মধ্যরাতের ট্রেন । পাপড়ি রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ, | ৪৫২ বার পঠিত
গুলি লাগল কাজলের ডান পায়ে। গোড়ালির সামান্য ওপরে। চামড়া-মাংস ভেদ করে গুলিটা বেরিয়ে গেল। একটা আর্তস্বর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল।
নয়ন পাশে ছিল। সে ঝটতি কাজলের মুখে হাতচাপা দিল। তারপরও কাজল চিৎকার করল। অসংখ্যবার চিৎকার করল। কিন্তু কেউ আর তা শুনল না।
সবুজ ঘাস নিমিষে রক্তে ডুবে গেল। কাজল তাও তাকিয়ে দেখল। হঠাৎ তার মনে হলো লতাপাতা, আকাশ, উড়ন্ত-পাখি সব কী রকম মরে যাচ্ছে। আকাশ-পাখিদের মৃত্যু দেখতে দেখতে মনে হলো সেও কী রকম মরে যাচ্ছে। কিন্তু নয়নের জন্য তার মরা হলো না! নয়ন তাকে পাঁজাকোলা করে পিছু হটতে লাগল। একসময় মানুষ-সমান-উঁচু পাটক্ষেতে ঢুকে পড়ল। ক্ষেতের ভেতর হাঁটুজল থমকে ছিল। আর পাটের শাখায় হলদে শুঁয়াপোকা। নয়ন থমকানো জলে ছপছপ ধ্বনি তুলল। অতঃপর জল ভেঙে ক্ষেতের গভীরে চলে এল।
কাজলের চোখের ওপরের আকাশ ঢাকা পড়ে গেল!
পাটের পাতায় পাতায় রোদ্দুর শুয়ে ছিল। শুয়ে ছিল খানিকটা ত্যারছা হয়ে; আয়েশি ভঙ্গিতে। ফলে সবুজ-ছায়া দুজনকে ঢেকে রাখল। সেই ছায়া সরিয়ে কাজলের আর মরে যাওয়া হলো না। বরঙ ছায়ার ভেতর চলতে চলতে ঘুমঘোরে ডুবে গেল সে। যেন-বা ছেলেবেলার কোনো বৃষ্টিমুখর দিনে তলিয়ে গেল! আষাঢ় কি শ্রাবণের ঝুমবৃষ্টির কোনো দিন। বৃষ্টি হলে মা ওকে ঘরে আটকে রাখতেন। কাজলের বন্দিদশা দেখে বৃষ্টি আরো ঘন হয়ে ঝরত। উঠানের সীমান্ত ঘেঁষা ন্যাংটা মান্দারগাছটা ভিজে একশা। আর ডোয়া আঁকড়ানো কাঁঠাল কি আমের পাতায় তীব্র সতেজতা। এসব দেখতে দেখতে মায়ের চোখে অন্যরকম দৃষ্টি ফুটে উঠত। মা উদাস হলেই কাজল দৌড়ে পালাত; সোজা বাংলা ঘরে।
নয়ন আর অরুণ তখন দীর্ঘ অপেক্ষায় ক্লান্ত। ফিরে যাবে কি যাবে না দোটানায় দুলছে। তখনি কাজলের দেখা মিলত। তারপর তিনজন মিলে নতুন পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে ওঠা। চুরি করে আনা মায়ের নকশিকাঁথার তাঁবুতে ঢুকে পড়া। সেই কাঁথার নিচে অচেনা-আলো। কেমন যেন ঘোর-লাগা। সদ্য-ভোর ফুটেছে। না ঠিক ভোরও নয়, ছাইবর্ণা-মেঘ আসমানের সমস্ত আলো ঢেকে দিয়েছে এমন…।
সেই অভূতপূর্ব আলোর ভেতর নয়ন আর অরুণের সঙ্গে ষোলো গুটি, বাঘচাল। নতুব গভীর মনোযোগে কড়িচালা। চারটে কড়ি চিতপাত পড়লেই কাড়াকাড়ি। হুটোপুটি। হয়তো বাইরে তখন বৃষ্টি আরো ঝেঁপে নেমেছে। কচুপাতার ছাতায় এ বাদল ঠেকিয়ে নয়ন আর অরুণের বাড়ি ফেরা অসম্ভব।
কড়িচালায় মগ্ন থেকে কেউ টেরই পেত না কখন যে বৃষ্টি থেমে গেছে। ফিকে রোদ্দুরে ভরে গেছে আকাশ। আর সেই আলোতে কাঁথার লুকানো কঙ্কাল হেসে উঠেছে। সেখানে পুরনো মশারি বা ঝ্যালঝ্যালে চাদরের দৈন্য; যেন-বা ভিখিরি ধারণ করেছে নকশিকাঁথার রাজবেশ।
রেললাইন ধরে হেঁটে এসে কাজলের কী যে হয়! রাতে আর ভাত খেতে ইচ্ছে করে না। করমালি চাচাও উপোস থাকে। কাজল না-খেলে সে খাবে কী করে? দুজন মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে। বসে বসে ভাবে আর ভাবে। রাতভর কেউই আর ঘুমাতে পারে না…।
নয়নের জন্যই কাজলের মরা হলো না। কিন্তু ওর যে আর যুদ্ধ করাও হলো না। কাজল মায়ের কাছে পড়ে রইল। ধীরে ধীরে শিশুর মতো হাঁটতে শিখল। লাঠি ভর করে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে কাজল বেঁচে রইল। কাজলের মনে হলো এ বড় নির্লজ্জ বেঁচে থাকা!
মাথার ওপর তখনো বোমারু বিমান। আর বাতাসে সারাক্ষণ বারুদের ঘ্রাণ। এসবের সঙ্গে দুই ঘরের পাশাপাশি ডোয়ার আড়াল। মা তবু সন্দিহান ছিলেন। করমালি চাচাকে দিয়ে মান্দারের তলায় ট্র্যান্স খুঁড়িয়েছিলেন। টিন দিয়ে ঢেকে ওপরে মাটি ভরাট করে দিয়েছিলেন। ঠুসঠাস শুরু হলেই কাজলকে ট্র্যান্সের ভেতর ঠেলে দিতেন। বড় সাবধানে লুকিয়ে রাখতেন; যেন যক্ষের ধন। মাঝে মাঝে কাজল অসহ্য হয়ে ফুঁসে উঠত। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের ক্রোধ দমাতে চাইত। মা সবই টের পেতেন। কাজলের অপারগতার যন্ত্রণা! ব্যর্থ সৈনিকের বেদনা মা বুকে তুলে নিতে চাইতেন। কাজল দাঁতে চেপে নিজেকে সামলাত। মায়ের কাছ থেকে পরাজয় গোপন করতে চাইত।
সেবার শীত আসতে না আসতেই ন্যাংটা মান্দারে সবুজের স্পর্শ লাগল। কিশলয়ে ভরে উঠল তার শাখা-প্রশাখা। তখন ঝাউতলি বাজার পাকিস্তান আর্মির দখলে। মা বড় সাবধান ছিলেন। কাজলকে আগেভাগেই সরিয়ে দিলেন। ঝাউতলির কাঁচা-রাস্তায় পঙ্গপালের মতো আর্মি। আর কাজল তখন গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে — ধলেশ্বরীর তীরে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চেনা পথ ফেলে যাচ্ছিল পেছনে। তারপর কাজল হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। আর দেখেছিল ঝাউতলির আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ইটরঙা-লেলিহান-শিখা সেই নিকষ কালোতে নৃত্যপর ছিল।
মা-ও দেখেছিল। আগুনের সর্বগ্রাসী তাণ্ডব দেখে জলের ধারে আছড়ে পড়েছিল—
‘বাজানরে সব পুইড়া ছারখার হইলো…’
কাজল মায়ের কথার উত্তর করেনি। ফের মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিল। তখন সোনালি-মেঘ আর কালো-ধোঁয়া একাকার হয়ে গ্যাছে। ইটরঙা-লেলিহান-শিখা দখিনা বাতাসে আরো ক্ষেপে উঠেছিল। ঝাউতলি গিলে ফেলে ক্রমে তা ফুলতলিতে ধেয়েছিল। আর দেখতে না দেখতেই ফুলতলিতে ঘরবাড়ি-দোকানপাট দাউদাউ আগুনে ভস্ম হয়ে গিয়েছিল। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছিল কেরোসিন-তেলের-ড্রাম, সর্ষেতেলের টিন। খই-মুড়ির বস্তার আগুন তা-থই নেচেছিল। ঘরের কড়িবর্গার কাঠ, বাঁশের মাচা ফটাফট শব্দ করে পুড়ছিল।
কাজল দূর থেকেও আগুনের উত্তাপ আন্দাজ করেছিল। কানের পাশ দিয়ে ছুটেছিল ঝাঁকে ঝাঁকে এলোপাথাড়ি বুলেট। ততক্ষণে কাজলও মায়ের পাশে শুয়ে পড়েছে। কাজলের পাশেই কার যেন যুবতি-বউ। যুবতি বউয়ের পাশে বৃদ্ধ। যুবক। বৃদ্ধা। কিশোরী। তরুণী— এইভাবে অগণন মানুষ নির্দ্বিধায় শুয়ে ছিল। আর তারা ধলেশ্বরী শীতল জলে ভিজে উঠেছিল। একই নদীর তীরে অসহায় মানুষের শয়ান দেখে কাজলের মনে হয়েছিল।
‘এইবার সমাজতন্ত্র!’
ঘোরতর যুদ্ধের দিনগুলোতে তা ছিল বইকি! মানুষ ভুলেছিল সকল ভেদাভেদ। চণ্ডালের ঘরে ঠাঁই পেয়েছিল ব্রাহ্মণ; হিন্দুর ঘরে মুসলিম, মুসলমানের মসজিদে হিন্দু — এভাবেই…!
ইদানীং এসব ভাবলে কাজলের ভারি অদ্ভুত লাগে। সেও কী রকম মরতে মরতে বেঁচে গেল! তার পঙ্গুজীবনের বাঁচাটা কী এমন দরকারি ছিল? কাজল তো স্টেনগান তুলে বারুদের গন্ধের ভেতর আর দৌড়াতে পারে না। ওর যে এখন অবলম্বন চাই। অবলম্বন।
বাঁশের শক্ত লাঠিটা কাজলের অবলম্বন। করমালি চাচা অবলম্বন। মা ছিলেন অবলম্বন। বুকের ভেতরের উদ্দীপনা ছিল অবলম্বন। নয়নের মতো বন্ধু ছিল অবলম্বন। যে আধমরা কাজলকে দুর্দান্ত সাহসে বাঁচিয়ে দিয়েছিল!
অথচ যুদ্ধের খেলাটা সে শিখেছিল কাজলের কাছেই। উদ্দীপনাটা বুকে জমিয়েছিল কাজলের কাছ থেকেই। কঞ্চির নলে গুলি ভরতে শিখেছিল কাজলের কাছেই। সেই ফুলফোটা উজ্জ্বল ছেলেবেলাতে।
কচুপাতা হাতের তালুতে ভালো করে ডলে নিত দুজন। তারপর কঞ্চির নলে পুরে দিত। পিচকিরি মতো হাতলটা জোরে ঠেললে হালকা শব্দ হতো। আর গুলিটা ছুটে যেত সামনে। ছিটকে পড়ত ঘন ঝোপের ওপর। ঝোপ বলতে কয়েকটা বরুণ, শেয়ালমুতা, মইলটা আর আসশ্যোওড়া। সেই বিস্তর সবুজের ভেতর কার গুলিটা যে কোথায় পড়ত? তা খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল। কাজল আর নয়ন তবুও ইতিউতি খুঁজত। খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত। তখন মনে হতো কচুপাতার গুলিতে যুদ্ধ যেন ঠিকমত জমছে না। খাটাজোড়া আর না-হলেই নয়। খাটাজোড়ায় নিশানা কখনো ব্যর্থ হয় না। ফটাশ করে এত জোরে গুলি বেরোয় যে কানে তালা ধরে যায়। কাজল গাছ খুঁজে ঠিক ঠিক খাটাজোড়া পেড়ে এনেছিল। ছোট-ছোট সবুজ রঙের দানা। অনেকটা কাঁচা তিতিজামের মতো দেখতে। সেই খাটাজোড়ায় গুলি ভরে সে আর নয়ন ধুরমার যুদ্ধ করেছিল। গুলি করতে করতে হাত ব্যথা করে ফেলেছিল। সেই থেকে রক্তে তাদের যুদ্ধের উষ্ণ-স্রোত।
‘স্বাধীনতা!’
নয়ন বলত —
‘স্বাধীনতা মানে বুঝছ? পক্ষীর লাহান উড়াল দেওয়া। নীল আসমানে উইড়া বেড়ানো। খালি উড়াল আর উড়াল। কেউ তোরে কনুদিন বাধা দিবো না।’
কাজল চুপ করে স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে চাইত। ওর যে বলার চেয়ে শুনতেই বেশি ভালো লাগত। নয়নের চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল। নিজের দেশের স্বপ্ন। যার ভাগ কাউকে দেওয়া যায় না। নয়নের চোখের কালো মণিটা প্রত্যাশায় ঝলসে উঠত। অথচ সেই নয়ন নিজেই একদিন স্বাধীন হলো! আসমানে ডানা মেলে পক্ষীর মতো উড়াল দিল। কাজল খুব একা হয়ে গিয়েছিল। তবু সে কাঁদেনি। এক ফোঁটাও কাঁদেনি। পানিতে উপুড় হয়ে থাকা নয়নের পচা-লাশ দেখে বোবা চোখে তাকিয়েছিল।
কাজল তো জানত সব সম্পর্কই ছিঁড়ে যায়। এটাই অমোঘ সত্য। মা চলে গেলে ফের তা উপলব্ধি করেছিল — সব সম্পর্কই ছিঁড়ে যায়। সব সম্পর্কই ক্ষণস্থায়ী।
নয়ন বা মা চলে গেলে কাজল আর অবলম্বন খোঁজেনি। অবলম্বন খোঁজার মতো কেউ তার ছিলও না। তবু করমালি চাচা কেন যেন যেচে অবলম্বন হয়েছিল। মায়ের মতো সে কাজলকে যতœ করে আগলে রেখেছিল।
ন্যাংটা মান্দারে ফি বছর নতুন করে পাতা গজায়। ডালপালা ছোট ছোট লাল ফুলে ভরে ওঠে। দেখে মনে হয় যেন পরিপূর্ণ যুবতি। নয়ন যখন ধরা পড়ল তখন সবে সবুজ ছুঁয়েছিল। আর নয়নের মৃত্যুর সময় একেবারে লাবণ্যময় যুবতি! আজও মান্দারে লালিমা দেখলেই কাজলের ঝট করে নয়নকে মনে পড়ে। নয়নের সত্যি সাহস ছিল। মরে যাওয়ার জন্য তো সাহস লাগে। নয়নের মরে যাওয়ার সাহস ছিল।
ধরা পড়ার পর লোহার গরাদ ভেঙে ফেলেছিল। তারপর শত্রুর কম্বল গায়ে জড়িয়ে পালিয়েছিল।
পালিয়ে এসে নয়ন যেন আমূল বদলে গেল! অসম্ভব মরিয়া হয়ে উঠল। বোমা মেরে কালভার্টের পর কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছিল। মাইন পুতে শত্রুর ঘাঁটি তছনছ করে দিয়েছিল।
এমনতর ডামাডোলের মাঝেও নয়ন কাজলকে দেখতে এসেছিল। এক গহিন রাতে ধলেশ্বরী সাঁতরে এসেছিল। কাজলের কাছে অনেক নিজের কথা বলেছিল।
বলেছিল —
‘জানস, রক্তে অহন সর্বনাশা বান ডাকে বুঝলি? ট্রিগার না-টিপলে রাইতে আর ঘুমাইতে পারি না।’
কাজল মন দিয়ে নয়নের কথা শুনেছিল।
সেদিনের রাত ছিল প্রগাঢ় শূন্যতায় ঠাসা। আকাশে চাঁদ ছিল। কিন্তু চাঁদের চেহারা ছিল ভাঙাচোরা। যেন চিত্রকরের গাফিলতিতে তা অসম্পূর্ণ। চোয়ালটা একপাশে বাঁকা। নাক আর মুখ এবড়োখেবড়ো। চাঁদটাকে দেখাচ্ছিল প্রস্তরযুগের বিষাদগ্রস্ত কোনো মুখচ্ছবির মতো। চাঁদের বিষণ্নতায় আলো ছিল ম্লন। সেই ক্ষীণ আলোতে মেঘেরা ইচ্ছেমত ভেসে বেড়াচ্ছিল। যেন ওদের কোনো বন্ধন নেই। আর বিষণ্ন চাঁদ ক্রমেই ক্ষয়াটে হয়ে উঠেছিল। সেই ক্ষয়াটে চাঁদকে ঢেকে ফেলে মেঘেরা ছিল উল্লসিত। মেঘে ঢাকা অসহায় চাঁদকে দেখে কাজল অসম্ভব এক সত্যের মুখোমুখি হয়েছিল —দুর্বলকে আঘাত করে সবলেরা চিরকাল উল্লসিত হয়।
নয়ন বলেছিল — ‘ওরা আমাগোরে দুর্বল ভাবে বুঝলি? এইবার কেচকি মাইর কারে কয় ট্যার পাইব।’
কাজল কথা বলেনি। নিজের পঙ্গুত্ব অস্বীকার করে বলতে পারেনি —
‘নয়ন, আমাগো মাটিতে ওরা কেমনে থাকে দেখুমনে।’
অথচ নয়ন অসম্ভব প্রত্যয় নিয়ে বলেছিল স্বাধীন এক সবুজ ভূমির কথা। আর দেশ সত্যিই স্বাধীন হয়েছিল…।
আজ কতটা বছর পেরুল? কাজল তা ঠিক ঠিক বলে দিতে পারে! এক হাতের কড় গুনে শেষ করে অন্য হাতের কড়ে এসে থামে। পায়ে গুলি লাগার পর থেকে কাজল বড় সচেতন। একেবারে পাকা হিসেবি। যেন ওর হিসেবে আর ভুল হবার নয়। ঘরে থেকেও কাজল সব ঠিক ঠিক হিসেব রাখে। হিসেব রাখে ঝাউতলি স্টেশনে কটা ট্রেন থামল; চলে গেল। কাজল ঝাউতলির সবকিছুর নির্ভুল হিসেব রাখে।
যুদ্ধের পর পরই ঝাউতলিতে রেললাইন বসল। অবশ্য এখনও স্টেশনে লোকসমাগম হয় না বললেই চলে। যারা নামে — তারা নিঃশব্দে নামে আর যারা চলে যায় — তারা নিঃশব্দে চলে যায়। এতে করে ঝাউতলির কোলাহল সমান্তরাল থাকে। শুধু মাঝরাতের ট্রেনটা বড় বেপরোয়া। সে ঝড়ের বেগে কোন সুদূরে যেন ছুটে চলে যায়! নিস্তব্ধ স্টেশনটা সেই ঝড়ের দাপটে কেঁপে ওঠে। রাতের নির্জনতায় ফাটল ধরে। আর সদ্য ঘুমভাঙা মানুষেরা ভয়ানক চমকে ওঠে। শুধু কাজল চমকায় না। সে নির্বিকার থেকে ছাত্রদের খাতার গণিতের জটিলতা সমাধান করে!
কদিন ধরে কাজলও কেন যেন চমকে উঠছে! সুদকষা, ঐকিক অথবা ভগ্নাংশের জটিলতায় ডুবে থেকেও চমকে উঠছে! ডান পায়ের শুকনো ক্ষতে ঘামাচির মতো দানা দেখার পর থেকে কাজলের এই অস্থিরতা। অবশ্য করমালি চাচাই প্রথম লক্ষ করেছে।
সেদিন রাতের কোটরে সন্ধ্যা খুব দ্রুত ঢুকে পড়েছিল। কাজলের পায়ে রসুন আর সর্ষের তেলের গরম মালিশ দিতে দিতে করমালি চাচা আবিষ্কার করেছে— ‘বাজান খেয়াল করছ? তুমার বিষের জাগায় এই শীতেও ঘামাচি হবার নাগছে।’
করমালি চাচার কথা শুনে কাজল আঁতকা ভয় পেয়েছিল। এক-সমুদ্র-জল যেন তার চোখের সামনে শুকিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে সেও মনোযোগী।
ঘামাচির দানাগুলো কদিনেই বড় হয়ে উঠেছিল। আর দানার মাথাগুলো পুঁজে সাদা হয়ে গিয়েছিল। কাজল ভেবেছিল হয়তো আপনা-আপনিই সেরে যাবে। কাজলের ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। দানাগুলো দিনকে দিন বিস্তৃত হলো। ফোড়ার মতো পেকে টনটনে হয়ে রইল। করমালি চাচা বেল বা লেবুগাছের কাঁটা তুলে গেলে দিলে ফের তা জমতে লাগল। আর দগদগে ঘায়ে কাজলের পা ছেয়ে গেল। করমালি চাচা অস্থির হয়ে তাগাদা দিয়ে চলল —
‘টেরেনের সুবিধা হইছে। শহরে যাওন আর সমুস্যা না। ভালা দাক্তর দেহাইয়া আসো বাজান।’
করমালি চাচা কাজলের জন্য কেন এত ভাবে?
করমালি চাচা মাকেও খুব ভালোবাসত। বাড়ির মনিব চাকর হলেও তার ভালোবাসা হয়তো একজন প্রেমিকের মতো ছিল। অথচ করমালি চাচা মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাত না। করমালি চাচা টের পাবার আগেই হয়তো তার ভালোবাসা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মানুষের ভালোবাসা তো এমনই। টের পাবার আগেই শুরু হয়ে যায়! যেমন করমালি চাচার ভালোবাসা। তার মনিব-পত্নীর জন্য অচেনা-ভালোবাসা…।
কাজলদের সংসারে ঘাত-প্রতিঘাত তো কম হয়নি। কিন্তু করমালি চাচা একটুও বদলাল না। বাবা আরেকটা বিয়ে করে শহরেই থেকে গেলেন। মা কাজল আর সজলকে নিয়ে ঝাউতলিতে। বাবা কালেভদ্রে খবর নিতেন। বাবা শহরে বিয়ে করার পর মা কখনো কাঁদেনি। কাঁদলেও হয়তো আড়ালে কেঁদেছে। কাজল বিকেলে ফুটবল খেলে এসে দেখত মায়ের চোখ-মুখ ফুলোফুলো। চোখের পাপড়িতে জলের কণা। মাকে তখন বর্ষাভেজা দোলনচাঁপার মতো দেখাত। অসম্ভব সতেজ অথচ স্পর্শকাতর। মায়ের অমন চেহারা দেখেও কাজল কিছুই জিজ্ঞেস করার সাহস পেত না। করমালি চাচা নিঃশব্দে ঘরে ঘরে আলো জ্বেলে দিত। কাজলকে ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া লাগাত —
‘খাড়ায়া কী ভাবো? হাত-মুখ ধুইয়া পড়তে বসো।’
করমালি চাচাকে এনেছিল কাজলের দাদা; কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। অবাক কাণ্ড! বড় হতে হতে পাহাড়িটা সভ্য হয়ে উঠল। গাড়লটার মন কিনা এই ঝাউতলিতেই গেঁথে গেল!
করমালি চাচা শহরে যেতে বললেই কী! কাজল ওমুখো হতে চায় না। ওখানে বাবা থাকেন; সজলও থাকে। বহু বছর আগে এক শীতে বাবা গাঁয়ে ফিরেছিলেন। মায়ের বারণ অগ্রাহ্য করে সজলকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সজল আর ফিরল না। শহরের নিউমোনিয়া থেকে বাবা সজলকে বাঁচাতে পারলেন না। সেই থেকে বাবা আর কোনদিন মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াননি। আর বাবার প্রতি ঘৃণায় মা সজলের কবরটাও কোনদিন দেখতে যাননি। অথচ করমালি চাচা ঠিকই গিয়েছিল। সজলের কবর দেখে এসে মায়ের সামনে ছেলেমানুষের মতো কেঁদেছিল। মা পাথর চোখে বলেছিলেন —
‘করমালি ভাই, তুমারে কি আমি যাইতে বলছি? কানতাছ ক্যান?’
মা যত দিন বেঁচে ছিলেন, করমালি চাচা প্রতিমাসেই শহরে যেত। মা মারা যাওয়ার পর আর যায়নি। কাজলকে একা ফেলে করমালি চাচা এক পা নড়েনি। হয়তো মায়ের শূন্যস্থান করমালি চাচা পূর্ণ করতে চেয়েছে। অথচ মানুষের মায়া-মমতাও আজকাল কাজলকে আর স্পর্শ করে না। করমালি চাচা হয়তো ছিটগ্রস্ত। নইলে কেন তাকে ছায়ার মতো আগলে রাখে? কাজল তো তা জানেই সব সম্পর্ক ছিঁড়ে যায়! এটাই অমোঘ সত্য…।
পায়ে পচন ধরার পর থেকে কাজল যেন আরো নিরাসক্ত হয়ে উঠেছে। জীবনের কঠিন, গোপন, গহিন দুঃখের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মানুষ নিরাসক্ত হয়; কাজল তো আজন্ম ও-রকম দুঃখের ভেতর দিয়ে হেঁটেছে; নিরন্তর হেঁটেছে। তাই জীবন আর মৃত্যু দুটোই আজ ওর কাছে একরকম। কাজল জানে, সে মরে যেতে পারে না বলেই বেঁচে থাকে। নির্লজ্জের মতো বেঁচে থাকে। জাগতিক আশা-আকাক্সক্ষা থেকে পালিয়ে এক কোণে পড়ে থাকে। এও এক ভালো। এক কোণে পড়ে রইলে নিজস্ব বোধগুলো সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। মানুষের লোভ, স্বার্থপরতা, হীনতা, নিচুতা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। এক কোণে পড়ে পড়ে আরো কঠিন, গহিন, গোপন দুঃখে নিমজ্জিত হওয়া যায়।
করমালি চাচার বয়স বেড়েছে। আগের মতো আর নির্বিকার থাকতে পারে না। কাজলের পচন ধরা পায়ে গরম-জল ঢালতে ঢালতে ফুঁপিয়ে ওঠে —
‘কত্ত কইলাম শহরে যাওগা। বড় দাক্তর দেহাইয়া আসো। কান পাতে না! মায়ের লাহান জিদ্দি হইছ।’
‘মায়ের জিদ আছিল —মায়াও আছিল। মায়ের মায়া আছিল সমুদ্দুরের সমান। তুমি তার মায়ার কথা না-বইলা জিদের কথা বলো ক্যান?’
‘তুমারে তা কইয়া লাভ কী? তুমার দিলে তো মায়া নাই। তুমি হইলা সীমার। মায়া থাকলে এই বুইড়ার কতা হুনতা। তুমি তো মায়ের মায়া পাও নাই। জিদ পাইছ।’
‘হ —আমার মায়া নাই। আমি তো সীমার। শহরে যাইতে কও কার কাছে? আব্বার কাছে? যে বাপ সন্তানরে মনে করে নাই তার কাছে?’
‘হেয় মনে না-করল। তুমার এহন বিপদ। পা কাটনের অতগুলান ট্যাকা কই পাইবা? কে দিব? মাস্টারি ট্যাকায় তো দুই পেটই চলে না। অহন বিপদে কী করবা? যাও বাজান।’
‘বিপদ তো আইজ শুরু হয় নাই। এত জীবন পার হইলো। অহনও পার হইবো।’
‘যা মন লয় করো। তুমারে কোলে-পিঠে কইরা মানুষ করছি কিন্তু তুমারে আমি বুঝবার পারি না বাজান।’
করমালির সঙ্গে কথা বলতে কাজলের আর ভালো লাগে না। সে চুপ করে যায়। আর কী যেন ভাবে। ভাবতেই থাকে। ঝাউতলির মানুষেরা ঘুমপরির দেশে ঢুকে পড়ে। আর মাঝরাতের দৈত্য ট্রেন ঝমঝম করে ছুটে চলে যায়…।
…বোঝাপড়াটা শুরু হলো কাজলের নিজের সঙ্গে নিজের। খুব সংগোপনে সে নিজের মনের সঙ্গে যুঝতে শুরু করল। একটা যুদ্ধ তাকে অসমাপ্ত রেখে ফিরতে হয়েছিল। আহত সৈনিকের বেদনা পরাজিতের মতোই। সেই বেদনা বয়ে কাজল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছিল। স্বাধীনতার গৌরবের কতটুকু তার নিজের অর্জন? ধলেশ্বরীর তীরে অসহায় মানুষের শয়ান-মিছিল দেখে ওর মনে হয়েছিল —
‘এইবার সমাজতন্ত্র!’
কাজলের ধারণা ভুল ছিল। ওর চিন্তা কক্ষনো বাস্তবতা পায়নি।
বরঙ মানুষে মানুষে বিভেদ তীব্র হয়েছে। কাজল এক কোণে পড়ে থেকেও তা অবলোকন করেছে। কাজল কী করবে? অপ্রত্যাশিত পঙ্গুত্ব ওকে অথর্ব করে রেখেছে। এই খুঁড়িয়ে চলা জীবনের কতটুকু মূল্য? কাজল জেনে গেছে চাইলেও সে আর কিছুই পরিবর্তন করতে পারবে না…।
করমালি চাচা শতবার বললেই কী? না —সে কক্ষনো বাবার কাছে যাবে না। যে বাবা সন্তানকে মনে রাখেনি, সেও তাকে মনে রাখতে চায় না…।
প্রতিরাতেই দৈত্য ট্রেনটা নির্দিষ্ট সময়ে ঝাউতলি পেরিয়ে যায়। আর কাজল তখন নিজের ভেতর নিজেই শক্তি সঞ্চয় করে। যেন আরেকটা যুদ্ধের প্রস্তুতি। কাজল আরেকবার সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতে চায়। মাত্র একবার।
স্কুল শেষে ফিরতে ফিরতে কাজল থমকে দাঁড়ায়। রেললাইনটা ভালো করে দেখে। অকারণে বাঁ-পা দিয়ে লোহার পাত স্পর্শ করে। তখন তার সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। কী ভয়ানক হিম! যেন সরীসৃপের শরীরে পা পড়েছে। কাজলের মনে হয় জগতের সমস্ত কাঠিন্য বুঝি লোহার পাতদুটোতে জমে আছে। লাইনের দুধারে সাদা-কালো-সবুজ নুড়িগুলো ইতস্তত ছড়ানো। পাতের নিচে কাঠের সিøপার—সিঁড়ি হয়ে কোন দূরে যেন চলে গেছে। এই ঝাউতলি থেকে মানুষেরা কোথায় চলে যায়? কাজল কেন এত বছরেও কোথাও যেতে পারল না। চলে যাওয়ার শক্তিটুকুও কেন সে সঞ্চয় করতে পারল না।
সে না হয় পারেনি,। কিন্তু করমালি চাচাও তো যেতে পারল না! লোহার পাতের হিম বুকে ধরে করমালি চাচা এখনও পড়ে আছে!
রেললাইন ধরে হেঁটে এসে কাজলের কী যে হয়! রাতে আর ভাত খেতে ইচ্ছে করে না। করমালি চাচাও উপোস থাকে। কাজল না-খেলে সে খাবে কী করে? দুজন মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে। বসে বসে ভাবে আর ভাবে। রাতভর কেউই আর ঘুমাতে পারে না…।
কাজলের সত্যি সাহস নেই। সে কাপুরুষ। মরতে ভয় পায়। নয়নের সাহস ছিল; দুর্দান্ত সাহস। তাই সে যুদ্ধ করে বীরের মতো মরেছে। আজকাল মাঝরাতে ট্রেনের সিটি বাজলেই কাজলের ভয় করে। নিজের ভেতর কেঁপে ওঠে। অথচ দৈত্য-ট্রেন কিচ্ছু পরোয়া করে না। ঝাউতলির তুচ্ছতা নির্দেশ করে বীরদর্পে আড়াল হয়ে যায়।
ধলেশ্বরী সাঁতরে যে রাতে নয়ন এসেছিল, সে রাত ছিল প্রগাঢ় শূন্যতায় ঠাসা। আকাশে ছিল বিষণ্ন-চাঁদ; যেন কোনো প্রস্তরযুগের। চাঁদ কি মানুষের বেদনা অনুভব করে? নইলে কেন সে বিষাদগ্রস্ত হয়? খাঁখাঁ শূন্যতার ভেতর নিষ্প্রাণ জেগে থাকে। অনেকদিন পর তেমনি এক বিষণ্ন চাঁদের নিচে কাজল চুপ করে বসে ছিল। খানিক আগে ও লোহার পাত স্পর্শ করেছে। ইস! যেন সরীসৃপের পিঠ।
সূর্য ডুব দিলেই রেললাইন কেন এত বেশি হিম হয়ে থাকে! কুয়াশা পড়ে বলে? কাজল আজ মাঝরাতের ট্রেনটার জন্য অপেক্ষমাণ। দৈত্য ট্রেনটা এলে আজ ওর বোঝাপড়া শেষ হবে।
কিছুক্ষণ পরই ট্রেনটার হুইসেল শোনা যায়। সতর্ক সংকেত! কাজল স্থির হয়ে বসে চোখ বুজে ফেলে। যেন নিবিড় ধ্যানে মগ্ন। অতঃপর খুব ধীরে সে ডান পাটা লোহার পাতে মেলে দেয়। যতটা সম্ভব টান টান করে মেলে দেয়। ইঞ্জিনের বিচ্ছুরিত আলো এসে পড়লে কাজলের বন্ধ চোখের পাতাও নড়ে ওঠে। ফের হইসেল বাজে। সতর্কসংকেত! অথচ কাজল তেমনি ধ্যানমগ্ন। ইঞ্জিনের তীব্র আলোর মাঝেও কাজল বসে থাকে। চোখ বুজে স্থির বসে থাকে…।