তিনটি কবিতা / ওমর শামস
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ডিসেম্বর ২০১৩, ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ, | ২০০১ বার পঠিত
ঋভু অনিকেত-কে
তার মা, ছেঁড়া আঁচল দিয়ে দেহ ঢাকে
আর বয়তুন, ছিদ্রগুলোকে জানালা মনে ক’রে সারা পৃথিবী দ্যাখে।
বাবাকে মনে নেই, লোকে বলে ম’রেছিলো বিলে মাছ ধরতে গিয়ে।
এখন সে তার মা-র আঁচলের তল থেকে দ্যাখে–
উঠনে ধান, বড়ুই গাছে টোনা, আমের বউল, বৈশাখে বিদ্যুৎ –
রাত্রির বৃষ্টির পরে সকালে কমলা–হলুদ কুমড়োর ফুল ফুটেছে।
গিঁটের নিচের অন্ধকার থেকে সে শুধু আলোর দিকেই তাকায়,
নিচে নয়–তার চিল শুধু উঁচু আর উঁচুতেই উড়তে পারে,
তার বিদ্যুৎ মাটির থেকে আসমানে ওঠে, ওপর থেকে নিচে নয়,
তার গাছ শুধু আকাশে, আকাশে আরো আকাশে পাতা নাড়ায়।
“তুনি, বালটি নিয়ে আয় – মা”। বয়তুন বড়ো হয়ে উঠছে।
কুপির আলোর থেকে হারিকেনের হলদে আলোয় ক, খ, মূর্ধন্য নাচে।
আবার পাখির ডাকেই যুক্তাক্ষর, শব্দ, বাক্য, সংখ্যা, শোলোক, পৃষ্ঠা
মনের মধ্যে পলির মতো জ’মে-জ’মে চর বাঁধে, আবার সহসাই
দুলিয়ে-ঝ’রিয়ে কাশ, পান কৌড়ির ঝাঁক হয়ে আকাশে উড়ে যায়।
সে এখন ওড়না পরে। ইশ্কুলে যায়…পায়ে চলার পথে,
ঐ লাইনটাই ঘুরে-ঘুরে পা-র সঙ্গে পা ফ্যালে– “ ক্যামন ক’রে
ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে, ঘূর্ণিপাকে”…বাঁকে পা ঘোরে।
অথচ দিগন্তের পথটা দিনে-দিনে কাঁটা–কাচ–শ্যাওলা-কাঁকরে-পাথরে
দুর্গম হয়ে উঠছে–ভূগোলের মাস্টার সেদিন অযথাই স্কুল শেষের
পর ব’সিয়ে রাখলো-রাবেয়া, ভাগ্যিস সঙ্গে ছিলো। মোকামতলির
দোকানগুলোর সামনে এখন বখাটেদের গালাজ-গোল-হট্টগোল,
উড়ন্ত-জ্বলন্ত সিগারেটের বাঁট :
“তোকে তুলে নিয়ে যাবো রে,
উড়িয়ে নিয়ে যাবো, কে ঠ্যাকাবে”?
ফেন্সিডিলের দুর্গন্ধ আর কালো নিকোটিন কুন্ডলী পাকায়…
হাঁস আর মুরগিগুলোকে আদাড় দ্যায় বয়তুন, উঠোনে; শুপুরি গাছে
একটা কাঠ-ঠোকরা, মেঘ ঠিক্রে রোদঃ
“তুনি, মা, কাপড়গুলো নেড়ে শুকোতে দে”…
দড়ির উপর কাপড় মেলতে থাকে বয়তুনঃ শাড়ী, শায়া, গামছা, চাদর
নিজের কামিজ, তারপর বালিশের অড়…
কোত্থেকে হাওয়া উঠে দড়ি দুলতে থাকে–
“কাপড় গুলো কি উড়ে যাবে না কি”?
বালিশের অড়ের সঙ্গে দুলতে থাকে বয়তুন–আরও, আরও…
“ছোটবেলার কাঁঠাল গাছের দোলনা যেন”? দোলে…বালিশের অড়ের
দুই কোনা স্নায়ুস্ফিত আঙুল-তালু–হাড়-শক্তি সদ্যজাত কব্জি হয়ে
বয়তুনের হাত ধ’রে দোলায়…দুল্তে-দুল্তে-দুল্তে উড়িয়ে নেয়
আকাশে…শুপুরি, নারকেল, তেঁতুল, বট…ওপরে আরও ওপরে…
একবার ঘাড় ফিরিয়ে বয়তুন দ্যাখে, গর্ত থেকে ছুটে দুটো শিয়াল
দৌড়চ্ছে ক্ষেতের আল দিয়ে…
উপরে, নীল, নীল, নীল-কি নীল আকাশ…
আসমানের কোলাজ
Never before in the history of Man has there existed so wide a gulf between
the progress of the scientific-technical realm and the barbarity of the moral-political realm.
Does the the twenty-first century promise something better?
— Carlos Fuentes
[জুন, ১৯১৫]
চলো তবে, তুমি আর আমি–যাই :
যেন, অ্যানেস্থিসিয়াগ্রস্থ শোথসান্দ্র রুগী,
ব্যাপৃত হয়ে আছে সন্ধ্যার স্কাই।
[১৯৩৭]
স্কাইলাইট মাথার উপর,
‘জন্মেছে জ্যোস্নার ডিম”–বুনোহংসী বলে–
“নীলাকাশে, দেহেরও ভিতর”;
সাঁই-সাঁই দুই পাখি ওড়ে–পিস্টন, পাখার গতর।
[অনন্তকাল]
“আজি এ নিবিড়তিমির যামিনী বিদ্যুতসচকিতা
বাদল বাতাস ব্যোপে” হৃদয় উঠেছে কেঁপে
সেকি জানো তুমি জানো,…জানো?
[ফেব্রুয়ারি ১৩-১৫, ১৯৪৫]
গোঁ গোঁ ডাকে ব্যোম,
মহাকাশ–বোমারুতে আচ্ছন্ন দিগ্-
সাইরেন…
ড্রেসডেনে বোমা পড়ে, আকাশ অন্ধ ক’রে–
হেল্মেটে ফ্রন্টে সৈনিক,
এখানে মিনার পড়ে, কারখানা, ক্যাথিড্রাল, স্তম্ভ পড়ে-
করিন্থিন, ডোরিয়ান-ছাদ-তলা-অট্টালিকা-সিঁড়ি ভেঙে-ভেঙে পড়ে–
মর্মর সিংহ ঝরে, এখানে আগুন জ্বলে:
কড়ি, বর্গা, ছাদ, থাম, দরোজা, জানালা জ্বলে–দাউ-দাউ রাস্তা জ্বলে–
বই, বাক্স, পালং, তোষক – দাউ-দাউ বৃক্ষ জ্বলে–
ঘাস, পাতা, ওক, বার্চ, সাইপ্রাস …
ফ্যাক্টরি, লরি, ট্রাক, তেল ডিপো, এরোড্রাম-দাউ-দাউ জল জ্বলে–
আকাশ অন্ধ ক’রে ড্রেসডেনে বোমা পড়ে-আকাশে আকাশ জ্বলে-
[অক্টোবর ৪, ১৯৫৭ – জুলাই ২০, ১৯৬৯]
আমি ইউরি গ্যাগারিন, অক্টোবর ৪, ১৯৫৭, আকাশে উঠছি–
সমুদ্র, তুন্দ্রা, পর্বত, বনভূমি, সমতল, মরুভূমি, নগর,
কি সুন্দর দ্যাখাচ্ছে পৃথিবী।
গ্যালিলিও, তুমি তো মহাকাশের দিকে তাকিয়েছিলে
টেলিস্কোপে চোখ দিয়ে–অসাধারণ, তোমার কল্পনা
অদৃশ্য বাস্তবতা কে চাক্ষুষ ক’রেছিলো।
তবু দেখে যাও, দেখে যাও…
আমি উঠছি ; সঙ্গে-সঙ্গে হে ভূ-পৃষ্ঠের মানুষ –
একজন, শ’-জন, অনন্ত জন হাতে হাত ধ’রে তোমাদেরও
উড়িয়ে নিয়ে চলেছি মহাকাশে, মহাকাশে, বিস্ময়ে।
আমি নিল-আর্মস্ট্রং, জুলাই ২০, ১৯৬৯, চাঁদে লাফাচ্ছি।
এসো হে মানুষ, অনুভব করো স্পন্দন,
সৃষ্টির ভর-ভরহীনতার সূত্র–
কি ক’রে জন্ম নিলো স্থান-কাল-ব্রহ্মাণ্ড!
একজন, শ’-জন, অনন্ত জন হাতে হাত ধ’রে তোমারাও–
এসো এই চাঁদে, অন্য চাঁদে, আরো-আরো চাঁদে নাচি।
[১৯৬৫ – ১৯৭৫]
জোছনার রাত, বোমা পড়ছে,
হো চি মিন শহরে, সড়কে বোমা পড়ছে –
উড়ছে B-52, B-57, Sky-Hawk, Dragon-Fly, F-105, F-111
এবং পড়ছে BLU-3, BOLT, Daisy Cutter, CBU-100 Cluster Bomb –
কিন্তু আমাদের মাথার মাথাল ভ্রূক্ষেপ করে না।
ছেলেরা যুদ্ধে, শিশুরা ঘুমিয়ে;
কাল বৃষ্টি হয়েছিলো আর আমরা ধান রুয়ে যাই।
[সেপ্টেম্বর ৫, ১৯৭৭ -]
সৌর-জগত ও তা ছাড়িয়ে ঘননীল মহাশূন্যের উদ্ভাসনে ছুটলো ভয়্যেজার–এখনও ছুটছে…
সৌর–বায়ুর শেষ স্পর্শ ত্যাগ ক’রে ২০১৩ তে পৌঁছলো হেলিওপজ…
৩০,০০০ বছরে পেরোবে উর্ট মেঘতন্ত্র…জানাবে কি?
[অক্টোবর, ২০১৩]
তোরাবোরা, বাগদাদ, ত্রিপোলির উপরে ছুটলো টমাহক…
ওয়াজিরস্তানের উপর এখনও ড়্রোন;
কিন্তু মহাশূন্যও ধাবমান।
মানুষ, মানুষ কবে পাল্টাবে তোমার যুদ্ধের দর্শন?
হাত
এই যে দেখেছ হাত : তার ভিতরে
তিস্তা, পসর, সুরমার ফালি…খালি রেখা;
চৌমুহিনীর থেকে সিরাজগঞ্জ…কত মেঠো-আল, সড়ক, রাজপথ…
এইটুকু জমিতেই ওমর-এর সমস্ত ম্যাপ…
গ্রহ, উল্কা, এমন কি নক্ষত্র-তিমিরের জ্ব’লে উঠবার প্রত্যাশায়।
নিরঙ্কুশ মোহর আমার এই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ,
কড়ে আঙুলে আমার সকল শত্রু
এবং তর্জনী-সৈন্যের প্রতি সমূহাদেশ।
তালু, মুষ্টি, পাঞ্জা কালে-ইতিহাসে তুলে নেয় নি কি বর্শার মাজা,
চুনি-খচিত বাঁটঅলা তরবারীর হাতল, এল-এম-জি, কালাশ্নিকভ।
কিন্তু, এখন সে সমস্তটাই আঙুল–তর্জনী থেকে কনিষ্ঠা, এমন কি বৃদ্ধা
টক্ টক্ টক্ …
আর খুলে যায় জানালা, দরোজা, মহাকাশ-
কৃত্তিকা থেকে শুরু করে ছায়াপথ, গ্যালাক্সি, সুপারনোভা,
সমস্ত সংখ্যার অন্তর্গত সমানু-অসমানুপাতিক রহস্য,
সক্রেটিস, রুমী, রীমান, মিসিসিপি, পিরামিড, অ্যাক্রোপলিস্ ,
সিস্টিন চ্যাপেলের থেকে আদম আর হাওয়া।
ছুঁতে পারে, মানুষ সবই ছুঁতে পারে
বাস্তব, কল্পনা, অতীত, ভবিষ্যৎ, একটি আপেল কিম্বা হরিয়াল পাখি
শূন্য-একে, শূন্য-একে, শূন্য-একে সমস্ত স্ক্রীন ভরে ওঠে
আঙুল, আঙুল ওকে! ধরো!
ঐ গ্যালো অনন্ত…