রুমির তিনটি কবিতা । অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০১৯, ২:১৭ পূর্বাহ্ণ, | ১৭৩৭ বার পঠিত
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি (১২০৭ – ১৭ডিসেম্বর ১২৭৩), জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ বালখী, মাওলানা রুমি,মৌলভি রুমি নামে তবে শুধু মাত্র রুমি নামে বেশি জনপ্রিয়। তিনি ছিলেন ১৩ শতকের একজন ফার্সি[কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, এবং সুফী। রুমির প্রভাব দেশের সীমানা এবং জাতিগত পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে; তাঁর কবিতা সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিভিন্ন শ্রেণীতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। রুমিকে যুক্তরাষ্ট্রের “সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি” [১২] এবং“বেস্ট সেলিং পয়েট” বলা হয়।
রুমির সাহিত্যকর্ম বেশিরভাগই ফার্সি ভাষায় রচিত হলেও তিনি অনেক স্তবক তুর্কি,আরবি এবং গ্রীক ভাষায়ও রচনা করেছেন। তাঁর লেখা মসনবীকে ফার্সি ভাষায় লেখা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসাবে তুলনা করা হয়; তাঁর কবিতা ফার্সি সাহিত্যকেপ্রভাবিত করেছে, শুধু তাই নয় তুর্কি সাহিত্য, উসমানীয় তুর্কি সাহিত্য, আজারবাইজান সাহিত্য, পাঞ্জাবের কবিতা, হিন্দী সাহিত্য, উর্দু সাহিত্যকেও অনেক প্রভাবিত করেছে। এছাড়াও অন্যান্য ভাষার সাহিত্য যেমন তুর্কীয়, ইরানী, ইন্দো-আর্য,চাগাতাই, পাশতো এবং বাংলা সাহিত্য ও বাংলাকে প্রভাবিত করেছে।
সূর্যোদয় চুনী
খুব ভোরে,
ঠিক সূর্য ওঠার আগে, প্রেমিক ও তার প্রিয়তমা ঘুম থেকে জাগে
এবং তারা খানিকটা পানি পান করে।
প্রেমিকা জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি আমাকে অথবা তোমার নিজেকেই বেশি ভালবাসো?
খাঁটি ও পরম সত্যটি আমাকে বলো।’
প্রেমিক একথার উত্তরে বলে, ‘আমার নিজস্ব বলতে আর কিছুই নেই,
আমি যেন সূর্যোদয়ের মূহুর্তে আকাশের দিকে মেলে ধরা এক চুনী,
সেই চুনী কি আর কোন পাথর থাকে অথবা রক্তিমাভার এক পুরো ভুবন?
সূর্যালোকের কাছে এর কোন প্রতিরোধ থাকে না।’
এভাবেই হাল্লাজ বলেন, ‘আমিই ঈশ্বর!’
এবং তারপর তিনি বললেন সত্য।
চুনী এবং সূর্যোদয় ত’ একই বিষয়।
শৃঙ্খলাপরায়ণ হও এবং নিজেকে নিয়মানুবর্তী করো।
ঠিক যেন কান ও কানের দুলের মত হও,
এই সূর্য-চুনীকে পরে নাও কানের দুলের মতো করে।
কাজ করো। তোমার কূপ খনন করে চলো।
কাজ থেকে বিনিময় আশা করো না।
সেখানে কোথাও না কোথাও অবশ্যই আছে সুপেয় জলের দিশা।
প্রতিদিনের এক অনুশীলনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করো।
সেই অনুশীলনের প্রতি তোমার আনুগত্য
যেন দরজার উপর একটি চাবি।
চাবি দিয়ে কসরত করে যেতেই থাকো, এবং ভেতরের আনন্দ
একটা সময় একটি জানালা তোমায় খুলেই দেবে
যাতে তুমি দেখতে পাও যে ভেতরে কে আছে?
অতিথিশালা
মানুষের জন্ম এই যেন এক অতিথিশালা ।
প্রতি সকালেই নতুন কেউ আসে।
আনন্দ, বিষাদ, সঙ্কীর্ণতা,
কখনো আবার মূহুর্তের সম্বিত ফিরে আসে
যেন এক অপ্রত্যাশিত অতিথি।
এই সব অতিথিকেই স্বাগত জানাও আর যতœ করো
এমনকি যদি তারা সবাই মিলে একটি দু:খের মিছিলও হয়ে থাকে,
যে মিছিল সহসা তোমার বাসা ধুয়ে-মুছে নিয়ে যাবে,
শুন্য করবে সব আসবাব,
তবু, প্রত্যেক অতিথিকেই সম্মানের সাথে যতœ করো।
তিনি তোমাকে বিদায় জানাতে পারেন
কোন নতুন আনন্দের জন্য।
কালো চিন্তা, লজ্জা ও আক্রোশ,
দরজার সামনে তাদের হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানাও,
আর সবাইকে ঢোকাও।
যিনি বা যে-ই আসুন,
তাঁর প্রতিই কৃতজ্ঞ হও।
কারণ এঁদের প্রত্যেককেই
অমর্ত্য থেকে পাঠানো হয়েছে প্রদর্শক হিসেবে।
খাবারের থলে
একদিন এক সুফী দেখলেন যে একটি শুন্য খাবারের থলে
দেয়ালে ঝুলছে।
সুফী অমনি ঘুরে দাঁড়ালেন এবং নিজের জোব্বাটি ছিঁড়ে বলতে লাললেন,
খাবার কিনা তার জন্য যার কোন খাবার দরকার নেই!
ক্ষুুধার যতœ নিতে!
দেখতে দেখতে সুফীর দাহ বাড়ে এবং তাঁর সাথে যোগ দেয় আরো অনেকেই,
প্রেমাগ্নিতে আর্তনাদ ও গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে
এক অলস পথিক যাচ্ছিল বলে বসলো, ‘ এ ত’ এক শুন্য থলে।’
সুফী বললেন, ‘চলে যাও। তুমি যা চাও আমরা তা’ চাই না।
তুমি ত’ নও আমাদের মত প্রেমিক।’
এক প্রেমিকের খাবার কিনা রুটির জন্য প্রেম,
রুটিটি নয়। যে কেউই খাদঅলা প্রেমিক
ভালবাসে অস্তিত্ব।
অস্তিত্বের সাথে প্রেমিকদের কিচ্ছুটি করার নেই,
তারা শুধুই সুদ জড়ো করে বিনা পুঁজিতেই।
তাঁদের ডানা নেই কোন, তবু তারা ওড়েন পৃথিবীর সর্বত্রই।
তাদের হাত নেই, তবু পোলো খেলার মাঠ থেকে তাঁরাই বল কুড়িয়ে আনেন।
দরবেশ যেন বাস্তবতার গন্ধ শুঁকতে পেলেন।
এখন তিনি দিব্য দৃষ্টির ঝুড়ি বোনেন।
নেই রাজ্যের বিশাল দিগন্তে প্রেমিকেরা পাতেন তাঁবু,
আত্মার কাছে খাদ্যহীনতার গন্ধই যেন খাদ্য।
এক মিশরীয়ের কাছে যেমন, নীল নদকে দেখতে রক্তাক্ত মনে হয়।
ইসরাইলীদের কাছে পরিষ্কার।
কারো কাছে যা নিরাপদ পথ সেটাই অন্যের কাছে বিপদ হতে পারে।