সময়ের ফের ও প্যারাবলের মর্জি । বদরুজ্জামান আলমগীর
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ মে ২০২৩, ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ, | ৬৮৮ বার পঠিত
এমন কথা আছে যা আমরা ঠারেঠুরে বলি, আবার সে-রকমও বুলি থাকে যা ইচ্ছায় আসে, কিন্তু ভরসায় ঠিক কুলিয়ে ওঠে না, ভরসা পাওয়া যায়ও যদিবা সাহসে ঠিক বেড় দেয়া যায় না— ফলে, সবার সামনে জোরে বলতে গিয়ে অনেক সময় আর্তনাদে ফেটেফেটে যায়, অথবা নিজের কথাটা অসহায় প্রতিধ্বনি হয়ে নিজেরই চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে।
ওই যেমন কাজাখ লোককথার নাপিতের দশা হয় কখনও কখনও। নাপিত রাজদরবারে যায় রাজার চুল কাটতে। পরম যত্নে, নির্বাচিত আতঙ্কে নরসুন্দর বাদশাহ নামদারের মাথায় চিরুনি প্রক্ষালন করে। নাপিতের অনুভব হয়— কোথাও চিরুনি বুঝি খানিকটা হোঁচট খায়। নাপিত তাই রাজার মাথা বরাবর আমল করে চায়— নাপিতের চক্ষু চড়কগাছ।
রাজা মশাই হস্ত ইশারায় নাইপতার বেটাকে থামায়— আমি জানি আমার চিকুরের আড়ালে কী দৃষ্টিগোচর হয়। শোন। জি, বলুন বাদশাহ নামদার। যা দেখেছো, দেখেছো। এই কথা অন্যকারো কাছে ঘুনাক্ষরেও বলেছো তো একনিমেষে গর্দান যাবে।
কোনরকম জান নিয়ে লৌহ ফটক পেরিয়ে নাপিত নিজের বাড়ি আসে বটে, কিন্তু সে নোতুন দিকদারিতে পড়ে। কথা নাই বার্তা নাই নাপিতের পেটের ভিতর একখান কথা খালি ঘুরপাক খায়— বেরুতে ছটফট করে, আর কথাটি খালাস হতে না পেরে পেট ফুলে ঢোল হতে থাকে।
ভয় পেয়ে, নিরুপায় নাপিত পেট ফোলার ত্রাসে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। জঙ্গলের ভিতর ছোটার সময় নাপিত দেখে গাছবিরিখের আড়ালে এক নিরালা ইদারা— তার ভিতর স্বচ্ছ পানি আয়াস বেঁধে থাকে। নাপিত কুয়ার ভিতর মুখ বাড়িয়ে লম্বা করে চায়— ইদারার ভিতর আরেক মনুষ্য রূপ— তাহা দেখতে পায়।
নাপিত এবার মুখ বাড়িয়ে ফিসফিস পানির তলে মানুষটিকে বলে— রাজার মাথায় শিং আছে, রাজার মাথায় গরুর শিং! এই মোক্ষম কথাটি বলার সঙ্গেসঙ্গে নাপিতের পেট মিইয়ে আবার স্বাভাবিক আকারে ফিরে আসে।
নাপিতের পেট চুপসে আগের জায়গায় গেলে আপাতত তার সমস্যার সমাধান হয় বটে, কিন্তু উত্তর নিশ্চয়ই পায়নি— একটি উত্তর তাকে আরো অনেক অনুত্তরের ফেরের মধ্যে ফেলে। উত্তর বরাবর পুকুরের মত- কেটে ছোট করতে চাইলে আরো বড় হয়।
নাপিত থেকে এবার একজন ধোপার শত্রুমিত্র, চালচিত্র, দেনদরবার ঘুরে দেখে আসি:
এক দীনহীন ধোপা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ময়লা কাপড় জড়ো করে। কাপড়ের গাটরি সে ঘোড়ার পিঠে তুলে নদী ঘাটলার দিকে যায়, নদীর ঘাটে কাপড় কেচে নদীর পাড়েই শুকাতে দেয়; শুকানো কাপড় ঘোড়ার পিঠে আবার বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে- তার বদৌলতে ধোপা ধানের মরশুমে টোকরি ভরে চুক্তির ধান পায়।
কিন্তু আজ নদীর ঘাটে এসে ধোপা একটা বড় ধরনের মুসিবতে পড়ে। ঘোটকের পিঠের কাপড় খালাশ করে যেই না ঘোড়াকে গাছের সঙ্গে বাঁধতে যাবে— তখনই বুঝতে পারে, ধোপা বেচারি ঘোড়া বাঁধবার দড়ি আনতে ভুলে গ্যাছে।
এদিকে আবার বেলাও ঢালুতে গড়িয়ে যায়; ঘোড়া না বেঁধে কোনভাবেই জলে নামতে পারবে না ধোপা। তাই ধোপার মাথার চুল ছেঁড়ার দশা। এমতাবস্থায় নদীর পাড় ঘেঁষে হাটে যায় গ্রাম পঞ্চায়েতের এক মুরুব্বি জন। মুরুব্বিকে ধোপা পুরো বিপত্তির খুলে বলে, এবং এর সুরাহাকল্পে পরামর্শ চায়।
বর্ষীয়ান পঞ্চায়েতী বলেন— এটা বড়ই নেহায়েত সমস্যা: তুমি ঘোড়ার কাছে যাও, অন্যান্য দিন যেভাবে ঘোড়াকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখো— ঠিক একইভাবে দড়ি বাঁধার অভিনয় করো— মনে রেখো, ঘোড়া যেন দেখে— তুমি তাকে বেঁধে রাখছো। আমি জানি, তুমি দড়ি আনোনি— ভুলে গ্যাছো; কিন্তু ঘোড়াকে বোঝাও তুমি প্রতিদিনের মতোই দড়িতে ওকে বেঁধে রাখছো। মুরুব্বি যা বলেন, লক্ষ্মী ছেলে ধোপাও তা-ই করে; তাতে ষোল আনা কাজ হয়।
কাপড় শুকিয়ে ঘোড়ার পিঠ বোঝাই করে খুশি ডগমগ ধোপা ঘোড়া হাঁকায়— হাঁট ঘোড়া, ঘরকে চল! কার কী-বা আসে যায়— ঘোড়া নড়ে না। ধোপা আবার বলে, চিৎকার করে— ঘোড়া নেহি শুনতা হে।
ধোপা পড়িমরি বুড়োর কাছে আর্জি পেশ করে যে, ঘোড়া পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে, এক পা নড়ে না। পঞ্চায়েত জন আবার বলে— এর সমাধান একেবারে জলভাত : তুমি দড়ি খোলার অভিনয় করো, কেবল খেয়াল রেখো ঘোড়া যেন দেখতে পায়।
ধোপা ফিরে এসে নিখুঁতভাবে ঘোড়ার চোখের সামনে দড়ির গিঁট খোলে, আর বলে— হাঁট, হাঁট ঘোটক— বেলা যে গড়ায়, গাঁয়ে চল। ঘোড়া এবার ঠিকঠিক হাঁটতে শুরু করে।
যা আছে, তা ছিল, যা থাকবে— আগে ও পরে।
এ একটি বেদান্ত প্যারাবল: দড়ি নাই দড়ি। অনুলিখন : বদরুজ্জামান আলমগীর।
তাহলে দেখতে পাচ্ছি— দৃশ্যময়তায় দৃশ্যহীনতা নির্মিত হতে পারে, আবার দৃশ্যহীনতাও দিব্যি গড়ে তুলতে পারে এক দৃশ্যময়তার জগৎ।
দেখা যাক, নিচের লেখাটি একচক্কর ঘুরে আসি :
তামাম দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঈশ্বরের মানুষ আবিষ্কার, অথবা অন্যভাবে, মানুষের ঈশ্বর উদঘাটন। এই পুরো ঘটনাটি ঘটে অদৃশ্যমানকে দৃশ্যমানে বাঙময় করে তোলার প্রক্রিয়ার ভিতর।
ধর্মের গ্রহণ।। মা-বাবার কোলে জন্মসূত্রে আমি মুসলমান ; ইতিহাসের মাতৃক্রোড়ে জন্মানো আমি হিন্দু; জীবনের বিপনীকেন্দ্রে লেনদেন ও মিথষ্ক্রিয়ার কল্যাণে সর্বধর্মের জাতক আমি; ইচ্ছার সংকল্পে সর্বপ্রাণ শূন্যতাবাদী।
আমরা সবাই ইচ্ছায় কী অনিচ্ছায় প্রকৃতির উৎসের সঙ্গে একটি ছন্দে বাঁধা । প্রতিটি জীবন এই উৎসের নাভিমূল থেকে আসে— আবার মূল বিন্দুর দিকে গমন করে । আমরা যেমন দৃশ্যমান জৈবিক মা- বাবাকে কাছে চাই, একইভাবে অদৃশ্য কেন্দ্রীয় জনক—জননীকেও অন্বেষা করি; এই খোঁজাখুঁজির এক নিশিপাওয়া সমাপ্তির নাম ঈশ্বর।
এক চক্ষুষ্মানের সঙ্গে আরেক দর্শকের দেখা হলে সব উপরিদৃশ্যের ছবি মেলে— যে দেখা অর্ধেক। উপরটুকু দেখা যায়, ভিতর থেকে যায় আড়ালে।
দু’জন অন্ধের দেখা হলেই কেবল ভিতর-বাহির স্বপ্ন ও জাগরণে,বাস্তব ও অধিবাস্তবের স্থিরতা আর চাঞ্চল্যে একযোগে আলোকান্ধকারে বিকশিত হয়ে ওঠে।
একজন অন্ধ বুদ্ধের সঙ্গে আরেকজন অন্ধ বুদ্ধের দেখা হলে জগতের সবকিছু দেখা যায় !
মৎপ্রণীত প্যারাবল : অদেখাকে দেখা।
আমাদের জীবনে নানা অন্ধতা নানাবিধ মাত্রায় বাঙময় হয়ে ওঠার মুন্সিয়ানা নানা কোণে, বিবিধ নিমগ্নতায় কল্পনার দিগন্তে জেগে উঠতে দেখি:
একদিন আমি ও আমার বন্ধু এক মন্দিরের ছায়া ঘুপচির ভিতর একজন অন্ধ লোককে দেখতে পাই। আমার বন্ধুটি বলে ওঠে- এই যে, দেশের সবচেয়ে বড় বুজুর্গ মানুষটিকে দেখো।
একসময় আমি আমার দোস্তকে রেখে অন্ধজনের কাছে সালাম দিয়ে দাঁড়াই, কথাবার্তা বলি। জিজ্ঞেস করি, যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে বলুন— কতোদিন ধরে আপনি চক্ষুহারা? এভাবেই জন্মেছি আমি।
আপনার সাধনার মার্গ কী?
আমি একজন জ্যোতির্বিদ। বলেই তিনি নম্রতায় হাতজোড়া বুকের উপর রাখেন- এখানে দুনিয়ার তাবৎ চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ নক্ষত্র সব দেখতে পাই।
কহলিল জিবিরান : জ্যোতির্বিদ। বাঙলা তরজমা : বদরুজ্জামান আলমগীর।
অন্ধতা যেমন প্রাণের ক্ষরণও নিমজ্জমান প্রজ্ঞায় বোধের নোতুন জানলা খুলে দিতে পারে।
জালালউদ্দিন রুমি বলেন— তুমি আমার মন ভেঙে দিয়েছো— আমি সে ফাটা হৃদয় আর রিফু করি না— আমার ভাঙা হিয়া-ই তোমার আমাতে প্রবেশের দরোজা— আমার মনমনুরা আঘাতে চৌচির না হলে তুমি সেখানে ঢুকবে কীভাবে?
রবীন্দ্রনাথের অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি, ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা তাই কি জানি! সকালবেলা চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছো তুমি এ কি, ঘর-ভরা মোর শূন্যতারই বুকের ‘পরে— একই মর্সিয়া।
মানুষ নিসর্গের অয়োময়ে কুমারপোকার অন্ধতায় লকড ডাউন হয়ে আছে— যেখান থেকে বেরুবার আর কোন ফোকর নেই, দরোজা লোপাট; অথবা বাজার বিজ্ঞাপনের উঁচু ও শক্ত বিলবোর্ডের বাইরে লকড আউট হয়ে মাথাকুটে মরে!
চরের নিদয়া হাওয়ার নিচে ফেটে থাকে যে বাঙ্গি তার থেকে মনফকিরি আর কী-ইবা হতে পারে! পুড়ে ছিদ্র হয়েছে বলেই তো বাঁশির সুরে আমাদের মনে এমন জোয়ারভাটা ও চন্দ্রকানা লাগে।
কালের চন্দ্রালোক পরাগে অহর্নিশি জেগে কোন মেস্তরি বানায় উজানভাটির পাতাম নাওখানি রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে, গাবকালি মাখায় জালালউদ্দিন রুমির ফাটা ফাটা ধ্যানে, লালন সাঁইজির জবাফুলে, রাধার নসিবে।
মৎপ্রণীত প্যারাবল : ভাঙা হিয়া পাঠ।
এই যে হৃদয়ের হারলেমে দেখাদেখি তার কোন লেখাজোখা নাই, আকার আকৃতি, দাগখতিয়ান নেই- কী অতীত কী বর্তমান ভবিষ্যৎ আর অনাগত কাল তমসার প্রিজমে মুখ বাড়িয়ে ধরে। তারই একটি নমুনা নিচের বয়ান :
নানা জনকে নানা কাজে আনন্দ পেতে দেখি- কেউ উঁচু ব্রিজ থেকে বর্ষার জলে লাফিয়ে পড়ে আনন্দ পায়, কেউবা চাকু দিয়ে নিজের হাত ফালাফালা করে কেটে জিভ বের করে লিকলিক করে হাসে, কারো আনন্দ দৈহিক মিলনে, কেউ নিরানন্দের কাঠিন্যকে উৎসব ভাবে, কেউ ছুটন্ত তীরের সামনে বুক চিতিয়ে হর্ষে লাফায়, কারুরবা উল্লাস অন্যকে ঠেঙিয়ে! অবশ্য সিংহভাগ মানুষেরই আনন্দ অন্যকে হারিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার উচ্ছাসে ।
আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হই ঠিকানা হারিয়ে
ফেলে— কোথায় যাবার কথা ছিল যখন তার দিশা পাই না!
আমি কোনভাবেই মোকাম করে উঠতে পারি না পূর্বজন্মের স্মৃতি আর আগামী জন্মের পিছুটানের মাঝখানে একটি লোকগীতির সুরের মধ্যে কে তুমি ফুটে থাকো এমন পদ্মফুল— লোটাস, লোটাস : মৎপ্রণীত প্যারাবল : আনন্দধারা বহিছে।
আনোয়ারউদ্দিনের দিন গ্যাছে পথের মোড়ে, ট্রেনের চাকায়, তার কাঙ্ক্ষিত নীড়ে কোনদিন সময়মতো ফেরা হয়নি। তকদিরের খোঁজে অজপাঁড়াগ্রাম থেকে আনোয়ারউদ্দিন যায় থানা শহরে— ব্যবসাপাতি করার উদ্যোগ করে, পরে যায় আরো বৃহত্তর শহরে, শহর থেকে নগরে, আয় রোজগার করে, বাচ্চাদের পড়াশোনা করায়, সংসারের খরচপত্র জোগান দেয়।
এভাবেই বেলা গেল সন্ধ্যা হলো— ভুতের কাঁধে চড়ে কোনদিক দিয়ে বুঝি জীবনের বেবাক সময় জেব্রা ক্রসিঙেই শেষ হয়ে যায়!
বর্ষার স্রোতধারা বিলের বুকে তীব্র তোড়ে বয়ে যায়— ফলে ঝরা পাতা, বালুকারাশি, শামুক ঝিনুক ঢালুতে সরে আরো গভীর নদীতলের দিকে হারায়। কিন্তু বাউয়া ধানের লম্বা চারা পানির আঘাত সয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে, ভেঙেচুরে যায়, তবুও দাঁড়িয়ে থাকে।
আনোয়ারউদ্দিনের বুকের গহীনে কাঁচা রঙিন টিনের বাক্সে বাউয়া ধানের চারার মতোই একটি কায়া- ফরিদা, অতিদূর ফেলে আসা নাম জীবনের জঙ্গমতা ও রুক্ষ্মতার মুখেও নির্নিমেষ মাথা নুয়ে থাকে। আনোয়ারউদ্দিন হয়তো সম্পূর্ণভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও না— কিন্তু অনুভবে, অজ্ঞানে তার মধ্যে সতত জেগে রয়।
৭৩বছরের দীর্ঘ জীবন শেষে আনোয়ারউদ্দিনের অন্তিম ক্ষণ এসে হাজির। তার আত্মীয়রা চারপাশে ভিড় করে থাকে— তাহারা যুগ যুগান্তরে পাওয়া পবিত্র গ্রন্থের দরদী কালাম পড়ে। কিন্তু দুনিয়ায় আর আনোয়ারউদ্দিনের বাতাসের হিস্যা নাই।
মৌলভি গামছার এক মাথা ধরে তাকে তওবা পড়ায়, আর কানের কাছে মুখ নামিয়ে জিজ্ঞেস করে: তোমার অন্তিম বাসনার কথা বলো। এই কথার সুইসুতায় কোন গহীন থেকে বুঝি আনোয়ারউদ্দিন বলে— এক চামুচ পানি খাবো। কার হাতে পানি খাবে বলো?
পৃথিবীর আদিমতম সৃষ্টিদিনের সরল, অনিঃশেষ থেকে একটি নাম বলে আনোয়ারউদ্দিন— ফরিদা। ফরিদার হাতে একচামুচ পানি খাবো।
ক্লাস এইটে পড়া ফরিদার কথা কেউ কোনদিন তার মুখে শোনেনি, কিন্তু তার আনন্দ বেদনার বিমূর্ততায় ৭৩বছরের গাবকালি মাঝে, আড়ালে অন্তরালের ভাঙাচোরায় তার সঙ্গেই যে ছিল।
একজীবনের অলিগলিতে, পাক কালামে, জলসাঘরে, অনাহারে, দখিনা হাওয়ায়, বাসনার প্রাণপণে যাহারে চায়, খোয়ারির নিগূঢ়ে ফরিদা নামটি ছিল।
এভাবে দিনান্তের কূলে এসে ভিড়ে ফরিদা— আনোয়ারউদ্দিনের আয়না ও তার উপর বসা একটি মর্মের চড়ুই পাখি— ঠোঁটে তার লৌ আর জবাফুলের মনতারা, ইবাদত!
মৎপ্রণীত প্যারাবল : ফরিদা।
ফরিদা ছাপা হলে পাঠকের প্রতিক্রিয়া আসে আশ্চর্যজনক। এখানে প্রোটাগনিস্ট আনোয়ারউদ্দিন— তার চৈতন্যের গভীর গহন বারামখানায় কীভাবে ফরিদার স্মৃতি প্রতিমা ধারণ করে রাখে আনোয়ারউদ্দিন, এবং জীবনের শেষক্ষণে কীভাবে সবাইকে অবাক করে ফরিদার কথা বলে আনোয়ারউদ্দিন তা আমাদের হৃদমাঝারে ঘনঘোর হয়ে নামে। কিন্তু পাঠকের মনে আসন পেতে বসে আনোয়ারউদ্দিন নয়— ফরিদা।
আলাপী মুসলমান কূলে জন্মনেওয়া কললড়া মেয়ে- তার একমাত্র ছেলে ১৫বছরের আব্দুস সোবান গঞ্জে গিয়েছিল রোজগার পাতি করতে, মাস যায়—বছর গড়ায় সোবান যে আর আসে না। সোবানের মা ট্রেনের দিকে চেয়েচেয়ে বিলাপ করে— সোবান, ও আমার নিমাই, নিমাই গো।
কিছুটা অন্যমাত্রায় একজন পাঠকের সঙ্গে ইটালো কালভিনো জড়িয়ে পড়েন এক অদৃশ্য খেলা ও জেরায়।
প্রক্রিয়াটা কিন্তু তা-ই আসলে। পাঠ একটি ব্রতযাত্রার সামিল— পাঠকের মনেও অনেক মানত থাকে, সেই আশাগুলি পাঠক বইয়ের ভিতর রুয়ে দেন; নাটক বা সিনেমার দর্শকের বেলায়ও হয়তো একই প্রক্রিয়া কাজ করে। তাই অনেকসময় চলচ্চিত্রকার ও তার দর্শক, থিয়েটার এবং তার অডিয়েন্স খুব ভিন্নতর বোঝের উপর দাঁড়ান। আবার অনেকে পাঠক লেখক, চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার এবং দর্শক একই পাটাতনে এসে দাঁড়াক তা চান না, হয়তো কিছুটা মানহানিকরও মনে করেন।
এ-বেলায় উডি অ্যালেনের একটি কথা মনে পড়ে; অ্যালেন বলছিলেন, তাঁর কোন সিনেমা দর্শকনন্দিত হলে, দর্শক সিনেমাটিকে একদম নিজের জীবনসত্য মনে করলে তাঁর মনে হয়— এমন তো হবার কথা নয়, কোথাও একটি ভুল হচ্ছে, বা গোটা ছবিটিই হয়তো ঠিকমতো বানানো হয়নি।
ইটালো কালভিনো খুবই ভিন্নতর একটি মনস্তত্ত্বে লেখেন ইফ অন এ উইন্টার’স নাইট এ ট্রাভেলার বইটি লেখেন। এখানে মজার একটি পাজল আছে— বইটি পড়তে শুরু করলে এর কোন আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি নাই— প্রথার শৃঙ্খলাও নাই; তার কারণ, এখানে লেখক পাঠকের জন্য বইটি লেখেননি, বরং উলটো পাঠক লেখকের জন্য বই লিখছেন।
এ এক নোতুন ধরনের পাঠাভিযাত্রা। প্রতিটি ভাগে, পরিচ্ছেদে পাঠক নিজেই নিজের মন জোগায়, এ বুঝি এক অসাধ্য সাধনের চেষ্টা। তরুণ মুসুল্লি নামাজে দাঁড়ালে তার মন যেমন মুহূর্তে দুনিয়া ঘুরে দেখার জন্য ইবনে বতুতা হয়ে ওঠে, পাঠকের মনও সেভাবে নানা বনে উপবনে, কখনো লাইব্রেরির তাকে উঁকিঝুঁকি মারে, আবার হয়তো তার দরজা গলিয়ে বেরিয়ে যায়। এখানে পাঠক লেখকের প্রকল্পের সঙ্গে মিলাচ্ছেন না, লেখক পাঠকের অলিগলিতে নিজেকে বসানোর চেষ্টা করছেন।
ইতিহাসে এমন ঘটে— আমরা অতীতের ঘোড়ায় চড়ে ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করি, কখনও বা ভবিষ্যতের বাঞ্ছায় অতীতের ঘর গুছিয়ে তুলি। অথবা এমনও হয়, হতে তো পারে— জন্মমৃত্যু, পূর্বপশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ আলাদা বলে কিছু নেই, আমরা কাজের সুবিধার জন্য তালিকা বানিয়েছি মাত্র।
আনার দানা।। তামাম দুনিয়া বুঝি একটা আনার ফল, হঠাৎ ফেটে গিয়ে আকাশ ভরে ফুটে উঠেছে তারা- আনার ফলের দানা।
এতো তারার ঝিলমিল নীরবতার নিচে, নক্ষত্রখচিত কোটি শিশুর মহল্লায় ঘোর লাগে— নিজের বুকের ভিতর সাত তবক আসমানের শিবনাথ ইশকুলে কখন যে অনূদিত হয় সরিষাপুর গ্রাম, ঢাকা শাহবাগ উপন্যাসের মোড়, আর ফিলাডেলফিয়া লিবার্টি বেল অঞ্চলে তুমুল জেনট্রিফিকেশনের উন্নয়ন উচ্ছেদ।
এতো হৈ-হুল্লোড়, ঝকমারির ভিতর আমার ভুবনপুরে এসে ছাউনির ঘর তোলে আমার নানু- সূর্যের মা- একাত্তরের যুদ্ধ থেকে যার ছেলে আর কোনদিন ফিরে আসেনি; কৌরালের সঙ্গে তার রাত্রিদিন জেগে থাকা সংসার— ঘুম নাই, জমজমের পানি নাই : জীবন বুঝি পলিথিনের ব্যাগ— কান্নায় গলে না, অপমানে টলে না।
নির্ঘুম নানুকে দেখি— কী অপার মমতায় জায়নামাজের পাটি ভাঁজ করে রাখে; মনে হয়- যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া তার ছেলে মিজু বুঝি জায়নামাজের ভাঁজে ভাঁজে মিশে আছে!
নানু কী আমার উপর এসে ভর করে? না হয় আমিও কেন পালা কেটে কেটে জমা রাখি লাটিমের ঘুন্নি, উষ্ণা বাড়ির পিছনে খালের করচনা ঢালুতে পড়ে থাকা ভূতলবাসী হামিদের বুকে জমাট রক্তজবা, সেই খালের ঢালুর উপরেই হঠাৎ দুইবেণী কিশোরী এক আমার ইনসমনিয়ার ভাঁজে ভাঁজে আজও ফুটে থাকে!
এতোদিন পর আমি হই আম্বিয়া খালা— ভাসতে থাকি আশার জাজিমে; আমারও চারপাশে স্তুপ হয়ে জমে ওঠে ইসিমের দানা- রইন্না গুডা, বুড়ি দাদী আয়নার মা’র এক প্যাঁইচ্চা শাড়ি— মৌলাধুনিক এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম; ও আমার অন্তর কানা, আকাশভরা সূর্য-তারা, আনার দানা।
বদরুজ্জামান আলমগীর : আনার দানা, সঙ্গে প্রাণের খেলা।
এ তাহলে একটি অলাতচক্র বোধকরি : সবটুকু একসাথে জানা, না-কী আলাদা আলাদাভাবে অজানার প্রজ্ঞা? যা আছে, তা নেই; যা নেই, তা তো অবস্থিতি করে আসলে। মার্কিন কবি মার্ক স্ট্র্যান্ড এভাবেই বলছেন দেখি :
আস্ত রাখা।। আমি যেই মাঠের উপর দাঁড়াই /মাঠ গায়েব হয়ে যায়।
এটিই দুনিয়ার নিয়ম / যেখানেই দাঁড়াই /সেখানে ওটাই আমি / যা নাই হয়ে যায়।
যখনই হাঁটি / আমি বাতাস ভাগ করি,/ ফলে অন্য বাতাস সবসময়ই /জোরেশোরে বয় /একটু আগে আমি যেখানটায় ছিলাম / তা পূরণ করে।
আমরা সবাই / সরে যাই। / তার কারণ আছে। / আমি সরে যাই,/ চাই— অখণ্ডতা জারি থাকুক।
মার্ক স্ট্র্যান্ড : আস্ত রাখা। বাঙলা ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর।
হাল আমলে সবচেয়ে ফলপ্রসূ বোঝাবুঝির নাম কী— ভুল বোঝাবুঝি।।
মুসা নবীর বয়ানে কোন প্যারাবল প্রায় নেই বললেই চলে। হযরত মুসা পূর্বনির্ধারিত নন— তিনি চলমান, তিনি জাল ফেলতে ফেলতে যান— এখনও সেই জাল গুটিয়ে তোলেননি; তিনিই একমাত্র নবী যিনি অর্ধেকটা শূন্যতা, বাকী অর্ধেক মাটি; কিছুটা মাজেজা বাকিটা বাস্তব, একভাগ নবী একভাগ মানুষ। মুসা নবীকে মনে হয়, ইতিহাসের প্রথম শ্রেণি সংগ্রামী নবী, বারবার তিনি ঈশ্বরকে তার নির্ধারিত আবাসভূমির কথা জিজ্ঞেস করেন— কিন্তু তিনি তার নির্দিষ্ট উত্তর পান না, মুসা পয়গম্বর এলাহীর দিদার প্রার্থনা করেন, কিন্তু তা-ও নামঞ্জুর হয়। তাঁর জীবন কেটে যায় আবাসভূমির সন্ধানে অবিরল চাকার উপর। তাঁর পায়ের নিচে স্থির সিদ্ধানের অনড় নির্বান নেই, ফলে নেই প্যারাবলও।
ঈশ্বর মুসা পয়গম্বরকে আদেশ করেন পাথরের সঙ্গে অন্তর্ভেদী কথা বলতে— যাতে তিনি পাথরের অন্তরে জলের নহর দেখতে পান; কিন্তু মোজেজ পাথরটি ভেঙে দেখান পাথরের প্রাণে জল থাকে না— জমাটে বসে থাকে নিষ্প্রাণ শুষ্কতা।
অথচ, নবীজমানার অনেক পরে বোর্হেস কী আশ্চর্য এক নিজস্ব নবুয়তি কায়েম করে বসেন। তারও মুসা নবীর মত নির্দিষ্ট কোন আবাসভূমি নেই। আবাসভূমি নেই হারুকি মোরাকামিরও। একটিই আবাসভূমির নাগরিক তাঁরা— সেই আবাসভূমির নাম— মন। মুসা নবীর দোটানা দেখি বোর্হেসে, কিন্তু হোর্হে লুইস বোর্হেস নিজের অভিজ্ঞান স্থির বলতে পারেন, কেননা, তিনি নিজেই ঈশ্বর, আর নিজেই তার অধীনে বান্ধা, নিজে নিম্নমুখী দয়া, আর ঊর্ধ্বমুখী মায়াও তিনি স্বয়ং।
বোর্হেস ও আমি।। সবকিছু ওই লোকটাকে নিয়ে ঘটে— লোকে যাকে বোর্হেস বলে ডাকে।
আমি বুয়েনোস আয়ারেসের রাস্তা ধরে সটান হেঁটে যাই— যন্ত্রচালিতের মতো দাঁড়িয়েও পড়ি মাঝেমধ্যে, প্রবেশ তোরণের নকশা আর গ্রিলের কারুকাজ একচোখ দেখে নিই। বোর্হেসকে আমি চিনি— চিঠির উপর এই নামটা দেখি, অধ্যাপকদের নামের তালিকায় এই নাম থাকে, আবার জীবনীকোষেও পাই।
আমার ওই গ্লাসগুলো ভালো লাগে— যেখানে উপরের অংশে বালু রাখা হলে আস্তেধীরে বালু নিচের অংশে পড়ে— তাতে একঘন্টা সময় লাগে। মৌজার দাগখতিয়ান, পুরনো হস্তলিপি দেখতে ভালো লাগে, কফির আমেজে দারুণ চাঙ্গা হয়ে উঠি আমি, স্টিভেনসনের গদ্যভাষা বড় টানে আমাকে— তার লেখায় এই ব্যাপারগুলো থাকে। কিন্তু কায়মনোবাক্যে না করার কারণে ফলাফল সন্তোষজনক হয় না— মনে হয়, একজন অভিনেতা এগুলো খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। আবার আমাদের দুজনের একদম সাপে-নেউলে সম্পর্ক, এটা বলাও ঠিক হবে না।
আমি আছি, সুখে-দুঃখে চলে যাচ্ছে; ওই কাগজে কলমের যে বোর্হেস— সে মনের মাধুরি মিশিয়ে লেখাজোখা করে; তার লেখাপত্রে আমাকে কবুল করে।আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সে কিছু কাজের জিনিস করেছে, কিন্তু এইসব দলিল দস্তাবেজ আমাকে উদ্ধার করে দেবে না। কেননা, সত্যিসত্যিই যদি ভালো কিছু থাকে ওখানে— সেগুলো কারো হিস্যা নয়— এগুলো আমার নয়, সে-ও নিজের বলে দাবি করতে পারে না। কেউ-ই ভালো কোন কিছুর সত্ত্বাধিকারী নয়— তার মালিক আমাদের ভাষা ও পরম্পরা।
মৃত্যুর হাতে আমার নিয়তি বাঁধা, একে পাশ কাটিয়ে সামান্য কিছুই হয়তো তার কলমে উঠে আসে। অবশ্য ছিঁটেফোঁটা করে আমার সবই ওকে দিয়ে দিয়েছি। যদিও আমি জানি, সে নিরেট সত্যে কামড় দিয়ে থাকে না, লেখার খাতিরে খানিকটা নড়ে যায়, সরে যায়— কিছুটা বানিয়ে বলে। স্পিনোজা আলবৎ জানে- তাদের সজ্ঞায় এ-ব্যাপার তারা হেব্জ করে।
পাথর পারমার্থিকভাবে আবার পাথর জন্ম চায়, বাঘেরও অভিপ্রায় বাঘের জীবন অব্যাহত রাখা। আমিও আমার নয়— বোর্হেসের মধ্যেই থেকে যেতে চাই। আমি যদি আদপেই কেউ হয়ে থাকি— আমি তার বইয়ের মধ্যেই নেহায়েত জীবন্ত দেখতে পাই, আমি বরং নিজেকে অনুভব করি অন্যান্য কাজে; কেউ যদি মনেপ্রাণে গিটার বাজায়- মনে হয়, ওখানে বরং আমি নিজেকে বেশি খুঁজে পাই।
বেশ আগের কথা বলছি— একবার ভাবলাম, আমি বরং নিজেকে বোর্হেসের নাগপাশ থেকে খুলে নিই। করলাম কী- আগিলা কালের মায়াদারি পিছনে ফেলে সময়ের স্ফূরণ আর তার হাতে অনন্তের বাজি ধরে বসি— কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারি, ওই খেলোয়াড়ি বোর্হেসের দখলে; আমি ফতুর হয়ে গ্যাছি।
আমার হয়েছে শনির দশা— আমার সবকিছু হয় খুইয়েছি বোর্হেসের কাছে, নয় গ্যাছে সর্বনাশের হাতে। এই যে একপাতা লেখা হলো, আমি তা-ও জানি না— আমাদের দুজনের মধ্যে কে আসলে এটি লিখেছে!
হোর্হে লুইস বোর্হেস : বোর্হেস ও আমি। বাঙলা ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর।
এই এক অর্ধেক দুই অর্ধেক ব্যাপার নিয়ে আরো অনেককেই মোকাবেলা করতে হয়েছে। বিশ্বাসী বনাম অবিশ্বাসীর তর্ক, কে আগে কে পরে সেই প্রশ্নও আছে, আশা কোনদিকে চায়— আবার নিরাশাও আগেপিছেই লাগোয়া থাকে। নিচের দুটি লেখার একটি দেনদরবার করে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর পাঠশালায়, আরেকটি বিজ্ঞান ও দর্শন, সংশয় আর অবিচল বিশ্বাসের রশি টানাটানি :
মাঝখানে কাটা ঈশ্বর।। ব্যক্তির ভিতর বাহির, একজন মানুষের সামনে আরেকজন মানুষের প্রতিপক্ষতা, আসমান ও জমিনের ফারাক, বাস্তব এবং স্বপ্নের দ্বৈরথ— এগুলোর হাত ধরে মনের খোদা বনাম বনের খোদা, কসমিক ঈশ্বর এবং ক্বলবের এলাহিকে মিলানোর দ্বন্দ্ব সমাজে, রাষ্ট্রে, দর্শনে এক অবিসংবাদিত মৌলিক দ্বন্দ্ব।
এমনই এক দোটানা মোকাবেলা করেছেন দার্শনিক, অধ্যাপক নিকোলাস ম্যাক্সওয়েল। তিনি দেখেন— মানুষের মনের ভিতরকার যে শুভবোধ তা নৈমিত্তিকতার ক্লান্তি, আয়াস, বাসনা, ক্ষুধা, বাৎসল্য, যৌনাকাঙ্ক্ষার মিশেল— তার ছন্দ, গতি প্রায়োগিক ও বহুধা অনুশাসন আর অভিব্যক্তিতে বাঙময়; তার থেকেও বড় কথা— তা পরস্পর নির্ভরতার যৌগ।
অন্যদিকে যে ঈশ্বর কিসমিক একচ্ছত্র ক্ষমতায় প্রতিভাত, অভিব্যক্ত- তা সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক। একটি ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতা উপরের নির্বিকার ব্যতিক্রমহীন নীতির সঙ্গে পায়ে পা মিলানোর আদি প্রশ্নটিই মনের ধর্ম ও বইয়ের ধর্মের আসল মোকাবেলা।
এই খসখসে অমসৃণ পরিস্থিতিকে একটি পরিস্কার পাটাতনে দৃশ্যমান করার জন্য নিকোলাস ম্যাক্সওয়েল ঈশ্বরকে মাঝখানে কেটে দুই ফালিতে রাখার পরামর্শ দেন।
ঈশ্বরকে দুইভাগ করে দেখা যাক, রাখা হোক— তাহলেই কার কোনদিকে যেতে হবে, সেই পথ আস্তেধীরে খোলাসা হবে।
নিকোলাস ম্যাক্সওয়েল : মাঝখানে কাটা ঈশ্বর। বাঙলা ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর।
আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ।। বোধকরি বৈজ্ঞানিক সত্যের নৈর্ব্যক্তিকতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটু ভয় ছিল। তিনি সত্যকে বস্তুনিরপেক্ষভাবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না।
১৪ জুলাই ১৯৩০ সনে আলবার্ট আইনস্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে যে আলাপ হয় তাতে বুঝি— রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় জ্ঞানতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে সবকিছু বিচার করার যে রেওয়াজ তার বাইরে যাননি।
আইনস্টাইন বলেন— জগৎ-সংসারে কেউ না থাকলেও অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার একইরকম সুন্দর থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেন— না, তা থাকবে না। মানুষের চোখের সমর্থন ছাড়া অ্যাপোলো বেলভেডিয়ার সুন্দর নয়।
আইনস্টাইনের উত্তর— তা হয়তো সৌন্দর্যের ব্যাপারে সত্য হতে পারে, কিন্তু সত্যের বেলায় নয়। কেউ দেখুক, কী না দেখুক- সত্য একা একাও সত্যই।
মানুষের অংশগ্রহণ বা আত্মিকতার বাইরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তাকে টেনে নিয়ে যাননি। আইনস্টাইন সংশয়ী হয়েছিলেন বটে, তাঁর কথায় একটু দীর্ঘশ্বাসের প্রলেপ ছিল; বলেছিলেন— বৈজ্ঞানিক সত্যের দিকে যাওয়াই তাঁর ধর্ম, তাই পিছন ফিরে তাকাননি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহত্ত্ব এখানেই যে, তিনি নিঃসঙ্গ হতে চাননি— তাই বারবার মানুষের দিকে ঘুরে দেখেন; আলবার্ট আইনস্টাইনের গরিমা ওখানে যে, তিনি পিছনে ফিরে তাকাননি।
বদরুজ্জামান আলমগীর : আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ।
ক্লান্তির পরেও কীভাবে জীবনমুখিতা গড়ে ওঠে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও আলবেয়ার কাম্যু।। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও জীবনজিজ্ঞাসার অস্তিত্ববাদী খোঁড়াখুঁড়ির রূপ দেখার নিরিখে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা এবং আলবেয়ার কাম্যুর দি প্লেগ উপন্যাসের পাশাপাশি পাঠ ব্যাখ্যা করে দেখা যায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা প্রকাশিত হয় ১৯৩৬-এ, আর আলবেয়ার কাম্যুর দি প্লেগ বেরোয় ১৯৪৭ সনে। দুটি উপন্যাসেরই অন্তর্লোক গড়ে ওঠে যুদ্ধোত্তর মানুষের বেঁচে থাকা,সংগ্রামশীলতা, মনস্তত্ত্ব, অসহায়তা ও ব্যক্তিচৈতন্য আর ঈশ্বরের ঘাত প্রতিঘাত ভালোবাসা নিয়ে। মানুষের ক্ষমতা, দুঃখ পাবার বৈধতা আর অন্যায়, ঈশ্বর ও মানুষের অধিকার, অনধিকার এবং সম্পর্কের বাস্তবিক দয়া ও রুক্ষ্মতা- এই দুই উপন্যাসের নাজুক জমিন গড়ে তোলে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এলাকা গাওদিয়া, আলবেয়ার কাম্যুর অঞ্চল আলজিরিয়ার ওরান শহর। দু’ জায়গাতেই আছে দোটানা, তীব্র যাতনা ও সঙ্কট। দুটো উপন্যাসেই নানা আঙ্গিকে, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ঈশ্বরিয়ানা বনাম বিজ্ঞানের অভিজ্ঞানকে মোকাবেলা করা হয়েছে।
প্লেগে ডাক্তার বার্নাড রিউক্স, পুতুল নাচের ইতিকথায় কলকাতা ফেরত ডাক্তার শশী বিজ্ঞানের শ্রমসাধ্য পরশপাথর হাতে মোকাবেলা করেন মড়ক ও মারী; অন্যদিকে পাদ্রী পেনিলোক্স মানুষের বানানো ওষুধে সেরে উঠতে অস্বীকার করেন- এমনকী তাঁর মৃত্যুর পিছনে রহস্যের মায়াবী পর্দা দোলে, একটি জোরালো সন্দেহের বীজানু থেকেই যায়- ঈশ্বরের আধিপত্য প্রমাণ করার জন্য ফাদার হয়তো নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন; একইভাবে পুতুল নাচের ইতিকথায় ঠিকঠিক রথের দিন যাদব পণ্ডিত তাঁর বিশ্বাস ও সংস্কারের জয় দেখতে ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেন।
বস্তুবাদী ডাক্তার রিউক্স দেখেন ফাদার পেনিলোক্স অতি মারিতে শিশুর মৃত্যু দেখেও কেমন অবিচলিত— বরং স্থির ধৈর্যে ঐশ্বরিক ক্ষমতার একচ্ছত্র মহিমায় নির্বাক, ডাক্তার শশীর প্রাণান্ত চেষ্টার পরও ভূতো, ক্ষেমির মৃত্যুর ভিতর দিয়ে নেমে আসা ধারালো হিম মৃত্যুর পরোয়ানা দেখেন অসহায় শশী।
এভাবেই জীবন ও মৃত্যুর ধ্রুপদী সিদ্ধান্ত রচিত হয়ে ওঠে। কুসুমের বাবা শশীকে বলেন, সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর এক, চিরকাল এমনিই দেখে আসছি ডাক্তার বাবু। পুতুল বৈ তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।
বদরুজ্জামান আলমগীর : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও আলবেয়ার কাম্যু।
যে পরাজিত হয়, বিনাশপ্রাপ্ত হয় সে-ই আসলে জিতে আসে, পোড়খাওয়া সমন্বয় সাধন করে।
পতঙ্গ।। উইপোকাদের হাটে একটা তাগিদ ওঠে— কে বাতির আগুন পরখ করে তার স্বভাবের তালাশ দিতে পারে?
প্রথম উই মোমের চারপাশ ঘুরে এসে রিপোর্ট দাখিল করে : বাতিটা একটা মুকুট যার উপর সূর্যালোক পড়ে ঝিকমিক করে। সরদার বলে, তুমি তো কাছেই ঘেঁষোনি, দূর থেকে উঁকি মেরেছো।
এবার দ্বিতীয় উইয়ের পালা— সে পাখনা মেলে পতপত করে ঘুরে আসে। বেচারিকে বড় অস্থির দেখায়। আইডাই খবর বলে: সে এক বিরাট ইতিহাস। আমি ওখানে সটান উড়ে যাই, দূরত্ব বজায় রাখি। কয়েক ঘন্টা বিষয়টি ঠাহর করি— রীতিমতো গায়ে একটা গরম আঁচ এসে লাগে, এই তাপই আমাকে ঠারেঠুরে আগুনের কাছে যেতে বারণ করে। আমি আলোর মধ্যে একটা সোনালি গুল্লি দেখতে পাই, আর কী হুজ্জতি বলো দেখি— ওই গুল্লির ভিতর একখণ্ড নীলা ঝিলমিল করে!
সরদারের কন্ঠ এবারও জলদ গম্ভীর— তুমিও দূরেই গোত্তা খেয়েছো— তার দিলের খবর আনতে পারোনি।
বেহিসাবি তিননম্বর পতঙ্গ সোজা উড়ে যায় বাতি বরাবর, তার শিখা বেড় দিয়ে ধরে। মথদের কেউ কেউ চিৎকার চেঁচামেচি করে, অনেকে ভয়ে নিজেদের চোখ ঢেকে ফেলে। কিন্তু সরদারজি সবাইকে এক ধমকে চুপ করিয়ে দেয়— একমাত্র ও-ই আগুনের অন্দরমহলের খোঁজ জানে।
তৃতীয় উই বাতির জ্বলন্ত সলতে আঁকড়ে ধরে, তারপর ফিরে আসে উই নয়- একখণ্ড শিখা উড়তে উড়তে সরদারের কাছে ফিরে আসে; পতঙ্গ আর আগুন আলাদা নয়— দোঁহা মিলে একটি লকলকে বহ্নিশিখা- আগুনের আলজিভ নীলাপাথর নয় আর- এক শুচিশুভ্র নিশানা।
জো মার্টিন : পতঙ্গ। বাঙলা ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর।
এক চিলতে বিবমিষা।। এটা আমার মুখের ছাপ। মাঝেমধ্যেই এই নিষ্ফলা দিনগুলোতে ব্যাপারটা ভেবে দেখি : আমি নিজের মুখমণ্ডল থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারি না। অন্যদের মুখাবয়বের তা-ও কিছু একটা অর্থ আছে, আছে কিছু স্পষ্টতা। আমারটা একদম ফাঁকা, অর্থহীন।
আমি সুদর্শন, না কিম্ভুত— সেটিও বুঝে উঠতে পারি না। মনে হয় কুৎসিত— আমি এমনই শুনে আসছি। কিন্তু এতে আমার কিছুই যায় আসে না।
মনে মনে আমি বরং অবাকই হই— যা হোক একটা কিছু তো ঠাওরেছো আমাকে, অন্তত তুমি একটা মাটির ঢেলাকে, বা ইটের টুকরাকে সুন্দর বা কুৎসিত বলেছো।
জাঁ পল সার্ত্রে : এক চিলতে বিবমিষা। বাঙলা ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর।
সময় সবুজ ডাইনি।। সময় সবুজ ডাইনি, পৃথিবীর উপকন্ঠে থাকো, /নাবিকের হাড় দিয়ে সন্ধ্যার উঠোনে তুমি / ভাঙা নাবিকের ছবি আঁকো। রণজিৎ দাশ : সময় সবুজ ডাইনি।
আধুনিক রাষ্ট্র।। রাত্রির গুহায় আতঙ্ক, ঋণ, দুর্ভাবনা শেষে কতো ভাষা ও বাসনা নিয়ে প্রতিটা দিন শুরু করি; কিন্তু হায়, দিন যেন সূর্যালোকের হাত ধরাধরি করে চলে; সূর্যপ্রভার বদান্যে সবকিছু স্ফটিক্স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, চারদিক সুনসান পরিষ্কার অভিব্যক্তি নিয়ে উপস্থিত, আর যায় কোথা!
এক আঙ্গিনায়, এক অপ্রতিরোধ্য রুখে এক সমন্বয়, স্বজনপ্রীতি, সংঘ, সমিতি, সভা, লেফট-রাইট, দল ও দলিলসহ এক মাংসাশী রাষ্ট্র হুংকার দিয়ে চারদিক থেকে নৃশংস উল্লাসে জেগে ওঠে! আমি কুঁকড়ে শামুকের মতো সেঁধিয়ে যাই— আবার রাত্রি-দিনের তফাৎ মুছে দিয়ে কালো এসফল্টের নিশি ঝেঁকে বসে!
এ-কেমন নিকষ রাত্রি— দিনের আভা দাবড়ে নিয়ে আমার চোখে ঔদাসীন্যের পেরেক ঠুকে দেয়; কীভাবে এতো রাষ্ট্র, দণ্ড ও দণ্ডবেড়ি, কিরিচের পিছনে রাষ্ট্র, হন্তারকের সামনে রাষ্ট্র, আকাশে পাতালে অন্তরীক্ষে, ইলিশের পেটে ডিমের মধ্যে রাষ্ট্র; বেডরুমের বিছানার চাদরে প্রিন্টের জমিনে সংবিধান, হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির শব্দেও লেফট রাইটের বুটের আওয়াজ- বড় হাঁসফাঁস করি— এ আস্তরণ সরিয়ে নাও।
কোথা গেলে আশ্রয় আছে, মাথা ঠেকাবার প্রশ্রয় আছে তা-ও জানা ভার। এই যে যুক্তরাষ্ট্র— লক্ষুকোটি মানুষের দিবারাত্রির স্বপ্ন- তার ভিতরেও এ কিসের দিব্যশঙ্কা দানা বাঁধে। নিচের দুটো প্যারাবল একচক্কর ঘুরে আসি।
ভাবতে গেলে মাথা ঘোরায়, কিন্তু ঘটনা তিনসত্যি যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পও পয়সার মাল কথা বলেন, বলতে পারেন।
আমেরিকান ডেমোক্রেসির অন্দরমহল সম্পর্কে জানতে চাইলে আমরা প্রধানত নোয়াম চমস্কির দরবারে হাজির হই। তিনি ভেঙে ভেঙে বুঝিয়ে বলেন— গণতন্ত্রের মূল বুনিয়াদ জনগণ যেখানে তাদের মতামত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নন, যেখানে শতভাগ দুইদলের একনায়কতন্ত্র কায়েম, কিন্তু কার্যত কর্পোরেট পুঁজিই এদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক— সেখানে ডেমোক্রেসি আসলে একটা ফাঁকা বুলি বৈ তো আর কিছু নয়।
কিন্তু পুরো ব্যাপারটি ডোনাল্ড ট্রাম্প মনের অজান্তে বড় চিত্তাকর্ষকভাবে বলেন। ট্রাম্প বলছেন— আমি আমেরিকান ফুটবলের চিয়ার লিডার, আমার কাজ ভালো স্কোরের জন্য নেচে যাওয়া। বেশ পরচুলা আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে ঢেউ খেলে যায়। আমরা আনন্দে অসহায় বোধকরি।
বদরুজ্জামান আলমগীর : ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পরচুলার ডৌল।
শুইতে গেলে হাঁটতে থাকি- কী কাণ্ড! হাঁটতে চাইলে পাকুড় গাছের তলে ঠাঁইনাড়া বসে পা দোলাই। জলতেষ্টায় পানির বদলে চলে যাই আগুনের ধারে। মাঘ মাসি শীতে আগুনের পাশে হাত বাড়িয়ে বসার বদলে কনকনে শীতে গান করতে করতে গভীর জঙ্গলে হারাই, মাইরি।
ইচ্ছা করে ভিলেন দেখি, খলনায়কের জোশই আলাদা। কিন্তু কোন ফাঁকে বাঙলা সিনেমার ভিলেন জসীম নায়ক বনে যায়। ফলে কী আর করা— মনে বড় আশা জাগে— দেখবো নায়িকা!
ঘুমের ঘোরে চমচম ভেবে কাঁথা চিবানোর কায়দায় হৈমন্তী খোয়াবে জিবরাইলের ডানায়, কী ইকারুসের মোমলাগানো পাখায় উড়েউড়ে নায়িকা সন্দর্শনে মাতি:
গোঁফের গোড়ায় মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে শিস মারি, শাবানারে আইঞ্জা দিয়া ধরি। চোখ খুলে দেখি, কই— আমার নায়িকা শাবানা কই- এ তো হুমায়ুন ফরিদী!
মৎপ্রণীত প্যারাবল— আমার পাগলা ঘোড়ারে।
বর্ণে বর্ণে রচিত।। মানুষ আশরাফুল মাকলুখাত হিসাবে নিজেকে প্রকৃতির উপর, জগতে সংসারে, আসমানে জমিনে অন্তরীক্ষে একচ্ছত্র শ্রেষ্ঠত্বের উচ্চাসনে বলবত করেছে। এই আত্মঘাতী বিজয়ে তাকে উল্লসিত হতে দেখি।
আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব অন্দরমলে লাগানো সংবেদের আয়নায় যদি দেখি, কী মিলিয়ে আনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রুনো লাতুই ও আরো অনেক ভাবুক দার্শনিকের চিন্তাসূত্রের সনে— তাহলে সহজেই বুঝতে পারি- প্রকৃতি থেকে নিজেকে আলাদা করে তার উপর যে সামরিক বিজয় চাপিয়ে দিয়েছে মানুষ— তাতে সে আসলে মহান বিজয়ের নামে ঘরে তুলেছে পরাজয়ের নিঃসঙ্গ তকমা।
বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে উৎপাদন করছেন রোবট মৌমাছি— যারা ফুলের পরাগায়নে মৌমাছির বিকল্প হবে, তারা মধু আহরণ করবে না কিন্তু একফুল থেকে আরেক ফুলে পরাগায়ন ঘটাবে। এটি কোন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার নয়— বরং এই জুয়াড়ি, ভেক্সিনেটেড ধনতান্ত্রিক ভোগবাদী দুনিয়ার একটি একচেটিয়া দখলদারি।
এভাবেই যৌনতা আর আধ্যাত্মিক এভিনিউ নয়, বরং একটি ক্ষমতায়নের বিন্যাসে এসে ঠেকে। ওগো রোবট মৌমাছি, তমাল তলার রাধা তাহলে কাকে বলবে তার অশ্রু দিয়ে লেখা কাঁপা কাঁপা ভুল বানানে তোলা দু’টি কথা— ভ্রমর কইও গিয়া, শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদে আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া!
বদরুজ্জামান আলমগীর : বর্ণে বর্ণে রচিত।
যে ডিঙিয়ে এসেছে বহু পথ, উত্থান-পতন, জিতে এসেছে বাজারের ঢোল ও করতাল, রঙিন বিরঙিন প্রতিযোগিতা, তার ভিতর মানুষ হয়তো খেয়ালই করেনি কখন বুকের খাঁচার ভিতর অগোচরে গড়ে তুলেছে এক গণ্ডারের খামার, উজাড় করে দিয়েছে বোনের মায়ার মতো সবুজ বন, সারাটা দুনিয়া চিবিয়ে খায় মুঠোর ভিতর। এভাবে জনান্তে গড়ে ওঠে পরিশ্রান্তির দানা— জনমিতি।
মোবাইল ফোন কী কী খাইছে।। মোবাইল ফোন কী কী খাইছে- ঘড়ি খাইছে, ক্যামেরা খাইছে, ল্যাপটপ খাইছে, রেডিও খাইছে, টিভি খাইছে, টেপ রেকর্ডার খাইছে, ক্যামেরা খাইছে, টর্চলাইট খাইছে, ক্যালেন্ডার খাইছে, এলার্ম খাইছে, ক্যালকুলেটর খাইছে, সিনেমা হল খাইছে, ধ্যান খাইছে, জ্ঞান খাইছে, বই খাইছে, নোট বুক খাইছে, ঘুম খাইছে, পড়াশোনা খাইছে, অপেক্ষা খাইছে, পীর খাইছে, মুরিদ খাইছে, চোখের পানি খাইছে, মুখের হাসি খাইছে, অনুভূতি খাইছে, অপেক্ষা খাইছে, আনন্দ খাইছে, বিষাদ খাইছে- আর আমি নিজেও জানি না— কোনদিক দিয়া আমারে খাইছে!
পাবলিক প্যারাবল : মোবাইল ফোন কী কী খাইছে।
সংগৃহীত।
লোকজ্ঞান, লোক অভিজ্ঞান এক অসামান্য ধন আমাদের সমাজে; কেবল আমাদের সমাজের কথা-ই শুধু কেন বলছি- সমগ্র দুনিয়াজুড়েই তা এক আস্থা, ভরসা, স্নেহ বাৎসল্যের বারামখানা। কখনো কখনো হয়তো তাদের শুধুই বচন প্রবচনের মতো শোনায়— যা আসলে হাজার বছরের পরম্পরা, যৌথতার ভিতর জন্ম নেয় সে-সকল প্রতীতি, অভিজ্ঞতার নির্যাস, সিদ্ধানের দৃঢ়তা, দর্শন।
কাজের মাপ রিজিকের বেড়।। অজিফা কাজ করে, খালি কাজের গোড়ায় কাজ, কামের পিঠে কাম। তাকে দেখলে মনে হয়, সোনামুখি সুইয়ের সামান্য ছিদ্রে বুঝি আস্ত কুড়াল এফোঁড়-ওফোঁড় করেই তবে শান্ত হবে। অজিফা এই ঘর ঝাট দেয় তো গাছের গোড়ায় পানি ঢালে, পানি ঢালা শেষ হতে না হতেই ঘর লেপামোছায় বসে, একফাঁকে টিউবওয়েল থেকে দুপুরের রান্নার জল এনে রাখে, হাঁসের জন্য শামুক কেটে দেয়। এর মধ্যে বাড়ির দেউরির ওপাশে ভিখারি এসে ভিক্ষার হাঁক দেয়। দৌড়ে ভিক্ষুক মাজরালিকে ফুরায় করে দুইমুঠ চাল দিয়ে দৌড়ে অজিফা আবার কাজে আসতে যাবার মুখে মাজরালি বলে, শোন মা, এই দেখ আমি আস্তে আস্তে হাঁটি- বাড়ি বাড়ি থামতে আমার ভালো লাগে, প্রত্যেক বাড়ির আলাদা আলাদা গন্ধ আছে, সব সুবাসের রিজিক হইলো আমার নাক। আমি যদি বুক ভইরা শ্বাস না লই তাইলে তাদের রিজিক মারা যায়। কাজেরও আয়ু আছে, সীমানা আছে, তোমার তকদিরে কাজের ভাগ আছে, হিস্যা আছে। এতো তাড়াহুড়া কইরো না মা, তোমার ভাগের কাম শেষ তো তোমার আয়ুও শেষ, উপরওয়ালার নিয়ামত আমরা কীভাবে পায়ে ঠেলি কও?
জনমিতি প্যারাবল : কাজের মাপ রিজিকের বেড়, সংগৃহীত।
মওলানা ভাসানী একবার কৃষক সমাবেশ করতে গেলে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ষণ্ডারা সভায় বাধা দেয়। মওলানা প্রশাসনকে বলেন, ঠিকাছে তোমাদের কথা-ই সই, আমি মিটিং করবো না, বক্তৃতা দিবো না; আল্লার দরবারে মোনাজাত করবো।
তিনি সভাস্থলে বক্তৃতার বদলে আল্লার কাছে হাত তুলে ফরিয়াদ শুরু করেন, সেখানে জালিম আইয়ুব শাহীর পতন চাওয়া থেকে, পাষাণ দুর্মরের হাত থেকে রক্ষা পাবার সমস্ত বক্তব্যই উপস্থিত করেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কিছুই করার ছিল না, কেননা কাঠামোগতভাবে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কোন বিষোদগার করেননি, বা কৃষককে ক্ষেপিয়ে তুলে কোন বক্তৃতাও করেননি। কেবল মোনাজাত করেছিলেন— কিন্তু মোনাজাতের ভিতর পরোক্ষে, সমস্ত সারবত্তাই হাজির করেন। প্যারাবল এমন একটি নিরাপোষ ডিসকোর্সের নাম— সুরের জন্ম গানের বাণীকে এক স্থির অতলে ঘনবদ্ধ করে।
নৈঃশব্দ্যের নন্দনতত্ত্ব।। সব যুগেই সময় নিজে মরমিয়ার একটি নোতুন রূপ পরিগ্রহ করে। এই মরমিয়া মানুষের কল্পনা, চিন্তা ও আশার আকার ভাষাবিন্যাসে দ্বান্দ্বিকভাবে জমাট বাঁধে— যা চেতনাধারার এক নোতুন বিকশিত গড়ন।
সুজেন সনট্যাগ : নৈঃশব্দ্যের নন্দনতত্ত্ব।
জগতে হাঙ্গামা আছে, মাঝেমাঝে তার প্রয়োজনও পড়ে। কিন্তু শোরগোলের ঠিকানা শেষাব্ধি নৈঃশব্দ্যই। লালন সাঁইজির যেদিন নিঃশব্দ শব্দরে খাবে— এই কালামের অভিঘাত কী মৌন গভীর! বোর্হেসের অমূল্য কথাটি মনে পড়ে— যে কথার আওয়াজ নৈঃশব্দ্যকে উসকে দেয় না— এমন কথা বলো না। নীরবতা বুঝি ক্লদ মনে’র চিত্রকর্ম- গাছের শাখারা কাঁপে একা ও একসঙ্গে, হ্রদের উপর বিছিয়ে থাকা শাপলার পাতাটি পতপত করে জলের পাটাতনে বাড়ি খায়, কোত্থেকে জানি এক ঘুন্নি হাওয়া বয় শনশন, গাছের ওপাশে বুক কাঁপিয়ে শিস দেয় রবিন— কিন্তু সবার এই সম্মিলিত সরব সচলতা নির্মাণ করে এক পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ্য, নীরবতা।
মন্ত্রীর নির্জন আবাসের সংকল্প।। জালালউদ্দিন রুমি কোলাহল ছেড়ে নীরবতার বারামখানায় লুকাতে যান না। কোলাহলের ভিতরেই বীজের বীক্ষায় নিজেকে ধ্যানের মাটিতে নিজেকে রোপণ করে দিতে পারেন— গার আমিনাম মোত্তাহাম নাবুয়াদ আমিন, গার বগুয়্যাম আসমাঁরা মান জমিন : আমি যদি তোমাদের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে থাকি তবে আমার প্রতি তোমাদের কোন সন্দেহের অবকাশ থাকা উচিৎ নয়, যদিও আমি আসমানকে জমীন আর আকাশকে পাতাল বলি।
গার কামালাম বা কামাল এনকার চীস্ত অর নিয়াম ঈঁ যহমত ও আযার চীস্ত : আমি যদি পীরে কামেল হয়ে থাকি তবে আমার ব্যবস্থাকে অস্বীকার করার কোন কারণ থাকতে পারে না। আর আমি যদি পীরে কামেল না হয়ে থাকি তবে আমার পিছনে তোমাদের এ কষ্ট-ক্লেশ ভোগের প্রয়োজন কি?
মান না খাহাম শুদ আযী খেলওয়াৎ বেরুঁ যাঁকে মশগুলাম বা আহওয়ালে দরুঁ : আমি নির্জন-বাস হতে বের হবো না। কারণ, আমি কোলাহলেই আধ্যাত্মিক অবস্থাসমূহে ডুবে আছি।
জালালউদ্দিন রুমি : মন্ত্রীর নির্জন আবাসের সংকল্প, মসনবী শরীফ।
কী সেই পরশপাথর— আমাদের তা জানা নেই। উজান ঠেলে গুগলির বদলে কোনদিন পাওয়া যাবে বাসনার মুক্তাওয়ালা ঝিনুক— কে তার খোঁজ জানে— কী সন্ধানে যাই সেখানে আমি কী সন্ধানে-
জন স্টাইনবেক তাঁর মুক্তা উপন্যাসে এমন একটি জীবনবৃত্তান্ত এঁকেছেন— তাতে একটি প্যারাবল গড়ে ওঠার ইতিবৃত্ত যেন দেখতে পাই।
কিনো সমুদ্রের কাছে একটি মুক্তা খুঁজে পান। আদিবাসী গড়নে গড়ে ওঠা কিনো, তার সারল্য, সংসার জীবন, নবজাত পুত্র কয়োটিটো, স্ত্রী হুয়ানা সবমিলে যে জীবন তার মধ্যে সমুদ্রে পাওয়া মুক্তাদানাটি যেন এক বিপুল হুল্লোড়ে আলোড়ন ঢেউয়ের অভিঘাত নিয়ে আসে।
অনেক ঘটনা উপঘটনার ভিতর কিনো আর বুঝি আদিবাসী সারল্যের নিরঙ্কুশ পারম্পর্যে অটল থাকতে পারেনি। পূর্বপুরুষের দাবি, সহজ জঙ্গমতা থেকে ছিটকে পড়ে। জন স্টাইনবেক কিনোর মুক্তাদানার ফলে বিচলনকে আদিবাসী সমাজে অ্যামেরিকার অনুপ্রবেশ হিসাবে একটি সমান্তরাল বয়ানে বিবৃত করেন।
উপন্যাসের শেষে দেখি— কিনোর লোভের কারণে তারা নবজাত কয়োটিটোকে হারায়। সন্তানের মৃতদেহ কাঁধে কিনো আর হুয়ানা আবার সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছে যায়— কুড়িয়ে পাওয়া মুক্তা আবার সাগরেই ছুঁড়ে ফেলে কিনো।
কালের টানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে লোকধর্মের একটি বিস্তর ফারাক হয়ে গিয়েছে— বুকের— বইয়ের ধর্ম আর বুকের ধর্ম আকারে, ইঙ্গিতে, সুবাসে একজায়গায় নেই। ফলে বাইবেলীয় নৈয়ায়িক অবস্থান থেকে যে প্যারাবল শুরু হয়েছিল তা নানা রূপকারের হাতে বিপুল পার্থক্যে, জৈবিক চাষাবাদে মেলা ফসল ফলিয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধের জায়গায় কখনো প্যারাবল এমনকী তার প্রতিপক্ষতা নিয়েও দাঁড়িয়েছে। নিচে তার একটি নমুনা।
ধর্মের গ্রহণ।। মা-বাবার কোলে জন্মসূত্রে আমি মুসলমান ; ইতিহাসের মাতৃক্রোড়ে জন্মানো আমি হিন্দু; জীবনের বিপনীকেন্দ্রে লেনদেন ও মিথষ্ক্রিয়ার কল্যাণে সর্বধর্মের জাতক আমি; ইচ্ছার সংকল্পে সর্বপ্রাণ শূন্যতাবাদী।
যেখানে যে আক্রান্ত— তার অন্তরের রক্তক্ষরণটিই আমি আমার ধর্মে গ্রহণ করি।
সব ধর্মই আমার ধর্ম— কোন ধর্মই আমার ধর্ম নয়।
সত্য কবরের নিঃসঙ্গতায় নিজস্ব, সত্য নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ!
বদরুজ্জামান আলমগীর : ধর্মের গ্রহণ, হৃদপেয়ারার সুবাস।
প্যারাবলে খ্রিস্টীয় সুসমাচার গ্রহণ করেন কোহলিল জিবরান, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর উপসংহারে অভ্রান্ত বাইবেলীয় পরিকল্পনা তুলে আনেন অক্টাভিয়া বাটলার; কিন্তু খ্রিষ্টীয় নীতিশাস্ত্র পরিহার করেন ফ্রানজ কাফকা, প্যারাবল লেখায় শিল্পবোধই প্রধান ও শেষ বিবেচনা হোর্হে লুই বোর্হেস-এর বেলায়, কালের বিন্দুবিন্দু জরুল ইটালো কালভিনোর সিদ্ধি, পাওলো কোয়েলহো ইতিহাসের কেন্দ্রে গঠিত হওয়া শুভবোধে নিষ্ঠ— তাঁর মধ্যে গহীন ভিতরে হয়তো খ্রিষ্টীয় মনোনয়নের একটি দূরবর্তী পোঁচ দেখা যায়।
অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের মধ্যে নৈমিত্তিক জীবনের চেনা বাস্তবের অচেনা, অতল ব্যাখ্যাও দুর্লক্ষ্য নয়।
বিপদজনক নিরাপত্তা।। দুই জেন গুরু ম্যাঙ গঙ আর কিয়ঙ হো এক বনের ধার ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। তাঁরা বৃষ্টিজলের হাত থেকে বাঁচার জন্য দ্রুত বনের কিনারে একটি ঘরে আশ্রয় নেয়। পুরো ঘরটি পাথর বসিয়ে বানানো।
একটু বাদেই কিয়ঙ হো বারবার ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখে। ম্যাঙ গঙ তাতে কিছুটা শঙ্কিত আর উৎসুক বোধ করে, ম্যাঙ গঙ কিয়ঙ হো-কে জিজ্ঞেসই করে বসে— এই ঘর খুব শক্ত সাবুদ- তুমি বারবার উপরের দিকে কী দেখো?
কিয়োঙ হো বলে— তুমি ঠিক বলেছো। পাথরের চাঁইগুলো খুব পোক্তভাবে লাগানো, তাই এই ছাউনিও খুব নিরাপদ। কিন্তু নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বিপদজনক।
জেন প্যারাবল। বাঙলা
প্যারাবলের এই বাস্তবানুগ অনুসন্ধিৎসা আমাদের জানান দেয়— প্যারাবল যতোটা না নিরেট সত্য তারো অধিক সত্যাভিমুখিতা। আধুনিক নৃবিজ্ঞানের এই দাবিই যেন প্যারাবলেরও পাটাতন। নিরেট অনড় সত্য বলে কিছু নেই— কেবল সত্যের দিকে অভিযাত্রা আছে। ট্রুথ ইজ নট দি গোল— গোল ইজ ট্রুথফুলনেস।
নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার-এর বিবেচনাটি এখানে উল্টেপাল্টে দেখা যায়: পিন্টার বলেন— সত্য কখনো একটি নয়— সত্য বহু; এবং সত্যকে অনেক কোণ থেকে আলো ফেলে দেখা যায়; অসত্যও তেমনি একটি ব্যাপার। জৈন ধর্মেও এমন একটি কথাসার আছে- সত্য একটি নয়, অনেকগুলি সত্য একসঙ্গে থাকে।
কেউ যদি বলেন, মানুষ মারা যায়— এটি কী নিরেট সত্য নয়? এর উত্তরও এক ঝটকায় দেয়া যায় না বোধ করি।সুফী সাধক তাঁর পদে ফরমান— জীবনের নামে মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, মৃত্যুর ভিতর সে জেগে ওঠে।
যে সত্যিকার গুরু সে কখনও আংশিক হয় না, সে সত্যের একপাশ বা কোন একটি পক্ষ নয়; তিনি সাধু ও গুনাহগার- দু’জনকেই একসঙ্গে বিচার করেন : লাও জু। অতীশ দীপঙ্কর বলেন- জগতে চূড়ান্ত সত্য কোথাও পাওয়া যাবে না।
নির্বিকার বিন্দুটি।। কৃষ্ণ মাত্র ১৬বছর বয়সে বাঁশি বাজানো ছেড়ে দেন। তিনি যখনই বোঝেন রাধার মন তমাল গাছের একটি পাতা বুঝি কেঁপে উঠেছে, তখনই বাঁশিটি রাধার হাতে তুলে দিয়ে একটি দূরত্বের রঙে লুকিয়ে যান। এভাবেই লীলাবান কৃষ্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণে রূপান্তর লাভ করেন।
আবদুল হাই বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে জলের ঢেউয়ে মিশে মৃগেল মাছের চোখের মণিতে সিদ্ধ হন; মৃত্যুকে পরিধান করে আবদুল হাই মেঘের ধামে বিদ্যুতের পদ্মহেমে লোকান্তরে মেশেন। রঙমালা বেগম প্রতিদিন গণক ডেকে দিশা গুণিয়ে দেখেন— কবে আহা, তার সাধু হাই বাড়ি ফিরবেন! চুলার আগুন একাএকা তরকারি পুড়ে ফেলে, কিন্তু তার আঁচ তাকে ঘুনাক্ষরে স্পর্শও করে না। এভাবে রঙমালা একটি স্থিরবিন্দু, নির্বিকার ঈশ্বর হয়ে ওঠেন।
সন্ধ্যা গড়িয়ে ঢালুতে নামতেই প্রতিদিন নিরুপমা পিসিমার জ্যোৎস্নার ডালি সাজাতে ইচ্ছা করে। দুধেদুধে অন্ধ দুনিয়া দেখতে নিরুপমা পিসিমা ঝামায় কাসার থালাটি ঘষেন— ফলে থালা ঝকমক করে ওঠে। কাহার তরে জানি মায়াপাত্রে জ্যোৎস্না তুলতে দরজার দিকে যান। পিসিমা ভুলে যান, কবেই ওই দরজা আদিঅন্ত কালের জন্য বন্ধ হয়ে গ্যাছে!
পিসিমা নির্বিকার। নিরুপমা পিসিমা এভাবেই ভগবান হয়ে ওঠেন।
বদরুজ্জামান আলমগীর : নির্বিকার বিন্দুটি, হৃদপেয়ারার সুবাস।
প্যারাবল নিয়ে।। অনেককেই অনুযোগ করতে শুনি— আপ্তবাক্য কেবল সুবচনের বাহার, এগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কোন কাজে আসে না। প্রজ্ঞাবান মানুষটি বললেন : আগাও, এই কথার ভিতর দিয়ে তিনি কিন্তু বাস্তবিক গজফিতায় মাপা কোন জায়গা অতিক্রম করে যেতে বলেননি; রথে কুলালে আমরা অবশ্য তা করতেই পারি; কথা সেটা না— ঋষি মানুষটি বোঝাতে চেয়েছিলেন অজানার উদ্দেশে পা বাড়াও— এমন কিছুর ইঙ্গিত তিনি করছিলেন— যা তার নিজের কাছেও গাণিতিকভাবে পরিস্কার নয়, এইজন্য তাঁর পক্ষে প্রায়োগিক কোন নির্দেশনা দেয়াই সম্ভব নয়। প্যারাবল ব্যাপারটাই তাই- যা আগাপাশতলা বোঝা যায় না- তা বোঝার জন্য কুস্তি করা বৃথা— একথা কে না জানে! তবুও দিনানুদিন ভালো কিছু করার জন্য মনেপ্রাণে চেষ্টা করতে হবে- সেটা অন্য ব্যাপার।
একজন তো মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলার দশা, বলে কী- এতো গড়িমসি কেন? তুমি যদি সবকিছুর মধ্যে কেবল আপ্তবাক্যের মাজেজা নিয়েই পড়ে থাকো— তাহলে তোমার হাড়ভাঙা খাটুনির সবটাই ভেস্তে যাবে, আর তুমি নিজেই একখান অনড় আপ্তবাক্যে বদ্ধ হয়ে পড়বে!
এ-পর্যন্ত শুনে একজন বললো : আমি বাজি ধরে বলতে পারি- এটিও একটি প্যারাবল।
প্রথমজনের উত্তর : তুমি জিতেছো।
দ্বিতীয় জন বলে : আফসোস- জিতেছো, কিন্তু তা-ও আপ্তবাক্যের ময়দানে।
প্রথম জন কহে : না, বাস্তব সত্য এই— প্যারাবলে তুমি হেরেছো।
ফ্রানৎস কাফকা : প্যারাবল নিয়ে।
মুজালি ফকির।। কেউ কোনদিন মুজালি ফকিরকে পরিপূর্ণভাবে হাসতে দেখে নি। হাসির কথা বললেই ফকির রহস্য করে একটুখানি হাসে, আর বলে, সব হাসি সেইদিনের জন্য তুইলা রাখচি; সে-দিনই হাসবো যেদিন আমার রাই-এর দেখা পামু।
অবশেষে মুজালিকে সবাই হাসতে দেখে।
মুজালি ফকির আরাম করে হাসে— যেদিন মরণ তার সামনে এসে দাঁড়ায়!
বদরুজ্জামান আলমগীর : মুজালি ফকির, দূরত্বের সুফিয়ানা।
নিজের সঙ্গে নিজের দেখা, সমাজের দেখা, রাষ্ট্রের দেখা, দুনিয়ার দেখা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দেখা। এভাবেই প্যারাবলে হয়তো ইতিহাসের ব্লাইন্ডস্পটগুলো ধরা পড়ে।
ভবাপাগলা নিজেকে দেখার জন্য নিজের থেকে সরে আসেন। নিজের জীবননদী দেখার জন্য নদী থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে তার প্রবাহটি দেখেন। কার্ল মার্কস শ্রেনীচ্যূতির ভিতর দিয়ে নিজেকে দেখার ও প্রাসঙ্গিক অবস্থান নেবার কথা-ই বলেন।
ইটালিয়ান প্রবাদ— খেলা শেষে রাজা ও সৈনিক একই বাক্সে যায় : যদি এই প্রবাদ অন্য একটি ঘটনার পরিণতি ও ফলাফল বর্ণনা করতে রূপকার্থে বলা হয় তাহলে সে হবে প্যারাবল।
জগতে আছে ভালো আর মন্দ, সাদা ও কালো, উত্তম এবং দুষ্টাচার- এই দুইয়ের মাঝামাঝি কিছু নাই।
ইতিহাস বলে, যেমন লুম্পেন সর্বহারা আছে, লুম্পেন বুর্জোয়াও আছে, সাধু আছে, সাধুবেশ ডাকাতও আছে। মনে হয় মুক্তিদাতা, কিন্তু আসলে আটককারী। এইগুলোর ফোকরে, জালিয়াতি, চালিয়াতি, খানেদজ্জালপনায়, বন্ধুত্বে, বিশ্বাসঘাতকতায় সামাজিক বোধে, মানুষের চৈতন্যে নির্জলা অঞ্চল জন্মায়— যা কখনও কখনও প্যারাবলের আকারে সূত্রাবদ্ধ হয়।
যে সত্যিকার গুরু সে কখনও আংশিক হয় না, সে সত্যের একপাশ বা কোন একটি পক্ষ নয়; তিনি সাধু ও গুনাহগার— দু’জনকেই একসঙ্গে বিচার করেন : লাও জু।
মন বলে, বাঙলায় কবিতা ও কথাসাহিত্যের মধ্যবর্তী একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে প্যারাবল, কী হতে পারে কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধের একান্নবর্তী টোলসত্র; হয়তো তা বয়ান করবে আমাদের হারিয়ে যাওয়া মহাকাব্যের স্মৃতি ও দর্শন। প্যারাবল গতকাল ও আগামীকালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস— আজ এখানে উপস্থিত নেই, আজ কেবল তার রন্ধনশালাটি আছে।
রসুইঘরে হয়তো তৈল সংকট আছে, কিন্তু নিয়ত গুণে বরকত হবে- এই আশায় একটি প্যারাবল রান্না করা হোক।
নয়া ঘড়া কানা কলস।। বাগানের বয়েসী মালী বেশ কতোকটা দূরের নদী থেকে জল তুলে পাট্টায় বাগানে নিয়ে আসে। ফুলগাছের গোড়ায় গোড়ায় জল ঢেলে দেয়— গাছেরা কলবলিয়ে ডাঙ্গর হয়ে ওঠে, গাছে গাছে নাকফুল, কানের দুল ফুলমঞ্জরি দোলে।
মালীর দুই জলতোলা গাগরীর মধ্যে একখান অতি পুরনো- এখানে ওখানে চিলতা উঠে গ্যাছে। অনেকগুলো ফুটো হয়ে আছে বলে পথে পথে পানি পড়ে যায়, বাগানে এসে পৌঁছার পর কানা কলসিতে জল প্রায় থাকেই না।
নিজের অকেজো ভাঙাচোরা দশা দেখে ফুটো কলস মালীকে বলে, আমাকে বরং ফেলে দাও ভাই, আমি তোমার দরকারি জল ধরে রাখতে পারি না।
মালী কেমন ভূতগ্রস্ততায় বলে, তার আগে চলো তোমাকে একটা জিনিস দেখিয়ে আনি। যেই কথা সেই কাজ, যে-পথে মালী প্রতিদিন জল বয়ে আনে, সেই পথে ভাঙা কলসীকে নিয়ে যায় মালী।
মালী বলে, দেখো পথের পাশে কত বুনো ফুল ফুটে আছে। তাই তো দেখছি । এ তোমারই কীর্তি! এই পথে জল নিয়ে যাবার সময় তোমার ছিদ্র দিয়ে রাস্তার ধারে জল গড়িয়ে পড়ে, তার ফলে এমন এক বেহেস্তি বাগান গড়ে ওঠে।
তোমার শরীর ভেঙে পড়েছে— কিন্তু তুমিই বানিয়েছো কী আচানক ফুল বাগিচা!
পাউলো কোয়েলহো : নয়া ঘড়া কানা কলস।
আলাপী মুসলমান কূলে জন্মনেওয়া কললড়া মেয়ে— তার একমাত্র ছেলে ১৫বছরের আব্দুস সোবান গঞ্জে গিয়েছিল রোজগার পাতি করতে, মাস যায়— বছর গড়ায় সোবান যে আর আসে না। সোবানের মা ট্রেনের দিকে চেয়েচেয়ে বিলাপ করে— সোবান, ও আমার নিমাই, নিমাই গো।
প্যারাবলের শ্রুতি অশ্রুতির ভিতর ধস ও আগুনের বাগান বাড়ি এসে পৌঁছালেই আমরা দেখতে পাই:
এমন অনেক আগুন আছে— ফুঁ দিলে নেভে— কোন কোন আগুন ফুঁ দিলে জ্বলে!
সময় আমাদের হাতে নেই, নেই হাতের বাইরেও, কেবল তা চাক্ষুষ ও মোলায়েম; কিন্তু কীভাবে তা মোকাবেলা করবো তার মীমাংসা আমাদের জানা নেই। ফলে আমরা এমনকরে ভাবি, বা ভাবতে প্রস্তুত থাকি— হাল জমানায় দুজন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে ফলপ্রসূ বোঝাবুঝির নাম কী— ভুল বোঝাবুঝি। আপাতত এভাবেই থাক— নিজের থেকে এক ঝটকায় সাপের নির্মোক ছাড়িয়ে নিই- শামুকের সিলগালা মুখে বালুর সঙ্গে মুখ ঘষে মুক্তার বাগানে এসে নামি।।