সিঁম আর সাঁর্ত্রেঁ | হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২৪ অপরাহ্ণ, | ৩৬৮ বার পঠিত
বেড়াইতে আসছি গ্রামে। বৃষ্টির সিজন। ভাবছিলাম যখন তখন বৃষ্টি হবে। যখন তখন ভিজবো। কিন্তু এইরকম কিছু ঘটলো না এইবার। সকালবেলা। রাস্তায় হাঁটতেছি। মনে মনে বৃষ্টিরে ডাকতেছি।
ভাবী নাস্তা সাধছিলেন। খাইলাম না। বলছি, আগে ঘুইরা আসি। তারপরে খাবো। কোনদিকে যাবো? হাটের দিকে? হাটের দিকে গেলাম না। মাঠের দিকে গেলাম। ধান কাটা শেষ। মাঠভর্তি ছোট ছোট নাড়া। এই সময় বৃষ্টিতে খুব ফুটবল খেলতাম। কতদিন হইলো? অতীত ব্যথা দেয়।
হাঁটতেছিলাম আমি। আচমকা কিছু একটা খুব দ্রুত সভয়ে রাস্তা পার হইলো। একটা ইঁদুর। ছেলে ইঁদুর না মেয়ে ইঁদুর বুঝতে পারলাম না। ইঁদুরটা প্রায় উধাও হইয়া গেছিলো। আমি ডাক দিলাম, শুনতেছেন?
তার ছোট কোঁচকানো মুখটা দেখা গেল। জবাব দিলো— আঁমাঁরেঁ ডাকঁছেনঁ?
—জ্বি আপনেরে। আমি শহর থেইকা আসছি। কথা বলার লোক পাইতেছি না কাছে।
—আঁমাঁর সাঁথেঁ কঁথাঁ বলঁবেনঁ?
—জ্বি। আপনে ব্যস্ত না হইলে।
ইঁদুরটা আস্তে আস্তে রাস্তার দিকে উইঠা আসতে লাগলো। আমার কাছে না আইসা একটু দূরত্ব রাখলো। তারপর জিজ্ঞাস করলো— কীঁ বলঁবেনঁ, বঁলেনঁ। একঁটুঁ ব্যঁস্তঁ আঁছিঁ।
আমি ইঁদুরের নাম জিজ্ঞাস করলাম। সে বললো— সিঁম। সিঁমনঁ দ্যঁ ব্যুঁভোঁয়াঁ।
আমি ফের জিজ্ঞাস করলাম— কিছু মনে কইরেন না। আপনে তাইলে একটা মেয়ে।
—আঁপনারঁ লঁজ্জাঁ পাঁওয়াঁ উঁচিতঁ।
—সরি।
সে একটা মেয়ে ইঁদুর, এইটা আমি ধরতে পারি নাই। তাই আমারে তিরস্কার করলো। কিন্তু কোথাও গেল না। আমাদের কথা আগাইতে লাগলো। সিঁম আমার পাশের বাড়িতে থাকে। পাশের বাড়িতে মাস্টারনি থাকে। মাস্টারনির একটা ছেলে, একটা মেয়ে। মাস্টারনির নাম আফরিন। একসময় তার লগে আমার বিয়ের কথা হইছিল। বিয়ে না কইরা পালাইয়া গেছিলাম। সিঁম জানতে চাইলো, কেন? বললাম— জানি না। মনে হয়, আমার সাহস কম।
সিঁম আরেকবার তিরস্কার করলো আমারে। সে তার প্রেমিকের কথা বলতে লাগলো। সিঁম কাঁদতে লাগলো। তারা একসাথে থাকতো। ধানের গোলা থেইকা একটু দূরে। গর্তে। তার প্রেমিকের নাম সাঁর্ত্রেঁ। সে এক বেপরোয়া প্রেমিক ছিল। যখন তখন গর্ত থেইকা বের হইতো। গৃহস্থ বাড়ির লোকজনরে বিরক্ত করতো। একদিন আচমকা একটা কাঠের পিঁড়ি সাঁর্ত্রেঁর মাথায় আইসা পড়লো। স্পট ডেড। সিঁম দূর থেইকা তার প্রেমিকেরে দেখতেছিল। কাঁদতেছিল সিঁম। বেপরোয়া প্রেমিক একটুও নড়তেছিল না। বেপরোয়া প্রেমিক নড়লো না আর।
আমি জিজ্ঞাস করলাম সিঁম, এখন আমি কোথায় যাইতে পারি?
— আপঁনারঁ যেঁদিঁকেঁ খুঁশিঁ।
—তোমার গর্তে আমারে থাকতে দিবা, সিঁম?
আমি কৌশলে ওরে ‘তুমি’ ডাকলাম।
— কেঁনঁ?
—জানি না। আমি কোথাও হারাইয়া যাইতে চাই, সিঁম।
—আঁমাঁর গঁর্তঁ কিঁ হাঁরাঁনোরঁ জায়ঁগাঁ?
—না।
—তাঁহঁলেঁ?
—আমি গর্তের ভিতর থাকবো।
—ঠিঁক আঁছেঁ থাকঁবাঁ। আঁমাঁরেঁ জ্বাঁলাঁবাঁ নাঁ কিঁন্তুঁ।
—আমি তোমারে জ্বালাবো না, সিঁম।
সিঁমও আমারে ‘তুমি’ ডাকলো। আমি তার পিছে পিছে গর্তের ভিতর যাইতে থাকলাম। সে একটা গান ধরলো। তার বেপরোয়া প্রেমিক সাঁত্রেঁরে নিয়া। সাঁর্ত্রেঁ আর ফিইরা আসবে না। এইটা এমন এক দুঃখ যা সিঁমের সমস্ত নিঃসঙ্গতার তুলনায় একটা চালের মত ছোট!
সিঁমের গর্তে একসাথে থাকতে শুরু করলাম আমরা। গর্তের ভিতর খুব অন্ধকার। সিঁমের ছলছল চোখ দুইটা সেইখানে আলোর মত জ্বলে। গর্তের ভিতর থাকতে থাকতে আমার মধ্যে একধরণের পরিবর্তন দেখতে পাইলাম। যেমন গর্ত থেইকা মোটেও বের হইতে ইচ্ছা করে না আমার। আমি গর্তের ভিতর থাকি। অন্ধকারে। স্যাঁতসেঁতে মাটির ভিতর।
এইভাবে আমি বাইরের কথা ভুইলা যাইতে শুরু করলাম। আম্মার মুখ, আব্বার মুখ ঝাপসা হইয়া আসতে লাগলো। বৃষ্টিরে অসহ্য লাগা শুরু হইলো। বৃষ্টিতে গর্ত ভিইজা যায়। ভাল লাগে না। আমার আর সিঁমরে তখন নতুন গর্ত খুঁড়তে হয়। গর্ত খুঁড়তে অসহ্য লাগে আমার। সিঁম দিনে বা রাতে একবার বাইরে যাইতো। গোলা থেইকা ধান নিয়া আসতো। আমি ধানের খোসা ছাড়াইতাম। সিঁম বইসা বইসা দেখতো। মাঝে মাঝে আমারে গর্তের বাইরে গিয়া একটু ঘুইরা আসতে বলতো। আমি তারে না করতাম। সে হাইসা দিত। তার হাসি আমার মন খারাপ কইরা দিত।
সিঁম একদিন বাইরে গেল। ফিইরা আসতে খুব লেইট হইতেছিল। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। সিঁম ফিরলো না তবু!
আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছা হইলো। ঠিক করলাম, তারে খুঁজতে বাইরে যাবো। গর্ত থেইকা বের হইলাম। গোলার দিকে গেলাম। গোলার নিচে হাঁস মুরগীর ঘর। সন্ধ্যায় হাঁস মুরগীসব ঘরে ফিরতে লাগলো। আমি সাবধান হইলাম। নারকেল গাছের আড়াল থেইকা আস্তে কইরা ডাকলাম— সিঁম, কইঁ তুঁমিঁ?
কোন জবাব পাইলাম না। বুকটা কাঁইপা উঠলো। আমি ফের ডাকলাম- সিঁম, ঘঁরেঁ আসঁবাঁ নাঁ? প্লিঁজ, ঘঁরেঁ ফিইঁরাঁ আঁসোঁ।
আমি মাঠের দিকে গেলাম। অন্ধকার। আকাশে চাঁদ উঠছে। চাঁদ দেইখা অসহ্য লাগলো। মাঠে নতুন ধানের গাছ। আমি আইলে আইলে দৌড়াইতে লাগলাম। চিৎকার কইরা ডাকতে লাগলাম— সিঁম, তুঁমিঁ কইঁ? আঁমাঁর একঁলাঁ ভাঁলঁ লাগঁতেঁছেঁ নাঁ, সিঁম। প্লিঁজ, ফিইঁরাঁ আঁসোঁ… সিঁম।
বড় অসহায় লাগতেছিল। ক্লান্তিতে, হতাশায়, দুঃখে ভিজা একটা আইলের উপর শুইয়া গেলাম আমি। হুহু কইরা কাঁদতে লাগলাম। একটা অপরিচিত শূন্যস্থান বহুদিন পরে ফের আমারে দখল করতে শুরু করলো। মনে হইতেছিল, চাঁদের নিচে কড়া এক অন্ধকারে আমার সব নিঃশ্বাস জইমা যাইতেছে। ভাঙ্গা গলায় সিঁমরে ডাকতেছিলাম আমি। আমার সিঁম ফিরলো না তবু।