সেলিম রেজা নিউটন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৩, ২:৩১ পূর্বাহ্ণ, | ২৩৬৫ বার পঠিত
কবিতায় রাস্তার সৌন্দর্য আর আমার বাচালতা (জাহিদ আকতারের কবিতা নিয়ে নোটকণা)
ফেসবুকে জাহিদ আকতারের কবিতা যত পড়ছি তত হতবাক হয়ে যাচ্ছি। দুর্দান্ত সব কবিতা। একেবারে স্বকীয় ভঙ্গিতে লেখা। ঢাকার একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জাহিদ কী করে এসব ভয়ঙ্কর কবিতা লিখে চলেছেন একের পর এক ভেবে বিস্মিত হই। তাঁর কবিতা নিয়ে বিস্তারিত লিখতে পারার স্বপ্ন দেখছি কিছুদিন ধরে। আপাতত সামান্য একটু খসড়া টোকা তুলে রাখছি এখানে।
জাহিদের সাম্প্রতিক একটি কবিতার নাম “বুক পকেটে কবিতা” (https://www.facebook.com/zahid.akter.7/posts/10201110130616136)। কবিতাটা পড়ে কয়েকটা কথা আমি না বলেই পারলাম না। সেগুলো ঐ কবিতার নিচে মন্তব্য আকারে লিখেছি। এখানে তবু দিয়ে রাখছি যেন আলাদা করে খুঁজে পেতে আমার আরাম হয়। (তিনটা ছবি সাথে দেওয়ার লোভও একটা কারণ।) গোটা কবিতাটাই আগে কপি-পেস্ট করে রাখি। [ এটাই তাঁর সবচেয়ে ‘ভালো’ কবিতা নয় — সেই সতর্ক-সংকেতও দিয়ে রাখি। আরো সব ভয়ঙ্কর কবিতার বেরিয়েছে তাঁর কলম দিয়ে। এখনও বেরুচ্ছে ঝরঝর করে। ঝরণা কলম দিয়ে এখনও লেখেন কিনা জিজ্ঞেস করা হয় নি ♥।
]
বুক পকেটে কবিতা
কবিতার শিল্পবোধসমৃদ্ধ অতিরঞ্জন নয়।
কতকগুলো নিউজ রিপোর্টিং।
গত মাসে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ধসে মারা গেছেন
কয়েকশ’ শ্রমিক। হুমকি দিয়ে তাদের ঐ ঝুঁকিপূর্ণ
ভবনে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
রাষ্ট্র বলেছে, আইন অনুযায়ী দোষীদের
বড়জোর সাত বছরের কারাদন্ড হতে পারে।
খবরটা শুনে আমরা সংক্ষুব্ধ হই।
তারপর ঘরে ফিরে যাই।
গেল ফেব্রুয়ারীতে ছেলেকে স্কুলে দিতে না পেরে
তাকে ভিক্ষুক বানানোর উদ্দেশ্যে এক পিতা
তার সন্তানের দুই হাত কেটে ফেলেছেন।
হাত কাটার সময় তার সন্তান জিজ্ঞেস করেছে-
‘বাজান, আমি ভাত খামু কি দিয়া?’
খবরটা শুনে আমরা চোখের পানি মুছি।
তারপর ঘরে ফিরে যাই।
গত ঈদের চান রাতে ভাত দিতে
না পেরে এক মা তার দুই সন্তানকে
বুড়িগঙ্গায় ফেলে ঘরে ফিরে আত্নহত্যা করেছেন।
খবরটা শুনে আমরা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি।
তারপর ঘরে ফিরে যাই।
কয়েক বছর আগে বগুড়ার এক কৃষক তার ধানের
ন্যায্য দাম না পেয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে
আত্নাহুতি দিয়েছেন।
খবরটা শুনে আমরা ব্যথিত হই।
তারপর ঘরে ফিরে যাই।
একদিন আমরা আর শুধু
কাঁদব না,
ব্যথিত হব না,
সংক্ষুব্ধ হব না,
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলব না।
একদিন আমরা আর ঘরে ফিরে যাব না।
একদিন আমরা ক্ষেত-খামার, জঙ্গল, অফিস-আদালত,
কারখানা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পড়ার টেবিল, স্টেশন,
রান্নাঘর, শপিংমল, ড্রয়িংরুম, মন্দির-মসজিদ-প্যাগোডা,
চায়ের স্টল, সাইবার ক্যাফে ছেড়ে-
নেমে আসব
নগ্ন পায়ে
একসাথে
সমস্বরে
চিৎকার করে
হাতে হাত
কাঁধে কাঁধ
দৌড়াব
একসাথে
সমস্বরে
চিৎকার করে
দৌড়াব-
বন্দুকের সামনে, ট্যাংকের সামনে
সারিবদ্ধ জলপাই রঙের সামনে
রাষ্ট্রের সামনে
সাম্রাজ্যের সামনে
আমাদের হাতের মুঠোয় থাকবে
একটি করে লাল সূর্য
আর বুক পকেটে থাকবে
একটি কবিতা
বিপ্লব যার শিরোনাম।
এবার যা বলার জাহিদের কাছেই বলা যাক। প্রিয় জাহিদ, আপনার এই হাতের মুঠোয় সূর্য আর বুক পকেটে বিপ্লব নিয়ে দৌড়ানোর দুর্দান্ত ধারণাটার জন্য আমার মনে পড়ে গেল ১৯৬৮ সালের মে মাসের কথা। “প্যারিস বসন্ত”, “মে ১৯৬৮” ইত্যাদি নামে পরিচিত সেই কয়েক মাসের ছাত্র-শ্রমিক গণজাগরণের, ‘কারখানা+বিশ্ববিদ্যালয়=বিপ্লব’ এর উত্তুঙ্গ ঘটনাবলীর কথা মনে পড়ে গেল। সারা ফরাসি দেশ জেগে উঠেছিল। শ্রমিকেরা কারখানা আর ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিয়েছিল, মালিক-মাস্টারদের বের করে দিয়ে। শত ফুল ফুটেছিল সেই বসন্তে।
প্যারিস বসন্তের অনেক অনেক দুর্দান্ত স্লোগান আর চিকা’র (দেয়াললিখন) মধ্যে একটা ছিল: “Cours camarade, le vieux monde est derrière toi”. ইংরেজিতে বললে দাঁড়ায়: “Run Comrade, The Old World is Behind You”. আক্ষরিক বাংলায় বললে: “জলদি দৌড়ো কমরেড, পুরোনো পৃথিবী তোমার পেছনে”।
এই আক্ষরিক বাংলায় মন ওঠে না। মাথায় স্লোগানটা ঘুরছিল মেলা দিন ধরে। তারপর একদিন ঢাকায় দৌড়াদৌড়ির সামিয়ক কয়টা দিনে, টাউন সার্ভিস বাসে বসে এর একটা পদ্য-অনুবাদ করে ফেলা গেল হুট করেই। ২০০১ সালের এই মে মাসেই। (কী কাণ্ড!) তবে সেটা আর স্লোগান থাকল না। ছোট চার লাইনের একটা পদ্য হয়ে গেল। নাম দিয়েছিলাম: “প্যারিস, মে ১৯৬৮”। নিজের নামে চালিয়ে দিলাম আমার “মাছরাঙা পাখির সফর” কবিতা সিরিজের ভেতরে (অনলাইনে এই সিরিজের কবিতাগুলো পড়ার জন্য দ্রষ্টব্য “সাহিত্য ক্যাফে”: http://www.sahityacafe.com/?p=1464)।
একটুখানি দৌড় তোমাকে
এগিয়ে দেবে মঞ্জিলে …
জলদি বন্ধু! পুরান্ জগৎ
আসছে ধেয়ে কাল গিলে!
আরো একটা স্লোগানের কথা মনে পড়ছে। সেই প্যারিস বসন্তের। সেটা হলো: “La beaute est dans larue”। ইংরেজিতে বললে: “Beauty is in the street”। “সৌন্দর্য থাকে রাস্তায়”। আপনার কবিতায় এই রাস্তার সৌন্দর্যই দেখতে পেলাম। তাই এত বাচালতা।
১৬ই মে ১৯৬৮ তারিখে টিভির সাথে কথা-বলা তিন প্রতিবাদী নেতা: অ্যালাঁ জিমা,জ্যাক সুভ্যাজু, এবং ড্যানিয়েল কোন-বেন্দিৎ। ওপরের স্লোগানটা: “জলদি দৌড়ো কমরেড,
পুরোনো পৃথিবী তোমার পেছনে” [প্যারিস বসন্ত, ১৯৬৮।]