নিরীহ জিজ্ঞাসা বা একগুচ্ছ কবিতা । নাহিদা আশরাফী
প্রকাশিত হয়েছে : 20 February 2021, 1:05 pm, | ৭৬৫ বার পঠিত

অর্থনীতি বনাম কুরুসকাঁটার ফুল
নীতি আমার বউয়ের নাম
নতুন সংসার, সামান্য অর্থ
তবু আমাদের সময়গুলোকে সে
কুরুসকাটার নিপুণতায় বুনে যেত
কাটার হিসেব কষে কষে
সুতোর গনিত বুঝে বুঝে
একেকটা দিন সে ফুটিয়ে তুলতো
বেলী অথবা গন্ধরাজের মতই
অতপর অর্থ নামক মোহনীয় গ্ল্যামারগার্ল
আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই
আমি নীতিকে ভুলতে শুরু করলাম
জ্ঞাতে কিংবা অজ্ঞাতে
এখন আমার অনেক অর্থ
শুধু নীতিই প্রাক্তন হয়ে গেছে …
একটি নিরীহ জিজ্ঞাসা
একটি কালো মাথাকে নত করতে
ব্যবহৃত হয়েছিলোএকটি সাদা হাটু
অথচ একটি কালো মাথা
কোন কিছু ব্যবহার না করেই
কোটি সাদা মাথাকে নত করেছে।
এবার পৃথিবীকে প্রশ্ন করো হে বর্নবাদ
কে বেশি শক্তি ধারণ করে
সাদা হাটু নাকি
কালো মাথা?
যে ঠোঁট জুড়ে থাকে প্রণয়ের মহাদেশ
১
নাম তার জপ করি নামতার মত
সিজদায় পরে থাকি বলি বারবার
প্রেমের আড়তে করি যত কারবার
মেলালে তুমিই শেষ মুলধন তত।
২
জল জানে তার বুকে কত জলযান
এপার-ওপার করে যত মানুষেরে
স্রোতের মতন মন জোর করে বেঁধে
বাঁধের স্বভাব নিয়ে লোকালয়ে ফেরে।
৩
জানালায় রোজ আমি মেঘ হয়ে ভাসি
মেঘের দ্রাঘিমা তুমি জলের কম্পাস
বিরহের কেন্দ্রে কত বিষাদের বালি
ব্যাথার গোলার্ধ জানে সেই ইতিহাস।
আমাদের মা মূর্খ ছিলেন
জানতাম আমাদের মা খুব গরীব। আমরা তিন ভাইবোন অবশ্য এসবের ধার ধারতাম না। অনাহারীর কাছে খাবারের চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। তাই খিদে পেলেই ইসরাফিল এর শিঙ্গার চেয়েও জোর চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলতাম।
মা তখন মাটির ভাঁড়ে রাখা ইতিহাসের আটায় কিছু ভুগোল মিশিয়ে রুটি বেলে দিতেন। তপ্ত তাওয়ায় রুটি এক বিপন্ন মানচিত্র হয়ে উঠতো।
অইদিনই জানলাম মা আমাদের কত বড় ইতিহাসবিদ।
আমাদের গলা দিয়ে শুকনো রুটি নামে না। মা বললেন, ‘কিছু মিথ্যে মাখিয়ে নে বাছা। মিথ্যে মাখনের কাজ করে। রুটি গিলতে সুবিধেও বেশ।’
অইদিন টের পেলাম মা আমাদের কত বড় রাজনীতিবিদ।
চাল – না ছিলো সামাজিকতায়, না ছিলো মাথার উপরে, না ছিলো উনুনের উপরে। প্রথম দুটির থোড়াই কেয়ার করতাম। কিন্তু উনুনমুখী চালের জন্যে আমরা নেকড়ের মুখ অথবা শাপের গর্তেও হাত ঢুকিয়ে দিতে পারি। অবশ্য এসবের কোন প্রয়োজনই হত না। ধান ক্ষেতে ইদুরের গর্ত কোথায়, মা ঠিক জানতেন। সারাদিনের সংগ্রহ তিন মুষ্টি চাল। তাতে কতটা জল মেশালে তিনজনের দুইবেলার ফেনাভাত তৈরি হবে ; মা ঠিকঠাক মেপে নিতেন।
সেদিন থেকেই বুঝতে শিখলাম মা কতবড় গণিতবিদ।
একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, একজন প্রজ্ঞাবান ইতিহাসবিদ, একজন অনন্যসাধারণ গণিতবিদকে সারাজীবন মূর্খ ভেবে বড় হওয়া এই আমরা নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কাগুজে সার্টিফিকেট নিয়ে বড়াই ও লড়াই করতে করতে সতত ভুলে যাই, আমরা মূলত কতটা মূর্খ!
চাঁদ মাতা
এই যে এত কথা বলি, স্বল্পমূল্যের ফুলদানিতে কিছু মিথ্যেফুল সাজানোর বাসনায়; আপন-পিয়াসী মন তো জানে, এক উৎকন্ঠিত শামুকের পীতবর্ণ খোলসের মাঝে এ কেবলই নিজেকে লুকানোর প্রয়াস। লুক্রেতিউস, আমিও তোমার মত। রোমান লুপ্তপ্রায় হরফে নিজের ঠিকানা লিখেছিলাম। পৃথিবীর কোন দেয়ালেই আর লেখা নেই তা। সেই থেকে আমরা কেবলই ঠিকানা বদলে যাই। আমি যখন রবীন্দ্রনাথের লাবণ্যে, তুমি তখন হাসানের উজ্জ্বল পাথর যে কেবলই লাবণ্য ধরে । আমি সিমোনেত্তা হলাম। তুমি সান্দ্রো হয়ে এঁকে দিলে ‘দ্যা বার্থ অব ভেনাস।’ অরণ্য জানে , সবুজ পাতার খামে ভরে কত মৌলিক মৌসুম পাঠিয়েছি । আগ্নেয়গিরি দেখেছে, গলিত লাভার ঝুড়ি ভরে কতটি মহাসমুদ্র উপহার দিয়েছি । আর জানে জোনাক পোকা, যার সাথে উড়ে উড়ে প্রাণায়াম আর প্রার্থনায় বসেছি। আমাদের সফল মিলন শেষে আমারই গর্ভজাত চাঁদ জন্ম নিলো এ পৃথিবীতে। আমরা তার নাম রাখলাম জোছনা।
অবশেষে সেই জোছনার আলোয় হাটতে হাটতে ঠিকানা হারাবার অথবা খুঁজে পাবার প্রবল ভয় আর আগ্রহ; দু’টি থেকেই আমরা মুক্ত হলাম অনাদিকালের মত…
লাল লাল শিমুলের ব্যাথা
হারাবার মত করেই হারিয়ে যাবো
ফিরে না আসার মত করে
পথগুলো মুড়িয়ে দিয়ে যাবো সবুজ ঘাসে।
স্মৃতিতলায় এত পলাশের সমারোহ ঘটিয়ে যাবো যে ;
আমাকে মনে করার ফুরসত মিলবে না তোমাদের
পাখিদের বলে যাবো,
খুঁটে খুঁটে খেয়ে নিতে তোমাদের সমস্ত বিষাদ
কৃষ্ণচূড়ার বনে সবুজ টিয়ের মত
ডানা ঝাপটাক তোমাদের আনন্দক্ষণ।
তোমাদের ছলকে ওঠা সুখের ঢেউগুলো
আপন আপন সমুদ্র খুঁজে পাক।
আমাকে তো মেঘের মত চলে যেতে হবে।
আমাকে তো বিধবা বিকেলের মত
সন্ধ্যের চিতায় পুড়ে যেতে হবে
আমাকে তো ফিরতেই হবে নিজস্ব স্মৃতির কোটরে।
লাল লাল শিমুলের মুখ দেখে কে কবে বুঝেছে
বুকে তার কতখানি হলদেটে কান্না জমে থাকে ?
নাম দিয়েছি অবহেলা
অবহেলা নামে এক উইপোকা আছে
হৃদয় যে নিপুণভাবে কুরে খেয়ে যায়
বাহানার বৃক্ষ জুড়ে বিরহের ফুল
ভালোবাসা পড়ে থাকে গাছের তলায়।
আমি তো কোকিল নই কাকের স্বভাব
ঠোঁটে নিয়ে বেঁচে আছি রোজকার ঘৃণা
পরিনয় মধু নিয়ে দূরে উড়ে গেলে
গুছিয়ে রাখি ফের তোমার আঙিনা।
আত্মান্বেষণ
হাত দোষারোপ করছে পা কে।
পা চোখকে
চোখ খিদেকে
খিদে দোষ দিচ্ছে মাথাকে
মাথা কানকে…
এতসব হুলুস্থুল দেহযুদ্ধে ভয় পেয়ে
আত্মা চুপিসারে বেরিয়ে
হাঁটতে থাকে অন্ধকারে…
এখন সে পাকুড় গাছের তলায়
ঘুমিয়ে আছে গুটিসুটি মেরে
বৃক্ষজন্মের আশায়…
চিম্বুক পাহাড়ের চিঠি
ঠিঠিতে সে সবিনয়ে লিখেছিলো, ‘তোমাকে দেখিনা অনেকদিন। কিশোরী তার কমলা ফ্রকের গণ্ডি পেরিয়ে কতদূরে এগিয়েছে, খুব জানতে ইচ্ছে করে। বাবার আঙ্গুল ধরা মেয়েটি এখন কোন আঙ্গুল ধরে হাঁটে জানতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে , নারী সবুজ আর সোনালি হয় কোন মৌসুমে।’
ফিরতি ডাকে তাকে লিখে পাঠিয়েছি , ‘কমলা ফ্রকের আলিঙ্গনে তুমিও তো সবুজ থেকে নীল হয়েছিলে । এরপরও প্রশ্ন করো ঋষি? জানো না বুঝি, অনুভবের মৌসুম এলে কিশোরী সবুজ হয়ে ওঠে আর প্রকৃত স্পর্শের মৌসুমেই নারী হয়ে ওঠে স্বর্ণাভ চিত্রল হরিণী।’
এ কবিতা অপাঠ্য বলে গণ্য করা হোক – ২
বাঁদুর জীবন-
ঝুলে আছি জীবনবৃক্ষের ডালে,
আধখাওয়া পেয়ারর মত
প্রেম পেয়ে ভাবি
যথেষ্ট পেয়েছি এই নিদানের কালে।
প্রিয় ছুরি-
খুন হবার ইচ্ছে মনে পুষে
নিতান্ত নিরীহ কুকুর হয়ে
তোর চারপাশে ঘুরি
রক্তের ঘ্রাণ শুকে বুঝে ফেলি
তোর আলতো হাতে ধরে থাকা
আমিই ঘাতক ছুরি।
মিথ্যে দুঃখের দেশে-
আকাশ থেকে যে তারা খসে গেলো
তার জন্যে তুমি দুঃখ পেতে থাকো।
পৃথিবী থেকে সভ্যতা খসে গেলে
সে হাহাকার কোথায় তুমি রাখো ?
কোথায় কোন জাহাজ ডুবেছিলো
তার খোঁজ তুমি ঠিকঠাক জানো
কত চোখ ডোবে বেদনার জলে
তবু ঠোঁটে মিথ্যে হাসি ঝলকানো।
ম্যাচবক্স
পাপড়ির কথোপকথনে জেগে ওঠে ঘুম
চোখের সাদা বিছানা জুড়ে
ফ্যাকাসে নিঃসঙ্গতা
অপরাহ্নের অস্থিরতা
হামাগুড়ি দিয়ে
নামতে থাকে মনির ঘোলাটে গহবরে।
দিনের ব্যর্থতাও জমে
নির্ঘুম রাতের কোটরে
সতত আমাদের সুখগুলো
মুঘল আমলের মসলিনের মত
ম্যাচবক্সেই এটে যায়
আর দুঃখগুলো গুড়ো মেঘ যেন
উড়ে বেড়ায় গোটা জীবন জুড়ে।
রুহ ও রুহানী
চুমু
খাও বলেই স্বাদের প্রশ্ন আসে
অনুভব করো
দেখবে ডানা ছাড়াই ভাসছো বাতাসে।
প্রেমে
পড়ো বলে থাকে ওঠার তাগিদ
কেবলা ভাবলে
সিজদায় পাবে তুমি রুহ জাগা ঈদ।