মুখোমুখি বসিবারে সেই জ্যোতির্বিজ্ঞানী : অদিতি ফাল্গুনী
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ আগস্ট ২০১৯, ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ, | ১৯৮৬ বার পঠিত
রমা চলে গেছে আজ দুই মাসের মত। শেষের কয়েকটা বছর যে ভয়ানক কষ্ট পেয়ে মারা গেছে তা’ বলার নয়। না, দাহ হয়নি তাঁর। রমা মুখে খুব বড় কথা বলার মানুষ ছিল না কোনদিনই। সাধারণ গৃহবধূরই জীবন পার করেছে আপাত:দৃষ্টে। তবে স্বামী বা বড় ছেলের বিজ্ঞান চর্চা বা নাস্তিক্য আন্দোলনে বাঁধাও দেয় নি। শোবার ঘরের এক কোণে দেব-দেবীর ছবি রেখে সকাল-সন্ধ্যা ফুল কি ধূপ-ধুনো দিত আবার খাবার টেবিলে স্বামী-পুত্রের পদার্থবিদ্যা বা মহাকাশ বিদ্যার আলাপও শুনেছে। সুজেয় চৌধুরী নিজে যেদিন মৃত্যুর পরে দেহ দাহ করার বদলে মেডিকেলের মর্গে ছাত্র-ছাত্রীদের অঙ্গ সংস্থান শেখার কাজে দান করবেন বলে যাবেন, রমাও হুট করে ঘরে পরার কাপড় বদলে এলেন।
‘তুমি কোথায় যাবে?’
‘তোমার সাথে—’
‘ওহ্— আমাকে বুঝি আটকাতে চাও?’
সুজেয় চৌধুরী ঠাট্টা করেছিলেন।
‘উঁহু— আমিও মরণোত্তর দেহ দান করতে চাই।’
‘বলো কি— তুমি?’
‘ওগো— আমি হয়ত তোমাদের মত পন্ডিত নই— বিজ্ঞানী নই। মূর্খ হাউজ ওয়াইফ। কিন্ত কোনটা বড় ধর্ম সে কি আমি বুঝি না? আমি মরে গেলে দামি কাঠ কিনে, ঘি ছিটিয়ে পোড়ানোর পর এক মুঠ ছাই হবার থেকে গরীব দেশে মেডিকেল ছাত্রদের পড়ার কাজে আমার মরা শরীরটা কাজে লাগলে সেই ত’ বড় পূণ্যের কাজ হবে, ধর্মের কাজ হবে।’
‘ক্রোশ ক্রোশ পথ সফর করতে গিয়ে কখনো কখনো কোন সরাইখানায় বা রাজ দরবারে কোন নর্তকীর কাছে যাই নি তা’ বলব না। যৌবনে পুরুষের কেমন হায়েনার মত ক্ষুধা থাকে তুমি ত’ জানো। তবে, সে ক্ষুধাও যে আমার মাথার উপর চড়ে আমার মালিক হয়েছে তা’ নয়। জীবন আমার কিতাব আর কম্পাসের সাথে, চুম্বকের সাথেই কেটেছে বেশি।’
মোবাইলে রিং বাজছে।
‘হ্যালো— সুজেয় স্যার বলছেন? আমি দৈনিক সচিত্র সময় পত্রিকার ক্রাইম বিট থেকে বলছি— স্টাফ রিপোর্টার হান্নান মাহবুব!’
‘বলুন?’
‘স্যার— শুভ্রজিত হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে আপনার কাছে কি কোন আপডেট আছে? আপনার স্ত্রী মারা গেলেন— ঘুরে-ফিরে আবার বইমেলার মাস এলো। এই ফেব্রুয়ারিতেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। চার বছরে তদন্তের অগ্রগতি কতটুকু হলো? সব মিলিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?’
‘সামনে ত’ চার্জশীট দেবে বলছে!’
‘দিলে কত তারিখ নাগাদ দিতে পারে?’
‘এখনো ঠিক হয়নি। অনুমোদনের জন্য চার্জশীট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ।’
‘ওকে স্যার— থ্যাঙ্ক ইউ। চার বছর লেগে যাবে একটি চার্জশীটের জন্য?’
‘হ্যাঁ— মামলার তদন্ত ত’ শামুক গতিতে চলছে। কি আর করা! আমাদের কলোনীয়াল আইন-আদালত আর বিচার ব্যবস্থা!’
‘স্যার— আপনাকে কি রিপোর্টে কোট করতে পারি?’
‘হ্যাঁ— নিশ্চয়।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!’
‘হ্যাঁ— আপনাকেও ধন্যবাদ।’
ফোনটি খাবার টেবিলে রেখে নিজেই শ্লথ পায়ে রান্নাঘরের দিকে যান। পাশের ঘরে ছোট ছেলে, ছোট ছেলের বউ আর দুই যমজ শিশু কন্যা হাসছে আর কথা বলছে নিজেদের ভেতর। ছোট পুত্রবধূর মা কিছুদিন হয় এসে থেকে গেছে। একটি কিশোরী মেয়ে ছোট বউ মা’কে রান্না-বান্নার কাজে সাহায্য করে। রমাকে শেষের দু/তিন বছর যে বুয়া দেখতো, তাকে নিজে থেকে চলে যেতে বলতে বাঁধছিল সুজেয় চৌধুরীর। তবে, বড় বুদ্ধিমতী মেয়ে। রমার মৃত্যুর দিন দশেক পরে এক সকালে পোঁটলা—পুঁটলি বেঁধে এসে বললো, ‘খালু— একবার কদমবুচি করতে দ্যান।’
‘কই যাচ্ছ তুমি? আরে— আমি কি তোমাকে যেতে বলেছি নাকি?’
‘এখানে অষন ত’ আমার তেমন কিছু করার নাই। আর সবখানেই খালাম্মার স্মৃতি। মনটা বড় পোড়ে।’
‘যাবে কোথায় এখন?’
‘দ্যাশে যাব। মাইয়া দুইটা বড় হইতাছে। আমার আম্মা— অদের নানী বুড়া হইয়া যাইতেছে। তার আর অত তাকদ নাই নাতনীগো দেখার।’
‘তোমার বর?’
‘সে ব্যাটা আর এক জায়গায় নিকা বইছে ত’ ম্যালা দিন আগেই!’
‘ওহো—’
‘আসি— খালু— দোয়া রাইখেন।’
‘দাঁড়াও— যাবার আগে তোমার সব পাওনা বুঝে নাও। আর গত দু/তিন বছর তুমি যা করেছো— এ বাড়িতে তোমার দরজা সব সময় খোলা থাকবে—’
কথাগুলো বলতে গলা ধরে এসেছিল তাঁর।
আজ ছুটির দিন। ছোট ছেলে আর ছোট বউ মা দু’জনেই স্কুল শিক্ষক। সারা সপ্তাহ কাজের পর শুক্রবারই ওরা খানিকটা ঘরে একসাথে সময় কাটায়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মত বাজে। এখন এক কাপ চায়ের জন্য ওদের বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। মিনি নামের কিশোরী গৃহকর্মীটি ড্রয়িং রুমের কার্পেটে বসে একটু পড়ছে। পড়–ক। রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে তিনি নিজেই এক কাপ চা করে নিলেন। এখন রমার রেখে যাওয়া ফাঁকা ঘরের পাশে চিলতে ব্যালকনিতে বসে তিনি এক আকাশ তারা ঠিকই গুনতে পারবেন। আর এই তারা দেখতে দেখতেই তাঁর সামনে অষ্পষ্ট ছায়ার আকারে চলে আসবে শুভ্র শ্মশ্রু আর দীর্ঘ জোব্বা বা আলখাল্লা পরা সেই মধ্যযুগীয় পন্ডিত। নব্বইয়ের দশকে ভেঙ্গে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের খাওয়ারাজম নামে এলাকায় যাঁর জন্ম হয়েছিল। যার একপাশে উত্তর তুর্কমেনিস্থান আর এক দিকে পশ্চিম উজবেকিস্থান।
‘কি হে ছোকরা? কেমন আছ?’
‘আমাকে ছোকরা বলছেন? জানেন আমার বয়স কত?’
‘যত বয়স হোক, আমার চেয়ে বয়স ত’ তোমার কিছুতেই বেশি নয়। বলো ত’ আমার বয়স ঠিক কত?’
‘কত যেন?’
সুজেয় চৌধুরী বিব্রত হয়ে মাথা চুলকান।
‘৯৭৩ সালে…তোমরা যাকে খ্রিষ্টাব্দ বলো…আমার জন্ম। মারা গেছি সাতাত্তর পার করে। এখন আমার বয়স কত হবে তাহলে?’
‘কি করে বলি— আমার কাছে ত’ এখন ক্যালকুলেটর নেই!’
‘হুম— তা’ একটা জীবন এই একটা শহরেই বলতে গেলে কাটিয়ে দিলে? জওয়ান কালে সেই অল্প কিছুদিন বিলিতি সাহেব মুল্লুকের কোন্ এক লীডস শহরে কয়েক বছর আর তারপর বাকি জীবনটা এই এক দেশ আর এক শহরে?’
‘না— মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুদিন আসামে ছিলাম!’
‘ঐ হলো— হিন্দুস্থান ত’ সেদিন তিন টুকরা হল- তার আগে ত’ একটাই দেশ ছিল। তাহলে? একটা জীবন একটা কি দু’টো শহর আর দেশেই শেষ করলে? এজন্যই তোমার কিছু হল না— বুঝলে?’
‘আপনি ত’ অনেক ঘুরেছেন।’
‘ক্রোশ ক্রোশ পথ সফর করতে গিয়ে কখনো কখনো কোন সরাইখানায় বা রাজ দরবারে কোন নর্তকীর কাছে যাই নি তা’ বলব না। যৌবনে পুরুষের কেমন হায়েনার মত ক্ষুধা থাকে তুমি ত’ জানো। তবে, সে ক্ষুধাও যে আমার মাথার উপর চড়ে আমার মালিক হয়েছে তা’ নয়। জীবন আমার কিতাব আর কম্পাসের সাথে, চুম্বকের সাথেই কেটেছে বেশি।’
‘আলবত— ঘুরেছি বলেই ত’ এত কিছু দেখেছি। কত কি জেনেছি! আমাদের সময়ে বাপু তোমাদের মত উড়োজাহাজ ছিল না। সেই উটের পিঠে চড়ে, কখনো গাধা-খচ্চর-ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আবার কখনো হাতির পিঠে চড়েও…কখনো পালকি কি ক্রোশ ক্রোশ পথ হেঁটে এক দেশ থেকে এক দেশে যেতাম আমরা! গনগনে মরুর বালুতে হিসাব মাপা পানি কাফেলার সবাই খাচ্ছে। কতজন উদরাময় হয়ে মারা যেত! ঘরে বসে সুখের জীবন পার করলে কি চলে? কত বড় বিজ্ঞানী হবার কথা ছিল তোমার— খোদা মাথায় কিছু মাল-মশলাও দিয়েছিলেন। আর কি হলে?’
‘আসলে দেশে সেই উনসত্তর সালে গণঅভ্যুত্থানের জোয়ার। শেখ সাহেব তখনো বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। তবু মানুষের হৃদয়ের নেতা হবার পথে। স্বাধীন দেশ হবে,— এমন একটা অব্যক্ত আকাঙ্খা আমাদের অনেকের মাথায় ঘুরছে। এছাড়া বিয়ে করেই নতুন বউকে রেখে গেছি। পিএইচডিটা হলো। দেশে ঢাকা ভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের চাকরি। একজন বাঙালী যুবক আর কি চাইতে পারে?’
‘নিশ্চয়তা— আহ্— নিশ্চয়তা— এর থেকে খারাপ কিছু আর হতে পারে না! আমাকে দ্যাখো— জন্ম হয়েছিল মধ্য এশিয়ার খোরাসমিয়ার কাছে। জীবনের প্রথম বছর পঁচিশ কাটিয়েছি জন্ম শহরেই। আফ্রিঘিদ বংশে। তখনো তুর্কী ভাষা, আচার-আচরণ আমার জন্মভূমিকে গ্রাস করেনি। তখনো আমরা আমাদের মাতৃভাষা খাওয়ারেজমে কথা বলতাম। ৯৯৫ সালে বিদেশী তুর্কীরা আমাদের শহর দখল করলে পালালাম বুখারায়। সেখানে তখন সামানিদ শাসক নুয়ের ছেলে দ্বিতীয় মনসুর বাদশাহ। সেখানেই ইবনে সিনার সাথে যোগাযোগ হল আমার।’
‘তবেই দ্যাখেন। বিদেশীরা শহরে হামলা করলো বলেই না পালালেন! জন্মভূমি ছাড়লেন। আমাকেও যেমন ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল ১৯৭১-এর মার্চ মাসে। এমনি এমনি কি কেউ দেশ ছাড়ে? সেই যে মহাভারত-এ বকরূপী ধর্মকে যুধিষ্ঠির বলছেন যে সুখী সেই মানুষ যে দিনের শেষে স্বদেশে বসে নিজ কুঁড়েঘরে শাকান্ন গ্রহণ করেন-’
‘আরে— তুমি আমার কথা ত’ শুনবে, নওজোয়ান? সব কথা ত’ নিজেই বলে চলেছো!’
‘জ্বি- জ্বি— বলুন!’
‘বুখারা থেকে আমি গেলাম তাবারিস্থান। সেখানে বসেই লিখলাম আমার প্রথম বই। তারপর গেলাম বাভান্দিদের বাদশা আল-মারজুবানের সাথে দেখা করতে। গজনীতে বাদশা মাহমুদ ক্ষমতায় এলেন। আমাকে তাঁর দরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী করলেন। ভারত অভিযানের সময় আমাকে সাথে নিলেন। হিন্দুস্থান গিয়ে সংস্কৃত শিখেছি, পতঞ্জলির লেখা তর্জমাও করেছি।’
‘একটা কথা বলবেন? সেই যুগে বসে কি করে পৃথিবীর ব্যাসার্দ্ধ বা পরিধির অমন নিখুঁত জ্যামিতিক ছবি এঁকেছেন? চাঁদের বিভিন্ন পর্যায়ের চিত্র?’
‘সফর- সফর- জীবন এক আশ্চর্য ভ্রমণ। ভ্রমণেই সব শিখবে তুমি। ঘর থেকে যখন প্রথম বের হলাম— নয়া নয়া মুল্লুকে যাই আর ঝামেলায় পড়ে যাই যে নামাজের কিবলা কোন্ দিকে হবে? সূর্য আর চাঁদের ঠিকঠাক হিসাব ছাড়া ত’ এসব হয় না। সেসব হিসাব ঠিক করতে গিয়েই দিন দিন জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে আরো জড়িয়ে গেলাম। এবার বলো ত’ তুমি কেন আমার বিষয়ে এত আগ্রহী?’
‘আসলে লীডসে কাজ করার সময় সাদা বিজ্ঞানীরা মুখে কিছু না বললেও ওদের হাব-ভাবে মনে হত আমরা পূর্বের মানুষ কিছুই পারি না। তখন একদিন একটা বইয়ে আপনার কাজ আজো বিজ্ঞানে কত প্রাসঙ্গিক জানতে পারি। সেই থেকে কৌতূহল। আচ্ছা- সেই যুগেই কিভাবে মনে হয়েছিল যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে?’
‘না- না- বেটা— তখন আজকের মত সবাই নিশ্চিত ছিল না যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। পক্ষে-বিপক্ষে দুই দিকেই যুক্তি ছিল। আমি প্রমাণ বা অপ্রমাণ কিছুই করতে পারিনি। তবে মনে হত যে পৃথিবী যে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে এটাই বেশি সঠিক। আর্য ভট্টের বই অনুবাদ দিন করেছি ত’ আমি। তাহকিক মা লি-ল-হিন্দ বইতে পাবে হিন্দুস্থানী জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আমার ভাবনা।’
‘আর পৃথিবীর ঘূর্ণন নিয়ে যে বইটি লিখেছিলেন? মিফাহ-ইলম-আলহাইয়া? জ্যোতির্বিজ্ঞানের চাবিকাঠি?’
‘ধুর বেটা- সেই কিতাব এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না! হারিয়ে গেছে- কত শত বছরের কত যুদ্ধ-দাঙ্গা-ঝড়-বন্যা…সব কি আর থাকে?’
‘আর ইবনে সিনা’র সাথে আপনার যে প্রায়ই বিবাদ হত?’
‘ওটাকে বিবাদ বলে না বেটা- বলতে পারো বাহাস! তর্ক। বুখারা থেকে চলে আসার পরও কত চিঠি পাঠিয়েছি ওকে, সে-ও আমাকে পাঠাত। আরিস্তÍঁ যে ভুল, শুণ্যতা বলে যে একটা বিষয় আছে সেটা পই পই করে বলেছি ইবনে সিনাকে। সে অবশ্য আরিস্তÍঁকে ওস্তাদ মানত।’
‘আরিস্তÍঁ মানে এ্যারিস্টটলের কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ- বাদ দাও। বহুক্ষণ নিজের কথা বকবক করলাম। হাল জমানার বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানী কারা ছোকরা?’
‘ছোকরা’ সম্বোধনে বাস্তবিক বড় অপ্রতিভ লাগে সুজেয় চৌধুরীর। দু/দু’টো নাতনী তাঁর ঘরে। আর তিনি কিনা ‘ছোকরা?’। তবু অপ্রতিভ ভাব কাটিয়ে বলেন, ‘ আছে অনেকেই। গ্যালিলিও যিনি টলেমির সূর্য ঘোরার তত্ত্ব বাতিল করেছেন, নিউটন, আইনস্টাইন, ম্যাক্স ওয়েবার, সত্যেন সেন, স্টিফেন হকিন্স…’
‘তুমি কি বিষয়ে কাজ করেছো যেন?’
‘আমার পিএইচডি ত’ ছিল সলিড স্টেট ফিজিক্স নিয়ে। কিন্ত আমার যে আরো কিছু প্রশ্ন ছিল।”
‘হ্যাঁ— বলো?’
‘আপনি ত’ টলেমির মতেরও বিরোধী ছিলেন, তাই না?’
‘টলেমি?’
‘আরব বা পারস্যে যাঁকে বাতালিমুস বলে আপনারা ডাকতেন?’
‘ও — হ্যাঁ- বুঝেছি। না— সে ব্যাটা ত’ মনে করত সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে।’
‘আপনার সময়ের চেয়ে আপনি অনেক এগিয়ে ছিলেন আসলে! আজকের যুগে যে বস্তÍটাকে আমরা ঘড়ি বলে চিনি, তার প্রাথমিক নমুনা নাকি আপনার তৈরি?’
‘ঐ হলো— দ্যাখো, আমি ঘর বাঁধি নি। বিয়ে-শাদি করিনি। গোটা জীবনটা মুসাফিরের মত এক দেশ থেকে আরেক দেশ শুধু পায়ে হেঁটে কি উটের পিঠে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার ধর্মে এক পুরুষ চারটি পর্যন্ত বউ নিতে পারার বিধান আছে। আমি সেখানে কোন নারীর কাছেই গেলাম না। তার বদলে কিছু জ্ঞান ত’ আমি অর্জন করতে পারবই, তাই না?’
‘সত্যি নারীর কাছে কখনো যান নি?’
এ প্রশ্নে খানিকটা রক্তাভ হন আল বিরুনী।
‘ক্রোশ ক্রোশ পথ সফর করতে গিয়ে কখনো কখনো কোন সরাইখানায় বা রাজ দরবারে কোন নর্তকীর কাছে যাই নি তা’ বলব না। যৌবনে পুরুষের কেমন হায়েনার মত ক্ষুধা থাকে তুমি ত’ জানো। তবে, সে ক্ষুধাও যে আমার মাথার উপর চড়ে আমার মালিক হয়েছে তা’ নয়। জীবন আমার কিতাব আর কম্পাসের সাথে, চুম্বকের সাথেই কেটেছে বেশি।’
‘হয়তো সেজন্যই ১৭৪৯ সালে ডানর্থন তাঁর চন্দ্র ত্বরণ বিষয়ে আপনার চন্দ্রগ্রহণ বিষয়ক তথ্যগুলো ব্যবহার করেছেন?’
‘আরে— আমি এর নামও শুনিনি।’
‘সবচেয়ে অবাক লাগে আপনি সেই যুগে পাহাড় বা পর্বতমালার উচ্চতা থেকে পৃথিবীর ব্যাসার্দ্ধ আন্দাজ করতে পারছেন। সেই ১০৩৭ সালে এশিয়া ও ইউরোপের মাঝে অতল এক মহাসাগরের এক পাশে আর একটি বিপুল ভূখন্ড থাকতে পারে বলে আপনি অনুমান করেছিলেন। এবং সেই ভূখন্ডে মানুষ আছে বলেও আপনার অনুমান ছিল। আপনার অনুমান সঠিক। আপনার এমন অনুমানের অনেক পরে কলম্বাস ভারত আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করে! সেই যুগে এই কাজ আপনি কিকরে করলেন?’
‘পৃথিবীর পরিধির সঠিক হিসাব আমি বের করতে পেরেছিলাম। সেই সাথে এত মুল্লুক ঘুরতে ঘুরতে আমাদের পূবের যত দেশ, কিতাবীদের রুমীয় দুনিয়া আর কালো হাবশিদের দেশ…এত জায়গা ঘুরতে ঘুরতে এটা মনে হয়েছিল। তোমাদের নয়া জমানার হাল-ফিলের সব কল-কব্জায় এই বুড়োর হিসাবগুলো ভুল হয়নি তো?’
‘না— ইউরেশিয়া এবং আফ্রো-ইউরেশিয়া ছাড়িয়ে আমেরিকা নামে ঐ ভূখন্ডের কল্পনা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য আপনাকে কূর্ণিশ করতেই হয়।’
‘হা-হা- সে না হয় করলে! তুমি তবে নারীর আঁচলেই বাঁধা পড়লে? শোন, বিজ্ঞানীকে সব মোহ ছাড়তে হয়। সুলতান মাহমুদ আমাকে অনেক খাতির করেছেন। তবে, না কোন সুলতান— না কোন নারী— না শিশুর মুখ দেখার আকাঙ্খা— কিছু আমাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। আমি মুসাফিরের মত— পাখির মত— এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ ঘুরতে ঘুরতে সেই জমানার অত ভোঁতা সব কল-কব্জা দিয়ে এত কিছু জেনেছিলাম। আর এই যে তুমি কখনো দেশ, কখনো আওরত আর কখনো বাচ্চার মায়ায় ঠাঁই গাড়লে…তোমার হাসিন বিবি একসময় বুড়ি হয়েছে, বিমার হয়ে মরেছে। একটা জোয়ান ছেলে বদনসীবের ফেরে অকালে জীবন দিল। আর এক ছেলে তোমার সাথে থাকলেও সে-ও তার বউ-বাচ্চা নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তাহলে দুনিয়ায় কেন আমরা আসি? কিছু রেখে যাবার জন্যই ত’?’
‘বাবা— বাবা- ও বাবা!’
গায়ে শাঁখা পরা একটি হাতের ঠেলায় চমকে ওঠেন সুজেয় চৌধুরী।
‘ফাল্গুন মাসে এখনো রাতের দিকে হিম পড়ে। রাত সাড়ে নটাতেও ব্যালকনিতে একা বসে আছেন? গায়ে একটা চাদরও নেই। রাতের খাবার খাবেন চলেন—’
ছোট বউ মা ডাকছে। উত্তরের আকাশে সপ্তর্ষিমন্ডলে শুভ্রজিতের চাপাতি বিদ্ধ, রক্তাক্ত ক্ষীণ আবছায়া দেহ কি দেখা যাচ্ছে?