মতাদর্শ নয়, পথ । সেলিম রেজা নিউটন
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ডিসেম্বর ২০১৩, ৬:০১ অপরাহ্ণ, | ৩০১৬ বার পঠিত
সাম্প্রতিক অনেক লেখায় বলেছি, আমি না বললেও খালি চোখেই দেখা যায়: বাংলাদেশ অন্ধ-বিশ্বাস আর অন্ধ-অবিশ্বাসের চক্করে পড়েছে নতুন করে। মুক্ত-চিন্তা, মুক্ত-পর্যালোচনা এবং মুক্ত-মতপ্রকাশের পথে বিপুল বিক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, নানা প্রকার ধর্ম-রাজনৈতিক গোষ্ঠী, এবং তাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্যপ্রবণ নানান মহল।
এই আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কয়েকটা কথা এখানে গুছিয়ে তুলে ধরা দরকার মনে হচ্ছে। কথাগুলো টুকরা টুকরা করে লেখা হয়েছিল ফেসবুকে। গত মে-জুন মাসে। ফেসবুক থেকে স্রেফ হুবহু টোকা এ নয়। গ্রহণ-বর্জন-পরিমার্জনা করতে হয়েছে স্বভাবতই।
এক। গুরু-গোঁসাই-গ্রন্থ এবং গুপ্তজ্ঞান প্রসঙ্গে যেকোনো পাঠের একাধিক অর্থ থাকবেই। অর্থ নির্ভর করে বক্তার ওপরে নয়, শ্রোতার ওপর। কোনো গ্রন্থই এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের বিচার-বুদ্ধি-বিবেক-বিবেচনা দিয়েই মানুষকে তার জীবন ও জগত্ সম্পর্কে উপলব্ধি করতে হয়। কোনো টেক্সটেরই কোনো অনড় অর্থের দোহাই দেয়ার মানে হয় না। জীবন-জগত্ অনড় নয়। সদাপরিবর্তনশীল। মানুষ তো মানুষ, অন্য প্রাণীরাও কোনো অনড় যান্ত্রিক শৃঙ্খল মেনে লেফটরাইট করে জীবনযাপন করতে পারে না। পশুপাখির জিন পর্যন্ত বদলায়। জিনের মিউটেশন হয়। জড় তো বদলায়ই।
একটা মাত্র গ্রন্থ দিয়ে পৃথিবীর তাবত্ কিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারার দাবি কোনো মহাগ্রন্থই নিজে করে না। আমাদের লাগে অজগ্র গ্রন্থ। অজগ্র পাঠ। মানুষের জন্য শেষ বলে কিছু নেই। প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা-কৌতূহল-অনুসন্ধান ইত্যাদি সব বেতাল জিনিসপত্র দিয়েই মানুষ গড়া। মানুষের এই গড়নকে অস্বীকার করার মানে হয় না। সুতরাং, ভালোবাসা-সহিষ্ণুতা-উদারতা-স্বাধীনতা-সংহতি-সৃজনশীলতা জাতীয় প্রাথমিকতম মানবিক মূল্যবোধগুলোর ওপর আস্থা রাখার চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
সত্য এক, কিন্তু তার প্রকাশ সীমাহীন ধরনের বিচিত্র। এটাই সত্যের স্বরূপ। জগত্ একশিলা বা মনোলিথিক জিনিস নয়। বিচিত্র বিষয়ে ভরা। এটাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সত্য। যিনি নিজে সত্য, সত্য শুধু তিনিই জানেন। কিন্তু কোনো এক বা একাধিক জনের জানাটাকেই ‘চূড়ান্ত সত্য’ বলে দাবি করতে গেলে জবরদস্তি আসে। জোর-জবরদস্তি করে মঙ্গল হয় না।
সত্যের কোনো সদাপ্রস্তুত ম্যানুয়াল নাই; রেডিমেড দণ্ডবিধি নাই। প্রত্যেককে তাঁর নিজের মতো করে আপন আপন জীবন-জগত্-সমাজের সত্য উপলব্ধি করতে হয়। কোনো গুরু-গোঁসাই-গ্রন্থই কাউকে পূর্বনির্ধারিত কোনো সদা-সত্য-উপলব্ধি গিলিয়ে দিতে পারে না।
আমি কোনো গোপন গুরুতন্ত্রে বিশ্বাস করি না। ‘গুরু’ কোনো আগাম-নির্দিষ্ট/আমলাতান্ত্রিক/কর্তৃত্বক্রমতান্ত্রিক পদ হতে পারে না। মানুষের অজগ্র শিক্ষক থাকেন, গুরু থাকেন। মানুষ মানুষের কাছ থেকে শেখে। প্রকৃতি-জীবজন্তু থেকে শেখে। যা দেখা যায় না তা থেকেও শেখে।
শিক্ষার সার্থকতা আমলে এবং অনুশীলনে। ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও’ এর চেয়ে ভালো কোনো পদ্ধতি আছে বলে মনে হয় না (দ্রষ্টব্য: কৃষ্ণদাস কবিরাজ কর্তৃক বিরচিত ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’)। এ হচ্ছে শেখার এবং শেখানোর মুক্তিপরায়ণ তত্ত্ব। মুক্তিপরায়ণ শিক্ষাতত্ত্ব।
শিক্ষার সার্থকতা শেয়ারিঙে। যত বেশি শেয়ারিং করা যায়, ততই মঙ্গল। আমি আপনার কাছ থেকে শিখি। আপনি আমার কাছ থেকে শেখেন। বোঝাপড়া-শিক্ষা-উপলব্ধি একমুখী রাস্তা নয়। কিন্তু গুরুতন্ত্র একমুখী কর্তৃত্ব দাবি করে। এই দাবি প্রতিষ্ঠা পায় গোপন জ্ঞানের (গুপ্তধনের মতো গুপ্তজ্ঞানের) একচ্ছত্র মালিকানার ওপর।
সংগুপ্ত সত্যের, গুপ্তজ্ঞানের তত্ত্বে আমি বিশ্বাস করি না। সত্যকে গোপন রাখার কোনো মঙ্গলজনক যুক্তি আমার কাছে নাই। যা আমি ভালো বলে উপলব্ধি করেছি তার প্রকাশ্য অনুশীলনই আমার কাম্য। তার জন্য মূল্য দিতেও আমি প্রস্তুত। আবার, যাহা সংগুপ্ত তাহাই তো প্রকাশ্য। কে কীভাবে দেখছেন তার ওপর নির্ভর করে মাত্র। শাসনতান্ত্রিক/আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিক থেকে দেখলে দেখা যায়, নানা ধরনের সত্যকে সিক্রেসি দিয়ে ঢেকে রাখে শাসকরা (দ্রষ্টব্য জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, ২০০৬: ‘কনস্পিরেসি অ্যাজ গভর্ন্যান্স’)। সিক্রেসি ছাড়া শাসন-তন্ত্র চলতে পারে না। কথিত ‘গণতান্ত্রিক’ শাসকদেরকে তো গোপনীয়তার সাংবিধানিক শপথ পর্যন্ত নিতে হয়। গুরুতন্ত্র তাই শাসনতন্ত্রই বটে।
গুরুতন্ত্রের গুরু আসলে কর্তৃত্ব-তন্ত্রের একচ্ছত্র কর্তা। (গুরুর ধারণা আদিতে একেবারেই আলাদা ছিল বলে আমার ধারণা। সেটা ছিল মাতৃতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটের সামাজিক ঘটনা। পরে এর মধ্যে পুরুষতন্ত্র এবং কর্তৃত্বতন্ত্র বাসা বেঁধেছে। এসব নিয়ে আরেক দিন কথা বলা যাবে।) গুরুতন্ত্র কায়েম করে গোপনীয়তাভিত্তিক কর্তৃত্বতন্ত্র। গোপনীয়তা বলতে এখানে ‘সিক্রেসি’ বোঝাচ্ছি, ‘প্রাইভেসি’ নয়। দ্রষ্টব্য: বর্তমান লেখকের ‘প্রাইভেসি কী বস্তু’)। আদি, আসল ও সহি সত্যের মালিকানা দাবি করে গুরুতন্ত্র, যাজকতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র, প্রফেসরতন্ত্র, মোল্লাতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র এবং যাবতীয় কর্তৃত্বতন্ত্র। এ রকম মালিকানা দিয়ে মানুষকে চিন্তাদাসই বানানো যায় বড় জোর। গুরু ছাড়া, কর্তা ছাড়া, মালিক ছাড়া দাসতন্ত্র দাঁড়ায় না। আবার, দাস ছাড়া, গোলাম ছাড়া, আবাল-অনুগত অনুচর ছাড়া গুরুতন্ত্র-কর্তৃত্বতন্ত্র-মালিকতন্ত্র টেকে না। এ এক পরস্পরনির্ভর/মিথোজীবিতাকেন্দ্রিক দ্বিমুখী প্রক্রিয়া: ‘গোলাম মালিক খোঁজে, মালিক গোলাম’ (কবীর সুমনের গান)।
আলাপ-আলোচনার ধারা যদি উন্মুক্ত হয়, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, সত্যের একচ্ছত্র মালিকানা দাবি করার দিকে ঝুঁকে না পড়ে, তাহলে যার যা বোঝার সেটুকু বুঝে নেওয়ার মতো অবকাশ তৈরি হয়।
আমি যা বলি তা আমারই উপলব্ধি মাত্র। আমারই সত্য মাত্র। কিন্তু এই উপলব্ধিকে আমি সহি সত্য বলে, বা একমাত্র সত্য বলে দাবি করি না। যত কাল্লা তত আল্লা। যাঁরা একমাত্র সত্য বা চূড়ান্ত সত্য জানেন বলে দাবি করেন, তাঁরাই ‘সত্যহীন’দেরকে শাসন করার, পরিচালনা করার ‘যোগ্যতা’ অর্জন করেন। তাঁরা লেনিনবাদী-লাদেনবাদী-লিবারালবাদী। আমার সংশয় হয়: আর যা-ই হোক, সত্য নিয়ে কারবার তাঁদের নয়।
আমি অরাজপন্থার মানুষ। স্বরাজ আমার স্বভাব। আমি কাউকে পরিচালনা করি না, আমাকে পরিচালনা করার সুযোগও কাউকে দিতে চাই না। অন্যের কাছ থেকে নিরন্তর শিখি। আগ বাড়িয়ে শেখাতে যাই না। বাধ্যতামূলক কোনো শিক্ষা অন্তরে গ্রহণ করি না।
দুই। তর্ক-বিতর্ক-পর্যালোচনার পদ্ধতি প্রসঙ্গে কারো কারো কথায় অস্পষ্ট একটা ধারণা আমার মনে জন্মায়: গুরুতন্ত্র সম্পর্কে যাঁর সংশয় আছে তিনি আবার গুরু নিয়ে বা গুরুতন্ত্র নিয়ে আদৌ কথা তোলেন কোন যুক্তিতে? প্রশ্নকর্তা যেন কোনো অসঙ্গতির দিকে আঙুল তুলছেন বলে মনে হয়। যেন তিনি বলতে চাইছেন, যিনি নিজে বিবাহ করেছেন, তিনি আবার বিবাহ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মুশকিল নিয়ে কথা বলেন কীভাবে? আলোচ্য বিবাহিত ব্যক্তিটি যেন এক প্রকার সুবিধাবাদী অবস্থান নিচ্ছেন এক্ষেত্রে।
এই ধারার সমালোচনা বা প্রশ্নের পেছনকার যুক্তিবোধ আমার কাছে স্পষ্ট হয় না। পরিবারপ্রথার সমস্যা নিয়ে কথা তুলতে গেলে আমাকে পরিবারবহির্ভূত হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হবে? কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষ (যথা বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো বা রাজনৈতিক দল) আমি পছন্দ করি না বলে এসব বস্তু নিয়ে কিছু বলাই যাবে না? রাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে কথা বলতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা-প্রণালির সমস্যা নিয়ে কথা বলা যাবে না? তার জন্য এই প্রশ্ন উঠবে যে: নিজে ঠিকই বিশ্ববিদ্যালয়-অধ্যাপনার সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়েরই বদনাম করা হচ্ছে? আবার, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নন, তিনি বিদ্যমান কর্তৃত্বপরায়ণ অধ্যাপনাতন্ত্র তথা বিদ্যা-বুরোক্র্যাসি নিয়ে কথা তুললে হয়তো বলা হবে, যিনি নিজে অধ্যাপক নন, তিনি অধ্যাপনাতন্ত্রের ভালোমন্দ নিয়ে কী বোঝেন? এই সব প্রশ্ন-সমালোচনা-বিদ্রূপ আসলে চিন্তার ও পর্যালোচনার মুক্তপ্রকাশের পথে অন্তরায় মাত্র। প্রশ্ন-পর্যালোচনা-চিন্তাভাবনার কোনো পূর্বশর্ত থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
আরেকটা মুশকিলও খেয়াল করছি। কোনো সামাজিক প্রপঞ্চ নিয়ে জিজ্ঞাসা-কৌতূহল-পর্যালোচনা হাজির করলে অনেকে প্রায় ধরেই নেন পর্যালোচক ওই প্রপঞ্চটিকে ‘মানেন না’। রাষ্ট্র নিয়ে কথা তোলা মানে আমি রাষ্ট্র মানি না। এর চেয়ে আজগুবি দৃষ্টিভঙ্গির কথা অনুমান করাও কঠিন। মানা বা না মানার তো প্রকৃত কোনো পর্যালোচনার বিষয়ই হতে পারে না। আমি আমার বিশ্বাসের কথা আমার ধারণার কথাটুকুই বলতে পারি মাত্র। সেটা কতটুকু ঠিক তা বাস্তব পরিস্থিতি-পরীক্ষণ-প্রয়োগ থেকেই আন্দাজ করা যেতে পারে মাত্র। ‘মানি না’ বললে অপ্রয়োজনীয় ধরনের মুখোমুখি একটা অবস্থা দাঁড়ানোর সুযোগ তো থাকেই, উপরন্তু সুযোগটা আমিই দিয়েছি বলে ভাবার অবকাশ থাকে। আমি আসলে সেটা চাই না।
আমি ঠিক তর্কবিতর্ক করতে চাই না। ‘মানি না’ বললে কেমন প্রতিবাদ প্রতিবাদ শোনায়। ইদানীং আমি আর বিবাদী-প্রতিবাদী হতে চাই না। স্রেফ বাদী হতে চাই। ইতির ওপর জোর দিতে চাই। নেগেটিভ এনার্জি খরচ করতে চাই না। এতে করে আমার মনের শান্তি অক্ষুণ্ন থাকে। বিবাদ-প্রতিবাদ করতে গেলে আমার অস্থির লাগে। ভালো লাগে না।
নিজের বেলায় আমার মনে হয়, নিজের কথাটুকু যুক্তি-ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গসহকারে বললেই তো হয়, অন্যের মতের প্রতিবাদ করার, কিংবা অন্যের মতের অসারতা প্রতিপন্ন করার কী দরকার আমার। আমি যদি কারো মতের প্রতিবাদ করতে চাই, কাউকে অসার প্রতিপন্ন করতে চাই, তাহলে তাঁকেও আমার মতটার প্রতিবাদ করতে, আমাকে অসার প্রতিপন্ন করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখন ক্যাচাল বাধে। ভালো লাগে না।
ইদানীং আমি তাই নির্দিষ্ট কারো কোনো কথা ধরে কোনো আপত্তি তুলতে চাই না। আমার নিজের কথাটুকু জানিয়ে রাখি শুধু। আর, অন্যেরা আমার কথা যদি কিছু বুঝে না থাকেন, এবং সেটা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি শুধু সেটুকুর একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে পারি। ব্যস্। আর কিছু না।
আরেকটু ভেঙে বলা যাক। অন্যের সঙ্গে আমার যা মেলে না, তা নিয়ে এখন আমার আগ্রহ কাজ করে না। (যদিও সবসময়ই ভিন্নমতগুলোকে আমি নিজের মতো করে ধৈর্য নিয়ে বুঝতে চাই। ভালো করে বুঝতে চাই। ভাবি, আলাদা আলাদা মত তো থাকবেই। কোনো মানুষ নিজের মতামত নিয়ে খোলা মনে চিন্তা করার মতো মানুষ হলে তাঁর যা বোঝার তা ঠিকই বুঝে নেবেন। খুঁজে নেবেন।
তবে যদি এমন হয় যে অমিলের জায়গাটা আমার মধ্যে প্রশ্ন বা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে, তাহলে আমি তাতে আগ্রহী হয়ে উঠি। সে ক্ষেত্রে নিজেই ভাবি। খুঁজি। যদি দেখি যাঁর সঙ্গে অমিল, তিনি কমবেশি খোলা মনের মানুষ, তাহলে তাঁকে প্রশ্ন করে করে আরো ভালো করে তাঁর ভিন্নমতটা বুঝে নিতে চাই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে তর্কে যাই না। যেতে চাই না। না যাওয়ার চেষ্টা করি অন্তত। সবসময় সফল হই না, বলা বাহুল্য। এ রকম অসফলতা আমার মনে অশান্তি সৃষ্টি করে।
আবার, অন্যের সঙ্গে যা আমার মেলে তা নিয়ে আমি স্বস্তি পাই, যদি তিনি আমার বিবেচনায় যুক্তিশীল-বুঝদার-খোলামনা হয়ে থাকেন। তখন আগ্রহও পাই। ভাবি এ ব্যাপারে আরো কিছু জানাবোঝার সুযোগ হবে হয়তো। একসঙ্গে কাজ করার আনন্দ পাওয়ার অবকাশও তৈরি হবে হয়তো। এমনকি তাঁর মিথ্যা-মিথ্যা ‘প্রতিপক্ষ’ সেজে প্রশ্ন করে করে তাঁর মতটার পক্ষের (মানে এক্ষেত্রে আমারই মতের পক্ষের) যুক্তিগুলোকে আরো ঝালাই করে নেয়া যাবে হয়তো। কিন্তু যাঁর সঙ্গে আমার মিলল, তিনি যদি সে রকম মুক্তমনা মানুষ না হন বলে আন্দাজ করি, তাহলে অস্বস্তি হয়, বিব্রত বোধ করি, কথা বাড়াই না।
অনেকে আমাকে অনেক দিন থেকেই জানেন। তাঁরা বুঝবেন: আমার এসব উপলব্ধি খুব বেশি দিনের না। অতীতে আমি তর্কপ্রিয় ছিলাম। নানা জনের সঙ্গে তর্ক করেছি। তুমুল তর্ক। শেষে দেখেছি ভালো লাগে না। মনোমালিন্য তৈরি হয়। ইত্যাকার অভিজ্ঞতা থেকে আমি এসব নিয়ে নতুন করে ভেবেছি। নতুন করে শিখেছি মনে হয়।
তিন। মতাদর্শ নয়, পথ মতাদর্শ মানেই চোখের ঠুলি, উল্টা-ইমেজ, ক্যামেরা-অবস্কিউরা। মতাদর্শ মানেই সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের মাতব্বরি। কোড অব কন্ডাক্ট। মতাদর্শ মানেই শাস্ত্র। শাস্ত্র চিরকাল শাসন-সাধনের উপায়-যন্ত্র-হাতিয়ার। মানুষের ওপর মানুষের শাসন আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য। তা সে যে শাস্ত্র-মতাদর্শ-থিওক্রেসির দোহাই দিয়েই চালানো হোক না কেন।
মতাদর্শ লাগে যেহেতু শাসনের জন্য, মতাদর্শ মানে তাই শাস্তির ভয় এবং পুরস্কারের লোভ। এই সূত্রে মতাদর্শ মাত্রেই সম্ভাব্য দণ্ডবিধি। আল্লাহ মানুষকে বিচার-বিবেক-বিবেচনা-যুক্তি-বুদ্ধিসহকারে স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করেছেন। কাউকে উত্তম কাউকে অধম হিসেবে পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুসারে মানুষ সৃজিত হয়নি। বাস্তবে মানুষ কী হবে, কেমন হবে তা নির্ভর করে ব্যক্তিক-জাগতিক-আত্মিক-মানসিক-আর্থসামাজিক অনেক কিছুর ওপর।
আমার ধারণা, শাসনপ্রণালির বদলে মানুষেরা নিজেরা-নিজেরা নিজেদের চালাতে পারে। অটোনমি-সংহতি-সৃজনশীলতার ভিত্তিতে। স্বাধীন বোঝাপড়া ও স্বাধীন চুক্তি দিয়ে। এটাই আমার চোখে উত্তম পদ্ধতি। ইতিহাস ও বিবর্তন থেকে আমি এর নমুনা পাই। নিশানা পাই। আল্লাহর ইশারা পাই।
যেকোনো থিওক্রেসিই মতাদর্শ। মতাদর্শ নিজেকে, নিজের কোনো অংশকে, সম্ভাব্য-ভ্রান্ত বলে ধরে নিতে পারে না কখনই। নিজেকে অভ্রান্ত ভাবাই মতাদর্শের লক্ষণ। এতে করে পথ রুদ্ধ হয়। শাসন পোক্ত হয়। মানুষের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়। দাসত্বের সূচনা ঘটে। মনুষ্যত্ব বিনষ্ট হতে থাকে। মানুষের অপমান হয়। খোদার ওপর খোদগারি করা হয়। আল্লাহর সর্বময়-সার্বভৌম ক্ষমতাকে অস্বীকার করা হয়। শেরেকি করা হয়। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করাই শেরেকি। তা সে রাষ্ট্রই হোক, পার্টিই হোক, বা কোনো মতাদর্শই হোক।
উদাহরণত বলা যায়, ইসলাম আমার কাছে মতাদর্শ নয়। বদ্ধতা নয়। আমার কাছে ইসলাম একটা পথ। পথ মানেই খোলা। পথ মানে উন্মুক্ত উদ্দেশ্য, এবং তা হাসিলের উন্মুক্ত উপায়। ইসলাম আমার কাছে অনেক পথের একটা পথ। একমাত্র পথ নয়। অবিকল্প অন্তরায় নয়। সব পথই আল্লাহর তরফে। সব পথই তাঁর উদ্দেশে। সব তরিকাই তাঁর তরিকা। যেকোনো পথেই হোক, হাঁটলেই তাঁকে পাওয়া যায়। আন্তরিকভাবে হাঁটলে। অনুসন্ধিত্সা নিয়ে হাঁটলে। জানবাজি-আত্মাবাজি ধরে হাঁটলে। পথিকের মতো হাঁটলেই শুধু ইঙ্গিত মেলে তাঁর। মুখস্ত আবৃত্তির চর্বিতচর্বণে জগত্সত্তাকে বোঝা যায় না। চেনা যায় না। নিজের কর্তব্যও নির্ধারণ করা যায় না অতএব।
পথ মানে বাঁধা-পথ নয়। পথিক মানে টিকেট-কাটা-প্যাসেঞ্জার নয়। আগে থাকতে শানবাঁধানো সড়ক তো রাজপথ স্রেফ। রাজার রাস্তা। শাস্ত্রের সড়ক। শাসকের সত্য। মানুষের পথ সদা-অনির্ধারিত। মানুষের সত্য আবিষ্কার-সাপেক্ষ। পা এবং আত্মা রক্তাক্ত হওয়া সাপেক্ষ। মুসাফিরের পথই তাই পথ। বাকি সবই পথের নামে শাস্ত্র-মতাদর্শ-থিওক্রেসি আর দণ্ডবিধি। শয়তানের চোখ-মারা। ইবলিসের ইশারা।
রাবি। খসড়া: ১৭ই মে, ১৯শে মে, ১০ই জুন ২০১৩।
পরিমার্জনা: ১২ই সেপ্টেম্বর ২০১৩
বানান, ভাষারীতি ও মতামত লেখকের নিজস্ব