অনুভব । কায়েস সৈয়দ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ২:৩৩ পূর্বাহ্ণ, | ৩৭৮ বার পঠিত
১.
রুস্তমের শরীরে আটকে আছে আছিয়ার দৃষ্টি। একাকীত্বের দিনগুলো আজ ফুরালো। রুস্তম ছাড়া পেলো জেলখানা থেকে। অভাব দূর করার নেশায় শিশু পাচার কাজে সহযোগিতা করতে গিয়ে ধরা খায় সে। এক বছরের কারাদণ্ড। সেই সময়টাতে তারা কমলাপুরে বস্তিতে থাকতো। ছাড়া পাওয়ার কয়েকদিন আগে রুস্তম আছিয়াকে তেজগাঁ রেলগেটের বস্তিতে গিয়ে একটা লোকের সাথে দেখা করতে বলে। ঐ লোক একটা খুপরির ব্যবস্থা করে দিলে আছিয়া সব মালামাল কমলাপুর থেকে তেজগাঁয়ে নিয়ে আসে।
রেললাইনের দুপাশে একটানা গা ঘেঁষে ছোট ছোট খুপরি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সারি সারি নৌকার ছাউনির সৌন্দর্য। কাছে গেলে পাওয়া যায় অদ্ভুত রকমের দুর্গন্ধ। সেই দুর্গন্ধ পাশ কাটিয়ে নতুন খুপরিতে প্রবেশ করলো দুজন। একপাশে রশি টানিয়ে জামা—কাপড় ঝুলানো। সামনের এক কোণায় কয়েকটা হাড়ি—পাতিল, থালা—বাসন। খুপরিতে কোন জানালা নেই। সামনের পর্দা ছেড়ে দিলেই সবকিছু আন্ধার।
শুয়ে আছে রুস্তম। অভাব পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। হালায় অভাবরে দূর করতে যেইডাই করতে গেলাম, হেইডাতেই ধরা খাইলাম—মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায় সে। না, ধরা খাওনের কাম আর করা যাইবো না। নিরাপদ কিছু করতে হইবো। মনে মনে ভাবে রুস্তম।
ঘনীভূত হয় খুপরির আন্ধার। রুস্তম হাত রাখে আছিয়ার বুকে। নিঃশ্বাস—প্রঃশ্বাসে তার বুক হাপরের মতো উঠছে আর নামছে। রুস্তমের হাত নিম্নগামী হয়ে তলপেটে গিয়ে থেমে যায়। মুহূর্তেই মূর্তি হয়ে যায় সে। শুধু মুখ বিড়বিড় করে আছিয়াকে বলে—
বৌ, তুই আমারে একটা বাইচ্চা দিবি? আমি আর কিচ্ছু চাই না। খালি ক আমারে একটা বাইচ্চা দিবি। কথা দে ওই বাইচ্চা আমার…
কামতৃষ্ণার ঘনীভূত মুহূর্তে হঠাৎ এমন প্রশ্নে হতবাক হয় আছিয়া। সে হ বলে রুস্তমকে টান মেরে নিচে নামিয়ে চুমু খায়। স্তব্ধতা কাটিয়ে রুস্তমও জড়িয়ে ধরে তাকে। আবার ঘনীভূত হয় সময়। এরপর বৃষ্টি…
২.
একেক সময়ে একেক কাজ করে কোনোমতে চলছে তাদের সংসার। অনিশ্চয়তার জীবন। রুস্তম জানে না মৌলিক চাহিদার সংজ্ঞা। দিনের শুরুতেই নিত্যদিনের সঙ্গী দুমুঠো ভাতের চিন্তা। আর এই দুশ্চিন্তা দূর করার চিন্তা রাষ্ট্রমস্তিষ্ক বাস্তবে করে কিনা সেটাও তার অজানা। বছর ঘুরতেই কথা রাখে বৌ। ছেলে সন্তান। আছিয়া নাম রাখলো আব্বাস। মায়ের ভাষ্য মতে ছেলে এক্কেবারেই তার বাবার মতো।
বড় হচ্ছে আব্বাস। তিন বছরের মধ্যে সে তার বাবার আদর কখনোই পায়নি। রুস্তম যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলে ছেলেকে।
একবার বর্ষায় ভিজে জ্বর হয় আব্বাসের। প্রচণ্ড জ্বরে মরার মতো অবস্থা। রুস্তম তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কোলে করে নিয়ে যাবার সময় সে আব্বাসকে বলে—‘তাড়াতাড়ি বড় হ’। আমি ত’র লাইজ্ঞা কবুতরের বাইচ্চা আইন্না দিমুনে। ত’র মায় রাইন্ধা দিবো, খাইস। শক্তি পাবি।
কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠে আব্বাস। সে ডাক দেয় আছিয়াকে
আছিয়া…ওই আছিয়া
—খাড়াও আইতাছি
তুই না আমারে কথা দিছিলি বাইচ্চা দিবি? আব্বাস আমার…?
—হ’আব্বাসতো আপনেরই পোলা। সরল মনে জবাব দেয় আছিয়া।
অরে একটা জামা পড়াইয়া দে, এক জায়গায় যামু
—কই যাইবা?
হেইডা এহন জাইন্না কাম নাই
—আইচ্ছা
আব্বাসকে হাত মুখ ধুইয়ে জামা পড়ায় আছিয়া। আর এই ফাঁকে ফোনালাপ সেরে নেয় রুস্তম।হ্যালু শওকত ভাই। আমি রুস্তম।
—কিরে, খবর কি তোর? আমগোতো এক্কেবারে ভুইলাই গেছছ। আর আইলিও না কামে। কি কইবার চাছ ক’
একটা বাইচ্চা আছে পাঁচ বছরের
—কছ কি!
কত দিবা?
—ওইডা লইয়্যা তোর লগে ছমছ্যা অইবো না। লাখ লাখ পাবি, লিয়ায়
আইচ্ছা। আইতাছি
অলি—গলি পেরিয়ে আধঘণ্টা ধরে রিক্সা এগোচ্ছে। আর রুস্তমের হাত ধরে চেপে বসে আছে আব্বাস। রুস্তম ওর চেহারার দিকে একবারের জন্যেও তাকাচ্ছে না। রিক্সা থেকে নেমে জড়াজীর্ণ এক বাড়ীর মধ্যে ঢুকে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় দুজন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একঝাঁক মুক্ত কবুতর পাখনায় আওয়াজ তুলতে তুলতে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় এক মুহূর্তেই। আব্বাসের মনে পড়ে কবুতরের বাচ্চার কথা। সে তার বাবার আঙুল ধরে নাড়াতে নাড়াতে জিজ্ঞেস করে—
আব্বা, তুমি না আমারে কবুতরের বাইচ্চা আইন্না দিবা কইছিলা?
রুস্তম ফিরে তাকায় আব্বাসের দিকে
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বাচ্চা মনে হচ্ছে তাকে
পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছে সে
কথাবার্তার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে যায়। উঁকি মেরে বেড়িয়ে আসে শওকত
শওকত বিশাল এক প্রাপ্তির চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আব্বাসের দিকে
আব্বাস অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বাবা রুস্তমের দিকে
রুস্তম আব্বাসের মুখের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না
মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত তরলে অদ্ভুত এক অনুভব
সন্তানের চোখে আটকে যায় বাবার দৃষ্টি