জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে কয়েক কথা । আফরোজা সোমা
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মার্চ ২০১৯, ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ, | ৩৫৫১ বার পঠিত
সাহিত্যের সাথে যাদের যোগাযোগ আছে তারা হয়তো শহীদুল জহিরকে জানেন। যারা শহীদুল জহিরকে জানেন তারা শহীদুলের লেখনী নিয়ে জানেন।
‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’-এর অক্ষরগুলোর উপরে আমি যে কতবার আঙুল বুলিয়েছি!
শহীদুলের অন্যান্য রচনাগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’। সামান্য একটা স্যান্ডেলের ফিতা পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে যে ফট করে ছিঁড়ে যায় আর তার সাথে যে একটি জাতির সবচেয়ে উত্তাল দিনের বিজয়ের ইতিহাস এবং তৎপরর্তী গভীর পরাজয়ের কাহিনীকে বেঁধে দেয়া যায়, তা যারা ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানবেন।
পুরাণ ঢাকার লক্ষী বাজার মহল্লার মানুষের জীবনের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ এবং তৎপরবতী সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ভূমিকাকে এই উপন্যাসে তুলে আনা হয়েছে দারুণ নৈপুণ্যে।
শহীদুল বাজারে হরে-দরে মেলে না। তাঁর সাথে আপনার নতুন অভিজ্ঞতা হবে। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় কঠিণ সত্য কাহিনীকে স্যান্ডেলের ফিতা ফট করে ছিঁড়ে যাবার মতন ঘটনার মাধ্যমে এমন সহজ বয়ানে বলে দিয়েছেন যে, সেই সত্যের ঘাত হজম করাটা কঠিণ বৈকি!
এই দারুণ উপন্যাসটিকে দারুণ মাদকতাময় উপস্থাপনায় মঞ্চে এনেছেন জাত-শিল্পী সৈয়দ জামিল আহমেদ।
সমালোচনায় কান দেবেন না। আমি গতকাল প্রিমিয়ার শো দেখেছি। আপনিও দেখুন। ৩শ, ৫শ ও ১ হাজার টাকা দামের টিকিট। সম্ভব হলে ৩শ টাকার টিকিট না কেনাই ভালো। তাহলে কাছ থেকে দেখতে ও শুনতে পাবেন।
শিল্পকলায় মঞ্চটাকে সচরাচর যেমন ক্ষদ্রকায় করে উপস্থাপন করা হয়, এ্ই নাটকে তা নেই। স্পেসকে ঢেলে সাজানোয় মঞ্চটা এখানে অনেক বৃহদাকার একটা স্পেসের অনুভূতি দেবে। মাঝ-বুড়িগঙ্গায় থাকা দুইজন ব্যক্তি তীরে দাঁড়ানো ব্যক্তির দিকে ডায়ালগ ছুঁড়ে দিলে বাস্তবে আপনি যেভাবে কথাটা শুনতে পাবেন, সেভাবেই ফিলটাও আনার চেষ্টা হয়েছে।
তবে, দুই একটা জায়গায় ডায়লগের দুই-একটা শব্দ আবহ সঙ্গীতের ভেতর ডুবে যাচ্ছিলো। এই যা ক্রটি। এগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। মাত্র প্রথম শো। দ্বিতীয় শো’তেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি তো আর নাটকটির পূর্ণাঙ্গ আলোচনা লিখতে বসিনি। তাই, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে আবহ-সঙ্গীত, অভিনয়, আলোকসজ্জা, স্পেসের ব্যাবহার, ডায়লগ থ্রোয়িং ইত্যাকার সকল কিছু নিয়ে বলছি না।
কিন্তু আপনি যদি নাট্যপ্রেমী হন, আপনি যদি ‘৭১ এর ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী হন, আপনি যদি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির উত্থানে ব্যাথিত মানুষ হন তাহলে আপনাকে নাটকটি দেখতে অনুরোধ করি।
যদি সম্ভব হয় উপন্যাসটা পড়ুন। তবে, বলে রাখি, বাংলাদেশের সাহিত্যের গতানুগতিক যে পাঠ অভিজ্ঞতা আপনার রয়েছে, শহীদুল সেগুলো থেকে একটু আলাদা। আর আপনি যদি সাহিত্য-পাঠের আঙিনায় অতি অনভ্যস্ত পাঠক হয়ে থাকেন তাহলে ‘অনভ্যাসের ফোঁটা যেমন চড়চড় করে’ তেমনি, শহীদুলের সাথে অপরিচয়ের কারণে তাঁর লেখাকেও আপনার হয়তো খানিক বিরক্তিকর ঠেকতে পারে। মনে হতে পারে, ‘লোকটা খালি একই কথা বারবার বলে’!
শহীদুলের অস্বস্তি উৎপাদনের দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগত।
ওহ, আরেকটা কথা! জামিল আহমেদের সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো চিন-পরিচয় নেই। আমাদের দেশে একটা চল আছে এরকম যে, কারো কোনো কর্ম নিয়ে ভালো কথা বলা মানেই, হয় সেই ব্যক্তির সাথে মাখামাখি সম্পর্ক থাকতে হবে, নয় তার দালাল হতে হবে। এর আগে ফারুকির ‘ডুব’ নিয়ে লিখে লোকের যা ছে-ছে সয়েছি! ভাগ্যিস! আমার ও ফারুকির কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। থাকলে আর গালি একটাও ফেরানোর উপায় ছিল না। যাই হোক, আমি এখনো মনে করি, বাংলাদেশের অধুনা সিনেমায় ‘ডুব’ একটা দারুণ অভিজ্ঞতা।
শহীদুল বাজারে হরে-দরে মেলে না। তাঁর সাথে আপনার নতুন অভিজ্ঞতা হবে। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় কঠিণ সত্য কাহিনীকে স্যান্ডেলের ফিতা ফট করে ছিঁড়ে যাবার মতন ঘটনার মাধ্যমে এমন সহজ বয়ানে বলে দিয়েছেন যে, সেই সত্যের ঘাত হজম করাটা কঠিণ বৈকি!
শহীদুলকে একেবারে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে কাব্যিক ব্যাঞ্জনায় মঞ্চে এনেছেন জামিল আহমেদ। জামিল আহমেদের ‘রিজওয়ান’ দেখে যারা আহা-উঁহু করেছেন, তারা এবার খোলা মন নিয়ে যান। পরের দেশের দুই ভাই-বোনের বেদনা গাঁথা দেখে আপনাদের চোখের পানিতে যদি কপোল ভিজে থাকে, তাহলে এবার নিজের দেশে ৭১-এ ঘটে যাওয়া দুই ভাই-বোনের শোকগাঁথাকে প্রত্যক্ষ করে আসুন। দেখুন, এক ভাইয়ের বিদীর্ণ হৃদয় ও খামচে ধরা এক পতাকার গাঁথা দেখে আপনার কপোল বেয়ে নামে কিনা দু’ফোঁটা জল।
ছবি গুলো নিয়েছি স্পর্ধা ফেবু পেইজের লিঙ্ক থেকে : https://www.facebook.com/spardhabd/posts/2237191026320337?__tn__=C-R