হুপ ড্যান্সের মাইফেল । মঈনুস সুলতান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১:০১ পূর্বাহ্ণ, | ৪৯৮ বার পঠিত
দিন চারেক ধরে ফ্লোরিডায় আমেরিকার আদিবাসীদের মিউজিক ফেস্টিভেল নিয়ে মজে আছি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনরা যুক্তরাষ্ট্রে ‘নেটিভ আমেরিকান’ বা ‘আমেরিকান ইন্ডিয়ান’ নামে পরিচিত। এদের নৃত্যগীতের এই বিচিত্র জলসাটি আয়োজিত হয়েছে মেলবোর্ন শহরের প্রান্তিকে, উইকাহাম নামক বিরাট পার্ক-সংলগ্ন গাছ-বিরিক্ষ-হ্রদ ও হরিণে ভরপুর একটি উপবনে। আদিবাসীদের হরেক কিসিম গোত্র থেকে আগত নানা ধরনের সমজদাররা উপবনে ক্যাম্পিং এর কায়দায় তাঁবু খাটিয়ে দিন গোজরান করছেন। আমি তাদের সাথে শরীক হয়ে হাল্কা একটি তাঁবুতে ডেরা বেঁধেছি, আর প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুপুরের আলাদা আলাদা মিউজিক ইভেন্টে হাজিরা দিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছি নৃত্যগীতে সরগরম সময়।
বিকালের অধিবেশনে পর বেজায় পেরেশানী লাগে, তাঁবুর দিকে হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়, আই নিড অ্যা লিটল ব্রেক, ভাবি, সামান্য কিছুক্ষণের জন্য হলেও প্রয়োজন প্রকৃতিতে এসকেইপ।
তাঁবুতে ফেরার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে অতঃপর গতিপথ পরিবর্তন করি, হ্রদের অন্য পাড়ে এসে ঢুকে পড়ি গাছ-বিরিক্ষে নিবিড়ভাবে ছায়াচ্ছন্ন সবুজাভ উপবনে। কিছুক্ষণ ট্রেইলের দিকনির্দেশনা সম্পর্কে সচেতন না হয়ে এলোমেলো হাঁটি। গোধূলি সমাচ্ছন্ন, তারপরও গাছপালার ফাঁক ফোকরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার নানা আকৃতির অপেনিংয়ে রোদ আঁকছে শ্যাডো পাপেটের প্রতিবিম্বিত আলোছায়ার মতো বিবিধ আকৃতির নকশা।
সামান্য হেঁটে চলে আসি, অপরাহ্ণের উপসংহারে হঠাৎ করে রৌশনঋদ্ধ হয়ে উঠা পরিসরে। ‘আওরিলাগা’ বা সাময়িকভাবে ট্রেইল হারানো সম্পর্কে সচেতন হই তখন। খুব একটা নার্ভাস লাগে না, অভিজ্ঞতা থেকে আমি ওয়াকিবহাল যে, সঠিক পথে চলার চেষ্টার করেও আমি প্রায়-কখনো নির্দ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পারিনি, আর এ মুহূর্তে আমার যেহেতু কোন নিশানা নেই, না হয় ভুল পথেই একটু ঘোরাফেরা করলাম।
অরণ্যানী হাল্কা হতে হতে পর্যবসিত হয়েছে স্রেফ ঝোপঝাড়ে। নিস্তব্ধতা ভেঙ্গেচুরে কতিপয় বাচাল পাখি এমন হালতে বাতচিত করছে যে, এদের বর্ণনায় কাকলির পরিবর্তে বির্তক শব্দটি ব্যবহার করবো কি না, দাঁড়িয়ে পড়ে আমি তা নিয়ে একটু ভাবি। তখনই চোখে পড়ে, স্মৃতিমন্দিরের মতো সুদৃশ্য একটি স্ট্রাকচার। এটি যে বিত্তবান কারো কবর, এ নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে না।
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ছোট্টমোট্ট এ স্থাপত্যের চুনকাম করা কাজ খুঁটিয়ে দেখি, এ ধরনের সমাধি ‘ক্রিপ্ট’ নামে পরিচিত। প্রয়াত বাসিন্দার নাম সিনিওর সনজেস মিরাভাল। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা তাঁর মৃত্যুদিবসের তারিখ হচ্ছে ১৭ই জানুয়ারী, ১৮০৩ সাল। আজকালকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পুরোটাই তখন ছিলো স্প্যানিশ কলোনি, যতোটা জানি, ১৮২২ সালের দিকে সামরিক অভিযানের ফলশ্রুতিতে ফ্লোরিডা যুক্তরাষ্ট্রের ‘টেরিটরি’ বলে ঘোষিত হয়।
একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে, সিনিওর মিরাভাল আমেরিকার দৌরাত্ম দেখার কোন সুযোগ পাননি। এসব ভাবতে ভাবতে আরেকটি বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠি, ক্রিপ্ট বা সমাধিসৌধ সচরাচর একা দাঁড়িয়ে থাকে না, আশপাশে একটি পুরো সেমিটারি বা কবরগাহের বিস্তৃত থাকার কথা। কিন্তু বাকি কবরগুলোর নিশানা কোথায়? তবে কী যুক্তরাষ্ট্রের দখলদার সেনানী ধংশ করে দিয়েছিলো তাবৎ সামাধি ফলক, কেবলমাত্র একটি স্ট্রাকচার বোধ করি এর সৃদৃশ্য স্থাপত্যের কারণে এতো বছর পরও বনানীতে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। রহস্যের সমাধান করতে পারি না, তাই ভাবি, অত কিছু আমার না জানলেও চলে, আমি বরং সামনের দিকে পা বাড়াই।
আওরি লাগাটা আরেকটু প্রকট হয়ে উঠলে, অনেক বছর আগে পড়া বনানীতে হারিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে রচিত একটি কবিতার শিরোনাম মনে পড়ে। ‘ লস্ট ’ নামক পদবলীটির রচয়িতা কবি ডেভিড ওয়াগোনার নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে ছিলেন এ্যংলো-স্যাক্সন বা শ্বেতাঙ্গ, কিন্তু বসবাস করেছেন স্প্যাসিফিক ওয়েস্টের নিসর্গ নিবিড় পরিবেশে, আমেরিকার আদিবাসী কৌমের সান্নিধ্যে, তাঁর অনেকগুলো কবিতায় নেটিভ আমেরিকান জনগোষ্ঠির প্রকৃতিবিষয়ক ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়।
আমি রীতিমতো পাইন অর্চাডের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর কবিতার চরণগুলি ইয়াদ করার চেষ্টা করি,‘স্ট্যান্ড স্টিল/দ্যা ট্রিজ এহেড এন্ড বুশেজ বিসাইড ইউ আর নট লস্ট..’ বা ‘ দাঁড়াও সুস্থির হয়ে/ তোমার সামনে ছড়িয়ে আছে যে বৃক্ষরাজি কিংবা পেছনের ঝোপঝাড়, তারা কিন্তু হারায়নি পথরেখা..।’ বাকি লাইনগুলো মনে করতে পারি না, তাই বেরিয়ে আসি খোলামেলা রোদ্রকরোজ্জ্বল পরিসরে।
কিন্তু তিনি আরেকটি চ্যালেঞ্জিং প্রসঙ্গ তুলে ধরে হাজেরান মজলিশকে অনুরোধ করেন, ‘বাপুরা, ভেবে দেখো একবার, অন্যরাও যে তোমার সঙ্গে খারাপ সলুক করেছে, এটা যেমন সত্য, তুমিও হয়তো.. যে আন্তরিকভাবে তোমার উপকার করেছে, কিংবা ভালোবেসেছে, প্রতিদানে তাকে ইগনোর করেছো, অসম্মান করেছো তার নিবিড় আগ্রহকে, এ বিষয়টাও কিন্তু তোমার পাঁজরে শিলাপাথর হয়ে চেপে আছে।’
এদিকে বেশ দূরে দূরে দুই-তিনটি কাঠের কটেজ আছে। বালুকায় কাঁকড় ও নুড়ি মেশানো সড়কেরও তালাশ পাই। একটি স্প্রুস গাছে ডাল থেকে ঝুলছে তীর চিহ্ণ দেয়া নিশানা, নিচে লেখা ‘হোমমেইড ওয়াইল্ড রাইস প্লাস স্রিম্প এন্ড ভেজিটেবোল ডিনার, ১৫ ডলার, ক্যাশ প্লিজ’।
ওয়াইল্ড রাইস বা কালো রঙের শস্যদানা আমেরিকার কোন কোন আদিবাসী সম্প্রদায়ের স্টেপল বা প্রধান খাদ্য, চালটি ‘মানোমিন’ নামে পরিচিত, আগেও খেয়েছি একাধিক বার, আরেকবার ভাজা চিংড়ির সাথে চেখে দেখার বসানা প্রবল হয়ে ওঠে। সংগীতের নৈশ অধিবেশনে পুরানো দিনের এক বান্ধবীও শামিল হচ্ছে। নেটিভ আমেরিকান কৌমের একটি গোত্রের মেয়েটির নাম ওশ্যান গ্রীন অলি। তার কথা ভাবতে ভাবতে অতঃপর দু’টি ডিনার প্যাকেট কেনার জন্য তীরচিহ্ণের নিশানা ফলো করি।
মোরাম বিছানো সড়কে দাঁড়িয়ে আছে নীল বর্ণের একখানা ভিনটেজ পিকাপ। এ মডেলের গাড়ি শ্রেভ্রলে কোম্পানী সর্বশেষ তৈরী করেছে সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর। বয়োবৃদ্ধ পিকাপটি পেশাদারী মেনটেনেন্সের কারণে এখনো হয়ে উঠেনি জরাজীর্ণ।
আমি বাহনটির ফ্রন্টাল ভিউ পাওয়ার জন্য ঘুরে সামনে আসতেই চোখে পড়ে, সড়ক থেকে সামান্য দূরে, সিমেন্টের ফ্রেমে আটকানো একটি সিরামিকের ডিস্ক; তাতে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ধীরে-সুস্থে আবর্তিত হচ্ছে আটটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রহ ও অনেকগুলো উপগ্রহ।
এ প্রতীকটি আদিবাসী সমাজের মুসকোগি ক্রিক গোত্র ব্যবহার করছে অনেকটা তাদের পরিচিতিমূলক মাসকট বা লগোর মতো। দাঁড়িয়ে পড়ে আমি ডিস্কটিকে স্টাডি করি। যতোটা জানি, আটারো শতকের পয়লা দিক অব্দি মুসকোগি কৌমের মানুষজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো, টেনিসি থেকে জর্জিয়া হয়ে আলাবামা অঙ্গরাজ্য ইস্তক। উল্লেখিত প্রতিটি অঙ্গরাজ্য ছিলো প্রথমত বিলাতের রাজার তাঁবে আলাদা আলাদা উপনিবেশ, এবং পরে এগুলো যুক্তরাষ্ট্র নামক ফেডারেশনের যুক্ত হয়।
১৮৩০ সালে ‘ইন্ডিয়ান রিম্যুভেল এক্টে’র মাধ্যমে অত্র এলাকায় বাসরত মুসকোগি গোত্রকে ‘ফোর্সড রিলকেশন’ কিংবা জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করার হুকুম জারী করা হয়। এ ধরনের কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তা আঁচ করতে পেরে কিছু মুসকোগি মানুষ নিশিরাতের অন্ধকারে নদীপথে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়, পার্শবর্তী স্প্যানিশ উপনিবেশ ফ্লোরিডায়। কালে কালে তাদের সংরক্ষিত গ্রাম গড়ে উঠে এভারগ্লেইড নামক নোনাজল জারিত নিসর্গনন্দন জলাভূমির উত্তরে।
ডিস্কের আড়াল থেকে মাইক্রোফোন জাতীয় কিছুর ক্রেকলিং সাউন্ড হয়। চমকে উঠে আমি এদিক ওদিক তাকাই। প্রায় তিন একর দূরে একটি উডেন কটেজের জানালায় ছায়া পড়ে। আমি কৌতূহলি এক নারীমুখের গোলাগাল আদল যেন দেখতে পাই।
বাতাসে ভেসে আসে বার্বিকিউ সচে জারিত আধপোড়া চিংড়ি মাছের গন্ধ। খোনা গলায় অদৃশ্য মাইক্রোফোনে কেউ একজন জানতে চায়,‘ ওয়ান্ট অ্যা ওয়াইল্ড রাইস ডিনার টেকআউট?’ আমি সম্মতি জানিয়ে দু’টি ডিনারের অর্ডার পেশ করি। সাথে সাথে মাইক্রোফোনটি অফ হয়ে যায়। আমি ফের ডিস্কটিকে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি।
শুনেছি যে, মুসকোগি ক্রিকদের মুখে মুখে প্রচলিত লোকগাঁথায় একটি কেন্দ্রীয় নক্ষত্রকে আমাদের গ্রহ বা পৃথিবীতে জীবনের আদি উৎস হিসাবে বর্ণনা করা হয়। এ নক্ষত্রটি বলাবাহুল্য আমাদের কাছে সূর্য নামে পরিচিত, এবং সূর্যের সাথে অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের সম্পর্ক বা মাধ্যাকর্ষণ যে সৌরমন্ডেলের অস্তিতত্ত্বের প্রধান চালিকা শক্তি, এ বাবদে মুসকোগির কৌমের মানুষজনরা শত শত বছর পূর্বে, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যে তথাকথিত বিজ্ঞানের অভির্ভাবের আগেও সচেতন ছিলো। আরেকটি বিষয়ে তাদের আদি জ্ঞানের সূক্ষতা যথা-সৌররশ্মির সঙ্গে শস্য এবং বহতা জীবনের সঙ্গে সৌরকর-পুষ্ট খাদ্যের সম্পর্ক, প্রভৃতিও আমাকে দারুণভাবে চমৎকৃত করে।
দুটি ডিনারের টেকআউট প্যাকেট নিয়ে গোদা পায়ে থপথপিয়ে, ঘাস, দন্ডকলস ও চোরকাঁটা ধামসে ব্যাপক ভারি দেহের একজন মানুষ এগিয়ে আসেন। চেহারাসুরতে তাঁকে গামা পয়লোয়ানের মতো শক্তিমত্ত মনে হয়। ক্যাশ পয়সা দিয়ে খাবার কিনতে কিনতে ভাবি, এ রকম বেজায় বলবান কাউকে তো কখনো আমি ভাত বিক্রি করতে দেখিনি!
মানুষটি সম্ভবত মুসকোগি কৌমের একজন, ওয়াইল্ড রাইস বিক্রি করা ছাড়া তাঁর ভিন্ন কোন পেশা আছে কী? জানতে বাসনা হয়, নীল রঙের ছোট্টমোট্ট ভিনেটেজ্ পিকাপে তিনি যখন সওয়ার হন, ড্রাইভিং সিটের সংকীর্ণ পরিসর তার ব্যাপক দেহটি কীভাবে ধারন করে?
তিনি টেকআউট ডিনার বাবদ টাকা কটি গুনে ফতুয়ার পকেটে ফেলে জলদগম্ভীর স্বরে আমাকে ‘এনজয় দ্য লাইভ নেটিভ আমেরিকান রিদম’ আওয়াজ দিয়ে উইশ করেন। আমি বলেই ফেলি,‘ মিউজিক ফেস্টিভেলে যাওয়ার ট্রেইলটি কোন দিকে, স্যার?’
স্থূলকায় বান্দাটি ব্যক্তি হিসাবে খারাপ না, বরং সদালাপি, ঝোলাগোঁফের ফাঁকে গোয়ামুরি হাসি হেসে তিনি আমাকে ফেরার সঠিক পথটি বাতলে দেন। তখনই খেয়াল হয়, তাঁর পনিটেইল জাতীয় চুটিবলা দীর্ঘ কেশের গোঁড়ায় ক্লিপ দিয়ে আটকানো পেল্লায় সাইজের গলদা চিংড়ি, গলা থেকেও লকেট হয়ে ঝুলছে সিন্ধুঘোটকের বিগ্রহ, এগুলো কেন ঝুলিয়েছেন, কী দিয়ে তৈরী, ধারনে কোন উপকারিতা আছে কিনা, কিছুই জানা হয় না, কিন্তু সঠিক ট্রেইলে পা দিয়ে ভাবি, বেজায় বিরাট আকারের একজন ভাতবিক্রেতাকে যে চাক্ষুষ করতে পারলাম, তা-ই বা মন্দ কী? ইনার সঙ্গে মোলাকাত না হলে ঘনায়মান সন্ধায় আউরি লেগে তো জংগলে স্রেফ ঘুরপাক করতে হতো।
সঠিক পথরেখায় নিজস্ব তাঁবুতে ফেলা কঠিন কিছু হয় না। তবে ঔষধপত্র গেলার ধুন্দর-মুন্দুরে মিনিট বিশেক লেগে যায়। অতঃপর যখন এম্বার-মাস্কি এসেন্সে ফ্রেশেনআপ হয়ে মিউজিক মজমার পরিসরে এসে পৌঁছি, উপবনের উপত্যকায় জরাজীর্ণ স্মৃতির মতো গোধূলি মুছে গিয়ে জমে উঠছে আধোন্ধকার সায়ান্ন। আলোকিত ডায়াসে জনা কয়েক নাম না জানা বাদক সমবেত তালে চাটি মারছেন ‘পাওআও ড্রাম’ বা জমায়েত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বিশেষভাবে নির্মিত বিশাল একটি ঢোলকে।
চেয়ারে বসতে বসতে মাইক্রোফোনে নেটিভ অঅমেরিকান কৌমের বিখ্যাত একজন নৃত্যশিল্পী উইন্ডড্যান্সার মহোদয়ের কন্ঠস্বর শুনতে পাই। তিনি সকলকে দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণে কান পেতে জননী পৃথিবীর হার্টবিট শুনতে আমন্ত্রণ জানান। দ্রিম..দ্রিম..থ্রপ.. থ্রপ ধ্বনিপুঞ্জ যেন তৈরী করে সম্মোহনী ব্যঞ্জনা। তার সাথে তাল-লয় বজায় রেখে উইন্ডড্যান্সার আসন্ন হুপ ড্যান্স সম্পর্কে মৃদুস্বরে কিছু তথ্য দিয়ে শ্রোতা-দর্শকদের অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করে তুলেন।
‘হুপ’ হচ্ছে উইলো গাছের স্থিতিস্থাপক ডাল বাঁকিয়ে বৃত্তাকারে তৈরী রিং। হুপ ড্যান্সাররা এ ধরনের রিং ব্যবহার করে থাকেন ‘ নেভার এন্ডিং সাইকোল অব লাইফ’ বা ‘অশেষ জীবনচক্র’কে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য। উইন্ডড্যান্সার হাজেরান মজলিশকে জীবনের ‘নো বিগিনিং এন্ড নো য়েন্ড’ বা ‘ না শুরু ও না শেষ’ প্রক্রিয়াটিকে বোঝানোর জন্য কিছু উপমা ব্যবহার করেন।
সংসারে জন্ম ও মৃত্যু কিন্তু সমান্তরালভাবে চলছে, কারো মৃত্যু হলে, মরদেহ আদতে পুষ্টি যোগায় লতাপাতা ও বৃক্ষের বিকাশে, যা পরিবেশকে করে তুলে দিনযাপনের জন্য সহনশীল। খাদ্য ও পুষ্টিতে জল,শস্য, সব্জি ও উদ্ভিদের অবদান তো সর্বজনবিদিত, জন্মদানের প্রক্রিয়ায় শামিল হওয়ার যে অন্তর্গত প্রেরণা, তার সাথে খাদ্যের সংযোগ নিয়েও তেমন কোন বিতর্ক শোনা যায় না।
একজন যুবক নৃত্যশিল্পী হাতের দুই কব্জিতে অনেকগুলো হুপ বা রিং নিয়ে মঞ্চে ঢুকে মাথা ঝুঁকিয়ে বাও করেন। উইন্ডড্যান্সার- যিনি তারুণ্যে হুপ ড্যান্সের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিলেন, উষ্ণভাবে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আওয়াজ দেন,‘গাইজ, প্লিজ ওয়েলকাম দ্যা নিউ ওয়াল্ড চ্যাম্পিওন অব হুপ ড্যান্স কোডি বয়েটনাম ফ্রম মুসকোগি ক্রিক ট্রাইব।’ আসরের কেউ কেউ এক্সাইটমেন্টে দাঁড়িয়ে পড়ে, আদিবাসী গোত্রের তরুণীরা উলুধ্বনি দেয়, যুবকরা নেচেকুঁদে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতীক খোদাই করা ডিস্ক উর্দ্ধে তুলে ধরে আওয়াজ দেয়, ‘ চেবি আব ও…ও জো… জো’, চতুরদিকে ছড়ায় প্রচুর অস্থিরতা, ক্যামেরাওয়ালারা মঞ্চের কাছ ভিড়তে গিয়ে উষ্টাবিষ্টা খায়।
ছেলেটি এক সাথে অনেকগুলো হুপ নিয়ে লোফালুফি শুরু করে, হুপের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। মাত্র দু দিন আগে এ মিউজিক মজমায় পরিচয় হয়েছে, এ রকম একজন বয়োবৃদ্ধ হিপি ডাফি সাহেব পাশ থেকে বলেন,‘ সুলতান পে এটেনশন… লুক … হি ইজ স্পিনিং দ্যা হুপ ক্লকওয়াইজ এন্ড কাউন্টার ক্লকওয়াইজ এ্যট দ্যা সেম টাইম… এর অর্থ হচ্ছে… কোডি হুপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলছে কসমোলজি বা মহাজাগতিক কায়-কারবারের নৃত্যচিত্র, সে বিশেষভাবে ফোকাস করছে আমাদের চেনা নক্ষত্রটিকে ঘিরে ঘুরপাক করনেওয়ালা গ্রহাদির বলয়ের ওপর।’ তাঁর কথাবার্তায় তেতোবিরক্ত হয়ে পাশ থেকে একজন সিরিয়াস গোছের শ্রোতা চাপাস্বরে বলেন ‘ শাট দ্যা ফাক ইয়োর মাউথ আপ…ম্যান’।
ধাতানিতে রীতিমতো ঘা খেয়ে আমি ঘাড় ফেরাই। হলুদাভ রঙের চুল-দাড়িতে ভবসব তরুণটি আমার মুখচেনা। তার টিশার্টে রঙতুলিতে আঁকা একটি কুকুরের ছবি, তার নিচে লেখা,‘ মাই লাভলি ডগ থিংক আই অ্যাম অ্যা জিনিয়াস।’
কোন এক সারমেয়র দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিভাবান বিবেচিত পুরুষটির কাঁধে জড়ানো নামাবলীর মতো হাল্কা আলোয়ানে অনেকগুলো ডালমেশন প্রজাতির কুকুরের ছবি। ফের হুলুধ্বনিতে আসর বিষ্ফোরিত হয়, বালিকারা হু.. লু.. লু..লু করতে করতে বেকরার হয়ে ওঠে। তাদের সমবেত ধ্বনি স্থিমিত হওয়ামাত্র আরেক দফা আওয়াজ ওঠে ‘চবি আব ও..ও জো.. জো’, কিছু নন-নেটিভ আমেরিকার শ্রোতা তেমন কিছু বুঝতে না পেরে খোদার খামোকা হায় হায় করে ওঠেন। পুরো ঘটনার অকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমি বেআক্কেলের মতো মুখখানা গম্ভীর করে ভাবি, বিষয়টার নোট নিতে পারলে আখেরে কাজে লাগবে।
আধো অন্ধকারে সকলে যেন দম বন্ধ করে হুপ ড্যান্সার কোডি বয়েটনামের শূণ্যে লাফিয়ে উঠে, হুপের ভেতর দিয়ে শরীর গলিয়ে বেরিয়ে এসে একসাথে গোটা ছয়েক হুপ নিয়ে লোফালুফির কেরেসমাতি দেখতে থাকে। কেউ কেউ কুলারের ডালা তুলে অপেন করেন বিয়ারের ক্যান। আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে লানি লংফেলো দাঁড়িয়ে পড়ে হাত নাড়ে।
গতরে অত্যন্ত সল্পবাস, দীর্ঘ চুল ও জংলা দাড়িতে তরুণটিকে নাগা সন্ন্যাসীর মতো দেখায়। লানি নিজেকে পরিচয় দেয় ট্যাটু আর্টিস্ট হিসাবে। সে একটি ক্যাম্পার ভ্যানে করে ট্যাটু বা উল্কি করে দেয়ার হাতিয়ারপত্র নিয়ে ঘুরছে। তার শরীরে- পায়ের পাতা থেকে কনের লতি অব্দি সর্বত্র উল্কির নানাবিধ চিত্র আঁকা।
এ নকশাগুলো প্রদর্শনী করার জন্য ছেলেটি নিমা জাতীয় খর্বাকৃতির টিশার্টের সঙ্গে কৌপিনের মতো শর্টস্ পরা ছাড়া অন্য কোন বস্ত্রাদি ব্যবহার করেনি। এ মুহূর্তে তার শরীরে প্যাচানো একটি তারগুনা থেকে ঝুলছে মরিচ বাল্ভ, তার সবুজাভ আলোয় উল্কি করা তসবিরগুলো ঝলমল করে। লানি লংফেলো ফের ওয়েভ করলে আমি দায়সারাভাবে ওয়েব ব্যাক করে চোখ ফেরাই। কিন্তু অনুভব করি, তরুণটি সম্মোহনী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তো ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনায় আমি সতর্ক হই।
গতকাল আমি লানির সঙ্গে খানিক কথাবার্তা বলেছি, তার পেশা সম্পর্কে স্রেফ সৌজন্যবশত আগ্রহও দেখিয়েছি। নাম করা সব পেইন্টার তথা পিকাসো, মাতিস বা সেজানের তৈলচিত্র বা জলরঙের প্রতিলিপি শরীরে অবিকলভাবে উল্কি করে দেয়াতে লানির স্প্যাশিয়েলটি আছে।
তার দক্ষতায় আমি চমৎকৃত হলে, সে আমার গতরে ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে উল্কি করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এমন কী – আরব্য উপন্যাসের কোন চরিত্র বা মহাভারতের কোন দৃশপট বুক থেকে তলপেট ইস্তক কিংবা তামাম পৃষ্টদেশ জুড়ে আঁকাতে চাইলেও সে কাজটি করে দেবে সোৎসাহে। কিন্তু সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বলে বক্ষদেশে গদাসহ ভীম আঁকিয়ে নেবো, এতোটা দুঃসাহসী আমি নই।
তো মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিয়েও তার হাত থেকে নিস্তার পাই না। লানি কাছে এসে আইফোনটি তুলে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,‘ হেই.. ওয়ানা সি মাই ওয়ার্ক..ম্যান?’ আমি স্ক্রিনে ভেসে উঠা একটি রমনীর পৃষ্টদেশের দিকে তাকাই।
তার অঙ্গে ফুটে ওঠেছে ইমপ্রেশনিস্ট ঘরানার ফরাসী চিত্রকর ক্লদ মোনের ‘ওয়াটার লিলি’ নামক দুনিয়াজোড়া মশহুর একটি চিত্র। লানি ফের ফিসফিসিয়ে জানায়, মেয়েটি বিয়ে করতে যাচ্ছে, তার ফিঁয়াসে চিত্র সমালোচক, সে পয়লারাতে বরকে সারপ্রাইজ দিতে চায়। আমি বেগানা নারীর বস্ত্রহীন সচিত্র দেহের দিকে তাকিয়ে ভাবি, তার সম্ভাব্য স্বামী হয়তো বাসরশয্যায় সমজদারের কায়দায় শাপলাফোটা দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে প্রত্যাশিত সংগম সম্পন্ন করার পরিবর্তে আর্ট রিভিউ লেখার কথা ভাববে।
উইন্ডড্যান্সার মহোদয় মঞ্চে ফিরে বাঁশরীতে তৈরী করেন হৃদয়ছোঁয়া ধ্বনি-তরঙ্গ। লানি লংফেলো ফের বকোয়াস শুরু করে, গলা খাকারি দিয়ে জানতে চায়,‘ আমি তোমাকে উল্কির কতগুলো একসেপশন্যাল ডিজাইন পাঠালে, তুমি কী তা রিভিউ করে দেখবে?’ আমি জবাব দেয়ার কোন সুযোগ পাই না, গতরে নামাবলির মতো কুকুরের ছবি আঁকা হাল্কা আলোয়ান জড়ানো পুরুষটি এগিয়ে এসে ফের চাপাস্বরে বলেন,‘গাইজ, গো এন্ড ফাক ইয়োরসেল্ফ’।
উইন্ডড্যান্সারের বাঁশরীর প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল হতে চাই, তাই কুকুরওয়ালার রূঢ় সংলাপে বিরক্ত হই না একবিন্দু, বরং সাহস করে ইশারায় উল্কিওয়ালাকে তফাত যেতে বলি।
ঘাসে শরীর ঘষটে কাছে এসে ডাফি সাহেব নোটবুকে পেন্সিল দিয়ে কিছু একটা লিখে আমার দিকে বাড়িয়ে দেন। তিনি লিখেছেন,‘ আই অ্যাম স্যারি ফর মেকিং নয়েজ, লেটস্ স্টে সাইলেন্ট এন্ড বি রেসপেক্টফুল টু উইন্ডড্যান্সার।’
উল্টাপিটে লিখে আমি জানতে চাই, কুকুরওয়ালা তার চেনা কি না? আমাদের চিরকুট চালাচালি চলতে থাকে, জানতে পারি, হলুদাভ চুলদাড়িতে ভবসব সারমেয়প্রিয় তরুণটি পেশায় একজন ডগ গ্রুমার, সে পুডুল জাতীয় কুকুরের কেশ কাটা, লোম ছেড়া প্রভৃতি বিষয়ে কমিউনিটি কলেজ থেকে রীতিমতো ডিগ্রি পাওয়া ব্যক্তিত্ব। তার ক্যম্পার ভ্যানে আছে কুকুরের কেশ কর্তনের ছোট্ট একটি সেলুন।
ট্রাইব্যাল মটিফের কাফতান জাতীয় ফ্লোয়ি ড্রেসে শরীর জড়িয়ে, লন্ঠন হাতে জমায়েতের ভীড়ভাট্টার ভেতর দিয়ে সাবধানে এগিয়ে আসে ওশ্যান গ্রীন অলি। তাকে দেখতে পাওয়া মাত্র চোখে ইশারাত্মক ভঙ্গি করে ডাফি সাহেব ছটফটিয়ে তার নোটবুক-পেন্সিল ঘাসে ফেলে রেখে, পাছা ঘষটে ঘষটে তফাতে সরে যান।
প্রাইভেসীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষটিকে ইঙ্গিতে ধন্যবাদ জানাতে চাই, কিন্তু আমার দৃষ্টিপথ ব্লক করে ততোক্ষণে বসে পড়েছে অলি। তার শরীর থেকে ছড়ায় লেবুপাতার তাজা ঘ্রাণ। হ্যারিকেন জাতীয় লন্ঠনটি বোধ করি বেটারি লাগানো, সে নভ ঘুরিয়ে তা লাইট করে। নারোম আলোয় আমি অলির দিকে তাকাই। কাফতানের লো নেকলাইনে উন্মোচিত হওয়া পরিসরে ঝুলছে রূপার আংটায় আটকানো রঙচঙে একটি পাখির পালক।
অনেক বছর আগে, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসার সময় স্যুটকেসে করে অল্প যে কয়েকটি বই নিয়ে এসেছিলাম, তার একটি, তথা কবি ফররুখ আহমদের ‘সাত সাগরের মাঝি’ বইটির বুকমার্ক হিসাবে এ বর্ণাঢ্য পালকটি অতলান্ত পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আভিবাসী হয়েছিল।
আমাদের বন্ধুত্বের পয়লা দিকে কোন এক সময় আমি অলিকে জন্মদিনে পালকটি উপহার দেই। প্রায় দুই দশক পর টাঙ্গাইলের মুনিয়া পাখির একটি পালকের গলায় হারে রূপান্তরিত হওয়াতে খানিকটা অবাক লাগে। তারুণ্যে তার পোষাকের নেকলাইনে যে ধরনের স্টাইল আমি পছন্দ করতাম, যাকে ফ্যাশনের পরিভাষায় যে ‘সুইটহার্ট কাট’ বলা হয়, তা জানতে পেরে, বিভাজনের কম্পনে যে ভাবে উদ্দীপ্ত হতাম, তার পরিবর্তে আজ, এ মুহূর্তে টপের নকশাটি ছড়াচ্ছে স্রেফ নস্টালজিক মুগ্ধতা, আমার প্রতিক্রিয়ার নিজেরই অবাক লাগে!
অলি কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমাকে অবলোকন করে, কিন্তু কিছু বলে না। হাত বাড়িয়ে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ডাফি সাহেবের ফেলে যাওয়া নোটবুকটি তুলে তাতে লেখে,‘ হ্যাভ ইউ ফরগটেন আবাউট দ্যা ডিনার?’
জবাবে আমি ব্যকপ্যাক থেকে টেকআউটের প্যাকেট দুটি বের করি। এলুমিনিয়াম ফয়েলের মোড়ক খুলে সে খাবার পরীক্ষা করে নোটবুকে লিখে,‘ ডু ইউ রিমেমবার দ্যা মিনিং অব দি ওয়ার্ড মেগওয়েচ? শব্দটা আমি তোমাকে শিখিয়ে ছিলাম।’
আমি একটু ঝুঁকে গিয়ে নিচে লিখি,‘ইয়েস আই ডু, তোমাদের ভায়ায় এর অর্থ হচ্ছে-থ্যাংক ইউ।’ খুশি হলো কি না- তা দেখার জন্য চোখ তুলতেই আমার গন্ডদেশে তার ঠোঁটের ছোঁয়া লাগে। ফিক করে হেসে অলি ফিসফিসিয়ে বলে,‘ আই সি, ইউ স্টিল ইউজ দ্যা মাস্কি এ্যম্বার এসেন্স।’
ওয়াইল্ড রাইসের কৃষ্ণাভ দানার উপর ছড়িয়ে আছে গোটা কতক আধপোড়া চিংড়ি, গ্রীল করা স্কোয়াস, কেপসিকাম, হালাপিনো মরিচ ও ট্যমেটোর সাথে পেঁয়াজ মিশ্রিত চুকা সালসা। খানাপিনা বেশ ভালোই জমে, কিন্তু খেয়াল হয়, আমি পানীয় বলে কিছু জোগাড় করিনি। ইশারায় সীমাবদ্ধতা স্বীকার করলে অলি ফের নোটবুকে লিখে,‘ আই নো ইউ উইল মিস ওয়ান থিং অর আদার ,’ বলেই সে পেটমোটা পার্স থেকে বের করে কোকোনাট ওয়াটারের দুটি ক্যান।
হঠাৎ করে শামান ড্রামটিতে এমন বেমক্কা চাটি পড়ে যে, আওয়াজে মনে হয়, আমাদের ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে অদৃশ্য কেউ যেন ছিটিয়ে দিলো বরফ-ঠান্ডা জল। কান খাড়া করি, ঢোলকের দিলদরাজ ধ্বনি মৃদু হতে হতে মিলিয়ে যায়, সাথে সাথে উইন্ডড্যান্সারের গাঢ় কন্ঠস্বরে মন্দ্রিত হয়ে উঠে মাইক্রোফোন। কব্জিতে অনেকগুলো হুপ কষে ধরে কোডি বয়েনটাম নেটিভ আমেরিকার কোন ট্রাইব্যাল চিফের উডওয়ার্ক স্ট্যাচুটির মতো নিষ্কম্প্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
উইন্ডড্যান্সার গল্প বলে যান। ধরা যাক আদিবাসী এক দম্পতির পুরুষটির নাম তাদের ট্রাইবের কেতানুযায়ী কমেট মুন, সে তার স্ত্রী গ্রীন গ্রাসহপারকে নিয়ে রিজারভেশন বা তাদের বুনিয়াদি পল্লী ছেড়ে ঘর বেঁধেছে মেট্রোপলিটান সিটিতে। যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার সংস্কৃতির সাথে এডজাস্ট করতে গিয়ে তারা নিজেদের নাম বদলে করে নিয়েছে গ্রেগ ও স্টেলা। তাদের আট বছরের ছেলে-সন্তান মাইককে পাঠাচ্ছে পাবলিক স্কুলে। কোডি বয়েনটাম শরীর অষ্টবক্র করে ছোট্ট একটি হুপের ভেতর দিয়ে গলে যাওয়ার চেষ্টা করে।
উইন্ডড্যান্সার গল্পটি কনটিনিউ করেন; স্কুলে গাত্রবর্ণ ও মুখের ডৌল-তসবির ভিন্ন হওয়ার কারণে শ্বেতাঙ্গ ক্লাসমেটরা মাইককে ‘রেডফেস পাপুস’ বলে খেপায়। আদিবাসীদের জন্য অত্যন্ত অসম্মানজনক এই শব্দ দুটি ব্যবহার করা ছাড়াও তারা দল বেঁধে শিক্ষকদের আড়ালে মাইককে ‘বুলিং’ বা মারপিট করে, কখনো ছিড়ে ফেলে বইপত্র, লাঞ্চবক্সে মিশিয়ে দেয় ডাস্টবিনের পঁচা ট্র্যাশ ইত্যাদি।
এ নিয়ে পিতামাতাকে বারবার স্কুলে টেলিফোন করে কমপ্লেইন করতে হয়। ফল কিছু হয় না, উল্টা তাদের মেইলবক্সে কেউ রেখে যায়,আদিবাসী আমেরিকানদের বিদ্রুপ করে কার্টুনের ভঙিতে আঁকা অশ্লীল চিত্রাদি।
চলমান জীবনের এ হুপটি অতিক্রম করতে যখন দম্পতির দারুণ বেগ পেতে হচ্ছিল, তখন কমেট মুন উরফে গ্রেগকে ছাটাই করা হয় চাকুরি থেকে। তাদের জীবনকে ঘিরে ঘুরপাক করতে শুরু করে অদৃষ্টের দ্বিতীয় হুপ।
কোডি বয়েনটাম একসাথে দুটি হুপকে রাহু ও কেতুর মতো চক্রাকারে তার দেহের চারদিকে ঘুরাচ্ছে..। উইন্ডড্যান্সার মহোদয় এবার তৃতীয় হুপের বর্ণনা দেন। গ্রীন গ্রাসহপার উরফে স্টেলাকে যেতে হয় হাসপাতালে, পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর ডাক্তার তার ব্রেস্ট-ক্যান্সারে সংক্রমিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
এভাবে তাদের দিনযাপনের মোট ছাব্বিশটি সমস্যার বর্ণনা দিয়ে উইন্ডডান্সার মহোদয় বিরতি নেন। আমরা তাজ্জব হয়ে দেখি, কোডি বয়েটনাম.. সমসংখ্যক হুপ একত্রে ঘোরাতে ঘোরাতে একটি স্থির বিন্দুতে নিয়ে এসে রিংগুলো জমা করছে দু-হাতের কব্জিতে।
কাহিনীর সাথে হুপের ঘূর্ণনচক্র দেখতে দেখতে রীতিমতো খেই হারিয়ে আমরা তব্দিল হয়ে বসেছিলাম। উইন্ডড্যান্সার আরেকটি বিষয়ে আমাদের সচেতন করে তুলেন। বিবিধ সমস্যার চক্করে জড়িয়ে মানুষের সংসারে জট লেগে যাওয়াতে গ্রেট স্পিরিট বা স্রষ্টার হাত কতখানি আছে, সে সম্পর্কে তিনি ঠিক ওয়াকিবহাল নন, তবে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে, ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন মানুষ তথা অনমনীয় আত্মীয়স্বজন, চাকুরীতে বস, ঈর্ষাবাজ সহকর্মী কিংবা চালিয়াত ব্যবসায়ী প্রমূখের যে হাত আছে, এ ব্যাপারে তিনি হানড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত।
সমস্যাদীর্ণ ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার বহু বছর পরও, যাদের হাতে এক সময় তুমি নাস্তানাবুদ হয়েছো, যারা জেনেশুনে তোমার সঙ্গে বেঈনসাফি করেছে বা অনায্যভাবে ঠকিয়েছে, তাদের প্রতি কিন্তু প্রচ্ছন্ন ক্রোধ বা প্রতিশোধের স্পৃহা পশমী শালে অজান্তে ছিটকে পড়া ছিটকে পড়া গনগনে অংগারের মতো ক্রমাগত পোড়াতে থাকে।
এটা থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় হিসাবে উইন্ডড্যান্সার আদিবাসীদের সমাজে প্রচলিত একটি ট্র্যাডিশনের উল্লেখ করেন। আদিবাসীদের কোন কোন সম্প্রদায় ঘটা করে আয়োজন করে হুপ ড্যান্সের, তারপর কেথারসিস হিসাবে তারা চেষ্টা করে, যাদের হাতে অতীতে তারা নাস্তানাবুদ হয়েছে, তাদের ক্ষমা করে দিতে।
আমার সঙ্গে অতীতে কিছু মানুষ বেঈনসাফি করেছ, বেঈমানি বা নাহকভাবে ইনসাল্টও করেছে কেউ কেউ। এদের স্রেফ জুতাপেটা করতে পারলে আমি অতি-অবশ্য প্রীত হতাম, কিন্তু নানা কারণে এদের নাগাল পাওয়া মুশকিল। সুতরাং উইন্ডড্যান্সার মহোদয়ের পরামর্শ মোতবেক ‘খালাস’ বলে শ্যালকদের ক্ষমা করে দেই।
কিন্তু তিনি আরেকটি চ্যালেঞ্জিং প্রসঙ্গ তুলে ধরে হাজেরান মজলিশকে অনুরোধ করেন, ‘বাপুরা, ভেবে দেখো একবার, অন্যরাও যে তোমার সঙ্গে খারাপ সলুক করেছে, এটা যেমন সত্য, তুমিও হয়তো.. যে আন্তরিকভাবে তোমার উপকার করেছে, কিংবা ভালোবেসেছে, প্রতিদানে তাকে ইগনোর করেছো, অসম্মান করেছো তার নিবিড় আগ্রহকে, এ বিষয়টাও কিন্তু তোমার পাঁজরে শিলাপাথর হয়ে চেপে আছে।’
তিনি এবার অনুনয়ের ভঙ্গিতে আবেদন জানান,‘গাইজ থিংক কেয়ারফুলি, তুমি হয়তো জানো না, গিল্ট ফিলিং কড়া ওষুধে একজিমার মতো তোমার চর্মতলে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। সো থিংক কেয়ারফুলি এগেইন, চেষ্টা কর নিজ জীবনের এ হুপটি অতিক্রম করতে, প্রতিজ্ঞা করো- যাকে অবজ্ঞা করেছো, অসম্মান করেছো, তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার।’
কোডি বয়েটনাম নৃত্য করতে করতে মাইফেলে ছুড়ে দিচ্ছে অনেকগুলো হুপ। যাদের হুপ ঘোরানোতে প্র্যাকটিস আছে, তাদের কেউ কেউ রিংটি তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি ঘোরাচ্ছে।
উইন্ডড্যান্সার মহোদয় বিষয়টা সকলের জন্য সহজ করে দিয়ে বলেন, হুপ যে ঘুরাতে হবে, তা নয়, বিকল্প হিসাবে তিনি চোখ মুদে যাকে অবহেলা করেছো, বা যার প্রতি খারাপ আচরণ করেছো, তার কথা ভাবতে বলেন।
আমি চোখ বন্ধ করতেই ত্রিনয়নের আলোয় ভেসে উঠে ওশ্যান গ্রীন অলির নেকনাইক শোভিত করে ঝোলা মুনিয়ার পাখির পালকটি। টাঙ্গাইলের কোন মুনিয়া আমাকে তার পালক গিফ্ট করেনি। বর্ণাঢ্য বস্তুটি আমি পেয়েছিলাম এক জনের কাছ থেকে প্রীতিউপহার হিসাবে। স্বীকার করতে বাধ্য হই যে, বিনিময়ে আমি তাকে অবহেলা করেছি, তার পাঠানো চিঠিপত্রও আমি শুধু অবজ্ঞা করিনি, কয়েক ছত্রের জবাব না লিখে রীতিমতো অসম্মান করেছি।
উইন্ডড্যান্সার মহোদয় তুরুপের তাসের মতো তাঁর শেষ পরামর্শটি পেশ করেন,‘ লিসেন গাইজ, এ সব পরিস্থিতিতে ইমেইল বা ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার না করে সামনা সামনি বসে ইন পার্সন ক্ষমা চাইলে হৃদয়মন পরিষ্কার হয় দ্রুত।’
দেখা-স্বাক্ষাতের সম্ভাবনার কথা ভাবতেই আতঙ্কে আমার অস্থির লাগে। পালক উপহার দেয়া নারীটি বর্তমানে বহাল তবিয়তে বিবাহিত। তার স্বামী একজন যশস্বী পন্ডিত। শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র শর্মার পুস্তাকাদির ওপর অভিসন্দর্ভ লিখে ডক্টরেট লাভ করেছেন। স্কন্ধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ঝুলিয়ে অধ্যাপনা করতে বেরোন। ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য তাঁর বসতবাড়িতে গিয়ে পন্ডিত প্রবরের মুখোমুখি হলে, তিনি না বিদ্যাসাগরী চটি জোড়া হাতে নিয়ে আমাকে ধাওয়া করেন.. ।
চোখ খুলতেই দেখি, হুপ ড্যান্সের তামাদি হয়েছে, কোডি বয়েটনাম রাজ্যের সব হুপ গলায় ও বাহুতে জড়িয়ে ঝুঁকে বাও করে বিদায় নিচ্ছে। ফ্রাইপ্যানের তপ্ত বালুকায় মুড়ি ফোটার মতো খুব ম্রিয়মানভাবে হাততালি পড়ে।
এমন জবরদস্ত পারফরমেন্সের পরও অডিয়েন্স ঠিক উচ্ছসিত হলো না, বিষয় কী, তা বোঝার চেষ্টা করি। আশপাশের কয়েকজন শ্রোতা-দর্শকের চোখমুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ‘ইন পার্সন’ ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাবনায় অনেকই ক্যামন যেন ঘা খেয়ে গেছেন, জোরেশোরে হাততালি দেয়ার মতো উচ্ছ্বাস আর অবশিষ্ট নেই। মানসিক দ্বিধাদ্বন্ধে পড়লে আমার এভোয়েডেন্সের স্বভাব আছে। ভাবি, সান্ধ্য অধিবেশনের শেষ দিকে একটু ধকল গেলো, এবার উঠে পড়া যাক।
— সমাধি সৌধের সুদৃশ্য স্ট্রাকচার (Cript)
— মোরাম বিছানো সড়কে দাঁড়িয়ে ভিনটেজ পিকাপ (Vintage Pickup)
— মুসকোগি ক্রিক গোত্রের প্রতীক- সিরামিকের ডিস্ক (Creek_Disc)
— হুপ ড্যান্সার কোডি বয়েটনামের নৃত্যকলা (Hoopdance)