পাণ্ডুলিপি থেকে । সহুল আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:০২ পূর্বাহ্ণ, | ১৪৭১ বার পঠিত
১৯৭১ সালে এই ভূখণ্ডের মানুষ যে ঝাঁপিয়ে পড়লো, রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিল, তা কোনো আকস্মিক ঘটনা না। কোনো জাতীয়তাবাদী অবস্থান না নিয়েও বলা যায়, এই ভূখণ্ডের মানুষ এতটাই উদ্যমী যে, মাত্র পঁচিশ বছরের মাথায় তারা দুই দুইটা রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটিয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যাবতীয় তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানের মতো একটা অকল্পনীয় ও অবাস্তব রাষ্ট্র পর্যন্ত স্থাপন করে ফেলেছিল। বাহ্যিক দিক থেকে দেখতে অস্থিরচিত্তের এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা আসলে কী চেয়েছিল? তাদের এমন রাজনৈতিক চেতনার উৎসই বা কী? এসবকে বিবেচনায় না নিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সন্ধান পাওয়া অসম্ভব।
রাজনৈতিক চেতনার ইতিহাস কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে কিংবা তাদের জন্ম-ইতিহাস থেকে খুঁজতে গেলে মুশকিলে পড়ার সম্ভাবনা আছে, এই অঞ্চলের মানুষের চাওয়া-পাওয়াটা ধরা আরও মুশকিল হবে। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ মধ্যকার দ্বি-দলীয় যুদ্ধের অনেক আগ থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের অধিকার চেতনা জন্মলাভ করেছে, কিংবা বলা যায় আমরা এর সন্ধান পাই। এই ভূখণ্ডের মানুষ প্রধানত কৃষক, মূলত নিম্নবর্গীয়। জীবনযাপনের কেন্দ্রে আছে ভূমি। যখনই এই ভূমিতে আঘাত এসেছে তারা প্রতিবাদ করেছে। বেশি দূরে যেতে হবে না, ব্রিটিশ আমলের প্রথম একশ বছরের মধ্যে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহের দিকে নজর নিলেই এই ভূখণ্ডের মানুষদের চেতনার জায়গাটা পরিষ্কার ধরা দিবে। প্রথম একশ বছরে, প্রায় পঁচিশটা কৃষক বিদ্রোহের সন্ধান পাওয়া যায়। তার মানে, এই ভূখণ্ডের মানুষরা গড়ে প্রতি চার বছর পর পর ব্রিটিশের বির”দ্ধে একেকটা বিদ্রোহ করেছে। ব্রিটিশ শাসনামলের শুর” থেকেই যে লুণ্ঠন ও শোষণ শুর” হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় এখানে দেখা দিয়েছিল একের পর এক দুর্ভিক্ষ। ১৭৭০ সালে ঘটে যায় ভয়াবহ ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ যেখানে বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারায়। অথচ, ১৭৬৮ সনে আদায়কৃত রাজস্বের চেয়ে ১৭৭১ সনের আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ৫,২২,০০০ র”পি বেশি ছিল। এই তথ্যই লুণ্ঠন ও শোষণের চিত্র তুলে ধরে। পুরাতন কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে নতুন কৃষি ব্যবস্থার উদ্ভব একদিকে যেমন নতুন করে নব্য জমিদার শ্রেণি তৈরি করেছিল, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দিয়েছিল, তেমনি কৃষককে করেছিল সর্বস্বান্ত। তারই ফলে কৃষকরা একের পর বিদ্রোহ করে গিয়েছে। আমাদের তাবৎ বুদ্ধিজীবী শ্রেণি যেখানে ব্রিটিশদের গুণকীর্তনে দিনযাপন করছিলেন, তাদের ঠিক পাশেই কৃষকেরা বিদ্রোহ করছিল, সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল। এই বিদ্রোহ জমিদার, জোতদার, মহাজনদের বির”দ্ধে পরিচালিত হলেও এর অভিমুখ যে উপনিবেশ-বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিল, তা নিয়ে প্রায় প্রত্যেক গবেষকই একমত। ফরাইজি আন্দোলন ধর্মীয় আবরণে শুর” হলেও সেটাও যে শতভাগ রাজনৈতিক ও ব্রিটিশবিরোধী রূপ ধারণ করেছিল, সেটাও সবাই মেনে নেন। কোনো সন্দেহ নেই এই কৃষকেরাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মূলস্রোত গঠন করেছিল।
গবেষক আবদুল বাছির ১৭৫৭ সাল হতে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত সংঘটিত প্রধান প্রধান কৃষক-বিদ্রোহগুলোর ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য এবং তৎকালীন মধ্যবিত্ত-শ্রেণির প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। পুরো মধ্যবিত্ত, এমনকি সেই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত আমাদের প্রধান প্রধান বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ানো দূরে থাক, উল্টো কৃষকদের ‘মূর্খ অশিক্ষিত’ বলার পাশাপাশি ব্রিটিশ শাসকদের গুণকীর্তনেই তারা ব্যস্ত ছিলেন। বরাবরই উপনিবেশ প্রশ্নে আমাদের কৃষকশ্রেণি ও মধ্যবিত্ত-শ্রেণি মুখোমুখি অবস্থানে ছিলেন। মধ্যবিত্তরা ব্রিটিশদের সহযোগী হিসেবেই ছিলেন। যখন তারা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়ালেনও, তখনও একান্ত নিজেদের শ্রেণি স্বার্থে, কৃষকেরা তখনও উপেক্ষিত থেকে যায়। ব্রিটিশ আমলের একেবারে শেষ মুহূর্তের তেভাগা আন্দোলন কিংবা নানকার আন্দোলন থেকে একই বিষয় ফুটে ওঠে। তখনও কৃষকদের দাবি উপেক্ষিত হয়েছিল। সেটা আরেক আলোচনা, আরেকদিনের আলোচনা।
আবদুল বাছির কৃষক বিদ্রোহের যেসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন তার মধ্য উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কৃষকদের আপসহীনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং জাতীয়তাবোধের উন্মেষ। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ হয় কিংবা ১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের নমুনা থেকে তিনি রায় দেন যে কতিপয় কৃষক-বিদ্রোহে স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। তাদের বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। কখনো কখনো ধর্মীয় আবরণের সাহায্য নিলেও মূল থেকে কক্ষচ্যুত হয়নি, ধর্ম ভেদ ও বর্ণ ভেদ তাদের সংগ্রামে কখনো বড়ো কোনো ইস্যূ হয়নি। এই ভূখণ্ডের আমরা যাদের আদিবাসী বলে চিহ্নিত করে থাকি তারাও ঔপনিবেশিক শাসনের বির”দ্ধে প্রতিরোধ করে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র-গঠন যুগ যুগ ধরে ভোগ করা তাদের প্রাকৃতিক স্বাধীনতাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। স্বাধিকারের প্রশ্নে আদিবাসীরা ছিল আপসহীন, অনমনীয়। চোয়াড় বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ এই স্বাধিকারের প্রশ্ন আমাদের সামনে নিয়ে আসে। কৃষক-বিদ্রোহের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ নিয়ে খানিক মত-দ্বিমত থাকলেও আবদুল বাছির বলেন—‘এখনকার কৃষক বিদ্রোহগুলোতে যা ছিল তা সবই রাজনৈতিক’। সেই সঙ্গে আবদুল বাছির এই মতও দেন যে, বাংলার কৃষক বিদ্রোহই ছিল আমাদের জাতীয়তাবোধে উন্মেষের প্রাথমিক উপকরণ। বাংলার ইতিহাসের গতিপথ নির্মাণে এই বিদ্রোহগুলোর অবদান অপরিসীম।
২
বাংলার জনমানসের এই চেতনার শেকড় বেশ গভীরে। পিটার কাস্টার্সও মন্তব্য করেছিলেন, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলাতেই গ্রামীণ কৃষিজীবীদের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী প্রতিরোধ ছিল সবচেয়ে তীব্র। অন্য কোনো অঞ্চলের কৃষক সম্প্রদায় এত ঘন ঘন সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটায়নি। এভাবে দেখলে বাংলার জনমানসে রাজনৈতিক সচেতনতার গভীরতাকে আকস্মিক বলে মনে হবে না। এই ভূখণ্ডের মানুষ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্বাধীনতার প্রত্যাশায় যখন পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে, পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি করার তোড়জোড় করছে তখন তাদের চাওয়া পাওয়া আর পাকিস্তানের বাকি অংশের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক ছিল। বাংলার নেতারা যখন পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন, তখন সমান্তরালে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নও দেখাচ্ছিলেন। মধ্যবিত্তও তখন ‘হিন্দু-মুসলমান’ বর্গে বিভক্ত হয়ে চাকরি-বাকরি থেকে শুর” করে সবকিছু নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। নিম্নশ্রেণিও তখন পাকিস্তানের মধ্যে তাদের মুক্তি খুঁজছিল। কামর”দ্দিন আহমদ দুঃখ করে বলছিলেন যে, সাধারণ লোকের সামাজিক ন্যায় বিচারের দাবি অর্থনৈতিক বলে বিবেচিত না হয়ে সাম্প্রদায়িকতা প্রসূত বলে বিবেচিত হয়েছিল।
কিন্তু আমরা জাতীয়তাবাদীরা তো জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে চাই, মানে এক জাতির রাষ্ট্র গঠন করতে চাই এবং এই চাওয়াটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে প্রচার করে থাকি। আমাদের রাষ্ট্র যখন বলে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই বাঙালি এবং ঘোষণা করি এখানে কোনো আদিবাসী নাই, তখন এই রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝা যায়। রাষ্ট্রের এই জাতীয়তাবাদী চরিত্র ধারণ করার জন্য এমন ইতিহাস বিবর্জিত আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন! সেই সঙ্গে আমাদের এই একজাতিরাষ্ট্র কেন্দ্রিক যে আলোচনা সেটা আমাদের জ্ঞানকাণ্ডে ঔপনিবেশিক বিষবাষ্পের উপস্থিতিরও প্রমাণ দেয়।
নতুন যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো সেখানে প্রত্যাশা কেমন ছিল, এবং কীভাবে প্রত্যাশা ভাঙল তার বিবরণ পাওয়া যায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। শেখ মুজিব যেমন পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে পাকিস্তান আনতেই হবে, আবার পাকিস্তান কায়েমের পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যে ধারাবাহিক সংগ্রাম, তাতে সেই তিনি শুধু সক্রিয় সদস্যই নয় বরং, নেতৃত্বও দিয়েছেন। মানে তাঁদের আন্দোলন জারি ছিল। তাই তাঁর অভিজ্ঞতা আমাদের জন্যে গুর”ত্বপূর্ণ। তাঁর বয়ানে যেমন আন্দোলনকারীদের স্বপ্নের কথা পাওয়া যায়, তেমনি স্বপ্নভঙ্গের কথাও পাওয়া যায়। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করছেন যে, সম্প্রদায়গতভাবে চাকরি-সুযোগ-সুবিধা এসব ক্ষেত্রে বঞ্চনার অনুভূতিটাই তাদেরকে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত করতে সাহায্য করেছিল। বিশেষ করে ‘চাকুরির ব্যাপারে প্রতিযোগিতা হিন্দু-মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে বিদ্বেষের ভাবই মুসলিম লীগ আন্দোলনকে জোরদার করে তুলে’। আন্দোলনের অংশ হিসেবে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন, এবং তাঁরা মুসলিম লীগকে যে রূপে দেখতে চেয়েছিলেন তা শেখ মুজিবের মন্তব্য থেকে ধারণা পাওয়া যায়—
‘এই সমস্ত খান বাহাদুরদের দ্বারা পাকিস্তান আসবে, দেশ স্বাধীন হবে, ইংরেজ তাড়ানোও যাবে, বিশ্বাস করতে কেন যেন কষ্ট হত! মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সঙ্গে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণির লোকেরা।…শহিদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় না করতে পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে টেনে আনতে না পারতেন, তাহলে কোনোদিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না। যদিও এই সমস্ত নেতাদের আমরা একটু বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সম্পূণর্রূপে পরাজিত করতে পারি নাই। যার ফলে পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল।’
তারা মুসলিম লীগকে যেমন দেখতে চেয়েছিলেন সেটা যে খান বাহাদুরদের মুসলিম লীগ থেকে আলাদা চরিত্রের হবে তা পরিষ্কার। তাঁরা চাইতেন যে মুসলিম লীগ কৃষকদের সঙ্গে থাকুক, জোতদার জমিদারদের কথা না বলে কৃষকদের কথা বলুক, মানুষের কথা বলুক। বাংলার মুসলিম লীগের নেতৃত্বের সঙ্গে অন্যান্য অংশের মুসলিম লীগের নেতাদের উদ্দেশ্য যে ভিন্ন সেটা কামর”দ্দিন আহমদও তাঁর বইতে দেখিয়েছেন। ঠিক তেমনি এই আন্দোলনকারীরা যে পাকিস্তান চেয়েছিলেন সেটাও খান বাহাদুরদের পাকিস্তানের চেয়ে অনেক দূরে। সেই স্বপ্ন যখন ভঙ্গ হচ্ছে তখন তাঁর মন্তব্যেও সেই আশা-হতাশার সুর।
‘১৯৪৭ সালে যে মুসলিম লীগকে লোকে পাগলের মতো সমর্থন করেছিল, সেই মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয়বরণ করতে হল কি জন্য? কোটারি, কুশাসন, জুলুম, অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করার ফলে। ইংরেজ আমলের সেই বাঁধাধরা নিয়মে দেশ শাসন চলল। স্বাধীন দেশ, জনগণ নতুন কিছু আশা করেছিল, ইংরেজ চলে গেলে তাদের অনেক উন্নতি হবে এবং শোষণ থাকবে না। আজ দেখছে ঠিক তার উল্টা।’
অন্যত্র বলছেন—
‘যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন করা দরকার।…পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়া শুর” হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। রাজধানী করাচি। সব কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে।’
ঠিক একই ধরনের মন্তব্য খেয়াল করেন—
‘কিন্তু যখন দেখলাম, শিল্প কারখানা যা কিছু হতে চলেছে সবই পশ্চিম পাকিস্তানেই গড়ে উঠতে শুর” করেছে, আর কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া পূর্ব বাংলার আর কেউ কোথায়ও নাই, বিশেষ করে বড়ো বড়ো সরকারি চাকরিতে পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা শুর” হয়ে গেছে।’
নিচের মন্তব্যে স্বপ্নের পাকিস্তান ও স্বপ্ন ভঙ্গের ছবি সবচেয়ে ভালোভাবে পাওয়া যায়—
‘পাকিস্তান হবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী বা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান আন্দোলনের যারা বির”দ্ধাচরণ করেছিল, এখন পাকিস্তান পাকিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্র করার ধুয়া তুলে রাজনীতিকে তারাই বিষাক্ত করে তুলেছে। মুসলিম লীগ নেতারাও কোনো রকম, অর্থনৈতিক ও সমাজনৈতিক প্রোগ্রাম না দিয়ে একসঙ্গে যে স্লোগান দিয়ে ব্যস্ত রইল, তা হলো ‘ইসলাম’। পাকিস্তানের শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষ যে আশা ভরসা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন, তথা পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোনো নজর দেওয়ারই তারা দরকার মনে করলো না।’
অর্থাৎ, এই ভূখণ্ডের মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন একটা স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে। তারা স্বাধীন হতে চেয়েছিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন। ইংরেজ আমলের বৈশিষ্ট্যগুলোর মৃত্যু চেয়েছিলেন। কিন্তু এইসব কিছু থেকে তারা যখন বঞ্চিত হচ্ছিলেন তখন সেই বঞ্চনা-বোধ তাদেরকে ক্রমাগত আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। পূর্ব বাংলায় তখন একের পর এক আন্দোলন চলছিল। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেন যে, এর মূল অনুপ্রেরণা এসেছিল জাতিগত নিপীড়নের কারণে উদ্ভূত বিক্ষোভ থেকেই এবং ভাষা প্রশ্নে না হলেও পাকিস্তানি শাসক চক্রের আঞ্চলিক নিপীড়নে বির”দ্ধে এই বিদ্রোহ ছিল অনিবার্য। পাকিস্তানের ওই অংশের তুলনায় এই অংশে এত এত আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে শেখ মুজিব দুই পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক মানসের প্রভেদের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলছেন—
‘পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করার জন্য জমিদার, জায়গিরদার ও বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীরা। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত না থাকার জন্যে জনগণ রাজনীতি সম্বন্ধে বা দেশ সম্বন্ধে কোনো চিন্তাও করেন না। জমিদার বা জায়গিরদার অথবা তাদের পীর সাহেবরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করে। বহুকাল থেকে বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলন হওয়াতে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের চেয়ে অনেকটা বেশি।’
পিটার কাস্টার্সের মতো শেখ মুজিবও এখানে মেনে নিচ্ছেন এই চেতনা ব্রিটিশবিরোধী কৃষকবিদ্রোহ হতেই জন্মলাভ করেছে। এই ভূখণ্ডের মানুষের এই আন্দোলন তাই থেমে থাকেনি। তারা যে জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটাকে আমরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বলে চিহ্নিত করলেও এর ভিত্তি যে অর্থনৈতিক বঞ্চনা- বোধ সে বিষয়ে প্রায় সবাই একমত হোন। এর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ রেহমান সোবহানের বিখ্যাত বই ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য’। আবার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বললে শুধু মধ্যবিত্তের লড়াই বলে প্রতিভাত হয়, কিন্তু স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা এসব প্রশ্নে যখনই এই ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষ সুযোগ পেয়েছে তখন সেটা জানান দিয়েছে, ভোটের মাধ্যমে হোক আর লড়াই করে হোক। পাকিস্তান আমলে যে কয়টা গণআন্দোলন হয়েছে তাতে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের শ্রেণি অবস্থান নিলে সেই চিত্র আরও পরিষ্কার হওয়ার কথা। যে স্বপ্ন নিয়ে এই জনগোষ্ঠী পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল সেই একই স্বপ্নের কারণে এই জনগোষ্ঠীই বাংলাদেশ আন্দোলন শুর” করে। যে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং যে উপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির অভিপ্রায়ে এই ভূখণ্ডের মানুষ পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল, সেই একই অভিপ্রায়ে পাকিস্তানের বির”দ্ধেও নেমেছিল। একটা স্বপ্ন দেখেছিল পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে, যখন দেখলো পাকিস্তান সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না, তখন তারা আবার আন্দোলনে নামলো।
ওপর থেকে দেখলে যে ছবি পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে, পাকিস্তান আন্দোলন ও স্বাধীন বাংলার আন্দোলন বিপরীতমুখী। পাকিস্তান আন্দোলন ‘হিন্দু-মুসলমান’ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ কেন্দ্রিক আন্দোলন এবং বাংলাদেশ আন্দোলন ধর্ম নিরপেক্ষ আন্দোলন। মূলধারার বয়ানে আমরা বলে থাকি যে, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ থেকে বের হয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদে প্রবেশ করে। এই বয়ান সত্য এবং এও সত্য যে, এই দুই আন্দোলনের চরিত্রে ভিন্নতাও প্রচুর। তবে, ওপর হতে দেখলে যেমন ভিন্নতা চোখে পড়ে তেমনি তল হতে দেখলে একটা মৌলিক মিলও চোখে পড়বে। তখন এমনও মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, এই ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষদের জন্যে এই দুই আন্দোলন একমুখীও বটে। ওই অর্থে একমুখী যে, বাংলার সাধারণ জনগণ যে কারণে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল সেই একই কারণে বাংলাদেশ আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করে। মানুষ মুক্তি চেয়েছে, ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি, শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি। মানুষ চেয়েছে, তাই গড়েছে; পায়নি, তাই ভেঙেছে; পাওয়ার স্বপ্নে আবার গড়েছে। শেখ মুজিব, একজন পাকিস্তান আন্দোলনকারী যিনি কি না পরবর্তীতে বাংলাদেশ আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁর বয়ান ও অবস্থান থেকে এই বিষয়টা স্পষ্ট বোঝা যায়।
৩
তার মানে সময়ের প্রয়োজনে এই ভূখণ্ডের মানুষ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, সময়ের প্রয়োজনে পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল, আবার সময়ের প্রয়োজনেই বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। এই সবকিছু যে একই সূত্রে গাঁথা ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকে তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। যে স্বাধিকার বা জাতীয়তাবোধ ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল তার এক বড়ো রূপান্তর হচ্ছে একাত্তর। ১৯৭১ সালে যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলো তাঁর চেতনা তাহলে কী হবে? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী হবে? যদি আমরা ইতিহাস ও সময় বিচ্ছিন্ন আলোচনা করি তখন এই প্রশ্নের উত্তর একরকম হবে, আর যদি ইতিহাস ও সময়কে বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা করি তখন উত্তর অন্যরকম হবে। কোন সময়ে কী প্রয়োজনে এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী এত এত বিদ্রোহ ও আন্দোলনে যোগ দিচ্ছিল, সেটাকে মাথায় রেখে বিবেচনা করলে চেতনার সন্ধান পাওয়া সহজ হবে, আর না হলে পুরো আলোচনা হবে পার্টিকেন্দ্রিক, ইতিহাসচেতনা বিবর্জিত।
বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রে কী ধরনের আলাপ-আলোচনা বিদ্যমান সেটা একটু বিবেচনায় নিলে আমরা বুঝতে পারব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমরা কদ্দুর ধরতে পেরেছি। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের আলাপ-আলোচনা শুর” হয় বায়ান্ন থেকে, বড়োজোর সাতচল্লিশ থেকে। এর ফলে এই ভূখণ্ডের মানুষের রাজনৈতিক চেতনাকে ধরাটা মুশকিলের কাজ হয়ে যায় এবং পুরো একটা জনগোষ্ঠীর জেগে ওঠাকে একটা নির্দিষ্ট পার্টির যুদ্ধ বলেই প্রতিভাত হয়। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা উচিত, আমরা যে জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে চাচ্ছি সেটার সঙ্গে এই ‘ইতিহাসচেতনা বিবর্জিত’ হওয়ার সম্পর্ক আছে। ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনে শুধু এই ভূখণ্ডের বাঙালিরাই অংশগ্রহণ করে নাই, বরং আমরা যাদের আদিবাসী বলি তাদেরও সমান অংশগ্রহণ আছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, বাংলাদেশ আন্দোলন সব জায়গায় এই ভূখণ্ডের সবারই অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু আমরা জাতীয়তাবাদীরা তো জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে চাই, মানে এক জাতির রাষ্ট্র গঠন করতে চাই এবং এই চাওয়াটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে প্রচার করে থাকি। আমাদের রাষ্ট্র যখন বলে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই বাঙালি এবং ঘোষণা করি এখানে কোনো আদিবাসী নাই, তখন এই রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝা যায়। রাষ্ট্রের এই জাতীয়তাবাদী চরিত্র ধারণ করার জন্য এমন ইতিহাস বিবর্জিত আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন! সেই সঙ্গে আমাদের এই একজাতিরাষ্ট্র কেন্দ্রিক যে আলোচনা সেটা আমাদের জ্ঞানকাণ্ডে ঔপনিবেশিক বিষবাষ্পের উপস্থিতিরও প্রমাণ দেয়।
দ্বিতীয়ত, ‘সময়ের প্রয়োজন’কে উপলব্ধি করতে না পারলে ইতিহাস চর্চা যে স্মৃতিচারণ ও ব্যক্তিপূজায় নিমজ্জিত হয় সেটা আমাদের চেয়ে বেশি আর কে জানে। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে ‘অনিচ্ছুক জাতি’ তত্ত্ব; এই তত্ত্বের কথা হচ্ছে, ‘বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন’। অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর নজিরবিহীন আত্মত্যাগ ও লড়াই-সংগ্রামের প্রতি চরম অবমাননাকর এই উক্তিটি সাধারণত গবেষক মুনতাসির মামুনের নামে চালানো হয়। এই উক্তি সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আব্দুল মান্নান বলেছিলেন যে, ‘তার [মুনতাসির মামুনের] এই উক্তিটি আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়’। মানে আব্দুল মান্নান সাহেবও মেনে নিচ্ছেন যে স্বাধীনতার জন্যে এই জাতি অনিচ্ছুক ছিল! যারা ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের ¯্রষ্টা, যারা ষাটের দশকের সামরিক স্বৈরাচারের বির”দ্ধে রাজপথে বুক চিতিয়ে লড়াই সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে; যারা শেখ মুজিবকে এই জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছে, তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বানিয়েছে, সামরিক শাসকের মিথ্যা মামলায় জেলে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেছে, যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক আক্ষরিক অর্থেই ‘যার যা কিছু আছে’ তাই নিয়ে একটা দুর্ধষ সেনাবাহিনীর বির”দ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে খোদ তাদের নেতা গ্রেফতার হওয়ার পরেও, যারা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে একমাত্র জাতি হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে; সেই জনগোষ্ঠী কিনা ‘অনিচ্ছুক’! অদ্ভুত ইতিহাসচেতনা!
ঠিক একইভাবে গত বছর যখন শিক্ষার্থীরা কোটা বৈষম্যের বির”দ্ধে আন্দোলনে নামলো তখন আমাদের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তাদেরকে ‘স্বার্থপর’ বলে চিহ্নিত করলেন। চাকরিজনিত বৈষম্যের বির”দ্ধে এই আন্দোলনকে স্বার্থপর বলে চিহ্নিত করার মতো এমন ‘ভ্রম’ পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয় যে, মুক্তিযুদ্ধকে তারা স্মৃতিচারণে পরিণত করেছেন। একটা ভূখণ্ডের মানুষ কেন মুক্তির যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং তাদের চেতনার উৎসই কোথায় সেটার হদিস সম্পর্কে তাদের উদাসীনতাই এই বিভ্রমের বড়ো কারণ। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করেন, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে স্মরণ করেন, কিন্তু কেন এই ভূখণ্ডের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপ দিয়েছিল সেই প্রশ্নও করেন না, সেই আলোচনাতেও যান না। পূর্বে উল্লিখিত জাতিরাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা এবং এই ‘অনিচ্ছুক জাতি’ তত্ত্ব উৎসাহ দেয় ‘মহান’দের খোঁজখবর নিতে, বাদ পড়তে থাকে প্রান্তজনেরা। সংখ্যাগুর”র আধিপত্যে প্রথমত বাদ পড়ে সংখ্যালঘুরা, দ্বিতীয়ত, এই সংখ্যাগুর”দের প্রান্তজনেরাও ধীরে ধীরে বাদ পড়তে থাকে ইতিহাস থেকে। ‘আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা’ বলেই তাঁদেরকে আলোচনা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ‘কখনো এই বাদ দেওয়ার প্রয়াসটা প্রকট এবং রক্তক্ষয়ী; আবার কখনো তা নীরব এবং প্রায় অগোচরে ঘটে যাওয়া’।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এই রাষ্ট্র ধারণ করতে পারছে কি না তার আরেকটা খবর পাওয়া যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে। সরকারি দলের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের বয়ানও পরিবর্তন হয়ে যায়; দলীয় অবস্থানের আলোকে ইতিহাস রচনার এই প্রচেষ্টা একদিকে যেমন পুরো ‘বিষয়টা’র প্রতি অনীহার জন্ম দিচ্ছে, তেমনি পুরো দেশের মধ্যে হাজারটা বিভাজন তৈরিও করছে অনায়াসে। আবার, অন্যদিকে যে ইতিহাস আমরা প্রচার করছি, তাতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সফলভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছি। আমাদের ইতিহাস হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস। আর এই সংগ্রামের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা মানে এই জনগোষ্ঠী থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। সেই সঙ্গে এই জনগোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়া থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার খোঁজ যেহেতু সাতচল্লিশ বা বায়ান্ন থেকে শুর” হচ্ছে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন উপেক্ষিত হচ্ছে, তখন আমাদের এই রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঔপনিবেশিক বিষবাষ্প যে রয়ে গেছে সেটা আর চোখে পড়ছে না। আমাদের চোখে পড়ছে না যে ব্রিটিশরা ঘাড় থেকে নেমে গেলেও তাদের উপযোগী আইন, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা ঠিকই আমাদের মাথায় রয়ে গেছে। এই ঔপনিবেশিক বিষবাষ্পের খবর নেয়ার জন্যে বেশি দূরে যেতে হবে না, আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধানের দিকে নজর দিলেই বুঝা যাবে, এমনকি বাহাত্তরের সংবিধানের দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে।