মেট্রোরেল । মন্দিরা এষ
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:১৯ অপরাহ্ণ, | ৩৪৬ বার পঠিত
১.
“এমন যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়াবার মানে নেই কোনো। একে দ্রুত কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলে ভাল হতো। এর থেকে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবু তা করা যাচ্ছে না, কারণ যন্ত্রণাটির প্রতি তার এক ধরনের মায়া জন্মেছে। সেজন্য সে তার নিজের উপড়ও বিরক্ত। নিজেরই থাকা-খাওয়ার ঠিক নেই, এর মধ্যে এই যন্ত্রণা এসে কাঁধে চেপেছে। যত্তসব।”
কিবোর্ডে দ্রুত আঙুল চালিয়ে এ পর্যন্ত লিখে অনুপ্রভা মুখ তুলে তাকালো জানালার বাইরে। পাশের বাসার ছাদের ঝাঁকড়া সফেদা গাছটিতে একটি ছোট হলুদ পাখি এসে বসেছে। সে প্রায়ই আসে। খুব মিষ্টি করে সুর তুলে শিষ দিয়ে কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে চলে যায় আবার। কিরি কিরি, চিরি চিরি, ছিরি ছিরি, ঝিরি ঝিরি, এমন অদ্ভূত তার ভাষা। একদিন মাকে ডেকে সে পাখিটাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, মা এই পাখিটার নাম জানো?
মা জর্দা দেয়া পান চিবুতে চিবুতে বললো, কুনডা? দাড়া, চশমা নিয়া আসি।
মা চশমা পরে আসতে আসতে পাখি ফুড়ুৎ। এর বেশকিছু দিন পর আবার তার আগমণ। তবে এবার সে একা আসেনি, সঙ্গে আরেকজন আছে। সেও ব্যাপক উৎসাহে কিরি কিরি, ঝিরি ঝিরি ভাষায় তার সঙ্গীনির সঙ্গে গল্পগুজব করছে। সে সময় মা অনুপ্রভার পাশেই বিছানায় বসে একটা বই পড়ছিলো। বই থেকে মুখ না তুলেই বললো, ফটিক জল।
হঠাত এ কথায় অনুপ্রভা চমকে উঠে বললো, কি বললা?
- ফটিক জল। পাখিডার নাম।
- কোন পাখি?
- যেইডা ডাকতাছে। তুই একদিন জিগাইলি না? তখন তো আর ডাক শুনি নাই। তাই না দেইখা নাম কইতে পারি নাই।
- তুমি কিভাবে বুঝলা এইটাই সেই পাখি?
- বুঝছি। কারণ ঐদিনও তুই এই ভাবেই জালনা দিয়া তাকিতুকি করতেছিলি।
- ও।
অনুপ্রভা যখন লিখতে বসে তখন সে চায় না, তার ঘরে কেউ থাকুক। এ কথাটি তার মা খুব ভালো করেই জানে। তবু তিনি প্রায়ই অবসর সময়ে সন্তানের পাশে বসে থাকেন। কথা বলা নিষেধ থাকার কারণে শেলফ থেকে কোন বই নামিয়ে নিয়ে এসে পড়তে শুরু করেন। আশলে ভান। কারণ অনুপ্রভা লক্ষ্য করেছে। তার পাশে কিছুক্ষণ থাকার লোভে যেসব বই কিছুটা পড়ে তিনি বিছানার কোণেই নামিয়ে রেখে গেছেন, সেগুলোর একটাও আর দ্বিতীয়বার কখনও ধরে দেখেননি। অবশ্য অনুপ্রভা এমন ভাব করে যেনো সে ব্যাপারটি ধরতে পারেনি।
মা ছুটে গিয়ে ইফতিকে জড়িয়ে ধরলো। ইফতি কাঁদছে, তাকে থামানো যাচ্ছে না। ইফতির বোন মায়ের ভয়ে জোরেশোরে খাওয়া শুরু করেছে। আমরা দু’বোন হতভম্ব হয়ে প্লেট থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকলাম। ফজলু চাচা এখন সমানে চাচিকে বকে যাচ্ছেন।
মায়ের সাথে অনুপ্রভার এমন বেশকিছু অলিখিত বোঝাপড়া আছে যা অর্ণা জানে না। অর্ণা অনুপ্রভার ছোটবোন। বাসার সব থেকে ছোট সদস্য হলেও অর্ণার আচার আচরণ অভিভাবকদের মতো। সব সময় একটা মুরুব্বি মুরুব্বি ভাব নিয়ে থাকে। বাসার ছোট থেকে মাঝারি মানের যেকোন সিদ্ধান্ত সে-ই নেয়। তারা তাকে ভয় না পেলেও, মোটামুটি সমীহ করেই চলে।
২.
অর্ণা এসে দাঁড়িয়েছে অনুপ্রভার চেয়ার ঘেঁষে। অনুপ্রভা ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলো অর্ণার মুখ থমথমে। সে এখন সংসার জটিলতা বিষয়ক কোনো কথাই শুনতে আগ্রহী না। কারণ আজ রাতের মধ্যেই তাকে এই উপন্যাসটি রেডি করে প্রকাশককে মেইল করতে হবে। সে নিজে থেকে অর্ণার সাথে কোনো বাৎচিতে যাচ্ছে না দেখে অর্ণা নিজেই নীরবতা ভাঙলো।
—দাদা। অর্ণা শৈশব থকেই কোনো এক বিচিত্র কারণে অনুপ্রভাকে দাদা ডাকে। এই ডাক তাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি।
—হু।
—এই দাদা।
—শুনছি তো, বল।
—এই অত্যাচার তো আর সহ্য হচ্ছে না।
—কোন অত্যাচার?
—ফজলু চাচা আর কয়দিন থাকবে?
—তা আমি কিভাবে বলবো? তাকেই জিজ্ঞেস কর।
—পারবো না। আমি তো পড়তে পারছি না। সামনের সপ্তাহে একটা চাকরির পরীক্ষা আছে। সমন্বিত ব্যাংক এক্সাম। পরীক্ষাটা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুইতো বাসার কোনো কিছুতেই থাকিস না। সব ঝামেলা দেখতে হয় মা আর আমাকে। কেন? সব দ্বায়িত্ব কী আমাদের? তোর কোন দ্বায়িত্ব নেই? এই ফজলু চাচাকে তুই বিদায় করবি। তুই তাকে আর চাচিকে গিয়ে বল, মেট্রোরেল দেখতে এসেছিলেন, দেখেছেন। সেই ট্রেনে চেপে আগারগাঁও টু উত্তরা বেড়িয়ে এসেছেন। এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকাল ট্রেনে চড়ে নান্দিনা ফেরত যান, নিজের বাড়িতে।
—আচ্ছা।
—আচ্ছা মানে কি? বলবি কি না?
—বলবো। আগে লেখাটা শেষ করি। তুই আমার ঘরে এসে পড়লেই তো হয়।
—না, হয় না। তোর যেমন লেখার সময় ঘরে অন্যকেউ থাকলে তুই লিখতে পারিস না, আমিও তেমনি ঘরে লোকজন থাকলে পড়তে পারি না।
— আচ্ছা তুই এখন যা। আমাকে এটা আজ রাতেই নামিয়ে ফেলতে হবে।
— তুই এত স্বার্থপর কিভাবে হোলি? শুধু নিজের বুঝটাই বুঝিস। আশ্চর্য!
অর্ণা প্রচন্ড রাগ নিয়ে কথাগুলো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে সাথে সাথে ঘর থেকে চলে গেলো।
ফজলু চাচা তার স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে আজ এগার দিন হলো ঢাকায় এসেছেন। আব্বুর চাচাতো ভাই। গঞ্জের হাটে তার একটি বড় মুদি দোকান আছে আর জমির ফসল, পুকুরের মাছ, এসব বিক্রি করে খুব ভালো ভাবেই চলে যায় তাদের। আব্বু মারা যাবার পর যোগাযোগটা অনেকটাই কমে গিয়েছে। মাঝে দু’এক বার এসেছিলেন অবশ্য। সবটাই জমিজমা সংক্রান্ত ব্যাপারে মার সাথে কথা বলতে। তার কথাবার্তা অনেকটা এরকম, আব্বুর ভাগে আশলে খুব বেশি জমিজমা নেই, দাদাজান নাকি তার প্রায় সব জমিই আব্বুকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে বেচে দিয়েছিলেন। মাঝে খুচরা আলাপের মতো, বয়স তো কম হলো না, আমাদের দু’বোনের এখনও বিয়ে কেন দিচ্ছে না মা, এসব। এবার অবশ্য এসব প্রসঙ্গ কিছুই তুলছেন না। তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আজ চিড়িয়াখানা তো কাল জাদুঘর ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
৩.
অর্ণার পড়াশোনা এবং আমার লেখালেখির জন্য দুটি আলাদা ঘরের প্রয়োজন ছিলো অনেকদিন ধরেই। তাই শ্যাওড়াপাড়ার দুইরুমের ঘুপচি বাসা ছেড়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই তিন রুমের একটা বাসা নেবো। সংসার চলে আমার একার উপার্জনে। তাই মা আর অর্ণা সংসারের জমা-খরচের বহু হিসাব-নিকাশ করে কাজীপাড়ার এই বাসাটা নিয়েছে। বাসাটা আমারও পছন্দ হয়েছে। আজকাল ঢাকার আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়িতে দক্ষিণখোলা বড় টানা বারান্দা চোখে পড়ে না। এ বাসাটায় আছে। প্রচুর আলোবাতাস। আমার লেখার যায়গাটা সেট করেছি যে জানালা ঘেঁষে, তার সামনের ছাদবাগান ভর্তি নানারকম গাছগাছালি আর পাখির ডাক এক ধরনের গ্রাম গ্রাম ফিল তৈরি করে। আমার ভালো লাগে।
সমস্যা হলো যে মাসে আমরা বাসা পাল্টালাম, ঠিক তার দু’মাস পরেই মহাসমারোহে চালু হলো মেট্রোরেল। আমাদের বাসাটি মেইনরোডের প্রথম গলিতে হওয়ায় আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায় মেট্রোট্রেনের দিনমান হুশহাশ যাওয়া-আসা। প্রথম প্রথম মা কিশোরী মেয়েদের মতো দৌঁড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতো মেট্রোট্রেন দেখতে। একদিন অর্ণা মাকে নিয়ে ট্রেনে করে ঘুরিয়েও আনলো। আমাকে খুব টানাটানি করলো তারা। আমার খালি খালি কোনো কারণ ছাড়া শুধু মাত্র মেট্রোট্রেনে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হলো না। ট্রেনতো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। প্রয়োজনে ওঠা যাবে। এদিকে মা তার প্রায় সব কাছের আত্মীয় স্বজনকেই এই তথ্য ফোনে কথা বলতে বলতে দিয়ে দিলো, যে তার বাসার বারান্দা থেকে কয়েক গজ দূরেই মেট্রোট্রেন চলে।
পরেই মাসেই সেজোখালা খালুকে নিয়ে এলেন মেট্রোরেল দেখতে। মা খুব খুশি হয়ে তাদের নিজেই ঘুরিয়ে আনলো ট্রেনে করে। সে মাসেই খুলনা থেকে এলো পিন্টোভাই। আমার বড় খালার ছেলে। সে একা এলো না। তার সঙ্গে তার নতুন বউ এবং বার তেরো বছরের শ্যালিকা।
পিন্টোভাই মেট্রোট্রেনে ঘুরে এসে দারুণ উত্তেজিত। আমি তখন একটি স্ক্রিপ্ট এডিট করছি। দু’ঘন্টা পরেই শ্যুটিং। প্রোডিউসার বার বার কল দিয়ে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন, নাভিশ্বাস অবস্থা। এর মধ্যেই পিন্টোভাই একদম বিনা নোটিশে ঘরে এসে বিছানায় আধশোয়া হয়ে গল্প জুড়ে দিলো।
- কি করতেছিস?
- লিখছি।
- ও। এই পর্যন্ত তুই কয়বার চড়ছিস?
- কি?
- কি আবার! মেট্রোতে। আশ্চর্য ঘটনা। আগারগাঁও থেইকা উত্তরা য্যান চোখের পলক ফেলতেই গেলামগা। কী ঝকঝকা তকতকা ট্রেন, স্টেশন। বাঙ্গালী হইলো নিমক হারাম, বদমাইশ জাতি। সরকার যে এতোকিছু করতেছে, তার নাম নাই। খালি নাই নাই আর খাই খাই।
- হুম।
পিন্টোভাই সরকারি দলের লোক। তার সাথে কথা আগানো অর্থহীন। তাছাড়া এই মুহূর্তে সরকার বা রাষ্ট্র নিয়ে আমার মাথায় কিছু নেই। মাথায় অত্যন্ত বিরক্ত মুখ নিয়ে বসে আছে প্রোডিউসার।
৪.
এরপর, এমন চলতেই থাকলো। মামা, চাচা, খালা, ফুপু, গ্রাম সম্পর্কের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের ভিড় লেগেই আছে। আমাদের সংসার খচরের যা হিসাব-নিকাশ ছিলো, তা পুরোপুরি তছনছ হয়ে গেলো। আগে ব্যাপারটি এমন ছিলো যে তিন মা-মেয়ের সংসার মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই চলে যায়। কিন্তু গত দু’বছরে দ্রব্যমূল্যের লাগাম ছাড়া হাঁসফাঁস অবস্থা। নিজেদের টেকাটাই রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে বাসায় মেট্রোট্রেনের দর্শণার্থী আত্মীয়স্বজনের ঢল থামছেই না এতোদিনেও। তাছাড়া আমার লেখার পরিবেশ পাচ্ছি না, অর্ণাও পড়াশোনা করতে পারছে না। বিচ্ছিরি একটা অবস্থা। কিন্তু আমিই বা কী করতে পারি! বাসায় আসা গেস্টদের তো আর বলা যায় না, আপনারা চলে যান।
মা এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থমথমে গলায় আমাকে বলে গেলো, টেবিলে ভাত দিছি। আইসা খায়া আমারে উদ্ধার করো।
মায়ের মেজাজ এখন বেশিরভাগ সময়ই খারাপ থাকে। তাই আর তাকে না ঘাঁটিয়ে আমি খেতে চলে গেলাম। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। পাটশাক ভাজি, আম দিয়ে টক ডাল, মাছের তেলের বড়া আর রুই মাছের ঝোল। ডাইনিং টেবিলসহ সোফা মেঝে যে যেভাবে ইচ্ছে খেতে বসেছে। বিকট সাউন্ড দিয়ে টিভিতে বাংলা সিনেমা চলছে। এদিকে ফজলু চাচার ছেলে ইফতি খেতে বসছে না। তাকে সবাই সাধাসাধি করছে, কিন্তু সে খাবে না।
আমি টেবিলে এসে বসতেই ফজলু চাচা আমাকে বললো, বুঝলা ভাতিজি, তোমার ভাইডা হইছে বদের হাড্ডি। সে মাংস ছাড়া ভাত খাইতে পারে না। অর মায়ে এই অভ্যাস বানাইছে, একমাত্র পুলা তো। আমি কত কই, মাছ শাকশুক খাওয়া লাগে, এডি হইলো গিয়া ভিটামিন। শইলের জইন্য ভালো। আমার কথা শুনলে তো হইতোই।
আমি কোন জবাব না দিয়ে চুপচাপ খাচ্ছি। আমি জানি ফ্রিজে মাংস নেই। থাকার কথাও না।
এর মধ্যে হঠাত অর্ণা বলে ওঠে, চাচাজি কথায় কাজ হবে না। ইফতির মেডিসিন একটাই। টানা দুইদিন ওরে ভাত খাইতে না দিলেই দেখবেন একেবারে সুপারি গাছের মতো সোজা হয়ে গেছে। তখন যা দিবেন, তাই খাবে। এবার বাড়ি গিয়ে ট্রাই করে দেখেন।
ওর কথায় তাকিয়ে দেখি সবাই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। মা মুখ নিচু করে সবাইকে খাবার দিতে মনযোগী হয়ে গেলো। আমি কী বলবো বুঝতে না পেরে আবার খেতে শুরু করলাম।
এর মধ্যে কথা নেই বার্তা নেই, হঠাত চাচি প্রচন্ডবেগে ইফতির পিঠে ধড়াম করে এক কিল বসিয়ে দিয়ে চাপা গর্জন করে বলে উঠলেন, সব যাগায় নবাবী করস ক্যা তুই? সবাই তোর বাপ নি, যে প্রত্যেকদিন দিন পুতের লাইগা মুরগী বাজার কইরা আনবো। খা কইলাম। নাইলে তর কপালে আইজ কঠিন মাইর আছে। মাইর কিন্তুক একটাও মাডিত পরবো না।
মা ছুটে গিয়ে ইফতিকে জড়িয়ে ধরলো। ইফতি কাঁদছে, তাকে থামানো যাচ্ছে না। ইফতির বোন মায়ের ভয়ে জোরেশোরে খাওয়া শুরু করেছে। আমরা দু’বোন হতভম্ব হয়ে প্লেট থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকলাম। ফজলু চাচা এখন সমানে চাচিকে বকে যাচ্ছেন।
৫.
ফটিকজল দম্পতি সফেদা গাছে শুধু বাসাই বানায়নি, দুটি ছানাও ফুটিয়েছে। তাদের এই সংসার দেখলে অনুপ্রভার নিজের সংসারের কথা মনে পড়ে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে হলদে পাখির সংসার করা দেখতে দেখতে তার ঘুম চলে এলো। ঘুমের মাঝে সে স্বপ্নে দেখলো, একটি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সে পাখিদের মতো শিষ দিয়ে কাকে যেনো ডাকছে। তার চারদিকে ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়। তারই কোনো একটি থেকে অন্য আরেকজন কেউ একইভাবে শিষ বাজিয়ে উত্তর দিচ্ছে। প্রথমে সে একা থাকলেও ধীরে ধীরে আরো বেশকিছু মানুষ আশেপাশে দেখা গেলো, যারা সবাই শিষ দিয়েই কথাবার্তা বলছে। কী সুন্দর এই দৃশ্য! এটা কি ইরানের কুশকয় গ্রাম? যারা গত পাঁচশো বছর ধরে মানুষের মতো কথা বলার পরিবর্তে পাখিদের মতো শিষ দিয়ে কথা বলে। কিন্তু সে এখানে এলো কি কোরে! আশ্চর্য! একি! হঠাত কে যেনো তাকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দিতে চাচ্ছে।
- দাদা, এই দাদা। দাদা।
আমি চোখ মেলে দেখি অর্ণা হাত দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হাই তুলে পাশ ফিরলাম।
- কী হলো? শুনতে পাচ্ছিস না?
আমি পাশ ফিরে খুব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হইছে? দেখতেছিস না ঘুমাইতেছি?
- মা কাঁদতেছে।
- কেন!
- ফজলু চাচা বেগ ভর্তি বাজার করে নিয়ে এসেছে।
- খুব ভালো কথা। এতে কাঁদার কি আছে?
- তুই বুঝতে পারতেছিস না। এতে মায়ের ভীষণ অপমান লাগতেছে।
- কী মুশকিল! বাজার করার সাথে অপমান করার কী সম্পর্ক! বুঝলাম না।
- তুই কীরে? দিনদিনই এই রকম ভ্যাবদা হয়ে যাইতেছিস কেন? আশ্চর্য! তুই এক্ষুণি মায়ের কাছে যা।
- আচ্ছা যাচ্ছি।
দুপুরের ঘটনার পর বিকেলে ফজলু চাচা দু’কেজি গরুর মাংস, দু’টি মুরগীসহ আরও কি কি যেনো বাজার করে নিয়ে এলেন। এতে মা অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ফজলু, এগুলা কি আনছো?
- ভাবি, সামান্য বাজার করলাম আরকি। তেমন কিছু তো না।
- তুমি আমার মেহমান। আমার যা সামর্থ্য, আমি তোমারে তাই রাইন্ধ্যা খাওয়ামু। তুমি বাজার করবা ক্যান?
- তাতে কি হইছে ভাবি? আমি কি আমার ভাতিজিগো লাইগা সামান্য বাজার করতে পারি না?
- পারো। সেইটা তোমার ভাতিজিরা যখন নান্দিনা তোমার বাড়িতে বাড়াইতে যাইবো, তখন। এখন তুমি আমার মেহমান। এই বাজার কইরা তুমি আমারে অপমান করলা।
চাচা মায়ের কথার জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বাজারের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা ডাইনিং টেবিলের কোণা ধরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। বাচ্চারা দুটি চিপসের প্যাকেট নিয়ে মহানন্দে কচমচ শব্দ করে চিবুচ্ছে। আর চাচি সোফায় বসে হাই তুলতে তুলতে টিভি দেখে যাচ্ছেন। যেনো কিছুই হয়নি, তার স্বামীর এই কর্মকান্ডে তিনি দারুণ তৃপ্ত।
পিরিস্থিতি সামলাতে আমি গিয়ে চাচাকে বললাম, দেখি কি কি বাজার করলেন? আরে! এতো অনেককিছু! আচ্ছা। আজ আমাদের পিকনিক। আমি নিজে সবকিছু রান্না করবো। চাচা আপনি বলেন কি কি আইটেম রান্না হবে?
- তোমার যা রাঁনতে মন চায়। তুমি যা রাঁনবা, তাই আমি আগ্রহ নিয়া খামু।
মা আমার কথায় যেনো আরো হতাশ হয়ে পড়লো। আমার দিকে কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। মা এই মুহূর্তে আমার ব্যাপারে কি ভাবছে, তা আমি জানি। কিন্তু মা এটা জানে না কেন আমি এই কাজটি করতে যাচ্ছি। তাকে এখনই জানতে হবে, এমন কোন কথা নেই। তবে এটা নিশ্চিত মা খুব দ্রুতই জানবেন।
আমি মহাসমারোহে বহুদিন পর অনেককিছু রাঁধলাম। ফজলু চাচা আর তার পরিবার খুব তৃপ্তি নিয়ে প্রতিটি আইটেম খেলো। চাচা খেতে খেতে বললো, ভাতিজি, তোমার হাতের রান্না যে এতো স্বাদ হইবো, এইটা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই। তোমরা হইলা এই যুগের ভার্সিটি পাশ মর্ডান মাইয়া। রাঁনতে শিখলা কবে?
আমি মুখে হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
তিনি গলায় একটু হতাশা মিশিয়ে আবার বললেন, এতো সুন্দর যার হাতের রান্ধা, এতো শিক্ষা-দীক্ষা, তার ক্যান সংসার হইবো না। আশ্চর্য! অইযে একখান কথা আছে না? অতি বড় সুন্দরী না পায় বর, অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর। তোমার হইছে সেই দশা।
এই বলেই তিনি আবার খাবার খেতে মনযোগী হলেন। আমি বিস্মিত হলাম না তার এসব কথায়। তাই কিছু বললামও না। অর্ণা সাথে সাথেই চাচাকে কিছু বলতে যাবে বুঝতে পেরে তাকেও চোখ ইশারায় থামিয়ে দিলাম।
ফজলু চাচা তার পরিবার নিয়ে পরদিন ভোরের ট্রেনেই বাড়ি ফিরে গেলেন। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি মা ডাইনিং টেবিলে বসে চা খেতে খেতে ফেসবুকে মেট্রোট্রেন নিয়ে এ যাবৎ যত ছবি পোস্ট করেছিলো, সে সব ডিলিট করে যাচ্ছে একের পর এক।
—