গ্যালাক্সির বাইরে থেকে । ফজলুররহমান বাবুল
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১০:১৬ পূর্বাহ্ণ, | ৪৫১ বার পঠিত
০১
আমি একবার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সদস্য পৃথিবীতে ছিলাম। ওখানে একদিন বালিশে মাথা রেখে আরামে ঘুমিয়েছিলাম, অতঃপর ঘুম থেকে জেগে দেখি চলে এসেছি গ্যালাক্সির বাইরে। আর ফেরা হয়নি। আমার মনে আছে, পৃথিবীতে পড়ালেখা শিখতে দু-একবার ইশকুলে গিয়েছিলাম। আরও মনে পড়ছে, কয়েকবার অসুস্থ হয়ে ডাক্তারখানায় গিয়ছিলাম আর আমাকে সুস্থ হওয়ার জন্য অনেক ওষুধপত্র গিলতে হয়েছিল। আজ, তোমরা আমাকে মনে করো, পৃথিবীর বাইরে কোনও পৌরাণিক পাখি-ঘোড়া, কিংবা ধরে নাও ঝরাপাতা, শুকনো পাতা (অথবা ভেবে নাও যা ইচ্ছে)। পৃথিবীতে আমি হয়ত কোনও শালিক কিংবা চড়ুইপাখি ছিলাম। আমি আসলে আমি-ই ছিলাম। একবার মানুষ হওয়ার জন্য পৃথিবীতে জন্মেছিলাম আর ভর্তি হয়েছিলাম ইশকুলে।
০২
এখান থেকে পৃথিবীকে একটা বিন্দুর থেকেও ছোটো দেখাচ্ছে। আর, মানুষ? আরও আরও আরও ছোট্ট! কত ছোট্ট বোঝাতে পারব না। তোমরা ভেবো না যে, এখান থেকে অতি দূরের গ্যালাক্সি-গ্রহে কত-কী দেখতে দূরবিন কিংবা অন্যকোনও যন্ত্রপাতি লাগে। খালি চোখেই সবকিছু দেখা যায় । ছোট্ট, অতি ছোট্ট এক বিন্দুর ওপর দেখতে পাচ্ছি তোমাদের, তোমরা কত ছোট্ট! দেখতে পাচ্ছি, তোমরা কেউ হাঁটছ, কেউ-বা গাড়িতে চড়ে এদিকে-ওদিকে ছোটাছুটি করছ , কেউ কেউ মহাকাশ-গবেষণায় ব্যস্ত, কেউ কেউ সাগরে ডুব দিচ্ছ, কেউ কেউ রাস্তাঘাট, বাড়িঘর-শৌচাগার বানাচ্ছ। বুঝতে পারছি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়েও কেউ কেউ টেনশনে আছ, ভাবছ খরচাপাতি নিয়ে। কেউ কেউ জমিতে ফসল ফলাচ্ছ, কেউ কেউ রোগবালাই নিয়ে গবেষণা করছ, কেউ কেউ মানুষ মারার অস্ত্র বানাচ্ছ, বর্জ্য দিয়ে কেউ কেউ দুষিত করছ সাগর-মহাসাগর।
তোমরা কী করছ? আর, কী করছে মোড়লরা— যারা শাসন করে পৃথিবীতে?
০৩
বাঘ ও সিংহরা যে-পৃথিবীর আলো-অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে, সেই পৃথিবীকে কেউ কেউ বুঝতে পারে আপন বোধ-বুদ্ধিতে। পশুকুল আপনার নিয়মেই দাঁড়ায় জীবনের আলজিহ্বায়, আর তোমরা মাঝেমধ্যে দেখতে পাও কুকুর ও হায়েনাদের কাছে বাঘ, সিংহ কিংবা লম্বা গলার জিরাফেরা কেমন নাস্তানাবুদ হয়। লম্বা গলা নিয়ে জিরাফেরা বেশ জোরেশোরে দৌড়াতে পারলেও কুকুর ও হায়েনাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, মারাও যায়। তাই না? অন্য কথা, জিরাফ কিংবা জেব্রার রক্ত-মাংসেও মাঝে মাঝে উদরপূর্তি হয় অন্যদের। তেমনই নিয়ম, তাদের জগতে। বুঝতে পারি না, নিরাপত্তার অজুহাতে তোমরা কেন মানুষ মারার অস্ত্র বানাও! তোমরা কেন মানুষ মার? তোমরা না মানুষ?
০৪
তোমরা যখন পৃথিবীতে আছ, দেখার জানালাটা বড়ো করো, নিজের মধ্যে যা নাই তার চেয়ে বেশিকিছু দেখার চেষ্টা করো। বলি, মাঝেমধ্যে একাকী থাকতে দাও নিজেকে, কিন্তু সবসময়ের জন্য একা হয়ে যেয়ো না।
০৫
পৃথবীতে একদিন আমি বালিশে মাথা রেখে আরামে ঘুমিয়েছি আবার জেগে উঠব বলে, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘ ঘুমের পর জেগেছি মিল্কিওয়ের বাইরে। মনে রেখো, পৃথিবীতে একবার ঘুমিয়ে পড়লে ফের জেগে ওঠার কোনও গ্যারান্টি নাই। তবে প্রকৃত ঘুম কোনও গ্যারান্টির পরোয়াও করে না। দীর্ঘ ঘুমের পর, আমার শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। ব্যথার টুকরোগুলো লাল, পৃথিবীর রক্তজবায় মোড়া। পৃথিবীর আকাশ তাকাচ্ছে আমার দিকে আর মিটিমিটি হাসছে। আমি ছুঁয়ে দিতে চাইছি তার মুখ। পারছি না। তোমরা মানুষ! ঘুমানোর আগে কোনও মানুষকে শিকার করো না।
০৬
তোমরা আমাকে মনে করো বাতাসে ঝরাপাতা, শুকনো পাতা। তবে তোমাদের পক্ষে এটা ভাবা ভুল হবে যে, কখনও আমার আবির্ভাব হয়েছিল কোনও বৃক্ষের ডালে। পৃথিবীতে বুড়ো লোকেরা আর বাচ্চারা আমাকে ভেবেছিল মানুষ। একদা আমি হয়ত মানুষ ছিলাম, যেহেতু— পৃথিবীতে নিজের ছায়ার সঙ্গে মুখ ভেংচিয়েছি কিংবা ধমকেছি নিজেকে। আমি ছিলাম আমি। পৃথিবীতে প্রায়শ আমার কথা শুনিনি আমি। আর, আমি বাড়তে দিয়েছি আমাকে, আবার ছেঁটেও ফেলেছি। আমার ভিতরে ঘুমিয়েছি আমি, আমার ভিতরে জেগে উঠেছি। আমি আমাকে করেছি শৃঙ্খলিত এবং করেছি মুক্ত কিংবা এলোমেলো। আমিই ছিলাম আমার আপন, আমিই ছিলাম আমার পর! এখন নিজের সঙ্গে একা থাকি।
০৭
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে দেখেছি কোনও অহংকারী রাজা, রাজনীতিক, আমলা, কবি নাই, ডাক্তার ও ওষুধপত্র নাই, শিক্ষক-ছাত্র -ইশকুল নাই, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা নাই, জমি বিক্রির দালাল নাই, গরুচোর নাই, ব্যাংক বীমা শেয়ারবাজার নাই, পিঁয়াজ-রসুনের সিন্ডিকেট, চুরিচামারি নাই, মারামারি নাই, কোনও শিল্প-সাহিত্য বা বিজ্ঞান সমিতি নাই, বিজ্ঞাপন নাই। তবে, আছে অনেককিছু।
কী কী আছে, এখন কিচ্ছু বলব না। বড্ড ঘুম পাচ্ছে আমার।