দুই শিল্পীর জীবনকথা । আলম খোরশেদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ, | ৪৭৩ বার পঠিত
বিক্তর: অ্যান আনফিনিশ্ড সং: জোয়ান হারা
দক্ষিণ আমেরিকার সর্বদক্ষিণ দেশ চিলের প্রসঙ্গ উঠলে অন্তত দুজন কিংবদন্তিতুল্য মানুষের নাম অনেকেরই মনে পড়বে, নিহত প্রেসিডেন্ট সমাজতন্ত্রী সালবাদর আয়েন্দে ও নোবেলবিজয়ী কম্যুনিস্ট কবি পাবলো নেরুদা। সেইসঙ্গে তৃতীয় আরেকজনের কথাও মনে পড়ে আমাদের কারো কারো। তিনি বিক্তর হারা, প্রথিতযশা নাট্য পরিচালক, যদিও গণসংগীত শিল্পী হিসেবেই তিনি প্রিয় ও পরিচিত ছিলেন বেশি চিলের সাংস্কৃতিক জগতে। তাঁরই প্রাণপ্রিয় পত্নী জোয়ান হারার লেখা একটি স্মৃতিকথা, Victor : an Unfinished Song বইখানাই আমার আজকের আলোচনার উপজীব্য।
আয়েন্দে ও নেরুদার সঙ্গে বিক্তর হারার নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হবার কারণ তাঁরা তিনজনই ইতিহাসের নৃশংসতম এক অভ্যুত্থানের বলি হয়েছিলেন। আজ থেকে ঠিক বাইশ বছর আগের কথা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত চিলের সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট ড. সালবাদর গসেন আয়েন্দেকে উৎখাত করার জন্য স্থানীয় অভিজাত শ্রেণি ও বহুজাতিক সংস্থাসমূহ মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান সিআইএ’র সাহায্যে লেলিয়ে দেয় ক্ষমতাগর্বী পিনোচেতের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীকে। তারা প্রেসিডেন্টের কার্যালয় বোমা মেরে গুড়িয়ে দেয়, তারপর ভেতরে ঢুকে সাবমেশিনগান হাতে একা একা লড়ে যাওয়া আয়েন্দেকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। ফ্যাসিস্ত শক্তি ক্যান্সার-আক্রান্ত নেরুদাকেও রেহাই দেয় না। তাঁর বাড়ি ভাঙচুর করে। প্রিয়বন্ধু আয়েন্দের মৃত্যুসংবাদ ও এই আক্রমণের আঘাত নেরুদার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয় না। তিনিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অন্যদিকে চিলের প্রগতিশীল ছাত্র, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীদের প্রধান পীঠস্থান কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘেরাও করে হাজার হাজার কম্যুনিস্টকে বন্দি করে স্টেডিয়ামে এনে আটকে রাখে প্রতিহিংসাপরায়ণ সেনাসদস্যরা। সেই দলে ছিলেন বিক্তরও। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবেশে আয়েন্দের বক্তৃতা দেয়ার কথা। (কী আশ্চর্য সাদৃশ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে! মৃত্যুর দিনে তাঁরও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে যাবার কথা ছিল।) আর সেখানে গান গাইবেন বিক্তর হারা। আসন্ন অভ্যুত্থানের আলামত টের পেয়েও জীবন বাজি রেখে বিক্তর সেদিন ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় প্রেসিডেন্ট, আয়েন্দে, প্রিয় দল পপুলার ইউনিটি, সর্বোপরি প্রিয় রাজনৈতিক আদর্শ সাম্যবাদের প্রতি তাঁর সংহতি পুনর্ব্যক্ত করে প্রতিবাদ ও উদ্দীপনার গানে চিলের সংগ্রামী ছাত্র জনতাকে উদ্দীপ্ত করতে।
সেই গান আর তাঁর গাওয়া হয় না। স্টেডিয়াম থেকে এক পর্যায়ে তাঁকে আলাদা করে নিয়ে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয় তাঁর অসম সাহসে ভরপুর বুক। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে, স্টেডিয়ামে বন্দি অবস্থায় রচনা করেছিলেন একটি গান। তাতে তিনি লিখেছিলেন, — ‘‘কী কঠিন গান করা! যখন আমাকে গাইতে হয় বিভীষিকার গান”। সেই গান তিনি শেষ করে যেতে পারেননি, সে-কারণেই জোয়ান তাঁর বইয়ের নামকরণ করেন ‘‘একটি অসমাপ্ত গান”। তাছাড়া বিক্তরের জীবনটাই তো একটা অসমাপ্ত গান। সুরে ও কথায় তা ভরাট হয়ে উঠছিল কেবল, এমনি সময় জোর করে থামিয়ে দেওয়া হয় তা। বিক্তরের বয়স তখন মাত্র সাইত্রিশ। মনে পড়ে, এই বয়সেই স্পেনের ফ্যাসিস্ত শক্তির হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন আরেক অসাধারণ লোককবি লোরকা। তো এই অসমাপ্ত গানসম বিক্তরের অসাধারণ জীবনগাথাই শুনিয়েছেন আমাদের তাঁর কর্মসঙ্গিনী জোয়ান হারা; গভীর আবেগে, বিচক্ষণ বিশ্লেষণে, সর্বোপরি অনবদ্য ভাষা ও ভঙ্গিতে।
ইংল্যান্ডের মেয়ে জোয়ান। নাচ তাঁর পেশা। সোশ্যালিস্ট মায়ের প্রভাবে চেতনায় উদার প্রগতিশীলতার ছাপ। জার্মানিতে নাচতে গিয়ে চিলের কম্যুনিস্ট কোরিওগ্রাফার পাত্রিসিওর সঙ্গে পরিচয়, প্রণয় ও পরিণয়। তাঁর হাত ধরে চিলে গমন। সান্তিয়াগো শহরে নাচের ইসকুল প্রতিষ্ঠা। সেখানে ছাত্র হিসেবে পেলেন চাষা পরিবারে জন্ম, সান্তিয়াগোর বস্তিতে বেড়ে ওঠা বিক্তর হারাকে, যার রক্তে লোকগীতি-গাইয়ে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সুরের নেশা, কণ্ঠে চিলের পাহাড়ি প্রান্তরের খোলা হাওয়া আর পদক্ষেপে শ্রমজীবী মানুষের সহজ ছন্দ। পাত্রিসিওর সঙ্গে এক পর্যায়ে জোয়ানের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তার সেই মানসিক বিপর্যয়ের সময় ফুলের তোড়া আর আশ্বাসের হাসি নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ান তরুণ বিক্তর। ক্রমে শিক্ষক জোয়ানই হয়ে ওঠেন তাঁর জীবনসঙ্গিনী। দুজনে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েন সমাজবদলের কাজে: অভিজাত শ্রেণির অকথ্য শোষণ থেকে চিলের সহজ, সরল খেটেখাওয়া মানুষকে মুক্ত করে, নতুন এক বৈষম্যবিহীন, আধুনিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে। জোয়ান চিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নাচ শেখান আর বিক্তর নাট্য পরিচালনা, লোকগীতি সংগ্রহ, গান বাঁধা, গানের দল প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি দেশে-বিদেশে ঘুরে ঘুরে গান গাওয়া নিয়ে মেতে থাকেন। সেই সঙ্গে পার্টির কাজ তো রয়েছেই। জোয়ান তাঁর এই সুন্দর সুখপাঠ্য উত্থান-পতনে ভরা উত্তাল রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতটিকে মূর্ত করে তোলেন আমাদের সামনে। বাম আন্দোলনের খুঁটিনাটি তথ্য, বিশেষ করে তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মীবাহিনীর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিশ্বস্ত দলিল এই বই। তৃতীয় বিশ্বের যে-কোনো দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীদের কাছে, বিশেষ করে কবি, শিল্পীদের জন্য এই গ্রন্থ একাধারে শিক্ষামূলক ও অনুপ্রেরণাদায়ী সন্দেহ নেই। বিক্তর তাঁর একটি গানে লিখেছেন — My song is of the ladder/We are building to reach the stars. এই বই, সাম্যের সেই সুন্দর নক্ষত্রকে ছিনিয়ে আনার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে আমাদের। বিক্তরের মতো আমরাও উচ্চারণ করি তাঁর সেই বিখ্যাত বীজমন্ত্র, ‘Venceremos’ , ’আমরা জিতবই।’
হোয়ার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস গন: পিট সিগার
বহু বছর পূর্বে এক শীতার্ত সন্ধ্যায় দক্ষিণ ন্যুয়র্কের গ্রিনিচ ভিলেজ সংলগ্ন এক মিলনায়তনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে মার্কিন লোকগীতির একজন একনিষ্ঠ সাধক, শান্তি, সাম্য ও যুদ্ধবিরোধী গানের বলিষ্ঠ কণ্ঠ, চিরসংগ্রামী কম্যুনিস্ট শিল্পী পিট সিগারের একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে ন্যুয়র্কের প্রগতিশীল সংগীতবিষয়ক পত্রিকা সিং আউট প্রকাশনী থেকে সদ্য প্রকাশিত এই মহান শিল্পীর ঢাউস আত্মকথা হয়ার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস গন (তাঁরই একটি বিখ্যাত গানের পঙক্তি) এর একটি কপি কিনে নিয়েছিলাম আপ্লুত আবেগে। বন্ধুদের প্ররোচনায় সিগারকে দিয়ে একটি অটোগ্রাফও করিয়ে নিয়েছিলাম বইয়ে, তাঁর সেই বিখ্যাত ব্যাঞ্জো সংবলিত স্বাক্ষরটিসহ।
পাঠের শুরু থেকেই টেনে ধরেছিল সিগারের সহজিয়া গদ্যের গতি আর তাঁর শান্ত, সৌম্য, সহাস্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বাদু, সরস গল্প বলার ভঙ্গিটি। প্রায় তিনশ’ পৃষ্ঠার এই বইখানি মোট দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। ছেলেবেলা থেকে শুরু করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন মন্দার সময়ে শ্রমিক রাজনীতি, ম্যাকার্থি আমলের কম্যুনিস্ট পীড়নের অভিজ্ঞতা, ষাটের তুমুল যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন আর সা¤প্রতিক কালের বিশ্বশান্তি, নারী স্বাধীনতা ও পরিবেশমনস্ক সামাজিক কর্মকাÐের বিশদ খতিয়ান এসব অধ্যায়ে পর্বে পর্বে বিবৃত হয়েছে। পিট সিগারের বিপুল অভিজ্ঞতাপুষ্ট জীবনের এই প্রসন্ন বয়ানে যেন এই শতাব্দীর নিপীড়িত মানুষের আনন্দ, বেদনা আর অন্তহীন সংগ্রামের গৌরবগাথাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। লোকসংগীতে উৎসাহীরা এই বইয়ে লোকগানের জন্ম, প্রসার ও প্রচারের শাশ্বত প্রক্রিয়াটিকে তার দার্শনিক ও সামাজিক ভিত্তিটিসমেত খুঁজে পাবেন। কেননা সিগার নিছক গায়ক কিংবা গান লিখিয়েই ছিলেন না, সংগীতবিশেষজ্ঞ বাবার সূত্রে সংগীতের দার্শনিক, মনস্তাত্তি¡ক ও কারিগরি দিকটিও তাঁর আয়ত্তে ছিল ষোলআনা। সেসবই তিনি তাঁর গান গাওয়ার ইতিবৃত্ত শোনানোর ফাঁকে ফাঁকে লোকমনীষার ঢঙে প্রাঞ্জল করে বর্ণনা করেন, অনেক গল্প আর অজস্র তথ্যের সমারোহে।
পৃথিবীর যেখানেই গণমানুষের উত্থান হয়েছে বৈষম্য, স্বৈরাচার আর অশুভের বিরুদ্ধে, পিট ছুটে গেছেন তাদের পাশে তাঁর ব্যাঞ্জো হাতে। কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছেন তাদের নিজস্ব সংগীতের সঙ্গে। তাদের উপকরণ এনে অবলীলায় মিশিয়েছেন তাঁর নিজস্ব কথা ও সুরে। আর এভাবেই জন্ম দিয়েছেন এক প্রকৃত আন্তর্জাতিক বিশ্ব মানবিক সংগীত ঐতিহ্যের। এই বইয়ের পাতায় পাতায় আমরা তাঁর সেসব অমূল্য অভিজ্ঞতারই বিবরণ পাই। ফলে একদিকে যেমন তাঁর সহকর্মী শিল্পী উডি গাঠ্রির তিরিশের দশকের ভুখা মানুষের গান ডাস্ট বৌল সংগীতের আশ্চর্য ইতিহাস শুনি, অন্যদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে জোয়ান বায়েজের ব্রিং দেম হোম এর মতো যুদ্ধবিরোধী শান্তির গানে গানে উত্তাল দশকের কথাও জানি। চিলের বিপ্লবী গণসংগীত শিল্পী বিক্তর হারা কিংবা মালি’র প্রতিবাদী কণ্ঠ কেইতা ফোদেবার অন্তরঙ্গ আখ্যান আমাদের চেতনাকে স্পর্শ করে, মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে।
সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের যে-অভয়সংগীত, উই শ্যাল ওভারকাম, সেই গানটি পিট সিগারই কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের এক গসপেলগীতি থেকে উদ্ধার করে নতুনভাবে সুর দিয়ে ছড়িয়ে দেন আমাদের মুখে মুখে। সেই কাহিনিও আমরা জানতে পারি সিগারের কলমে। পিট সত্যি এই যুগের এক আশ্চর্য শিল্পী —একাধারে গানবাঁধিয়ে, ব্যাঞ্জোহাতে গাইয়ে, গানের কথক, যোদ্ধা, যেকোনো প্রগতিশীল আন্দোলনের মিছিলের পুরোধা, প্রতিবাদী কণ্ঠ- এক যথার্থ গণমানুষের শিল্পী। সংগীতের প্রকৃত সামাজিক ভূমিকাটি হৃদয়ঙ্গম করা যায় তাঁর মতো শিল্পীদের গান শুনে ও শিল্পীজীবনের অভিজ্ঞতার আস্বাদ নিয়ে। সেই সুবর্ণ সুযোগটিই আমরা পেয়ে যাই পিটের এই আত্মজীবনীমূলক বইটি থেকে। এই বই গণসংগীত ও লোকগীতিতে আগ্রহী সকলেরই অবশ্যপাঠ্য। সেই সঙ্গে সাম্যবাদে সমর্পিতপ্রাণ মানুষদের জন্যও, কেননা এই গ্রন্থ মানুষের মুক্তির মন্ত্রে যোগায় অনিঃশেষ অনুপ্রেরণা। সমাজতন্ত্রের বর্তমান দুঃসময়ে পিট সিগারের এই আত্মজীবনী আমাদের নতুন করে শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করে সন্দেহ নেই।