সমকালীন আফগানিস্তানের লান্দে । কায়েস সৈয়দ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:১০ পূর্বাহ্ণ, | ৫৮৯ বার পঠিত
আফগান সঙস্কৃতিতে কবিতাকে সম্মান করা হয়। বিশেষ করে উচ্চ সাহিত্যের কাঠামোকে যা ফার্সি বা আরবি থেকে আসা। পশতু ভাষায় লান্দে শব্দের অর্থ ক্ষুদ্র বিষধর সাপ। একটি লান্দে একটি মৌখিক এবঙ বেনামি গানের ক্ষুদ্র অঙশ যার বেশিরভাগই নিরক্ষর বা প্রান্তিক মানুষের দ্বারা সৃষ্ট যারা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তে দুই কোটিরও বেশি বিস্তৃত পশতু নারী। ঐতিহ্যগতভাবে লান্দেগুলো প্রায়শই হাতে বাজানো ঢোলের তালে তালে উচ্চস্বরে গাওয়া হয়। অন্যান্য সঙ্গীতের সাথে লান্দেও তালেবাদ দ্বারা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিলো এবঙ কিছু কিছু জায়গায় এখনও নিষিদ্ধ।
লান্দের অল্প কিছু নিয়ম-বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একটি লান্দেতে মোট বাইশটি মাত্রা থাকে। প্রথম লাইনে নয়টি ও দ্বিতীয় লাইনে তেরোটি (ভাষান্তরে তা রক্ষা করা যায়নি)। কবিতা শেষ হয় মা অথবা না ধ্বনি দ্বারা। এই কবিতায় প্রায়শই অন্ত্যমিল থাকলেও অনেক দ্বিপদী অমিল গদ্যেও বিন্যস্ত। পশতু ভাষায় অভ্যন্তরীণভাবে দুলাইনের মধ্যে শব্দে শব্দে এক ধরণের মিল রেখে গুন গুন করে গাওয়া হয়। যা তাদের বিষয়বস্তুকে তীক্ষ্নভাবে অস্বীকার করে। যা শুধুমাত্র এর সৌন্দর্য, বেহায়াপনা ও বুদ্ধিমত্তার জন্যই নয় বরঙ প্রেম, দুঃখ, বিচ্ছেদ, স্বদেশ এবঙ যুদ্ধ সম্পর্কে সাধারণ সত্য উচ্চারণ করার ক্ষেত্রে এর তীক্ষ্ন বিদ্ধ করার ক্ষমতার জন্য স্বতন্ত্র। এই পাঁচটি প্রধান লক্ষণার মধ্য দিয়ে লাইন দুটি প্রকাশ করে একটি সম্মিলিত ক্রোধ, একটি বিলাপ, একটি পার্থিক প্রহসন, স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, বিচ্ছেদ অবসানের আকাঙ্ক্ষা, সশস্ত্র হওয়ার প্রতি আহ্বান, যা সমস্তই একজন পশতু নারীর যেকোনো সহজ চিত্রকে হতাশ করে। যেনো নীল বোরকার নিচে একটা নীরব ভূত ছাড়া আর কিছুই না। কখনও তা আপাত অশালীন মনে হলেও তা আসলে নিপীড়িত নারীদের ঘৃণা ও ক্রোধের অসহায় প্রকাশ।
হাজার হাজার বছর আগেকার আর্য কাফেলা থেকে শুরু করে চলমান মার্কিন ড্রোন হামলা পর্যন্ত আফগানিস্তানে বয়ে চলা এই লান্দের বিষয়গুলোকে র্যাপের মতো রিমিক্স করা হয়েছে। পুরনো শব্দগুলোকে নতুন এবঙ আরও প্রাসঙ্গিক করার জন্য অদলবদল করা হয়েছে। শতাব্দীর প্রাচীন লান্দের একজন নারীর হাতা এখন তার ব্রা বা অন্তর্বাস হয়ে উঠেছে। একজন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ অফিসার এখন একজন সমসাময়িক আমেরিকান সৈনিক হয়ে ওঠে। একটি বই হয়ে ওঠে একটি বন্দুক। প্রতিটি কামড়ে ধরা শব্দের পরিবর্তন সামাজিক ব্যাঙ্গাত্মক ইন্ধন দ্বারা বিরক্তির মধ্য দিয়ে অনেক কিছু শেখায় যা একজন নারীর জীবনপৃষ্ঠের নিচে ঢেউ তোলে।
লান্দে চর্চা শুরু হয় যাযাবর ও কৃষকদের মধ্যে। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে, দিন শেষে মাঠে অথবা বিয়েতে কবিতা ছিলো বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম। এ ধরণের জমায়েত আজকাল বিরল। চল্লিশ বছরের বিশৃঙ্খলা ও সঙ্ঘাত লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে। যুদ্ধ একটি সঙস্কৃতিকে করেছে তরলিত আর বিশ্বায়ন হয়েছে ত্বরান্বিত। এখন মানুষ ইন্টারনেট, ফেসবুক, মেসেজ এবঙ রেডিওর মাধ্যমে লান্দে শেয়ার করে নেয়। এটি একমাত্র মাধ্যম যা তাদেরকে ঝুঁকিতে ফেলে না। লান্দে সাধারণত গাওয়া হয় এবঙ গান গাওয়া আফগান চেতনায় শুদ্ধতার সাথে সঙযুক্ত। নারী গায়িকাদের অবশ্য গণিকার মতো দেখা হয়। নারীরা গোপনে আসরে মিলিত হয় শুধুমাত্র পরিবারের ঘনিষ্ঠদের সামনে। সাধারণত একটি গ্রামে বা একটি পরিবারে একজন নারী লান্দে গানে অন্যদের তুলনায় দক্ষ কিন্তু তবুও পুরুষরা জানেন না তিনি কে। একজন আফগান নারীর জীবনের বেশিরভাগ অঙশই ষড়যন্ত্র ও গুপ্তচরবৃত্তির নীতির সাথে জড়িত। সে কে হতে পারে এবঙ সে আসলে কে তার মধ্যে থাকে একটি বৈসাদৃশ্য।
নাম ধরে ডাকি তবু তুমি যেনো পাথর
কোনোদিন তুমি তাকাবে ঠিকই দেখবে আমি নিথর
যে কিশোরী কবি এই লোক কবিতাটি উচ্চারণ করেছিলো সে নিজেকে পরিচয় দিতো রাহিলা মুস্কা নামে। কবিতা লেখার জন্য যাকে দিতে হয়েছিলো প্রাণ। বাস করতো হেলমান্দে। হেলমান্দ ছিলো তালেবান অধ্যূষিত শক্তিশালী ঘাঁটি এবঙ ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর মার্কিন আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে আফগানিস্তানের চৌত্রিশটি প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্থ প্রদেশ। অন্যান্য গ্রামীণ আফগান নারী ও মেয়েদের মতো মুস্কারও বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। যুদ্ধবাজদের দ্বারা অপহৃত বা ধর্ষিত হতে পারে এই ভয়ে তার বাবা পঞ্চম শ্রেণির পর থেকে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। অন্যান্যদের মতো তার পরিবারও মেয়েদেরকে শিক্ষিত করাকে অসম্মানজনক ও বিপজ্জনক হিসেবে দেখতো। এমন পরিস্থিতিতে ঘরে বসে নারীদের কাছ থেকে এবঙ কাবুল থেকে প্রচারিত রেডিও শুনে শুনে সে কবিতা চর্চা শুরু করে। কবিতাই হয়ে ওঠে তার একমাত্র অব্যাহত শিক্ষা। কিন্তু উপরের কবিতাটি হলো দ্বীপদী বা দুই লাইনের একটি লোক শ্লোক, একটি লান্দে। আজকাল নারীদের জন্য রেডিওর কবিতার অনুষ্ঠানগুলো বহির্বিশ্বে প্রবেশের কয়েকটি উপলব্ধ মাধ্যমগুলোর একটি। রাহিলা মুস্কা রেডিও শোনার সময় মিরমান বাহির নামে একটি নারী সাহিত্য সঙ্ঘের কথা জানতে পারে। প্রতি শনিবার বিকেলে রাজধানি কাবুলে সঙ্ঘের সবাই মিলিত হয়। কল করতে, তাদের সৃষ্টি পাঠ করতে বা কবিদের সাথে কথা বলতে প্রদেশের মেয়েদের জন্য সঙ্ঘটির একটি ফোন নাম্বারও ছিলো যার সৎব্যবহার মুস্কাও করতো। মুস্কা, পশতুতে যার অর্থ হাসি, এতো ঘন ঘন কল করতো এবঙ এমন প্রতিশ্রুত ছিলো যে সাহিত্য সঙ্ঘের সবার কাছে সে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পারিপারিক সমস্যার কথা সে ইঙ্গিত দিয়েছিলো কিন্তু কাউকে কিছু খুলে বলেনি। শহর এবঙ গ্রামের অনেক নারী একই রকম মারাত্মক পরিস্থিতির কথা ভাগ করে নিয়েছিলো। তাই তার প্রকাশ করা নরকের ইঙ্গিত আলাদা বলে মনে হয়নি।
২০১০ সালে বসন্তের এক দিনে মুস্কা দক্ষিণ-পূর্ব শহর কান্দাহারের একটি হাসপাতালের বেড থেকে তার কবিবন্ধুদের কল করে বলে যে সে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেবে, প্রতিবাদে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলবে। তার লেখা কবিতা দেখে ফেলার পর তার ভাইয়েরা তাকে মারধর করেছে। কবিতা, বিশেষ করে প্রেমের কবিতা আফগানিস্তানের বেশিরভাগ নারীর জন্য নিষিদ্ধ : প্রকাশ করে অসম্মান ও স্বাধীন সত্ত্বা। ঐতিহ্যগত আফগান সঙস্কৃতিতে উভয়ই নারীদের জন্য অস¦স্তিকর। এরপর কিছু দিনের মধ্যে কান্দাহারের হাসপাতালেই মুস্কা মারা যায়।
বিয়ের বয়স পার হয়ে যাওয়াএকজন নারী, একাধিক স্ত্রীর মধ্যে একজন স্ত্রী হওয়ার চেয়েও দুর্ভাগ্যবান। এই লান্দেটি একজন অবিবাহিত মেয়ের বিলাপ প্রকাশ করেযে কিনা অবিবাহিত থেকে যাওয়ার ভয়ে ভীত এবঙ যার বয়স দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। পশতু সমাজে এমন নারীকে মূল্যহীন ভাবা হয় কেননা তার যত্ন নেয়ার জন্যও কোনো ছেলে বা মেয়ে নাই।
তার আসল নাম জারমিনা এবঙ তার গল্প ছিলো তার কবিতার চেয়েও ঢের বেশি। এটি ছিলো একটি ভুল প্রেমের গল্প। অল্প বয়সেই তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ পাকাপাকি ছিলো কিন্তু ছেলের বাবার সাম্প্রতিক মৃত্যুর পরে ভোলভার (কন্যাপণ) জোগার করতে না পারায় মুস্কাকে তাকে বিয়ে করতে না বলা হয়। মুস্কাার ভালোবাসা পরিণত হয় নরকে এবঙ ভবিষ্যৎ পর্যবেশিত হয় অনিশ্চয়তায়। এ সমস্ত কিছু সমাধানে মৃত্যুই হয়ে ওঠে তার একমাত্র নিয়ন্ত্রণ যা সে তার জীবনের ওপর জাহির করতে পারে। উপরের লান্দেটি হলো তার বেঁচে থাকার পাথেয়মূলক একটি কবিতা। প্রায় সব লান্দের মতোই যার নির্দিষ্ট কোনো লেখক নেই। যদিও সে এই কবিতাটি লেখেনি তবুও রাহিলা মুস্কা প্রায়ই ফোনে মিরমান বাহিরের নারীদের কাছে এটি আবৃত্তি করতো। একজন নারী প্রচলিত হাজার হাজার লান্দের মধ্য থেকে তার জীবনের সাথে সম্পর্কিত মুষ্টিমেয় লান্দে মনে রাখে। সে সেগুলো আবৃত্তি করতে তুলনামূলকভাবে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। প্রকৃতপক্ষে সে সেগুলো লিখেনি। কারো খেয়াল ছাড়াই সে যে একটি/দুটি শব্দ পরিবর্তন করেছে তা কবিতার আকারেই বোনা। মুস্কার নোটবইয়ের বিপরীতে এই ছোট কবিতাটি তার বাবার দ্বারা ছিঁড়ে ফেলা বা ধ্বঙস করা সম্ভব হয় না। টিকে থাকে লান্দে কারণ সেগুলোর মালিক কেউই নয়।
এসো- চলো পাশাপাশি এখানে শুয়ে পড়ি
আমার উপর তুমি চড়ে বসলেও কাঁদবো না আমি
*
উফ! এতো শক্ত করে চেপে ধরো না
পুড়ে যাচ্ছে মাই- সবেমাত্র আমি হয়েছি যৌবনা
*
উজ্জ্বল চাঁদ! আজ খোদার প্রেমের রাত
এমন নগ্ন আলোয় দুজন প্রেমিক-প্রেমিকাকে অন্ধ করে দিও না খোদা
*
কেনো আমি চুড়ি পরি বুঝবে
যখন অন্ধকারে প্রাচুর্য-বনে ভুল বিছানা বাছবে
চুড়ি ঐতিহ্যগতভাবে নারীত্ব ও সৌন্দযের্র প্রতীক। গরমের সময়ে অনেকগুলো মেয়ে রাতে যখন এককক্ষে কিঙবা একসাথে বারান্দায় ঘুমায় তখন চুড়ির আওয়াজের মধ্য দিয়ে কোনো নারী তার প্রেমিককে তার শোবার বিছানার প্রতি ইঙ্গিত দিতে পারে। অন্যদিকে একজন নারীর কবরে ভাঙা চুড়ি রাখা দুঃখ প্রকাশের প্রতীক।
***
মেয়ে :
তুমি আমাকে চুমু খেলেই ঠোঁটে কামড় দাও
কি বলবে মা?
ছেলে :
এই বলে উত্তর দিও মাকে
পানি আনার সময় নদীর তীরে পড়ে গিয়েছিলে
মেয়ে :
মা যদি বলেন- ভাঙলো না জলের পাত্র
তবু নিচের ঠোঁট দিয়ে কেনো ঝরলো রক্ত?
ছেলে :
এই বলে উত্তর দিও মাকে
আমি পড়েছি পাথরে আর জলের পাত্র মাটিতে
মেয়ে :
তোমার কাছে আছে মায়ের সব প্রশ্নের উত্তর, সুন্দর
এখন ঠোঁটে ঠোঁট রাখো আর মিটিয়ে ফেলো তৃষ্ণা
মৌখিক কথা কাটাকাটির এই প্রেমময় কবিতাগুলো প্রাচীন গ্রীকদেরস্টিকোমিথিয়ার সাথে মিলে যায়। যদিও তাতে একটি অঙশ উচ্চস্বরে একজন পুরুষ এবঙ অন্য অঙশ একজন নারী গাইতে পারে কিন্তু লান্দে আসলে পালা করে গাওয়ার সুযোগ নাই।কোনো অনুষ্ঠানে একজন নারী এবঙ একজন পুরুষ একসাথে গান করার উপলক্ষ পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।একটি ড্রামের তালে তালে পুরো সিরিজটি আবৃত্তি করবেন একজন গায়ক (নারী অথবা পুরুষ)। তারপর সন্ধ্যায় আগুনের চারপাশে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগীতায়, অথবা আজকাল রাতের খাবারের পরে কাবুলের একটি বসার ঘরে সোফায় গায়কদের মধ্যে একটি উৎসাহপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরী হবে যারা সৌন্দর্য বা কৌতুক দিয়ে অথবা কবিতার গভীরতার মধ্য দিয়ে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
শুভেচ্ছা পাঠাও আমার প্রেমিকের কাছে
সে পায়ুপথে বায়ু ছাড়লে আমিও ছাড়বো জোরে
*
ফেসবুকে ছিদ্র করে আমাকে রোপণ করো- বাছা
আর মাকে বলো ‘আমাকে কামড়ে ধরেছে বিছা’
*
খোদা- অভিশপ্ত করো জার্মানিদের
যারা গাড়ি উদ্ভাবন করে আমার প্রেমিককে নিয়ে গেছে দূরে
আফগানিস্তানে বাতকর্ম করা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি পীড়াদায়ক ও লজ্জাজনক। একজন লোক সম্পর্কে এরকম লোককথা প্রচলিত আছে যে, সে তার পরিবারের সামনে ভুল করে বাতকর্ম করে ফেললে হতাশ হয়ে তিনি বিশ বছরের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যান।বিশ বছর পর যখন সে ফিরে আসে তখন সে ঘরের বাইরে থেকে শুনতে পায় তার স্ত্রী তার সন্তানদেরকে বলছে তারা যেনো তার বাবার মতো বাতকর্মকারী (পশতু ভাষায় তিজার) না হয়। এ কথা শুনে সে আবার বিশ বছরের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো। এই রূঢ় লান্দের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো- একজন নারীও প্রয়োজনেতার স্বামীর মতো স্পষ্টভাষী ও শক্তিশালী হতে পারে।
ইমাল দোরানি তার পশতু লান্দে ফেসবুক পেজে দ্বিতীয় কবিতাটি পোস্ট করেন যাতে বিশ হাজারেরও বেশি লাইক পড়ে। কবিতাটি প্রেম-বিষাদের সব বিষয়বস্তু তুলে এনেছে : রু² চুম্বন ফেসবুকে হয়, নদীতীরে নয়। দোরানির ফেসবুক পেজে আফগানরা যারা বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকে তারা প্রেম, বিচ্ছেদ এবঙ প্রিয় কাবুল (কাবুল-জান) সম্পর্কে লেখা লান্দে একে অপরের সাথে বিনিময় করতে অনলাইনে মিলিত হয়। তারা ভাগ করে নেয় ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। তাদের কবিতাগুলোর মধ্যে মুসাফির (ভ্রমণকারী) শব্দটি বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলোর মধ্যে একটি। মুসাফির হতে পারে একজন উদ্বাস্তু, হতে পারে একজন ছাত্র যে শিক্ষা অর্জনের জন্য দেশ ত্যাগ করেছে, হতে পারে একজন যে কিনা জীবিকা অর্জনের জন্য দুবাই গেছে, দেশের বাইরে বসবাস করা যেকোনো আফগান, তা স্বআরোপিত হোক বা চাপানো হোক। ফেসবুকে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত হতে একজন বন্ধু একটি লান্দে পোস্ট করে আর তারপর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কবিতাটি হাস্যকর, দুঃখজনক কিঙবা যৌনপ্রদক নতুন সঙস্করণে রূপ নেয়। এটি একটি সৃজনশীল বিনিময় মাধ্যম যা বাস্তব সময়ে কয়েক দশক, এমনকি শতাব্দীও ধরে রাখতে পারে।
***
অস্বীকার করবো না- প্রেমে পড়েছি আমি
এমনকি যদি আমার সবুজ উল্কি- ছুড়ি দিয়ে উপড়ে ফেলো তুমি
*
শুরু থেকে আমায় ভালো- না বাসতে পারলে
এই ঘুমন্ত হৃদয়খানি তবে- কেনো জাগাতে গেলে ?
পশতু মেয়েদের জন্য প্রেম নিষিদ্ধ। একজন ভালো পশতু মেয়ে তার বিয়ের সময় মুখ গোমড়া করে প্রকাশ করে যে সে যাকে বিয়ে করতে চলেছে তার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। শৈশবকাল থেকেই যদি সে তার বাগদত্তার প্রেমে আবিষ্কৃত হয় তবে তাকে হত্যা করা যেতে পারে মৃত কবি জারমিনার মতো। সে তার সম্মান প্রমাণের জন্য আত্মহত্যাও করতে পারে। এই প্রথাটি ইসলামের পূর্ববর্তী এবঙ হিন্দু সতীদাহ প্রথার সাথে সম্পর্কিত যেখানে একজন স্ত্রী তার স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চিতায় ঝাঁপ দিয়ে স্বামীর প্রতি তার বিশ্বস্ততা প্রমাণ করে।
***
আমার প্রেমিকা আমেরিকার সৈন্যের মতো সাদা
আমাকে সে শহীদ করলো- তার কাছে আমি তালেবের মতো কালা
*
যেহেতু আমার প্রেমিক মার্কিন হতভাগা
হৃদয়ে আমার তাই ফুটে আছে ফোসকা
ঊনবিঙশ শতাব্দীর ব্রিটিশ দখলদারদের প্রসঙ্গে প্রথম লান্দেটি এভাবে বলা হতো : আমার প্রেমিকা ব্রিটিশ সৈন্যের মতো সাদা/বৈধ…। ইঙরেজ, ইঙলিশ শব্দগুলো সঙক্ষেপে যেকোনো বিদেশীকে বোঝাতো। ধীরে ধীরে আমেরিকান শব্দটি এই জায়গা দখল করে নেয়। এখন বিদেশী সৈন্য যেমন স্প্যানিশ, ব্রিটিশ, ইতালীয়কে আমেরিকান বলা হয়। এখানে কৌতুকটি এক ভুল বোঝাবুঝি। বহিরাগত তার নিজের প্রেমিকাকেও চিনতে পারে না, তাই সে তাকে শত্রু হিসেবে হত্যা করে, ভুল করে সে শহীদ হয়।
দ্বিতীয় লান্দেতে আমেরিকান প্রতিস্থাপিত হয়েছে একজন মিথ্যাবাদী হিসেবে।
***
ও খোদা- এ তুমি কী করলে আমার ?
অন্যেরা ফুটে ব্যাকুল আর আমি এখনও আঁটসাঁট মুকুল
বিয়ের বয়স পার হয়ে যাওয়াএকজন নারী, একাধিক স্ত্রীর মধ্যে একজন স্ত্রী হওয়ার চেয়েও দুর্ভাগ্যবান। এই লান্দেটি একজন অবিবাহিত মেয়ের বিলাপ প্রকাশ করেযে কিনা অবিবাহিত থেকে যাওয়ার ভয়ে ভীত এবঙ যার বয়স দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। পশতু সমাজে এমন নারীকে মূল্যহীন ভাবা হয় কেননা তার যত্ন নেয়ার জন্যও কোনো ছেলে বা মেয়ে নাই।
***
প্রিয়, তুমি যেনো ঠিক আমেরিকা
তুমি হও দোষি, আমি চাই ক্ষমা
তিক্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত এই লান্দে এখন আফগানিস্তানের রেডিও ও ফেসবুকে জনপ্রিয়। প্রেমিক এবঙ জাতি উভয়ই বিশ্বাসঘাতকতা করতে সক্ষম। মিথ্যাবাদী হিসেবে তারা প্রায়শই পশতু কবিতায় অদলবদল হয়। মুস্তফা সালিক সর্বাধিক বই বিক্রি হওয়া একজন পশতু ঔপন্যাসিক ও কবি যিনি কাবুলে এক সন্ধ্যায় খবরের কাগজে মোড়ানো গরুর মাঙশের কাবাব নিয়ে এটি শেয়ার করেছিলেন। এখানে ইঙরেজিতে সালিকের একটি কবিতা গুজব :
একটি মৃত কাক বিদ্যুতের খুঁটি থেকে পড়ে গেলো। পড়ে গিয়ে কালো পাখিটি এক মহিলার হাতে আঘাত করলো। রাস্তার মধ্যে, কাক তাকে কামড় দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছে বলে ফিসফিসানি শুরু হয়। গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে পাগল হয়ে গেছে কাক। খবরের শিরোনাম হয়-শহর থেকে দূরে নাগরিকরা নিজেদেরকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রেখেছে পাগলা কাকের ভয়ে। উদ্ধার কার্য এখন সেনাবাহিনীর দায়িত্ব।