আরজ আলী মাতুব্বরের গোড়ালি । বদরুজ্জামান আলমগীর
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ, | ৫৩০ বার পঠিত
আরজ আলী মাতুব্বর কথার পিঠে কথা বলে গ্যাছেন, বিরামহীন সেই কথা। সমতলভূমি অঞ্চলে গঠিত হওয়া ধর্মগুলো কর্মসূচিনির্ভর, তাই সেখানে কথা ও বয়ানেরই কারবার, আরজ আলী মাতুব্বরও তার বাইরে নন।
যা নির্মিত হয় কথায়, তাকে খারিজ করতে গেলেও কথা-ই ভরসা। কিন্তু ভালোকরে খেয়াল করলে দেখা যায়— বাক ও নির্বাকের ভিতরে একটি অভ্যন্তরীণ মিল আছে; যেমন অন্তর্লীন একটা ঐক্য আছে প্রায় উলঙ্গ হয়ে বিকিনি পরে একটি মেয়ের রাস্তায় ঘোরা, আর আপাদমস্তক হিজাবে ঢেকে একটি মেয়ের রাস্তা চলাচলের মধ্যে— যে মেয়েটি বিকিনি পরে রাস্তায় নেমেছে— তার সাধ্য নেই তার শরীরে সমুচিত জামাটি ওঠায়— তাহলে তিনি আর ট্রেন্ডি থাকতে পারবেন না, আর যিনি বোরকায় মোড়ানো— সঙ্গত জামাটি পরার অধিকার তারও হাতে নেই।
বোধিধর্ম বুদ্ধের শিক্ষা নিজের ভিতর ঘনীভূত করেছিলেন ধ্যানের কল্যাণে। ধ্যানের চারপাশে একটি নীরবতার দেয়াল থাকে, কথার চারপাশেও থাকতে পারে সরবতার ব্যূহ, মাতুব্বরের কথা শ্রেণীকক্ষে সুসমাচারের অভিনিবেশ নয়, বরং তা একের পর এক কর্মসূচি হাজির করার পালা। ধ্যানগ্রস্ততায় বুদ্ধের শিক্ষাকে বোধিধর্ম ভারত থেকে জেন পথে চীনদেশে নিয়ে যান, আবার ধ্যানোত্তর ধ্যানে সোটো জেন মার্গে তা জাপানে নিয়ে পৌঁছান সাধু ডোগেন।
হয়তো একটি গুহ্য কারণ থাকতে পারে— পাহাড়ের পায়ের নিচে দলা হওয়া ধর্মগুলো মোরাকাবাপ্রবণ, আর সমতলভূমির ধর্ম চঞ্চল। তা না হলে হানাফি, শাফায়ি, মালেকি, হাম্বলি, ওহাবি,আহলে হাদিস, জাহিরি, ইশনা আশারিয়া, জাইদিয়া, আলাভি, আহমাদিয়া, ইবাদি, কিংবা চার্চ অফ দ্য ইস্ট, ওরিয়েন্টাল অর্থোডক্সি, ইস্টার্ন অর্থোডক্সি, রোমান ক্যাথলোসিজম, প্রোটেস্টেন্টইজম, রেস্টোরেশনইজম, এমনকী মুতাজিলা, ইমাম গাযযালি— সবাই কথা বলেন, অজস্র কথা। মাঝেমাঝে মনেহয়, গৌতম বুদ্ধ পাহাড়ের বদলে মরুর দেশে জন্মালে তিনিও হয়তো তুবড়ি বাজির মত কথাই বলতেন। এটি বোধকরি যিনি বলছেন- তা কেবল তার একার দায় নয়, যারা শুনছেন তারাও এমন একটি পরিসর তৈরি করে রেখেছেন— সেথায় শুধু নীরবতায় কাজ হয় না।
এই পুরো পরিপ্রেক্ষিতেরই অংশ বুঝি আমাদের আরজ আলী মাতুব্বর। ফলে তিনিও বাহাসের দরবারে অসহায়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি— আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন ঢোলের মোটা চামড়ার মত— শত আঘাতে ফাটে না, ছিঁড়ে না; বড় বড় আঘাতে বরং আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
অন্য আরেকটি পথ খোলা ছিল— সশস্ত্র বা আধাসশস্ত্র কিংবা বুদ্ধিবাদী কোন বাম ঘরানার সঙ্গে একীভূত হওয়া। এবারও অবাক হয়ে দেখি, তিনি তা করেননি।বাঙলা অঞ্চলের ইতিহাসে আমাদের যার যা করার কথা থাকে— হরহামেশাই তার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রত্যয়ের কিছু করতে দেখি। মোফাক্কর চৌধুরীর যে ভাবাবেগ ও বিহবলতা ছিল— তাঁর জন্য একজন নির্ঘুম যাজক হলে সবচেয়ে সঠিক কাজটি হতো, কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের পথ, চারু মজুমদারের জন্যও একই অতীতাশ্রয়ী ভবিষ্যৎ বাণীটি খাটে।
তাঁর আত্মকথন— ভিখারীর আত্মকাহিনী থেকে, ওঁর পরিপার্শ্বজনের বয়ান থেকে যেভাবে জানতে পারি— তাঁর মা লবেজান বিবির মৃত্যুর পর জানাজা দেবার আগে বরিশাল শহর থেকে ডেকে আনা ফটোগ্রাফারের তোলা ছবির কারণে একটি অনভিপ্রেত নৃশংস পরিস্থিতির উদ্রেক হয় : জানাজাকারী মৌলভি, মুসুল্লি ও নামাজীদের কাছ থেকে আকস্মিক ফতুয়া আসে যে, মৃতব্যক্তির ছবি তোলা হারাম, বেদাত; ফলে জানিয়ে দেন— তাঁরা লবেজান বেগমের জানাজা দেবেন না; আরজ আলীর একান্ত কাকুতি মিনতির পরও তাঁরা মুসলমানের এক রা-তে অনড় থাকেন। ফলে আরজ আলীর হাতে আর কোন সমাধান থাকে না— তিনি অনেকটা মাটি গেড়ে মা-কে ওই গর্তে জানাজাবিহীন, দোয়াখায়েরবিহীন পুঁতে রাখেন।
এই ঘটনাটির ভিতর আমরা আরজ আলী মাতুব্বরকে প্রথম সুনির্দিষ্টভাবে দেখতে পাই। এমন একটি মর্মন্তুদ ঘটনার পর যে-কোন একজন গৃহস্থ মানুষের পক্ষে কী করা স্বাভাবিক ছিল—
কৃতকর্মের জন্য বিনাশর্তে ক্ষমাপ্রার্থনা করা; গ্রামবাসীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে জোড়াত করা, শলাপরামর্শ করার জন্য দল পাকানো, চেয়ারম্যান মেম্বারের কাছে ধর্না দেয়া, মাটি থাবড়ে বিলাপ করা, শ্রেণীমত হুমকিধামকি দেয়া, উৎকোচ দিয়ে অন্য মৌলভি ডেকে নিয়ে আসা। কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বর এসবের কিছুই করেননি। একঅর্থে এই ঘটনাটি আরজ আলীর জন্য শাপে বর হয়ে ওঠে। মাতুব্বর মোল্লাবাজি মোকাবেলা করার জন্য ভিতরে ভিতরে গোকুলে বেড়ে উঠছিলেন— তা আমরা সবাই জানি।
একদম ছোটবেলা থেকে আরজ আলী মাতুব্বরের পাঠাগ্রহ রীতিমতো পাঠলিপ্সার পর্যায়ে পড়ে, একটি বইয়ের জন্য তিনি ১৪মাইল অবধি হাঁটতেও কসুর করেননি, একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঢুঁ মারা, বই চুরি করা, একপয়সা দুইপয়সা করে বইকেনার টাকা জমানো, মক্তবে পড়ার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া— বইসংগ্রহের জন্য যে-কোন ত্যাগ স্বীকার করতে
তিনি একপায়ে খাড়া ছিলেন। তবে এ-কথা সত্য— মায়ের জানাজার ব্যাপারটা তাকে আমূল নাড়িয়ে দেয়, এবং ওখানেই তাঁর বাকি জীবনের গতিমুখটি নির্ধারিত হয়ে যায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি ধর্মের সার-অসার বোঝার গভীর নিষ্ঠায় ধ্যানমগ্ন হবার বদলে তিনি যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠেন; ফলে সত্য অনুধাবনের চেয়ে যুদ্ধজয়ের নেশায় তিনি পাগলপারা হয়ে ওঠেন। নির্জন সাধনায় অতলযাত্রার বদলে তিনি বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে পুরোপুরি মনোনিবেশ— ফলে লিপ্ততার মোক্ষম নয়, তাঁর অভীষ্ট হয় ফললাভ। দিনশেষে আমাদের আরজ আলী মাতুব্বরের কাছে ফিরে আসতে হয়, কেননা, সাধনার পথে তাঁর নিষ্ঠার ফল দেখি, তারচেয়েও বেশি যা দেখি তা অধিকতর বিস্ময়কর ও জরুরি : তিনি সে-ই কাজেই ব্রতী হন, যে-কাজের সঙ্গে তার স্বভাবের ষোল আনা মিল পড়ে।
শৈশব থেকে তার বড় হয়ে ওঠার গ্রাফটার দিকে তাকালে অতি সহজেই বোঝা যায়— তিনি কতোটা অর্গানিক্যালি বস্তুবাদী। কারো কারো কাছে হয়তো কিছুটা ঠুনকো ও আনমনা লাগে, কিন্তু তার জীবনে বাস্তবতার খুঁটিনাটিই তাকে এভাবে গড়ে তোলে।
শিশু আরজ আলী মাতুব্বরের মা লবেজান বিবি অন্যের বাড়িতে কাজ করে, দিনশেষে ছেঁড়া আঁচলের নিচে সানকিতে একটু ভাত নিয়ে আসেন, সেই ভাতের জন্য আরজ দিনভর অপেক্ষা করে, গ্রামে কোন মহিলা মারা গেলে মুর্দার গা ধোয়ার কাজ করেন লবেজান বিবি— সেদিন হয়তো দুটো পয়সা বেশি পান আরজ আলীর মা, সেই টাকা থেকেই মা ছেলের জন্য একিটা গেঞ্জি বা জামা কিনে দেন, শত ঝুঁকি নিয়ে লবেজান বিবি ধাইয়ের কাজও করেন।
আরজ আলী ঘুড্ডি বানান ভালো— কিন্তু নিজের জন্য নয়, মেলায়, বা হাটে বিক্রি করার জন্য— নিজে ঘুড্ডি ওড়ানোর সৌখিনতা পুষে রাখেন না কখনও, তিনি বেঁচেবর্তে থাকার জন্য বানান বাঁশ দিয়ে পানি তোলার কল, কখনও গান করেন, গান বাঁধেন গানের দলের সাথে। তাঁর জীবনই তাকে শিক্ষা দিয়েছে শতভাগ বস্তুনিষ্ঠ থাকতে।
একবার হারিকেন উল্টে বইয়ের পাতায় কেরোসিন পড়েগেলে আরজ আলী দিব্যি কেরোসিনের কারণে বইয়ের নিচের পাতাটি পরিস্কার দেখতে পান— এর ভিতর দিয়েই তাঁর মাথায় আচমকা এক বুদ্ধি খেলে— তাহলে তিনি এভাবে কেরোসিন ঢেলে নানাদেশের মানচিত্র আঁকতে পারেন। এই কৌশলে মানচিত্র এঁকে বাজারে তোলার পর বেশকিছু আয়রোজগার হয় তাঁর।
এভাবেই জীবনের পাঠশালায় তিনি ভাব নয়, বস্তুর এলেম পান আরজ আলী মাতুব্বর; তাঁর গোড়াপত্তনে দ্বিত্ব নাই, আছে এক; সম্ভাবনা নয়, আছে স্থির নিশ্চয়তা; তাতে মেটাফোর নাই, আছে চাক্ষুষ যোগফল। এই এককাট্টা উপসংহার তাঁর গোটা জীবনের মোকাবেলা ও সংগ্রামশীলতায় অক্ষরে অক্ষরে প্রতিবিম্বিত হতে দেখি। তাঁর এই বাস্তবিক ও আঙ্কিক জ্ঞানের কারণে শেষাবধি একজন একজন জমি মাপের আমিন হয়ে উঠেছিলেন।
একটি উদাহরণ দিই— তিনি দেখাবেন কোরান কোন ঐশী বাণীর সংকলিত গ্রন্থ নয়, তা আকাশবাণী হবার কোন কারণ থাকতে পারে না, এ মানুষের প্রয়োজন সাপেক্ষ এক প্রায়োগিক, ঐতিহাসিক গ্রন্থ। এ-কথা প্রমাণ করার জন্য তিনি একটি রেফারেন্স দেন :
কোরানের সুরা নিসাতে পরিস্কার বলা হয়েছে মৃতব্যক্তির সম্পত্তি ফারায়েজ বিধি অনুযায়ী তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বাটোয়ারা করে দিতে হবে। মৃতব্যক্তির দাফন-কাফন, স্ত্রী, বা স্ত্রীদের দেনমোহর মিটিয়ে দেয়া, স্ত্রী, বা স্ত্রীদের ঋণ পরিশোধ করা, মৃতব্যক্তির ওসিয়ত থাকলে তা পরিশোধ করে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নিরঙ্কুশ বিলিবন্টন করে দিতে হবে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ওয়ারিশানদের মধ্যে তা ভাগ করার হিসাবের মধ্যে। আমরা সকলে জানি, মোট সম্পত্তিকে বলে ষোলআনা, ফারায়েজ আইন অনুযায়ী ভাগের অনুপাত ঠিক রেখে সম্পত্তি ভাগ করতে গেলে তা ষোলআনা সম্পত্তি আঠারোআনায় গিয়ে ঠেকে। আছে আপনার ষোলআনা, কিন্তু বাটোয়ারা করতে হয় আঠারো আনা; কিন্তু বাস্তবে আঠারোআনা বলে তো কিছু নাই— এই বিভ্রাটকে বলা হতো আউল বিধান। কোরানের এই গড়হিসাবকে শেষপর্যন্ত একটি জায়গায় সাত-পাঁচ চৌদ্দ করে হিসাবে বিধিবদ্ধ করেন হযরত আলী। তিনি যে হিসাবে ফারায়েজ বিধানকে স্থির করেন তাতে সম্পত্তির পরিমান দাঁড়ায় ষোল আনার পরিবর্তে সাতাশআনা- তারপরও সমস্যার একটা কিনারা হয়। এই পরিস্থিতি বর্ণনা করে আরজ আলী মাতুব্বর বলেন— তাতে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে স্রষ্টার অঙ্কজ্ঞানে ভুল আছে; তাই যদি হয় তাহলে আল্লাহ ভুলের উর্ধে থাকেন না— এভাবেই আরজ আলী মাতুব্বর বাহাস করেন- এই গ্রন্থ মানুষের বয়ান— তা ঐশীগ্রন্থ হতে পারে না।
আল কোরানসহ জগতের সকল পবিত্র ও মহাগ্রন্থগুলোর ঐশীগ্রাহ্যতা সম্পর্কে তাবৎ গবেষণা আছে। সেই গবেষণাগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, দার্শনিক জিজ্ঞাসায় নিবিষ্ট, কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বরের প্রতিপাদ্য একদম সাদাকালো কাণ্ডজ্ঞানের উপর বসানো— এ যেন তার এক নির্ভুল আমিনতি বিদ্যায় ক্ষেতখিরি জমি মাপামাপির অকাট্য যোগফল।
অনেকেই আরজ আলী মাতুব্বরকে দার্শনিক বলেন; আমার কাছে মনে হয়, মাতুব্বরের কৃতিত্বই এখানে যে তিনি তাঁর সাকল্য জীবনে কখনোই দার্শনিক পরিভাষায় কথা বলেননি, দার্শনিকের মত ব্যবহার করেননি; তিনি একের পর এক বিজ্ঞানভিত্তিক রেফারেন্স দিয়েছেন, সামাজিক, ঐতিহাসিক, বিবর্তনমূলক বস্তুবাদের বিবরণ ও নথি পেশ করেছেন; তিনি একজন ধীমান, নাছোড় কৃষক— প্রকৃতি যে পাঠ দিয়েছে তাকে— তিনি তার নির্ভীক উপস্থাপক।
কিন্তু সবকিছুর পরও আরজ আলী মাতুব্বর সামগ্রিক মনোযোগ ও মর্যাদায় আমাদেরকে মোকাবেলাপ্রবণ একটি সময়ের দিকে ইঙ্গিত করেন; কাড়ি কাড়ি অর্থবিত্তের মালিক আরও সম্পদ দখল ও পাহারার জন্য ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ইলন মাস্ক বলেন— আমাদের সবার উপরে একজন ঈশ্বর আছেন; অন্যদিকে লামচরির এক বিত্তহীন কৃষক আরজ আলী মাতুব্বর শক্ত গোড়ালির উপর দাঁড়িয়ে বলছেন— না, ঈশ্বর বলে কিছু নাই।।
দেখতে পাচ্ছি, দারিদ্র্যের হাড়কাটা কষাঘাতে আন্তোনিও গ্রামশি ক্রমান্বয়ে এক জগৎখ্যাত দার্শনিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিপুল প্রাধান্যে চলে আসেন, কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বরের সামূহিক নির্ভীকচিত্ত ক্ষিপ্রতা থাকার পরও কোন মৌলিক দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, বা ইতিহাসকার হয়ে ওঠার যোগসূত্র দানা বাঁধেনি। যে জাতিগোষ্ঠীর ভিতর থেকে, যে ভাষার মর্মের ভিতর থেকে একজন মৌলিক ও সাহসী চিন্তক বেরিয়ে আসেন— তিনি কখনোই একা তা করে উঠতে পারেন না— তার চিন্তাপ্রক্রিয়া, প্রাক্সিস ও ব্যক্তিত্বে গোটা কৌমের বুদ্ধিবৃত্তিক নাব্যতার পলি এসে জমে, এটি একটি সামগ্রিক নিঃসঙ্গতার একটি দলিল বৈ তো নয়; গ্রামশির যোগাযোগ গড়ে ওঠে খোদ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের পরিবারের সাথে, তিনি সংস্কৃতি, শিক্ষা, শ্রেণী ও হেজিমোনির ধারণা মোকাবেলা করছেন কার্ল মার্কস ও বেনেদিত্তো ক্রোচের সঙ্গে, আর আরজ আলী মাতুব্বর সখ্য গড়ে তুলেছেন জিজ্ঞাসার লেখক ফযলুর রহমান মৃধার সঙ্গে; এ যোগসূত্র ও যৌথতা খারাপ ছিল না। কিন্তু তাঁদের জ্ঞানের জমিন ও বোঝাপড়ার ভিত পুরোটাই মুখস্থ ও ফর্মুলা বিজ্ঞানের জের। আমাদের সামগ্রিক সমাজদেহে বিজ্ঞানের নাম ছিল, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতার চিহ্নও ছিল না, ফলে আতজ আলী মাতুব্বরে যা আছে তা বহির্বিশ্বে বিজ্ঞানচর্চার হিসাব— বিজ্ঞানমনস্কভাবে দার্শনিক হয়ে ওঠা, কিংবা দার্শনিকভাবে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার কোন গাছপাথর ওখানে থাকেনি।
একজন আরজ আলীকে দার্শনিক করে তোলার সামাজিক তাগিদ, সঙ্গতি ও প্রস্তুতি আমাদের অঞ্চলে ছিল না, তাই তিনি আমাদের সক্রেটিস হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু গ্যালিলিও হয়ে উঠেছিলেন ঠিকই : নিকোলাস কোপারনিকাসের সৌরতত্ত্বের পক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তির কারণে ১২ এপ্রিল ১৬৩৩ সনে চার্চের সামনে গ্যালিলিও গ্যালিলে ক্ষমাপ্রার্থনা করে মুচলেকা দিতে বাধ্য হন, তারপর বাকি জীবন তিনি কার্যত গৃহবন্দী ছিলেন, এভাবেই গ্যালিলিও ১৬৪২ সনে মারা যান। আরজ আলী মাতুব্বরও মুচলেকা লিখে জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৫০ সনে; তাঁকে কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জনগণকে উসকে দেবার অপরাধে জেলে পোড়া হয়েছিল।
মাতুব্বরের প্রকৃত কৃতি ওখানে— স্বাভাবিক উজান-ভাটির টানে যা করার কথা ছিল— তা তিনি কখনোই করেননি। আঙুল ঠেকিয়ে দেখানো যায় এমন কোন দর্শন আমাদের নেই, কিন্তু সার্বিকভাবে যে উপরিকাঠামোর অধীনে আমরা আছি তার অন্তঃসলিলায় একটি দার্শনিক স্থিতি নিশ্চয়ই আছে— একটি মৃন্ময় চিন্ময়ের যৌগ— যাকে বাংলার দর্শন না বললেও বাংলার মরমিয়া বলতেই পারি— যা আমাদের দার্শনিক প্রাণশক্তির যোগান দেয়। ফলে এটি খুব নিরন্তর স্বাভাবিক ছিল— দিনশেষে আরজ আলী মাতুব্বর একটি ভাব সাধনার দিকে নোঙর করবেন, কিন্তু আমরা আশ্চর্য হই দেখে যে, তিনি মরমিয়ার দিকে ঝোঁকেননি।
অন্য আরেকটি পথ খোলা ছিল— সশস্ত্র বা আধাসশস্ত্র কিংবা বুদ্ধিবাদী কোন বাম ঘরানার সঙ্গে একীভূত হওয়া। এবারও অবাক হয়ে দেখি, তিনি তা করেননি।বাঙলা অঞ্চলের ইতিহাসে আমাদের যার যা করার কথা থাকে— হরহামেশাই তার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রত্যয়ের কিছু করতে দেখি। মোফাক্কর চৌধুরীর যে ভাবাবেগ ও বিহবলতা ছিল— তাঁর জন্য একজন নির্ঘুম যাজক হলে সবচেয়ে সঠিক কাজটি হতো, কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের পথ, চারু মজুমদারের জন্যও একই অতীতাশ্রয়ী ভবিষ্যৎ বাণীটি খাটে।
আরজ আলী মাতুব্বর ভারত অঞ্চলে চিন্তার দিক থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী যাদের তাঁরা হলেন চার্বাক দার্শনিক। একটি জায়গায় চার্বাকদের সাথে আরজ আলী মাতুব্বরের নিদারুণ মিল, তা হলো— চার্বাকরা বলতেন প্রত্যাদেশের উপর একচুলও আস্থা নাই আমাদের, আমাদের কিছু বিশ্বাস করতে বলো তো নগদে প্রমাণ দেখাও। একটু অমিল অবশ্য হয় বিলাসের জায়গাটায়— চার্বাকরা বিশ্বাস করতেন— ধার করে হলেও ঘি খাও, আর সুখে থাকো— এজীবনই তোমার সবটা জীবন, বাকি উড়াকথা ফক্কা; আরজ আলী মাতুব্বর সুখ-ভোগের দিকে একেবারেই নেই, পুরোটাই অঙ্কের হিসাব তার।
সত্যের সন্ধানে আরজ আলী মাতুব্বরের যে প্রকল্প তা অনেকটাই দার্শনিকসুলভ; অন্ততপক্ষে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বইটির যে শিরোনাম— সত্যের সন্ধান— তার মধ্যে একটি দার্শনিক অভিব্যক্তি আছে। কেননা, তিনি সত্যকে কোন পূর্বানুমানে ফেলছেন না, সত্য একটি না-ও হতে পারে, অথবা এমনও হতে পারে— সত্য আছে, কিন্তু তারসঙ্গে কখনও দেখা হয় না। এক্ষেত্রে খুব কাছের একটি উদাহরণ দিই। আমাদের হাতের মধ্যে হাতের তালু আছে, আবার হাতের পিঠও আছে- কিন্তু তালুর সঙ্গে পিঠের, পিঠের সঙ্গে তালুর কোনদিনই দেখা হয় না। তার মানে হাতের তালু ও হাতের পিঠ দেখন প্রক্রিয়ার বিচারে অসত্য, কিন্তু ভাবপ্রক্রিয়া ও অদৃশ্যতায় সত্য।
ব্যাপারটা খুব মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে যখন দেখি আরজ আলী মাতুব্বর সৃষ্টিতত্ত্বের বিভিন্ন লোককাহিনীর ভিতর অভিযাত্রা করেন, সেখানে তাঁর কোন অধৈর্য্য বা গুরুত্বহীনতা নাই। একের পর এক বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর পুরাণ কাহিনী বর্ণনা করে যাচ্ছেন, নিচে তার কিছু নমুনা হাজির করা যাক :
চীনারা সৃষ্টির আদি থেকেই আছে, তারা অন্য কোথাও থেকে আসেনি, তাদের স্রষ্টা টা নামক হাতুড়ি দিয়ে ডিম্বাকার পৃথিবী ভেঙে ফেলে, তাতেই ডিমের ভিতর থেকে মানুষ বেরিয়ে আসে, প্রথম যে মানুষটি বেরোয় তার নাম পাঙ্কু।
মিশরের একটি নৃগোষ্ঠী মনে করে— তাদের সৃষ্টিকর্তার নাম খুনুম, খুনুম প্রথম ডিম্বাকৃতি পৃথিবী সৃষ্টি করেন, পরে নিজের ইচ্ছাতেই মানুষ তৈরি করেন।
আফ্রিকার এক বুনোজাতির বিশ্বাস— মান্টিশ নাম একটি পতঙ্গ তাদের সবকিছু সৃষ্টির মূল।
হটনটন জাতিগোষ্ঠীর ধারনায় তাদের সৃষ্টিকর্তার নাম শুনিগুয়ান- তিনি শূন্য থেকে এই মহামহিম দুনিয়া সৃষ্টি করেন।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া অঞ্চলের কিছু আদিবাসী মনে করে পণ্ডঝিল নামক একটি পক্ষী এই জগৎসংসার সৃষ্টি করে।
আলাস্কার থিলিংকিট আদিবাসীরা মনে করে, জেল নাম একটি দাঁড়কাক তাদের আদি সৃষ্টিকর্তা।
এমন আরও বহু অভূতপূর্ব জিনিস আছে যাদের কথা আরজ আলী মাতুব্বর নিরলসভাবে তুলে আনছেন, তাতে তার কোন ক্লান্তি নাই। ফলে বোঝা যায় তাঁর ব্যক্তিত্বে একটা সহজাত নিরীক্ষামূলক দার্শনিক, বা নৃবিজ্ঞানীর পরিসর ছিল। কিন্তু আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষার যে নিগড় তা তাঁর অজান্তেই একটি তালা লাগিয়ে দিয়েছে, ফলে তিনি তাঁর চ্যালেঞ্জ জিতে আসার জন্য যে ভাবনার পাটাতনের উপর তিনি দাঁড়ান তা ইউরোপীয়। দুঃখজনক হলেও সত্য তিনি একজন গ্রামীণ কৃষকমাত্র, তারপরও যে বিজ্ঞানের কাছে, বিজ্ঞানের ফলাফলের কাছে শতভাগ সমর্পিত তা পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের ভিৎ।
ঈশ্বরহীনতা প্রমাণ করাই তাঁর এককাট্টা প্রকল্প। এই প্রকল্পের দার্শনিক এলাকায় যাঁরা কাজ করেন তাদের মধ্যে ফ্রেডারিখ নীটশে, কার্ল মার্কস, জাঁ পল সার্ত্রে, বারট্রান্ড রাসেল, আলবেয়ার কাম্যু অগ্রগণ্য। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিযাত্রাটুকু খেয়াল করলে দেখা যায়— তাদের প্রত্যের মধ্যে আগুপিছু আছে, পারমার্থিক ও জাগতিক ক্রিয়াকাণ্ডে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ম্যাটাফোর আছে— তারা প্রত্যেকেই অবরোহী— নিরীক্ষা ও ধ্যান করে করে আগান, কেউ আরোহী নন— পূর্বনির্ধারিত কোন সত্যই তারা উদযাপন করেন না; রেনে দেকার্ত আধুনিক দর্শনের একটি আভিমুখ্যই নির্ধারণ করেন এভাবে— একচ্ছত্র সত্য বলে কিছু অপেক্ষা করে নেই— যা আছে তা সত্যের দিকে যাত্রা।
কিন্তু আরজ আলী মাতুব্বরকে দেখি নিরঙ্কুশ বিজ্ঞানের হালখাতার ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছেন— বিজ্ঞানও একতরফা কিছু নয়, বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত নিজেকে ভুল প্রমাণিত করার ব্রতযাত্রা।
কিন্তু সবকিছুর পরও আরজ আলী মাতুব্বর সামগ্রিক মনোযোগ ও মর্যাদায় আমাদেরকে মোকাবেলাপ্রবণ একটি সময়ের দিকে ইঙ্গিত করেন; কাড়ি কাড়ি অর্থবিত্তের মালিক আরও সম্পদ দখল ও পাহারার জন্য ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ইলন মাস্ক বলেন— আমাদের সবার উপরে একজন ঈশ্বর আছেন; অন্যদিকে লামচরির এক বিত্তহীন কৃষক আরজ আলী মাতুব্বর শক্ত গোড়ালির উপর দাঁড়িয়ে বলছেন— না, ঈশ্বর বলে কিছু নাই।।