A-mor বা অ-মর বা অমৃত । আলী আফজাল খান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:২২ অপরাহ্ণ, | ৮২৭ বার পঠিত
প্রজ্ঞাপারমিতা বৃঃ
হোমারের বাড়িঘর বলতে কিছুই ছিল না
আর দান্তেকে গৃহী হওয়া সত্ত্বেও গৃহ পরিহার করতে হয়েছিল।
— কবির দেশান্তর, বের্টোল্ট ব্র্রেশট
গঙ্গা থেকে পদ্মা, পদ্মা থেকে মেঘনার মোহনায় বিসর্জন
— এই তো উড়াল জলের, ফিরে আসে মেঘ হয়ে বজ্রযানীর চোখে
ইমনসন্ধ্যায় চুল্লিতে প্রিয়ঙ্গুশাখা আর কাকডুমুর ডালের সুগন্ধে যে মাধব চিতায় সমর্পণ
কালঘুমে ক্যাথার্সিস, স্বর্গীয় আগুন আধান করে চৈতন্য-দিব্য অমরতা
কাকে বলো ভস্মগর্ভা? তোমার দিন কাটবে তাকে নিয়েই তুলসীতলায়
আধৃত মাধবীলতা হাতে অনন্তের দরবারে যজ্ঞের উপবীত
কড়ি সঞ্চায়িত দোলায় মৃত্যুজয় বোধিসত্ত্ব
একাধারে তিনি এখন গৃহী ও অতিথি
পুনরাবর্তনময় ভঙ্গি ও বিন্যাস চিন্ময় শক্তি
শালপাতার আগুন ভরা করপুট তারা
জন্মদাগ-রক্তের ভেতর জবাফুল
মাথার ভেতর দাঁড় বায় দিব্যদেহ
নাভির ভেতর বাবার রোদ ঢুকে পড়ে
ভূমিচক্রের টোটেম ও কৌমজীবন
বাড়ির আউতায় স্মৃতিরাস, আমআঁটির ভেপু
মাকড়শার জাল বুনে আলোছায়াময় আত্মকথন
যেন ওলান থেকে বীজমন্ত্র আজলকাজল মায়ামদির শূন্যতা এবং করুণা
দেহেই তোমার মহৎ মার্গ বজ্র মোহিনী
‘ওম মনিপদ্মে হূম
আহা, মনিই প্রকৃত পদ্ম’
বোধিচিত্তের পরমানন্দ রথ সহজ
‘এস জপহোমে মন্ডল কম্মে
অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধম্মে।
তো বিনু তরুণি নিরন্তর ণেহে
বোধি কি লব ভই প্রণ বি দেঁহে। ’
ব্রহ্মের জন্ম মূলত ঘোষণা করে
জন্ম যেমন মরণও তেমনি শূন্যচিত্ত
ভাষাই মানুষের একমাত্র আবাসন
তাই শ্মশানের অন্যনাম পিতৃবন
সিরাজ সরা চকোরী
রাতের কণ্ঠা ধরে শিরার মতো শব্দে ব্রাহ্মী খরজিভ থেকে মহাকাল বলে ফেলল অকস্মাৎ
—আর তো ফেরা যায় না অনন্ত!
হাত আলগা হয়ে খুলে আসা আউলবাউলের দিলচকোরী হে সখিন, দেখো আরো ত লোক আছে ঋতুদেহে দ্রবীভূত, মাঠের পাকা হলুদ খুলে লাগিয়ে দেয় যারা খিন্ন, শিশির ঝেড়ে পুরাতন করে ফেলে একা প্রান্তরের শোক গিলাহ।
গলার বাক্সে বর্ষা বসেছে বেদম। সে জল অন্তর্বাহিনী হোক যার ধর্মনাম লাভা। ব্রহ্মাণীবর্ষ জুড়ে আলোর শলা, রুহ রুহ নামে বৃষ্টির শরীর বুঝে মাটিতে গেঁথে গেল সেই ফলা ফালা বিদ্যুৎ, পুনর্বয়ব।ফিঙেরা আচ্ছন্ন ঘিরে রাখে উক্ত আঁচ, দাঁতের শ্বাপদ কামড়ে কামড়ে ছেনে আসে শস্যবতী শরীর।
আত্মার বন্দিশে হা হা উথাল হাওয়া পাক খাচ্ছে, চিঁড়েকোটা আওয়াজ কাটছে কেউ আর বার বার কিসের দমফাটা আকুতি যেন ঘনিয়ে আসে শিরাস্নায়ু কাঁপিয়ে।কতখানি দূরবর্তী হবে তুমি তাদের আত্মীয়া? তোমার আত্মার গোলাপে অঙ্কিত হয়না একটিও ঘুঘু পাখির ডাগর! এমন কি চরাচর যার কাশের বনে পালক ফুরায় না এহেন অঘ্রাণে, হিমবুক ঝরে মরে অপার ধোঁয়াশ অলক্ষ্য তিতির…
বেতসলতার মতো, তারপর আরো নি:শর্ত নমন, তারপর মস্তিষ্কের খাঁজে বসিয়ে দিচ্ছে এমন যে কোষগুলো নড়াচড়া করার আগেই শুধোচ্ছে, “তর্পণে বসলো?” প্রশ্ন স্বর বদলে অথচ বেরোচ্ছে পূর্বজগৃহ থেকে এভাবে, “অনন্ত শূন্যতা, মায়া ডাকে?”
সাদা কাগজের আতঙ্কী গুটিয়ে আসে একলব্যের শিহরে, স্বাক্ষরহীন অস্থির মহাকাব্যে। কাঁড়বাঁশের গন্ধে বিভোর বনজ অর্জুনেরা ছিলাটান উপড়ায় । পিলচু হাড়াম বাধ্যত দ্রোণ কেউ, মানব মাংসের বিকল্প রাখেনি এযাবৎ কোন বিবর্তন। উত্তরাধিকার অগ্নির ধর্ম খুঁজে নেয়। দিন গত হলে সবারই সন্ধ্যা এক; তারারন্ধ্রে খুব ঘষে আসে তাবৎ ভাষাবিদের মুনশিয়ানায় আশ্চর্য সরোদ ।
রাত, প্রকৃত প্রস্তাবে মন্বন্তর সাজিয়ে রাখে নশ্বর বুভুক্ষু স্নায়ুদের পাতে, বালি পড়ে এলে এক পূর্ণ আওয়ারগ্লাস। শরতের তেতো চাঁদ- মুখোমুখি যেটুকু গলে আসে গলায়, শবনম অথবা গন্তব্যশরাব…
A-mor বা অ-মর বা অমৃত
দুই বল্লে তুমি আমি, দুই বল্লে স্তন
তিনের সাথে জাহাজ আর সাগরের শিহরণ
৪ আর ভাল্লাগেনা, ক্রমশ: হারায়া ৫, ৬, ৭-এ
তোমার নাম উচ্চারণ করি জাদুর রাতে
যখন ব্ল্যাকহোল আসে জোছনা পান করতে
এবং ছাতিম ফুলের সুবাস ছড়াবার আগে
এবং আমি শূন্যতা অনুভব করি আবেগ এবং সঙ্গীতের
পাগলাটে ঘড়ি যেন গান গায় পুরানো ঘন্টার আগে
অন্তর বাসে যে আসন নিলো আদিত্য স্বাক্ষরহীন,
সে কি অন্তর্বাসের টান দাগ?
হেমন্ত অক্ষর খুজে নবান্ন উৎসব,
হাঁপটানে কই কেশরীর নখর?
একমাত্র মানুষ যাদের প্রতি আমি আগ্রহী তারা হল পাগল: বাঁচার জন্য পাগল, কথা বলার জন্য পাগল, বাঁচানোর জন্য পাগল, সবকিছু একই সময়ে চাই যার। জানি যারা অপেক্ষা করে তাদের জন্য সময় খুব ধীর, যারা ভয় পায় তাদের জন্য খুব দ্রুত, যারা অনুশোচনা করে তাদের জন্য খুব দীর্ঘ, যারা উদযাপন করে তাদের জন্য খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু যারা ভালবাসে তাদের জন্য সময় অনন্তকাল।
ভালবাসা তো খোঁপার সুবাস
তুমি গোলাপ দেখতে পারো,
কিন্তু সুগন্ধি দেখতে পারো না
আকাঙ্ক্ষা একটি প্রশ্ন
যার কোনো উত্তর নেই
একটি পাতা যার শাখা নেই এবং
এমন একটি পৃথিবী যার স্বর্গ নেই
আমরা এমন একটা প্যাকেজিং সংস্কৃতির পৃথিবীতে বাস করি যেখানে মৃতের চেয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, প্রেমের চেয়ে বিবাহ এবং বুদ্ধির চেয়ে শরীর বেশি গুরুত্বপূর্ন। যদিও ইরোটিজম নিজের জ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি, কবিতার মতো অপরিহার্য। বলছো বার বার গোলাপের জন্য দেরী হয়ে যাচ্ছে, আর শীতের জন্য তাত্তারি। স্তনের কাছে গেলে ছাতিমের গন্ধ লাগে, বুঝি শীত আসছে।
আনন্দ ঘুমিয়ে যায়
দুঃখ জেগে থাকে
ভালবাসা ছাড়া আর কে আছে
সারা রাত জেগে থাকে প্রার্থনায়
‘When I said forever, I meant it’
তবু চাদরে ভেসে ওঠে যতিচিহ্নের অনুপস্থিতি
পাথর ঘামে শিশিরে, শ্রী মুকুল পাথরকুচি
[কীভাবে একটি শব্দ দেশকালের সীমানা পেরিয়ে যায় তা আজও রহস্য।ভাবনায় ভাবনায় ঘর্ষণে আগুন জ্বলে ওঠে নাকি আমরা প্রত্যেকেই বহন করছি একটিই আদি বীজ! আমোর(Amor) শব্দটি দান্তের ‘ভিতা নুওভা’র ভরকেন্দ্র। প্রেম বা প্রেমের দেবতার অনুষঙ্গে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে শতাধিকবার।
সংস্কৃত Dipaka শব্দটি কখনও লেখা হয় Dipuc। Dipuc উলটে এবং শেষে ‘o’ যোগ করে লাতিন প্রমের দেবতা Cupido। মূল শব্দটিরও একটি অর্থ প্রেমের দেবতা। কামদেবের একটি নাম রম(Rama)। Rama শব্দটি উলটে ‘a’র স্থানে ‘o’ বসালে হয় Amor।
অবশ্য প্রাচীন লাতিনে শব্দটি Amor নয় Amar। পুরাণ ও ব্রাহ্মণে কামদেবের যে বর্ণনা পাই তার সঙ্গে দান্তের প্রেমের দেবতা Amor-এর অদ্ভুত মিল। আমরা Amor শব্দটিতে আরও একটি মাত্রা যোগ করতে পারি। A-mor বা অ-মর বা অমৃত।
আসলে বেয়াত্রিচে নয়, যিশুখ্রিস্ট নয়, প্রেম নয়, প্রেমের দেবতাও নয়, দান্তে তো আজীবন এই অমৃতের সন্ধানই করেছেন। আর বেদের কবিদের মতো অমৃতকে কে আর সংজ্ঞাত করেছেন।
অমৃত-র অর্থ: “মৃত্যুহীন অন্তহীন ছেদহীন ভেদহীন চরাচরজোড়া বিপুল প্রাণের প্লাবনে একাকার হয়ে মিশে যাওয়ার মিশে থাকার বিস্মিত নন্দিত পুলকিত স্নিগ্ধ প্রশান্ত অনুভূতি।”]
মেঘ না’র স্রোত
পদ্মা যমুনার দুই বেনীর স্রোত
মেঘনার বুকে যেন শান্তির চর
সুরমার মেঘ এতটা পেলব
চিবুক তুলে যেন দুর্গা, দুর্গা
জালে তুলা তাজা মাছের খলবল
—এ মাছের তরকারীর ঝাল খেয়ে জিভে শিস নিলে দোয়েলের ঘুম ভেঙে যায় মধ্যরাত্রে
—জানি, আমার ব্রহ্মান্ড কাঁপতেছে তোমার চৌম্বকক্ষেত্রে পড়ে
—তোমার বুকে স্রোতের শব্দ গো
—একটা কার্ডিওগ্রাফ এঁকে দেই হাতে?
—উহুঁ, আমার চোখে সুরমা আছে উজল
—অমন হাঁ করে কি দেখছ নক্ষত্রশিশু?
চিবুক তুলে চাইল আলাপী ধলেশ্বরী
স্বল্প ফুঁড়ে অস্তিত্বে অর্ধরমণে ‘ঘুনে ধরছে কাঞ্চা খড়ি, মনে লয় সেই বিষের বড়ি খাইয়া মরি নাইলে লাগাই বুকে ছুরি’- এমন লুঠতরাজ। জলেশ্বরীর বুকে স্রোত, আমাদের কাম জোয়ারের মধু, ওলট আর পালট হয় অস্পষ্টের ঋতুদেহ, পদ্মা আর যমুনার ঘূর্ণি পটিয়সীর নকশার তাস ব্ল্যাকহোলের মতো আবর্তে পড়ে একের পর এক ঝড়
বিষে অঙ্গ জর জর, লহর বুনে চোখে ঘোর
ঘোরের চোখে মেঘ, হা হা উথাল হাওয়ার পাক
বাঘনখে মেঘের কালো গর্ভ চিরে এসে দাঁড়িয়েছে দৌর্দণ্ডপ্রতাপ
কিসের দমফাটা আকুতি যেন ঘনিয়ে আসে শিরাস্নায়ু কাঁপিয়ে
আমার এমন লাগে কেন?
জিয়ন্তে হইলাম মরা, বিভাষায় কোন এক জ্যান্ত বলে যাকে
তুমি না থাকলে শরীরে থাকে না পানি,
চৈত্র্যের শুকনা মাঠে কেমনে থাকি আমি?
দাঁতের শ্বাপদ কামড়ে কামড়ে ছেনে আসে শস্যবতী শরীর
দড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নদীর জল নিংড়ে
গোপন জামায় আলীরে রাখো গুঁজে আয়ুভর।
উচ্চতা
ঠিক পিছনেই মানুষ প্রাণীর সবুজ বন
দীর্ঘ
দীর্ঘ রনাঙ্গণ
সারাটা জীবন দৌড়ে পার হয়ে এলাম পাহাড়ে
ঠিক সামনে তিন হাজার ফুট গিরিখাঁদ
তারপর মাটি অথবা মাংসের কবর
ভাবছি প্রকৃতির কাছে থেকে যাবো
আকাশে উড়লেই শূন্যতা
আকাশে উড়লেই বাতাস
শূন্য থেকে মাটিতে তিন হাজার ফুট উচ্চতার জীবন
বড় হতে হতে যে উচ্চতা ছুঁতে পারিনি আজও
আমার কি সাধ হয় না তা ছোঁয়ার?