কবন্ধ ওয়ার্ডের গল্প । অদিতি ফাল্গুনী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ এপ্রিল ২০১৯, ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ, | ১৪৫৬ বার পঠিত
১. মা’র সাথেই সুইং সেকশনে কাজ করছিল না কি ভারতী? আজ বছর খানেক হয় স্কুল যাওয়া তার বন্ধ। বাবা পড়ার খরচ আর চালাতে পারছিল না। ভারতী রাণী দাস, নবম শ্রেণী, রোল নং-২৪, সাভার গার্লস স্কুল। সালোয়ার-কামিজের উপর সূতির পুরু ওড়না ক্রস করে পরে, মাথায় দুই বেণী ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়া আর নেই। চৌবাচ্চার দুই নলের একটি হইতে পানি ঢুকিতেছে আর একটি হইতে বাহির হইতেছে’র মাথা ভোঁ ভোঁ করা পাটিগণিত নেই, স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে চকের গুঁড়ো মাখা হাতে সিঙারা খাওয়া নেই…মা’র সাথে বছর খানেক আগে স্কুল ছেড়ে এই ফ্যাক্টরিতে যেদিন সে সুইং সেকশনের চাকরিতে এলো…তারপর থেকে প্রতিদিন সকালে ফ্যাক্টরির এই সাত তলায় তাদের মা-মেয়ের একসাথে উঠে যাওয়া, ফ্যাক্টরিতে ঢুকেই হাজিরা খাতায় নাম লিখিয়ে সেই যে কলের পুতুলের মতো কাজ শুরু…মা…মা কই? সকাল নয়টায় সেই যে হঠাৎই কেমন একটা শব্দ হলো আর এত এত মানুষ…পুরুষ মানুষ আর মেয়ে মানুষ সবাই মিলে সব ক’টা ফ্লোর থেকে সিঁড়ির সামনে জড়ো হতে না হতে মাথার উপর আস্তে আস্তে নেমে এল ইট-চুন-সুড়কি-রড-কংক্রিটের আস্ত ঢালাই ছাদটাই…তারপর সে যে আর কিছুই মনে করতে পারে না…কিছুই যে মনে পড়ে না আর…কোথায় সে ঢুকে গেছিল…কোন্ ভারি ভারি ইটের দেয়াল তার কিশোরী বুকের উপর চাপা পড়েছিল… দিয়ে সে ঠেলে তুলতে চাইছিল ভারি সেই সব দেয়ালের চাঁই…মা! মা!…ক্ষীণ গলায় ভয় পাওয়া শিশুর মতো আর্তনাদে আর মা’কে না পাওয়া, আতঙ্কিত অসংখ্য নর-নারীর ক্রমাগত পিষে ফেলতে থাকা ভিড়ের ভেতর কান্নার অতীত ভয়বোধে মনে পড়ে হবিগঞ্জের মেলায় একবার নাগরদোলার সামনে হাঁ করে তাকিয়ে আইসক্রিম মালাই চুষতে চুষতে মা’কে কিছুক্ষণের জন্য হঠাৎই হারিয়ে ফেলার সেই শৈশবভীতি…তারপর ক্রমাগত অন্ধকার…সাভার বাজারের পেছনে লাগোয়া তাদের বস্তির এক রুমের বাসায় লাইট নিভে গেলে থিকথিকে গলির ৩৬৫ দিনের সূর্যহীনতার অন্ধকার…একটি অতিকায় জন্ত—র মতো ছাদের ভিম, এত এত লোহার শিক আর জ্বলে উঠতে থাকা আগুনের শিখার নিচে সে কখন চাপা পড়ে গেছিল কে জানে…তার যখন ঘুম ভাঙে তখন নিজেকে সে দেখতে পায় আধো-অন্ধকার এক সুড়ঙ্গের ভেতরে। চারপাশে পচা মাংসের গন্ধ। ভার হয়ে থাকা শরীরের উপরটা কোনক্রমে নড়িয়ে আর উঁচু করে তখনি সে খুঁজে পায় মা’কে…তার থেকে কয়েক হাত দূরে নিথর শুয়ে…সুইং সেকশনেরই রওশন খালার পাশে তার মা কুসুম রাণী দাস পড়ে আছে…বেশি না…মাত্র দু’টো লাশ ছিল তার পাশে তিন দিন… মা’র কাছে যাবার জন্য বার কয়েক চেষ্টা করেছিল আরতি…কিন্ত— যাবে কি করে? ডান পায়ের উপর একটি আস্ত দেয়ালের চাঁই…অথচ বাঁ পা, দুই হাত আর গোটা ধড়টা কিন্ত— নির্ভার। এর ভেতরেই…মা আর এক খালার লাশের গন্ধের পাশে থাকতে থাকতেই কি যে অসম্ভব ক্ষুধা লাগে তার! ক্ষুধা আর ক্ষুধা! কতগুলো দিন আর রাত! এত হাঙ্গামার ভেতর বাঁ হাতের প্লাস্টিকের বেল্টের সাথে দেড়শো টাকার ক্যাসিও ঘড়ি ত’ দিব্যি চলে দেখি। ওহ্ ক্ষুধা মা…গন্ধ…বমি পায়…বমি…সে কি মারা যাবে? তার পাশে কেউ ত’ নেই দু’টো লাশ ছাড়া…হ্যাঁ, দু’টো লাশ…এ কেমন কৃতান্ত দূর্গন্ধ? লাশ দুটো থেকে সমানে গন্ধ ছড়াচ্ছিল…আ: কেউ একবার আসো! আমাকে বাঁচাও! শুনতে কি পাচ্ছো তোমরা? পাতালপুরীর উপরের আলোর পৃথিবীর মানুষেরা… একদিন যেখানে আমরাও ছিলাম… আহ্, সীতার পাতাল বুঝি এমন ছিল…না, হাজার হোক রাণী আর কারখানার মজদুরনীর পাতাল বুঝি এক? রাণীর পাতালে স্বর্গের দেবতারা ফুল ছড়ায়……বাঁচাও…সে কি আর্তনাদে গোঁ গোঁ করে না ক্ষীণ স্বরে অচেতন গোঙায়? তিন দিন তিন রাত অপেক্ষার পর একদল মানুষের মুখ দেখতে পাওয়া যায় সুড়ঙ্গের উপর। তাদের হাতে মাইক, ‘আমরা আসছি- বোণ- আমরা আসছি! ভয় পেও না! কিন্ত— বাঁচতে হলে তোমার ডান পা যে কাটতে হবে! ডান পা? কি শুনছে সে? না- ভয় পেয়ে মাথা নাড়ে সে- একবার ভাবো মেয়ে- না হলে যে জীবনেও উঠতে পারবে না! এখানেই জীবন শেষ হয়ে যাবে!’ লোকগুলো তার দিকে প্রাণ প্যাকেটের জুস এগিয়ে দিতে দিতে, এনার্জি বিস্কুটের নীল পাতলা কাগজে মোড়া প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে লম্বা করাত আর হাতুড়িতে দেয়াল ভাঙ্গতে থাকে, তারপর আরতির ডান পায়ের উপরের কংক্রিট চাঁই সুদ্ধ করাতে তার ডান পা-ও কাটা হতে থাকে। ও মা…মাগো…চিৎকার করে না, ধৈর্য্য ধরো…সবার আগে বাঁচা…তোমার মতো মেয়েরা কেউ কেউ নিজেও করাত চেয়ে হাত পা কেটে ফেলছে জানো? না, আমি অমন বাঁচতে চাইতাম না…আমার পা কাটতাম চাই না…না, না… কাটোইন…আমি বাঁচতাম চাই…
২. গরম খাইতাম, বড় অইতাম কত কইছ মা’রে
বড় অইলে, ছুটো অইয়া কানবায় সুনারে।
গতরো তোমার কাঁপি কাঁপি উঠবো তাপ জ্বর
কেউ দিত নায় ভেল্লার কষ তোমার কপালোর উপর।
…ভলান্টিয়াররা যখন তাকে সুড়ঙ্গ থেকে স্ট্রেচারে টেনে তুলছে, ডান পা’টা চোখের সামনেই করাতে আলগা হয়ে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে… পাতলা ফ্যাঁসফেঁসে সূতা শুদ্ধ পায়জামার একটি পায়ের কাপড় কাটা পা’র সাথে দুলছে…তবু ব্যথা লাগছে না…হ্যাঁ, ভলান্টিয়াররা ইঞ্জেকশন দিয়ে নিয়েছিল বাঁ পায়ে…যাতে ডান পা করাতে কাটার যন্ত্রণা ওর সয়…রক্তে ভেসে ওঠা শরীরের লালে স্ট্রেচারের সাদা কাপড়ও লাল…মা’কে কি ফেলে যাচ্ছে সে?
কি মুস্কিল! তোমার এই বাচ্চা মেয়েরে কাজে নিলে আমাদেরই ত’ শিশু শ্রমিক রাখার জন্য কয়দিন পর সরকার,পুলিশ আর এনজিওরা ফ্যাক্টরিতে তালা ঝুলায় দিবে!’
আমার মা’র লাশটাও নিয়া যাইতাম…দাহ করতাম…ও স্যার! শেষবার সে বাতাসে আর্ত গোঙানীর মত ছুঁড়ে দ্যায়, মেলে দ্যায় তার কণ্ঠস্বর।
পাতাল থেকে বা সুড়ঙ্গ থেকে উপরে উঠবার পর অচেতন তাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বাবা তখন আরো অনেকের মত তার আর তার মায়ের ছবি হাতে দাঁড়ানো ছিল। মা’র লাশটা ভাগ্য ভাল একসাথেই আনা হয়েছিল। সাভার শ্মশানে ঐ সন্ধ্যাতেই নাকি পুড়িয়ে ফেলেছে।
—কমলা খা একটু!’
কাকাতো দিদি আর কাকাতো ভাই মাথার কাছে দু’পাশে দু’টো টুলে বসা। ওরা হবিগঞ্জ থেকে খবর পেয়ে এসেছে।
—না’—ভারতী শুধু ডানে আর বাঁয়ে মাথা নাড়ে একবার। স্যালাইন চলছে। কাকাতো দিদি দরকারে বেডপ্যান দিচ্ছে। কিন্ত— কতদিন ওরা এখানে সব কাজ ফেলে থাকবে? বাবা রিক্সা চালায়। মা চলে গেল। ঘরে আছে আর ক্লাস থ্রি-তে পরা ছোট বোণটা। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে তার কি হবে? হিন্দুর মেয়ের বিয়ে হতে নাকি খরচ বেশি। অনেক বেশি সোনা-দানা দিতে হয়। সে যে পা কাটা মেয়ে!
—ভারতী আপা!’
ডানদিকের বেডের মুন্নী না? সবাই জানতো ওর বয়স ১৩ বছর। কিন্ত— ওদের সংসারে আসলেই নাকি খুব অভাব। মাথায় লম্বা হয়েছিল মুন্নী অনেকটা। স্বাস্থ্যও বেশ ভাল। মুন্নীর মা এসে ম্যানেজারদের হাতে-পায়ে ধরেছিল।
কি মুস্কিল! তোমার এই বাচ্চা মেয়েরে কাজে নিলে আমাদেরই ত’ শিশু শ্রমিক রাখার জন্য কয়দিন পর সরকার,পুলিশ আর এনজিওরা ফ্যাক্টরিতে তালা ঝুলায় দিবে!’
অর বাপে রিক্সা চালায়। হাঁপানির টান আছে। তাই একদিন চালায় ত’ দুইদিন বাড়িত থাকে। আমি ছুটা বুয়ার কাম করি। সংসার চলে কন? আপনেরা ওর আইডি কার্ডে বয়স ষোল বছর দেখায় দেন। মেয়ে আমার মাশাল্লা খাইতে পারুক না পারুক লম্বা অইছে…স্বাস্থ্যও ভাল…অরে ষোল বছর লিখা নিলে কেউ ধরতে পারব না!’
কুচকুচে কালো, লম্বা আর স্বাস্থ্যবতী মুন্নীর মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই ওয়ার্ডে ও সবার ছোট। ওর ডান হাতটা কাঁধের কাছ থেকে কাটা। বুকের সামনে কুঁচি দেওয়া একটি সাদাটে মার্কিনী কাপড়ের ফ্রক। দূর্ঘটনার দিন ও ছিল কারখানার নয় তলায়। দুই চুলে কলা বেণী। মুন্নীর বাবা দুপুরের খাবার টিফিন কেরিয়ারে করে মেয়ের জন্য নিয়ে আসছে। ইসশ…মুন্নীর মত হাত কাটা হয়েও যদি পা বাঁচত ভারতীর! তবে বাথরুম করতে অন্তত: সে নিজেই যেতে পারত। পায়খানা-পেশাবের জন্য অন্যের উপর ভরসা করা কি যে ঘেন্নার কাজ! এই ওয়ার্ডের সাতটি মেয়ের ভেতর মুন্নীর ক্ষতিই সবচেয়ে কম। দিব্যি ও এখন ঘুরে-ফিরে বেড়াতে পারছে। বেড থেকে বাথরুম, ওয়ার্ড থেকে ব্যালকনি। এই ওয়ার্ডে মুন্নী পর সবচেয়ে কম বয়স ভারতীর। এ জন্যই মুন্নী মনে হয় ওর কাছেই বেশি আসে। ভয়ানক কালো আর ভয়ানক মিষ্টি চেহারার মুন্নী এসে ভারতীর বেডের সামনে দাঁড়ায়, জ্বর কমছে তোমার?’
মুন্নী রে…তুই এখনো ছোট…তুই কি বুঝিস আমরা কি হারালাম?
ভারতীর চোখে আবার জল আসে। কম্বলের ভেতর থেকে মাথা নাড়ে সে।
`মুন্নী— ভাত ঠান্ডা হই যায়।‘
মুন্নীর বাবা মেয়ের জন্য মেঝেতে টিফিন কেরিয়ার খুলে ডাক দেন।
যাইছুইন আব্বা!
মুন্নীর ডান হাত কাটা কাঁধের উপর আলগা হয়ে আসা কলা বেনী খুলে কিছু কোঁকড়া, কালো চুলের স্তবক এসে পড়ে।
৩. এই ওয়ার্ডে এলেই ডাক্তার কি নার্স সবার চোখই প্লাবণীর দিকে চলে যায়। কারণটি বোঝা খুব কঠিন নয়। একা তারই এতগুলো মেয়ের মাঝে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত গোছের চেহারা। টকটকে ফর্সা রং। প্লাবণী আক্তার। রংপুরের কারমাইকেল কলেজে অর্থনীতিতে সম্মান ফাইনাল পড়তে পড়তে ক্লাসমেটকে পালিয়ে বিয়ে করলে! বাবা-মা ডিভি-১ পাওয়া পাত্র ঠিক করে ফেলেছিল। চালচুলোহীন, ছাত্র বরের সাথে ঢাকায় এসে দেখলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া কি কষ্ট! বরের এক বন্ধু সাভারে গার্মেন্টসে চাকরি করে। সে-ই তোমার বরকে দিল একটি ফ্যাক্টরিতে ম্যানেজারিয়াল পজিশনে ঢুকিয়ে। খোদ সাভারেও এখন বাড়ি ভাড়া নেহাত কম নয়। তাই বরের ফ্যাক্টরির পাশাপাশি এই ফ্যাক্টরিতেই কারখানার শ্রমিকদের হাতে একটা সূঁচ ফুটলে কি টুকটাক অসুখ হলে প্রাথমিক চিকিৎসা বিভাগে তোমার চাকরি নিতে হলো। চাকরি হয়েও গেল। এই কাজে ডাক্তার বা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেবিকা হবার দরকার নেই। মাস ছয়েক টোনা-টুনী চাকরি করতে করতে সংসারের নানা জিনিষ-পত্র কিনছো, সাজিয়ে-গুছিয়ে ঘর করছো…হঠাৎই একদিন বরের বাবার খুব অসুখের খবর এলো। বরকে রাতের বাসে তুমিই জোর করে ঠেলে পাঠালে। পরদিন সকাল সাড়ে আটটার ভেতর অফিস পৌঁছে গেছো। লম্বা রেজিস্ট্রি খাতায় তুলছো নতুন আসা সব ওষুধের নাম। দশটার দিকে চা খাবে এক প্রস্থ। তখন দুটো লিটল ম্যাগাজিনে যে কবিতা দেবার কথা তোমার তা নিয়ে একটু বসবে। অফিসে আসার ব্যাগে দুটো বই তোমার। একটি বাংলা অনুবাদে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের মৎস্যকণ্যার গল্প। আহা, মানুষ রাজপুত্রের জন্য লেজ কেটে পা পেল বটে সমুদ্রতলের মাছ কুমারী; কিন্ত— সেই পা পেয়ে যদি বা সে হাঁটতে পারত, তার হাঁটা দেখতে যদিও ছিল সবচেয়ে সুন্দর…আসলে হাঁটতে গিয়ে খুব কষ্ট হতো তার।
বরের বন্ধুর স্ত্রী শেফালী ওয়ার্ডের সামনের ব্যালকনি থেকে আবার বেডের কাছে চলে এলো, তোমার বরের সাথে কথা হলো প্লাবণী! তোমার শ্বশুরের অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক বেটার। আজ রাতের বাসেই রাসেল সাভার আসছে!’
শেফালীর চোখ ছলছল করে ওঠে— কি বউ ফেলে গেছিল আর কি বউ এসে দেখবে? হায় আল্লা! কেঁদেই ফেলে শেফালী। আশ্চর্য, শেফালী তার বা তাদের দু:খে কাঁদছে। কিন্ত—, প্লাবনী কেন কাঁদতে পারছে না? ক্ষতি ত’ তার বড় কম হয় নি। বাম পা’টা গোটাটাই নেই। তবু দিনে-রাতে চোখ তার শুকনো থাকে। জ্বালা করে। অথচ এক ফোঁটা চোখের জলও পড়ে না। হরতালের দিন ছিল বলে প্রথমে ভেবেছিল অফিস যাবে না। কিন্ত— সকালেই খবর এলো মালিক অফিস যেতে বলেছেন। ক’দিন আগে নাকি কারখানার ঘরটা যে কোনদিন ভেঙে পড়তে পারে বলে একটি পরিদর্শক দল বলেও গেছিলেন। তবু কারখানায় তাদের যেতে হলো। ভলান্টিয়াররা তার প্রাণপণ মরণ আর্তনাদে তার কাছে এসেছিল ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর। তাকে টেনে তুলবার সময় ইঞ্জেকশন দিয়ে ব্যথানাশক দেবার চেষ্টা করলেও আস্ত বাম পা গোটাটা করাতে কেটে বিশাল কংক্রিটের চাঁইয়ের নিচ থেকে উদ্ধার করতে সেই ব্যথানাশক কি বা কাজে লাগে?
—তুমি কয়দিন মোরে ভালবাসিবেন? বেশিদিন না! বেশিদিন তুমি মোর পাশোত না থাকিবেন। তবে এখনি ক্যানো থাকেন? এখনি চলিয়া না যান ক্যানো?
সোহানা মেয়েটা কাঁদে, আমার যে একখানা হস্ত আর একখানা পা নাই। তবে মরদ হইয়া, চেংড়া হইয়া তুমি আমার পাশে থাকিবেন ক্যানো? তুমি কোন ভাল চেংড়িকেই, নতুন কোন কুমটাকেই (কুমারীকেই) বিবাহ করেন না ক্যানো?’
বছর সতেরোর মেয়েটার এই দূর্দশার ভেতরেও স্বামীর প্রতি সোহাগ মিশ্রিত অভিমান দেখে এত দু:খেও প্লাবণীর মুচকি হাসি পায়। গোটা ওয়ার্ডে সোহানার স্বামী ভাগ্য সেরা। ছেলেটা বউয়ের পাশ থেকে নড়ে না। স্ত্রীর মল-মূত্র সবই নির্বিকার পরিষ্কার করছে। সারাক্ষণই এটা-সেটা খেতে বউকে অনুরোধ করছে। তবু মেয়েটা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। সারাদিনই কাঁদছে। তার হাতের ডান দিকের মেয়েটা আবার সারাদিনই কি এক অজানা ক্লান্তিতে ঘুমায়। ঘুম ভাঙ্গলেই মাথার কাছে বসা শাশুড়িকে একটা শুকনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞাসা করে, —আম্মা— হাতখান ত’ গেল। কি কাজ করবাম? খাইবাম কি?
শাশুড়ি পাল্টা শ্বাস ফেলে শুধু বলে, সব আল্লাহ্ ভরসা বউ— আল্লারে ডাকো!
রাখি বেগম কে? যিনি দুই পা নিজের হাতে কেটে ধ্বংসস্তপ থেকে বার হয়েছেন? সাহসের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন?’
এক টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী ওয়ার্ডে ঢোকে।
ফর্সা, শুকনো রাখি বেগমের দুই পা কাটা গেলেও দুই হাত ত’ যায় নি। সে হাসিমুখে হাত তুলে জানায়, আমি— আমি রাখি বেগম।‘
আপনি রাখি বেগম? সারা দেশ ত’ আপনার সাহসিকতার ঘটনায় তোলপাড়! বলুন…রাণা প্লাজার ধ্বংসস্ত—প থেকে বের হবার অভিজ্ঞতা আমাদের বলুন!’ প্রতিবেদক মাইক্রোফোন এগিয়ে দেয়।
আমি রাখি বেগম। দেশ খুলনায়। ত্রিশ বচ্ছর বয়স। দুইটা বাচ্চা আছে আমার। নয় আর ছয় বয়স। এই ফ্যাক্টরিতে আমি সব মিলায় সাত/আট মাস মাত্র কাজে ঢুকিছিলাম। নতুন চাকরি। আগের ফ্যাক্টরিতে প্রায়ই বেতন বকেয়া থাকত কিনা! ঘটনার দিন সকাল আটটায় কারখানায় ঢুকি ত’ কাজ শুরু করিছি। মেশিনের পিছনি কাজ করতিছিলাম। কারেন্ট গেল চইলে। আর ছাদের ভিমটা মাথার উপর নামি আসতি লাগলো। বেষ্পতিবার সেই ভিমের নিচে চাপা থাকা অবস্থা থিকিই কিছু ভলান্টিয়ারের মাথা দেখতি পালাম। চিক্কুর পাড়ি ডাক দিলাম। তারা কয় কি, বুইন— বাঁচতি হলি দুটো পাই যে কাটতি হবি নি। তোমার স্বামী কি এরপর তোমারে ঘরে নিবে? আমি কই- না নিলি না নিবি নে। মোর বাচ্চা দু’টোরে না দেখি আমি দোজখেও যাবনানে। আমারে করাতটা দাও। দিল উপর থিকি বাড়ায়ে। দিলাম পোঁচ দুই পায়ে! ওরে ভাই রে…কবরের আজাব এ জীবনেই পাইয়ে গেলাম। রক্ত আর মানাছে না! পরে আমাকে তুইলে তিন দিন নাকি রক্তই দিয়েছে হাসপাতালে। আমি ত’ ছিলাম অচেতন!’
৪. লাইট নিভাবো প্লাবনী? তোমার একটু ঘুমানো উচিত। রাসেল ভোররাত নাগাদ পৌঁছে যাচ্ছে।’
শেফালী বলে।
সারাদিন ত’ থেকে থেকে এই জাগি এই ঘুমাই। একটু পড়ি?’
পড়বে? আচ্ছা?
আমার হাত ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা দেবে? আর কলমটা?
জানি তুমি কবি মানুষ। কবিতা লেখো। তাই বলে এই শরীরে লেখালিখি?’
দাও না।’
কবন্ধ ওয়ার্ডের কবিতা: জলে ভাসা, মেঘে ওড়া ১ম মেয়ে: কাঁধে নেই হাত,
ডান হাত কাটা…
ব্যান্ডেজ ভরা ঘা
ওড়ে মাছি আর
ঘোরে পিঁপড়ে
মশা ভনভন
ঘুম এলে চোখে
স্যালাইন সুই
শিরা গেঁথে রয়…
ব্যথায় নড়ি না,
ব্যান্ডেজ খোল
কাটা কাঁধে আয়,
আয় মেঘদল! জুড়ে দে ডানা…
উড়ে যাই পরী,
মেঘ হয়ে আর
মেঘের দেশেতেই
ছেড়ে দিয়ে মাটি
ছেড়ে এ ভূমিতল!
২য় মেয়ে: উরু থেকে এই হাঁটুর নিচটা
পুরোটাই কাটা…
অবশ কোমর,
কড়া ব্যান্ডেজ
নড়া যাচ্ছে না…
মনে পড়ছে
গ্রামের নদীতে
বর্ষার জলে অতল কতটা
সাঁতার কেটেছি শ্রাবণ দুপুরে
পূর্ণিমা রাতে স্নান করেছি—
মাছেদের সাথে,
আয় আয় মাছ!
পুচ্ছটি দে দুখী বোণকে
ডুব দেব আর অতল জলেতে
ছেড়ে এ পৃথিবী
মানুষের ঘর…
হয়ে যাব আমি
মাছেদের মেয়ে!
৩য় ও ৪র্থ মেয়ে, সেই সাথে সবাই সমস্বরে (কোরাসে):
কাটা হাত আর শুণ্য কাঁধেতে,
জুড়ে দাও ডানা মেঘবালিকারা…
কাটা পা আর শুণ্য কোমরে-
পুচ্ছ জুড়ে দাও সাগরদেবতা
পাতালে ভাসি আর
আকাশে উড়ি
ছেড়ে এ পৃথিবী
মানুষের ঘর!
(উৎসর্গ: সাভারের রাণা প্লাজার ধ্বংসস্ত—পে হাত-পা হারানো, সাত পোশাক শ্রমিক বোণকে যাদের সাথে প্রত্যক্ষ কথা বলার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এই গল্পে ব্যবহৃত সিলেটি ভাষায় লেখা কবিতাটি কবি শামীম আজাদের ফেসবুক নোট থেকে নেওয়া হয়েছে। সেজন্য কবিকে জানাই বিশেষ কৃতজ্ঞতা)।