে শিউরে ওঠে ব্রেশ্টের কিশোর মন।
এমনকি তাকেও যুদ্ধে যেতে হত যদি না কর্তৃপক্ষ পেপারমিল শ্রমিক থেকে কারখানার ম্যানেজার হয়ে যাওয়া তার পিতার সুপারিশ না শুনত! আর এই ক্ষোভেই যুদ্ধের কার্যকারণ, সামাজিক অবিচার আর শোষণের উৎস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা ব্রেশ্টের মন হয়ে ওঠে রাজনীতিবিমুখ এবং প্রথম জীবনে যার ছাপ তার সৃষ্টকর্মেও দেখা যায়। কিন্তু আরো বছর তিনেক পর ব্রেশ্ট পরিচিত হন মহান মার্ক্সের ‘ক্যাপিটাল’ এর সাথে। মার্ক্সবাদে আত্মস্থ হয়ে কবি বলেন- ‘যখন আমি ক্যাপিটাল পড়ি, তখনই আমি আমার নাটকগুলো বুঝতে পারলাম। মূলত মার্ক্সই ছিলেন এ নাটকগুলোর একমাত্র দর্শক’। তারপর থেকেই জার্মান সাহিত্যকলায় ক্রমাগত এক্সপ্রেশনিজম বাতিল হয়ে যে নিউ এক্সপ্রেশনিজমের উন্মেষ হয়, ব্রেশ্ট তাতে ‘মানুষের জন্য শিল্প’ এই মন্ত্র আরোপ করেন।
এইভাবে তিনি বিদ্যমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সম্পর্কের জটিলতাগুলো মঞ্চে অত্যন্ত সফলভাবে তুলে ধরেন। তার নতুন টেকনিক ‘seperation of the element’ যেখানে সঙ্গীত, ভাষা আর রচনা মঞ্চায়নের এক নতুন সমন্বয় ব্রেশ্ট সামনে নিয়ে আসেন। দেখান, এগুলোর মধ্যে যেমন নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে; তেমনি আছে একটার উপর আরেকটার আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা। ব্রেশ্টের সমন্বয়ে এদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে স্বাধীন রেখে দেখানো হয় কিভাবে এরা একে অন্যের প্রবণতাগুলো ধারণ করে এবং তৈরি করে শিল্পের অপার বিভা! আর এইখানে তাকে সহযোগিতা করেন তৎকালীন তরুণ কম্পোজার kurt weill, casper neher প্রমুখ। life of galileo, mother courage and her children, the good person of szechwan, the resistible rise of arturo Ui, the caucasian chalk circle, fear and misery of the 3rd reich ইত্যাদি হলো ব্রেশ্টের অসাধারণ সব রচনা। সবগুলো নাটকেই একটা প্রচ্ছন্ন অথচ তীক্ষ্ণ বিরোধ তিনি আরোপ করেন তৎকালীন জার্মান সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধগুলোতে এবং এইভাবে তিনি বিরোধিতা করেন ইতিহাসের নৃশংস খুনি হিটলারের, তার দল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টির; সাথে সাথে ফ্যাসিস্ট আন্দোলনগুলোরও; যার পরিণতিতে তাকে দেশছাড়াও হতে হয়।
ব্রেশ্ট মনে করতেন- মঞ্চস্থ কোন নাটক যেন তার চরিত্র অথবা বিষয় দিয়ে দর্শকদের আবেগে ভাসিয়ে না দেয় বরং তার পরিবর্তে দর্শক মঞ্চে নিজেকে দেখুক, নিজের বর্তমান দশার প্রতিফলন দেখুক এবং তা দেখে জ্বলে উঠুক, ভাবিত হোক। মঞ্চে যে দর্শক আবেগে থরথর কাঁপেন, পর্দা নামার সাথে সাথেই এই আবেগমুক্তি ঘটে এবং দর্শক একধরনের আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকেন। এই কারণেই ব্রেশ্ট চাইতেন, মঞ্চে যথার্থ চরিত্র রূপায়ণের মাধ্যমে সামাজিক অবিচার এবং শোষণের এমন একটা ধারণা দর্শককে দিতে যেটা তাদের ভাবাবে; দেখাবে যেন তারা নিজেরাই এই সমস্যাগুলোর সাথে লড়ছেন; এবং সাথে সাথে এটাও তারা জানবে এর থেকে উত্তরণের রাস্তাও আছে; উত্তরণ সম্ভব! যেন নাটক বাস্তবতা নয়; তবে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। মঞ্চে এই প্রতিচ্ছবি যেমন নির্মাণ করা যায় তেমনি একে বদলানোও। কাজেই দর্শক যেন বুঝতে পারে, মঞ্চের বাইরে অবধারিত যে বাস্তব, তাও নির্মিত এবং চাইলে তাকে বদলে ফেলাও সম্ভব!
দুইঃ ‘the caucasian chalk circle’ বার্টল্ট ব্রেশ্টের এক অনবদ্য রচনা। ব্রেশ্ট যখন গল্পটি লিখেন তখন তিনি আমেরিকায়; নির্বাসিত। ১৪শ শতকে চীনের li xingdao রচিত ‘play circle of chalk’ গল্পটি ছিল এই রচনার মূল উৎস। জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজীতে এটি অনুবাদ এবং মঞ্চস্থ করেন এরিক বেন্টলি। ১৯৪৪ সাল, ফ্যাসিস্ট হিটলারের নেতৃত্বে গোটা বিশ্ব তখন খুনের রক্তাক্ত করাতে ধরাশায়ী। গল্পে ব্রেশ্টকে পাই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে এক তীব্র ভাষ্যকার হিসেবে।
গল্পের পটভূমি ইউরোপে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট লড়াই। তিরিশ বছর ধরে চলতে থাকা এ যুদ্ধে এক পর্যায়ে ক্যাথলিকরা আউসবার্গ দখল করে নেয়। চামড়ার ব্যবসায়ী প্রোটেস্ট্যান্ট চিংলি কে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হয়; তার কারখানা পুড়িয়ে দেয়া হয়। ক্যাথলিকদের কাছ থেকে জীবন রক্ষায় চিংলির স্ত্রী তাদের একমাত্র শিশু সন্তানকে ঘরে রেখেই পালিয়ে যান তার আত্মীয়ের বাসায়। নিজের জীবন বিপন্ন করে শিশুটিকে রক্ষা করেন সেই ঘরের একমাত্র পরিচারিকা আনা। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই সে যখন শিশুটিকে তার মায়ের কাছে ফেরত দিতে যায়, ভীত মা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকেন; তার আত্মীয়রা প্রোটেস্ট্যান্ট শিশুটিকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। বেচারি পরিচারিকা শিশুটিকে ফেলে দিতে পারে না। নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে তাকে লালন-পালন করতে থাকে। যুদ্ধের এই ভয়াবহতায় আমরা দেখি সম্পর্কের এক নতুন রূপ; আসল মা না হয়েও পরিচারিকা আনা হয়ে ওঠে শিশুটির মায়ের চেয়েও বড় কিছু! গল্প এগুতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হয়। আর একদিন আনা দেখে তার ঘর থেকে চুরি হয়ে গেছে আদরের সন্তানটি।
আনা ছুটে যায় মিসেস চিংলির ঘরে। যদি সন্তান না থাকে তাহলে মিসেস চিংলির পক্ষে চিংলি প্রোপার্টির মালিক হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আনার ত এসবের প্রতি কোন লালসা নেই; সে শুধু তার সন্তানকে ফিরে পেতে চায়। মিসেস চিংলির প্রত্যাখানে অসহায় আনা বিচারকের আদালতে ফরিয়াদ নিয়ে যায়। এইখানে আমরা দেখি চক সার্কেলের মাহাত্ম; বিচক্ষণ বিচারকের বিচার; যেন নাটকের ভেতর আরেকটা নাটক! প্রাচীন উপাখ্যানের শানে-নূযুল কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞ বিচারক সন্তানসহ দুই মাকে ঠেলে দেন চক(খড়িমাটি) দিয়ে আঁকা বৃত্তের ভেতর; যেন তারা দু’জন গায়ের জোরে সন্তানের দুই হাত ধরে টান দেয় আর যে শক্তিশালী, যার মমতা বেশি সে ফিরে পায় তার প্রাণের সন্তানকে। প্রিয়তম সন্তানের হাত ছিঁড়ে যাবার ভয়ে ভীত আনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সম্পদলোভী জন্মদাত্রী প্রকৃত মা মিসেস চিংলি ছোট্ট ছেলেটাকে এক হ্যাঁচকা টানে বৃত্তের বাইরে নিয়ে যায়; বেচারি আনা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কিন্তু বিচারক যা বোঝার বুঝে গেলেন! এতক্ষণ আনাকে দেখে ছেলেটার কান্নাকে যিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি এবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন- আনাই শিশুটির মা হওয়ার যোগ্য!
গল্পটি আমাদের দেখায় যুদ্ধ কিভাবে সকল দেশ, দেশের দরিদ্র জনগণের উপর চেপে বসে এবং তাদের নিঃস্ব করে দেয়। যে অন্যায়, যে জিঘাংসা তারা নিজেরা ডেকে আনেনি, তার ফল কত নির্মমভাবে তাদের ভোগ করতে হয়। যুদ্ধে কিভাবে মূল্যবোধের মৃত্যু ঘটে, ভালোবাসা হয় পলায়নপর, স্বার্থপর; যুদ্ধ কিভাবে দূর থেকে দূরের জনপদও গুড়িয়ে দেয়, ধূলিসাৎ করে তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা, বাঁচার তাগিদ! পাল্টা দিকও ব্রেশ্ট আমাদের দেখান। এমন চরম মূহুর্তেও মানুষের ভেতর অটল থাকতে পারে ন্যায়বোধ; সর্বহারা হয়ে গিয়েও মানুষ পারে সত্যের প্রতি দৃঢ় থাকতে! যত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই হোক, ব্রেশ্ট আমাদের বলেন, তবুও পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ন্যায়ের লড়াই চলে, উত্থিত হয় এইসব অপ্রিয় প্রশ্ন যা শেষতক পরাজিত করে দানব লুটেরাদের। গল্পের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হল- আমাদের অতীত, প্রাচীন ঐতিহ্য যে প্রক্রিয়াগুলোর মধ্য দিয়ে আগলে রাখে সমাজ বিকাশের জন্য অপরিহার্য ন্যায়, প্রীতি, প্রেম, বিচারসহ যাবতীয় মূল্যবোধ, তার একটা সৃজনশীল চিত্রায়ন!
‘Mother courage and the children’ গল্পটিও যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। ১৯৩৯ সালে রচিত অন্যায় যুদ্ধ ও ফ্যাসিজম বিরোধী এ গল্পে ব্রেশ্ট একজন মাকে দেখান যে যুদ্ধে একে একে তার তিন সন্তানকে হারান এবং এই হারানোর ভেতর দিয়েই তিনি বেঁচে থাকার সংগ্রাম করেন। শুধু যুদ্ধ এবং ফ্যাসিজম বিরোধী গল্পই নয়, ব্রেশ্ট তার রচিত গল্পে তুলে ধরেন মানবিক বহু সম্পর্কের চিত্র, তাদের মধ্যকার যোগাযোগ, বদল; সেখান থেকে বাঁচার অনুপ্রেরণা, হারিয়ে নির্বাক হয়ে বসে থাকা। তিনি ইতিহাস থেকে বাস্তব চরিত্রগুলো টেনে আনেন; তাদের জীবনের এমন কিছু দিক নিয়ে তার ভাষাশৈলী কথা বলে যেটা ব্রেশ্টের লক্ষ্য অনুযায়ী আমাদের ভাবায়; আলোড়িত করে। ‘হিমায়িত মোরগের গল্প’-তে আমরা ব্রিটিশ লর্ড চ্যান্সেলর ফ্রান্সিস বেকনকে পাই যিনি ছিলেন একজন দার্শনিকও। উৎকোচ গ্রহণ করে যিনি অসংখ্য অন্যায় কাজ করেছেন; এমনকি মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দিয়েছিলেন। যার শাসনকাল ব্রিটিশ ইতিহাসে একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়।
কিন্তু ব্রেশ্ট আমাদের পাল্টা দিকও দেখান। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর বেকন তার নিজস্ব জমিদারবাড়িতে ফিরে আসেন। জীবনের শেষ দিনগুলো পার করছিলেন দর্শন ও প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে। একদিন তাঁর সাথে পরিচয় হলো বাড়ির আস্তাবলের কাজে নিয়োজিত কিশোর ডিকের সাথে। বৃদ্ধ বেকন যেন একাকিত্ব দূর করার সঙ্গী পেয়ে যান। বাড়তে থাকে তাদের ঘনিষ্ঠতা। বেকন ডিককে বিজ্ঞানের শিক্ষা দেন। ভাষা প্রয়োগের শিক্ষা দেন। কৌতূহলী করে তোলেন প্রকৃতির নানান সৃষ্টির প্রতি। গল্পের শেষে আমরা দেখি যখন বৃদ্ধ বেকনের শেষকৃত্য চলছিল, বালক ডিকের যেন সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে তাকিয়ে আছে সাতদিন ধরে বরফ আচ্ছাদনে সতেজ থাকা মৃত মুরগিটির দিকে; যেটা আগুনে পুড়ছিলো; কৌতূহলী ডিক এটা খেয়ে দেখতে চায় – এর স্বাদ এখনো আছে নাকি এটা পচে গেছে। ব্রেশ্ট কৌতুক করে বলেন- যদিও বেকন তার সমসাময়িক অনেকের বিরাগভাজন ছিলেন কিন্তু এও ঠিক যে তিনি অনেককে করে গেছেন বিজ্ঞানমনস্ক; গবেষণায় আগ্রহী!
ব্রেশ্টের গল্পে আমরা মহান বিজ্ঞানী ব্রুনোকে পাই যাকে চার্চ ধর্মদ্রোহী বলে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু ব্রেশ্ট ইতিহাসের এই যন্ত্রণাকে আরো সঠিকভাবে তুলে ধরেন আমাদের কাছে। দেখান, ব্রুনো কখনোই ধর্মদ্রোহী ছিলেন না। তিনি শুধু তার পর্যবেক্ষণের পক্ষে অটল থেকেছেন; বলেছেন সূর্য একটা নয়; মহাবিশ্বে সূর্য অসংখ্য! তাহলে ধর্মদ্রোহীতার যে অভিযোগ, তার ভিত্তি কোথায়? মসনিগো নামে একজন সম্ভ্রান্ত লোকের আমন্ত্রণে ব্রুনো কিছুদিন তার বাড়ির আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আদতে চতুর মস্নিগোর উদ্দেশ্য ছিলো ব্রুণোর কাছ থেকে প্রকৃতি বিজ্ঞান ও যাদুবিদ্যার জ্ঞান আয়ত্ত করা। ব্রুনো যদিও প্রকৃতি বিজ্ঞান নিয়ে অনেক আলোচনাই করলেন, যাদুবিদ্যার কথা কিছুই বললেন না। এতে মসনিগো ভীষণ চটে যায়। অকৃতজ্ঞ বলে গালি দেয় এবং এতোদিন ধরে তার যে আতিথেয়তা, তার খরচ চেয়ে বসে। অন্তরঙ্গ আলাপে ব্রুনো চার্চ, যীশু, তৎকালীন রোমান সমাজব্যবস্থা, পাদ্রীদের ব্যপারে তার মুল্যায়ন মসনিগোর কাছে তুলে ধরেছিলেন। এইসব সহ আরো নানাবিধ মিথ্যা মিশিয়ে মসনিগো মহান বিজ্ঞানী ব্রুনোর বিরুদ্ধে রোমান আদালতে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ তোলে!
এইভাবে ব্রেশ্টের গল্পে মহান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও আসেন, মহান দার্শনিক সক্রেটিস আসেন, সম্রাট সিজার আসে। ইতিহাসের জীবন্ত, প্রভাবশালী চরিত্রগুলোর চিত্রায়ন; তাদের সমাজের ন্যায়, অন্যায়, বিচার, কুটিলতা ইত্যাদির বর্ননা আমাদের কম্পিত করে। অথচ ভাষায় ব্রেশ্টের কোন চঞ্চলতা নেই, কোন উগ্রতা নেই; কোন অস্থিরতা নেই; যেন একটা দৃশ্যের পর অবধারিত আরেকটা দৃশ্য; কোন কম্পন নেই, কোন আহাজারি নেই। যেন স্রোতের শব্দে অথবা গর্জনে তাঁর কোন আগ্রহ নেই; আগ্রহ কেবল তার বয়ে যাওয়ায়! সেটাই লক্ষ্য; যেন তা পাঠককে ভিজিয়ে দেয়, ভাসিয়ে নেয় পাড়ে; তবে যেন পাঠক ডুবে না যায়!
তিনঃ ব্রেশ্টের কবিতার অনেকগুলো দিকের মধ্যে প্রধান হল এর কন্টেন্ট যা সামাজিক বাস্তবতায় ঋদ্ধ, দীর্ঘ এবং রচনামূলক; আবার তার গল্পের মতই এতে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে জমা হয় ঐতিহাসিক ঘটনাপুঞ্জ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির বাহারি উপাদান যার ভেতর দিয়ে ব্রেশ্ট তার চিন্তা পাঠকের মননে প্রবেশ করিয়ে দেন; সাথে সাথে কবি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন চলমান বাস্তবতাকে । ব্রেশ্ট এমন এক কবি যার জীবনকাল দুটো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের চাক্ষুষ সাক্ষী এবং এর থেকে তিনি মোটেও পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন নি; বরং এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই নিষ্ঠুরতার মুখোশ উন্মোচন করেছেন এবং এর ভেতরে থেকেই দেখিয়েছেন- এখান থেকেও উত্তরণ সম্ভব! ‘the mask of evil’ কবিতায় কবি বলেন- আমার দেয়ালে ঝোলে জাপানের কাষ্ঠকারুকাজ/ দৈত্যের মুখোশ এক, স্বর্ণে প্রলেপিত। / বেশ একাগ্র মনে দেখি / মাথার ফুলে ওঠা শিরা উপশিরা, যা বলে দেয় / ভয়াল মন্দ হওয়া কত যে কষ্টসাধ্য তা। (অনুবাদঃ মফিজ দ্বীন শেখ) মুখোশে ঢাকা দৈত্য যার মাথার শিরা উপশিরা ফুলে উঠেছে; কবির কাছে মনে হল মন্দ হওয়া কতটা কঠিন! আর এইভাবে ব্রেশ্টিয়ান স্টাইলে কবি আমাদের এর পাল্টা দিকটাও ভাবতে বলেন; যেন দৈত্যের মুখোশ থেকে ঠিকরে ওঠা যন্ত্রণা আসলে তার দ্বারা সৃষ্ট অজস্র বিভীষিকা আর মৃত্যুর দলিল; স্বর্ণে প্রলেপিত লুটেরাদের সাথে আমরা পরিচিত হই।
কবি বলেন, আগে খাবার; তারপর নীতি-নৈতিকতার তালিম। নির্বাসিত কবি যুদ্ধবিধ্বস্থ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন সবসময় সবখানেই ক্ষুধার্ত মানুষের ভাষা আর অভিব্যক্তি এক ও অভিন্ন। সাম্যসমাজের স্বপ্ন দেখা কবি উপলব্ধি করেছেন- সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আর রাষ্ট্রের শাসক-শোষক শ্রেনীর কারণেই অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি। আর এ জুলুমের ফল তাদেরকেই ভোগ করতে হয় যারা এর জন্য দায়ী নয় মোটেও। ব্রেশ্টের কবিতায় জীবন সংগ্রামে জর্জরিত সাধারণ মানুষ, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নিষ্পেষিত মানুষ, বিত্তবান হৃদয়হীন সুবিধাবাদী সুশীল, যুদ্ধে একের পর এক সাধারণ সৈনিকের মৃত্যু, শিশুদের মৃত্যু, ফ্যাসিজমের ভয়াবহ আগ্রাসন, মানবিক যন্ত্রণা, দখল হয়ে যাওয়া স্বপ্ন, সংগ্রামী মা যেমন প্রাঞ্জল কথন আর ভাষার নিয়ন্ত্রিত শুদ্ধ প্রয়োগে ফুটে ওঠে, তেমনি এর পাল্টা দিকও দেখি – নতুন জীবনের জন্য লড়াইরত সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিকদের; এন্টি-ফ্যাসিস্ট মুভমেন্ট; কমিউনিস্টদের উত্থান। ‘To posterity’ কবিতায় কবি বলেন- ‘বিশৃংখল সময়ে শহরগুলোতে হেঁটে যাই আমি/ তখন তারা ক্ষুধার জালে বন্দি;/ বিদ্রোহের সময় তাদের কাছে ছুটে যাই আমি/ বিদ্রোহ করি তাদের সাথে মিলে; / আর এইভাবে আমার সময় অতিবাহিত হয়।/ যুদ্ধ-ময়দানেই আহার করেছি আমি / আর ঘুমিয়েছি খুনিদের রক্ত-চোখের ছায়ায়’।
বার্টল্ট ব্রেশ্ট সরাসরি শ্রমিক শ্রেনীর রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দুনিয়ার পরিবর্তন তিনি দেখেছিলেন খুব কাছ থেকেই। karl korsh নামে তৎকালীন জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির একজন বিপ্লবী নেতার সান্নিধ্যে এসে ব্রেশ্ট মার্ক্সবাদে আরো গভীরভাবে আত্মস্থ হন। তিনি বুঝতে পারেন দুনিয়ার সব ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব, লড়াই, সংগ্রাম এবং পরিবর্তনের চেহারা শুধুমাত্র শ্রেনী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলেই তাদের ঠিকভাবে বোঝা যাবে এবং জানা যাবে ভবিষ্যতের করণীয় প্রসঙ্গেও। এই সত্যজ্ঞান অর্জন করে কবি তার কবিতায় কথন এবং কাব্যময়তার এক প্রখর, তীব্র, অন্তর্ভেদী সংশ্লেষ ঘটান। ১৯৩৩ সালে ফ্যাসিস্ট খুনি হিটলার ক্ষমতায় এলে ব্রেশ্টকে জার্মানী ছাড়তে হয়। ডেনমার্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইডেন, আমেরিকার মত দেশে জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কবিকে নির্বাসিত থাকতে হয়। ডেনমার্কে বসে লেখা ‘the exile of the poets’ কবিতায় ফুটে ওঠে কবির নির্বাসিত জীবনের দহন-যন্ত্রণা। ‘হোমারের কোন আবাস ছিল না/ ঘর ছাড়তে হয়েছিল দান্তেকেও / লুক্রেটাস নির্বাসনে গিয়েছিলো/ হেইনেও; আর ডেনমার্কে নির্বাসিত / ব্রেশ্টকে শুতে হচ্ছে খড়ের ছাদের নিচে’!
দিমিত্রি থিওরি ( Dimitri theory) অনুসারে, মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে তৎকালীন ফ্যাসিস্টবিরোধী লড়াইয়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, ব্রিটেনদের সাথেও ঐক্যের প্রশ্ন সামনে আসে; যদিও মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত বিপ্লবীদেরই অনেকটা একা একা এই লড়াই করতে হয়; ঠিক সময়ে আমেরিকা, ব্রিটেনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে। কবি ব্রেশ্ট যখন দেখেন আন্টি-ফ্যাসিস্ট মুভমেন্ট পরাজিত করেছে ফ্যাসিস্ট হিটলারকে, তিনি আনন্দে, আবেগে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন; স্বপ্ন দেখতে থাকেন একদিন এইভাবে শ্রমিক-রাজ তথা নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর সমাজ প্রতিষ্ঠারও। শ্রমিক শ্রেনীর নেতৃত্বে বিপ্লবী লড়াই সংগ্রামের ব্যপারে স্পষ্ট ধারণা ছিল কবির। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই যে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক লড়াই-সংগ্রামগুলো নিরন্তর দানা বাঁধছে- এর মধ্যদিয়েই শ্রমিক সংগঠন আরো বলিষ্ঠ হবে; সৃষ্টি হবে ধ্রুপদী নেতৃত্বের। ‘in praise of the work of the party’ কবিতায় কবি বলেন- ‘একজন মানুষের কেবল দুটো চোখ থাকে/ কিন্তু একটা পার্টির থাকে শতসহস্র চোখ/ একাকী একজন মানুষ বিলুপ্ত হতে পারে/ কিন্তু একটা পার্টি কখনোই বিলুপ্ত হয় না’।
শ্রমিক শ্রেনীর তথা নিপীড়িত মানুষের লড়াই ছাড়া মুক্তির আর কোন পথ কবি খুঁজে পান না। যারা লড়াই করছে, কবি তাদের প্রশংসিত করেন। বলেন- হ্যাঁ, একটা সময় আসবে যখন/ যারা জ্ঞানী, ভদ্র;/ যারা ক্ষুব্ধ, বিশ্বস্থ/ যারা অনাবৃত পাটাতনের উপর বসে লিখে/ যারা বঞ্চিত এবং সংগ্রামীদের পক্ষে লড়াই করে/ তারাই সবার উপরে থাকবে/ সম্মানিত হবে’। সেই সাথে কবি সমালোচনা করেন সেইসব উদার সাম্যবাদীদের, বাম তথাকথিত গণতন্ত্রীদের, মানবতাবাদী মুখোশের আড়ালে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার সুবিধাভোগকারীদের, উদারতাবাদীদের, মানবপ্রেমী-জ্ঞানহিতৈষীদের, সামারিটান্সদের। ‘The interrogation of the good’ কবিতায় কবি বার্টল্ট ব্রেখ্টের কাব্যভাষার একটা ভিন্নরূপ দেখি; শান্ত অথচ প্রচ্ছন্ন আগ্রাসী! কবি লিখলেন- ‘ সামনে আগাওঃ আমরা শুনছি / যে তুমি একটা ভালা মানুষ। / তোমারে কিনা যায় না; কিন্তু দিনের-আলো / যেইটা ঘরের আন্ধার দূর করে- তাও/ ত কিনা যায় না। / তোমার জবানের নড়চড় হয় নাই।/ তয় তুমি জানি কি কইছিলা?/ তুমি সৎ; এইটা তোমার খেয়াল।/ কেমন খেয়াল ? / তুমি ভয়ডরহীন।/ কার সামনে? / তুমি গুণীলোক।/ কার লাইগ্যা? / নিজের ভালামন্দ’র দিকে তোমার ভ্রুক্ষেপ নাই।/ তাইলে কার ভালামন্দ তুমি দ্যাখো?/ দোস্ত হিসাবে তুমি ভালাই। / তুমি কি আসলেই ভালা মাইনষ্যের দোস্ত ?/ তাইলে এইবার আমরারে শুনোঃ আমরা জানি।/ তুমি আমাগোর শত্রু। এই কারণেই আমরা / এখন তোমারে একখান দেওয়ালের সামনে খাড়া করাবো। কিন্তু তোমার / বিদ্যা-বুদ্ধি আর ভালা চিন্তাগুলা মাথায় রাইখা / তোমারে সত্যই ভালা দেওয়ালের সামনে খাড়া করাবো; শেষে গুলি করবো/ একটা ভালা বন্দুকের ভালা বুলেট দিয়া; এরপরে পুইতা ফেলবো / একখান ভালা খুন্তি দিয়া ভালা মাটির তলে!)
আমেরিকায় নির্বাসিত থাকার সময় কালের এই মহান কবি এবং নাট্যকারকে আমেরিকান প্রশাসন তৎকালীন হলিউডে মার্কিন জাহানের ভাষায় রাষ্ট্রদ্রোহী লেখক সংঘ ‘Screen writers guild’ এবং ‘Amrican communist party’’র সদস্য হিসেবে সে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। ১৯৪৭ সালের ৩০ অক্টোবর আমেরিকার ‘House of Un-American Activities Committee’র (HUAC)জেরার মুখে পড়তে হয় কবিকে। সেদিন ব্রেশ্টের দেয়া জবানবন্দি আমাদের জানায় কবির স্পষ্টবাদিতা, শিল্প সম্পর্কে তার বিশদ ধারণা এবং তার দর্শনের কথাও। কবি বলেছিলেন- “যেহেতু আমি যুক্তরাষ্ট্রের একজন অতিথি, তাই এর স্বার্থ পরিপন্থী রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে আমি বিরত থেকেছি; এমনকি আমার লেখালেখির মধ্যেও। এছাড়া আমি স্ক্রিন রাইটার্স গিল্ডের সদস্যও নই। প্রাগে নাৎসি বাহিনীর নৃসংশতা নিয়ে লেখা আমার একটি মাত্র গল্পই হলিউডে চিত্রায়িত হয়েছে। আমেরিকান চলচিত্রকে কখনোই আমি আমার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা অথবা শিল্পকলা দিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করি নি। যাই হোক, যেহেতু আজ আমাকে এইচইউএসি’র সামনে উপস্থিত করা হয়েছে, প্রথমবারের মত আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ব্যপারে কিছু বলার তাড়না বোধ করছি। ইউরোপে গত বিশ বছর ধরে একজন নাট্যকার ও কবি হিসেবে আমি যে অভিজ্ঞতা হাসিল করেছি, তার আলোকে বলতে চাই- সংস্কৃতির জমিনে আমেরিকার জনগণ যদি কাউকে তার মুক্তচিন্তা প্রকাশে বাধা দেয় অথবা শিল্পকে (art) তার নিজস্ব গতিতে চলতে না দিয়ে তার বিকাশে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে নিশ্চিতই তারা অনেক বেশি ঝুঁকি নেবে, হারাবেও অনেক কিছু! আমরা একটা ভয়ঙ্কর পৃথিবীতে বসবাস করছি। আমাদের সভ্যতার চেহারা এমন যে যদিও আমরা ইতিমধ্যেই অনেক বেশি সম্পদশালী হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছি, কিন্তু তবুও; সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে দারিদ্রতা শুধু বেড়েই চলেছে। একের পর এক যুদ্ধ আমাদের সর্বনাশ করেছে; বলা হচ্ছে, তারচেয়েও বড় যুদ্ধগুলো আসন্ন। হতে পারে, তাদের কোন একটা গোটা মানব সভ্যতাকেই বিলুপ্ত করে দেবে। দুনিয়াতে আমরাই হয়ত মনুষ্য নমুনার শেষ প্রজন্ম! সত্যি বলতে কি, ঘোড়ার ঘানি টানার সেইসব দিন থেকে আজকে পর্যন্ত আমরা উৎপাদনের নতুন সক্ষমতাগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি নি। কাজেই এই দুর্দশাগ্রস্থ সময়ে তোমরা কি আসলেই মনে কর, সবগুলো নতুন ধ্যান-ধারণাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নগ্ন করেই তবে প্রয়োগ করতে হবে? প্রকৃতপক্ষে কেবল শিল্পই পারে এইসব নতুন ধ্যানধারণাগুলোকে পরিচ্ছন্ন এবং মহৎভাবে উপস্থাপন করতে!’’
১৯৪৯ সালে ব্রেশ্ট জার্মানীতে ফিরে আসেন এবং স্থায়ীভাবে তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে বাস করতে থাকেন। ১৯৫৬ সালের ১৪ আগস্ট দেহান্তরিত হন কালের এই মহান স্রষ্টা। দেখা গেল, জার্মানির বুর্জোয়া সমাজ, কপট সুশীলেরা তাঁর মৃত্যুর ব্যপারে ব্যপক নিস্পৃহ; কারণ একটাই নৈতিকতার প্রশ্নে মহান ব্রেশ্ট ছিলেন ঠিক তাদের বিপরীত। কিন্তু যাদের জন্য তাঁর সব সৃষ্টকর্ম, যাদের জীবনকে শিল্পের দ্যুতিময় আভায় তিনি মহিমান্বিত করেছেন, তারা ঠিকই মনে রেখেছে তাঁকে; সেদিনও যেমন, আজও! বার্লিনে যে বাড়িতে ব্রেশ্ট বসবাস করতেন, লিখতেন; তার পাশে একটা ধাতুনির্মিত ফলকে কোন এক নাম না জানা শ্রমিক টাঙ্গিয়ে দিয়েছে দুটো লাইনঃ “Where is Ausberg? The city which is silent about its great son.”
(এপ্রিল ২০১৩)
তথ্যসূত্র এবং কৃতজ্ঞতাঃ ১। ‘The interrogation of the good’ – কবিতাটি শ্লাভোয় জিজেকের করা ইংরেজি অনুবাদ থেকে অনূদিত।
২। ‘বার্টল্ট ব্রেশ্টের কিছু গল্প কিছু কবিতা’ রচনাঃ মফিজ দ্বীন শেখ
৩। কৃষাণ রয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
৪। এরিক বেন্টলি; পরিচালক এবং অনুবাদক
৫। আয়ান ম্যাকডায়ার্মিড, জাকুপ মাটো, রাইনাশ ইদ্রিজি, ভ্যাংজুশ জিকো, আনাসতাস কাপুরানি’র আলোচনা
৬। ইন্টারনেট