শব্দের আষাঢ়ে প্যাঁচাল । বদরুন নাহার
প্রকাশিত হয়েছে : 01 September 2017, 1:28 am, | ১৫৮৩ বার পঠিত

রাশপ্রিন্ট থেকে যে চিঠি এলো তা বৃষ্টি বন্দনার। কিন্তু শব্দের সঙ্গে বৃষ্টির বিয়ে আমি দিব না। বৃষ্টির সঙ্গে মিলেমিশে থাক ছন্দ। কানপেতে থেকে কোন শব্দপতনে আমি আতকে উঠি না, বরং ছন্দের তালে তালে বৃষ্টি আমায় ভুল করতে শেখায়, ফাঁকি দিতে শেখায়, নিজের কাছ থেকে নিজেকে পালিয়ে যাবার পথ আগলে দেয়। আর তখন ছেলেবেলার বৃষ্টিময় দিনের ওমে ঠুকে পড়ি। আমাদের পাড়ায় বিশ্রি রকমের খানাখন্দ। পাড়ায় সবার বাসার সামনে ছোট ছোট গর্তকেটে মাটি তুলে ভিটে গড়া। বড়রাই করেছে কাজটা, আবার যত বিরক্তিও তাদের! আমারা যারা ছোট, কথায় কথা সবাই বলে চুনোপুঁটি, তাদের কিন্তু ভালোই লাগে। বৃষ্টিতে ওই খানাখন্দ এক একটা পুকুর। আমাদের সাঁতার শেখার হাতেখড়ি, আমাদের নারকেলের ডানা লাগানো দিন পেড়িয়ে মাছের লেজের মতো হাত দুলিয়ে সাঁতার কাটি।
জলজ হিসাবে তখন মাঝে মধ্যেই আমাদের নাকের নীচে শ্যাওলা রঙের মোচ জন্মাতো! মায়ের ধারণা রাতের কাঁশির শব্দটার উৎপত্তি সেখান থেকে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের শব্দের উৎপত্তি বিষয়ক অনিহা তৈরী হয়, ল্যাটিন শব্দ আমাদের সব কিছুর গোড়ায় নিয়ে যেত। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কথা আর নাই বললাম। শব্দ নিয়ে এত কচলানো ভালো লাগে না। শব্দের ছাড়পত্র তো সুকান্তা দিয়ে গেছেই আমার চিৎকারে, পৃথিবী আর আমার অধিকারের শব্দবলীতে এত জট পাকানোর কি দরকার। কেননা তখন থেকেই তো বৃষ্টিতে আমরা ওম কাঁথা থেকে মাথা উচিঁয়ে ভেজে দেওয়া বাদামের খোসা ছড়াই, কাঁঠালের বিচির মচমচে পেটে কামড় বসায় আর ছোলা ভাঁজাকে পাটায় পিঁশে ঝাঁল মাখনি মেখে খাই, তখন ওই পুকুরে জন্ম নেয় সোনা ব্যাঙ, কোলা ব্যাঙ! ওদের ঘ্যাঁঙর ঘ্যাঁঙর ডাক শুনতে শুনতে আমরা সন্ধ্যের বাতি জে¦লে ঝুলে ঝুলে ছড়া পড়ি, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে…। ওই রবীন্দ্রনাথ। সেই শুরু আজও বৃষ্টির সঙ্গে লোকটা আমাদের ঘরে বেঁজেই চলেছে। শ্রাবণও তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে..। কতটা শব্দের খেলা জানলে তবে রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায়? এপ্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজি না। রবীন্দ্রনাথ আর হবেন না, তাঁর জন্ম হয়েছে, আজ অবধি মৃত্যু ঘটেনি। সেই শব্দের তোড়ে আমরা আজও বাদলা দিনে ভেসে বেড়ায়।
বাঁশির মাথায় চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে আমরা দুঃখের সুরে ভেসে যায় বেহুলার দেশে। স্বর্গের দেবতার কাছে গিয়ে নৃত্য করি। আমাদের জীবন ফিরে আসে নতুন করে, প্লাবন শেষে আমরা নূহের বজরা থেকে নেমে পড়ি। আর শব্দ তখন পলিযুক্ত ভূমি হয়ে হাট করে খুলে যায়। আমরা অপেক্ষা করি কিশোরীর বাঁকানো শরীর নিয়ে। আসচ্ছে বছর শব্দের চাষবাসে জন্ম নিবে নতুন গল্পের। এইসব সুদিনের অপেক্ষার কোন শেষ নেই, শব্দের মুক্তি তাই কখনও মেলে না। সে বেঁচে থাকে ছন্দে, গদ্যে, স্বপ্নে, প্রেমে, গানে অথবা আমাদের জানা নেই শব্দের শেষ…
এই যা এল বুঝি বৃষ্টি! রাশপ্রিন্ট যাই বলুক ছন্দই কিন্তু আসল। যা আমরা টিনের চালে টাপুরটুপুর বৃষ্টিতে প্রথম খুঁজে পাই। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আমরা টাপুর-টুপুর, কোলা ব্যাঙের ছা, রামছাগলের দাড়ি, চিচিংফাঁক এইসব শব্দের খেলায় মেতে যাই। যতসব ননসেন্স ওয়ার্ড বা শব্দ আমাদের পায়ে পায়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমরা তখন শব্দ খুঁজি নীল আকাশের মাঝে, সাদা মেঘের ভেলায় করে কুড়িয়ে আনি অনুভূতি আর শব্দগুলো দাঁড় করিয়ে দিয়ে একে অপরের মাঝে প্রতিষ্ঠা করি সত্তা। নিজস্ব ভঙ্গিমায় আমাদেরকে সরূপ দেয় শব্দ। তখন আমরা মিলিয়ে দেখি ভাদ্রমাসের তালপড়ার রূপখানা। মায়ের অগ্নিমূর্তিতে পিঠের উপর আছড়ে পড়া শব্দের মতো। পথে পথে শব্দে শব্দে প্রেমিকার লেজ পর্যন্ত আমরা খুঁজে পাই! আর এই সব আনন্দ দিয়ে দিয়ে শব্দ আমাদের মাঝে বসতি গড়ে। তুমুল বৃষ্টিতে শব্দ হয়ে যায় ভয়ঙ্কর। প্লাবনের মাঝে ভেসে যাওয়া মানুষের কন্দন আমাদেরকে চেনায় শব্দের যত দুঃখ। বাঁশির মাথায় চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে আমরা দুঃখের সুরে ভেসে যায় বেহুলার দেশে। স্বর্গের দেবতার কাছে গিয়ে নৃত্য করি। আমাদের জীবন ফিরে আসে নতুন করে, প্লাবন শেষে আমরা নূহের বজরা থেকে নেমে পড়ি। আর শব্দ তখন পলিযুক্ত ভূমি হয়ে হাট করে খুলে যায়। আমরা অপেক্ষা করি কিশোরীর বাঁকানো শরীর নিয়ে। আসচ্ছে বছর শব্দের চাষবাসে জন্ম নিবে নতুন গল্পের। এইসব সুদিনের অপেক্ষার কোন শেষ নেই, শব্দের মুক্তি তাই কখনও মেলে না। সে বেঁচে থাকে ছন্দে, গদ্যে, স্বপ্নে, প্রেমে, গানে অথবা আমাদের জানা নেই শব্দের শেষ। অক্ষরের বুকজুড়ে গেঁথে থাকা শব্দ আমাদের নিঃশ্বাসের মতো জীবিত এক সত্তা। যদিও শব্দ আষাঢ়ে গল্প করে!