স্পেনের ১৯২৭-র কবি প্রজন্ম । ভূমিকা ও অনুবাদ ওমর শামস
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জানুয়ারি ২০১৪, ৭:২০ অপরাহ্ণ, | ২৯৪০ বার পঠিত
১৯২৭ স্পেনের আধুনিক কবিতার এক মহেন্দ্র-ক্ষণ। ওই বছর থেকেই এক কবি প্রজন্মের হিশেব করা হয় যারা এক গুচ্ছ কবি নক্ষত্র। অন্তত ১০ জন কবি, যাঁদের প্রত্যেকেরই জন্ম ১৯০০ সনের একটু আগে বা পরে, তাঁরা স্পেনের কবিতাকে তার ক্লাসিকাল যুগ থেকে সমুত্থিত করে আপাদমস্তক আধুনিক বোধ ও শিল্প সৌকর্যে মহিমান্বিত করেন ১৯২৭ শুরু করে। এই কবিরা হচ্ছেনঃ পেদ্রো সালিনাস (নভেম্বর ২৭, ১৮৯১-ডিসেম্বর ৪, ১৯৫১), হোর্খে গিয়েন (জানুয়ারি ১৮, ১৮৯৩ – ফেব্রুয়ারি ৬, ১৯৮৪), হেরার্দো দিয়েগো (অক্টোবর ৩, ১৮৯৬ – জুলাই ৮, ১৯৮৭), দামাসো আলোন্সো (অক্টোবর ২২, ১৮৯৮ – জানুয়ারি ২৫, ১৯৯০), ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা (জুন ৫, ১৮৯৮-অগাস্ট১৯, ১৯৩৬), রাফায়েল আলবের্তি (ডিসেম্বর ১৬, ১৯০২-অক্টোবর ২৮, ১৯৯৯), বিথেন্তে আলেহান্দ্রে (এপ্রিল ২৬, ১৮৯৮-ডিসেম্বর ১৪, ১৯৮৪), লুইস থেরনুদা ( সেপ্টেম্বর ২, ১৮৯১ – নভেম্বর ৫, ১৯৬৩), এমিলিও প্রাদোস (মার্চ ৪, ১৮৯৯ – এপ্রিল ২৪, ১৯৬২), মানুয়েল আলতোগিয়ের্রে (জুন ২৯, ১৯০৫ – জুলাই ২৬, ১৯৫৯) । এঁরা প্রত্যেকেই স্বপ্রতিভায়, স্বকীয় কল্পনায়, প্রাতিস্বিক প্রকাশে বিশিষ্ট।
ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান সাহিত্যের রোমান্টিসিজম কাল-পর্ব ঠিক স্পানিশ সাহিত্যে আসে নি। বিশ শতকে পড়ে, এই সব কবিরা য়ূরোপীয় অন্যান্য ভাষার আধুনিক বোধ এবং শৈলী উভয়ের সঙ্গেই পরিচিত হলেন। আর ফরাসী ভাষা তো স্পানীশ-এরই সহোদরা, যে ভাষাতে বোদলেয়ার, র্যাঁবো, মালার্মে একটি বিশিষ্ট কবিতা-ধারা তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং যার ঢেউ ইংরেজি, জার্মান সহ অন্যান্য ভাষাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সাতাশের কবিগোষ্ঠী ফরাসি আভাগার্ড-এর সঙ্গে পরিচিত হলেন, সঙ্গে-সঙ্গে তাঁদের নিজের ভাষার ক্লাসিক কবি – গংগোরা, লোপে-দে-বেগা, কেবেদো – এঁদের কাব্যশৈলীর পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রয়োগ ঘটালেন। এ ব্যাপারে থেরনুদা, লোরকা, গিয়েন, সালিনাস, আলবের্তি, এঁরা প্রবন্ধ লিখে তাঁদের ধারণাকে প্রতিষ্ঠ করেন। সুররিয়ালিজম, স্পানীশ জীবন বিশেষ করে আন্দালুসিয়ার, গৃহযুদ্ধ ও তার পরের অবস্থা, বাম রাজনৈতিক আবহ – এই সবগুলো কবিতার বিষয়কে চিহ্নিত করে সঙ্গে-সঙ্গে ফর্ম, বাগ-ভঙ্গী, সিনট্যাক্স বিন্যাস-অবিন্যাস, মাত্রা-কৌশল, নতুন চিত্রকল্প – এ-সব এই কালের কবিতাকে এক নতুন শক্তি ও সংহতি দ্যায়। এবং এতোটাই যে এই প্রজন্মের কবিতা পৃথিবীর অন্য যে কোন ভাষার কবিতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।
এই বিষয়ে সৎ আলোচনা নিদেন পক্ষে একটি পুস্তকের দাবি করে। আপাতত সে সম্ভব নয়। এখানে আমি এই ১০ কবির মধ্যে দামাসো আলনসো এবং মানুয়েল আলতোগিয়ের্রে ব্যতিরেকে বাকি ৮ জনের প্রত্যেকের একটি করে কবিতা অনুবাদ প্রকাশ করছি।
সত্তর থেকে আশির দশকে এককালে লোরকা, নেরুদা এবং ভায়্যেহো-র কিছু অনুবাদ করেছিলাম। ইচ্ছা ছিলো সাতাশের কবিদের নিয়ে লেখা। এখানে তার কেবল শুরু। বাংলায় ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা সমধিক পরিচিত নানা কারণে, অন্যরা অতোটা নয়। আমার ইচ্ছা থাকলো, এঁদের প্রত্যেকের আরও বিস্তারিত পরিচয় করানোর। সময় প্রমাণ করবে কতোটা পারি।মৃত্যু
পেদ্রো সালিনাস
প্রথমেই ভুল্লাম তোমার কণ্ঠস্বর –
যদি এখানে থাকতে আমার পাশে,
আমি জিজ্ঞেস করতাম, “কে” ।
তারপর আমি ভুলে গেলাম তোমার পায়ের ধাপ।
মাংশের হাওয়ার মধ্যে যদি লুকতো কোন ছায়া,
আমি জানতাম না যে সে তুমি!
শীত আসার আগে, তোমার সব পাতা
ধীরে ধীরে ঝ’রে পড়লো : হাসি,
চাহনি, তোমার জামার রঙ,
তোমার জুতোর মাপ।
তারপরও, আরো ঝরতে লাগলো তোমার পাতা :
কায়ার থেকে মাংশ, তোমার দেহ।
শুধু তোমার নাম থাকলো আমার কাছে,
তোমার সাতটি অক্ষর।
আর তার মধ্যেই তুমি জীবন্ত
অস্থির ব্যতিব্যাস্তভাবে সংশয়ী
রুহু ও বদনসহ –
তোমার কংকাল, তার গড়ন,
তোমার স্বর, তোমার হাসি, সাতটি অক্ষর
– ওই সব অক্ষর।
তুমি ঘুরে চললে – একা, আর তোমার দেহ।
আমি তোমার নাম ভুলে গেলাম।
সাতটি অক্ষর ঘূর্ণ্যমান – অপরিচিত,
একে অন্যকে চেনে না।
সেগুলো পরিবহনের বাসে
বিজ্ঞাপন হয়ে যায়, রাত্তিরে রঙে জ্বলে,
তারা অন্য নামে চিঠিতে চলে যায়।
তুমি হয়তো কোথাও!
বিচ্ছিন্ন, ভগ্ন, অসম্ভব।
ওই তো তুমি, তোমার নাম, যা তুমি ছিলে –
উদ্ভূত –
মূর্খ সব স্বর্গের দিকে
বিমূর্ত আক্ষরিক ঔজ্জ্বল্যে।
অবনতির অবলোপ
হোরখে গিয়েন
নিরালোক, এখন পুরোটা অন্ধকার, ভীষণ।
নিঃশব্দতা পেঁচিয়ে রাত্রি
চ্যাঁচানো জানোয়ারসহ হামা দিয়ে আসে।
কোনো ভয়ে তুমি বিপন্ন?
ভয় পেয়ো না।
চিৎকার !
দুর্যোগ তার কচ্ছপ আর গার্গয়েল
রাত্রির তলে জট খায়, প’ড়ে যায়,
রূপান্তরিত হয় রাত্তির। সবটাই গভীরতা রাত্রির,
তারপর ভোর।
সূর্য উন্মোচিত করবে
একটি সরল সমতলের সুন্দর নির্মলতা।
তোমার হৃদয় আমি পরতে পরতে খুল্লাম
হেরার্দো দিয়েগো
তোমার হৃদয় আমি পরতে পরতে খুল্লাম,
দেখলাম ভিতরে কি :
নরোম হাড়ের খিলান
তাদের রেখার পাতলা প্রতিরোধ,
তোমাকে আমি তিলে তিলে চিনলাম।
কিন্তু ভুলে গেলাম গোপন-সূত্র –
কি ক’রে তোমাকে আবার জোড়া দিতে হয়।
এখন তোমার চেয়েও কম জানি তোমার হৃদয়,
আর এই জটিল খেলা
এখন একটি সমাধানহীন রহস্য!
পরকীয়া
ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা
তাহারে কুমারী ভেবে
নিলাম নদীর তীরে,
কিছুটা বাধ্য হয়ে।
অথচ সে ছিলো পরিণীতা।
শবে-বরাতের রাত ছিলো –
নিভেছিলো দীপাবলী
জ্বালিয়ে জোনাক ।
পেরিয়ে পথের বাঁক লোকালয়
ছুঁলাম সুনিদ্রিতা স্তন দুটি,
স্ফুটলো কদম ফুল থোকা।
আব-মাড় তার পেটিকোটে
জাগালো আওয়াজ, যেন কাঞ্জিভরম
ছিন্ন-ছিন্ন শত ছুরিকায়।
রূপালি আলোকহীন পল্লবে
গাছগুলো বড়ো, আরো বড়ো
মনে হয়েছিলো । নদী থেকে
দূরে আরো দূরে – সারাটি
আকাশ ভ’রে কুকুরের চিৎকার।
পেরিয়ে আমের বন
শর-কাশ-হোগলার ঝোপ,
তার কুন্তলদাম তলে
করলাম শয়নীয়।
আমি, খুললাম গ্রীবাবন্ধ,
সে তার বসন –
আমার কোমরবন্ধ্, বাঁধা পিস্তল।
মুক্তো-ঝিনুক কিবা শামুকেরও
নয় এতো মসৃণ গা,
রূপোর গেলাসও এতো
ঝক্ঝকে না।
যেমন চমকে ওঠে মাছ,
মিলালো যুগল ঊরু –
আধেক বরফ বাকি আধেক আগুন।
আমি আসোয়ারি , রেকাব লাগামহীন
ছুটলাম সব সেরা রাজপথে রাতে।
বল্বো না সে যা ব’লেছিলো,
আমিও মানুষ কি-না!
বয়স ও বিবেচনা
আমাকে করেছে মিতবাক।
আর আমি, যেহেতু জিপসি,
জিপসিরই আচার আমার।
দিলাম খোপার কাঁটা মেয়েটিরে –
পড়িনিকো প্রেমে ।
কেননা নদীর তীরে নিলাম যখন,
ব’লেছিলো – কুমারী সে –
আশলে সে ছিলো পরিণীতা।
বালির ফেরেস্তা
রাফায়েল আলবের্তি
আমি সিরিয়াস। তোমার চোখে সমুদ্র ছিলো দুই কিশোর – আমাকে নিরীক্ষ্যমান –
কটাক্ষ এবং কঠোর বাক্যের প্রতি ভয়ার্ত।
রজনীর দুই ভয়ানক কিশোর – নিষ্ক্রান্ত-আকাশ,
যাদের শৈশব ছিলো জাহাজের লুন্ঠন এবং চন্দ্র-সূজ্যির সন্ত্রাস।
ঘুমোও। বন্ধ করো।
আমি দেখেছি, আশল সমুদ্র ছিলো এক কিশোর, যে আনগ্ন লাফাচ্ছিলো,
আমাকে এক প্লেট নক্ষত্র আর সামুদ্রিক শৈবালের ঘুমে নিমন্ত্রণ ক’রে।
হ্যাঁ! হ্যাঁ! এখন আমার জীবন হয়ে যাবে, এখন ছিলো, একটি পরিত্যক্ত সৈকত।
কিন্তু তুমি, জেগে আমাকে ডুবিয়ে দিলে তোমার চোখের ভিতর।
জীবন
বিথেন্তে আলেহান্দ্রে
আমার বুকের মাঝে কাগজের পাখি এক কয়,
চুম্বন ক্ষণ – এখনও তো হয়নি সময়।
বাঁচো! বাঁচো! সূর্য আজ ভাঙ্গে নির্দৃশ্যত,
চুমু কিম্বা পাখি, এখুনি বা কাল, অথবা সে কখনোই নয়।
ছোট্ট আওয়াজই তাই মৃত্যু হননীয় –
ঢ’লে পড়ে কারুর হৃদয়।
অথবা এ পৃথিবীর অন্য কোন ঘেরে
সোনার জাহাজে চ’ড়ে সোনা-চুল রূপসী সে রয়।
ব্যথাতুর মাথা, তপ্ত কপোল, সূর্য মরণোন্মুখ –
এখানে এ তমসায় স্বপ্নে নদী বয়,
নল-খাগড়ায় সবুজ রক্ত উপচোয়;
খোয়াবে তোমাতে খুঁজি জীবন ও উত্তাপ সুখ।
যখন বসন্ত ছিলো
এমিলিও প্রাদোস
যখন বসন্ত ছিলো স্পেনে :
সমুদ্রের আড়াআড়ি, আয়নাগুলো
চূরমার করতো সব বারান্দা
এবং জেসমিন তার মিনিয়েচার
তারাটিকে বাড়াতে থাকতো রাত্তিরে
যতোক্ষণ না পৌঁছতো সৌরভের সীমানা …
যখন বসন্ত ছিলো।
যখন বসন্ত ছিলো স্পেনে :
নদীকূলে চাঁদ-প্রজাপতি
রেণু দিতো মেয়েদের নগ্ন শরীরে
এবং আমাদের হৃদয়ের
নিঃশব্দতার মধ্যে ফুটতো জুঁই
যতোক্ষণ না আমাদের দম
বন্ধ হয়ে যেতো …
যখন বসন্ত ছিলো।
যখন বসন্ত ছিলো স্পেনে :
সমস্ত সমুদ্রতট সংযুক্ত হতো
একটি আংটিতে আর তারপর
সাগর স্বপ্ন দেখতো
বালুকার উপর মাছের চোখের মতো
আকাশের মুখোমুখি, যা
হাওয়াহীন তরীর চেয়েও শান্ত
তার মণির মধ্যে।
যখন বসন্ত ছিলো।
যখন বসন্ত ছিলো স্পেনে :
তন্দ্রাচ্ছন্ন জলপাইগুলো কেঁপে উঠতো
দিনের নীল-লোহুর ভিতরে,
আর তখন সূর্য ষাঁড়ের চামড়া গড়িয়ে
পড়তো জমিনের মাটির দলায়
তক্ষুনি কোপানো কোদালের ফলায় …
যখন বসন্ত ছিলো।
যখন বসন্ত ছিলো স্পেনে :
ফুলন্ত চেরি গাছ
লাফিয়ে নিজেদের গেঁথে দিতো
স্বপ্নের জমিনে, ফুটতো ঠোঁট
প্রত্যূষের আকাশের বুদ্বুদে
যতোক্ষণ না আমাদের দেহ
ঝর্নার পানির মতো উচ্ছলিত …
যখন বসন্ত ছিলো।
যখন বসন্ত ছিলো স্পেনে :
সব মানুষ মৃত্যুকে আনগ্ন করেছিলো,
এবং মাটির উপরে সব্বাই একসঙ্গে
ছড়িয়েছিলো যতোক্ষণ না তারা
কাল বিস্মৃত হলো
এবং হৃদয় জ্ব’লে উঠে লঘু হলো …
যখন বসন্ত ছিলো।
যখন বসন্ত ছিলো স্পেনে :
আমি আকাশ খুঁজলাম, আমি আমার
আদিম অশ্রুবিন্দু খুঁজলাম, আর
সমস্ত নক্ষত্র আমাকে তুলে ধ’রে
আগের মতো একই বালিতে ছড়িয়ে দিলো,
রাত্রির ম্যাগনোলিয়ার সৌরভের মতো …
যখন বসন্ত ছিলো।
কিন্তু হায়! শুধু তখন …
যখন বসন্ত ছিলো স্পেনে,
তখন – যখন বসন্ত ছিলো।
রাত্রির পোষাক পরা অনুশোচনা
লুই থেরনুদা
কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে এক ধূসর লোক আসছে :
কেউ বুঝবে না কে! কিন্তু শূন্য কায়া সে,
সমুদ্র, বাতাস, প্রেইরি ঘাসের মতো ফাঁকা –
পাথুরে আকাশের নিচে এতো কটু অজন্মা।
সে গতস্য সময়। আর তার পাখা এখন
অন্ধকারের ভিতর কোন ফ্যাকাশে কঠোর কিছুর
সঙ্গে ধাক্কায়। সে অনুশোচনা। দ্বিধাগ্রস্থ, সে
তার আলুথালু ছায়াকে আগলায় রাত্তিরে।
হাত কাঁপিয়ো না। আরোহণশীল লতা উঠে
শীতের বৃক্ষের কান্ড ঢেকে দেবে।
অদৃশ্য ধূসর মানুষ নিস্তব্ধতার ভিতরে হাঁটে।
মৃতদের শুনতে পাও না? এখন মৃত্তিকাই ঠসা!