হেগেল: সত্তাচিন্তার প্রজ্ঞাপাঠ । সন্তর্পণ ভৌমিক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১২:৪১ পূর্বাহ্ণ, | ৫৮৯ বার পঠিত
এক
যারা ভাষা, সংস্কৃতি, দেশ ও চিন্তার লোকায়ত চারিত্র নিয়ে ভাবেন, আলোচনা করেন, ভাবতে আগ্রহী, তারা হেগেলের নাম শুনেন নি অথবা তাঁর দর্শন পড়েন নি—এটা ভাবা বাতুলতা মাত্র। শিক্ষিত মানুষের চিন্তামাত্রই knowingly or unknowingly হেগেল দ্বারা প্রভাবিত। হেগেলের দর্শনের চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে, এবং হচ্ছে। হেগেলের দর্শনের প্রয়োজনীয়তা হয়তো ফুরিয়ে গেছে, তথাপি গত প্রায় চারশ’ বছর ধরে মানুষের শিক্ষিত চিন্তার ধারক ও পরিপোষক Georg Wilhelm Friedrich Hegel। ২৭ আগস্ট ১৭৭০ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে জন্ম হয় হেগেলের। হেগেলের বাল্য জীবন নিয়ে বিভিন্ন রকম পরস্পরবিরোধী মত ও অমত প্রচলিত। উদাহরণ স্বরূপ, তাঁর পিতার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। মোটামুটি যা জানা যায় তা হলো তাঁর পিতা Georg Ludwig ছিলেন প্রাদেশিক অর্থবিভাগের একজন নিম্নপদস্থ কর্মচারী। স্বচ্ছল জীবন যাপন ছিল বলে মনে হয় না। হেগেলের মা Maria Magdalena Louisa ছিলেন হাইকোর্টের এক উকিলের কন্যা। এক অস্বচ্ছল পরিবারে একরকম সংগ্রামী জীবন অতিবাহিত করেছেন। হেগেলের ১৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান। হেগেল ছাত্র হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন না। শেক্সপিয়ার যেরকম প্রাতিষ্ঠানিক ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ ‘দুর্বল’ ছিলেন, হেগেলও সেইরকম দর্শনে মোটেই ভালো ফলাফল করতে পারেন নি। University of Tübingen-র সনদে লেখা ছিল, ‘তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী। ভাষা বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বে তিনি সবিশেষ পারঙ্গম, কিন্তু দর্শনশাস্ত্রে অতিশয় দূর্বল’।
সামান্য গৃহশিক্ষকতা দিয়ে হেগেলের কর্মজীবন শুরু। কিন্তু এই সময়টা হেগেলের দার্শনিক জীবনের ভিত্তিভূমি বলা যায়। আর্থিক দৈন্যতা থাকলেও এই সময় তিনি নিজেকে ভেঙেচুরে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেন। কারণ এই সময়ে তিনি গ্রীক ইতিহাস, সংস্কৃতি ও দর্শন গভীর মনোযোগের সাথে আয়ত্ত করেছিলেন। এথেন্সের সাহিত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর যে অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল, তার কৃতিত্ব তাঁর প্রথম কর্মজীবনের পঠনপাঠনের ফল। শোনা যায়, এই সময়ে তিনি যিশু খ্রিস্টের উপর একখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যিশুর অলৌকিক জীবন যাপন ও জন্মের কাহিনিকে তিনি পরিত্যাগ করে যিশুকে মানুষ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন, যদিও এই গ্রন্থখানি তিনি পরে নষ্ট করে ফেলেছিলেন বলে জানা যায়।
পিতার মৃত্যুর পর হেগেল ১৫০০ ডলার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। এর ফলে তিনি প্রাইভেট টিউটরের কাজটি পরিত্যাগ করেন। বই পড়ার প্রতি আকর্ষণ যে কী প্রবল ছিল হেগেলের এই সময়ে বন্ধুর প্রতি লিখিত এক চিঠিতে টের পাওয়া যায়। শেলিংকে (Friedrich Wilhelm Joseph Schelling) তিনি লিখেছিলেন যেখানে বইয়ের প্রাচুর্য আছে সেরকম কোনো নগরীতে তিনি বসবাস করতে ইচ্ছুক। তাঁর এই ইচ্ছা অনুযায়ী শেলিং তাকে জেনা (Jena) নগরে বসবাস আরম্ভ করার পরামর্শ দেন। হেগেল আনুমানিক ১৮০১ সালে জেনা নগরে গমন করেন এবং ১৮০৫ সালে University of Jena-র অধ্যাপক নিযুক্ত হন। শেলিং এই চাকরি পাওয়ার জন্য বিশেষ সহায়তা করেছিলেন বলে অনেকের ধারণা। এখানে আসার মাত্র কিছুদিন আগে হেগেলের প্রথম দার্শনিক গ্রন্থ The Difference Between Fichte’s and Schelling’s Systems of Philosophy প্রকাশিত হয়েছিল। জেনা’তে শেলিং-র সহায়তায় হেগেল Critical Journal of Philosophy নামে এক পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। হেগেল এই পত্রিকাতে শেলিং-র মতামতকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে, দার্শনিক মতৈক্য রেখে অনেক প্রবন্ধ রচনা করেন। এই সময়ে হেগেল ও শেলিং দুজনেই বিশ্বাস করতেন বিষয় ও বিষয়ীর সংযোগ ভিন্ন জ্ঞান সৃষ্টি হতে পারে না। যেমন শুধু ‘আমি’, অথবা শুধু ‘বই’ জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারে না। আমি বই পড়ি —যখন আমি (বিষয়ী) এবং বই (বিষয়) একইসঙ্গে সংযুক্ত হয়, তখনই বই সম্বন্ধে জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ক্রমে ক্রমে দুই বন্ধুর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। শেলিং আত্মা ও প্রকৃতির সম্পর্ক প্রমাণের জন্য এক অদ্বিতীয়, নিঃসঙ্গ ও নিস্পৃহ অস্তিত্বের কল্পনা করতেন, যে- অস্তিত্বের প্রকাশ দ্বিবিধ : আত্মা ও প্রকৃতি। এবং এই অস্তিত্ব আত্মা ও প্রকৃতির উভয়ের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য বিবর্জিত এক নিরপেক্ষ অবস্থা। হেগেল প্রথমে এই মতামতকে সমর্থন করলেও পরে তিনি এই ধারণা থেকে সরে আসেন। হেগেল আত্মা ও প্রকৃতিকে পৃথক সত্তা হিসেবে ভাবতে পারেন নি। আত্মা থেকেই প্রকৃতির সৃষ্টি, যেখানে দুইয়ের বিশেষণগত অবস্থিতি শূন্য। হেগেল Phenomenology গ্রন্থের ভূমিকায় এই নিয়ে শেলিং-র দর্শনের শ্লেষ্মাত্মক সমালোচনা করলে দুই বন্ধুর বন্ধুত্বের অবসান হয়।
প্রুশিয়া নেপোলিয়নের কাছে পরাজিত হলে জেনা নগরে একধরনের যুদ্ধকালীন আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে, ফরাসি সৈন্যরা নির্বিচারে জার্মানিতে লুটতরাজ শুরু করে। একদিন ফরাসি সৈন্যরা হেগেলের বাড়ি আক্রমণ করলে হেগেল প্রায় শূন্য হাতে পালিয়ে যান। তবে পালানোর সময় তিনি Phenomenology of Spirit গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন। এই ঘটনার পর থেকে কয়েক বছর হেগেলের জীবনের দুর্দিনের অধ্যায়। দারুণ অর্থকষ্টে তিনি দিনাতিপাত করেন। হেগেলের এই সময়কার তথ্য খুব একটা জানা যায় না। যা জানা গেছে তাও পরস্পরবিরুদ্ধ। তবে অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করলেও মুক্তচিন্তার চর্চায় তিনি মোটেই পিছিয়ে পড়েন নি। নুরেনবার্গ জিমনেসিয়ামে অধ্যাপক পদে থাকাকালীন সময়ে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ Logic-ই হচ্ছে তার প্রমাণ। এই গ্রন্থই হেগেলের জীবনের নতুন এক অধ্যায় উন্মোচিত করে। তিনি Heidelberg Universityতে অধ্যাপক পদে নির্বাচিত হন। ১৮১৭ সালে Heidelberg University-এ থাকাকালীন সময়ে হেগেল সুবৃহৎ ও সুবিখ্যাত Encyclopedia of the Philosophical Sciences প্রকাশ করেন এবং যার ফলশ্রুতিতে ১৮১৮ সালে তিনি University of Berlin-এর অধ্যাপক পদ প্রাপ্ত হন, এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন। এখান থেকেই তিনি দার্শনিক সম্রাট বলে সারাবিশ্বে পরিচিত ও নন্দিত হন। গ্যেটে হেগেলের সমকালীন ছিলেন, এবং সাহিত্য সম্রাট হিসেবে গ্যেটে তখন সারাবিশ্বে সুপরিচিত। অন্যদিকে বিটোভেন তখন সঙ্গীত সম্রাট হিসেবে সুনন্দিত।
হেগেল কোনো রাষ্ট্রের ‘চিরস্থায়ী শান্তি’কে অলীক কল্পনা বলে অভিহিত করেছেন। চিরস্থায়ী শান্তি বলে কিছু নেই, তা ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রই হোক না কেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি একক শান্তি প্রতিস্থাপক আন্তর্জাতিক সংস্থা বা আইনের তিনি কোনো সার্থক সম্ভাবনা দেখেন নি। হেগেলের মতে নিজের স্বাধীনতা রক্ষা করাই রাষ্ট্রের সর্বত প্রধান কর্তব্য। রাষ্ট্রের জীবন ও উদ্দেশ্য ব্যক্তির জীবন ও উদ্দেশ্যের চেয়ে মূল্যবান ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেহেতু ব্যক্তিগত জীবন উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকা প্রত্যেক মানুষের অবশ্য কর্তব্য।
দর্শনশাস্ত্রের সকল বিভাগেই হেগেলের সমান দক্ষতা ছিল। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শনশাস্ত্রের সকল বিষয়ই দক্ষতার সাথে পড়িয়েছেন। দর্শনের ইতিহাস, ধর্মের দর্শন, অধিকারের দর্শন, ইতিহাসের দর্শন, সাহিত্য ও কলার দর্শন—সর্বত্র তিনি সব্যসাচী ছিলেন। ছাত্ররা হেগেলের বক্তৃতার নোট সযত্মে রাখত। হেগেলের মৃত্যুর পর এই নোটগুলো ‘হেগেলের বক্তৃতা’ নামে প্রকাশিত হয়। প্রচুর অভিনব দার্শনিক তত্ত্ব ও তথ্য এর মধ্যে নিহিত।
তবে সুবক্তা হিসেবে হেগেল সেকালে কোনো পরিচিত পান নি। বাংলায় যাকে ‘বাগ্মী’ বলে, হেগেল সে অর্থে মোটেই তা ছিলেন না। তাঁর সমকালীন আরেক বিশ্বজয়ী দার্শনিক Johann Gottlieb Fichte অথবা তাঁর বন্ধু শেলিং সুবক্তা ছিলেন। অতি সহজ ভাষায় দর্শনের দুর্বোধ্য বিষয় এরা জনসমক্ষে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। সেদিক দিয়ে হেগেল ছিলেন জটিল ও মন্থর। তাঁর বক্তৃতার ভাষাও ছিল ভারাক্রান্ত। কথা জড়িয়ে যেত বহুলাংশে। তথাপি ছাত্রদের ভালোবাসায় হেগেলের সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না। জনশ্রুতি আছে, University of Zena তে থাকাকালীন সময়ে হেগেল যে- সময় ক্লাস নিতেন, হেগেলের বিশিষ্ট সমালোচক ও আরেক দার্শনিক দিকপাল Arthur Schopenhauer সেই সময়েই নিজের বক্তৃতার সময় একবার নির্দিষ্ট করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ছাত্ররা কেউ-ই হেগেলের ক্লাস ত্যাগ করে যান নি। জড়তা ও দুর্বোধ্যতা নিয়েই হেগেল তৎকালীন শিক্ষিত সমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।
প্রথম জীবনে হেগেল বিপ্লবের একান্ত সমর্থক ছিলেন। বিপ্লব ছাড়া কোনো রাষ্ট্র উন্নতি করতে পারে না—এ তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। তত্ত্ব অনুপযুক্ত, যদি তা বিপ্লবের সমর্থক না হয়। ১৮০৬ সালে নেপোলিয়ন জেনা নগরে যুদ্ধের জন্য উপস্থিত হন। হেগেল একজন যথার্থ বিপ্লবীকে দেখে কি তার ভাবাবেশ হয়েছিল, তা জানা যায় তাঁর লেখা একটি চিঠির মাধ্যমে। Friedrich Immanuel Niethammer কে তিনি লিখেছিলেন ‘I saw the Emperor —this world-soul—riding out of the city on reconnaissance. It is indeed a wonderful sensation to see such an individual, who, concentrated here at a single point, astride a horse, reaches out over the world and masters it’.
দুই
এলিয়াটিক (Eleatic: সক্রেটিস পূর্ববর্তী গ্রীক দার্শনিকরা) দর্শনে সত্তাই একমাত্র সত্য। ইহা নিত্য, সত্য ও ধ্রুব। এখানে সত্তা বলতে কি বুঝায়? প্রত্যেক বস্তু থেকে তার যাবতীয় বিশেষণ অথবা গুণাবলী বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে তাহাই সত্তা। এই সত্তা সর্বব্যাপী, অপরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল যা কিছু এই জগতে দেখা যায়, তাহা সত্য নয়। সত্তা এক ও অবিভাজ্য। বহুর কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। বহুত্ব ভ্রান্তির সমতুল। এলিয়াটিক দর্শন এও বলছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ সত্য হতে পারে না। ইন্দ্রিয় অনেক সময়ে প্রকৃত জ্ঞান ও বুদ্ধিকে প্রতারিত করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যাইতে পারে মরূদ্যান। চক্ষু দ্বারা জলের উপস্থিতি সম্যক বাস্তবিক মনে হলেও তাহা ভ্রমাত্মক, অবিবেচনাপ্রসূত। অতএব সত্তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। তাহলে কীসের দ্বারা এই অখণ্ড, অপরিবর্তনীয় সত্তাকে বুঝা যায়। এলিয়াটিক দার্শনিকরা বলছেন একমাত্র প্রজ্ঞা দ্বারাই সত্তাকে উপলব্ধি করা যেতে পারে। ‘চিন্তায় তাকে পাওয়া যেতে পারে, প্রজ্ঞা দ্বারা তাকে ধারণা করা যেতে পারে’। সত্তা প্রজ্ঞাগ্রাহ্য, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নহে, ইহাই এশিয়াটিক দর্শনের সারকথা। হেগেলও এই দর্শনকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু হেগেল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকেও অস্বীকার করেন নি। পরিবর্তিত আকারে নতুনতররূপে হেগেল এর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। ধরা যাক, একটি চিতাবাঘ ৬০ মাইল/ঘণ্টা বেগে ধাবমান। এটি একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য (যেহেতু দৃষ্টি বা চোখ দ্বারা জ্ঞান হচ্ছে চিতার ক্রিয়া) সত্য। চিতা এখানে গতিহীন, স্থির বলা যায় না। আবার বাগানে ১০০ বৃক্ষ আছে। তার মানে কি উদ্যানে একটির বেশি বৃক্ষ নেই? গতি ও বহুত্ব তাহলে কি? গতি ও বহুত্ব পরমার্থিক সত্য হতে পারে না। যা দেখছি এবং তা আসলে ব্যবহারিক সত্তা। যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য—সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রের রাত, বজ্র, বজ্রাহত আমি, বৃক্ষ—এরা ব্যবহারিক সত্তায় বর্তমান। এদের প্রত্যেকের বিশেষণ আছে। বিশেষণলুপ্ত শব্দ চিত্তবৃত্তিতে আসে না। এদের এইসব তথাকথিত বিশেষণ নিষ্কাশিত হলেই পরমার্থিক সত্তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যেতে পারে। প্লেটো ও এরিস্টটলকে বুঝতে হলে এই ব্যবধান জ্ঞান একান্ত আবশ্যক।
কিন্তু সোফিস্টগণ এইসব জ্ঞানকে অপরিণত ও বালখিল্য বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রোটাগোরাসের মতে যা আমার নিকট সত্য বলিয়া জ্ঞান হয়, তা আমার কাছে সত্য, আবার তোমার নিকট যা সত্য বলিয়া জ্ঞান হয়, তা তোমার নিকট সত্য। অর্থাৎ যা আমার প্রত্যক্ষ হয়, তা ব্যতীত অন্য কোনো সত্য নেই। প্রতিভাস ও পরমার্থ এক। এই প্রতিভাস কী? ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তাই প্রতিভাস। ইন্দ্রিয় কর্তৃক সব অভিজ্ঞতাতেই এক প্রকার সংবেদনশীলতা তৈরি হয়। এই সংবেদন সমন্বিত জ্ঞানই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছাড়া পরমার্থের জ্ঞানের উৎকর্ষ কোনোভাবেই হতে পারে না। প্লেটো অবশ্য এই সংবেদনজনিত জ্ঞানকে খণ্ডন করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন কেবলমাত্র সংবেদন হতে কোনো জ্ঞান পূর্ণ হতে পারে না। সংবেদনজনিত জ্ঞানের জন্য ইন্দ্রিয় ছাড়াও অতিরিক্ত আরেক বৃত্তির প্রয়োজন, তার নাম ‘বাক্য’। আমাদের সকল প্রকার বাস্তবিক/স্বাপ্নিক/অবাস্তবিক জ্ঞানই বাক্যের আকারে প্রকাশিত হয়। আমরা বাইরে কোনো communication বা সম্পর্ক স্থাপন করতে গেলে যে রকম বাক্যের সাহায্য নিই, তেমনি মানুষ যখন নিজের মনে/আপন মনে চিন্তন করে, তাও বাক্যের সাহায্যে অনূদিত হয়। এই ‘বাক্যতত্ত্ব’ ব্যবহারিক ও দর্শন জগতের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই বাক্য দ্বারা দর্শন জগতে প্রথম ‘শ্রেণিবিভাগ’ শুরু হয়। দু-একটা উদাহরণ দেখা যাইতে পারে। যেমন আমার জ্বর হয়েছে। অতএব শরীরে তাপ অনুভূত হচ্ছে। এটা একধরনের অভিজ্ঞতার অনুভূতির প্রকাশ। ‘বাক্য’ দ্বারা অনুভূতি সাবলীলভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু যেখানে তাপ অনুভূত হচ্ছে তা যে ‘শরীর’, এটা আমি কীভাবে বুঝতে পারি! ‘ইহা শরীর’ —এ জানার উপায় কি? ইহা শরীর, এই জ্ঞান দুই ভাবে প্রজ্ঞায় এসে ধরা দেয়। ১) অন্য অনেকের সাথে আমার শরীরের সাদৃশ্য। ২) অন্য অনেকানেক বস্তু যেমন পশু, পক্ষী, ঘর, বাড়ি থেকে আমার শরীরের বৈসাদৃশ্য। আবার কীভাবে তাপকে সংজ্ঞায়িত করা যায়? ১) হয়তো পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে, অথবা ২) শৈত্যের অনুভূতির সাথে তাপের অনুভূতির পার্থক্য। তাহলে মোদ্দা কথা কী দাঁড়ালো? ‘শরীর’ শব্দ এক শ্রেণির দ্রব্যের, তাপ শব্দ এক শ্রেণির ‘অনুভূতির’। যাবতীয় জ্ঞানের মধ্যে এই ‘শ্রেণি’ অন্তর্নিহিত। ইহাই শ্রেণিবিভাগের সূত্রবিন্দু। এই শ্রেণিবিভাগ শুধু দ্রব্য বা অনুভূতি নয়, গুণ, কর্ম, সবকিছুই এই শ্রেণিবিভাগের অন্তর্গত। হেগেল শ্রেণিবিভাগকে খুব একটা একতরফা গুরুত্ব দেন নি, যতটা তাঁর পরবর্তী কালের দার্শনিকরা দিয়েছেন। হেগেলের মতে বাক্য অনুভূতি প্রকাশে অসম্পূর্ণ। যা বাক্যকে পরিশীলিত ও উপস্থাপিত করে তা হলো ‘চিন্তা’। এই সমস্ত জগৎ আর কিছুই নহে, চিন্তার ‘একটি স্থূল রূপ মাত্র’। হেগেলের মতে চিন্তা ছাড়া জগতে আর কিছু নাই।
কিন্তু এই চিন্তা আবার স্বয়মপ্রকাশ নয়। চিন্তার প্রকাশের পিছনে যা কাজ করে তা হচ্ছে প্রজ্ঞা। এই প্রজ্ঞা কোনো বস্তু নয়। জগতে অনেক ধরনের বস্তু দেখা যায়, যারা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত : ১) জড় বস্তু ও ২) মানসিক বস্তু। জড় ও মানসিক বস্তু মিলে ‘বিশিষ্ট বস্তু’ সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রজ্ঞা কোনো বিশিষ্ট বস্তু নয়। ইহা বিশিষ্ট বস্তুর কারণ। বিশিষ্ট বস্তু দেশ (space) ও কালের (time) মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু প্রজ্ঞা দেশ ও কালের অতীত। তার উপর প্রজ্ঞার অবস্থান সার্বিক। ইহা সকল বিশিষ্ট বস্তুর সাথে ‘in and through’-ভাবে অবস্থিত। চিন্তায় যুক্তিকে বিশিষ্ট বস্তু হতে পৃথক করা সম্ভব, কিন্তু বস্তু বিচ্যুত যুক্তির কোনো অর্থ থাকতে পারে না। বাহু বর্জিত ত্রিভুজের অস্তিত্ব নেই। সুন্দর বস্তু ছাড়া সৌন্দর্যের অবস্থান থাকতে পারে না।
হেগেল বিশ্বইতিহাসের দর্শন রচনা করেছেন। বিশ্বইতিহাসেই প্রজ্ঞার উদয়, বিকাশ ও শেষ পর্যন্ত আনন্দে ‘ইহার’ পরিসমাপ্তি। এই জগৎ মূলত প্রজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ। হেগেলের মতে প্রজ্ঞা স্বয়ম্ভু। এখন প্রশ্ন হলো প্রজ্ঞা তার Idea-গুলোকে কার্যে পরিণত কীভাবে করে! কীরকম সমাজ কাঠামোর ভিতর দিয়ে প্রজ্ঞা কাজ করে, হেগেল তার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। হেগেলের প্রজ্ঞা ধারণার ঐক্যসূত্র হিসেবে কাজ করে। প্রত্যেক সৃষ্টির পিছনে, প্রত্যেক মানুষের চিন্তায় কিছু অদরকারি ও কিছু দরকারি বা অপরিহার্য ধারণা থাকে। প্রজ্ঞা এই দুই ধরনের ধারণার ঐক্যসূত্র। ধারণা সমূহ ইহার সৃষ্টি নয়, ইহা ধারণা বিবর্জিতও নয়। ইহা ধারণা সমূহের ঐক্য বিধায়ক, পূর্ণ ও অখণ্ড। হেগেলের প্রজ্ঞা জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের ধারক ও ঐক্যসূত্র। এক সর্বব্যাপী অপরিবর্তনশীল আধ্যাত্মিক সত্তা। ইহা কার্যত সক্রিয় ও গতিশীল। ইহা সকল জড় ও জীবের ভিতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। হেগেল বলেন positivity and negativity পরস্পর নিরপেক্ষ নয়। Positivity and negativity পার হয়েই আমরা প্রকৃত সত্যের কাছে পৌঁছি। হেগেলের মতে বুদ্ধি ও বস্তুর মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। স্বয়মপ্রকাশ এক চৈতন্যের দুই বাহু মাত্র। ফলে যা যুক্তিসঙ্গত, তাই সৎ এবং যাই সৎ তাই যৌক্তিক হতে বাধ্য। Whatever is actual is rational and whatever is rational is actual. হেগেলের চিন্তাধারা এক ধরনের দ্ধন্ধের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। প্রথমটি সদর্থক (thesis), দ্বিতীয়টি নঞর্থক (anti-thesis) এবং তৃতীয়টি সমন্বয় (synthesis)। এইভাবে চিন্তাপদ্ধতি absolute idea-তে গিয়ে পৌঁছে।
হেগেলের এই দ্বান্ধিক অথবা ডায়ালেকটিক (dialectic) বিচার পদ্ধতি সর্বজনবিদিত ও বহুল পঠিত। এর ব্যাখ্যাও গত ৪০০ বছরে বিস্তর হয়েছে। ডায়ালেকটিকের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন অনেকের নিকট দূর্বোধ্যও বটে। প্রথমে সাধারণের ধারণা ছিল ডায়ালেকটিক একটি যুক্তিতর্কের কৌশল মাত্র। কিন্তু হেগেল এই ধারণাকে বারবার খন্ডন করেছেন। তাঁর বহু বক্তৃতায় তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন ডায়ালেকটিক কোনো যুক্তিতর্কের কৌশল নয়, বরং বিশ্বের ও বিশ্ব ইতিহাসের ইহা অন্তর্নিহিত মূলসূত্র। আমাদের ব্যবহারিক জীবনের প্রত্যেক ঘটনাই এই ডায়ালেকটিকের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
হেগেল এই ডায়ালেকটিক বিচার পদ্ধতিকে তাঁর পূর্বতন দার্শনিকদের Metaphysical বিচার পদ্ধতি থেকে আলাদা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। অনেক দার্শনিক metaphysical বিচার পদ্ধতিকে lower mathematics এবং dialectic বিচার পদ্ধতিকে higher mathematics বলেছেন। Lower mathematics-এ আলোচ্য বিষয়গুলো একে অপরের থেকে পৃথক। এখানে বৃত্ত বৃত্তই, ত্রিভুজ ত্রিভুজই, বহুভুজ বহুভুজই। এখানে এদের একে অপরের মধ্যে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু higher mathematics-এ একটি বহুভুজকে কীভাবে বৃত্তে পরিণত করা যায়, তার বিস্তারিত কৌশল জানা যায়। অতএব dialectic technique যে metaphysical technique-র চেয়ে উত্তম—এই বলার উদ্দেশ্য। আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলা যায়, যেমন মেটাফিজিক্যাল ধারণা হচ্ছে জাতি বা species অপরিবর্তনীয়। ফরাসি বস্তুবাদী দার্শনিকরা এই ধরনের ধারণার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু Darwin-র Origin of Species এই মতবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। কিভাবে পরিবেশ ও পরিস্থিতি একই জাতিকে আমূল পরিবর্তন অথবা নিঃশেষ করে দিতে পারে তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সেখানে আছে। সূতরাং ডারউইনের বিবর্তনবাদ ডায়ালেকটিক বিচার সমর্থিত বলা যায়।
হেগেলের বিচারপদ্ধতির আরেকটি বিশেষত্ব হলো হেগেল পূর্ববর্তী দর্শন ও ইতিহাস কে কখনো ঘৃণার চোখে দেখেন নি। ইহা হেগেলের ব্যক্তিগত চারিত্রেরও একটা বিশেষ দিক। আলোচনা, সমালোচনা করলেও কোন কিছুতে তাঁর ঘৃণা কখনো প্রকাশ পায় নি। যেমন Claude Adrien Helvétius মধ্যযুগের ফিউদতন্ত্রকে মানুষের নির্বুদ্ধিতার চরম নিদর্শন বলে ব্যাখ্যা করেছেন। হেগেল নিজেও মানুষের চরম নির্বুদ্ধিতার ফলাফল হিসেবে মধ্যযুগকে আখ্যা দিয়েছেন কিন্তু তিনি এও বলেছেন অন্ধকার মধ্যযুগ ছিল বলেই আলোর প্রয়োজন পড়েছিল। মানবতার বিকাশের পথে মধ্যযুগ যে একটি অনিবার্য স্তর ছিল, তাও বহুবার বলেছেন।
তিন
হেগেলের Doctrine of being সাগরের মতো গভীর ও অন্ধকার। ইহা দুর্বোধ্য কিন্তু অবোধ্য কি? বাঙালি দর্শনগ্রন্থ রচয়িতারা এই Doctrine of being-কে বলেছেন ‘সত্তাবাদ’। দেখা যাক হেগেলের মতে সত্তাবাদ বলতে কি বুঝায়। এখানে সত্তা মূলত গুণ+পরিমাণ+সমানুপাতের সৃষ্টি। সত্তা ও অসত্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। হেগেলের মতে সত্তা=অসত্তা। নির্গুণ সত্তা=0। অসত্তা=0। সুতরাং দুইয়ের মধ্যে বিভাজন থাকতে পারে না। সত্তা ও অসত্তার মধ্যে সমন্বয় ঘটতে পারে। হতে পারে সত্তা+অসত্তা=পরিবর্তন। এই পরিবর্তন আবার দুইয়ের সমষ্টি। ১) উৎপত্তি ও ২) লয়। উৎপত্তি= অসত্তা থেকে সত্তার সৃষ্টি। লয়=সত্তার অসত্তায় পরিণতি। সত্তা দেশ (space) ও কালের (time) দ্বারা প্রভাবিত নয়। অতএব সত্তা শূন্যগর্ভ।
উৎপত্তি+লয়=বিশিষ্ট সত্তা (determinate being)। এই বিশিষ্ট সত্তাই বস্তুর গুণ হিসেবে পরিচিত। কোনো বস্তুর গুণকে তার সত্তা থেকে পৃথক করা যায় না। গুণকে সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করলে বস্তুর অস্তিত্ব বলতে আর কিছু থাকে না। ইহা বস্তুর সীমাবদ্ধতা অথবা বাস্তবতা। বস্তুর এই গুণ ২ প্রকার। ১) ধনাত্মক ও ২) ঋণাত্মক। কোনো বস্তুর বর্ণ, ভর, ওজন, ক্ষেত্রফল প্রভৃতি ধনাত্মক গুণ। আবার এই গুণগুলো উল্লেখ করলে এর বিপরীত গুণগুলোও সংজ্ঞায়িত হয়। যেমন এই বস্তুর বর্ণ লাল, তার মানে এই বস্তু হলুদ বা সবুজ নয়, এও নির্ধারিত হয়ে যায়। এই অর্থে এই গুণগুলো ঋণাত্মক। সূতরাং গুণ একদিকে বাস্তব, অন্যদিকে ‘যা নয়’ তাও নির্দেশ করে। বস্তুর গুণকে ধনাত্মক বা ভাবাত্মক স্বরূপ হিসেবে চিন্তা করলে পাওয়া যায় being in itself (নিজের সাথে নিজের গুণের সাযুজ্যরূপ)। আবার বস্তুকে ঋণাত্মক বা অভাবাত্মক গুণ দ্বারা ব্যক্ত করলে অথবা অন্য বস্তুর সাথে তুলনা করলে বা সম্পর্কিত কিনা বিবেচনা করলে পাওয়া যায় being for other’s.
হেগেলের মতে সসীমের বিস্তীর্ণ একের পর এক পারস্পরিক সম্পর্ক হেতু যে অসীমের ধারণা অনুমিত হয়, তা প্রকৃত অসীম নয়। উৎপত্তি ও লয়ের সংমিশ্রণে যে পরিবর্তিত সত্তা সৃষ্টি হয়, সেই পরিবর্তিত সত্তা থেকে অবিরাম পরিবর্তিত সত্তা একের পর এক সংশ্লিষ্ট অথবা বিশ্লিষ্ট রূপ অনন্ত কাল ধরে চললেও তা অসীম বলে বিবেচিত হতে পারে না। যেমন 1+2+3+4+……এই শ্রেণিক্রম অনুসরণ করলে কখনো প্রকৃত অসীমে পৌঁছানো যাবে না। 1, 2, 3, 4.. প্রত্যেকটি সংখ্যাই সসীম। সসীমের সমষ্টি থেকে অসীমে পৌঁছানো অসম্ভব। মানুষের বুদ্ধি বড় বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বুদ্ধিই সসীম ও অসীমকে একে অপরের বিরুদ্ধ বলে চিহ্নিত করে। বুদ্ধির এই ভ্রান্তি কেবলমাত্র প্রজ্ঞা দ্বারাই সংশোধিত করা যায়। প্রজ্ঞা দ্বারা এই বিবেচিত হয় যে সসীম অসীমেরই এক অংশমাত্র। প্রকৃত প্রস্তাবে সসীম ও অসীম অভিন্ন। একমাত্র The Idea-ই অসীম। ইহা হতে সসীমের সৃষ্টি।
অসীম নিজেই নিজের নিকট ব্যক্ত সত্তা। অহংকার এই ব্যক্ত সত্তার উত্তম উদাহরণ। বস্তুর নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই। বস্তুর অস্তিত্ব আমার চিন্তার মধ্যে। কিন্তু অহং বা অহংকার নির্দেশ করে আমি কে? আমিই আমার জ্ঞানের বিষয় ও উপাদান। এই অহংকার অসীম। এই অহং অনহং দ্বারা পৃথকীকৃত। অসীম ও সসীম যেরকম অভিন্ন, হেগেলের মতে অহং ও অনহংও অভিন্ন। হেগেল এইরূপ চিন্তাকে being for itself নামে অভিহিত করেছেন।
এই being for itself আবার ৩ বিভাগে বিভক্ত। ১) এক, ২) বহু ও ৩) আকর্ষণ ও বিকর্ষণ। এক ও একক—যা শুধুমাত্র নিজের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু এই এক আবার বহুর সম্মিলিত অবস্থা। ‘বহু’ একের সাথে যুক্ত হয়ে এক ও এককে পরিণত হচ্ছে। এখানে যদিও উভয়ে পরস্পর পরস্পরের সাথে পরস্পর মিশে আছে/গেছে, একীভূত—তথাপি তাদেরকে চিন্তা দ্বারা পৃথক করা সম্ভব। এই চিন্তার পৃথকীকরণই বিকর্ষণ। আবার প্রত্যেক বহু-ই এক এক দ্বারা পরস্পর চিন্তা দ্বারা পৃথকীকৃত। অতএব তাদের মধ্যে সাদৃশ্য বর্তমান। ইহাই আকর্ষণ বলে বিবেচিত।
হেগেলের ‘পরিমাণ’ও ৩ ভাগে বিভক্ত। ১) বিশুদ্ধ পরিমাণ (pure quantity), ২) নির্দিষ্ট পরিমাণ (quantum), ৩) পরিমাণের গভীরতা (degree)। বিশুদ্ধ পরিমাণ আবার ৩ ভাগে বিভক্ত। ১) বিশুদ্ধ পরিমাণ স্বয়ং (pure quantity itself), ২) অবিচ্ছিন্ন ও বিচ্ছিন্ন পরিমাণ (continuous and discrete), আর ৩) পরিমাণের সীমাবদ্ধতা (limitation)। পরিমাণের সাথে বস্তুর গুণের কোনো সম্পর্ক নেই। ইহা আকার সর্বস্ব। হেগেলের Actuality পরিমাণের বাস্তবতা বুঝায়। যার মধ্যে একত্ব ও বহুত্ব সমাসীন। ইহা বহু একের সমষ্টি। ইহাই সংখ্যা। যার মধ্যে পরিমাণ ও গুণের সম্মিলন ঘটে তাকে বলে পরিমাণগত অনুপাত। পরিমাণের উপর গুণের নির্ভরতাই সমানুপাত। Hydrogen ও Oxygen মিলে জল (H2O) তৈরি হয়। এখানে ২ (H2) : ১(O)-এই অনুপাতে Hydrogen ও Oxygen মিশ্রিত। আবার ২:২ করলে Hydrogen peroxide (H2O2) উৎপন্ন হয়। গুণ তাহলে এখানে পরিমাণের উপর নির্ভরশীল। তজ্জন্য হেগেল বলছেন, দেশের রাষ্ট্রনৈতিক ও শাসনতন্ত্রের গুণাবলী নির্ভর করে দেশের আয়তন ও জনসংখ্যার উপর।
চার
এবার দেখা যাক হেগেলের দর্শন প্রাত্যহিক জীবনে কীরূপে ব্যবহৃত/কার্যকর হতে পারে। হেগেল খুব সুন্দরভাবে সমাজ ব্যবস্থার কাঠামো কীরূপ হওয়া উচিত তা উপস্থাপন করেছেন। হেগেল মানবীয় অধিকারকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। ১) সম্পত্তি : বস্তুর উপর মানুষের অধিকার অসীম। মানুষ বস্তুকে যদৃচ্ছা স্বাধীনভাবে উপভোগ করতে পারে। এই অধিকার ব্যক্তিগত অধিকার। সম্পত্তির অধিকার। হেগেল ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপের বিরোধী ছিলেন। অনেক দার্শনিক ও সমালোচক এইক্ষেত্রে সাম্যবাদ থেকে হেগেলের দর্শন পৃথক বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এটাও জানা আবশ্যক, সাম্যবাদ ব্যক্তিগত সম্পত্তি-বিরুদ্ধ আচরণ করে না। সাম্যবাদ সম্পত্তির অন্যায় বিভাজনের বিরোধী। জীবনধারণের জন্য যে-খাদ্য প্রয়োজন তার ওপর ব্যক্তিগত অধিকার সাম্যবাদ সমর্থন করে। হেগেল প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপর অধিকার স্বীকার করলেও ব্যক্তিগত সম্পত্তি সকলের সমান হতে হবে, তা স্বীকার করেন নি। কেননা সকল মানুষ সমান হলেও বোধ, বুদ্ধি ও ক্ষমতার পার্থক্য মানুষে মানুষে বর্তমান। হেগেল সম্পত্তির অধিকারকে আবার ৩ ভাগে বিভক্ত করেছেন। ১) দখলের অধিকার; ২) ব্যবহারের অধিকার; ৩) সম্পত্তি ত্যাগের অধিকার। প্রত্যেক মানুষের তার নিজস্ব জীবনের উপর অধিকার বিশেষভাবে স্বীকৃত। কিন্তু তাই বলে, নিজস্ব জীবনকে নিজের ইচ্ছায় সবরকম ভোগ করার পক্ষে হেগেলীয় দর্শন বিরোধী। সেজন্য হেগেল জীবনের যে কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যা সমর্থন করেন নি। বরং আত্মহত্যা ইচ্ছার ও অধিকারের ধ্বংস সাধন বলে ঘৃণা করেছেন।
২) চুক্তি: হেগেল সম্পত্তির হস্তান্তরকে চুক্তি বলেছেন। সম্পত্তি কেবল স্থাবর হতে পারে না। হেগেলের মতে পরিশ্রমও একপ্রকার সম্পত্তি। এবং এই সম্পত্তি বর্জনের অধিকার প্রত্যেক শ্রমিকের আছে। দুইজন সম্পত্তিবান মানুষের সম্পত্তি বর্জনের অধিকারই চুক্তি বলিয়া অভিহিত। এক্ষেত্রে হেগেল বিবাহকে চুক্তি বলে গণ্য করেন নি। রাষ্ট্রও চুক্তির আওতায় বলে স্বীকার করেন নি।
৩) অন্যায় আচরণ : হেগেলের ‘অধিকার’ বিষয়ের ওপর ‘সার্বিক ইচ্ছা’র প্রভাব। কিন্তু সকল মানুষের ইচ্ছা সার্বিক হতে পারে না। সেহেতু মানুষের মধ্যে ‘অন্যায় আচরণ’ দেখা দেয়। হেগেলের অন্যায় আচরণ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ও শিক্ষার আলোকে ব্যাখ্যা করা হয় নি। হেগেল অন্যায় আচরণকে আইনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই অন্যায় আচরণ তিন ভাবে হতে পারে। ১) অ-পূর্বপরিকল্পিত, ২) প্রতারণা, ৩) অপরাধ। অ-পূর্বপরিকল্পিত অন্যায় আচরণ থেকেই দেওয়ানি বিচারের উদ্ভব। যখন দুইজন মানুষের মধ্যে সম্পত্তিগত অথবা চুক্তিগত বিবাদ উপস্থিত হয়, তখন প্রত্যেকেই মনে করে তার দাবি আইনসঙ্গত। অথচ একজনের দাবি আদালতে অবশ্যই ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। যখন কেউ উপযুক্ত অপরাধের আইন জেনেও আইনের বিরোধিতা করে, তখন তার কর্ম প্রতারণামূলক হিসেবে বিবেচিত হবে। অপরাধী আইনের দাবি অস্বীকারপূর্বক আইন বিরোধী কর্ম করে, অতএব তার কর্ম দণ্ডনীয়। হেগেল ‘অপরাধীর জন্য শাস্তি’ বিচার ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ বলে উল্লেখ করেছেন। হেগেল সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডেরও সমর্থক ছিলেন। ব্যক্তি অপেক্ষা রাষ্ট্রের মূল্য অধিক। অতএব প্রয়োজন হলে ব্যক্তির জীবন দাবি করা রাষ্ট্রের নৈতিক অধিকার। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডকে তিনি বিচারপদ্ধতির একদম শেষ অবস্থা বলে অভিহিত করেন। রাষ্ট্র একদম অপারগ হলেই মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন করতে পারেন।
হেগেলের কর্মনীতি অধিকার হতে পৃথক। হেগেল অধিকারকে বলেছেন মানুষের সহিত বাইরের জগতের সম্পর্ক, অন্যদিকে কর্মনীতিকে বলেছেন মানুষের অন্তরের সহিত তার বিবেকের সম্পর্ক। সকল জনসাধারণের ইচ্ছা সর্বজনীন হওয়া বাঞ্ছনীয়। সর্বজনীন ইচ্ছা ও ব্যক্তিগত ইচ্ছার সংঘর্ষ থেকেই অন্যায় আচরণের সৃষ্টি হয়। মানুষের ইচ্ছা যেরূপ হওয়া উচিত, তা যদি ‘ইচ্ছা যেরকম আছে’ তার অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়, তবে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। হেগেল কর্মনীতিকে মানুষের একান্ত আভ্যন্তরীন ব্যাপার বলে মনে করছেন। এই আভ্যন্তরীন ব্যাপারই যখন বাহ্য প্রতিষ্ঠান রূপে দেখা দেয়, তখন তাকেই সমাজনীতি বা Social Ethics বলে। কর্মনীতিতে ইচ্ছা স্বয়মপ্রকাশ। অতএব ইচ্ছা যদি বিবেক দ্বারা সমর্থিত হয় তবে সেই ইচ্ছাই ব্যক্তির পক্ষে ‘নিয়ম’। মানুষ সাধারণত তার বিবেকের বাইরে অন্য কারো কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে অপারগ।
হেগেল কর্মনীতিকে বলছেন এই তিনের সমন্বয় : ১) অভিসন্ধি; ২) অভিপ্রায় ও ৩) উদ্দেশ্য। কর্মের ফলের কথা চিন্তা করে মানুষ যখন কর্ম করে, অর্থাৎ কর্মফল যখন মানুষকে কর্মে উৎসাহিত করে, তাকে এখানে অভিসন্ধি বলা হচ্ছে। কর্মের ফল কিন্তু বিস্তৃত, সূদূরপ্রসারী। এক কর্ম থেকে বহু ফলাফল সৃষ্টি হতে পারে, হয়। সকল কর্মফল কর্তার মানসে উপস্থিত নাও হতে/থাকতে পারে। আবার যে-সব কর্মফল কর্তার মনে উপস্থিত থাকে, অথবা থাকাটা বাঞ্ছনীয়, তাহাই অভিসন্ধি বা purpose. এই সকল ফলের মধ্যে যে সকল ফলাফল কৃতকর্মের অবশ্যম্ভাবী ফলাফল, তাই অভিপ্রায় বা intention. যে-বিশেষ ফলের জন্য কর্ম সম্পাদন, তাই উদ্দেশ্য বা end. নানাবিধ কর্মের বিবিধ উদ্দেশ্য থাকলেও তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকা অকল্পনীয় নয়। একটা উদ্দেশ্য অন্য উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায় হতে পারে। আবার বহু উদ্দেশ্য মিলিত হয়ে একটা উদ্দেশ্যে পরিণত হতে পারে। হেগেল এইরকম সাধারণ উদ্দেশ্যে কে well being বলেছেন। ইংরেজি well being-কে বাংলায় মঙ্গলজনক অবস্থা বললেও হেগেলের কর্মনীতি অনুসারে well being ভালো ও মন্দ দুইয়ের সমষ্টি। কারণ উদ্দেশ্য ভালো ও মন্দ উভয়েই হতে পারে। জীবনের লক্ষ্য এই ভালোমন্দ উদ্দেশ্য কর্তৃক নির্ধারিত হয়।
হেগেলের মতে ইচ্ছার স্বরূপ হবে/হওয়া উচিত সর্বজনীন। প্রত্যেকের ইচ্ছা থাকে এবং তার মধ্যেই ইচ্ছা substantiate বা mature হয়। এহেন ইচ্ছার মধ্যে কর্ম বর্তমান। কর্মের সাথে কর্মের অভিপ্রায়, অভিসন্ধি ও উদ্দেশ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। হেগেলের মতে মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা যদি সর্বজনীন ইচ্ছার সাথে মিলিত না হয় তখন সেই ইচ্ছাকে ‘অসৎ’ বলে। যদি ব্যক্তিগত ইচ্ছা সর্বজনীন ইচ্ছার প্রতিভাস হয়, তবে সেই ইচ্ছাকে ‘সৎ’ বলা যেতে পারে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই সর্বজনীন ইচ্ছা তাহলে কী? হেগেল বলছেন যুক্তিসঙ্গত ইচ্ছাই সর্বজনীন ইচ্ছা। হেগেল সামাজিক নীতি বিষয়ে কোন কোনো কর্ম কর্তব্য, কোনো কোনো ইচ্ছা সর্বজনীন তার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কোন কোনো ইচ্ছা বা কার্য সর্বজনীন, সৎ ও প্রজ্ঞানুগততার জন্য বাহ্যিক আইন কানুনের প্রয়োজন নেই, হেগেল মনে করেন মানুষের অন্তরে অনুসন্ধান করলেই এর উত্তর পাওয়া সম্ভব। অন্তরের এই ক্ষমতাই conscience.
‘অন্তরে অনুসন্ধান’ এই/এর মর্মকথা কাব্যিক। এর সাথে বাস্তবতার মিল অতি সামান্যই। মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা সর্বজনীন ইচ্ছা হবে এমন কোন কথা নেই। ব্যক্তিগত ইচ্ছা সর্বজনীন ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এই নির্বাচনের জন্য একটা ‘নির্ধারক’ প্রয়োজন। হেগেল সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইচ্ছার চেয়ে পরিবারের ইচ্ছা এবং পরিবারের ইচ্ছার চেয়ে রাষ্ট্রীয় ইচ্ছার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। হেগেল রাষ্ট্রকেই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সর্বজনীন ইচ্ছার বাস্তব রূপ হিসেবে দেখেছেন। মানুষের পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কর্তব্য দ্বারা ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হয় না। কোনো পারিবারিক/সামাজিক/রাষ্ট্রীয় নিয়মকে ‘মেনে না চলা’কে হেগেল ব্যক্তিস্বাধীনতা বলেন নি। আপন কর্তৃক আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকেই হেগেল ব্যক্তিস্বাধীনতা বলেছেন। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম অনুযায়ী ব্যক্তির চারিত্রই উদ্ভাসিত হয়। এই নিয়ম প্রতিপালনপূর্বক মানুষ নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। বিবাহ করলে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হয়—এ-ধারণা ভুল। বিবাহের মাধ্যমে, প্রকৃতপ্রস্তাবে, ব্যক্তিমানুষের মুক্তি হয়।
পরিবার হতেই সমাজনীতির উদ্ভব। বিবেকের সাথে well being যোগ হলেই moral substance তৈরি হয়। Moral substance-র পরিবার থেকেই উদ্ভব। পরিবারের মূল উৎস বিবাহ। দুই ব্যক্তি মানুষের মধ্যে মানসিক ঐক্যই প্রেম। বিবাহে দুই ব্যক্তি পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য পরিত্যাগ করে এক-এ পরিবর্তিত হয়। বিবাহের মাধ্যমে গাণিতিক সূত্র পাল্টে যায়। ১+১=২ না হয়ে ১+১=১ হয়। এই ঐক্য ও মানসিক প্রেমই পরিবার ও সমাজনীতির মূলমন্ত্র। বিবাহের পর সন্তানসন্ততিরাও এই একত্বে যোগ হয়। হেগেলের মতে সন্তানাদিসহ সমগ্র পরিবারই এক ব্যক্তি বলে বিবেচিত হয়। পুত্র কন্যা বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত পিতা-মাতার সহিত একত্রে থাকবে, এবং এক্ষেত্রে তারা পরাধীন। দুই পরাধীনের মধ্যে বিবাহ নিয়ম বহির্ভূত। এক্ষেত্রে হেগেল মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ব্যবস্থার ভ্রাতাভগ্নীর বিবাহের নিন্দা করেছেন। হেগেলের মতে বিবাহ দুই স্বাধীন ব্যক্তির মিলন। বিবাহ একটি কর্ম ও নৈতিক বন্ধন। স্বামী স্ত্রীর সুখ, অথবা সুযোগ সুবিধা বিবাহের উদ্দেশ্য হতে পারে না। বিবাহ একটি কর্তব্য। স্বামী স্ত্রীর কর্মনৈতিক মিলনই বিবাহ। ইন্দ্রিয় তৃপ্তি এখানে মূখ্য হতে পারে না। যেহেতু বিবাহ একটি কর্তব্য, অতএব সুখদুঃখের সাথে বিবাহের কোনো সম্পর্ক নেই। হেগেল সুখদুঃখহেতু লাগাতার বিবাহবিচ্ছেদকে সমর্থন করেন নি। বিবাহ যদি কেবল সুখের হতো অথবা চুক্তি মাত্র তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদের সমর্থন করা যেত। কিন্তু বিবাহ তা নয়।
হেগেল বিবাহ পূর্ববর্তী প্রেমকে স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। যে-পূর্বরাগের সহিত যুক্তি নেই, তাকে বিবাহে পরিণত করা মূর্খতা। মানুষ যখন পূর্বরাগের সহিত পরিচিত হয় তখন তার বিদ্যাবুদ্ধি পরিণত নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিবাহ পূর্ববর্তী অনুরাগকে প্রাধান্য দিলে ‘বিবাহের মহৎ উদ্দেশ্য’ আর মর্যাদা পায় না। পিতা-মাতা কর্তৃক নির্বাচিত বরকন্যাকেই হেগেল সমর্থন করেছেন। যদিও প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত নির্বাচনের আগে যথেষ্ট পরিমাণ যুক্তির বিবেচনা করা।
হেগেলের মতে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত সকল সদস্যদের পরিবারের সম্পত্তির উপর সমান অধিকার থাকবে। পুত্র কন্যা এখানে অভেদ। পরিবারের সম্পত্তি হতে পুত্র কন্যার শিক্ষার ব্যয়ভার নির্ধারিত হবে। এখানে হেগেলের শিক্ষার অর্থ সর্বজনীন ইচ্ছার বহিঃ ও অন্ত প্রকাশ। শিক্ষা : স্বাধীনচেতা মনের সার্থক গঠন। মনের স্বাধীনতা পূর্ণ শিক্ষিত হলেই মানুষের বিবাহের অধিকার জন্মে। এবং এইভাবে পরিবার থেকে এক স্বাধীনচেতা সমাজের সূত্রপাত হয়।
এইরকম একেকটি পরিবার বিভাজিত হয়ে বহু পরিবার সৃষ্টি করে। এইরকম বহু পরিবার মিলে একটি civil society তৈরি হয়। কিন্তু এই স্বাধীন ব্যক্তি অন্যান্যকে আপনার উদ্দেশ্য সার্থক করার জন্য উপায় বা means মনে করে। এতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপর নির্ভর করতে বাধ্য। এই নির্ভরতা থেকেই যদ্যপি civil society বা অসামরিক সমাজের কার্যপদ্ধতি তৈরি হয়। অসামরিক সমাজে পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হলেও মানুষ প্রত্যেকে তার নিজস্ব স্বার্থকেই মূখ্য মনে করে। এতেই সামাজিক বিরোধের সৃষ্টি হয়। এই সামাজিক বিরোধের নিষ্পত্তির জন্য ‘রাষ্ট্রের’ প্রয়োজন। রাষ্ট্রে আলাদা আলাদা অসামরিক সমাজের কোনো অস্তিত্ব নেই। রাষ্ট্রের অন্তর্গত জনগণের সর্ববিধ মঙ্গলের জন্য সকল জনগণ মিলে একটি রাষ্ট্র তৈরি করেছে হেগেল এই মতবাদের পূর্ণ সমর্থক ছিলেন না। হেগেল রাষ্ট্রকেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রের স্বার্থ পরিবার ও সমাজনীতির বিরুদ্ধ হলেও রাষ্ট্র প্রাগ্রসরমান—একেও বিবেচনায় রেখেছেন।
অসামরিক সমাজের সবার ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব থেকেই অসামরিক মানুষ ব্যক্তিগতভাবে পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি আসে। খাদ্য, পানীয়, পোশাক ও ঔষধ—এসব নিত্যকার প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সবারই প্রয়োজন। এই অভাবগুলো পূরণের জন্য একে অপরের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাতে কেউ খাদ্য উৎপাদন করে (কৃষক), কেউ কাপড় বা বস্তু তৈরি করে (তন্তুবায়, শিল্পী), কেউ চিকিৎসা করে (ডাক্তার বা কবিরাজ)। প্রত্যেকেই নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরিশ্রম করে এবং করতে বাধ্য হয়। নিজস্ব পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে একে অপরের চাহিদা পরিতৃপ্ত হয়। ব্যক্তিগত স্বার্থ তখন সার্বজনীন স্বার্থে পরিণত হয়। হেগেলের মতে সমাজ পরিশ্রমের উপর ভিত্তি করে ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১) কৃষক; ২) শিল্পী ও বণিক; ৩) শাসক। এই শাসকগোষ্ঠীকে হেগেল সর্বজনীন শ্রেণি বলে অভিহিত করেছেন। হেগেল বংশগত শ্রেণিবিভাগ সমর্থন করেন নি। তাতে রাজতন্ত্রের বিবিধ শ্রেণিবিভাগ হেগেলের তত্ত্বের কাছে নিরর্থক হয়ে পড়ে। হেগেল মনে করতেন পরিশ্রমই শ্রেণিবিভাগের একমাত্র উপায়। ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুযায়ী এই বিভাগ হওয়া উচিত।
হেগেল রাষ্ট্রকে সমর্থন করেছেন। রাষ্ট্রের অধিকারকেও। এবং ইহাতে অসংখ্য পরবর্তী দার্শনিকরা হেগেলকে প্রতিক্রিয়াশীল, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী বলেছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহের কাছে হেগেলের রাষ্ট্রনীতি তাই অকার্যকর মনে হয়। যদ্যপি এও বলতে হয়, হেগেল রাষ্ট্রকে সমর্থন করলেও রাষ্ট্রের দোষত্রুটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, এটা বলা যায় না। হেগেলের রাষ্ট্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজের সৃষ্টি। হেগেল বারংবার রাষ্ট্রের সর্বজনীন ইচ্ছা ব্যক্তির পারস্পরিক ইচ্ছার সাথে অভিন্ন এই দেখিয়েছেন। যারা অহংকার ও দম্ভের সাথে নিজের মতামতকে প্রাধান্য ও প্রশ্রয় দিয়ে বহু যুগের সভ্যতাকে বিপ্লবের নামে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় বা ধ্বংস করে, হেগেল তাদের ঘিন্না করতেন। যে সর্বজনীন প্রজ্ঞা থেকে এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, তিনি মনে করতেন রাষ্ট্রও সেই প্রজ্ঞা থেকে উদ্ভূত। কারো স্বেচ্ছাচার ও ব্যক্তিগত খেয়াল থেকে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র তৈরি হতে পারে না।
হেগেলের মতে রাষ্ট্রের ও ব্যক্তির দাবি অভিন্ন। ব্যক্তির মধ্যে সর্বজনীনতার বীজ নিহিত থাকে। এই সর্বজনশীলতা রাষ্ট্রের কাছে এসে পূর্ণতা লাভ করে। রাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কৃতকর্মের ফলাফল একটি অনিবার্য সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে। রাষ্ট্র তাই অন্তর্গত ব্যক্তি, সমাজ ও civil society-কে পরমবন্ধু বলে গণ্য করে, এবং তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। এইভাবে এক একটি রাষ্ট্র সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
হেগেল রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে তার মতামত প্রকাশের জন্য সংবাদপত্রের সাহায্যের পক্ষপাতী ছিলেন। শাসক সম্প্রদায় এই সংবাদপত্র হতে জনগণের মতামত জানতে পারবে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এই সাধারণ মত গ্রহণ করতে রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে না, হেগেল এও বলেছেন। সাধারণ জনগণের যে-কোনো ইচ্ছা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এবং সার্বজনীন হবে তার জন্য জ্ঞান ও দূরদৃষ্টির প্রয়োজন বলে হেগেল মনে করতেন। যেহেতু আপামর জনসাধারণ এই দূরদৃষ্টির অধিকারি নয়/হতে পারে না, তাই রাষ্ট্র পরিচালনার শীর্ষ ব্যক্তিদের বাছাই কমিটির কথাও এখানে চিন্তা করা যেতে পারে।
হেগেল কোনো রাষ্ট্রের ‘চিরস্থায়ী শান্তি’কে অলীক কল্পনা বলে অভিহিত করেছেন। চিরস্থায়ী শান্তি বলে কিছু নেই, তা ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রই হোক না কেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি একক শান্তি প্রতিস্থাপক আন্তর্জাতিক সংস্থা বা আইনের তিনি কোনো সার্থক সম্ভাবনা দেখেন নি। হেগেলের মতে নিজের স্বাধীনতা রক্ষা করাই রাষ্ট্রের সর্বত প্রধান কর্তব্য। রাষ্ট্রের জীবন ও উদ্দেশ্য ব্যক্তির জীবন ও উদ্দেশ্যের চেয়ে মূল্যবান ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেহেতু ব্যক্তিগত জীবন উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকা প্রত্যেক মানুষের অবশ্য কর্তব্য। যুদ্ধে লিপ্ত থাকলেও প্রত্যেক রাষ্ট্র তার শত্রু রাষ্ট্রকে স্বাধীন বিবেচনা রাখবে। যুদ্ধ যদি দুই রাষ্ট্রের মধ্যে হয়, তাহলে বুঝতে হবে সাধারণ জনগণ এই যুদ্ধের ভিত্তি নয়। রাষ্ট্র রাষ্ট্রকে আক্রমণ করবে কিন্তু সাধারণ জনগণের জীবন ও সম্পদ যুদ্ধের আক্রমণের লক্ষ্য হবে না, হেগেলের এই ছিল রাষ্ট্রের প্রতি পরামর্শ।
পাঁচ
Art বা কলা নিয়ে হেগেল বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে সৌন্দর্য দ্বিবিধ। ১) প্রত্যক্ষ বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু যেমন রম্য, মূর্তি, সঙ্গীত ২) প্রত্যক্ষ বস্তুর মানসিক প্রকাশ যেমন কবিতা। এই সকল প্রকারভেদের মধ্য দিয়ে যখন The Idea সুনিবিড়ভাবে প্রকাশিত হয় তখনই তা/তারা ‘সুন্দর’ বলে গণ্য। The Idea—ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কলা ও প্রকৃতির মধ্যে সুপ্রকাশিত, কেননা বিশুদ্ধ চিন্তায় The Idea আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য থাকে না, অতএব অনুভূতির বাইরে এর অবস্থান। The Idea জড়, উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। স্থূল জড়ের মধ্যে The Idea শুধু existence রূপে থাকে। প্রকাশ ক্ষীণতম। কেননা বিভিন্ন জড়বস্তুর মধ্যে সংহতি বিভিন্ন। একে অপরের সাথে প্রত্যক্ষরূপে আলাদা। উদ্ভিদ জগতে The Idea-র সৌন্দর্যের প্রথম প্রকাশ যা পূর্ণতা লাভ করেছে প্রাণী দেহে। হেগেলের মতে উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎও স্বাধীন নয়। এদের স্বাধীনতার মাত্রা সীমাবদ্ধ। এদের স্বাধীনতা up to a certain limit. এরা সবাই প্রাকৃতিক কার্য-কারণ-র (cause-effect) শৃঙ্খলা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ The Idea-র সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য মানুষকে প্রকৃতির সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে নিজেকেই সুন্দর বস্তু সৃষ্টি করতে হবে, আর এখানেই কলার গুরুত্ব।
হেগেলের মতে Art বা কলা দুই ধরনের ১) অর্থ, ২) রূপ। অর্থকে কলার spiritual content বা আধ্যাত্মিক আধেয় বলা যায়। এই spiritual content-ই Art-র বিভিন্ন অংশে প্রকাশিত হয়। এই বিভিন্ন অংশ একটি particular সৃষ্টির জড়িয় (*জড় বা জড়ীভূত বোঝাতে চাইছেন মনে হয়) দেহ বা রূপ (materials embodiment)। স্থাপত্যশিল্পে রূপ সৃষ্টি হয় জড়বস্তু দ্বারা (ইট, পাথর ইত্যাকার), চিত্রে বর্ণ দ্বারা, সঙ্গীতে ধ্বনি এবং কবিতায় মানসিক প্রতিরূপ (mental image)। অর্থ ও রূপসাম্যতা রক্ষা করে যদি কোনো Art সৃষ্টি হয়, তবে তা সর্বোত্তম।
হেগেল কলার কয়েকটি শর্ত মেনে চলার পক্ষপাতী ছিলেন। যেমন ১) কলা হুবহু নিসর্গের অনুকরণ বা অনুসরণ করবে না। যা দেখছি বা প্রত্যক্ষ করছি তার বাইরে প্রকৃতির অভিব্যক্তি কি আছে, তাকে খুঁজে বের করাই কলার গুরুত্ব। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কোনো ব্যক্তির প্রতিরূপে (potrate) তার মুখের ক্ষতচিহ্ন, জন্মদাগগুলো উপস্থাপন করা অবান্তর। কেননা এইসব চিহ্নের সাথে প্রকৃত মানুষের স্বরূপে কোনো সম্পর্ক সাধারণত থাকে না। ২) নৈতিক উপদেশ কলার উপপাদ্য হতে পারে না। অনন্ত আত্মা ও প্রকৃতিকে ধরাই কলার যেখানে উদ্দেশ। ৩) খুব উন্নত সভ্যতার ইতিহাস বা সংস্কৃতি কলার উপযুক্ত নাও হতে পারে। হেগেলের মতে সুউচ্চ ও সুশৃঙ্খল সভ্যতার মানুষের আচরণ প্রচলিত আইন ও প্রথা দ্বারা পরাধীন। ৪) কোনো মানুষের চরিত্র বর্ণনায় তার প্রজ্ঞা ও জ্ঞান কীভাবে প্রকাশিত হয় বা করা যায়, তার দিকেই মনোযোগী হওয়া উচিত। চরিত্র বর্ণন কখনো শুধু reporting হবে না। প্রজ্ঞার সাথে সম্পর্কিত গুণ ও কার্যই বর্ণিত হওয়া উচিত। ৫) দুষ্কৃতিমূলক কার্য বা রুচির কোনো স্থান কলায় থাকতে পারে না। পাপকার্য যুক্তিহীন। মানুষের হীন চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। ৬) দুই সৎব্যক্তির প্রবৃত্তি ও আদর্শের সংঘর্ষ কাব্য বা কলায় রূপায়িত হতে পারে।
হেগেল কলাকে ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। ১) প্রতীকমূলক (symbolic), ২) সর্বোৎকৃষ্ট (classical) ও ৩) ভাবপ্রবণ (romantic)। আগেই বলা হয়েছে প্রত্যেক কলা অর্থ+রূপের সমন্বয়। Symbolic কলার মধ্যে অর্থের চেয়ে রূপের আধিক্য বেশি। হেগেলের মতে অর্থ ও রূপ যথার্থ রূপে প্রকাশিত হয়েছিল গ্রিক কলার মধ্যে, যদিও তিনি জড়িয় রূপের প্রাধান্য ও অধিক দেখেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন কলা প্রতীকমূলক। যখন মানুষের ভাষা ভাবব্যবহার প্রকাশের উপযুক্ত বা পরিপোক্ত হয় নি, অথবা মানুষের মন ভাবপ্রকাশের কোনো উপযুক্ত আধার পায় নি, তখন মানুষ প্রতীকের সাহায্যে মনের কথা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছে। যদিও হেগেলের মতে প্রতীক দ্বারা অর্থের ইঙ্গিত করা যায় কিন্তু অর্থের প্রকাশ করা যায় না। প্রতীকের সাথে আলোচ্য বস্তুর আংশিক সামঞ্জস্য থাকে, পরিপূর্ণ সাদৃশ্য থাকা সম্ভব নয়। এজন্য প্রাচীন প্রতীকমূলক কলার একাধিক রকম ব্যাখ্যা হয়েছে। শিল্পীর মনে প্রজ্ঞা ও প্রকৃতির পার্থক্যবোধ থাকা উচিত। যে-জাতির মধ্যে এই পার্থক্যবোধ সুস্পষ্ট নয়, তারা কখনো উন্নত কলার অধিকারী হতে পারে না। হেগেলের মতে fable বা উপকথা প্রকৃত কলা নয়। কারণ এতে নীতিবোধের পরামর্শ থাকলেও প্রজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্ক এখানে বাহ্য, স্থবির।
সর্বোৎকৃষ্ট বা classical কলায় অর্থ ও রূপের সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। হেগেল গ্রিক কলায় এর প্রাচুর্যও দেখেছেন। গ্রিকরা পরমাত্মার নির্গুণ ও সর্বব্যাপী অপরিবর্তনশীল অবস্থান স্বীকার করে না। সেহেতু গ্রিক দেবতাগণ মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন এবং বলিষ্ঠ ও ব্যক্তিত্ববান। Classical কলায় এই মানবিক গুণাবলীই (anthropomorphism) প্রধান আকর্ষণ। গ্রিক কলার, অনেকানেক অংশে, গ্রিক দেবতাগণ জগতে থেকেও জগৎ সম্পর্কে নির্লিপ্ত, উদাসীন—এই মনের কথা/ভাব সুপ্রকাশিত। এক অনাবিল, অনাহুত আনন্দের অন্তঃপ্রকাশ যেন প্রতিশিল্পে মূর্তমান। হেগেল এদেরকে শ্রেষ্ঠ কলা বা art বলেছেন। যদিও as a sceptic তিনি এও বলেছেন গ্রিক কলার মধ্যে absolute spirit সসীম রূপে বর্তমান। কিন্তু absolute spirit অসীম, পূর্ণব্যাপী। গ্রিক দেবতাগণ পরাধীন, এরা অদৃষ্টের মহাজালে বন্দি। এক্ষেত্রে কলা স্বাধীন হতে পারে না। এবং এটাই classical কলার প্রধান দূর্বলতা।
ভাবপ্রধান বা romantic কলা দ্বন্ধ+গতি+চাঞ্চল্যের সৃষ্টি ও প্রকাশ। নিজের মনের মধ্যে ‘বৃত্তির’ দ্বন্ধ, এবং দ্বন্ধজনিত সমাধানের শান্তি ও আনন্দের রূপ—এই-ই romantic art. আবার মানসিক বৃত্তির দুঃখ, দুর্দশাও romantic কলায় সমানভাবে প্রকাশিত। খ্রিস্টের জীবন, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মধ্যে আত্মার যে-দ্বন্ধ, এবং সেই দ্বন্ধের জয়লাভ ও আনন্দ romantic art-এ বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে অন্তর্জগতের মূল্য বাহ্য জগতের চেয়ে অধিক। Romantic কলা ও সাহিত্যে আত্মার আত্মসম্মান, প্রেম, প্রভুভক্তি এসব পরিকল্পিত ও পরিস্ফুরিত। আমি আত্মা, অতএব আমাকে কেউ সম্মান করুক, এই বিবেচনা আত্মসম্মানের। দুই আত্মার বোঝাপড়া, একই নির্মেঘ আকাশের চিন্তা ও প্রবৃত্তি—এই প্রেম। আর প্রভু সর্বতপ্রকার দোষত্রুটিহীন। আলোচনা সমালোচনাবিহীন ভক্তিই প্রভুভক্তি। এইসবই হেগেলের মতে গ্রিক কলায় সুস্পষ্ট। আবার তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণও করেছেন গ্রিক শিল্পের মাত্রারিক্ত দৈহিক সুখ ও ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তির বাহুল্যতার। হেগেল স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পকে romantic art-র শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করেন নি। তাঁর মতে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য গতিকে প্রকাশ করতে অক্ষম। সেক্ষেত্রে চিত্র, সঙ্গীত ও কবিতাই romantic art-র আদর্শ। সঙ্গীত ও কবিতা চিত্রের চেয়ে উন্নততর, কারণ চিত্র বস্তুর বাহ্য রূপের প্রকাশে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু সঙ্গীত (তার বাহন সুরঞ্জিত সুর) ও কবিতা (তার বাহন শব্দ ও মানসিক বৃত্তির গতিশীল সঞ্চালন) নিত্য, শুদ্ধ আত্মার সর্বব্যাপী অপরিবর্তনশীল অস্তিত্বের নির্মোহ জানান দিতে সক্ষম।
. . .
উৎস
১) ১৮১২-১৬ সালে হেগেলের Science of Logic প্রকাশিত হয়। ইহা এক যুগান্তকারী গ্রন্থ বিশেষত তর্ক ও ন্যায় বিচারের দাবিতে। নিখিল বিশ্বের বিকাশের মূলতত্ত্বের কারণ, উদ্দেশ্য এবং ধাপে ধাপে বিবর্তনের ধারাবাহিকতার বিবরণ অত্যন্ত মেধাবী ও যোগ্যতর ভাবে হেগেল এখানে আলোচনা করেছেন। হেগেলের মতে দর্শন কেবল কতিপয় চিন্তার কুয়াশা নয়, বরং এর একটা পরিস্কার কাঠামো আছে, যা কোনোভাবেই দুর্বোধ্য হতে পারে না। হেগেলের কাছে দর্শন জ্যামিতির মতো specified আকৃতি ও গঠন সম্বলিত। হেগেলের logic বিষয়ে William Wallace বলেছেন ‘This is the work which is the real foundation of the Hegelian philosophy. It’s aim is the systematic reorganization of the common wealth of thought. It gives not a criticism like Kant; not a principle like Fichte; not a bird’s eye view of the fields of nature and history like Schelling; it attempts the hard work of reconstructing, step by step into totality the fragments of the organism of intelligence. It is scholasticism if scholasticism means an absolute and all-embracing system’. (The logic of Hegel, Impression, 1931, p. 14).
২) হেগেল মহাসমুদ্রজাত ও মহাসমুদ্রও বটে। এখানে তাঁর একবিন্দু অবগাহনের প্রচেষ্টা।
৩) হেগেলের মৃত্যুর এক দশকের মধ্যে Young Hegelians বা Left Hegelians-র সৃষ্টি। এখানে সবিশেষ পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন Ludwig Andreas von Feuerbach এবং Karl Marx. Feuerbach often recognized as a bridge between Hegel and Marx. বিশ্ব ইতিহাসকে জড়তত্ত্বের সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে হবে, ভাববাদ বা চৈতন্যতত্ত্বের সাহায্যে নয়, এইই dialectic materials approach. ফয়েরবাক হেগেলের ডায়ালিকটিককে বর্জন করেছেন একঘেয়ে বলে। প্রচলিত আছে, মার্ক্সও প্রথম জীবনে হেগেলের ডায়ালিকটিককে ‘দার্শনিক অসহ্য’ মনে করতেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে তিনি বুঝতে পারছিলেন the very soul of the new system কে। (Although at the first glance there may seem good grounds for such an opinion, it is controverted by the before-mentioned fact that in the Deutsch-Franzosische Jahrbucher Engels was already treating the method (dialectic) as the very soul of the system. Plekhanov, Fundamental Problems of Marxism, p. 26). হেগেল-ফয়েরবাক-মার্ক্স এই ত্রয়ী dialectic বুঝার জন্য অন্যত্র অথবা অন্য সময়ে বিস্তারিত আলোচনা করার অভীপ্সা র’ল।
৪) হেগেলের মতবাদ যদি ডায়ালেকটিক ভাববাদ (dialectic idealism) হয়, তাহলে মার্ক্সের মতবাদকে ডায়ালেকটিক জড়বাদ (dialectic materialism) বলা যায়। পার্থক্য শুধু idealism এবং materialism-এর, ডায়ালেকটিকের নয়।
৫) তারক চন্দ্র রায়, পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, ১ম ও ২য় খন্ড, ১৯৫২।
৬) William T. Harris, Hegel’s Logic: A book on the Genesis of the Categories of the Mind, A critical exposition, Chicago.
৭) হেগেলীয় দর্শন, অনিল রায়, জয়শ্রী প্রকাশন, শ্রাবণ ১৩৬৫, কলকাতা।
৮) ‘Universal law pervading the whole of nature”. “Everything is opposite”. “..the One forms the prosupposition of the many and in the thought of One is implied that it explicitly makes itself many’. The Logic of Hegel.
৯) Difference is first of all immediate difference i.e. diversity or variety. In diversity the different things are each individually what they are and unaffected by the relation in which they stand to each other. This relationship is therefore external to them…. This external difference, as an identity of the objects related is Likeness as a non-identity of them, is Unlikeness, The Logic of Hegel, p. 216.