আমিই হুমায়ূন আহমেদ । জহিরুল মিঠু
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০১৯, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ণ, | ১০৮৯ বার পঠিত
আমি লোকটিকে দেখে প্রথমেই ভেবেছিলাম তিনি আমার লেখা পড়বেন না। নীল মলাটে কম্পোজ করা স্পাইরাল বাইন্ডিংএর খাতাটা তিনি বেশ মনোযোগ দিয়ে ধরলেন।প্রথম পৃষ্ঠায় তার টানটান চোখ দেখে আমার ভীষণ চিন্তা হলেও তার চেহারায় বিরক্ত না দেখে ভাবলাম, যাক পেরেছি! তিনি পড়তে লাগলেন আর আমি মনে মনে বড় খতমের দোয়া পড়তে লাগলাম।
আজ জরীর বিয়ে। সকাল থেকেই সোবহান সাহেব বারবার বাজারে যাচ্ছেন আর আসছেন। জরীর মায়ের মুখে দুটো কথা শুনেই বলছেন,আগে বলোনি কেনো? আচ্ছা আমি আবার যাই, পায়জামাটা দাও।
পায়জামা -পাঞ্জাবি পরছেন তিনি গত ত্রিশ বছর ধরে। ঘরে এসে পায়জামা ছেড়ে লুঙ্গি পরেন যদিও তবে শহরের বাজারে বের হন না লুঙ্গি পরে। জরীর মা এটা নিয়ে তাকে মজা করে টিপ্পনি কাটেন, আপনি তো জমিদার!
সোবহান সাহেবের এতে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। এক সময় জমিদার ছিলের তার দাদা দেওয়ান আব্দুর রশীদ ঠাকুর। এলাকায় অনেক স্কুল কলেজ মাদ্রাসা -মসজিদ তার দাদার দান।যদিও এটা নিয়ে তার দীর্ঘশ্বাস না, তার দীর্ঘশ্বাস এই প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো অনুষ্ঠানে দাতা পরিবার হিসেবে তাকে একটা নিমন্ত্রণপত্র পাঠান না! এমনিতে মাইকে দোয়ার সময় দাতা পরিবারের কথা বলেন ঠিকই তবে দেখা হলে তেমন একটা পাত্তা দেন না কেউই! দু’তিনবার বিভিন্ন লোকাল পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে তিনি এটা নিয়ে বিষেদাগারও করেছেন। এতে কোনো কাজ হয়নি বরং মনে হয়েছে তারা ঐ লেখার জন্যে তাদের পরিবারকে হেয় করছেন ইচ্ছে করেই।
তিনি অবশ্য এ ব্যাপারে মুখে কাউকেই কিছু বলেন না।
চলাফেরায়, হাটেমাঠে — কোথাও তার সাথে কারো উচ্চবাক্য হয়নি কোনোদিন, আড়ালে ও সামনে সবাই তাকে সম্মান করে। আজ পরীর বিয়েতে তিনি সবার ঘরে গিয়ে দাওয়াত করেছেন।তার ভাগ্নে হিমুকেও তিনি কিছু দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সে মিসির আলীকে দাওয়াত শুধু করেইনি , তাকে আজ সাথে করে নিয়েও আসবেন।আর আরেকটা বিশেষ কাজ দিয়েছিলেন সেট হচ্ছে একশ ফকিরকে নতুন লুঙ্গি-শাড়ি পরিয়ে নিয়ে আসার জন্য। হিমু এ কাজে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।দু’তিনজন রাজী হলেও অধিকাংশ ভিক্ষুক আগ্রহী না বলে হিমু সে প্রজেক্ট বাতিল করেছে। হিমু তার সোবহান মামাকে বলেছে,ফকির বাদ দেন,এখন বাংলাদেশে কোনোও ফকির নেই, আপনি এই টাকা কোনো পাবলিক লাইব্রেরিকে দিয়ে দেন যাতে তারা আরও কিছু বই কিনে। বিজ্ঞানের বই খুব কমই পাওয়া যায় লাইব্রেরিগুলোতে। সায়েন্স ফিকশন যে কজন লেখে অনেক পাঠকই তাদের চিনেন না। তাদেরকেও চিনুক।
সোবহান সাহেব হিমুর কথা ফেলতে পারেন না কোনো সময়। এবারও পারেননি। তিনি প্রায় একলক্ষ টাকার চেক হিমুকে লিখে হাতে ধরিয়ে দিলেন। হিমু তার মামার দিকে তাকিয়ে বুঝে ছিল,মামাও যেন বেঁচেছেন।
হঠাৎ বিয়ে বাড়িতে হৈ চৈ। হিমু ব্যান্ড পার্টি নিয়ে এসেছে। তারা ‘লীলাবালী লীলাবালী’ বাজাচ্ছে। মনে হচ্ছে বর যেন এসে গেছে।জরীও একবার উঁকি দিল। সোবহান সাহেব হিমুকে অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,মিসির আলী সাহেব কোথায়?
হিমু বিরক্ত হয়ে বললো, আ রে ফেলো তোমার মিসির আলী! দুদিন ঘুরে তাঁকে পাইনি। সে কোনো এক রানুর জন্য তার দেশের বাড়িতে গেছে, গোয়েন্দাগিরি করতে।
পাগলের ডাক্তার।
সোবহান সাহেব এই হিমুকে মেলাতে পারেন না।
তার বদলে ব্যান্ডপার্টি আনছি। পোলাপাইন মজা পাইবো।
এরা যে সুন্দর ‘ফাইট্যা যায়’ বাজায় মামা, শুনলে মনে হবে তোমার বুকটাই ফেটে গেছে।
সোবহান সাহেব জরীর মাকে কী জবাব দেবেন সেটা ভাবতে থাকেন।জরীর খুব শখ ছিল তার বিয়েতে মিসির আলী আসবে। জরীর বর আজরাফও মিসির আলীর ভক্ত। জরীর শেষ শখটা পূরণ না করতে পারলে তার মনে অনেক কষ্ট হবে। তিনি ভেবেছিলেন, মিসির আলীকে বলবেন,স্যার আপনি যদি মেয়ের উকিল বাপ হতেন।
আজরাফকে না কি জরী বলেছেও মিসির আলীকে হিমুভাই নিয়ে আসবেন।আজরাফ সেটা বিশ্বাস করেনি। জরী তাকে এইও বলেছে, তার হিমুভাই পারেন না এমন কোনো কাজ নেই! রাত বারটায় যে ধানমন্ডি থানার ওসিকে নিয়ে ভাইজান হোটেলে পরোটা আর গরুর মাংস খেতে চলে যায় তার পক্ষে মিসির আলীকে আনা শস্য সমান ব্যাপার।আজ জরীর মুখটাই তো থাকবে না।
এতটুকু পড়ে প্রকাশক একটি সিগারেট ধরিয়ে আমার দিকেও একটি এগিয়ে দিলেন।আমি সিগারেট খাই না সাধারণত, বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়লে দু’এক টান দেই!
জরীর জন্মের পর পরই সোবহান সাহেবের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠেছিল। জরীর মা বিলকিস বেগম তখন থেকেই চিন্তা করে রেখেছিল এই মেয়ের বিয়ের সময় অনেক খরচ করবেন।তার দিকের এবং তার স্বামীর দিকের সবাইকে তিনি নতুন কাপড় দিয়েছেন।সবাইকে এইও বলেছেন জরীর বিয়েতে তারা যেন কোনো উপহার না দেন।জরী আর আজরাফের জীবন যাতে সুন্দর হয়, সে দোয়াই চান তিনি সবার কাছে। আত্মীয় স্বজন সবাই একবাক্যে বলেছে জরীর মত মেয়ে বিলকিসের গর্ব।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়ে মা-বাবার মতের একটুও উনিশ-বিশ করেনি।যখন যেমন বলেছেন সে তাই মেনে চলছে। তাদের কথা, জরীর ভাগ্য কী রকম ভালো হবে তুমি চিন্তাই করতে পারবে না।
এসব ভাবতে ভাবতে সোবহান সাহেবের মাথাটা ঘুরে ওঠলো। তিনি চোখে ঝাপসা দেখলেন। ব্যান্ডপার্টি ‘ফাইট্যা যায়’ বাজাচ্ছিল এত জোরে যে তার রুমে তিনি মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে গেলেন সেটা কেউই শুনতে পেল না।
বিলকিস বেগমের বান্ধবী পারুলের ছেলে শুভ্রকে তার বন্ধুরা ‘কানা বাবা’ বলে ডাকে। জরীর সে ব্যাচমেটও। জরীকে শুভ্র খুব পছন্দ করলেও কোনোদিন সে তাকে এটা জানাতে পারেনি।আজ তার বিয়েতে মাকে নিয়ে এসেই পড়লো ব্যান্ডপার্টির পাল্লায়। জরীর বিয়েটা কোনো পার্টি সেন্টারে হলে সে আশপাশে কোথাও চলে যেতো কিন্তু অনুষ্ঠানটা যোহেতু বাসায় তাই ঘরে ঢুকা ছাড়া তার আর গতি রইলো না। মাইগ্রেনের সমস্যা তার প্রবল।এই বিদঘুটে শব্দে তার মাথাটাই যাবে। বন্ধুর বিয়েতে এসে শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়েই যদি টানাহ্যাঁচড়া লেগে যায় তবে তো বিপত্তি।সেটা চিন্তা করে শুভ্র জরীর বাবার বেডরুমের দিকে এগুলো। সে জানে ওই রুমটা যেহেেতু সবচেয়ে ভিতরে শব্দ সেখানে কম আসবে। রুমে ঢুকেই সে চমকে গেল। চশমার ভারী কাঁচ ভেদ করে সে বুঝতে পারলো, এটা জরীর বাবা। সে কী করবে বুঝতে না পেরে তার ড্রাইভার আনিসকে ফোন করলো। ড্রাইভার আনিসফোনেই সব শুনে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাজির।
সবাই অবাক। ড্রাইভারের সাথে এ বাড়ির সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় বলে সে অনায়াসে ভিতরে চলে গেল স্ট্রেচার নিয়ে। শুভ্র আনিসকে বললো,কোনোভাবেই আংকেলের কথা বলা যাবে না জরীকে,আমি বলবো আমার এক বন্ধু এসেছিল,সে হঠাৎ করে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছে। আনিস আর অ্যাম্বুলেন্সের সহকারীরা সোবহান সাহেব মিনিট পাঁচেকের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিল। মুখটা ঢেকে রাখায় অন্য কেউ কিছু বুঝেনি। তবে জরীর মা একবার বলছিল,শুভ্র তোর আংকেল কই? শুভ্র তখন বলেছিল, আংকেলকে আমি মোড়ের দোকানে দেখে এসেছি! অ্যাম্বুলেন্স বের হয়ে সোজা বড় রাস্তায় উঠার সাথে সাথেই সোবহান সাহেব ‘পানি, পানি’ বলে আওয়াজ দিলেন।শুভ্রও তাদের সাথে ছিল। তখনই তার মনে হলো,আংকেলকে সে সেখানেই পানির একটা ঝাপ্টা দিতে পারতো চোখে-মুখে।মাঝে মাঝে মাথায় কোনো বুদ্ধিই আসতে চায় না। সোবহান সাহেব পানি খেয়েই বলে উঠলেন,আমি এখানে কেন?
শুভ্র এগিয়ে এসে সব বললো। সোবহান সাহেব বললেন,হয়তো প্রেশার বেড়েছিল। না না,রাতে ঘুম হয়নি।তারমধ্যে নানা ধরণের চিন্তা আমাকে আর ধরে রাখতে পারেনি।শুভ্র বললো,আংকেল ডাক্তার দেখিয়েই আমরা ফিরবো। সোবহান সাহেব বললেন,আমি এখন বেশ আছি। তোমরা অ্যাম্বুলেন্স ঘুরাও!আনিস শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্রের চোখ থেকে গ্রিন-সিগন্যাল পেয়েই সে অ্যাম্বুলেন্স ঘুরাতে বললো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জরীদের গেটে আবার হাজির অ্যাম্বুলেন্স।এবার উৎসুক মানুষের ভীড় আগের চেয়ে বেশী। সোবহান সাহেবকে নামতে দেখে কেউই কিছু বললো না। শুভ্র ব্যান্ডপার্টিকে বাদ্য থামাকে অনুরোধ করলো। হিমু এগিয়ে এসে বললো,আরে কানাবাবা যে! শুভ্র বললো,আপনি কিন্তু আমাকে শ্বেতপদ্ম ডাকেন হিমুভাই! হিমু লজ্জিত হলো সামান্য। সোবহান সাহেব হিমুকে বললেন,অ্যাম্বুলেন্সটাকে টাকা দিয়ে বিদায় করতে। শুভ্র বলে উঠে,আনিস সব সামলাবে আংকেল।
সোবহান সাহেব বললেন, তা কী করে হয়, হিমু তুই টাকাটা দিয়ে দে, কেমন? হিমু কিছুই জানতো না, সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় তবে বলে,আচ্ছা মামা!
সোবহান সাহেব জরীর মায়ের খোঁজে রান্নাঘরে যান।
হিমু আর শুভ্র এক সাথে বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে যায়।
এতটুকু পড়ে প্রকাশক একটি সিগারেট ধরিয়ে আমার দিকেও একটি এগিয়ে দিলেন।আমি সিগারেট খাই না সাধারণত, বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়লে দু’এক টান দেই!
প্রকাশকের কাছ থেকে সিগারেট নিতে গিয়ে নিজেকে সম্মানিত মনে হলো। প্রকাশক কয়েকটান দিয়ে চোখ কুঁচকে বললেন, আপনার নামটা যেন কী? অামি অবাক হয়ে নামটা বললাম।প্রকাশক কী ভাবলেন! তারপর গভীর জ্ঞানের কথা বলছেন এমন ভাবে বললেন,আপনার লেখার হাত ভালো, হুমায়ূন আহমেদ থাকতে তাঁর বই বের করতে পারিনি, সে দুঃখ এখনো ফেরি করে বেড়াই! আপনাকে দিয়ে হবে। এমন গল্প বিশ-ত্রিশটা লিখে ফেলেন চটজলদি, আগামী বছর বইমেলার প্রথমদিনেই আপনার বই আমরা তুলছি। আর বইটার নাম কী হবে জানেন? আমাকে কিছু বলার আগেই বললেন,আমিই হুমায়ূন আহমেদ! তবে শর্ত একটাই আপনি, পাঁচ বছর কোনো প্রকাশকের সাথে কথা বলতে পারবেন না। আপনি রাজী থাকলে আমরা এখনই চুক্তি করবো। আমি কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললাম, তাই হোক!