পাতার পাহাড়, রক্তবর্ণ হীম আর উষ্ণবয়সী ব্ল্যাকবোর্ড । পাপড়ি রহমান
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ৮:৫৪ অপরাহ্ণ, | ৩৪৮ বার পঠিত
পাতার পাহাড়
টিলার উপর থেকে রাবার বাগানটাকে একেবারে পাতার পাহাড়ের মতো দেখায়। রাবার প্ল্যান্টগুলোর পাতাই কেবল দৃশ্যমান হয় বলে প্রাথমিকভাবে আমাকে এই বিভ্রমের ভেতর পড়তে হয়েছিল। অবশ্য এই বিভ্রমের ভেতর নাস্তানাবুদ হওয়ার পূর্বে আমি ঝুক্কুর ঝুক্কুরের দূর্দান্ত স্বাদ পেয়েছিলাম। আদতে ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে যেনতেন প্রকারের স্বাধীনতা নয়। দীর্ঘকাল ফাটক বাসের পর এক্কেবারে গ্যাস বেলুনের মতো উড্ডিন হতে পারা। উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার মতো ঘটনাই ছিল সেটা। আমার আতংকবাদী বাবা ওই প্রথমবার আমাকে ঘরের বাইরে দুই পা ফেলতে দিলেন। আর আমার এই রকম গ্যাস বেলুন হয়ে ওড়ার সুযোগ ঘটলো রাজা কাক্কার কল্যাণে। রাজা কাক্কা মানে বাবার ফুপাতো ভাই। তদুপরি তিনি ফরেস্টার বা আরও উর্ধ্বতন কোনো পদে কর্মরত। বাবা তাকে মোটামুটি দেবতা জ্ঞান করেন। রাজা কাক্কার মেয়ে বিউটি আপা আমার চাইতে পাঁচ ক্লাস উঁচু। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যে কিনা আমারই ইশকুলে ভর্তি হলো। আর বিউটি আপার সাথে আমার খাতির জমলো দুধে ভেজানো চিতইয়ের মতো। যাতে কেবল চিৎ হয়ে ভেসে থাকা। উপুড় হওয়ার মতো কোনো ঘটনাই ঘটলো না কোনোদিন! রাজা কাক্কা আর বিউটি আপার ব্যাপক টানা-হেঁচড়ায় আমার আংকবাদী বাবার দিল সামান্য নরম হলো। কিন্তু বন্দুকটা রইলো আমার দিকে তাক করা। এই এক আরেক বিভ্রম! ভয় আর ভালোবাসা। দোস্তি আর ঘৃণা। আমি জানি তাক করে রাখা বন্দুকের নলটি অন্যত্র সরিয়ে নিলে বাবা একেবারে অন্য মানুষ। সদ্য জন্মানো শিশুর গায়ের পেলবতা সেই মানুষের মনে সেঁটে থাকে। অচেনা রূপ-গন্ধ-আশ্রয়। অথচ অহেতুক এই বন্দুক তাক করে রাখা — বাবাকে একেবারে আংতকবাদীতে পর্যবসিত করেছে।
একেবারে পরম পাওয়া এই ঝুক্কুর ঝুক্কুর! ট্রেন আমাকে নিয়ে ছুটলো ম্যালা দূর! ম্যালাদূর কতদূর? এইটা একটা প্রশ্ন বটে! ম্যালাদূর যে কতদুর তা মেপে বের করা মুশকিলের বিষয়।
ঝুক্কুর ঝুক্কুর করে ট্রেন গতি নিয়ে ছুটে চলে। আর গাছেদের-পাতাদের-গন্ধ আমার নাকে ঝাপটা মেরে যায়। আহ! কি করে বুঝাই যে সবুজের কি অদ্ভুত গন্ধ আছে? গাছেদের-পাতাদের গন্ধ কি মাতৃজঠরের গন্ধের মতো? আমি জানিনা। মাতৃজঠর মানে কি তাইতো আমি ভাল জানি না!
উথাল-পাতাল করা সবুজগন্ধে ভাসতে ভাসতে আমি ট্রেনের জানালায় মুখ রাখি। তখন দুই ধারে পাহাড়ের সারি-বনজ ঝোপ দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। যেন ওরা মেঘের বিদ্যুৎ। সামান্য ঝিলিক মেরেই অদৃশ্য হয়ে যায়। আমার দৃষ্টি পিছলে যায় লালমাটি আর দেবদারুর বনে। ভিনদেশী ত্বক নিয়ে ইউক্যালিপটাস। তেজপাতার ডাঁটো পাতার বৃক্ষরাজি! পাহাড় আর সমতলের আলোছায়ার ভেতর দুলতে দুলতে ট্রেন আমাকে সত্যি সত্যি যদুনাথপুরে পৌছে দেয়!
নেমে দেখি ফরেস্টের জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জিপে ওঠার পর চলন্ত জিপের পেছনের খোলা অংশে তাকিয়ে দেখি কোথায় সেই পাহাড়ের সারি? কোথায়ই বা রেল লাইন? সব হাওয়া হয়ে বিস্তীর্ণ সবুজ আমাদের ঘিরে রেখেছে! গাছেদের-পাতাদের এতটাই মেশামেশি যে কোনটা যে কি গাছ তাও আলাদা করা দূরহ। সেই নিবীড় বনরাজি, গাঢ় সবুজ গাছপালা আর পাখিদের বিচিত্র ডাক শুনতে শুনতে দেখি সেগুনের প্রায় গোলাকার-টাউস পাতারা আকাশচারি হয়ে আছে। ত্রিপল ঢাকা জিপের ভেতর সবুজ গন্ধ ভরে উঠলে আমি মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠি — একটা গাছ আমি অন্ততঃ চিনতে পেরেছি — সেগুন!
আহা! স্বাধীনতা! স্বাধীনতা সব সময়ই জীবনকে আনন্দময় করে দেয়। আমাকে যদি আর ফিরতে না হতো ওই মারধরের সংসারে! যেখানে এক নিষ্প্রভ বুদ্ধির মা তার তৈজসপত্রের মতো নিজের মেয়েটিকেও এক কোণে ফেলে রাখে — অযত্নে অবহেলায়!
যখন আমার অপু-দূর্গার মতো গ্রামময় এক ছেলেবেলা ছিল, তখন আমি সেগুনকে বেশ ভালই দেখভাল করতাম। কেউ তো আর জানেনা — বোশেখের ঝড়-বৃষ্টির পর সেই গাচের নিচে পড়ে থাকা ছিন্নপত্র ও গোটা গোটা ফল দেখার লোভে কতদিন আমি ছুটে গেছি। সেগুনের পাতা ডলে দুই হাত রাঙিয়ে তুলেছি। ওইসব খবর কেই-বা রাখে? ওই অপু-দূর্গার জীবনে কেইবা আমার গতিবিধির উপর কড়া নজরদারি করবে?
আমার আতংকবাদী বাবার খপ্পরে পড়ায় আগে গ্রামময়, বৃক্ষময়, বৃষ্টিময় — স্বাধীন এক ছোটকাল আমাকে মারাত্মক সুখী করেছিল!
আমার সেই ছোটকালেই সেগুন আমার সংগী হয়েছিল। সেগুনের ফুল ছিল হালকা ঘিয়ে রঙের। আকাশের তারার আকৃতির। সেই ফুল নাকের পাতায় বসালেই পড়ে যেত। আমি ফের বসাতাম।
এভাবেই দিনমান ফুলের উত্থান-পতন খেলায় মেতে থাকতাম। সেগুনের অনতিদূরে বাতাবিনেবুর গাছ। তাতে যখন ফুল ঝেপে আসত — আহা কি যে তাদের রূপ আর সুগন্ধ। আমাদের ছুটন্ত জিপের কোনো ধারেই বাতাবিনেবুর একটা গাছও নজরে এলো না!
শুধু গাছের গন্ধভরা, পাতার গন্ধভরা সবুজ হাওয়া কেটে কেটে আমাদের জিপ এগিয়ে চলল।
জিপ, থামল বেশ উচু একটা টিলার নিচে। নেমে দেখলাম সুদীর্ঘ সিঁড়ি টিলাটাকে দুই হাতে পেঁচিয়ে ম্যালাদূর উঠে গেছে। আমরাও আমাদের তল্পিতল্পাসহ উঠতে লাগলাম। যতই উপরে উঠতে লাগলাম চারপাশে সন্নিবিষ্ট সবুজপাতা ছাড়া আর কোনো দৃশ্য নাই! ওই প্রত্যন্ত পাহাড়িয়া অঞ্চলে বৃক্ষ আর আকাশ ছাড়া আর যেন কিছ্ইু নেই!
সিঁড়ি আর শেষ হয় না। উঠতে উঠতে হাঁপ ধরে যায়। জলতেষ্টায় কণ্ঠ কাঠ-কাঠ হয়ে উঠলে — রাজা কাক্কার সুবিশাল বাংলো।
টিলার উপরের ওই বাংলো থেকে চারপাশে তাকালে দুই-চারটা চ‚ড়া দেখতে পাওয়া যায়। ওইসব পাহাড়ি ছড়া বা ঝর্ণার জলে রোদ্দুর পড়ে রূপালি রঙের নহর বইয়ে দিচ্ছে।
এই যে একেবারে ছবির মতো সাজানো পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যাবলি — যা দেশে মনে হয় স্বর্গ কোনোভাবেই এর চাইতে উত্তম হতে পারে না। তবে সব চাইতে আনন্দের বিষয় এইখানে আমার আতংকবাদী বাবা নাই। তার কড়া শাসন আর প্রচণ্ড মারধরের উপদ্রব নাই।
আহা! স্বাধীনতা! স্বাধীনতা সব সময়ই জীবনকে আনন্দময় করে দেয়। আমাকে যদি আর ফিরতে না হতো ওই মারধরের সংসারে! যেখানে এক নিষ্প্রভ বুদ্ধির মা তার তৈজসপত্রের মতো নিজের মেয়েটিকেও এক কোণে ফেলে রাখে — অযত্নে অবহেলায়!
পরদিন ঘুম ভাঙতেই দেখি রোদ্দুর বাংলোটিকে স্পর্শ করে হেসে আছে! যেদিকে তাকাই সবুজের নানারূপে একেবারে ব্যারাছ্যারা অবস্থায় পৌছে যাই। আদতে এইসব হলো সিদ্ধান্তহীনতার ঘোর। কোন সবুজ যে আমার নয়ন জুড়িয়ে দেবে আর আমি সেদিকেই নির্ণিমেষ তাকিয়ে থাকবো!
বাংলো থেকে নিচে তাকালে পা শিরশির করে। বিস্তর সবুজের ভেতর আমার ঘূর্ণায়মান আঁখি হঠাৎ করে খুব কাছে এক রূপার নহরের সন্ধান পেয়ে যায়। সবুজ বনানীর মাঝখানটা চিরে যেন গলিত রূপার ধারা বইছে। আর ওই রূপালি স্রোত বহু নিম্ন সমতলভ‚মির ওপর সর্পিল গতিতে বয়ে চলেছে।
বাংলোতে দাঁড়িয়ে আমি ওই ঝর্ণার কল্লোল শুনছি! আহা! কে জানে মরণের পর স্বর্গ কেবন? কেউ তো ফিরে এসে বলে নাই স্বর্গের রূপ আসলেই কেমন?
কিন্তু আমি জানি এই, বন-বনানীর সবুজ আর নমিত ঝর্ণাধারার চাইতে স্বর্গ কিছুতেই উত্তম হতে পারে না।
রক্তবর্ণহীম
লোকালয় পেরিয়ে বহুদূরে বরমচালের রাবার বাগানটিতে যে সবুজরাজ্য গড়ে উঠেছে — তাতে হীমও যেন নামে একেবারে আপোষহীণভাবে। কারণ সূর্যের আলো ওই অরণ্যে বা বনানীতে ছিটকি পাতার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রবেশ করে। রাতভর উশ পড়ে পাতার উপর আর ওই উশ বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপটপিয়ে ঝরতেই থাকে। ভোরে ঘুম ভাঙলেই দেখি অপরূপ দৃশ্যাবলি। দূর্বাঘাসের উপর অজস্র ছোট ছোট হীরে যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে।
ঘুম ভাঙার পর ঝর্ণার থেকে তোলা জলে মুখ-হাত ধুয়ে নাস্তা খেতে হয়। প্রতিদিনের নাস্তার মেনু ঘরে তৈরি কাঁচা ছানা। হাতে বেলা রুটি। ছোলার হালুয়া। কোনো কোনো দিন গরম ভাত, ভর্তা। বাসী তরকারী। বাংলোতে কোনো পানি সাপ্লাইয়ের বন্দোবস্ত নাই। পানি আনতে হয় অনেক নিচুতে গিয়ে ঝর্ণা থেকে। সেই পানি রোদের বুকে ফেলে গরম করা হয়। এবং ওতেই চলে স্নান।
প্রায় বিকেলেই আমি আর বিউটি আপা হাঁটতে বেরোই। হাঁটবার জন্য আমাদের সুদীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। আমরা হাঁটি রাবার বাগানের ডানা ঘেষে। কখনো বা রাবার বাগানের ভেতর। গাছেদের আর পাতাদের ঝাঁজালো সবুজ গন্ধে আমাদের বুক ভরে ওঠে। তখনো হয়তো সূর্যাস্তের ঢের দেরি। কিন্তু চারপাশে কি রকম সবুজাভ অন্ধকার। বিউটি আপা বেশ ভারি ধরনের কার্ডিগান গায়ে চাপিয়ে হাঁটে। আমার সেরকম উষ্ণ কোনো শীতের কাপড় নেই। আমাকে পরতে হয় আমার আতংকবাদী বাবার খামখেয়ালীতে বানানো কোট স্টাইলের একটা জামা। সামান্য ভারি কাপড়টা — কিন্তু ভেতরে কোনো লাইননের বালাই নেই। ফলে যত শীত সবটাই ওতে হুড়হুড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারে। এবং ঢুকে পড়েও। আমি শীতের বিষাক্ত কামড়ে মরণাপন্ন হয়ে উঠলেও কাউকে কিছু বলিনা। আমার কোনো দীনতাই অন্যকে বলতে লজ্জা লাগে।
হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা বাঁ হাতের বুড়া আঙুল যখন পুরে চুষতে থাকে। এটা তার প্রিয়তর অভ্যাস। যখন আশে-পাশে কেউ না থাকে বিউটি আপা তার এই অভ্যাস বজায় রাখে।
এদিকে আমি বয়সে ছোট ও বিউটি আপার প্রিয় বলে এই কাজটি সে আমার সামনে হরহামেশাই করে। ওই রকম সবুজাভ অন্ধকারের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে বিউটি আপা একদিন বলে ওঠে —
— গণ্ডারের গন্ধ পাচ্ছি।
— কি! মানে কি?
—গণ্ডার নেমেছে পাহাড় থেকে। রয়েছে আমাদের কাছ থেকে সামান্য দূরেই।
— কি?
— হ্যাঁ, আমি গণ্ডারের গন্ধ চিনি।
শুনে ভয়ে আমার গায়ের লোম জারিয়ে যায়।
বন্য জীব-জন্তুও তাহলে রয়েছে এই অরণ্যে? ঘন জঙ্গল কেটে রাবার চাষ করা হয়েছে — মানুষদের কিছু ঘর-বাড়িও রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কিন্তু তা প্রায় না থাকার মতোই। তবুও একেবারে জন-মনুষ্যি নাই এমনতো নয়! এর মাঝে গণ্ডার কীভাবে আসে?
চিন্তা যত দ্রুতই করিনা কেন — ওই সূর্যের আলোহীন সবুজাভ বিকেলে কোনো কিছুকেই প্রতিরোধ হিসাবে দাঁড় করাতে পারি না। হয়তো আমার মতো বিউটি আপাও পারে না। আমরা জানি, সূর্য জঙ্গলের আড়ালে হারিয়ে গেলে চারপাশ কত দ্রুত ঘন অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে ওঠে। আর সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কতোটাই না ঝুঁকির। ভাবতে ভাবতেই শীত যেন হঠাৎ আমাদের আরো আচ্ছন্ন করে ফেলে! আমরা জানিনা — শীতের তীব্রতায় না গণ্ডারের ভয়ে আমাদের দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক শব্দ তুলতে থাকে। যদিও খুব মৃদু সে ধ্বনি। কিন্তু বিউটি আপা বা আমি দুজনেই সে ধ্বনি থামাতে পারি না। প্রায় দৌড়ে বাগান থেকে বেরিয়ে আসি। বিউটি আপা সাধ্যমত চেষ্টা করে আমার সঙ্গ ধরতে। কিন্তু আমি এত জোরে দৌড়াই যে মুহূর্তে রাবার বাগানের দীর্ঘকায় গাছগুলো দূর ছবির মতো অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিউটি আপা হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে দৌড়ের গতি বাড়ায়। আমরা যখন টিলার উপরে উঠি তখন ওই সবুজাভ অন্ধকার ঘন কালোতে রূপ নিয়েছে।
আমাদের ঘেমে নেয়ে ওঠা শরীর গরম কাপড়ের আড়ালেই থাকে। ঝর্ণার তোলা জলে মুখ-হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে প্রবল কাশির চোটে আমি একেবারে কাস্তের মতো বেঁকেচুরে যাই।
আমার মনে হয় প্রচণ্ড কে হিমখণ্ড আমার বুকের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ফলে বেদম কাশিতে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
বিউটি আপার আম্মা রসুন থেতো করে সর্ষের তেলে গরম করে আমার বুকে-পিঠে জোর মালিশ দেন। কিন্তু আমার কাশির উপশম হয় না।
বিউটি আপা তার টাউস টেনজিস্টারের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গান বাজায়। একেবারে লো ভলিয়্যুমে। আমি বলি—
—আরেকটু জোরে বাজান
— না, না আর জোরে না।
— কেন?
— মানুষ শুনলে মন্দ বলবে।
গান বাজালে মানুষ মন্দ বলবে? আমি এই রহস্যের কোনো কুল-কিনারা পাইনা। বিউটি আপাকে দেখি টেনজিস্টারের সাথে কান লাগিয়ে গান শোনে। ফলে আমাকেও কান লাগিয়ে গান শুনতে হয়। আমার কান ব্যথা করতে থাকে আর কাশিও বাড়তে থাকে।
এদিকে চাচীমা আমাকে প্রতিদিনই গোসল করতে বলেন। বলেন,
— গোসল কর, গোসল কর নইলে কফ বুকে শুকাইয়া যাইব।
আমি সূর্যের নিচে ফেলে রাখা কুসুম গরম পানিতে হররোজ গোসল করি।
বিকাল হলেই রাবার বাগানের ধারে বা ভেতরে বা ঘাসময় দীর্ঘ জমির উপর হাঁটতে থাকি। সঙ্গে বিউটি আপা। আমার পরনে আমার আতংকবাদী বাবার খামখেয়ালিতে বানানো সেই কোট। ভেতরে লাইলিন ছাড়া। ফলে পাহাড়-টিলা-অরণ্য-ঝর্ণার যত হীম সব আমার শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। আমার কাশির বেগ বাড়ে ঝর্ণার খুঁতখুঁতে জ্বরে আমি অবসন্ন হয়ে পড়তে থাকি।
ওই পাহাড়-অরণ্য-ঝর্ণা আর বিশুদ্ধ বাতাস, তাজা ছানা-হালুয়া-রুটি কিছুই আমার জ্বর কমাতে পারে না! এমনকি আমার কাশিও না।
আমার মনে হয় প্রচণ্ড কে হিমখণ্ড আমার বুকের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ফলে বেদম কাশিতে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
বিউটি আপার আম্মা রসুন থেতো করে সর্ষের তেলে গরম করে আমার বুকে-পিঠে জোর মালিশ দেন। কিন্তু আমার কাশির উপশম হয় না।
জ্বর-কাশি নিয়েই আমি রাবার বানানোর প্রক্রিয়া দেখি। কিভাবে রাবারের বৃক্ষ কাটা হয়? কিভাবে তাতে টিনের পাত্র পেতে দেয়া হয়? কিভাবে আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে সেই রাবারের মণ্ড তৈরি করা হয়।
এদিকে চাচীমার গরম সর্যের তেল আর রসুনের মালিশে আমি বিব্রত হতে থাকি। কারণ আমি দেখি আমার সমতল বুকে পক্ষী-শাবকের নরম রোঁয়া উঠেছে। ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন আমাকে সংকুচিত করে তুলছে!
ধুর! চাচীমা খামাখাই এত কষ্ট করছে। আমার কাশি তো কিছুতেই কমছে না!
এদিকে অরণ্য বা পাহাড়ের কোনো পরিবর্তন নাই। এমনকি ঝর্ণাধারাও। বাংলোর উপর থেকে তার জলপতনের শব্দ আমি শুনতে পাই। চাচীমার আরদালি-বেয়ারারা ওই জল টিনের পাত্রে ভরে উপরে উঠিয়ে নিয়ে আসে।
আহ! একেবারে বিশুদ্ধ জল!
এই পাহাড়ের হাওয়া বিশুদ্ধ। গাছতলা-বৃক্ষরাজি তাদেরও উদ্ভাসিত তারুণ্য।
আর আছে বান্দরের মেলা! প্রায়ই গাছ থেকে নেমে এসে তারা চাচীমার নানান কিছু নিয়ে পালিয়ে যায়! তাদের ধরার সাধ্য কারো নাই।
আর আছে পাখিদের বিচরণ। কত বর্ণ-গোত্রের পাখি! কত বিচিত্র তাদের কথাবার্থা! বিশাল-বিশাল রক্তচোষা! ভয়ে আমি একা কোথাও যাই না!
রক্তচোষা যদি আমার সব রক্ত চুষে নেয়া এই ভয়েই কিনা কে জানে আমার শরীরের রক্তকণারা জোট বাঁধে। অবশ্য আমি তা আদৌ বুঝতে পারি না।
আমি পুনরায় ত্রিপল ঢাকা জিপগাড়িতে চেপে বসি। বিউটি আপা স্বজল চোখে তাকিয়ে থাকে। চাচীমা বলেন —
‘ফের আইসো বাপ! ইশকুল ছুটি হইলেই আইসো।
আমার আংতকবাদী বাবা আমাকে নিতে এসেছে। ফের সেই ভয়াবহ কারাগার! ফের বন্দীজীবন! ফের বৃক্ষহীন নগর। বিষাক্ত হাওয়া। ট্রেন আমাকে হাওয়ার টানে উড়িয়ে নিতে থাকে। বরমচালের অরণ্যে আমি কত যে কাঠবিড়ালী দেখেছি! কত পাখি! আর তাদের গান!
কেন যে আমি মানুষ!
কাঠবেড়াল হলেও তো লুকিয়ে থাকতে পারতাম গাছের কোটরে।
দুই পাশের লালমাটির পাহাড় ফেলে ট্রেন কি ভিষণ জোরে ছুটে চলেছে!
পাতাদের সবুজ ঘ্রাণ হাওয়া থেকে ক্রমে হারিয়ে যেতে থাকে।
আমি কি তাকালেই দেখতে পাব ওই নিবীড় স্নেহচ্ছাময় সবুজ বনভ‚মি?
জানি — পাবো না।
ফেলে আসা কোনোকছিুই মানুষ কোনোদিন অক্ষত ফেরত পায়না!
উষ্ণবয়সী ব্ল্যাকবোর্ড
আমাদের বাগানের ঘাসগুলা কি অতটাই সবুঝ?
বিউটি আপার সাথে যে ঘাসে আমি হেঁটেছিলাম তাদের মতো?
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ঘাসেদের সবুজ হওয়া দেখি, কিন্তু কিছুতেই ওই সবুজের সাথে মেলাতে পারি না। আমাদের বাসার ভেতরে অরণ্যের ঘ্রাণ নেই — কেরোসিন তেলের ঘ্রাণ থইথই করে। মা ওই তেলে স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে। এদিকে তরল কাশির দমকে আমার শরীর আরো অনেক বেশি বেঁকেকুকে যায় — আমি কাশতে কাশতে দম নিতে পারিনা।
আমাদের সাদা গোলাপ গাছে বিস্তর কুঁড়ি এসেছে। কয়দিন পরই ফুল ফুটিয়ে গাছটিকে এরা ঢেকে দেবে। নানারঙের জিনিয়া আর গোলাপি — সাদা দোপাটি ফুলের সারি দেখতে দেখতে আমার পাহাড়ের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। গন্ডারের গন্ধ ভরা বিকেল। আমাদের ত্রাস আর দৌড়ানো শুরু করা। ওই গভীর নির্জন অরণ্যে — ওই সবুজাভ সন্ধ্যাবেলায় আমাদের ত্রাণকতারূপী কেউ ছিল না। ফলে আমাদের দৌড়াতে হয়েছে। বেদম দৌড় যাকে বলে।
আমি আমাদের বাগানের ঘাসেদের রকমসকম দেখতে দেখতে প্রচণ্ড কাশিতে ফের বাঁকাকুকা হয়ে যাই।
তরল লবণাক্ত কফ ফেলতে ফেলতে হঠাৎ চমকে উঠি। দেখি রক্তের মতো কি যেন ঘাসের ভেতর গড়িয়ে যাচ্ছে।
রক্ত!
সত্যিই রক্ত নাকি?
ফের কাশি ওঠে। ফেলতে ফেলতে ফের চমকাই।
রক্ত!
আহা! সেই যে হীমের বিকেল — পাহাড়ের সেই প্রচণ্ড হীম কি রক্তবর্ণ ধারণ করে আমার ফুসফুসের ভেতর বাসা বেঁধেছে!
তৃতীয়বারের কাশিতে ঘনরক্ত উঠে আসে।
আর বাগানের ঘাসে সেই রক্ত লাল ফড়িংয়ের মতো ঝুলে থাকে।
আমি আমার আতঙকবাদী বাবাকে ডাকি।
— বাবা কাশির সাথে রক্ত যাচ্ছে!
— কি বল? কই দেখি?
— বাগানের ঘাসে।
বাবাকে বলা হয় না ঘাসের উপর বসে থাকা লাল ফড়িংদের পিছু পিছু আমি কত সাবধানে পা ফেলেছি। দুই হাতে ডানা দুটো যেই ধরতে যাবো — হঠাৎ সে উড়ে গেছে! আর আমি সে দুঃখে প্রায়ই কেঁদে ফেলেছি।
আজ সেই লাল ফড়িংয়ের দল আমাদের বাগানের ঘাসের উপর স্থির বসে আছে। ভারি অদ্ভুত কাÐ তো!
বাগানের ঘাসে রক্তচিহ্ন দেখে বাবা ভয়ানক গম্ভীর হয়ে যায়!
আমাকে আর কিছুই বলে না।
এরপর থেকে আমার ইশকুল কামাই হতে লাগল। বিকেলের বেলার সাথীরা আমাদের বাসায় আসা ছেড়ে দিল।
আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্রমাগত কাশতে লাগলাম। রক্ত ঝরে ঝরে আমার ফুসফুস প্রায় শূণ্য হয়ে গেল। অবস্থা দেখে বাবা প্রায় উন্মাদগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। এ ডাক্তার, সে ডাক্তার — ছোট-বড় সব ডাক্তার জড়ো করে ফেললেন। ওষুদ-পথ্য-এক্সরে-জ্বর-চাদর এইসবের মাঝে আমার জীবন কি অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গেল!
আমি রাতভর কাশতাম। আমার বিছানার পাশে ছাই ভরতি বাসন দিয়েছে মা। যাতে বাতাসে জীবানু না ছড়ায়। ভোর হতে হতে রক্তে ভিজে সব ছাই দলা পাকিয়ে যেত!
আমিও অবাক হতাম — আমার এতটুকুন শরীরে কি করে এত রক্ত এলো?
এই যে অবিশ্রাম কাশছি — কাশির সাথে টকটকে তাজা রক্ত উঠে আসছে — তবুও কেন রক্ত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে না আমার শরীর থেকে?
সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার মনে পড়ে যেত ইশকুলের কথা। ক্লাস টিচার রাবেয়া খাতুন ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ি দিয়ে তারিখ লিখছেন। তাঁর দুধসাদা আঙুলে চকখড়ি ধরে রাখা। সরু সরু চমৎকার আঙুলগুলো চকের গুঁড়োড়ে মাখামাখি! রাবেয়া খাতুন, আমার খাতায় প্রায়ই লিখে দেন ‘ভালরাখা’।
‘ভাল রাখা’ মানে কি?
একদিন লিখলেন ‘রাখা’।
আমি বুঝলাম ‘ভালরাখা’ মানে গুড ধরণের কিছু হবে। আপার নাম আসলে রাখা-রাবেয়া খাতুন। রক্তের সমুদ্দুরে ভাসতে ভাসতে আমার শুধু ইশকুলের কথাই মনে পড়ে। খরস্্রোতা নদী পেরিয়ে আমার ইশকুল — আমার ক্লাসরুম আর সহপাঠিরা। এদিকে মাকে দেখি আমার খাবারের গ্লাস-প্লেট সব আলাদা করে দিয়েছে। আমার প্লেটে সে কাউকে খেতে দেয় না। অন্যদের প্লেট-গণ্ডাসে আমাকেও। এটা সে এতটাই চাতুরির সাথে করছে যে আমার আতংকবাদী বাবা টেরও পায়না।
আমার কি ভয়ংকর কোনো অসুখ করেছে?
নইলে মায়ের এত সাবধানতা কেন?
আমি একদিন খেতে বসে কেঁদে ফেলি!
বাবা চোখ লাল করে জানতে চায় —
— কি হইছে কান্দস কেন?
আমি বলি —
— আমার খাওয়ার প্লেট-গণ্ডাস মা আলাদা করে দিয়েছে।
— কোনটা তোর?
আমি আঙুল তুলে একটা লাল বর্ডারের প্লেট দেখিয়ে দিলে বাবা ওতে যেতে বসে যায়।
বাবার মুখ দেখি থমথম করে। দেখি বাবাও কাঁদছে।
আমার মনে হয়— আমার শরীরটা পাখির মতো হাল্কা হয়ে গেছে! এখন আমি যেন ইচ্ছে করলেই উড়ে যেতে পারি। উড়ে উড়ে বরমচালের রাবার বাগানে পৌঁছে যেতে পারি। ওইখানে যে ঝর্ণা বইছে, সে জল পান করে ফিরে আসতে পারি। অথবা ওই সবুজ বনভ‚মির প্রতিটি বৃক্ষের পাতায় পাতায় দোল খেতে পারি। ঠোঁট দিয়ে খুঁটে দিতে পারি পাতাদের শিরা-উপশিরা।
অথবা উড়তে উড়তে ওই অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলতে পারি। হয়তো তখন অন্ধকার ঘনায়মান। বানরের দল গাছের ডালে চুপটি করে বসে বসে অপেক্ষা করছে রাত্তিরের।
অন্ধকারের ভয়ে আমার পাখি-শরীরটা নিমিষে লুকিয়ে ফেলতে পারি পাতাদের আড়ালে, যাতে কেউ আমাকে আর খুঁজে না পায়। আমি অরণ্যের গন্ধের ভেতর, বিশুদ্ধ হাওয়ার ভেতর, ঝর্ণার জলের ভেতর একাকার হতে হতে ভুলে যেতে পারি সংসার কারাগার। যেখানে বাড়াবাড়ি শাসন, কড়া পড়ার চাপ, প্রচণ্ড মারধরে আমার ছোট্ট শরীরটা প্রায়ই নীলাভ হয়ে থাকে। সেই জখম চিহ্নের দিকে তাকিয়ে আমি সারারাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। একটা জখম না সারতেই আরেকটা জখমের চিহ্ন তীব্রভাবে শরীরে বসে যায়।
অবিরাম কাশি, রক্তপাত, ওষুধ, পথ্য, চাদর, বালিশ, বিছানার সঙ্গে আমার আতংকবাদী বাবা সেঁটে থাকে। আমার ভয়ানক অসুস্থ শরীরটাকে সারিয়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু আমি তো সেরে উঠতে চাইনা। সেরে উঠলেই আমার শরীরটা আর পাখি থাকবে না। ভারি শরীর নিয়ে আমি কি আর উড়তে পারবো? কিন্তু আমাকে যে উড়তেই হবে।
উড়ে উড়ে যেতে হবে ওই পাহাড়ে। ওই অরণ্যে। ওই অরণ্যে আমি ফের যেতে চাই — যে অরণ্যের হীম আমার ফুসফুস ঝাঁজরা করে দিয়েছে। আমার এই অসুস্থতা, প্রবল রক্তপাতময় শরীরটাকে আমি ওই অরণ্য ছাড়া আর কোথায়ই বা রাখতে পারব?
ওই অরণ্যের দিনগুলোতেই তো আমার সমতল বুকে ডিমের কুসুমের মতো কুঁড়িস্তন জেগে উঠেছে। ওই অরণ্যই আমাকে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে।
এখন এই ভাঙাচোরা, মৃতবৎ, ক্ষয়িষ্ণু শরীরটাকে নিয়ে আমি কোথায় আশ্রয় পাবো?
আমি জানি মানুষ ফিরিয়ে দিলেও অরণ্য কিছুতেই ফেরাবে না। ফেরাতে পারবে না। অরণ্যের ঠাঁই মানুষের জন্য চিরকালের!