স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী-র সাক্ষাৎকার । আহমদ সায়েম
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৪:৪১ অপরাহ্ণ, | ৮৭৭ বার পঠিত
গত শতকের পাঁচের দশকের বাংলা কবিতায় আসে নবতর এক পরিবর্তন। তখনকার সময়ে নতুন কবিতার আন্দোলন চলছিল কলেজ স্ট্রীটের রাস্তায় রাস্তায়। হাংরি জেনারেশনের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। কফি হাউজকেন্দ্রিক ভালো কবিতা পাঠের আহ্বান ছিল ফেস্টুনে ফেস্টুনে আর প্লাকার্ডে। উৎপল, শক্তি আর বিনয় ছিলেন এ সময়ের কবিতার স্বপ্নদ্রষ্টা। যদিও বিনয় মজুমদার দল গোত্র ছাড়া বিচ্ছিন্ন ভাবে নিজের কাব্যজগতকে ভিন্নভাবে, ভিন্নরূপে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন; কিন্তু বিনয় মজুমদার এই সময়েরই এক প্রবল প্রভাববিস্তারী কবি।
অত্যন্ত মেধাবী বিনয় ছাত্র জীবন থেকেই তাঁর মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন সবখানে। গণিতপ্রেমি কবি বিনয় মজুমদার ঠাকুরনগরের শিমুলপুরে বসবাস করেন কলকাতা ছেড়ে গিয়ে। প্রেম, কাম, প্রকৃতি, গণিত সবকিছু একাকার হয়ে দেখা দিয়েছে তাঁর কবিতায়।
চিরকুমার বিনয় ছিলেন একজন প্রকৌশলী; কিন্তু চাকরির তোয়াক্কা না করে কেবল গণিতচর্চা আর কবিতাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। পরবর্তীকালে তা অনেকের নিকট মিথ হয়ে ধরা দিয়েছে। বিনয়কে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পত্র-পত্রিকার বিশেষ কিছু সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। হয়েছে একাধিক পিএইচডি গবেষণাও; কিন্তু কবি বিনয় মজুমদার ও তাঁর কবিতার জগৎ তারপরও রয়ে গিয়েছে যেন অধরা।
গত ২০২১ সালের মার্চ মাসে কবি ও গণিতজ্ঞ বিনয় মজুমদারকে নিয়ে বাংলাদেশের আশ্রয় প্রকাশন থেকে পাঁচ বছরের পরিশ্রম শেষে দুই তরুণ কবি এহসান হায়দার ও স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তীর যৌথ সম্পাদনায় `এক আশ্চর্য ফুল বিনয় মজুমদার’ নামে একটি বিপুল আয়তনের সম্পাদনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
সম্প্রতি বিনয় মজুমদার সম্পর্কিত এ গ্রন্থের বিষয়ে রাশপ্রিন্ট ওয়েবজিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন— কবি স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী
সুবিধা হয়েছে এটুকুই যে, বিনয় মজুমদার আমাদের দুজনেরই অন্যতম প্রিয় কবি। নইলে সম্পাদনাকাজের সূত্রে আমরা এক বিন্দুতে মিলতে পারতাম না। আর আন্তর্জাল মাধ্যমের প্রতি ঋণ আমাদের স্বীকার করতেই হবে। নইলে যে পরিমাণ টেলিকল করতে হয়েছে তাতে আই.এস.ডি.-র আমল থাকলে বাপপিতেমোর ধনও শেষ হয়ে যেত। তাছাড়া আমরা দুজনেই কবি এবং গদ্যকার, প্রায় সমবয়েসি ফলত যুগরুচিও প্রায় একই। আরেকটা কথা বলার— আমরা দুজনেই উদার প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক পরিবেশে পড়াশোনা করেছি, বেড়ে উঠেছি। তাই সমাজমান্য হরেককিসিম সুড়সুড়ি আমাদের দুজনেরই নেই।
লিট্ল ম্যগাজিন-সহ দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও বিনয় মজুমদারকে নিয়ে বেশ ভালো-ভালো কাজ হয়েছে; আপনাদের কাজও বেশ বড়ো, এ আয়োজনের উদ্দেশ্য নিয়ে জানতে চাই।
স্নিগ্ধদীপ: হ্যাঁ, আমরা জানি যে বিনয় মজুমদার এই মুহূর্তের পত্রিকাবাণিজ্যের সসাগর থিম। দু-বাংলাতেই তাঁকে নিয়ে কাজ হচ্ছে। এমন-কী বাংলা গবেষণাক্ষেত্রেরও তিনি এ-মুহূর্তের অন্যতম শিকার। বিশেষত বিদ্যায়তনিক গবেষণার কথাই আমি বলতে চাইছি। কিন্তু এসব কিছু উল্টেপাল্টে দেখে, হাতড়ে দেখে, সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে তার অধিকাংশেই ব্যক্তি বিনয় ও শিল্পী বিনয়ের যে-সমন্বিত রূপটি আদত বিনয়, তিনি ডিসব্যাল্যান্স্ড অবস্থায় রয়েছেন। একথা ঠিকই যে, শিল্পীজীবন ডিসটিল্ড ওয়াটারের মতো বিশুদ্ধ, স্বাদহীন ও খাদহীন হয় না। তা খুবই রঙিন ও আকর্ষক। আর মানবচরিত্রের এই দুর্বলতাকে কবি বিনয় নিজেই চিহ্নিত করে গেছেন তাঁর কবিতায়— “সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও/ মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।” ফলত রবীন্দ্রনাথের চাইতে গুগ্ল-জ্ঞানী জনতার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন কাদম্বরী দেবী বা রাণু অধিকারী কিংবা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, বিনয়ের চেয়ে গায়ত্রী। এদিকে বিনয়ের ভক্ত যাঁরা, তাঁরা বিনয়ের হাঁচি-কাশিকেও কবিতা ভেবেছেন। বিদ্যায়তনিক ও স্বাধীন বিনয়গবেষকেরা কখনও অ্যাকাডেমিক প্রোটোকল মানতে গিয়ে, আবার কখনও বিতর্কের ভয় কিংবা ভাসা-জানা— যে-কারণেই হোক সর্বতোভাবে কবির সকল সৃষ্টির ভিতর থেকে পজিটিভিটি ছড়িয়ে দেওয়াকেই লক্ষ্য ও পরমার্থ ভেবেছেন। বিনয় রবীন্দ্রনাথ নন, বিনয় বিনয়। বিনয়ের প্রধান পরিচয় হল তিনি ‘ফিরে এসো, চাকা’ নামে একটি আশ্চর্য ও অনশ্বর কবিতার বই লিখেছেন, যে বইয়ের বয়েস আজ ষাট। রবীন্দ্রনাথ প্রতিভাদানব, যাঁর প্রতিভার গ্রাফিক্যাল পতন নেই। যাঁর শুরু থেকে শেষ লেখা (“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে,/ হে ছলনাময়ী।”)-র ইতিহাস জানলে ও কেবল উপর-পাঠ করলেই যে-কোনও মূর্খও সেকথা বলবে। চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় এই তুলনায় খানিক আসতে পারেন। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ অবধি আমরা গ্রাফডাউন পাব না। মহাপ্রতিভা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা মহাপ্রতিভা হুমায়ূন আহমেদ-এর বেলায়ও কিন্তু গ্রাফডাউন রয়েছে। তাই তাজমহল যেমন একটি, রবীন্দ্রনাথও একজন। যাইহোক… লেখক ও গবেষকরা আজও বিনয়কে বেশিটাই তাঁর কৃতির কৃত্তিকাবরণে ঢেকে রেখেছেন বলে আমাদের মনে হয়। আমরা সম্পাদনার সময় এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেছি। চেয়েছি বিনয় যে ও যেমন— বিনয়ের সেই নগ্ন প্রকাশটি পাঠকের সামনে তুলে ধরতে। উদাহরণস্বরূপ বলি— আমি নিজে বিনয়গবেষক অথচ এই বইতে আমার লেখাটিই একটি নেগেটিভ লেখা। এরকম আর কী… বিগ বাট বুলশিট তৈরির উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না। আমরা উদ্দেশ্য ঠিক করে নিয়ে কাজ করেছি। কাজ করতে করতে উদ্দেশ্য ঠিক করিনি। তবু চার বছরের সময়কাল জুড়ে গ্রন্থনাম, গ্রন্থমান ও গ্রন্থসজ্জা নিয়ে ভেবে গেছি। হাউ টু বি আ গুড এডিটর— এই ছিল আমাদের তাগিদ। লেখা ও আঁকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা কোনওরকম পক্ষপাত, সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি বা ব্যক্তিক সম্পর্ককে প্রশ্রয় দিইনি এটুকু বলতে পারি। যে-সকল লেখক অকারণেই বিনয়জীবন দিয়ে বিনয়কবিতাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছেন অর্থাৎ তাঁদের অল্পজ্ঞানের মাছকে কুশলী শাকে ঢাকবার চেষ্টা করেছেন, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁদের লেখা আমাদের বাদ দিতে হয়েছে। কেন-না পাঠকের জ্ঞাতার্থে একটি দীর্ঘ বিনয়জীবনী সংযুক্ত হয়েছে এই গ্রন্থে। কিছু পুরনো ও প্রয়াত লেখকের লেখা বা বিনয়েরই কয়েকটি পুরনো লেখা ঐতিহাসিক কারণে আমাদেরকে রাখতে হয়েছে। কারণ আমরা বিনয়বিষয়ক একটি প্রামাণ্য পাঠ তৈরি করতে চেয়েছি। শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতার একটি মডেল সংকলন করতে হলে যেমন মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ প্রমুখকে রাখতেই হয় তেমনই ব্যাপারটা। এই গ্রন্থ যাঁরা হাতে তুলে নেবেন তাঁরা খোলসহীন সম্পূর্ণ আকর বিনয়কে পাবেন বলে মনে করি। এর বেশি বলছি না। বাকিটা কিনে বা সংগ্রহ করে পড়ে আস্বাদন করে বুঝতে হবে। রসগোল্লা যে খায়নি তাকে যেমন রসগোল্লার স্বাদ বোঝানো সম্ভব নয়।
জেনেছি ১০৩ ফর্মার প্রাইম সাইজের একটা বই! বিনয়ের কোনও বিশেষ লেখা, বই, গণিত (গণিতের নতুন কিছু দিক ওঁর হাত দিয়ে এসেছে) কোনওটিই বাদ দেওয়ার নয়। আপনারা কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিলেন এই বইয়ে?
স্নিগ্ধদীপ: অবধারিতভাবে জীবন, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ডায়েরি, চিঠিপত্র, গণিত-খসড়া— কোনও দিকই বাদ যায়নি। কিন্তু পাশাপাশি দুটো কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। ১ম, বিনয় মূলত কবি। তাঁর অন্যান্য পরিচয় যদি কখনও মুছেও যায়, কবি বিনয় থেকে যাবেন। আর কিছু না হোক তাঁর ‘ফিরে এসো, চাকা’-র থেকে যাওয়াই উচিত। একটি বইয়ের প্রত্যেকটি কবিতাই কবিতা— এমন উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের ‘প্রান্তিক’ কিংবা জীবনানন্দের ‘মহাপৃথিবী’ হয়। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ল— বিনয়ের প্রিয়তম কবিতার বই ছিল ‘প্রান্তিক’। জীবনানন্দোত্তর কালে শঙ্খ ঘোষের ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ বা বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’ বা ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘জিরাফের ভাষা’ এ-পঙ্ক্তিতে আসতে পারে। স্বাভাবিক কারণেই তাই আমাদের বইতে কবি বিনয়ই বেশি মূল্যায়িত হয়েছেন। ২য়, অগোছালো বিনয় তাঁর জীবনখাতায় পাতায়, ঘরের দেয়ালে, মেঝেতে অনেক জ্যামিতিক ও বীজগাণিতিক খসড়া কষেছেন। তার কিছ-কিছু সংরক্ষণ করা গেছে, কিছু যায়নি— হারিয়ে গেছে। বহু পত্রিকা বা বইতে সেই খাতার পাতার স্ক্যান্ড ইমেজ ছাপা হয়েছে। এ-গ্রন্থেও এ-অবধি প্রকাশিত হয়নি এমন কিছু স্ক্যান্ড ছবি মুদ্রিত হয়েছে। কিন্তু শ্রীনিবাস রামানুজন যেমন বহুলাংশেই পরীক্ষিত ও প্রমাণিত, বিনয় মজুমদার তা নন। যতদিন না তা হচ্ছে, সেগুলি নিয়ে আলোচনার অতিবিস্তার উচিত হবে না বলেই আমরা মনে করেছি। তবে আলোচনার আলোক একেবারেই পৌঁছয়নি, বিনয়ের জীবন ও সৃষ্টির এমন দিগন্ত হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না এখানে।
এহসান হায়দার ও আপনি দুজনের ভাষা এক হলেও দেশ কিন্তু ভিন্ন, এতে করে আপনাদের কাজের সুবিধা ও অসুবিধার কথাগুলো জানতে চাই।
স্নিগ্ধদীপ: অত্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন। দেখুন, সুবিধা হয়েছে এটুকুই যে, বিনয় মজুমদার আমাদের দুজনেরই অন্যতম প্রিয় কবি। নইলে সম্পাদনাকাজের সূত্রে আমরা এক বিন্দুতে মিলতে পারতাম না। আর আন্তর্জাল মাধ্যমের প্রতি ঋণ আমাদের স্বীকার করতেই হবে। নইলে যে পরিমাণ টেলিকল করতে হয়েছে তাতে আই.এস.ডি.-র আমল থাকলে বাপপিতেমোর ধনও শেষ হয়ে যেত। তাছাড়া আমরা দুজনেই কবি এবং গদ্যকার, প্রায় সমবয়েসি ফলত যুগরুচিও প্রায় একই। আরেকটা কথা বলার— আমরা দুজনেই উদার প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক পরিবেশে পড়াশোনা করেছি, বেড়ে উঠেছি। তাই সমাজমান্য হরেককিসিম সুড়সুড়ি আমাদের দুজনেরই নেই। কেবলমাত্র দুটো বিষয়ে আমরা প্রাদেশিক— জাতীয়তা ও ভাষা। বাঙালি জাতিত্ব ও বাংলা ভাষা ছাড়া আমাদের অন্য আবেগ নেই। এবার আসি অসুবিধের প্রশ্নে। কিছু বাস্তব অসুবিধে তো হয়েইছে। তা অস্বীকার করলে সত্যের অপলাপ হবে। যখন এ-বইয়ের কাজ (লেখা সংগ্রহ ইত্যাদি) শুরু হয়, তখন আমরা কেউ কাউকে সম্মুখে চিনি না। আমাদের আলাপ ভার্চ্যুয়ালি। আমার স্ত্রী পায়েলী (ধর)-র সঙ্গে অবশ্য আগে থেকেই ওর (হায়দার দা-র) একটা ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিল। তবু ফেসবুকে দেওয়া তথ্যের তো কোনওরকম সত্যতা নাও থাকতে পারে! তাই স্নিগ্ধদীপ চক্রবর্তী কে, কী ও কেন আর এহসান হায়দারই বা কে, কী ও কেন— তার মধ্যে বিস্তর ফাঁক থেকে যাবার সম্ভাবনা ছিল; বলা ভালো আশঙ্কা ছিল। পরম করুণাময়ের কাছে আজ আমি কৃতজ্ঞ যে শেষমেশ তা হয়নি। তবু এই চার বছরেরও বেশি সময় আমাদের জন্য ভীষণ কঠিন গিয়েছে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম এই কাজটি এক বছরের মধ্যে করে ওঠা যাবে। কিন্তু তা যে করে ওঠা গেল না তার জন্য দুটো বিষয় দায়ী। ১ম, মানুষের প্রতি আমাদের আস্থা আর মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ— এই রবীন্দ্র-উবাচ আমরা মনে রেখেছিলাম। বাঙালির ওপর বিশ্বাস রাখা বিপজ্জনক— হুমায়ুন আজাদের এই প্রবচনটির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। প্রকাশনা বেনিয়ার দুনিয়া, তা আবেগে চলে না। এক্সেল শিটের লাভক্ষতির হিসেবে চলে। তাই এই কাজটা অনেকদূর এগিয়ে যাবার পরেও দুবার করে আমাদের প্রকাশক পরিবর্তন করতে হয়েছে। যা অভিপ্রেত ছিল না শুধু তা-ই নয়, যা আমাদেরকে অনেক মিথ্যে পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। অসীম শূন্যতারও জন্ম দিয়েছিল আমাদের সামনে। বারংবার মনে হয়েছিল আমাদের স্বপ্নের এই প্রকল্পটির কাজ আর বোধহয় সামাল দেওয়া গেল না! ২য়, কাজটা করতে গিয়ে আমাদের পছন্দ ও চাওয়ার না-আপস মনোভাবের কারণে বইটির ব্যাপকাকার হয়ে পড়া। যেহেতু দুজনেই ভার্চ্যুয়াল ক্ষেত্র থেকে দুজনকে দেখছি এবং যেহেতু দুজনেই অতিমানুষ নই, তাই কখনও অবিশ্বাসের বাতাবরণও তৈরি হয়েছিল আমাদের মধ্যে। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি এটাও ঠিক। যাঁদের থেকে লেখা নিয়েছি, আমাদের তরফ থেকে তাঁদেরকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে এক বছরের মাথায় বইটি প্রকাশ পাবে। বাস্তবে তা হয়নি। তাঁদের মধ্যে কেউ লাগাতার তাগাদা দিয়েছেন, কেউ উৎসাহ জুগিয়েছেন, কেউ আমাদের সম্পাদক হবার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কেউ-বা তাচ্ছিল্য করে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। এই ব্যাপারগুলো প্রচুর টেনশন তৈরি করেছিল আমাদের দুজনেরই অভ্যন্তরে এবং আমাদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে। আমি বাস্তবে বইটির নির্মাণপ্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে পারিনি কাঁটাতারের কারণে। প্রথম থেকে তো বটেই— এই করোনা-পরিস্থিতির মধ্যেও ফিল্ড ওয়ার্ক যেখানে যা করার সব হায়দার দা-ই করেছে। তাকে আমার সুপ্রীত বাধাই। বইটির জন্মের পর আমি দেখেছি, অবশ্যই ভার্চ্যুয়ালি। করোনাকারণে সীমান্ত বন্ধ। বইটিকে জন্মাতে দেখলে আরও ভালো লাগত। রাস্তার লড়াইয়ের সঙ্গেসঙ্গেই ভালোলাগার এই অনুভূতিটুকুও আমি মিস করেছি। এই দুঃখ আমার যাবার নয়।
লেখকদের লেখার মূল্যায়নে নতুনত্ব কী ছিল কিংবা বলতে পারেন দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল আপনাদের?
স্নিগ্ধদীপ: সেরকম যান্ত্রিক কোনও পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি নির্বাচিত লেখাগুলির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে। সাহিত্য গণিত নয়। তবে প্রধানত যা আমরা খুঁজে পেতে চেয়েছি তা হল লেখকদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। তা বিতর্কিত হতেই পারে। বিতর্কিত হলে নিষ্ঠ পাঠক নিশ্চয়ই তার জবাব দেবেন। সাহিত্যের সমস্ত শাখার মধ্যে কবিতা হল সবচাইতে জটিল, অসংজ্ঞেয় ও রহস্যময়। কবিতাকে শল্কমোচন করতে জানতে হয়। শব্দ-চিত্র-উপমা-প্রতীক ইত্যাদি মিলেই একটা সমগ্র কবিতার গঠন। সমগ্রতাই কবিতা। এমন নয় যে, একটি কবিতাকে চিরতে চিরতে তার পেট থেকে মুক্তো বেরিয়ে এল। একটি পেঁয়াজ যেমন ছাড়াতে ছাড়াতে পেঁয়াজ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না, কবিতাও তেমনই। প্রতিটি শল্কই যেমন পেঁয়াজ, প্রতিটি শল্কই তেমন কবিতা। প্রয়োজন শিল্প নয়, প্রলম্বনই শিল্প। ঈশ্বরের সৃষ্টিতেও এই ব্যাপারটিই রয়েছে। ধরা যাক, আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চালাবার জন্য, চোখে দেখার জন্য কিংবা কানে শোনার জন্য কয়েকটি ফুটো রাখা— এইটুকু হল প্রয়োজন। ফুটোটা শিল্প নয়। কানের লতি, পক্ষ্ম, ভ্রূ-পল্লব কিংবা নাকের ডাঁশার প্রলম্বিত গড়নটাই হল শিল্প বা শিল্পসৌন্দর্য। এই বিষয়টি ধরতে পারা চাই কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ লেখবার ক্ষেত্রে। কেউ-কেউ আছেন যাঁরা শব্দের ছাল ছাড়িয়ে কবিতাকে সজিনার ডাঁটা ছিবড়ে করে ফেলার আনন্দ পান। আবার কেউ কবিতার পেট কেটে রূপকথার মাণিক্য খোঁজেন। কেউ-বা লেখার মধ্যে অনাবশ্যক কাব্যভাবের ফেনা তৈরি করে নিজের অপরিণত বোধটিকে আড়াল করবার খেলা করেন। বলাবাহুল্য তা অংশদৃষ্টি। এই ধরনের অনেক লেখাই আমাদের কাছে এসেছিল যা প্রেমিকার অভিমানে তুচ্ছ করতে হয়েছে।
‘এক আশ্চর্য ফুল : বিনয় মজুমদার’ বইটি পাঠককে কেন সংগ্রহ করতে হবে বলে মনে করেন আপনি?
স্নিগ্ধদীপ: এটি গ্রন্থ নয়, গ্রন্থাগার। লেখক শ্রদ্ধেয় অমিতাভ পাল মহাশয় অন্তত এমনটাই মনে করেছেন। তাঁর এই মন্তব্যে বিশেষ সততার রৌদ্র রয়েছে বলে আমার মনে হয়। এই বইটি পাঠকের পাঠাভ্যাসকে উসকে দেবে, ভবিষ্যতের গবেষকরা এই বইতে (বইয়ের ‘অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত বিনয়’ নামের অংশটি যেমন) পেয়ে যেতে পারেন অপ্রত্যাশিত ও দুর্মূল্য কিছু মণিমানিক। কবি ও কবিতাপ্রাণ মানুষ, বিনয়প্রিয় সুজন প্রত্যেকেরই তাঁর-তাঁর খোরাক ছড়িয়ে আছে এই বইয়ের অলিতে গলিতে— এ আমাদের স্থির বিশ্বাস। বইটি সংগ্রহ করলে পাঠকের ব্যক্তিগত সংগ্রহের তালিকায় শুধুমাত্র একটি নাম সংযোজিত হবে তা নয়, বরং নীলকণ্ঠ পাখির একটি পালক তাঁর সঞ্চয় হবে বলে আমরা মনে করছি। ধন্যবাদ।