দশটি কবিতা । ঋতো আহমেদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ নভেম্বর ২০২৩, ৪:১৯ অপরাহ্ণ, | ৪৩৯ বার পঠিত
কবিতা ০৮
হে দূরতম অতীত হে সময়দিগন্ত তোমার থেকেই বেরিয়ে এসছে
এই পথ। এখনও ঘুমাও তুমি। তোমার থেকেই বেরিয়েছে অন্ধকার। আসন্ন প্রাত
হে পাষাণপাথর হে আয়ু হে বিষভাণ্ডের মুখ তোমার থেকেই বেরিয়েছে জগত্সংসার। এমনও
ঘুণাক্ষর—। তোমার থেকেই বহমান নদ। অপ্রসন্ন ঢেউ। চোটপাট
তোমরা এবার হাই তোলো। ওঠো। আয়নার ভিতর থেকে
কথা বলি আমরা। একটু পরপর হাত নাড়াই। নয়তো পত্রিকা চলে এলে চা-নাস্তার ডাক পড়বে যখন, তারপর
আর সময় হবে না। এসো, সামনাসামনি কথাগুলো বলে ফেলি আমরা।
বলতে বলতে একটা সাদা ফোয়ারা বেরিয়ে আসুক আমার
মুখ থেকে। পাষাণ থেকে পাথরগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ুক
. সময় ভেঙে ভেঙে পড়ুক
. অন্ধকার ভেঙে ভেঙে পড়ুক
. ঢেউগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ুক
কবিতা ১২
তোমাকে দেখা যাচ্ছে না, আমাকে যাচ্ছে।
এই দেখা না দেখার মাঝখান থেকে একটা স্বপ্ন এসে মেলে ধরল তার ডানা। প্রথমে
পাখির ডানার মতোই মনে হচ্ছিল তারে। কারণ, স্বপ্ন তো একপ্রকার পাখিই
তারপর সেই পাখি ধীরে ধীরে তার জীবন ভেঙে বেরিয়ে এলো,
জীবনে—
নিরন্তর নিরন্তর জীবনে। আমরা তার উড্ডয়ন দেখতে পেলাম আর ভাবতে থাকলাম
আমাদের দেখা না দেখার মাঝখানে একটা পাখি ছাড়াও আর কী কী থাকতে পারে
তলিয়ে দেখতে হবে।
তুমি বললে, গা বেয়ে ওঠা ব্যর্থ জঙ্গল
আমি ভাবলাম, শ্বাপদসংকুল স্বর্গঙ্গা, গরম ধাতুর উল্কা
তুমি লিখলে, রক্ত মাংস মায়া, তুমি লিখলে জীবন্মৃত্যু, লিখলে সর্বজয়া
আমি দেখলাম, অগ্নি, দেখলাম পুড়ে যাচ্ছে পাতাল ও হায়া
কবিতা ১৩
পৃথিবীটা থেমে থেমে চলছে আজকাল।
কিন্তু এমনটা ছিল না সবসময়। আমার বাবার আমলে
আন্তঃনগর ট্রেনের মতোই ছিল এর গতি। আর দাদার আমলে
কোনও ট্রেনই ছিল না আমাদের গাঁয়ে। তখন লাটিমই ছিল পৃথিবী। দাদা
বলতেন, এই দ্যাখ, তোদের লাটিম যেমন ঘোরে, পৃথিবীটাও তেমন। ঘুরতে ঘুরতে
ঘুরতে ঘুরতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
সবাই শুনে হাসত। আমিও বোকার মতো ভাবতাম, তাহলে শাল কোথায় পৃথিবীর?
ছিটকেইবা যাচ্ছি না কেন? কিন্তু—
ছিটকে যে গিয়েছি কতোটা, তা আজ অনুমানও করতে পারি না। হাজার আলোকবর্ষ দূরের
তাঁর কবর থেকে তিনি আমাদের দেখছেন আর বলছেন, বলেছিলাম না? তখন তো
হাসতিস খুব। এখন ক্যামন…এখন তো আমার হাসার পালা…
তাঁর খুরখুরে হাসির দমকে পৃথিবীটা দুলে দুলে উঠল ভোরের দিকে
কবিতা ১৪
আমাদের দেখার মধ্যে একটা তফাৎ দেখা দিল। এটা
বুঝতে পেরেই আমরা কেউ কাউকে আর দেখতে চাইলাম না। তখন
অগোচরেই একেকটা কাণ্ড ঘটে যেতে লাগল কবিতায়—
এই যেমন গত বছর হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম, ক্রমশ নীচের দিকে
নেমে যাচ্ছি। কবিতার স্থান-কাল এতোটাই বেঁকে গেছে, যে এখন
কেবল ভারীই লাগছে অক্ষরগুলোকে। যা-ই লিখি না কেন
নিচের দিকে নেমে যায়। একেবারে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। অথচ
কী হালকাই না ছিল একসময়!
তুলোর মতো উড়ে উড়ে বেড়াত আমাদের মনের সামনের মাঠে। আমরা
হাত বাড়িয়ে যে কোনও সময় যে কোনও কবিতা উড়িয়ে দিতাম বায়ুমণ্ডলে।
পাঠক তার ঘ্রাণ শুঁকে নিতে পারতো।
এখন, একেকটা পঙক্তির উচ্চারণ শুনতে চাইলে ঘাড় অনেকটাই কাঁত করতে হয় তাকে।
কুয়োর ভিতরে ঢিল ছুঁড়লে যেমন কিছুক্ষণ নীরবতার পর পতনের আওয়াজ পাওয়া যায়—
ঠিক তেমনি, কবিতা আজকাল উচ্চারিত হয় পাতাল থেকে। কারণ, এর বক্রতা হয়ে গেছে
পাতাল মুখী।
অসীম।
কবিতা ১৫
পাখিরা কীভাবে চলে যায় আজ আরও একবার জানতে পারলাম।
হ্যাঁ, যাবার আগে কিছুটা সময় নেবে সে। তোমার দিকে তাকাবে কয়েকবার। কিছু একটা
বলতে চাইবে হয়তো। যার কিছুই বুঝবে না তুমি। অথবা বুঝবে কেবল
মর্মটুকু। সে চলে যাচ্ছে। বিদায় জানাচ্ছে। এবং জানাচ্ছে ধন্যবাদও।
ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য। এদ্দিনের জল শস্য আর কয়েদখানার ভালোবাসার জন্য।
তবে, পাখিদের এই চলে যাওয়াটা মানুষের জন্য যে ভীষণ মন খারাপের, তা বোঝা যায়
রাত নামলে। কেননা, রাত নেমে আসলেই উদয় হয় উৎকণ্ঠার। বারান্দায়
ঘন ঘন পায়চারি। অন্ধকারে কিছু একটা দেখার চেষ্টা। কিংবা
শুনতে পাওয়া যায় কিনা নড়াচড়ার কোনও আওয়াজ। পরিচিত সেই ডাক।। কিন্তু যে
বাতাসের ভিতর থেকে কথা বলে উঠবে সে, যেই খড়কুটো, যে রোদ, যেই ঝড় বৃষ্টি জল—
সর্বোপরি যেই বিস্তীর্ণ আকাশ
সেইখানে, মনুষ্য ভালোবাসার মান আসলে কত?
কবিতা ৩২
পৃথিবীর দক্ষিণাঞ্চল থেকে যে গল্পটা উড়তে উড়তে
এসে গিয়েছিল এই কংক্রিটের বনানীর মাথা বারাবর, সে আজ
অকস্মাৎ শ্রাবণের ধারার সঙ্গে ভেসে গিয়েছে।
তাকে বহন করার মতো পাখিদের কোনও ডানা আর শুকনো ছিল না।
আমরা তাকে ধরার জন্য দ্রুত পা বাড়ালাম। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে
একসময় তার কথার জলে আমাদের পা ভিজে গেল। ক্ষণে ক্ষণে পরিষ্কার হয়ে উঠল
পূর্বাকাশ।
আমরা একে অন্যের দিকে তাকালাম। আমরা কি হারিয়ে ফেলেছি?—
আমরা, কী হারিয়ে ফেলেছি? একটা বুড়ো বটগাছ আর একটা বিদ্যুৎগর্জনমুখর রাত
আমাদের পথ আগলালো। ভাবছি কী করতে পারি আমরা? অকাট্য অন্ধকারকে ভেদ করে
এখন কি দেখা দেবে কোনও পূর্বপুরুষের পা? বিস্মৃতির গহিন থেকে
জ্বলে উঠবে কোনও পদশব্দের অগ্নি?
পরদিন, শহুরে আভিজাত্যের সূর্য ছাড়া আর কিছুই নেই। যে কিনা সেই
অপঠিত গল্পের দেহ থেকে একটু একটু করে শুষে নেয় অক্ষর। শুষে নেয় সমুদ্রের
উত্তাল ইতিহাস। আমাদের ঘুম ভাঙে এক ছিন্নভিন্ন অতীত আগাছার জঙ্গলে।
কবিতা ৩৩
ভাবো একটা উওর্ড্রোবের ভিতর ক’বছর বাঁচা যায়? কিংবা একটা পুরনো
সিআরটি’র ভিতর? কেউ কেউ অবশ্য এক জীবনও পারে। আবার কেউ হয়তো পারে
একটা ফুল অথবা একটা ফলের মৌসুম পর্যন্ত।
জানিনা পৃথিবীতে এখন কোন ফুলের হাওয়া বইছে। ঘুম ভাঙতেই
বাতাসে ছড়িয়ে থাকা আগুন নির্বাপক এলার্মের মতো সংকেতের ঢেউ এসে বাড়ি খায়
আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে। বুকের ভিতর গুমরে গুমরে ওঠে আপন হারানোর ভয়।
আমি দেখতে পাই কাল রাতের মেঘসঞ্চার দূরের আকাশে এখনও বিরাজমান।
শুনতে পাই তাদের গুরুগুরু ডাক, উড়ে যাচ্ছে আমার মাথার উপর দিয়ে। চোখে পড়ছে
খসে খসে পড়া কালচে-সাদা পলেস্তরা। অচরিতার্থ গন্দম।—
আমাকে আর কী ভার বইতে হবে? ছড়ানো আগ্নিপথে, কে পড়ে আছেন অমন
উবু হয়ে? মৃত্যুর ভিতর কি একাকীত্বের ভিতর কি সঞ্চারিত মেঘ নিজেকে হারাতে জানে?
মানুষ ও মায়ার ভেদরেখা মুছে গেলেই কি জীবন অনন্ত?
কবিতা ৩৭
প্রত্যেক রাতে একটু একটু করে মরে যাও তুমি।
কেউ তোমাকে বলেছিল, পরের জগতে যেতে চাইলে, এসো।
তুমি তখন ভয় পেয়েছিলে। পরের জগত্ মানে কি মৃত্যুর পরের কিছু? নাকি সমান্তরাল
প্রতিবিশ্ব? প্রতি রাত্রেই যেখানে একটু একটু করে ঘুরে আসা যায়।
তোমার ভয় ও লোভ—দুটোই কাজ করেছিল জানি। অবশ্য, তুমি বলতে কিউরিসিটি।
আসলে কিছুই হারাতে চাইতে না। তোমার ধারণা হয়েছিল বদ্ধমূল যে
একবারে নয়, একটু একটু করে মরলেই বোধহয়
যাওয়া যায় ঊর্ধ্ব মাত্রায়।
একসময় তোমার বাঁ পাশটার কিছু অংশ আর দেখতে পেলাম না আমরা।
যেমন তোমার বাঁ হাতের কড়ে আঙুল, বাঁ কানের লতি এইসব—
দেখতে পেলাম কেবল তোমার অদ্ভুত প্রসন্ন মুখ। আর,
সেইসঙ্গে ১২৭ রকম জিজ্ঞাসা আমাদের মনের সামনের হাওয়ায় ভাসতে লাগলো।
ফুঁ এর পর ফুঁ দিয়ে আমরা তাদের ঠেলে দিতে চাইলাম তোমার ক্ষয়ে যাওয়া অংশের
শূন্যের দিকে।
কে জানে হয়তো ওই শূন্য থেকেই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর শুরু।
কবিতা ৩৮
ঘুটঘুটে রাত আমার বাঁ দিকের দরজার ওপাশেই ফুটে আছে নিঝুম লবঙ্গের মতো। বললাম, চায়ের মধ্যে এলাচের সঙ্গে দু’খানা রাতও মিশিয়ে দিও। সামান্য ঝাঁঝ না থাকলে আজকাল কেন যে ভাল্লাগে না চা! চেতনাসিন্ধুর বুকেও ঝড় ওঠে না। কিন্তু যেই ডান দিকের দরজাটা খুলে গেল অকস্মাৎ, হু হু করে ঢুকতে শুরু করলো মাতাল হাওয়ার বাক্যস্রোত, আর একটা অশ্লীল বৃক্ষের ডাল উড়ে এসে পড়ল একেবারে ভূমধ্যসাগরে। তখন ক্যামন করে যে কেঁপে কেঁপে উঠল এই জগত্বিছানা! আমার হাতের থেকেও এক মুহূর্তে পড়ে গেলেন সেলান। আমার হাত,, যে কিনা ১৯৭০ সালের ২০ শে এপ্রিল ছাড়া কিছুই ছিল না এদ্দিন। যে অমন নির্মিতির ভাষার ভিতর দিয়েও নেমে আসতে পারতো জলস্রোতে। ঘাড় নামিয়ে তার দিকেই তাকালাম আমি। কোনও সুরঙ্গ নেই। গোপন করার মতো কিছুই নেই এই হাতে। তারপরও, বারবার ভাবি, এই পতন তাহলে কি সভ্যতার কোনও পরিহাস ছিল, নাকি অবচেতনের মায়ায় অদৃষ্ট কালপ্রবাহে লবঙ্গের ঝাঁপ? আমার তো কোনও বহুছিদ্রময় বৃত্তান্ত ছিল না কোনোদিন। প্রশ্নের বিপরীতে আমার প্রশ্নসঞ্চার তোমাদের আকাশগঙ্গায় আলোই ছড়িয়েছে প্রতিবার। তোমরাও দেখতে পেয়েছ সৃষ্টির পূর্ব সময়ে কবিতা, দেখতে ক্যামন দেখাতো। কোন রণমুহূর্তেইবা কবিতার গভীরে গিয়ে সাতটি রঙে রাঙিয়ে দেয়া যায় তার গরিমা। তাহলে, আমার বাঁ দিকের দরজা খোলার আগে আমার ডান দিকের দরজাটা খুলে গেল কেন? আমার বোধগম্য হয় না।
কবিতা ৪৫
এইতো, পুলসিরাতের আগে যে মাটি তোমাকে আগলে নেবে
তার কাছে বসে বুক ভরে শ্বাস নাও। এইখানে, ধূলো হয়ে যাবার পূর্ব পর্যন্তই
সময় তোমার। খুব কাছে থেকে
কারা যেন এইসবই বলে গেল আমায় গতরাতের স্বপ্নে। মা বলেছিলেন, ভালো স্বপ্নগুলো
জমিয়ে রাখবি ভোরের জন্য। আর যত মন্দ কিছু, শেষ করবি গভীর রাতে।
অথচ আমার রাত কখনও ভোর হয় না। কিন্তু প্রায়শই ভোররাত হয়ে যায় গভীর।
পরিচিত সব মুখোশ পরে কারা যেন আসে। পাখিদের ভাষায়
কথা বলে। যদিও
ভালো ও মন্দের প্রভেদ খুব একটা বুঝতে পারি না আমি। প্রতিবার
ঘাম দিয়ে জ্বর সারার মতোই ঘুম ভাঙে মধ্য-দুপুরে। দেখি-যে নির্জন মাঠের মধ্যে
পাতাদের স্তুপের পাশেই শরীরটা বিস্তারিত হয়ে আছে।
ঝরঝরে মাটির আকাশে কোথাও নক্ষত্র নেই চুম্বন নেই। নিখিল ঘাসের উপর কেবল
দুটো চড়ুই আর একটা বুলবুল। আমার দিকেই কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছে বারবার।
আমি জিজ্ঞেস করি, তুমিই কি সেই বেহেস্তের বুলবুল? বলতে পারো
পুলসিরাতের কোন পাড়েইবা রয়েছি আমরা?
সে কোনও উত্তর দেয় না।
হঠাৎ উড়ে যায়।
একটা গূঢ় সত্য থেকে যায় অমীমাংসিত এবং পরম প্রশ্নের চাদরে আবৃত।