একগুচ্ছ কবিতা । আনিসুর রহমান অপু
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ এপ্রিল ২০২১, ৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ, | ৬৭১ বার পঠিত
নীল নিঃসঙ্গ্যের বোঝা
জানি না কখন তলানিতে নেমে গেছে জোয়ারের
জল, বিশ্বাসের প্রমিত প্রবাহ। ফরেস্ট হিলের
রাত—মৌ চাষের গল্প—ঢেকে গেছে গাঢ় কুয়াশায়!
পাহাড়ের প্রতিশ্রুতি সমতলে ছড়ায় এ কোন
প্রহসন! আস্থাহীন প্রীতি-প্রজনন খোয়াড়ের
ক্ষরণ বরণ শুধু, ধু-ধু নিঃস্বতা অন্ত্যমিলের
দেয় যে যোগান থাকবে ক’জন তার ভরসায়?
ভেবেছিলাম, ঝড়ের মুখে তুমি-আমি পোড়োবাড়ি
হবো একদিন? নিজ নিজ ছায়ারাও এমন অবাধ্য
রয়ে যাবে, ভেবেছে কে-কবে! অনুভবে ভাষা খোঁজা
রোমন্থনের রঙিন স্মৃতিই যা সঞ্চয় এখন!
পরিচর্যার অভাবে প্রেম গুটিয়েছে পাততাড়ি,
অথচ একদা ছিল সে কাছের, একান্ত আরাধ্য—
কে-যে চাপিয়েছে কাঁধে তার, নীল নৈঃসঙ্গ্যের বোঝা!
ভেঙে দেয় পথের কম্পাস
ভাবি, ভুলে যাবো—
দু’হাতে সরিয়ে সবিস্তার আগাছা জঞ্জাল
সারা মাঠে রুয়ে দেবো রোদেলা সম্প্রীতি,
পারিপার্শ্বের শকুনেপনা আর তার নিত্য নবায়ন
কথার কুহকে সবকিছু জেতার জ্যামিতি,
ভেঙে দেয় পথের কম্পাস!
অন্তরের উদ্যমতা নাই হয়ে যায়—
ছাই হয়ে যায় নক্ষত্রের আলোর আশ্বাস!
পাঁজরের নিচ থেকে উঁকি মারে গনগনে স্মৃতি
পাশ ফিরে শোয় সরল স্রোতের ধারা
প্রহসনে পিষ্ট নিবেদন নিঃসঙ্গ সৈকতে একা
ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস!
কী করে ঝুঁকি নিই, প্রাণটা সবেধন
ঘটনা গোলমেলে, ছুটছি মাথা ফেলে
কার কি আসে যায়, অতলে ডুবে গেলে!
কুটিল ছলে বলে, মা-মাটি পায়ে দলে
মানুষ বোঝে সব, যদিও গ্যাঁড়াকলে!
গিন্নি এই ধারে, কর্তা ওই পাড়ে
ধূর্ত আরে ঠারে, কল ও কাঠি নাড়ে!
পা চাটা চাটুকার, ঘৃণিত ঘর-বার
হায়েনা-ছুঁচো আর, সাপেরা চারধার
পাঁজর চুরমার, বাড়ছে হাহাকার
মুখোশী মুখ ‘পরে, দু’বেলা থু থু মার!
কুটিল বিবেচনা, ঘসেটি গবেষণা
হাজারী আলোচনা, বাজারী প্রণোদনা
তুলছে সেই ফণা, ঢালছে বিষকণা
বিলিয়ে ষোলো আনা, দেখায় সতীপনা!
সতত ধিকৃত, মগজ বিকৃত—
চাটারা চিহ্নিত, খুনিও স্বীকৃত—
তবুও চামচায়, পতাকা খামচায়
শকুন-শ্বাপদেরা, মুফতে নাম চায়!
চেতনা কারুকাজ, জিতছে তেলবাজ
কোথা সে রণসাজ, হারছে দেশ আজ!
গুমের গুমরানি, হরেক হয়রানি
ঘোঁটের কানাকানি, ভোটের নিশিরানী।
গুগল ফেসবুক, বলেছে উজবুক
তবুও দুর্মুখ, গিবতে খোঁজে সুখ!
বিষের বিভাজন, ধুঁকছে জনগন
চুষছে ললিপপ, সুশীল সুধীজন!
আমরা ক্ষমাশীল, বুকেতে বড়ো দিল
নিয়ত খাই কিল— নিগড়ে হই নীল
তবুও সাধারণ, সতত ভুলোমন—
কী করে ঝুঁকি নিই, প্রাণটা সবেধন!
আশা চাই, আশা
প্রসঙ্গরা এভাবেই এমন প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়, প্রতিকূলতায়!
জানালার পর্দা সরালেই মায়াবতী মেঘ, বর্ণাঢ্য বৃষ্টির বৈভব ছড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ধুয়ে নাও ভেজা চোখ, ডুকরানো বিষণ্ণতার ঘরগেরস্থী,
চলো ফেরাই, প্রত্যয়ী দিন—’
হৃদয়ের ঋণ ঝরাপাতার মোটিফে তবু আঁকে বিষাদের আলপনা!
আকাশও হারিয়েছে খোদ নিজের উপর থেকে আস্থা—
জেনেছে অস্তিত্ব তার শূন্যতার খেলা, বাতাস তাড়িত তৃণ।
মেহগনি মন মেনেছে যে গহীনের গভীরতা, নীল দহনের রহস্য তোরঙ্গ— ছায়া তার দীর্ঘশ্বাস পোষে যার দুঃখে!
কোন সুখে কবিতার বিদীর্ণ অক্ষর হতে উড়েছে উদাস প্রজাপতি!
অবজ্ঞার দগদগে দাহ, কোন জলে যায় চুকেবুকে!
মেঝে থেকে ছাদ অব্দি ছড়ানো হতাশা—
আশা চাই, আশা—সেই সবুজ ডানার পাখিটি
আত্মার কুঠুরিতে যার বাস!
দিশেহারা-দ্বিধান্বিত রাত্রি ফুঁড়ে প্রাণিত প্রভাত!
নরম কোমল প্রসন্ন প্রশান্তি—
স্বপ্ন উপচানো মুঠো;
ঘটনার তোড়ে হারিয়ে যাওয়া কবেকার আলাদা ঠিকানা দুটো,
আলোয় ভাসুক আরো একবার,
দ্যোতনা জড়ানো মুখে মায়াবী দু’চোখ যার—
সৈকতে প্রথম দেখা।
জানে সে, যা কিছু বিচ্ছিন্নতা, সে কেবল অনিচ্ছার দায়,
উপায়ান্তহীন এই অভিপ্রায়— জানে কুহু, কেকা—
অসমাপ্ত স্বপ্নের ভেতর থেকে জেগে উঠে, ডেকে উঠি, ‘রেবেকা’ , ‘রেবেকা’ !
নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে
তাহলে এই-ই সেই প্রেম—
পলেস্তারা খসে পড়া ফ্যাকাশে-ধূসর;
কী বোকার মতো অথচ, আঁকড়ে ছিলাম অপেক্ষা!
নেশাগ্রস্থ মাকুর মতোন বুনে গেছি বিদগ্ধ বিড়ম্বনার বেনারশি!
নানা অভিযোগ, চাপের পাহাড়
বিষাক্ত শব্দের বানে অন্ধকারে বিদ্ধ হতে থাকা
ঘাড়গোঁজা বিমর্ষ সংসার—
বারে বারে ঠেলেছি দুয়ার —খোলেনি, জ্বলেনি বাতি
মৌ-লোভীদের দাপটে!
কতো তৃষ্ণা নিয়েই না সাজিয়েছি সুন্দরের সারাবেলা
প্রশান্ত দিনের আশায় গুনেছি দিন
অথচ সমস্ত সুসংবাদগুলো গিলে ফেলেছে শূর্পনখার নথি;
যা-কিছু এখন দিন, রাত্রি দিয়ে ঘেরা
কী-করে যে হবে আরাধ্য আলোর কাছে ফেরা!
শরীরের সংবর্ধনা নেই—
স্বৈরাচারের ছুঁ মন্তরে আটকে আছে মনের মিছিল!
সমর্পন-নিবেদন অথবা প্রশান্তি কুৎসিত বিভাজনে খানখান!
সবুজের সংকটে পাখিরা কষ্টে আছে খুব,
দীপ-ধূপ জ্বলছে না সমঝোতাকামী অম্লজানের অভাবে!
পিষ্ট গোলাপের বিষণ্ণতা বোঝারও নেই কেউ,
বৃষ্টিহীন মেনোপজি মেঘেদের মতো ধুঁকছে স্বপ্ন-ও সম্ভাবনা!
তবু সেঁটে থাকি— আঠাহীন
কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানির মতো ঝুলে থাকি,
যাপনের ছাই দিয়ে আঁকি রামগড়ুরের হাসি—
নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে গেয়ে যাই বেসুরো ভৈরবী!
রূঢ় সেই সত্যিটাও
এইসব অভিমানের বাজার মূল্য নেই আর—
কে বা কার ভেজা চোখ দেখে ভেজে আজ ইটের শহরে!
জহরে-কহরে ধুঁকছে যে যাপন-জীবন
ট্রাকের চাকার নিচে পিষ্ট হওয়া স্বপ্ন-সহবাস
মর্গের রিপোর্টে পাবে তার কতোটুকু প্রাণ—
প্রতিদিন রুদ্ধ দরোজার থেকে মুখে চুনকালি মেখেও যে
পথিক চেনেনি কিছু ফানুসের রঙ, সঙ সেজেই সে
দীর্ঘশ্বাস সেঁটে হেঁটে যাবে প্রবঞ্চিত পথ!
কবিতায় ফোটানো কি যায় সমস্ত দ্বৈরথ!
হিজড়াদের প্রসাধনের মতো দিয়েছে কতো-কী উপচানো প্রেম
টুইটুম্বুর ভালোবাসায় খাবি খাওয়া আহা ভায়োলিন
বয়ে গেলে অথচ ট্রমায় তড়পানো রাত্রিদিন—
পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা সাফল্যের ঋণ
দখলে-দুষণে চলে গেলো সব ফড়িয়াদের ডেরায়!
চেনা মানচিত্র জুড়ে শুধুই স্বার্থের অশ্লীলতা,
লাভ ও লোভের লেলিহান শিখা
প্রতিনিয়ত পুড়িয়ে দিচ্ছে সহমর্মিতার সুবাতাস!
আতশবাজির উৎসব থেকে প্রত্যাখ্যান নিয়ে ফিরেছে যে ম্লানমুখ,
দুঃস্বপ্নে তাড়ানো যার আবেগের আলপথ
অবহেলা মেখে মেখে নিত্য নীল হয়েছে নৈমিত্তকতা—
বোঝার উপর তার শাকের আঁটির মতো
আরো কিছু বিষণ্ণতা রেখে দাও—
নেবে নজরানা নেচে নেচে জমি-জোত, প্রাচুর্য ও পরগনা,
দিতে দ্বিধা অথচ সামান্য সুঁই —এই যার মননের ভূঁই
আত্মকেন্দ্রিক সে মেঘের দুয়ারে মেলে না যে বৃষ্টির প্রত্যাশা—
বেচারা জীবন জেনে নিক রূঢ় সেই সত্যিটাও!